এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  সমাজ  শনিবারবেলা

  • ইহুদি রসিকতা ৯: শ্নরার

    হীরেন সিংহরায়
    ধারাবাহিক | সমাজ | ২৪ জুলাই ২০২১ | ২৬৬১ বার পঠিত | রেটিং ৪ (৩ জন)
  • শ্নরার বা উপযাচককে নিয়ে

    ছয়ের দশক। কলেজের প্রথম বছর। একটা গান পুজো প্যান্ডেলের লাউড স্পিকারে খুব শোনা যেতো (ছবির নাম দস লাখ) -

    গরিবোঁ কি সুনো, ওহ তুমহারি সুনেগা
    তুম এক পয়সা দোগে, ওহ দস লাখ দেগা


    এ কথা গুলোর সার মর্ম খুঁজতে গিয়ে মনে হয়েছে এ তরিকাটি তো মন্দ নয়। আমি এক জনকে এক পয়সা দিলে ঈশ্বর দশ লাখ দেবেন আমাকে। অল্প কমিশনে ডিরেক্ট মানি ট্রান্সফার। লাভ শুভ, শুভ লাভ। ওপরঅলার কাছে সরাসরি দশ লাখ চাইলে হয়তো খরচা বেশি পড়তো।

    সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের সাহায্যার্থে অর্থবানের টাকার থলির বাঁধন আলগা করার আইনি নির্দেশ সব আব্রাহাম পন্থী ধর্মের অন্তর্ভুক্ত। ইহুদি ধর্মে প্রথমে ফসলের, পরে আয়ের কিছু শতাংশ (দশ অবধি) অভাবী মানুষের সেবায় উৎসর্গ করার আদেশ পাওয়া যায় – এর নাম জেদেকাহ (আক্ষরিক অর্থে ন্যায়)। সবাই সমান উপার্জনে সক্ষম নন বলে অর্জিত ধন ভাগ করে নেওয়াটা ন্যায় বলে বিবেচিত হয়। প্রাচীন সমাজে আপামর জনসাধারণের জন্য সরকারি দাতব্য চিকিৎসা ব্যবস্থা ছিল না -রাজা রাজড়ারা কর আদায় করে যুদ্ধু বাধাতেন। জনসেবায় কুয়ো খোঁড়া বা রাস্তা বানানোর কাহিনি ইতিহাসে পাওয়া যায় বটে তবে সেটি সবসময় প্রয়োজন অনুযায়ী সাধিত হত কিনা তা বিতর্কের বিষয়। অতএব দরিদ্র জনগণের ভরসা স্বচ্ছল জনগণ। এই দানের সদিচ্ছা স্বচ্ছল জনগণের ওপরে ছেড়ে না দিয়ে একটা ধর্মীয় আদেশ সেই দান ব্যবস্থাটিকে কায়েম করে।

    আজকের মতন বেসরকারি সাহায্য উদ্যোগ অথবা এন জি ও গড়ে উঠতে বহু বছর লেগে গেছে। জেরুসালেমে মন্দির ধ্বংস হবার পরে ইহুদি ধর্মে ভ্যাটিকান সুলভ কোন কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব কোন দিন ছিল না। তাই শনিবারে সিনাগগে দান আদায়ের কৌটোতে (তার নাম পুষকে) সংগৃহীত দানের যথার্থ বণ্টন দায়িত্ব বর্তায় স্থানীয় ইহুদি সমাজের ওপরে। গ্রামে গঞ্জে পর্বে আমরা দেখেছি ষ্টেটেলের মানুষ গ্রামের দরিদ্র মেয়েদের বিয়ের যৌতুকের টাকা অবধি সংগ্রহ করতেন সেই বাকসোয়।

    খ্রিস্ট ধর্মে আয়ের দশ শতাংশ দানের নির্দেশ আছে যাকে বলা হয় টাইথ। সেটি গিরজেয় জমা করতে হতো। কি ভাবে তা ব্যয় করা হবে স্থির করতেন ধর্ম পিতাগণ। ইসলামে আছে জাকাত। সকল ধর্মনিষ্ঠ মুসলিমের কর্তব্য আয়ের অন্তত আড়াই শতাংশ সৎ কাজে ব্যয় করা।

    আমরা দান করি স্বেচ্ছায়। কর দিই অনিচ্ছায়।

    করের টাকা সরকার ঠিক কোনখানে ব্যয় করেন আর মাছ কখন জল খায় সেটা জানা একই রকম দুরূহ কাজ। দানের টাকাটা কোথায় বা কাকে দেব সেটা আমি নিজে স্থির করতে পারি। আজকাল অকসফ্যাম ইউনিসেফ ইত্যাদি অজস্র সংস্থা আমাদের এই শুভকর্ম সাধনে সহায়তা করার জন্য হাত বাড়িয়ে আছেন। তবে তাঁরাও যে যথাযথ ব্যয় করছেন এমন ভাববার কোন সঙ্গত কারণ নেই। সেটা আরেকটা বিষয়।

    ইহুদি তালমুদে দান করার আদেশ তো দেওয়া হল। সেটি করা ঈশ্বর সেবার সমতুল্য সেটাও বোঝা গেল। কিন্তু সে দানের বারিধারা কার ওপরে বর্ষিত হবে তার হদিশ দেওয়া নেই। সিনাগগের ভাঁড়ে টাকা জমা দিলেই কি কাজ ফুরলো? এ টাকার স্রোতের গতি কোন মুখে যাবে?

    ধনী থেকে দরিদ্রে ক্যাশ পৌঁছে দেবার এইন কঠিন কাজটি করার জন্য ইহুদি সমাজে যে বরেণ্য মনুষ্য কুল আবির্ভূত হলেন তাঁদের আমরা জেনেছি শ্নরার বা উপযাচক নামে।

    শ্নরেন একটি পুরনো জার্মান ক্রিয়াপদ যার সামগ্রিক অর্থ আপনার হৃদয়ে যুগপৎ দয়া, করুণা, দুঃখ উৎপাদন করে আপনার কাছ থেকে কিছু অর্থ তৈল তণ্ডুল লবণ সংগ্রহ করা।

    শ্নরেন থেকে এসেছে ইদিশ শব্দ শ্নরার। তদ্ভব!


