ক্ষোভ জমে ছিল অনেক দিন ধরেই। নরেন্দ্র মোদির কার্যকলাপ ক্ষোভ তৈরি করার মতোই, এ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নাই। মোদি সাম্প্রদায়িক বিভাজন শুধু করে নাই সম্ভবত এক মাত্র নেতা এই অঞ্চলের যিনি তা নিয়ে গর্বও করেন। বাবরি মসজিদ কিংবা নাগরিকপঞ্জি তৈরি করা এসবের যে একটা প্রভাব আমাদের দেশে পরে তা আমরা বা এই উপমহাদেশে বাস করে এমন অনেকেই জানে। কোন অদ্ভুত কারণে এই ক্ষেত্রে সবাই একটা ভারসম্য তৈরির চেষ্টা করে। ওইদিকে মুসলিম মরেছে এদিকে দাও দুইটা হিন্দু মেরে! মসজিদ ভেঙেছে দাও মন্দিরে আগুন। এতে কবে কোথায় কোন মুসলিমের উপকার হয়েছে তা আমার জানা নাই। তবে এই ধারা যে চালু আছে তা আমরা জানি। সব মিলিয়ে মোদি বাংলাদেশে আসলে প্রতিবাদ হবে এইটা সহজেই অনুমান করা গেছে।
প্রতিবাদ হচ্ছিল। সরকারের চাপে হোক বা কৌশলে হোক হেফাজতে ইসলাম মোদি দেশে আসার আগে আগে জানাল যে তারা ২৬ তারিখ মাঠে থাকবে না। অন্য বাকি যে দল গুলো মানে সাকি, নুরুর দলের সারা জীবন লেগে যাবে এত মানুষ জোগাড় করে এত বড় আন্দোলন করা। ২৬ তারিখ ঢাকায় এরপরে যা হল তার দায় দায়িত্ব তবে কে নিবে? ঢাকায় পুলিস যে কড়া মনোভাব দেখাল তারও যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। বায়তুল মোকারম থেকে তাদের বের হতেই দেওয়া হল না। আর ধর্ম প্রাণ মুসুল্লিরা নামাজ শেষেই শান্তিপূর্ণ ভাবে লাঠি, ইট নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল! এমন তরিকার শান্তিপ্রিয় মুসুল্লি পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।
মূল সংঘর্ষ হল চট্টগ্রামের হাটহাজারি আর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়র সরাইলে। উগ্র হয়ে উঠল মানুষ। তুমুল সংঘর্ষ। প্রাণ চলে গেল পাঁচজনের! কী ভয়ঙ্কর কথা! প্রাণ গেল কিসের জন্য? মোদি দেশে আসল বলে? এইটা হাস্যকর কারণ না একটা? প্রশাসনের যুক্তি কী আমি জানি না। কোন পর্যায়ে গেলে গুলি চালানো যায় এগুলা যারা বিশেষজ্ঞ তারাই হিসাব করুক। আমি কারণটা বুঝতে চাচ্ছি। মোদি দেশে আসলে বা না আসলে আমাদের মানে আমরা বাংলদেশি যারা আছি তাদের কী লাভ ক্ষতি হয়ে যেতো? মোদির সফর বাতিল হলে ভারতের মুসলিমদের সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যেত? বাবরি মসজিদের রায় পাল্টে যেত? এই আন্দোলন থেকে আসলে কী চাচ্ছিল হেফাজত বা অন্য আন্দোলনকারীরা? বিশ্বকে জানান দেওয়া যে আমরা ওই দেশে যে অন্যায় হয়েছে তার প্রতিবাদ করেছি? তা তো হয়েছিলই, তাহলে? আর কী চাচ্ছিল আন্দোলনের নেতারা? এই দেশে আন্দোলন করে দেশ যদি নরক বানিয়েও দেওয়া হয়, যদি টানা আন্দোলনে জনজীবন স্তব্দ করেও দেওয়া হয় তাহলেও কী ভারতের রাজনীতি বা তাদের পররাষ্ট্রনীতি পরিবর্তন করা সম্ভব? তাহলে কোন যুক্তিতে মোদিকে ফেরাতে আমার দেশে আগুন জ্বলবে? কেন আমার দেশের মানুষের প্রাণ যাবে?
