মহান ষাঁড়ের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সমস্ত গ্রামটা তুলকালাম হয়ে উঠলো! যথারীতি পক্ষ হবার কথা ছিল দুটো! কিন্তু এই মহান ষাঁড়ের বেলায় পক্ষ হল আড়াইটা! আড়াই নম্বর পক্ষটা পুলিশ! তারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখল কিংবা তামাশা দেখা ছাড়া উপায় ছিল না! কেননা হানাহানিতে নেমে আসা দুই পক্ষের লোকের সংখ্যার সামনে পুলিশ এবং তাদের কার্তুজের সংখ্যা সিকি পরিমাণ! জমায়েতের মূলপক্ষ দুই ভাগ হয়ে ছিল যথারীতি দুটো বিখ্যাত ধর্মীয় লোগোর আবডালে! এক পক্ষ বলল, এই মহান ষাঁড় আমাদের ধর্মের! তাকে আমরা শেষ বিদায় জানাবো আমাদের আচার অনুযায়ী! অন্যপক্ষ বলল, মোটেই না উনি, মানে মহান ষাঁড় জন্মেছিলেন আমাদের সম্প্রদায়ের শান্তিবাহন হয়ে! ফলে একদল মুচি এসে কিছুক্ষণ পুরো ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করলো এবং বুঝে ফেলল, এখানে চামড়ার দামের চেয়ে মূল্যবান অনুভূতি সরব, ফলে তারা সটকে পড়লো! জুবুথুবু পুলিশেরা শুধু ওয়াকিটকিতে কেন্দ্রে খবর জানাতে লাগলো যে, উদ্ভুত পরিস্থিতি সংঘাতের দিকে ধাবমান, এহেন হালত নিয়ন্ত্রণে আরও ফৌজ পাঠান অন্যথায় আমাদের সরিয়ে নিয়ে বাঁচান!
দুই পক্ষ মাইকে চিৎকার দিয়ে বলতে লাগলো এই ষাঁড়ের মহাত্ম! কেউ কেউ তার শৈশবের স্মৃতি খুলে বসলো, কিভাবে সে ষাঁড়কে খাবার দিয়েছিলো কিংবা কেউ কেউ বলল, মানত করে ষাঁড়কে ঘাস খাওয়ানোর পর তার মানত পূর্ণ হবার আধিলৌকিক কাহিনী! কিন্তু সব থেকে ভালো ব্যাপার ছিল, এইসব বাকোয়াজি, চিৎকার কেউই মনোযোগ দিয়ে শুনছিল না! মাঝখানে মাঠের মধ্যে ষাঁড়টা পরে থাকলো আর আকাশে কয়েকটা শকুন ড্রোনের মতো ঘোরাঘুরি করে টের পেয়ে গেলো মানুষই একে ছিঁড়ে খাচ্ছে! কিন্তু লগডাউন ভেঙে জামায়েত হওয়া এইসব মানুষদের আবেগকে ছুঁড়ে ফেলতে না পেরে স্থানীয় নেতারা এসে বলল, আপনারা যা-ই করেন্না কেন মুখে মাস্ক এবং হাতে গ্লোভস্ পিন্দে করবেন! তারপর তারাও এই গ্রামের কল্যাণে এই ষাঁড়ের অবদান এবং যারতার ক্ষেতের বেড়া ভেঙে ঢুকে পরার যে অবাধ পাসপোর্ট ভিসা এই ষাঁড়ের ছিল সেই মহাত্ম বর্ণনা করে ক্ষান্ত হলেন! সাংবাদিকেরা ছিল সবচে ব্যস্ত! তারা চারদিকে এতো নিউজের ভিড়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলতে লাগলো এবং তারা জানলো যে, করোনা ভাইরাস থেকে গ্রামকে বাঁচানোর জন্য ষাঁড় কমিটি থেকে ষাঁড়ের গলায় মন্ত্রপড়া ঘণ্টা বেঁধে দেয়া হয়েছিল সপ্তাখানেক আগে! ফলে সারা গ্রাম ষাঁড়টা ঘুরে বেড়াতো আর তার ঘণ্টার শব্দে করোনা ভাইরাস ঘাঁটি গাড়তে পারতো না গ্রামের কোথাও! কিন্তু দুপুরের দিকে যখন সূর্য তার তাপ দিয়ে সবাইকে কাহিল করে ফেলতে শুরু করলো তখন ভিড়ের মধ্যে একজন মাথা ঘুরে পরে যাবার কিছুক্ষণের মধ্যে শোনা গেলো প্রতিপক্ষ নাকি বান নিক্ষেপ করে লোকটাকে ফেলে দিয়েছে এমন গুঞ্জন এবং তার জ্ঞান না ফেরায় মুহূর্তের মধ্যে হাঙ্গামা লেগে গেলো! ফলে সঙ্গে বয়ে আনা দাউ সড়কি বল্লম কিংবা তীর জাতীয় দেশীয় অস্ত্রের এস্তেমাল শুরু হল আর সাংবাদিকেরা পুলিশের কাছে এসে বলল, এখন কি হবে? পুলিশ বলল, ইয়া নফ্সি ইয়া নফ্সি করেন আর ছবি তুলেন! কিছুই করার নাই!
সন্ধ্যায় রক্তারক্তি শেষ হলে হাঁসপাতালের বারান্দা ভরে উঠলো রক্তাক্ত ষাঁড়প্রেমী যোদ্ধাদের ভিড়ে! তাদেরকে দেখতে এলো জাতীয় ষাঁড় কমিটির নেতারা এবং তারা দুইপক্ষেকে আশ্বাস দিয়ে গেলো উচ্চতর তদন্ত হবে এই ঘটনার! কিন্তু ষাঁড়টার কোন ব্যবস্থা হল না, মুচিদের দলটা আবার এসে একটা বাগানের আড়ালে দাঁড়িয়ে বুঝতে চেষ্টা করলো সমাজ সেবার দায়িত্বটা তারা তুলে নেবে নাকি কর্পোরেশন? সাংবাদিকেরা সারা দেশে এই সংবাদের ডজন ডজন ফটেজ ছড়িয়ে দিলো! সেইসব ফুটেজে দেখা যায় উল্লাসিত তরুণেরা হল্লা করে জানাচ্ছে, খুনোখুনির সময় সকলেই তারা মুখে মাস্ক এবং হাতে গ্লোভস্ পরে মারামারি করেছে যাতে করোনা ভাইরাসের সংক্রমন না ঘটে! ফলে আসামি হিসেবে একদল মুখোশধারী মানুষের নামে মামলা দায়ের করা হল এবং গ্রামটার নাম হল, ষাঁড়গ্রাম!
১৯ এপ্রিল ২০২০