    শ্নরারকে আপনি ভিখিরি বলে খামখা বেইজ্জতি করতে পারেন না। শ্নরার রাস্তার ভিখিরি নন । তাঁর কোন বৃত্তি আছে,। হয় ছোট খাটো দোকান চালান নয় পরের বাড়িতে মজুর খাটেন। সব সময় অর্থের টানাটানিতে ভোগেন। অনেকগুলো ছেলে মেয়ে নিয়ে সংসার কাটে কষ্টে সৃষ্টে। অশিক্ষিত নন, কিঞ্চিৎ লেখাপড়া জানা আছে। ইদিশ তাঁর ভাষা। হিব্রুতে দু চারটে বাক্যি বলে চাষা ভুষোর সম্ভ্রম কুড়োন। বাইবেলের প্রথম পাঁচটি বই বা তোরা এবং তালমুদ সম্বন্ধে তিনি কানে শুনে ওয়াকিবহাল। জুতসই জায়গায় জেনেসিস, একসোডাস বা দশ আদেশ থেকে দু লাইন ছাড়তে পারেন। হিব্রু বাইবেলের গল্পকে আজকের সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে পেশ করতেও সক্ষম তিনি।

    শ্নরার খুব ভালো মতন জানেন জেদেকাহ বা দান করে পুণ্য অর্জন করাটা ধনীর অভীষ্ট। তিনি পথে নামেন সেই অমৃত সুলভ দানের বারিধারার সন্ধানে। সেটা তাঁর বিজনেস মডেল।

    শ্নরার নিয়মিত সিনাগগে হাজিরা দিয়ে উপস্থিত জনতাকে খুঁটিয়ে দেখেন - কোন মানুষের কাছে কি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে সেটি অনুধাবন করে তৈরি হয় তাঁর নিজস্ব টার্গেট মার্কেট। রাবির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পাঁচটা পরামর্শ পান। ইহুদি সমাজে রাবি কেন্দ্রীয় দস্তাবেজ দফতর বা মহাফেজখানা। যে কোন বিষয়ে মতামত, কারো চরিত্রের সার্টিফিকেট তাঁর কাছে প্রাপ্তব্য। রাবিকে শ্নরার সরবরাহ করেন বাজারি গুজব (যাকে আমরা আমাদের ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কিং ব্যবসায় মার্কেট ফিডব্যাক বলি)। রাবি সামাজিক বিবেকের দর্পণ। তাই রাবির নেক নজরে থাকা এবং তাঁর সার্টিফিকেট পাওয়াটা শ্নরারের কর্তব্য।

    শ্নরার হাজির জবাব। তার ব্যঙ্গ, কৌতুক এবং রসবোধ উচ্চ মার্গের। ব্যারন রোটশিল্ড বা ব্যাঙ্কার ফুরসটেনবেরগের উলটো দিকে চেয়ার টেনে বসে শ্নরার বাজারের হাল হকিকত, পাড়ার কেচ্ছা বা ধার্মিক তত্ত্বের ওপরে দুটো মন্তব্য হাওয়ায় ভাসিয়ে দেবার দক্ষতা রাখেন। পোশাক আষাক সস্তার কিন্তু পরিষ্কার। আচরণ ও শব্দ চয়ন ভব্য। ধনীর দুয়োরে দুয়োরে ঘুরে সমবেদনা এবং তার সঙ্গে লবণ ও অর্থ সংগ্রহ করেন। সেটির পরিমাণ সঙ্গত বা মনোমত না হলে ধনীকে আবার বাক্যবাণে বিদ্ধ করতে ছাড়েন না।

    আয়ের এক দশমাংশ সমাজের অভাবি মানুষকে দান করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বাইবেলে- নির্দ্বিধায় সে কথা তিনি ধনী ইহুদিকে মনে করিয়ে দেন।

    দরিদ্র জন সাধারণকে সাহায্য করে ঈশ্বরের আজ্ঞা পালন করা সেই ধনবানের কর্তব্য। শ্নরার নিমিত্ত মাত্র – তিনি ধনী ব্যক্তিকে তাঁর ঐশ্বর্যের সম্ভার বণ্টনের সুযোগ করে দিয়ে কৃতার্থ করছেন। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তাঁকে বুঝিয়ে দেন যে প্রভূত অর্থ সঞ্চয় করার পরে তার যথা যোগ্য অংশ শ্নরারের হাতে তুলে দিলে তবেই সেই ধনবান প্রভুর অপার করুণা অর্জন করতে সক্ষম হবেন।

    দরিদ্রের প্রয়োজন অর্থের, ধনীর প্রয়োজন জুতসই দানের। সেই সেতু বন্ধনের পবিত্র দায়িত্ব যার হাতে তিনিই শ্নরার যাকে আমরা উপযাচক বলতে পারি।

    ধনী ও দরিদ্র এই দুজনকে যে দুজনের দরকার তার একটা চমৎকার ছবি পাই ইদিশ ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক শলেম আলাইখেমের (আসল নাম সলোমন রাবিনোভিতস) বর্ণনায়। কাসরিলেভকা নামক একটি পোলিশ গ্রামকে তিনি অমর করে গেছেন। এই নামে কোন গ্রাম সত্যি ছিল কিনা জানা যায় না। তবে এটি সেই সময়ের ষ্টেটেলের ইহুদি জীবনের কঠোর দারিদ্র্য আর সংগ্রামের প্রতীক।

    লেমবেরগের (ইউক্রেন) ইহুদি সম্প্রদায় রীতিমত স্বচ্ছল হয়ে উঠেছে। সবারই কাজ কর্ম, ব্যবসার অবস্থা বেশ ভালো - জারের পুলিশ উৎপাত করে না অবধি। কারো কোন অভাব নেই।

    একদিন শনিবারের সমাবেশে রাবি জানালেন সিনাগগের তহবিলে টাকা জমা পড়ছে ভালো রকম। এই উদারতার জন্য সমবেত মানুষদের ধন্যবাদ দিলেন। কিন্তু জেদেকাহ বা ন্যায় পালনের ক্ষেত্রে একটি সমস্যা দেখা দিয়েছে। দান আসছে বর্ষার ধারা মতো কিন্তু সেটি দেওয়া হবে কাকে। গ্রহীতা নেই। সবাই সুখে স্বছন্দে আছে। গরিব মানুষ খুঁজতে যে বেরুতে হয় লন্ঠন হাতে! প্রভুর ইচ্ছা কি ভাবে পূরণ হবে?

