বছর চারেক আগের একটা লেখা, কোনো এক সতেরোই সন্ধ্যেবেলায়। রদ্দি মাল, কিন্তু পি-আচার্য্য শিখিয়েই গেছেন, 'শীতকাল' কিংবা 'তোমার প্রিয় মহামানব' রচনা একবার গাঁতিয়ে নিলে বছর-বছর কাজে লাগে, অর্থাৎ উৎসব-পার্বণের বাংলা রচনা ফৌজদারী মামলার মতো, জীবদ্দশায় তামাদি হয় না।
**১৭-ই সেপ্টেম্বর**
আমাদের এই অঙ্কের লাইনে অনেক ওপেন প্রব্লেম আছে, মানে এমন অদ্ভুত অঙ্ক, যার উত্তর আগেই বলা আছে, কিন্তু কি করে অঙ্কটা কষতে হবে কেউ জানে না। তো আমার জীবনেও ওই লার্ভা থেকে পিউপা হওয়ার মাঝখানটা ভর্তি ছিলো এরম গাদা গাদা প্রশ্নে ... ওপেন প্রবলেম! না না বারমুডা অথবা তজ্জনিত ট্রায়াঙ্গল নয়, ঈস্টার দ্বীপপুঞ্জ বা লক নেসের জলোসরাস-ও নয়, একদম পাতি ছাপোষা শহরতলির বাঙলা মিডিয়াম প্রব্লেম, এই যেমন ধরুন, ১) আসল দুলাল চন্দ্র ভড় কে? (R) চিহ্ন না পুরো নাম? ২) আসল বেণীমাধব শীল বা আদি-তম শ্রীভৃগুই বা কারা? আর ৩) সন্তান দল প্ল্যাটফর্মের দেওয়ালে দেওয়ালে 'রাম নারায়ণ রাম' লিখতে লিখতেই বা কী করে জানতে পারলেন নেতাজী এবার ল্যাদ কাটিয়ে রিটার্ন টিকিটটা বুক করেছেন সামনের মাসে?
কিন্তু সবথেকে আশ্চর্য লাগতো এইটা দেখে যে বাকি সব পুজো-পার্বণ এদিক-ওদিক গড়াগড়ি খায়, কিন্তু ওই এক বিশ্বকর্মা পুজো নট-নড়নচড়ন, ফি বচ্ছর ১৭-ই সেপ্টেম্বর বাঁধা।
সেই দমদম জংশনের প্ল্যাটফর্মে যেমন সদর্পে ঘোষণা থাকতো, 'সব জ্যোতিষী বারবার, অমৃতলাল একবার!' (বলাই বাহুল্য, অমৃতলালের কেরিয়ার নিয়ে সেই থেকে কিছুটা সংশয় এযাবৎ রয়েই গেছে)। তো এবারের গল্প আমাদের সেই 'নিষ্পাপ' ছোটোবেলার একমাত্র ফিক্সড পয়েন্ট নিয়ে, যার নাম ১৭-ই সেপ্টেম্বরের আকাশ, ধারকাছ দিয়ে গেলে সাবধান, এই বয়সে ভোঁকাট্টা হলে দায়িত্ব কিন্তু কর্তৃপক্ষের নয়।
বিশ্বকর্মা পুজোর দিনটা কিন্তু আসলে সিজন ফিনালে, মেগা-ফাইনাল, যাঁকে বলে পাঁচ সেটের হাড্ডাহাড্ডী নাদাল-ফেডেরার। এক মাস আগে থেকে চলতো মাঞ্জা দেওয়া, ভাতের মাড়ের সাথে কাঁচের গুঁড়ো, সাগু, শিরিষ মিশিয়ে সুতোয় প্রলেপ। সুধীজনেরা জানেন, মাঞ্জার ধার নিয়ে নিউটনের একটা সূত্র আছে, যত আজগুবি লজ্জাঘেন্নার-মাথা-খাওয়া জিনিষ সে মাঞ্জায় গেছে - ততই তার ধার। বন্ধুরা সব বাসে যেতে যেতে রোমহর্ষক গল্প শোনাতো, কে পচা ডিম দিয়ে মাঞ্জা দেবে বলে ডিম পচিয়ে