২
এত রক্ত কেন?
এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ পেরোতেই ছত্তিশগড়ের সমতল জুড়ে তাপ প্রবাহ শুরু। বেলা দশটা বাজতেই রোদ্দূরের আঁচ যেন ফ্লেম থ্রোয়ারের মত লাগে। তার সঙ্গে দোসর হয়েছে গরম হাওয়ার হলকা, স্থানীয় ভাষায় ‘লু’। ফলে সকাল ন’টা বাজতেই মধ্যবিত্ত পরিবারের ঘরে ঘরে জানলায় টাঙানো হয় ভারি পর্দা, নিদেনপক্ষে ভাঁজ করা বেডকভার। কুলার চললে ভাল। নইলে ছাত থেকে সিলিং ফ্যান গরম হাওয়া টেনে নামায়। লেবুর সরবত, গ্লুকোন -ডি দিয়ে জলসেবা ইত্যাদি চলতেই থাকে। বাইরে বেরোলে চোখে কালা চশমা এবং মাথা ও কান ঢেকে গামছা।
কোথাও বিশ্রাম করলে তক্ষুণি ঠান্ডা জল খেতে নেই, গলা শুকোলেও নয়। আগে খানিকক্ষণ বসে জিরিয়ে নাও, বরং গরম চা খাও। ধীরে ধীরে শরীরের তাপ এবং বাইরের তাপ কাছাকাছি হবে। তখন যত ইচ্ছে ঠান্ডা জল খাও, বরফ দিয়ে গন্না রস খাও, লস্যি খাও। কে মানা করছে!
সৌরভ ও সিমরণ অফিস থেকে বেরোনর সময় মোড়ের দোকান থেকে এক এক গেলাস ঠান্ডা লস্যি মেরে দিয়েছে। এখন ওরা বিলাসপুর শহরের বাইরে হাইওয়ের উপর গড়ে ওঠা একটি নতুন হাউজিং কমপ্লেক্সে ঢুকছে। জায়গাটা শহর থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার বাইরে। তাই গাড়ির বদলে মোটর বাইক।
এই নিউ আর্যা কলোনীর মেইন গেটের সামনে খানিকটা আয়তক্ষেত্রের মত জায়গায় কিছু সমান্তরাল পাইপ সেট করে রাখা হয়েছে। ওগুলোর মাঝখানে চার ইঞ্চি করে ফাঁক। উদ্দেশ্য যেন গেট খোলা পেয়ে গরু-ছাগল না ঢোকে এবং যত্রতত্র গোবরের আলপনা দিয়ে আঙনটুকু নোংরা না করে। এর ফলে মোটরবাইক হোঁচট খেতে খেতে হিক্কা তুলল।
আচমকা গিয়ার বদলে ব্রেক কষায় সিমরনকে টাল সামলাতে হল।
এবার ও অপ্রস্তুত হয়ে খিঁচিয়ে উঠল—দেখে চালাতে পারিস না?
সৌরভ সমানতালে তেতো জবাব দিতে যাচ্ছিল, ঠিক সময়ে সামলে নিল। কারণ পিঠের উপর আচমকা উষ্ণ ছোঁয়া লাগায় ও সিমরনের অস্বস্তির কারণটা ধরতে পেরেছে। ও জানে এটা ইচ্ছাকৃত নয়, তবু সিমরনের বিরক্ত লাগাটা স্বাভাবিক।
সিকিউরিট গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ও বলল—সোনালী মিশ্র, বি-২০২।
সিকিউরিটি অফিসার ফোন লাগানোর আগে জিজ্ঞেস করে- কী নাম বলব?