    এক গুণী বললেন তিনি শুনেছেন শখানেক মাইল দূরে কাসরিলেভকা নামের একটি গ্রামে কেবল হাড় হাভাতে দরিদ্র ইহুদির বাস। আমরা কি তাদের সাহায্য পাঠাতে পারি? রাবি বললেন তারচেয়ে ভালো হয় যদি আমরা লোক পাঠিয়ে সেখান থেকে বরং কাউকে লেমবেরগে নিয়ে আসি। সে আমাদের মধ্যে বাস করে, নিয়মিত দান গ্রহণ করে আমাদের পুণ্য অর্জনের সুযোগ দিক। সিনাগগের বাকসোয় যে দান জমা পড়বে সবটাই তার প্রাপ্য হবে।

    পাঁচটি ছেলে মেয়ে বউ নিয়ে সপরিবারে ব্লুম এসে বাসা বাঁধল লেমবেরগ শহরে ইহুদি সমাজের একমাত্র দান গ্রহীতা রূপে।

    সে দিব্যি থাকে, খায় দায়। ছেলে মেয়েরা মিদ্রাশে পড়া শোনা করে, হিব্রু শেখে। ব্লুমের বউকে প্রায়ই কেনা কাটা করতে দেখা যায় লেমবেরগের বাজারে দোকানে। ব্লুম তাস খেলে দিনে দুপুরে। কুটোটি কাটে না। অথচ ব্লুমের দাবি দাওয়া ক্রমশ বাড়তে থাকে। একদিন সে জানালে সিনাগগের সাপ্তাহিক দানে তার পোষাচ্ছে না। ব্লুম তার মার্কেট ভ্যালু বুঝে গেছে। সে জানে লেমবেরগের গোটা ইহুদি সমাজের পুণ্য অর্জনের চাবি তার হাতে।

    রাবি পড়লেন সমস্যায়। ব্লুমের দাবি চক্র বৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকলে সিনাগগের সাপ্তাহিক চাঁদাতে কুলোবে না। অনেক চিন্তা ভাবনা করে একদিন রাবি এক সমাবেশ ডাকলেন (হিব্রুতে মিনিয়ান – অন্তত দশ জন হাজির হলে তবেই মিটিং শুরু করা যায়)। সেখানে ব্লুমকে তার দাবি গুলো কমাবার অনুরোধ জানানো হল। মিনিয়ানের বক্তব্য শুনে ব্লুম যে উত্তর দিলো সেটি এই রকম:

    • মনে রাখবেন, আমি আপনাদের পুণ্য লাভের একমাত্র কাণ্ডারি। ছেলে মেয়ে বউকে নিয়ে লেমবেরগ এসেছি আপনাদের কল্যাণের জন্য। আমি নিত্যই চেষ্টা করি যাতে সিনাগগের সাপ্তাহিক সংগ্রহটির সদ্ব্যবহার হয়। সেটি না হলে ঈশ্বর অপ্রসন্ন হবেন। আমি এও জানি আপনাদের সকলের স্বচ্ছলতা বাড়ছে। সেই মতো আপনাদের দানের পরিমাণও বৃদ্ধি পাওয়া উচিত। তবু যদি আপনারা আমার প্রাপ্য দানের অংশ বেঁধে দিতে চান, আমি আগামী কালই সপরিবারে কাসরিলেভকা ফিরে যাব। দেখি আপনারা কি করে পবিত্র তোরা নির্দেশিত দান ধ্যানের ধারা অব্যাহত রেখে সুকৃতি ও শ্রেয় অর্জন করতে পারেন।

    কথিত ইতিহাস অনুযায়ী ব্লুম সপরিবারে লেমবেরগের ইহুদি সমাজের ধর্ম আচরণের পরাকাষ্ঠা বহাল রাখে আজীবন।

    শ্নরারের সঙ্গে আমার কিঞ্চিৎ পূর্ব পরিচিতি আছে। আমাদের পদুমা গ্রামের পূজো বাড়িতে, পালে পার্বণে, ধান কাটার সময়ে দেখা দিয়েছেন আশে পাশের গ্রামের দরিদ্র ব্রাহ্মণ। বসেছেন আটচালার বারান্দায়, সবার পাশে। তাঁদের আলাপ পরিচয় আছে গ্রামের সকলের সঙ্গে - আজকের ছেলে ছোকরাদের বাপ ঠাকুরদার নাম জানেন। চাষ বাস থেকে আরম্ভ করে গোরুর গাড়ির আলাং কুচি কিভাবে লাগানো উচিত সে সব নিয়ে যথাযোগ্য উপদেশ দিয়েছেন। আমাদের মতো ছোটদের রামায়ণ মহাভারতের গল্প শুনিয়েছেন, তারই মধ্যে দুটো সংস্কৃত শব্দ গুঁজে দিয়ে ভালো হবার উপদেশ দিয়েছেন (আমার বাল্য বন্ধু মধু মণ্ডল সেই সংস্কৃত ভাষ্যকে বলত অং বং)।

    তার পরে এসেছেন আমাদের অন্দর মহলে। দাওয়ায় বসে গল্প, মায়ের সঙ্গে। সবার খোঁজ খবর নিয়ে সুপরামর্শ দিয়েছেন। ভগবান আমাদের পরিবারকে সুস্থ রাখুন, আরো সমৃদ্ধ করুন। এক পাত খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে সসম্মানে। তাঁদের ফেরার সময় হলে পুজোর বস্ত্রাদি কিছু দক্ষিণা মুড়ি নাড়ু চাল এবং হয়ত আরো কিছু মা বেঁধে দিয়েছেন। বেলা পড়ে এলে মাকে ‘চির সুখী হও’ আমাদের ‘কল্যাণ হোক ‘ এই সব আশীর্বাদ করে সেই পুঁটলি ঝোলায় বেঁধে বসুরি বা ভালকো গ্রামে তাঁদের আপন গৃহের দিকে যাত্রা করেছেন।