শহীদ হয়েছে, কে আবার কাঁচের গুঁড়োর জন্য দিদিদের কিছু চুড়ি কুরবান করতে গিয়ে নিজেই কুরবান হয়ে গেছে, এক পাড়াকাকু ছিলেন মাঞ্জা-স্পেশালিস্ট, তাঁর মাঞ্জা-ফর্মুলার রহস্য কে-এফ-সি-র চিকেনের মতো, কেউ জানে না কি দেয়, বদলোকে বলতো কুকুরের এবং মানুষের সম্মিলিত ইয়ে থাকে তবে পূতীগন্ধময় লাটাই ছাড়া তার প্রূফ দেখিনি কখনো -- মাঝ আকাশে তাঁর ঘুড়িটি যখন বে-রেহমি-সে আগে বাড়তো আশেপাশের ছাদে সমবেত আর্তনাদ শোনাও এক অভিজ্ঞতা বটে !
বহুযুগ পরে ট্যারান্টিনোর কিল-বিল দেখছি, একটি দৃশ্যে জাপানী সন্নিসী উমা-দিদিমুনিকে তরোয়াল দিয়ে বললেন, 'If on your journey, you should encounter God, God will be cut' - মনে হলো আমাদের পাড়াকাকুর মাঞ্জা তো আর দেখো নি, নিশ্চয়ই ট্যারান্টিনোর ঘুড়িও কেটে দিতো।
সব গল্পেই একটা খিঁচুটে ভিলেন থাকে, আমাদের ঘুড়ির গল্পে ছিলেন পাড়ার এক দাদু, নাম ধরা যাক সদার বাবা গদা, নিয়মিত খেলা ভন্ডুল করে দেওয়ায় পাড়ায় তাঁর আদরের নাম ছিলো বাল ঠাকরে। তিনি বাচ্চাকাচ্চাদের ছাদে দেখলেই পরিত্রাহি চিৎকার করতেন আর অমনি আদেশ হতো সুড়সুড় করে নেমে আসার। এতেও ছাদময় ঘুড়ির দৌরাত্ম্য না কমায় তিনি একবার পাড়াশুদ্ধু গার্জেনদের সভা ডেকে বানিয়ে বানিয়ে ভয়ানক গল্প বলতে লাগলেন, কাকে দেখা গেছে কার্নিশ বেয়ে হাঁটতে, কে লগা নিয়ে হাইওয়েতে স্পিড লিমিট ক্রস করে দৌড়চ্ছিলো ইত্যাদি। অল্পেতেই কাজ হলো, অবিলম্বে ব্যান হলো আমাদের ছাদে যাওয়া। মনে আছে সেদিন সেই মিটিং থেকে বেরিয়ে দেখি অধোবদন সদাকাকু গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে, আমাদের দেখে বললেন, বাবার এই কাঠি করার হ্যাবিট-টা না আর গেলো না ...
অবিশ্যি সত্যি বলতে গেলেও আমার যে কিছু উন্নতি হতো এমন নয়, মাঞ্জা-টাঞ্জা দেওয়া তো দূর, ঘুড়িও যে খুব একা-একাই দারুণ ওড়াতে পারতাম এমন দাবী করলে পাড়ার বন্ধুরা এসে চাঁটি মারবে। তবে গ্যলারি যদি খ্যালার-ই অঙ্গ হয়, তাহলে আমিও একটা প্রত্যঙ্গ তো বটেই। মিলেনিয়াল-রা জানে কিনা জানিনা, তবে ঘুড়ি যখন ওড়াতে হয়, ছাদ থাকলে ছাদ থেকে সুতো ধরে তলায় ঝুলিয়ে প্রবল একটা হ্যাঁচকা-টর্ক। না থাকলে খোলা মাঠে এক অভাগা এক যোজন দূরে দুহাত তুলে ঘুড়ি ধরে দাঁড়াবেন আর পেশাদার উড়িয়ের কাজ মওকা বুঝে হ্যাঁচকা-টান ...