জবাবে ও একটা কার্ড বাড়িয়ে দেয়।
কার্ডে চোখ বোলানোর পর সিকিউরিটি ওদের দুজনকে আপাদমস্তক জরিপ করে। তারপর সম্ভ্রমের সঙ্গে নরম গলায় বলে—আপলোগ যাইয়ে, সর! সীধা জাকে পহলা রাইট টার্ন, বি-টাওয়ার। দুসরা মঞ্জিল।
এই নিউ আর্য হাউজিং কমপ্লেক্সে অধিকাংশ টাওয়ার ছ’তলা। প্রতিটি ফ্লোরে মাঝখানে একটা কমন বারান্দা আর তার দুপাশে দুটো করে ফ্ল্যাট।
সিকিউরিটি গেট থেকে বাঁদিকের বাউন্ডারি ওয়াল ঘেষে লম্বাটে লন আর ফুলগাছের সারি। গরমের চোটে সব সীজন ফ্লাওয়ার গেছে মরে। তিনজন মালি কাজ করছে। শুকিয়ে যাওয়া অধিকাংশ গাছগাছালি খুঁড়ে একপাশে আগাছার মত জড়ো করে রাখছে। খুরপি দিয়ে জমি ওলট পালট করে মিশিয়ে দিচ্ছে শুকনো গোবরের সঙ্গে কিছু কেমিক্যাল সার। এবার গরম ও বর্ষার ফুলগাছ লাগানো হবে।
এইসব দেখতে দেখতে সৌরভ একটা অতিরিক্ত গলি এগিয়ে গেছল। বাইক দাঁড় করাতে গিয়ে দেখল একটা পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে এবং তার কাছে জনাদশেক লোকের ভীড়। ও সিমরনকে মোটর বাইকের কাছে দাঁড়াতে বলে ভীড়ের কাছে গিয়ে উঁকি মেরে পাথর হয়ে যায়।
ভীড়ের মাঝখানে স্বস্তিকা চিহ্নের মত হাত পা ছড়িয়ে উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছে একটি অল্পবয়েসির শরীর । তার পরণে কোন সিকিউরিটি এজেন্সির ইউনিফর্ম, মাথার কাছে অনেকটা জায়গা জুড়ে রক্তের ধারা পিচ ঢালা পথে ছড়িয়ে গিয়ে জমাট বেঁধেছে।
সৌরভের পেশাদার চোখ দেখে নেয় জমাট বাঁধা রক্তের কালচে রঙ, ঘটনাটা ঘটেছে অন্ততঃ দু’ঘন্টা আগে। চকখড়ি দিয়ে ওর চারপাশে গণ্ডী টেনে দেওয়া হয়েছে, স্পষ্টতঃ পুলিশ তার কাজ শুরু করে দিয়েছে। এখানকার থানার কেউ ওকে চেনে না, তাই বাঁচোয়া। চুপচাপ সরে পড়া যাবে, গা গোলাচ্ছে।
ভীড়ের মধ্যে প্রশ্ন করে জানতে পারে যে একই সিকিউরিটি এজেন্সি থেকে এই ছেলেটি এখানে কাজে লেগেছে। বেশিদিন না , মাস দুই। পাঁচ বা ছ’তলা থেকে ঝাঁপ দিয়েছে, সুইসাইড কেস। নীচের লিফটম্যানকে বলেছিল যে সি-৫০১ থেকে ওকে ডেকেছে সিস্টার্ন ঠিক করতে, ও প্লাম্বারের কাজ জানে।
সি- ৫০১! মানে ও একটা টাওয়ার এগিয়ে এসেছে? তাড়াতাড়ি মোটর বাইকের দিকে যেতে গিয়ে দেখে সিমরন পায়ে পায়ে ভীড়ের কাছে চলে এসেছে। সৌরভ চেষ্টা করে ওকে এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে। কিন্তু সিমরন এক ঝটকায় ওর হাত ছাড়িয়ে ‘ক্যা হুয়া ভাই’ বলতে বলতে উঁকি মারে।
দু’সেকেন্ড!
তারপর ও মুখে হাতচাপা দিয়ে ছিটকে চলে আসে। ওর চেহারায় ফ্যাকাশে ভাব। সৌরভ ওকে ধরে নিয়ে যায় মোটরবাইকের কাছে। বলে -ব্যস, একটা লেন পিছিয়ে যেতে হবে, হেঁটেই চল।
গিয়ার নিউট্রাল করে ও বাইকটা ঠেলে নিয়ে যায়। বি টাওয়ারের সামনে এসে লিফটম্যানকে বলে সেকন্ড ফ্লোর।
বেল টেপা মাত্র দরজা খুলে গেল। দরজা খুলছেন এক মাঝবয়েসি মহিলা, চেহারায় চাপা উত্তেজনা। এতক্ষণ লাগল? বোঝা গেল গেট থেকে সিকিউরিটি ফোন করে দিয়েছিল।
--সরি! ভুল করে সি-ব্লকে চলে গিয়েছিলাম। তারপর –মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ভদ্রমহিলা বললেন—ওই সুইসাইড করা ছেলেটার বডির চারদিকের ভীড়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন?