    এঁরা কেউ ভিক্ষার্থী ছিলেন না।

    এঁরা ইহুদি শ্নরারের বীরভূম সংস্করণ।


    **********


    রোটশিল্ডের কাছে এসেছেন রুবিন।

    রুবিন: হের রোটশিল্ড! আমি আপনার ঠাকুরদাকে চিনতাম, আপনার বাবাকে, কাকাকে জানতাম…
    রোটশিল্ড-: আচ্ছা, কত টাকা পেলে হবে বলুন তো? আমার বংশ কুলুজি নিয়ে টানা টানি করবেন না।
    **********


    একটি বিশাল পপলার গাছের নিচে মারবেলে বাঁধানো প্রকাণ্ড সমাধি, তার সামনে বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা

    রোটশিল্ড

    গ্রুন সেদিকে তাকিয়ে রোটকে বলল, ‘ দেখেছিস, বাঁচা কাকে বলে? ”
    **********


    ব্যারন ব্লুমেনথাল হেঁটে যাচ্ছেন।

    নাফতালি (টুপি খুলে): : সার, কিছু অর্থ সাহায্য করুন
    ব্যারন (বিরক্ত) : আমি রাস্তায় টাকা পয়সার কথা আলোচনা করি না।
    নাফতালি (তিক্ত) : কেন? আমার ব্যবসা চালানোর জন্য অফিস খুলব নাকি?
    **********


    সক্কালবেলায় ব্যবসায়ী ব্লুমেনফেলডের বাড়িতে কড়া নাড়ছে ইতঝাক।

    ইতঝাক : সার, বড়ো কষ্টে আছি। কিছু সাহায্য করুন।
    ব্লুমেনফেলড (বিরক্ত হয়ে): তার জন্যে এত সকালে আমার বাড়ির কড়া নাড়ছ?
    ইতঝাক (আরও বিরক্ত): দেখুন আপনি আপনার ব্যবসা কিভাবে চালান সে ব্যাপারে আমি আপনাকে পরামর্শ দিই না। আমার ব্যবসা কেমন ভাবে চালাব সেটা আমাকে শেখাবেন না।
    **********


    অনেকক্ষণ ধরে এক উপযাচক তার অভাবের গল্প শুনিয়ে যাচ্ছে। মেয়ের বিয়ে আটকে আছে। পাত্র পক্ষের দাবি খুব বেশি। পঞ্চাশ হাজার গিলডার পেলে মেয়েকে সালঙ্কারা করে বিয়ে দিতে পারে।

    রোটশিল্ড: শুনুন আপনাকে পঞ্চাশ হাজার গিলডার দিতে পারব না। এটুকু ভরসা দিতে পারি, যত দিন বেঁচে আছি, বছরে এক হাজার গিলডার পাবেন।
    উপযাচক: আপনি তো বলেই খালাস। আপনার যা কপাল, বেশিদিন না বেঁচে আমাকে ঠিক ফাঁকি দিয়ে যাবেন।
    **********


    প্রবচন: গরিবের শত্রু কম। ধনীর বন্ধু সংখ্যা সীমিত।
    **********


    ধনী ইহুদির বাড়িতে ইয়াকব।

    ইয়াকব : একটু দয়া করুন। পরিবার নিয়ে বড়ো অভাবে আছি।
    মরগেনষ্টেরন: তুমি কি জানো ওয়ারশতে আমার পিসি পঙ্গু? কিয়েভে মাসী কঠিন ব্যাধিতে শয্যাশায়ী? কাকা ডানজিগে মৃত্যুশয্যায়?
    ইয়াকব: ক্ষমা করুন। আমি জানতাম না আপনার নিজের পরিবারেই এত সমস্যা।
    মরগেনষ্টেরন : শোনো, আমি তাদের কাউকেই কোনো সাহায্য করি না। তোমাকে করতে যাব কেন?
    **********


    বড়লোকের বাড়ির দাওয়াতে বসে অনেকক্ষণ আপন দুঃখের গল্প শুনিয়েছে পিনকাস। গৃহিণীর মায়া হল। তিনি দুটো ব্যবহৃত জামা হাতে করে নিয়ে এলেন।

    গৃহিণী : এই জামা দুটো নাও। দেখ তোমার গায়ে হবে। প্রায় নতুন। কেউ একদিনও পরে নি।
    পিনকাস : মাদাম, ঠিক বলেছেন। এ যে একেবারে নতুন। আপনি এ থেকে একটা কিনে নিন না।
    **********


    অফিসের সেক্রেটারির কাছে অনেক কান্না কাটি করে বলে কয়ে রোটশিল্ডের দফতর অবধি পৌঁছেছে আরিয়েল। রোটশিল্ড অগত্যা তাকে বসতে বললেন। তারপর সে শুরু করল তার দুখ ভরি কাহানি। তার পরিবারে সবাই অসুস্থ, ব্যবসা বন্ধ। এমনকি কুকুরটা অবদি হাঁটা চলা ভুলে গেছে। যত শোনেন রোটশিল্ড আরও বিষণ্ণ হয়ে পড়েন। আর থাকতে না পেরে তিনি ঘণ্টি বাজালেন। প্রহরী হাজির হল।

    -"এর দুঃখের গল্প শুনে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। একে শিগগির আমার অফিস থেকে দূর করে দাও। "
    **********


    ইলান সকাল থেকে এসে নানা রকমের দুঃখের গল্প করল। ব্যারন সিলবারস্টাইন তাকে বেশ কিছু গিলডার দিয়ে কোনোমতে বিদেয় করেছেন। দুপুর বেলা ব্যারন তাঁর প্রিয় মহার্ঘ্য রেস্তরাঁয় গিয়ে দেখেন সেই লোক তাঁরই পাশের টেবিলে বসে মেয়নেস সহ লাখস (সালমন মাছ) নিয়ে বসেছে।