এর উত্তরে আওয়ামীলীগের স্বভাব সুলভ যে উত্তর, কেউ কিছু করলে তা স্বাধীনতা বিরোধী বলে ট্যাগ দিয়ে দেওয়া সেই ট্যাগ লাইনেই আমাদের যেতে হচ্ছে। কিছু করার নাই, এদের কার্যক্রম বাধ্য করছে আমাদের ওই লাইনে চিন্তা করতে। আজকে গত শুক্রাবারের ঘটনার প্রতিবাদে হরতাল দিয়ে ছিল হেফাজত। ঢাকা মোটামুটি শান্ত ছিল। কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যা হয়েছে তা রীতিমত চমকে দেওয়ার মত ঘটনা। এরা সুরসম্রাট আলাউদ্দিন খাঁ সঙ্গীতাঙ্গনে আগুন দিয়েছে, সরকারি গ্রন্থাগারে আগুন দিয়েছে, রেললাইন উপড়ে ফেলেছে, দেশের সবচেয়ে আধুনিক ও অত্যন্ত জরুরি ট্রেন সোনার বাংলা এক্সপ্রেসের সমস্ত জানালার কাচ ভেঙেছে হরতাল সমর্থনকারীরা। কেউ কি আমাকে বুঝাবে এর সাথে মোদির সফরের সম্পর্ক কোথায়? কিংবা শুক্রবারের সংঘর্ষের সময়, যেদিন আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করছি গর্বের সাথে সেদিন কী করে কেউ বঙ্গবন্ধুর মুরালে আগুন দেয়? এখন কেউ যদি এর সাথে স্বাধীনতা বিরোধীদের যোগসূত্র খুঁজে পায় তাহলে দোষ দেওয়া যাবে? আমি অন্তত কোন দোষ খুঁজে পাব না এতে।
এখন কি হেফাজতের নেতারা খুশি। কারণ তারা তীব্র আন্দোলন তৈরি করেছে। মানুষ মরেছে, পুরো দুনিয়া দেখেছে মোদি আমাদের দেশে কত অজনপ্রিয়, মানুষ কত তীব্র ভাবে মোদির সফর ত্যাগ করেছে।পুলিসের ভূমিকায় তাদের এই কাজ সফল ভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এখন? এর চেয়ে বড় প্রচার তো আর সম্ভব না, তাই না? পুলিস যদি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকত, আপনারাও চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলে তো এমন দৃশ্য পেত না কেউ, তাই না? হেফাজত বা আন্দোলনকারীরা যা চেয়েছে তা পেয়েছে, এখন কী হবে? যে পরিবার গুলো তাদের প্রিয়জন হারিয়েছে তাদেরকে কি হেফাজতের নেতারা গিয়ে বলবে আপনার সন্তানের, আপনার প্রিয়জনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমাদের আন্দোলন পুরো দুনিয়ার নজরে এসেছে? এবং এতে করে ওই পরিবারের সবার মনে শান্তি নেমে আসবে? সাথে এই নেতারা কি এটাও বলবে যে এই আন্দোলন আসলে কোন উপকারে আসে নাই। যে ঘটনার জন্য এই প্রতিবাদ তার উপরে খুব একটা প্রভাব পড়বে না! বরং এই দেশে কত উগ্র ধর্মালম্বীরা বাস করে এইটা প্রমাণ করে মোদি আরও বেশি করে সাম্প্রদায়িকতার প্রচার ও প্রসার করে যাবে! এমন কী এর প্রভাবে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের ফলাফলেও পার্থক্য তৈরি হতে পারে! এই খবরে নিশ্চয়ই নিহতের আত্মা শান্তি পাবে?
হেফাজতকে আজকের দিন পর্যন্ত আনার দায় আওয়ামীলীগের। ধীরে ধীরে ফ্রাংকেনস্টাইন তৈরি হয়েছে। আজকে যখন দানব হুঙ্কার দিতে চায় তখন সব দোষ দানবের। দানব তৈরি করল কে তার কোন দোষ নাই! হেফাজতেরও বুঝা উচিত অরাজনৈতিক তকমা লাগিয়ে নানান ইস্যুতে তারা যে ঝাঁপিয়ে পরে এবং প্রতিবারই যে আন্দোলন একটু বাড়তেই তা সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ দিতে চেষ্টা করে কেউ, তা কেন করে এবং তারা কারা? যখন তখন যে কেউ তাদের আন্দোলনের লাগাম নিয়ে নিচ্ছে আর ওরা বেদুম মার খাচ্ছে। লাভের গুড় কে খাচ্ছে তা বুঝতে না পারলে মুশকিল।
হেফাজতের উচিত তাদের অবস্থান পরিষ্কার করা। আসলে এরা কী চায়? যদি জামাতের জায়গাই নিতে হয় তাহলে হেফাজতের উচিত জামাত থেকে শিক্ষা নেওয়া। আজকে জামাত কোথায় এটা নিশ্চয়ই কারো অজানা না! হেফাজতের মূল পুঁজি হচ্ছে ধর্ম। খুব অনুভূতিপ্রবণ মানুষ এদেশের। সুযোগ পেলেই এই অনুভূতি নিয়ে খেলা বন্ধ করতে হবে। সরকারেরও উচিত এদেরকে তাদের অবস্থান সম্পর্কে পরিষ্কার ধারনা দেওয়া। এই কাজ দ্রুতই করতে হবে, যত দেরি তত ক্ষতি।
( ছবি - ডেইলি স্টার)
এই স্পষ্ট স্বর আরও দরকার।
এই মোচোল্মান গুলো একটাই ভাষা বোঝাা