কথায় একটা চাপা ঝাঁঝ।
সৌরভ এড়িয়ে গিয়ে প্রশ্ন করে—মিসেস সোনালী মিশ্র?
--উঁহু, আমার মেয়ে সোনালীর এখনও বিয়ে হয়নি। আমার নাম শকুন্তলা ।
-- এই কেসটা নেবার জন্য অনুরোধ এসেছে জনৈক সোনালী মিশ্রের ফোন থেকে এবং উনি রিটেইনার ফি ২০০০ টাকাও অনলাইনে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তাই –
--জানি; ওটা আমারই পরামর্শ ছিল। আপনারা বসুন, ও তৈরি হয়ে আসছে। ততক্ষণ আমার সঙ্গে কথা বলতে পারেন। কিন্তু ডিএসপি সাব এলেন না?
--আসবেন। আজকে উনি অন্য একটা ব্যাপারে ব্যস্ত আছেন। তাই আমাদের পাঠিয়েছেন। আমরা প্রাথমিক রিপোর্ট জমা দিলে তারপর। আচ্ছা, মিস মিশ্র আসার আগে আপনি যদি সমস্যাটা কী সেটা একটু খুলে বলেন!
শকুন্তলা তিনটে কাঁচের গ্লাসে জল ভরে সামনে রাখেন। নিজে ঢক ঢক করে একটা গেলাস খালি করে সৌরভকে জিজ্ঞেস করেন—চা খাবেন তো?
রুচিসম্মত ভাবে সাজানো সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের বসার ঘর। রঙীন টিভি, কিছু বই ও খবরের কাগজ। তবে একটা দেয়াল জুড়ে বেশ কিছু ফটোগ্রাফ এবং সার্টিফিকেট—ভাল ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখা।
সৌরভ বিনীত ভাবে জানায় যে সেসব সোনালী এলে পরে হবে ‘খন। আপাততঃ কথাবার্তা শুরু হোক। শকুন্তলা বলুন –সমস্যাটা কী?
খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে শকুন্তলা দেবী বলতে শুরু করেন।
‘ আমার মেয়ে সোনালী বিলাসপুরের গভর্নমেন্ট গার্লস কলেজ থেকে ইকনমিক্স নিয়ে মাস্টার্স করছে। ফাইনাল ইয়ার। ও পড়াশুনোয় ভাল, কো-কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটিতেও বেশ নাম। ইন্টারকলেজ ডিবেটে ও এবং আর একটি মেয়ের টিম চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। বুঝতেই পারছেন ও কলেজে বেশ পপুলার। আমার স্বামী রেভিনিউ ডিপার্টএমেন্টে অফিসার। এখন মহাসমুন্দ জেলায় তহসীলদার। ফলে মাসে দু’একবার বাড়ি আসতে পারেন, তার বেশি নয়। এখানে আমরা মা-মেয়ে পাঁচ বছর ধরে রয়েছি, কোন অসুবিধে নেই’।
--মাফ করবেন, মাঝখানে বাধা দিচ্ছি। আপনি কিছু করেন কী?
শকুন্তলার চেহারা উজ্বল হয়ে ওঠে। গর্বের সঙ্গে জানিয়ে দেন যে উনি বিলাসপুর শহরের ‘টপার ওয়্যার’ এর একমাত্র ডিস্ট্রিবিউটর।
‘টপার ওয়্যার’? সৌরভের চেহারায় স্পষ্ট যে নামটা ও কখনও শোনেনি।
শকুন্তলা আরও অবাক। এর নাম শোনেনি এমন কোন প্রাণী তাহলে এই গ্রহে এখনও আছে? উনি বড় করে শ্বাস টেনে তারপর বলতে শুরু করেন --‘টপার ওয়্যার’ মেডিসিন্যালি ট্রিটেড ফাইবারের বাসন। নানান ডিজাইনে নানান সাইজে পাওয়া যায়, দাম একটু বেশি বটে, তবে বেনিফিট অনেক বেশি।
সৌরভের করুণ চেহারা দেখে সিমরন মুখ খোলে।
--হ্যাঁ অ্যান্টি। আমি জানি, আমার মা ব্যবহার করেন। এতে ভরে রাখলে কাঁচালংকা একমাস পরেও তরতাজা সবুজ থাকে। গরমকালেও দুধ বা দই টকে যায় না। জল বাসি হলেও খারাপ হয় না, ব্যাকটেরিয়া হয় না।
শকুন্তলার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। মেয়েদের বুদ্ধিগম্যি ছেলেদের থেকে যে বেশি সেটা বেশ বোঝা যাচ্ছে। এবার উনি আগের কথায় ফিরে এলেন।
সবকিছু ঠিক ঠাক চলছিল। কিন্তু কিছুদিন হল এক আপদ শুরু হয়েছে। আমার মেয়ের মোবাইলে আননোন নম্বর থেকে ধমকি ভরা মেসেজ আসছে।
সিমরনের ভুরু কুঁচকে এসেছে। এর জন্যে এত! ওই নম্বরটা ব্লক করে দিলেই হয়। এর জন্যে আমাদের বুক করা—
--ধেত্তেরি! ধমকে উঠেছেন শকুন্তলা দেবী।
-ওটুকু কি আমরা জানিনা? নতুন নতুন নম্বর থেকে থ্রেট আসতে লাগল। মেয়ে নিজের সিম বদলে ফেলল। কোন লাভ হল না। উৎপাত বেড়েই চলল। তখন আমরা--
--সাইবার পুলিশের কাছে কমপ্লেইন করে--
সিমরন দমে গেলেও থামার পাত্র নয়। কিন্তু এবার ধৈর্য্য হারালেন শকুন্তলা।
--আগে সবটা শুনে নাও বাছা। আমরা স্টেট সাইবার সেলে কমপ্লেইন করেছি এবং মহিলাদের হ্যারাসমেন্ট এর জন্য যে স্পেশাল সেল সেখানেও গেছি। ক’দিন বন্ধ ছিল, আবার যে কে সেই।
সৌরভ সিমরনের দিকে তাকায়, কোন কথা বলে না। সিমরন বুঝে যায় এবং যথারীতি নন-স্ট্রাইকারের এন্ডে দাঁড়িয়ে পড়ে।
সৌরভ এবার শকুন্তলা দেবীর চোখে চোখ রাখে—প্রায় তিরিশ সেকেন্ড। উনি কি কিছু লুকোচ্ছেন?
--আচ্ছা, এই উৎপাত, মানে থ্রেটগুলো, ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছে? প্রথম থ্রেট কবে এসেছিল? তারিখটা মনে আছে?
--মাস চারেক আগে মনে হয়। মেয়ে ঠিক করে বলতে পারবে। তবে আমরা পুলিশকে খবর দিয়েছিলাম মার্চের শেষের দিকে।
--আপনাদের কাছে কমপ্লেইনের কপি আছে? ওটা দেখতে চাই। আর সম্ভব হলে ওই থ্রেটনিং মেসেজগুলো।
শকুন্তলা একটু যেন বিভ্রান্ত, এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন। তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠতে যাচ্ছিলেন আবার ধপ করে বসে পড়ে হাঁফ ছাড়লেন। মুখে একচিলতে হাসি। সৌরভের মাথার উপর দিয়ে তাকিয়ে বলে উঠলেন—এই তো মুন্নি এসে গেছে। আপনাদের সব গুছিয়ে বলবে।
শকুন্তলার দৃষ্টি অনুসরণ করে পেছনে ফিরে তাকায় সৌরভ, ঘাড় ঘোরায় সিমরন। বেডরুমের দরজা খুলে এ ঘরে পা রেখেছে শ্যামলা একহারা গড়নের একটি মেয়ে। বয়েস মনে হয় পঁচিশ পেরোয় নি। পরনে সাদামাটা কিন্তু রুচিসম্মত সালোয়ার-কুর্তা। তেলহীন চুল শ্যাম্পু করে ফাঁপিয়ে ফুলিয়ে রাখা। কিন্তু এহ বাহ্য, ওর ব্যক্তিত্বের দীপ্তি সৌরভকে ছুঁয়ে গেল। সৌরভ কি একটু অসহজ?
--নমস্তে! আমি সোনালী মিশ্র। ‘ওয়াচ অ্যান্ড সিকিউরিটিজ’কে আমিই ফোন করেছিলাম। আপনাদের কথাবার্তা আমি পাশের ঘর থেকে শুনতে পাচ্ছিলাম। আপনার নাম বোধহয় সৌরভ বিশোয়াস, কোসলে স্যারের অ্যাসিস্ট্যান্ট। আর আপনি?
--সিমরন কৌর। আমিও ওনার অ্যাসিস্ট্যান্ট। আচ্ছা, আপনি ওর নাম জানলেন কী করে?
--আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার আগে আমি আপনাদের সম্বন্ধে একটু রিসার্চ করেছিলাম, ব্যস্।
মেয়েটির মুখে একটু হালকা হাসির ছোঁয়া। কিন্তু সিমরন হাসলো না।
--এবার কাজের কথায় আসি। মা, তুমি একটু চা বানিয়ে আনবে? আমি পাতা ভিজিয়ে দিয়েছি।
শকুন্তলা দেবী যেন নিতান্ত অনিচ্ছায় উঠে ভেতরে গেলেন।
মেয়েটি একটা চাবি দিয়ে ওর টেবিলের ড্রয়ারের ভেতর থেকে একটা ফাইল বের করে সৌরভের হাতে ধরিয়ে দিল।
--এতে আমার থানায় করা জিডিআর, সাইবার সেলের কমপ্লেইন, মহিলা সেলকে লেখা চিঠি এবং কয়েকটি মোবাইল টেক্সটের স্ক্রীনশট –সবই দেয়া আছে। সৌরভজী, আপনি একবার দেখে নিন। যা যা আপনার দরকারি মনে হবে সেগুলো নিয়ে যাবেন। এগুলো সব এক্সট্রা সেট, আরও দুটো আছে।
সোনালী মিশ্র সিমরনের উপস্থিতিকে যেন গ্রাহ্যের মধ্যেই আনছে না।
মা আসার আগে একটা কথা বলে রাখি। এই কেসটা কিন্তু সামান্য টিজিং স্টকিং গোছের সাইবার ক্রাইম নয়। তাই মায়ের আপত্তি সত্ত্বেও আমি আপনাদের সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করি। আমার মনে হয় এই কেসটা কোসলে স্যার দেখলে ভাল করতেন।
সোনালীর মুখে একটু ভয় ও আশংকার কালো ছায়া।
--আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন মিস মিশ্র। আমাদের ক্লায়েন্টের প্রত্যেকটি কেস স্যারই দেখেন। আমরা ওনার সহকারী মাত্র। এই কেসটাও প্রথম থেকেই স্যার দেখছেন। ওনার স্পেসিফিক নির্দেশে কিছু প্রাথমিক ডেটা নেওয়ার জন্য এখানে এসেছি। ফিরে গিয়ে ওনাকেই রিপোর্ট করব।
সোনালীর মুখ উজ্বল হয়ে ওঠে।
--আপনাদের কি বলে যে--!
--কিছু বলার দরকার নেই। আমরা সবাই নিষ্ঠার সঙ্গে ডিউটি করি। ক্লায়েন্টকে সন্তুষ্ট করা আমাদের ইথোস এর মধ্যে পড়ে।
সোনালী যেন প্রথমবার সিমরনের উপস্থিতির বিষয়ে সচেতন হল, একটু হাসল কিন্তু কোন কথা বলল না। ঘরের মধ্যে একটা অস্বস্তিকর নীরবতা।
সৌরভ চোখ নামিয়ে ফাইলের মধ্যে ডুবে যাওয়ার চেষ্টা করে। কমপ্লেইনে বলা হয়েছে উড়ো ধমকিগুলো আসা শুরু হয়েছে মার্চের ২০ তারিখ থেকে। মানে পুরো একমাসও হয়নি। সাইবার সেলকে কমপ্লেইন করা হয়েছে মাত্র ১০ দিন আগে। কিন্তু শকুন্তলা যে বলেছিলেন ‘মাস চারেক’!
এবার সৌরভ মন দেয় হুমকিগুলোর দিকে। আইপি নম্বরে বিশেষ ফারাক নেই। ধরে নেওয়া যেতে পারে লোকেশন বিলাসপুর শহর বা তার ১৫ কিলোমিটার রেডিয়াসের মধ্যে হবে। এগুলো ধরে ফেলা তো সাইবার সেলের পক্ষে তেমন কঠিন কিছু নয়!
এবার সৌরভ মন দেয় কন্টেন্টের দিকে। এক নজর তাকিয়েই চক্ষু চড়কগাছ! এসব কী?
স্ক্রীনশট ১ “জ্যাদা হোঁশিয়ার মত বন লড়কী। আভী ভী সুধর যা, নহী তো--”। বেশি চালাকি করিস না ছুঁড়ি ! এখনও শুধরে নেবার সময় আছে, নইলে---।
২ “বাত মান যা বেওকুফ আওরত, শোচতী কি তেরী ইউনিয়ন বঁচায়েগী তুঝে? ভুল যা!” কথা শোন বোকা মেয়ে। কী ভাবছিস, তোর ইউনিয়ন তোকে বাঁচাবে? ভুলে যা।
৩ “ তু বদমাশি সে বাজ নহী আয়েগী? ঠিক হ্যায়, বাদ মেঁ বহুত পছতায়েগী”। তুই তোর বদমাইশি করা ছাড়বি না? বেশ, পরে আফশোস করবি বলে দিলাম।
--ধমকিদেনেওয়ালা আপকে পরিচিত লগ রহা হ্যায়।
সিমরন সৌরভের ঘাড়ের উপর দিয়ে ফাইল পড়ছিল।
-না, আমি ওদের কাউকে চিনিনা। এমনকি ধমকি যে দিচ্ছে সে স্ত্রী কি পুরুষ, জোয়ান কি বুড়ো কিছুই বুঝতে পারছি না। তাই আপনাদের হেল্প চাইছি।
এবার সোনালি সিমরনের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে জবাব দেয়।
সৌরভ কিছু বলার আগে একটি ট্রেতে চার কাপ চা ও কিছু বিস্কুট সাজিয়ে ঘরে ঢুকলেন শকুন্তলা। সবাইকে হাতে হাতে কাপ ধরিয়ে নিজে একটি তুলে নিয়ে একটা চেয়ার টেনে গ্যাঁট হয়ে বসলেন।
তারপর হালকা সুরুৎ সুরুৎ চুমুক দিতে দিতে বললেন—শুনুন ছোটে জাসুস। আমার মেয়ের বন্ধু অনেক, শত্রুও কম নয়। বিলাসপুর এখনও আধা গাঁও। কোন মেয়ে একটু ভালভাবে কথা বললে ছেলেগুলো ভাবে মেয়েটা ওর প্রেমে পড়েছে। সেই থেকে ভুল বোঝাবুঝি, মন কষাকষি। এর পরে মারামারি এমনকি মার্ডার! সোনিয়া আমার খুব গুণের মেয়ে। কলেজে ডিবেট, ভাষণ সবেতেই নাম। ওর আলাদা একটা ইউনিয়ন। বেশি ভোট পায়নি,থার্ড পজিশন। কিন্তু কলেজ অথরিটি ওকে ভয় পায়। ও যে কাউকে রেয়াৎ করে চলে না। বেচাল বে-আইনি কিছু দেখলেই প্রটেস্ট করে।
এসবই ওর কাল হয়েছে। অনেক সম্বন্ধ এসেছিল। কিন্তু মেয়ের আমার মোটেই বিয়েতে মত নেই। এসব হুমকি উড়ো ফোন সব এমনই কেউ ফ্রাস্টেশনে করে থাকবে।
--মা, তুমি তোমার ঘরে যাও। ডাকলে পরে আসবে। এটা সিরিয়াস ম্যাটার।
উঠে দাঁড়িয়েছে সোনালী। ওর গলার আওয়াজ হিমশীতল।
এবার সৌরভ অস্বস্তি বোধ করে উঠে দাঁড়ায়, ভাবে এখানেই দাঁড়ি টেনে অফিসে ফিরে যাবে। মনে হয় শকুন্তলা ঠিক বলছেন।
--দেখুন মিস মিশ্র, মনে হয় আপাততঃ আমার আর কিছুই করার নেই। পুরো ফাইলটাই নিয়ে যাচ্ছি। কোসলে স্যারকে দিয়ে দেব। উনি স্টাডি করে যা ইন্সট্রাকশন দেবেন তা আপনাকে জানিয়ে দেওয়া হবে।
--দাঁড়ান, আরও একটা কাজ বাকি আছে যে! আমাদের পুলিশ প্রটেকশন চাই।
এর জন্যে সৌরভকে কেন বলা হচ্ছে? সৌরভ কী করবে? সিমরনের মনটা খচ খচ করে। এগুলো তো পুলিশ বিভাগের আওতায় পড়ে। সোনালী যেন থট রিডিং জানে।
-- পুলিশ আমাদের পাত্তা দিচ্ছে না। কিন্তু কোসলে স্যার বললে হয়ে যাবে। উনি ডিজিপি শ্রীবাস্তব স্যারের বন্ধু।
হরি! হরি! তাহলে এই ব্যাপার। এর জন্যেই দু’হাজার টাকা দিয়ে রিটেইনার। সৌরভ তেতো মুখে সোনালীকে বলে—বন্ধু হলেই ওরকম হয় নাকি? সবকিছুর একটা কায়দা কানুন আছে না? থ্রেট
পারসেপশন। ক’টা বখাটে ছোঁড়ার ফ্রাস্টু কমেন্টের জন্যে পুলিশ প্রটেকশন!
সোনালীর মুখের চেহারা অপমানে কালো, কিন্তু চোখ দুটো জ্বলে ওঠে। ও বিড়বিড় করে—এইজন্যেই চাইছিলাম প্রফেশনাল গোয়েন্দা আসুন। তারপর মাথা নীচু করে কিছু ভেবে যেন একটা সিদ্ধান্তে আসে।
--এক মিনিট মিঃ বিশ্বাস। থ্রেট পারসেপশন না কি যেন বলছিলেন? এই মেসেজটা দেখুন। আজ সকালে আমার ফোনে এসেছে।
ও নিজের মোবাইল অন করে মেসেজটি এদের দুজনকে দেখায়।
“লোকেশ আজ গেল। এরপর কার নম্বর”?
বিমুঢ় সৌরভ জিজ্ঞেস করে—লোকেশ কে? আপনি চেনেন?
--লোকেশ বিদ্রোহী হল সেই সিকিউরিটি স্টাফ যার শরীর সি-টাওয়ারের সামনে সকাল থেকে মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে। এখন হয়ত পুলিশের গাড়ি বা অ্যাম্বুলেন্স বডি তুলে হাসপাতালে নিয়ে গেছে।
--আপনার সঙ্গে কীভাবে পরিচয়?
সোনালী দেয়ালের দিকে তাকায়। খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর কারও দিকে না তাকিয়ে ধরা গলায় বলে—লোকেশ আমার বয়ফ্রেন্ড। আমরা একসঙ্গে কলেজে পড়েছি ফার্স্ট ইয়ার থেকে। দলিত পরিবারের গরীব ছেলে। কবিতা লিখত, কিন্তু বিধবা মা আর দুটো ছোট ভাইবোন। তাই গ্র্যাজুয়েট হবার পর থেকেই কলেজ ছেড়ে চাকরি খুঁজছিল। কোথাও বেশিদিন টিকতে পারত না। বড্ড মেজাজি। এই আর্য্যা কলোনীতে দু’মাস আগে সিকিউরিটি এজেন্সি থেকে কাজে লেগেছিল। আমারই রেকমেন্ডেশনে। আমরা ব্রাহ্মণ, ওরা দলিত। ওর সংগে মেলামেশা করি মা চাইতেন না। আজকে মনে হল হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন।
--সুইসাইড কেন করল?
--লোকেশ সুইসাইড কেন করবে? ওকে নিঘঘাৎ পাঁচতলার ব্যালকনি থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছে।
--কারা ফেলেছে?
--বুঝতে পারছেন না? যারা আমাকে থ্রেট করছে, আজকের মেসেজটা আবার দেখুন।
সৌরভের হতভম্ভ মুখের দিকে তাকিয়ে সোনালী ফের বিড়বিড় করে—এই জন্যেই কোসলে স্যারকে চাইছিলাম। উনি দলিত, উনি ঠিক বুঝবেন।
(চলবে)