    তিনি তার সামনে গেলেন।

    ব্যারন সিলবারস্টাইন: দু ঘণ্টা আগে খাবার জোটে না বলে কান্না কাটি করলেন আমার অফিসে। আর এখন এই দামি রেস্তরাঁয় বসে লাখস খাচ্ছেন। লজ্জা করে না?
    ইলান : আপনি কি ভেবেছেন? পয়সা না থাকলে ভালমন্দ খেতে পাই না। এখন দুটো পয়সা পেয়েছি কিন্তু একটা ভালো জায়গায় বসে খেতে পারব না? তাহলে মেওনেস দিয়ে লাখস খাব কখন?
    **********


    ভিলনো (ভিলনিউস, লিথুয়ানিয়া)

    রবিবার মরগেনষ্টেরন বাড়ির বারান্দায় বসে খবরের কাগজ পড়ছেন। একজন এসে দাঁড়াল তাঁর সামনে। অন্য গ্রামের লোক। তিনি চেনেন না।

    রুবিন : হের মরগেনষ্টেরন আপনি আমাকে চিনবেন না। তবে আমি আপনার মহান উদারতার কথা অনেক শুনেছি। এক ভ্রাম্যমাণ অর্কেস্ট্রায় বাজনা বাজাতাম। কিন্তু বাজার খারাপ। অর্কেস্ট্রা বন্ধ হয়ে গেছে। আমার কপালটাই মন্দ। যদি সাহায্য করেন কিছু।
    মরগেনষ্টেরন : কি বাজনা বাজাতেন?
    রুবিন (খানিকটা ভেবে): হারপ।

    মরগেনষ্টেরন বাড়ির ভেতরে কাউকে ডেকে হারপ আনার হুকুম দিলেন।

    মরগেনষ্টেরন : এই নিন। এবার একটু বাজিয়ে শোনান।
    রুবিন : আপনাকে বললাম না আমার কপালটাই খারাপ। এমন একটা বাজনার কথা ভেবে বের করলাম যা প্রায় কারও বাড়িতে থাকার কথা নয়। আর আপনি সেটাই আমার সামনে হাজির করলেন!
    **********


    ইয়াকব : আরন, তুমি ভদ্র সভ্য শিক্ষিত শিক্ষিত ছেলে। বড়লোক দেখলেই তার সামনে মাথা নিচু করো কেন?
    আরন: আদমের সময় থেকে চলে আসছে ইয়াকব । দুধ পেতে গেলে গোরুর সামনে হাঁটু গেড়ে বসতে হয়।
    **********


    রোটশিল্ডের ফ্রাঙ্কফুর্ট অফিসে উপযাচক এসে হাজির হয়েছে একটি তরুণ যুবককে সঙ্গে নিয়ে।

    উপযাচক : হের রোটশিল্ড এই ছেলেটাকে কাজে রাখুন।
    রোটশিল্ড : আমি তাকেই কাজে রাখি যার কপাল ভালো।
    উপযাচক : কি করে বোঝেন কার কপাল ভালো?
    রোটশিল্ড : তাকে যদি আমার তৎক্ষণাৎ পছন্দ হয় তাহলেই তার কপাল ভালো।
    **********


    ব্যাঙ্কার রুবিনস্টাইনের কাছে গিয়ে নাফতালি তার দুঃখ দারিদ্র্যের কাহিনি শোনাচ্ছে। সে লেখা পড়া জানা মানুষ। কাজ জোটে না। দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষা করে দিন চলে।

    রুবিনস্টাইন: আচ্ছা তাহলে এক কাজ করুন। আমার এক ক্রিশ্চিয়ান হিসেব রক্ষককে কালই কাজ থেকে বিদেয় করেছি। আপনি আমাদের চেনা মানুষ। আপনাকে সে কাজটা দিতে পারি। তাকে যা দিতাম তার চেয়ে দুশ গিলডার বেশি দেব।
    নাফতালি: হের রুবিনস্টাইন, আমি বলি কি, আমার জানা একটি ভালো ক্রিশ্চিয়ান ছেলে আছে। কাল নিয়ে আসব। তাকে আপনি ঐ কাজটা দিন আগের মাইনেতে। আর দুশো গিলডার আমাকে দেবেন প্রত্যেক মাসে।
    **********


    গেলেস ডাক্তারের কাছে গিয়ে তার রোগ বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে দারিদ্র্যের গল্প শোনাল। শুনে ডাক্তার কাতসেনশাইনের মায়া হল। তিনি

    গেলেসের পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ওষুধ দিলেন বিনা পয়সায়। মায়া বশত তিনি গেলেসকে কুড়িটা রুবেলও হাতে দিলেন।

    কয়েক মাস বাদে রাস্তায় তাঁদের দেখা।

    কাতসেনশাইন : আপনাকে বেশ ভালো দেখাচ্ছে! আমার চিকিৎসায় তাহলে কাজ হল!
    গেলেস : ধন্যবাদ। খুব ভালো আছি। আপনার চিকিৎসায় নয়। সেই যে আপনি আমাকে কুড়ি রুবেল দিয়েছিলেন, তাই দিয়ে একজন ভালো ডাক্তার দেখিয়েছিলাম। তিনিই সারালেন।
    **********


    কনস্টানসা। রোমানিয়া।

    শরীর খারাপ, মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না, খাওয়া জুটছে না ইত্যাদি নানা রকমের অভাবের গল্প শুনিয়ে খাইম অনেকক্ষণ ধরে ঘ্যান ঘ্যান করে গেল। হের ব্লুমেনফেলড মোটে কান দিচ্ছেন না। এবার খাইম একটু অন্য রাস্তা ধরল।

    খাইম: হের ব্লুমেনফেলড, আমার অন্তত একটা উপকার করুন। জাহাজের টিকিট কাটার টাকা যদি দেন, আমি সপরিবারে প্যালেস্টাইন চলে যাব। আপনার বারবার বিরক্ত করবো না।
    ব্লুমেনফেলড: খাইম, আপনি আমাদের প্রতিশ্রুত দেশে ফিরে যেতে চান, সেটা খুব ভাল কথা । আমি অবশ্যই সাহায্য করব। তবে একটা কাজ করতে হবে। এই দেখছেন আমার ড্রয়ারের এই বাইবেলটি? আপনাকে দেব। এটি হাতে করে প্যালেস্টাইন নিয়ে যাবেন আর সেখানে পৌঁছুলে সিনাই পাহাড়ের ওপরে রেখে দিয়ে আসবেন। যদি রাজি থাকেন তাহলে বলুন।
    **********