ছেলেবেলার সেই খেলার মাঠের সেপিয়া ছবিতে সব্বাই পেশাদার, যে একটি ছেলে এপ্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত ছুটে ছুটে সবার ঘুড়ি প্রাণপণে উপরে ঠেলছে সেই ক্যাবলা ছানাটিই আমি।
যৌবনের শুরুতে এক বান্ধবীকে প্রাণপণ ইম্প্রেস করতে চেয়ে বলেছিলাম, 'না ওড়াতে জানিনা, কিন্তু ঘুড়ি কেন ওড়ে সেই মেকানিক্স টা জানি', ফিজিক্স-এ (ও প্রেমে) যে আমার ফুটুরটি নেহাত-ই ডুম, সেই সন্ধ্যেয় প্রথম বুঝি ...
আর বুঝি, গল্প কেন সত্যি হয় না ... বললাম না, নেহাত-ই নিষ্পাপ এবং ক্যাবলা ছেলেবেলা ছিলো আমার - যা পড়তাম সব ভাবতাম সত্যি ! সেবার পুজোবার্ষিকীতে শীর্ষেন্দুর একটা গল্প পড়লামঃ একজন লোক, যাঁর জীবনে ভারি কষ্ট - তিনি রোজ ঘুড়ি ওড়ান আর রোজ একটা করে আজগুবি আদেশ পেতে থাকেন ঘুড়ির গায়ে লেখা, কোনোদিন বলে বসের মাথায় ঘোল ঢালতে, কোনোদিন বলে ঝাঁপ মারতে তিনতলা থেকে। ও মা, গল্পের শেষে দেখা যাবে, যা যা করেছেন সবেতেই খুব উপকার হয়েছে তাঁর - বসের টাকে চুল, মাজার ব্যথা গন এবং লাইফ ঝিঙ্গালালা। তো আমার খুব ফ্যান্টাসি হতো, একদিন নিশ্চয়ই মাঠে নেমে আসা শেষ ঘুড়িটা যখন কুড়িয়ে পাবো, আকাশের কোনো এক বন্ধু কিছু পাঠাবে লিখে? হয়তো বলে দেবে কি করলে আর টিফিনে জলের বোতল চুরি হবে না, বা বন্ধুরা আর খ্যাপাবে না ... কিন্তু নাঃ, সে ঘুড়ি আর আসে না! তারপর একদিন ভেবে দেখলাম, ইনকামিং যখন নেই, আউটগোয়িং-ই সই।
পাড়াকাকুকে বলে বিশাল দো-ত্তে ঘুড়ির ওপর স্কেচপেনে লিখে রাখতাম মহার্ঘ সব সদুপদেশ, কোনোটা গভীর জীবন-দর্শন, কোনও কোনোটা আবার নিতান্তই ছাপোষা, যেমন "এক মাস নখ কাটবেন না", কিংবা "আজ চান করার সময় একটু শ্যাম্পু খেয়ে দেখুন" ইত্যাদি ...
"বোম-মারা" বলে বিকট আওয়াজ হতো কাটা পড়ার সময়, আর বহুদূরে ঘুড়িগুলো হারিয়ে যাওয়ার সময় চেয়ে চেয়ে দেখতাম কোথায় পড়ছে ...
আজ বাড়ি ফেরার সময় একবার আকাশের দিকে তাকালাম, নাঃ, তাদের একটাও অতলান্তিক ক্রস করেনি দেখছি ...