    কভনো (আজকের কাউনাস)।

    গৃহকর্ত্রীকে দুঃখের ব্যাখ্যান করেছে আইগেলব। মাঝে মাঝে চোখের জল ফেলেছে। তিনিও প্রায় কেঁদে ফেলেন।

    গৃহকর্ত্রী: বাবা, তোমার কষ্টের কথা শুনে আমারও খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু শোনো আমার ঘরে তো এখন ক্যাশ টাকা নেই। সন্ধ্যেয় আমার স্বামী ফিরলে তাঁর কাছ নিয়ে রাখব। তুমি বরং কাল সকালে এসো।
    আইগেলব: আগামী কাল? ঠিক তো? দেখুন, কথা রাখবেন। লোকের এমনি প্রতিশ্রুতির ওপর ভরসা করে অনেকবার ঠকেছি।
    **********


    গোল্ডবেরগের দরোজায় উপযাচক শামির

    গোল্ডবেরগ: তোমাকে সাহায্য করব কেন? তুমি একজন শক্ত সবল মানুষ। খেটে খাও।
    শামির : কি চান? আপনি দুটো পয়সা ঠেকাবেন এই আশায় আমি হাত পা ভেঙ্গে পঙ্গু হয়ে থাকি?
    **********


    গৃহকর্ত্রী সেজে গুজে সবে বেরুচ্ছেন। দুয়ারে এসে দাঁড়াল ইলান।

    ইলান: মহীয়সী মহিলা, আমাকে একটু দয়া করুন। চার দিন কিছু খেতে পারিনি।
    মহিলা: কেন, একটু জোর করো। চেষ্টা করো। ঠিক পারবে।
    **********


    সাবাথের সন্ধ্যেয় (শুক্রবার) সমাজের অভাবী মানুষকে বাড়িতে ডেকে একত্র ভালো মন্দ খাওয়া ও খাওনোর প্রচলিত প্রথাটির ব্যত্যয় করেন না ফাইনমান। ষ্টেটেলে দরিদ্র মানুষের অভাব নেই, তা ছাড়া আছে শ্নরার ইলান। তাকে নিমন্ত্রণ করলে সে আবার কখনো একা আসে না। আমাদের দেশে বিয়ের কার্ডে সবান্ধবে বর বধুকে শুভেচ্ছা জানানোর কথা লেখা থাকত। ঠিক সেই রকম ইলান আসে কাউকে সঙ্গে নিয়ে। সে মানুষটি চুপ চাপ খেয়ে যায় কোন কথা বলে না অবধি। একদিন ফাইনমান তাঁর কৌতূহল চেপে রাখতে পারলেন না। ভোজ শেষে নাথান আর তার সঙ্গী ফিরে যাবে। ফাইনমান নাথানকে একপাশে ডাকলেন।

    ফাইনমান: দেখুন, সাবাথের সন্ধ্যেয় আমার বাড়িতে আপনার সবাই সাদরে আমন্ত্রিত। কিন্তু আপনাকে জিজ্ঞেস করতে পারি কি আপনার এই সঙ্গীটি কে? নিঃশব্দে আসেন, নিঃশব্দে চলে যান?
    নাথান: ও হল আমার জামাই, সলি। বিয়ের চুক্তি অনুযায়ী ও দু বছর আমার বাড়িতে থাকবে, খাবে। আমি গরিব মানুষ। আমি কি আর ভালমন্দ খাওয়াতে পারি? তাই আপনি বা আপনার মতো সদাশয় মানুষ আমাকে যখনি নেমন্তন্ন করেন, সলিকে সঙ্গে নিয়ে আসি।

    পু: ঘর জামাইয়ের প্রথাটি ষ্টেটেলের ইহুদি সমাজে সম্যক চালু ছিল!
    **********


    গোল্ডস্টাইন একটা পয়সা না দিয়ে বিদেয় করছেন আশারকে। আশারের কাকুতি মিনতি নিষ্ফল।

    আশার: প্রার্থনা করি আপনার জীবন আব্রাহাম, আইসাক আর ইয়াকবের মতো হোক (ইহুদিদের তিন পিতৃ পুরুষ)।
    গোল্ডস্টাইন: তার মানে কি?
    আশার: আপনি আব্রাহামের মতো বিভ্রান্ত, আইসাকের মতো অন্ধ আর ইয়াকবের মতো খোঁড়া হবেন।
    **********


    উদ্ভ্রান্ত চেহারা নিয়ে নাফতালি এসেছে গোল্ডস্টাইনের কাছে

    নাফতালি সার, আমার বড়ো বিপদ। আগুন লেগে আমার সর্বস্ব পুড়ে গেছে। একটু সাহায্য করুন!
    গোল্ডস্টাইন অবশ্যই করব। তোমার বাড়ি যে পুড়ে গেছে সেটা রাবির কাছ থেকে লিখিয়ে আনো।
    নাফতালি (ভেবে) সার, রাবির ওই সার্টিফিকেটটাও আগুনে পুড়ে গেছে যে।
    **********


    ইতঝাক আর কিরশকের্ণ গেছে গোল্ডবেরগের দফতরে।

    ইতঝাক: হের গোল্ডবেরগ দেখুন কাকে এনেছি সঙ্গে করে। কিরশকের্ণ! এর বাবা জ্ঞানী মানুষ, ঠাকুরদা

    মহান তালমুদ পণ্ডিত ছিলেন। নিজেও একজন সাধু সন্ত। তালমুদ, তোরা চর্চা নিয়ে পড়ে আছে। কিন্তু এখন অবস্থা এত খারাপ যে বেচারার অন্ন জোটে না।

    গোল্ডবেরগ তৎক্ষণাৎ কিরশকের্ণকে দশ রুবেল দিলেন।

    ইতঝাক: আমাকে কিছু ঠেকালেন না যে ?
    গোল্ডবেরগ: আমি এই সন্তকে দিলাম। তোমাকে কেন দেব?
    ইতঝাক: তা এই সন্তকে আপনার কাছে নিয়ে এলো কে? পুণ্য লাভের সুযোগ করে দিলো কে? আমার দক্ষিণাটা দেবেন না?
    **********


    গোল্ডফারব গমের আড়তের মালিক। দরাজ দিল মানুষ। ইওসেল সেখানে হাত পাতলেই দশ রুবেল পায়। আজ গোল্ডফারবের মুখ গম্ভীর।

    গোল্ডফারব: ইওসেল, আজ কিছু দিতে পারব না। এক জায়গায় টাকা লাগিয়েছিলাম সেটা ডুবেছে।
    ইওসেল(রেগে): আজে বাজে জায়গায় টাকা লাগিয়ে আমাকে ডোবাচ্ছেন ? হিসেব করে ব্যবসা করুন।
    **********


    লয়ভেন, বেলজিয়াম

    বেলজিয়ামের সমুদ্র তট মাত্র ৬৬ কিলো মিটারের। এত লোকে সেখানে যায় যে ছুটি কাটানো ব্যয় সাপেক্ষ।

    দাভিদ গেছে গোল্ডস্টাইনের অফিসে।

    দাভিদ : আমাকে কিছু সাহায্য করুন। আমার খুব কাশি হচ্ছে। কয়েকদিন ঘ্রন প্লেনে কাটিয়ে আসি।
    গোল্ডস্টাইন: আমার কাছে টাকা নিয়ে আপনি বেলজিয়ামের সবচেয়ে দামী স্পাতে যাবেন?
    দাভিদ : দেখুন, আমার নিজের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে আমি কোন কার্পণ্য করি না।
    **********


    গোল্ডবেরগের অফিসে ইয়াকব।

    ইয়াকব : আপনার সম্পদ অগাধ। আমার দারিদ্র্য কঠোর। এ দুটো কথা মনে রেখে আশা করি আপনি ব্যবসায়ে সংযত হয়ে চলবেন। বিবেচনা বজায় রেখে বেশি লাভের বাসনাকে লাগাম দেবেন।
    গোল্ডবেরগ (ক্ষিপ্ত): দয়ার ভিখিরি হয়ে আমার দরোজায় এসে আমাকেই এসব কথা শোনাচ্ছেন?
    ইয়াকব (শান্ত ভাবে): ভিক্ষে করার কায়দা শেখাবেন না। নিজের ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হয় আমাকে।
    **********


    পিন্সক (আজকের বেলারুশ)

    ধনী ব্যবসায়ী গোল্ডফারব চান না লোকে যখন তখন তাঁকে এসে বিরক্ত করে। নাথানকে বলা আছে সে যেন মাসের একটি নির্দিষ্ট দিনে তাঁর বাড়ি এসে এক রুবেল নিয়ে যায়।

    নাথান এসেছে তার প্রাপ্য রুবেলটি নিতে। দরোজায় প্রহরীরা আটকাল। আজ ভেতরে যেতে দেওয়া যাবে না -গোল্ডফারবের মেয়ের বিয়ে।

    দ্বাররক্ষীর প্রতি নাথান: সেই কারণে আমি আমার পাওনা রুবেলের কথা ভুলে যাব? মেয়ের বিয়ে দেবেন তিনি আর লোকসানটা হবে আমার?
    **********


    স্টেটেলের ব্যবসায়ী গোল্ডেনবেরগ নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করেছেন। সব পাওনাদারকে প্রাপ্য অর্থের দশ শতাংশ দিয়ে ঋণমুক্ত হবেন। তাঁর দোকানে শ্লয়মের আবির্ভাব হল। সে নিয়মিত সেখানে কিছু পেয়ে থাকে।

    গোল্ডেনবেরগ : জানো না আমার ব্যবসা লাটে উঠেছে?
    শ্লয়মে : অন্য সকলের মতো আমিও জানি।
    গোল্ডেনবেরগ : তাহলে হাজির হয়েছ কেন? কিসের আশায়?
    শ্লয়মে : আমাকে আপনি মাসে মাসে যা দিতেন তার দশ শতাংশ দেবেন, রুবেল প্রতি দশ কোপেক! যেমন আপনার সব পাওনাদারকে দিচ্ছেন।
    **********


    গ্লাসগোর ইহুদি ছেলে ষ্টেফান ডাইকস (এককালের পোলিশ ইহুদি, ডিকারহফ নাম বদলে ডাইকস হয়েছে এক পুরুষ আগে) ছিল আমাদের ব্যাঙ্কের গ্র্যাজুয়েট ট্রেনি। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমরা খুঁজে এনেছি এমনি অনেককে। ব্যাঙ্কের ভবিষ্যৎ এদের হাতে । আমি বলতাম তোমরা আমার পেনশনের সুরক্ষার দায়িত্ব নেবে একদিন! কলকাতা বিশ্ব বিদ্যালয়ের কাঁটাকল ক্যাম্পাসে অর্থনীতির পাঠ শেষে আমার নিজের কর্ম জীবনটাও এইভাবে শুরু হয়েছিল ষ্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়াতে। তাই এদের সঙ্গে সহজেই আত্মীয়তা গড়ে ওঠে।

    ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কিং আর আন্ডার রাইটিঙের (যেখানে আমরা আমাদের খদ্দেরকে বাজার থেকে ঋণ যোগাড় করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকি – সেটি তুলতে পারলে ভালো ফি মেলে। না পারলে হাতে হ্যারিকেন) বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম ষ্টেফানকে। আমরা ভবিষ্যতদ্রষ্টা নই। তবে ঋণ দাতাদের- তা সে ব্যাঙ্ক হোক আর কোন তহবিল বা ফান্ড হোক- মেজাজ মরজি, ট্যাঁকের জোর অধ্যয়ন করে সে পরিমাণ টাকা বাজার থেকে তোলা যাবে কিনা তা নিয়ে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছুই। আমার কর্তারা মনে করেন এই দূরদৃষ্টি আমার কর্মসূচীর অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু শেষ অবধি সেটা জুটবে কিনা সেটি অনিশ্চিত থেকে যায়। আমাদের কোন ডিল বাজারে আনার সময় (যাকে বলে লঞ্চ) আকছার আমার সহকর্মীদের বলেছি – লেট আস প্রে! পার করো আমারে!

    তখন ষ্টেফান এই গপ্পটি ছাড়ল।

    সোমবারের সন্ধ্যেয়। সিনাগগে মারিভা, দিনের শেষ প্রার্থনা।

    সেদিন এই শ্নরারের বিশেষ সুবিধে হয় নি। অনেকের দোরে তার করাঘাত বিফল হয়েছে। এখন সিনাগগের সামনের সারিতে বসে বিড়বিড় করে যাচ্ছে ‘ঈশ্বর, আজ আমাকে অন্তত দুটো পাউন্ড পাইয়ে দাও। একটু দয়া করো'।

    পেছনে বসে ছিলেন বৃহৎ ব্যবসায়ী মরগেনগোল্ড। তিনি পাশ থেকে হাত বাড়িয়ে দুটো পাউনড সেই মানুষটির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন - "এই নাও তোমার দু পাউনড। এখন চুপ করে বোসো । ঈশ্বরকে ঘাঁটিও না। তাঁকে বৃহৎ অঙ্কের টাকার কথা ভাবতে দাও।"

    ষ্টেফান একটু হেসে বলল ‘ ওই সামনের সারির লোকটার দাবি কম। অল্পে খুশি। আর আপনি হলেন ওই মরগেনগোল্ডের মতন। রাঘব বোয়াল মক্কেলকে বিশাল অর্থের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বা আন্ডার রাইটিং করে ফেঁসে আছেন! এখন প্রভু আপনার ভরসা! তাঁকেই বড়ো নম্বর ভাবতে হবে‘।
    **********


    প্যারিসে রোটশিল্ডের অফিসে এসে হাজির হয়েছে কাসরিলেভকার এক শ্নরার, গ্রুন।

    গ্রুন: জানি আপনার অর্থের অভাব নেই। কিন্তু একমাত্র আমি আপনাকে চিরন্তন জীবনের রহস্যটি খুলে বলতে পারি।

    রোটশিল্ড: কত লাগবে?
    গ্রুন: বেশি নয়, তিনশ রুবেল।
    রোটশিল্ড: শেষ দর?
    গ্রুন: এর চেয়ে সস্তায় চিরন্তন জীবন পাওয়া যায় না সার।
    রোটশিল্ড গুনে গুনে তিনশ রুবেল দিলেন।
    রোটশিল্ড: এবারে রহস্য উন্মোচন করুন!
    গ্রুন: আপনি যদি চির জীবন লাভ করতে চান, এই ব্যস্ত প্যারিস শহর ছেড়ে আমার সঙ্গে কাসরিলেভকা চলুন। সেখানে বাসা বাঁধুন। কাসরিলেভকায় আজ পর্যন্ত কোন ধনী মানুষের মৃত্যু হয় নি।

    সূত্র: শলেম আলাইখেম
    **********


    সাবাথের সন্ধ্যেয় ধনী সিলবারবেরগের বাড়িতে দুই শ্নরার, তরুণ শ্লয়মে এবং বয়স্ক ময়শে আমন্ত্রিত। সারা সন্ধ্যে ময়শে নানা রকম কৌতুক এবং রঙ্গ রসের গল্প করে পরিবারের মনোরঞ্জন করল। তাদের পরিবারের জন্য খাবার দাবার সহ পুঁটলি বেঁধে দিয়েছেন গৃহকর্ত্রী। সে পুঁটলি কাঁধে ফেলে অন্ধকার মাঠ পার হয়ে দুজনে আপন গ্রামে ফিরে যাচ্ছে।

    শ্লয়মে: ময়শে, তুমি যে কত রকমের গল্প, কত হাসি ঠাট্টা জানো! আমি যদি তার অর্ধেক জানতাম!
    ময়শে: ভাবিস নে শ্লয়মে। বয়েস বাড়লে দেখিস অভাবের তাড়নায় সব রসিকতা শিখে যাবি।
    ছবি: র২হ
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ২৪ জুলাই ২০২১ | ২৬৬১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • b | 14.139.196.12 | ২৪ জুলাই ২০২১ ১৬:০৪496057
  • শেষ গল্পটা মারাত্মক। 

  • হীরেন সিংহরায় | ২৪ জুলাই ২০২১ ১৬:৪০496058
  • শ্রী ব 


    ঠিক তাই। বাহিরে যার হাসির ছটা ভিতরে তার চোখের জল ।  

  • শান্তা সান‍্যাল ( ভাদুড়ী ) | 2409:4060:102:7cb5::1262:68ad | ২৪ জুলাই ২০২১ ২২:২৮496063
  • প্রতিটা পর্বে ই নতুন নতুন বিষয় জানা যাচ্ছে। সঙ্গে মজাদার রসিকতা। এবারে ও তার ব‍্যতিক্রম নেই। রুবিনের বাজনা ,বা , গেলেস‌ ও  ডাক্তারের গল্পোটি বেশ সরস, হাস‍্যরসাত্মক। ময়শের কথা সার্কাসের ক্লাউন, রাজাদের বিদুষক বা ভাঁড়েদের কথা মনে করিয়ে দেয়।

  • Ramit Chatterjee | ২৪ জুলাই ২০২১ ২৩:৩৮496065
  • দারুণ লাগলো 

  • গবু | 223.223.138.37 | ২৬ জুলাই ২০২১ ০৯:৫৫496104
  • দুর্দান্ত সিরিজ হচ্ছে এটা। 

  • syandi | 45.250.246.59 | ২৬ জুলাই ২০২১ ২১:২১496111
  • এi সিরিজের লেখাগুলি পড়ার জন্য অপেক্ষায় থাকি। 

  • tuhin kumar bhowmick | ২৭ জুলাই ২০২১ ০৯:২১496124
  • খুব ভালো লেগেছে . ইহুদি সমাজ সম্পর্কে অনেক জানা হলো .

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন