এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  বাকিসব  মোচ্ছব

  • আহিরণ নদীর বুক ফাটে, মুখ ফোটে নাঃ ৯ম পর্ব

    Ranjan Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    বাকিসব | মোচ্ছব | ০৫ নভেম্বর ২০২০ | ১৮৮৪ বার পঠিত
  • ৮)

    আহিরণের পূবপাড়ে আজ সন্ধ্যেয় গাছগাছালি আবার চৌপালে বসেছে। বৃদ্ধবটের শরীর খারাপ, সভায় অনুপস্থিত। ওর প্রতিনিধি হয়ে এসেছে অশত্থ। আসলে বনবিভাগ থেকে কয়েকদিন আগে কিছু মুখ্যু কর্মচারি এসেছিল। তারা কুড়ুল দিয়ে বটের গায়ে বাকল তুলে একটা চৌকো মত আকার বানিয়েছে। তাতে গরম আলকাতরা দিয়ে একটা নম্বর লিখে দিয়েছে—৫৫৭।

    মানে এই জঙ্গলে এই বটগাছটির সংখ্যা হল ওই ৫৫৭। গুণতি হচ্ছে, রেকর্ড দুরুস্তি হচ্ছে। কিন্তু বটের যে চোট লেগেছে, ঘা শুকুতে যে সাতদিন লাগছে—তার বেলা?

    সেকথা উঠতেই পাকুড় বলে উঠল—মানুষেরা এ’রকমই হয়।

    কোসম সেবারের অভিজ্ঞতা ভোলে নি, তাই মানুষের কথা উঠতেই মাথা নেড়ে সায় দেয় ,-- সে আশকথা পাশকথা যাই হোক। মানুষ নামের দু’পেয়ে জন্তুর ব্যাভার নিয়ে তার মনে কোন সন্দ নেই । বলল সেবার যখন ছুরিখুর্দ গাঁয়ের আমোল সিং বৈগা আমার বোঁটা ছিঁড়ে ফুল-পাতা নিতে এল অষুধ বানাবে বলে, তখন তো আমি তোমাদের পূজ্য পঞ্চায়েতে নালিশ করেছিলাম। কিন্তু আমার ব্যথা নিয়ে তোমরা কেউ কিছু কর নি। খালি আমার বন্ধু কাঁকড়াবিছে ওকে উচিত শিক্ষা দিয়েছিল।

    পরে যখন কোরবা থেকে ওষুধ কোম্পানির আড়কাঠি এসে জোর করে আমায় তছনছ করে সব নিয়ে গেল, তোমরা বললে কেঁদে লাভ নেই , যা হবার তা তো হয়ে গেছে। বনইমলি আমার হয়ে বলতে এলে বুড়োর দল ওকে চুপ করিয়ে দিল। উলটে বটদাদু আমাকে বোঝাচ্ছিলেন যে আমাদের নাকি মানুষজন ছাড়া চলে না । ওদের বিরুদ্ধাচরণ করে নাকি জঙ্গলে টেকা দায়। এখন হল তো? নিজের গায়ে না লাগলে অন্যের কষ্ট কেউ বোঝে না ।

    পলাশ-শিমূল যমজ ভাইয়ের মত। একসঙ্গে বৈঠকে আসে, একসঙ্গে যায়। যা বলে তা যেন আগে থেকে মহড়া দিয়ে তৈরি হয়ে এসেছে। কখনও দাঁড়ি কমা আলাদা হয় না । পলাশ বলল-- এই সব নাকে কান্না বন্ধ করে কাজের কথায় এস। আহিরণের ওপারে কোশ চারেক ওপাশে বিজলি কারখানা খুলছে; দিল্লি সরকারের। পাশেই আগারখার, দুরপা, কোসমন্দা, মনগাঁও, গেওরা –এসব জায়গায় দু’বছর আগেই জরিপ হয়ে কয়লা খাদানের কাজ শুরু হয়ে গেছে। মাটির তলায় নয়, মাটির ওপরে। এবার সেই কয়লায় এপারে বিজলি তৈরি হবে। এর জন্যে অনেক কাঠ চাই,-- বরগা, খুঁটি, বল্লী, বাতা এসবের জন্যে। তাই অনেক গাছকে মরতে হবে। এই যে গায়ে আলকাতরা দিয়ে নম্বর লেখা হচ্ছে তা আর কিছুই নয়, বলির আগে পাঁঠাদের দড়ি বেঁধে দাঁড় করিয়ে রাখা।

    যত্ত গাঁজাখুরি কথা। আগারখার, দুরপা বা কোসমন্দায় বিজলির কল বসবে তো এখানে গাছ কাটবে কেন? কে এই সব আতংক ছড়াচ্ছে? নামটা বল! তুই হতভাগা হলি এই জঙ্গলের গাছ। এর বাইরে কোনদিন পা বাড়াস নি। তুই কোত্থেকে এত সব খবর পেলি?

    গলা তুলল শিমূল।

    ওকে ধমকাচ্ছ কেন? তোমাদের সাবধান করতে এল, তো খেরে উঠলে! জেগে ঘুমুতে চাও, তো ঘুমোও। কে মানা কচ্ছে ? সেই যে বলে না –‘ভাল রে ভাল করে গেলাম কেলোর মার কাছে, কেলোর মা বলল আমার ছেলের সঙ্গে আছে’। তোমাদের হল সেই দশা।

    একটা সিড়িঙ্গে তেঁতুল গাছ আগ বাড়িয়ে বলতে গেল—এসব খবর দিল কে?

    ঝাঁঝিয়ে উঠল শিমুল। ‘তুই চুপ কর! তিনদিনের এঁড়ে, এল শিং নেড়ে’! খবর দিয়েছে শালিক, ময়না আর টিয়েপাখির ঝাঁক। ওদিকে গাছকাটা শুরু হল, তো ওদের পুরনো বাসা ভেঙে গেল। তখন সবাই দলবেঁধে এদিকের জংগলে চলে এসে কুটোকাটা দিয়ে ঘর বানানো শুরু করেছে। কিন্তু সে আর ক’দিন? এখানে দাগ পড়া শুরু হয়েছে। এর পর কুড়ুল করাত আর মস্ত মস্ত ট্রাক নিয়ে চলে আসবে ঠিকেদারের দল।

    আচ্ছা, এই দলের পান্ডা কেটা? তাকে কিছু করা যায় না ? পটিয়ে পাটিয়ে কাজটা যদি একটু ঢিলে করা যায়! তাহলে কিছুটা সময় পাওয়া যাবে।

    বড় দেশি আমগাছ আর বাবুল মুখ খুলল--একটা নতুন আস্তানা খুঁজে পেতে একটু সময় তো লাগবেই। এমন ওঠ- ছুঁড়ি-তোর-বিয়ে ধম্মে সইবে? নদীর ওপারে কোসগাই পাহাড়ের উপর দেবীর মন্দির। কোসগাই দেবী খুব জাগ্রত। উনি এমন অন্যায়ের কোন প্রতিবিধান করবেন না ?

    পলাশ বলল –আছে, লোক আছে। সরকারি কোম্পানির পাটোয়ারি ঝাড়ু সিং আর ঠিকেদার সমেলাল দেবাঙ্গন, ছুরি গাঁয়ের কাশ্যপ ডাক্তারের গিন্নি যার নাম দিয়েছে নারদমুনি। কিন্তু এদের খাঁই মেটানো তোমার আমার কম্মো নয়। আমাদের দু’একজন চেষ্টা করেছিল। তো ব্যাটা ঝাড়ু সিং হাঁকিয়ে দিল। বলল যে এসবের অর্ডার এয়েছে উপর থেকে, মানে দিল্লি থেকে। ওর পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়।

    ব্যাটা নচ্ছার! এদিকে ওর মাটির ঘর পাকা হচ্ছে, ছাদের টালি-খাপরা ফেলে ছাত ঢালাই হয়ে গেছে। এবার মেজেতে নাকি সাদা-কালো দাবাখেলার ছকের মত টাইলস বসবে।

    আচ্ছা, ঝাড়ু সিং আবার একটা নাম হল নাকি! মানুষদের যে দিন দিন কি পিবিত্তি হচ্ছে? কোথায় আগের দিনের মত মহেশ, সুরেশ, গণেশ, রমেশ বা অন্য কোন ঠাকুর-দেবতার নাম রাখবে, অন্ততঃ রাকেশ, নরেশ, দেবেশ—তা না কিসব অলুক্ষুণে ঝাড়ু, মেথর, চামার এইসব।

    অলুক্ষুণে কথাটা ঠিকই ধরেছ। আসলে ওর আগে তিন ভাইবোন জন্মেছিল। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই যমরাজ টেনে নেয়। তাই এর পরে ওর দিদির নাম হল মহেতরীন বাঈ ( মেথরানী), ওর নাম ঝাড়ু আর ছোট ভায়ের নাম চামার সিং। তারপর দেখ হাতে হাতে ফল। এমন সব যমের অরুচি বিচ্ছিরি নাম রাখায় যমরাজ আর ফিরেও তাকায় নি।

    একপাশে কখন এসে চুপটি করে বসেছিল ঠিকরে বাজ। দেখতে ছোট, কিন্তু বাঁকানো ঠোঁটে আর নখে তরোয়ালের ধার। সে ডানা ঝাপটে বলে উঠল—ফের বাজে মেয়েলি গাল-গল্প! এদিকে যে অমঙ্গল নেবে এসেছে ছুরি গাঁয়ে তার কোন খবর রাখ তোমরা?

    সবার চোখ এখন ঠিকরে বাজের দিকে। হয়েছেটা কি? আহিরণের জঙ্গলে এমন কোন খবর তো আসে নি!

    বাজের চেহারায় বিজ্ঞ বিজ্ঞ ভাব, ভাও খেয়ে সে আরও গম্ভীর। একটা কৃত্রিম মোটা ফ্যাসফেসে আওয়াজে ও বলতে শুরু করল।

    তবে শোনঃ কাঠঘোরা টু ছুরি বাস রাস্তা-- প্রায় তিরিশ কিলোমিটার -- এখন পাকা হচ্ছে। এতদিন ওমুড়োয় কোরবা থেকে দশ কিলোমিটার আর এমুড়োয় কাঠঘোরা থেকে পাঁচ কিলোমিটার পাকা ছিল । মাঝের তিরিশ কিলোমিটার পথ হল খোয়াওঠা মোরাম ঢালা কাঁচা রাস্তা যা বর্ষায় গাড়ি চলার মত নয়। কিন্তু বিজলি কারখানা তৈরি হচ্ছে, ট্রাক চলবে, সাহেব-মেমদের গাড়ি আসবে যাবে; ওদিকের গাঁয়ে কোয়ার্টার, বাজার-হাট, ইস্কুল, দোকানপাট সব বসানো হবে। তাই রাস্তা পাকা হবে।

    নবযুবক বনইমলি বিরক্ত হয়ে বলে –কাজের কথায় এস। এর মধ্যে ছুরিগাঁয়ে অমঙ্গলের ছায়া কোথায় দেখলে?

    ঠিকরে বাজ জবাব না দিয়ে এমনভাবে তাকালো যে মুরুব্বিরা চেঁচিয়ে উঠল—ভাইগে ভাইগে, খামোশ! খামোশ! কেউ মাঝখানে কথা বলবে না ।

    একটু কেশে ঠিকরে বাজ আবার শুরু করল।

    তিরিশ কিমি রাস্তায় পিচ ঢালার কাজ তিনজন ঠিকেদারকে ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল। সবচেয়ে বড় টুকরো, প্রায় পনের কিলোমিটার , পেয়েছে কোরবার ঠিকেদার মহেন্দ্রপাল শর্মা। এর মধ্যে ধনরাস-ছুরি গাঁয়ের সামনে গতকাল কাজ চলার সময় একটা ট্রাক থেকে মজদুর নামার সময় ট্রাকের চাকা সিলিপ মারে আর পালটি খাওয়া ট্রাক একটা গরম প্রায় ফুটন্ত পিচের ড্রামে ধাক্কা মে্রে ওটাকে কাত করে দেয় । রাস্তায় পড়া গাঢ় দলা দলা পিচ চিতপটাং হওয়া ট্রাকের নীচে গড়িয়ে গড়িয়ে ঢুকতে থাকে । পাঁচজন মজদুর, তিনজন মর্দ অউর দো জন অঊরত, আটকা পড়ে ছটফট করতে থাকে; বাঁচাও বাঁচাও চেঁচাতে থাকে। কিন্তু ঠিকেদারের বাকি লোকেরা ভেবে পায় নি কী করা উচিত। ট্রাকের নীচের থেকে ওদের টেনে হিঁচড়ে বার করতে গেলে নিজেরা গরম গলা গলা পিচে ঝুলসে যাবে।

    কয়েক ঘন্টা ধরে এই নাটক চলল, মানে যতক্ষণ ওদের প্রাণ ছিল , জল চাইছিল। ছুরিগাঁয়ের মেয়ে-মদ্দ ভীড় করে করুণ মুখে এই তামাশা দেখল। এখানেই শেষ নয়।

    ঠিকেদার শর্মা সরপঞ্চ সঝলা কুমারকে পটিয়ে ফেলল, উনি যেন পুলিশের এবং ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে দিব্যি গেলে বলেন যে খালি ট্রাক পালটে গেছল। তাতে কোন মানুষ ছিল না । কেউ মারা যায় নি, শুধু ড্রাইভার আহত হয়ে হাসপাতালে। শর্মা ডেডবডিগুলোকে লোপাট করে দেয় আর তাদের আত্মীয়দের বলে ওরা কাজ ছেড়ে পালিয়ে গেছে ভিনগাঁয়ে, বেশি টাকার লোভে আর কি! কোথায় গেছে? তা শর্মা জানে না ।

    এবার দেখ দেবীর কোপে গাঁ যদি ছারখার না হয়ে যায়!

    অমঙ্গলের লক্ষণ দেখা যেতে লাগল ক’দিন পর থেকে।

    ব্যাংকের কাজকম্মের মাঝে রূপেশের নজরে এল একটা খুব ফর্সা জোয়ান ছেলে আলোয়ান জড়িয়ে একটা বেঞ্চে গুটিশুটি মেরে বসে আছে। দু’ঘন্টা কেটে গেল, ভিড়ের লোকজন চলে গেছে। ছেলেটা একই ভাবে বসে আছে। অসুস্থ? জ্বরজারি নাকি? রূপেশের অস্বস্তি বাড়তে লাগল। একটু পরে চাপরাশি ঠুল্লুকে বলল—যা তো, ওকে ডেকে নিয়ে আয়, কী চাই ওর?

    ও জানাল যে একটু পরে ও ম্যানেজার সাহাবের সঙ্গে কথা বলবে, কিন্তু একলা।

    রূপেশের ভ্রূ ওপরে উঠল। কী কেস? কোন কমপ্লেন? লোন পাস করানোর নাম করে ঘুস চাওয়া? এখন তো স্টাফ মাত্র দু’জন। ফিল্ড অফিসার নতুন রিক্রুট থেকে আগামী মাসে পাওয়া যাবে। এদের মধ্যে ঘরশত্রু বিভীষণটি কে? রাজন নাকি ঠুল্লু? তবে লোনের কাগজপত্রে ঠুল্লুর হাত পৌঁছয় না । রাজনের সুযোগ বেশি। ও ডকুমেন্ট ফিল আপ করে। তাহলে তো রাজনকে এখান থেকে সরাতে হবে। দু’পক্ষের স্টেটমেন্ট নিয়ে প্রাইমা ফেসি কেস মেঁ দম হ্যাঁয় মনে হলে ওকে সাস্পেন্ড করিয়ে ডিপার্টমেন্টাল ইনভেস্টিগেশন করার রেকমেন্ডেশন পাঠাতে হবে হেড অফিসকে। দু’মাস আগেই ও বিলাসপুরের স্টেট ব্যাংক ট্রেনিং সেন্টারে ফ্রড, ইনভেস্টিগেশন ও ডিপার্টমেন্টাল এনকোয়ারি নিয়ে একটা সাতদিনের ক্যাপসুল কোর্স করে এসেছে। এর মধ্যেই সে নতুন শেখা বিদ্যেটি কাজে লাগানোর সুযোগ এসে গেল! হে ভগবান!

    রাজনকে যে ও খুব পছন্দ করে। কিন্তু তাবলে কি চোখ বুঁজে থাকবে? মাই স্টাফ, রাইট অর রং ! তাহলে ন্যাচারাল জাস্টিসের কী হবে? প্রাকৃতিক ন্যায়?

    ও হ্যাঁ, প্রাকৃতিক ন্যায় তো বলে কাউকেই তার পক্ষ না শুনে সাজা দেওয়া উচিত নয়। দ্যাট উইল বি এ ট্র্যাভেস্টি অফ জাস্টিস। ঠিক, নালিশটা শোনার পর রাজনের কী বলার আছে তা ও শুনতে হবে। আগে থেকেই কেন ওকে দোষী মনে করছি? নাঃ, এই বায়াসড এই পূর্বাগ্রহ ঠিক নয়। আমার মনটাকে ক্লিন শ্লেটের মত রাখতে হবে।

    এই যে শোন, এদিকে এসে আমার সামনের চেয়ারটাতে বস। এবার বল। কী কমপ্লেন তোমার? আমার ব্যাংকে কী অসুবিধে হচ্ছে?

    সাহেব, আমার লোন চাই।

    আচ্ছা, কত টাকা?

    সাহেব দশ হাজার।

    কবে অ্যাপ্লিকেশন দিয়েছ? কার হাতে? আমার ব্যাংকে কিসী কে সাথ বাত কিয়া?

    না না , আজই প্রথম আপনার ব্যাংকে এলাম। কেউ জানে না , আমার বাড়িতেও না ।

    কী নাম তোমার? দশ হাজার অনেক টাকা। কী বিজনেস করতে চাও?

    মুন্নালাল দেবাঙ্গন, আমরা তাঁতি। বিজনেস নয়, এই টাকাটা আমার চিকিৎসায় খরচা হবে।

    মানে? কী হয়েছে তোমার?

    আমি দিন প্রতিদিন দুর্বল হয়ে যাচ্ছি। শরীরে রক্ত কমে যাচ্ছে। কোন কাজ করতে পারি না । ঘরে দুটো খটখটা (পিট লুম), তাতে দুই হাতের সঙ্গে দুই পা’ও চালাতে হয়। পেরে উঠছি না । রাত্রে জ্বর আসে।

    রূপেশ ভাল করে ওর অস্বাভাবিক হলদেটে চেহারা, নিস্তেজ চোখ ও ফিসফিস করে কথাবার্তা খেয়াল করে। --শোন, তুমি কোরবায় সরকারি হাসপাতালে যাও। রক্ত পরীক্ষা করাও। বিনে পয়সায় হয়ে যাবে। তখন ধরা পড়বে কী হয়েছে।

    মুন্নালাল আরও এগিয়ে আসে। ফিসফিস করে বলে—না মালিক, আমি জানি আমার কী হয়েছে। আসল হল আমার বৌ। ও হল টোনহী, আমার রক্ত শুষে নিচ্ছে। তাই দিন দিন কমজোর হো রহা হুঁ। চেহরা পীলা পড় গয়া হ্যাঁয়।

    এ কোন দুনিয়া! রূপেশ চেনে না।

    ও দুর্বল গলায় বলে—আমি কী করতে পারি? কোন ধান্ধা অথবা রোজগারের জন্যে ছাড়া কী করে লোন দেব?

    ছেলেটা রূপেশের হাত ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।

    মালিক, আপনি আমায় বাঁচান। এই টাকা নিয়ে আমি যাব রায়পুরে মীরা দাতারের দরবারে। সেই দরগায় এইসব কালাজাদুর চিকিৎসা হয়। একমাস থেকে ইলাজ করিয়ে তবে ফিরব। তাই টাকাটা চাইছি, হুজুর, ফিরিয়ে দেবেন না ।

    জোশী মহারাজ বলেছিলেন – বিপদা অকেলে নহী আতী। আপদ-বিপদ কখনও একা আসে না । আরও বলেছিলেন যে বুরে ওয়ক্ত সাবধানে মাথা নীচু করে পার করতে হয়। গোঁয়ার্তুমি করে লাভ হয় না । যব ওয়ক্ত পর গয়ে বাঁকা, তো গধে কো বোলো কাকা! সময় খারাপ হলে, লোকে গাধাকেও কাকা বলে।

    উনি পাঠিয়েছিলেন ভগতরাম রামায়ণীকে ওর পাঠশালার জন্যে লোন চাইতে। তা ব্যাংক ম্যানেজার ওকে বেয়ারিং চিঠির মত ফেরত পাঠিয়েছে। বিকেল বেলা পেতলের গেলাসে কালো গরুর দুধ চুমুক দিয়ে খেতে খেতে উনি ভগতরামের দুঃখের কথা শুনলেন। এও শুনলেন যে উনি জামিন হবেন জেনেও ব্যাংক ম্যানেজার টস-সে-মস নহীঁ হুয়ে। এবম্বিধ ব্যবহারে কি গুরু মহারাজের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করা হয় নাই? উনি যে এই এলাকার মারোয়াড়ি সমাজের গুরু।

    দু’সপ্তাহ পরে রূপেশ বিলাসপুরের ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টরের অফিস থেকে একটি চিঠি পেল। তাতে রামায়ণীর নালিশের উল্লেখ করে বলা হয়েছে গ্রামীণ ব্যাংকের ছুরি শাখা কি সত্যিই ন্যায়প্রার্থী ভগতরামের স্কুলের জন্যে লোন দিতে অস্বীকার করেছে? করে থাকলে তার কারণ জানিয়ে সাতদিনের মধ্যে উত্তর দিক।

    রূপেশ সেই দিনেই উত্তর দিনে জানিয়ে দেয় যে ওর ব্যাংকের বর্তমান ঋণনীতি অনুযায়ী পাঠশালার জন্যে ঋণ দেবার কোন বাজেট নেই । আর ওই পাঠশালাটি ইতিমধ্যেই সরকারের ‘বালবাড়ি’ প্রজেক্টের অন্তর্গত অনুদান পেয়েছে। ফলে ওদের আর কোন ফান্ডের দরকার নেই । এবং ঋণ আবেদনে ক্যাশ চাওয়া হয়েছে, অথচ সেই টাকা কী কাজে খরচ হবে তার কোন স্পষ্ট প্রপোজাল নেই ।

    এর দুদিন পরে জোশী মহারাজ ওকে ডেকে ঘরে বসিয়ে চা খাইয়ে বুরে দিন কেমন করে কাটাতে হয় তার উপদেশ দিলেন। রূপেশ ভেবে পেল না কাকে ‘কাকা’ ডাকতে হবে। তার ঠিক একদিন পরে রামায়ণী এসে হাজির। সঙ্গে এক মহিলা। ওর পাঠশালার প্রধান শিক্ষিকা। রামায়ণী পান চিবুতে চিবুতে বলল – সেই তো ফজিহত হল। আগেই আমার কথা শুনলে এই ‘বুরে দিন’ দেখতে হত নয়া।

    --বুঝলাম না ।

    --কেন? কালেক্টরের অফিস থেকে আপনার কাছে আমাকে লোন দেওয়ার আদেশ আসে নি?

    -- না তো!

    -কিঁউ ঝুট বোল রহে হো, সাব? আমি বিলাসপুরে ওদের অফিসের ডেসপ্যাচ রেজিস্টার দেখে এসেছি। ওরা তো বেশ কয়েকদিন আগেই আপনাকে চিঠি দিয়েছে। আমাকে কপিও দিয়েছে।

    --ও হ্যাঁ; চিঠি তো এসেছিল। তার জবাব ও পাঠিয়ে দিয়েছি।

    --তার কপি? কী লিখেছেন?

    -- ওখান থেকেই নিয়ে নিন। তবে আপনাকে লোন দেব বলি নি।

    বজ্রাহতের মত দাঁড়িয়ে থাকে রামায়ণী। তার পর করুণ স্বরে বলে—কেন রাগ করছেন সাহাব? কুছ লে দে কর মামলা খতম কীজিয়ে না ! দোনো কা ভলা হো জায়ে।

    -রাগ করি নি তো। আসলে আমি খুব ছোটা আদমী। মামলা এখন কালেক্টরের কোর্টে; আমার হাতের বাইরে। এবার আপনাকে ওনার অফিস থেকেই লোন নিতে হবে।

    সেদিন বিকেলে খবর এল যে মুন্নালাল দেবাঙ্গন ‘রক্তাল্পতায়’ ভুগছিল, মারা গেছে। ঠুল্লু বিকেলের চা দেওয়ার সময় বলল—সাহাব, এটা আপনার ভুল। ওকে মীরা দাতারের দরগায় চিকিচ্ছের জন্যে দশ হাজার টাকা লোন দিলে ও সেরে উঠত। ওর বৌ সত্যি সত্যি ওর রক্ত শুষে নিচ্ছিল। আসলী চুড়েল। পাক্কা ডাইনী।

    রূপেশের মন খারাপ হয়ে গেল। খালি হাতে ফিরে যাওয়ার সময় মুন্নার হলদেটে চোখের হতাশ চাউনি ওর স্বপ্নে বারবার ফিরে আসবে।

    কিন্তু খারাপ সময় এত তাড়াতাড়ি শেষ হয় না । তিনদিন পরেই কাঠঘোরা থানা থেকে কালো গাড়ি ভরে সাতজন সেপাই আর জিপে করে থানেদার হাজির। বাজারের কাছে বুড়ো সীতারাম আগরওয়ালকে আজ সকালে নিজের ঘরের আঙিনায় কুয়োর বাঁধানো পাড়ে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। ধুতি-বানিয়ান পরা নিঃসন্তান বিপত্নীক বৃদ্ধ কুয়োর মধ্যে গলা বাড়িয়ে কিছু দেখার অবস্থায় পড়ে আছেন। গলায় কালশিটে । দুপুর নাগাদ দারোগা সদলবলে হাজির হল ব্যাংকে। এই ব্যাংকে বুড়োর কোন টাকাপয়সা জমা আছে কি না , থাকলে কত, তাতে কোন নমিনির নাম আছে কি না !

    ঠুল্লু জনান্তিকে বলল—সাহাবের এখন সাড়ে সাতি’র দশা চলছে।

    ৯ কালসর্পযোগ!

    কাঠঘোরা থানার থানেদার বা স্টেশন অফিসার অজয় ডোঙ্গরের মেজাজটা সকাল থেকেই খিঁচড়ে আছে। আজ মহাশিবরাত্রি। গিন্নি উপোস রেখেছেন। সকালে এক কিলোমিটার দূরে আহিরণ নদীর পাড়ে শিবমন্দিরে গিয়ে ভোলেনাথের মাথায় জল ঢেলে ঘরে ফিরে তবে দাঁতে কিছু কাটবেন। এদিকে ডোঙ্গরেজীর বেশিক্ষণ খালি পেটে থাকা পোষায় না। তবে বেটার হাফ যখন না খেয়ে রয়েছে, পুলিশ বলে কি চক্ষুলজ্জা থাকবে না? কাজেই উনি অপেক্ষা করছেন কখন অর্ধাঙ্গিনী কপালে আশীর্বাদি ফোঁটা লাগিয়ে প্রসাদ নিয়ে ফিরবেন, তখন পুরি-সব্জি সাঁটিয়ে খাতায় রওয়ানগি লিখে ছুরি গাঁয়ে যেতে হবে। একটা কাজ আছে।

    আজ ওখানকার স্কুলের মাঠে ছাত্র বনাম সরকারি অফিসারদের একটা ক্রিকেট ম্যাচ খেলার কথা, সরকারি টিম বলতে ন’জন টিচার, তার আদ্দেক কোনদিন ব্যাট ছুঁয়ে দেখে নি। হয়ত বচপনের দিনে ডান্ডা-গিল্লি খেলেছে। তবে উনি কলেজ টিমের প্রাক্তন কীপার প্লাস ব্যাটসম্যান, আর গ্রামীণ ব্যাংকের ম্যানেজার ভদ্রলোক নাকি ভিলাইয়ের স্কুলের অফস্পিনার ছিল।

    এর মধ্যে এক উটকো আপদ; ছুরি গাঁয়েতেই কাল একটা খুন হয়েছে। গতমাসে একটা বানিয়া বুড়োর সন্দেহজনক মৌত, তারপরে এই কান্ড!

    থানেদারের কি দোষ! উনি মাত্র গত বছর পুলিশের চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। কয়েক মাস শিক্ষানবিশীর পর প্রত্যন্ত এলাকায় একটা থানায় কিছুদিন ছোটবাবু, তারপর এই বিলাসপুর জেলার আদিবাসী তহসীল বা মহকুমা স্তরের থানায় পুরোদস্তুর দায়িত্ব। এখানে পয়সা আছে। কাছেই কয়লা পাওয়া গেছে। ওপেন কাস্ট মাইনিং শুরু হচ্ছে। আর মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে গোপালপুরে বারুদ ফ্যাক্টরি-- নাইট্রোগ্লিসারিন তৈরি হয়। সেখানে আবার এন টি পি সি'র থার্মাল পাওয়ার স্টেশনের স্টাফেদের জন্যে কোয়ার্টার তৈরি হবে, সার্ভে চলছে।
    এইসব কর্মকান্ডের একটাই মানে। সমানে বাইরের লোক আসবে। বিশেষ করে বিহার বর্ডার থেকে। অন্তররাজ্য ক্রিমিনাল গ্যাং গুলো আস্তানা গাড়বে। সংগঠিত অপরাধের সংখ্যা বেড়ে যাবে। তার সংগে পাল্লা দিয়ে বাড়বে থানেদারের কামাই। বছর তিনেক পরে নীলামে এই থানার রেট বাড়বে। তখন অন্য কেউ বেশি দাম দিয়ে এই থানায় পোস্টিং পাবে, অজয়কে যেতে হবে আরো পিছিয়ে পড়া কোন থানায়। সে যখন হবে, তখন হবে। আপাতত: তিন বছর কিছু তো কামিয়ে নেয়া যাবে।
    ঘটনাচক্রে ছুরির গ্রামীণ ব্যাংকের ম্যানেজার ওর চেনা বেরিয়েছে, একসঙ্গে ভিলাইয়ের প্ল্যান্টের স্কুলে পড়ত, বিয়েশাদি হয় নি। ওর জন্যেই আজ স্কুলের ছাত্র বনাম সরকারি কর্মচারির প্রীতিম্যাচে ওকে অনুরোধ করা হয়েছে উইকেট কীপিং করার জন্যে। ব্যাংক ম্যানেজার রূপেশ সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে যে থানেদার ডোঙ্গরেজি দুর্গ গরমেন্ট কলেজের হয়ে টুর্নামেন্টে নিয়মিত কীপিং করত। ম্যাচের পরে রূপেশের স্টাফ মেসে স্ট্যাগ পার্টি- দেশি মুর্গার রোস্ট ইত্যাদির কথা হয়ে আছে।
    কাল বিকেলে স্কুলের মাঠে একটু প্র্যাকটিস করেছিল। শরীরের আড় ভাঙছিল। কিন্তু সকালে মোটর সাইকেল চড়ে ব্যাংক ম্যানেজার রূপেশ হাজির।
    -- যা তা ব্যাপার! আমি কাল বিলাসপুরে হেড অফিসের মিটিং সেরে অনেক রাত্তিরে ফিরেছি। সক্কালে ব্যাংকের চাপরাশি জানাল যে গতকাল সন্ধ্যেয় কে বা কারা সুদখোর আজিজ পালোয়ানকে বীভৎস ভাবে খুন করেছে। কে করেছে কেউ নাকি জানে না। সবার মুখে কুলুপ আঁটা। সরপঞ্চের সঙ্গে কথা বলে জানলাম যে সন্দেহের বশে লুচুকদাসকে ধরে এনে বেওয়ারিশ গরুমোষকে রাখার ঘর বা কাঞ্জি হাউসে বেঁধে রাখা হয়েছে, আপনি বল্লে কোতোয়ালের দল এখানে ওকে হাজির করবে।
    ছোটবেলার চেনা হলেও গঙ্গারাম অজয় ডোঙ্গরেকে আপনি করেই বলে। ডোঙ্গরে মানে জাতে হরিজন, কোন কথায় ইগো হার্ট হবে কে বলতে পারে! থানেদার বলে কথা।
    ওরা দুজন থানার আঙিনায় মিঠে রোদ্দূরে চেয়ারে বসে কাঁচের গ্লাসে গরম চা খাচ্ছে এমন সময় তিন কোতোয়াল হাজির। তিনটেরই পরণে রেলের খালাসীদের মত নেভি ব্লু হাফ প্যান্ট আর শার্ট; তবে কোমরে চওড়া বকলেস লাগানো বেল্ট, আর মাথায় একই রঙের টুপি।
    তিন জনে এসে সার বেঁধে দাঁড়ায়, স্যালুট মারে, ঠিক যেন কোন কমিক স্ট্রিপের ক্যারেক্টার।
    -- কি ব্যাপার? তিনমূর্তি একসাথে? তোমাদের না বডির পাশে থাকার কথা?
    -- সরকার! আসামীকো লানা থা, বহুত খতরনাক আসামী, খুনী! ইসীলিয়ে--।
    -- কোথায় সেই খতরনাক আসামী?
    তিনমূর্তি মাথা চুলকোয়।
    বয়স্কটি কিন্তু-কিন্তু করে বলে -- ও হুজুর পরের বাসে আসছে, আমার ছেলেটা সঙ্গে আছে।
    রূপেশের মুখ হাসি চাপার অসম্ভব কষ্টে বেগুনি হয়ে যায়। কিন্তু থানেদারের চেহারা হিংস্র হয়ে ওঠে।
    -- মেরে সাথ মজাক? চুতিয়াপনার জায়গা পাস নি? সবকটার পাছায় হান্টার লাগালে তবে এদের ট্রেনিং পুরো হবে। আসামী যদি পালিয়েছে তো তোদের দিন খুব খারাপ যাবে, দেখে নিস্‌।
    ইতিমধ্যে পরের বাস এসে গেছে। বুড়ো কোতোয়ারের ছেলের সঙ্গে নেমেছে কোমরে দড়ি বাঁধা কথিত আসামী লুচুকদাস।
    অজয় একপলক তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নেন। ন্যালা ক্যাবলা আধপাগলা গোছের একটা লোক। উস্কোখুস্কো চুল, শার্টের হাতাটা ছেঁড়া। চোখের কোণে পিঁচুটি, হলদেটে দাঁত, মুখ থেকে বাসি মদের টোকো গন্ধ, আর নিম্নাংগের পাজামাটা অনেক পুরোনো,পায়ের কাছে ফাঁসা। এ মেরেছে আজিজ পালোয়ানকে? কি করে?
    জিগ্যেস করতেই হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে লুচুকদাস। ও কিচ্ছুটি জানে না। কাল ছিল শঙ্করজীর দিন। ও গাঁজায় দম একটু বেশি চড়িয়ে মন্দিরেই ভোম হয়ে সারারাত্তির কাটিয়েছে।
    অজয় দুই ধমক দিয়ে মুন্সীকে বলেন খাতায় এন্ট্রি করে ব্যাটাকে লক আপে ভরতে। ডাক্তারকে খবর করা হয়, সঙ্গে গিয়ে প্রাথমিক পরীক্ষা করে বডি অ্যাম্বুলেন্সে করে কাঠঘোরা মর্গে নিয়ে আসার জন্যে, কাল পোস্ট মর্টেম করতে হবে। আজ হবে না। কারণ ডোম সুখিয়া মহাশিবরাত্রির ছুটিতে মাতাল হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

    তিন তিগাড়া, কাম বিগাড়া!

    পোস্ট-মর্টেম রিপোর্ট এসে গেছে। রিপোর্ট পড়ে থানেদার ডোঙ্গরে'র চক্ষু চড়কগাছ। মৃতদেহের শরীরে অন্তত: ২৯ টি ছোট বড় আঘাতের চিহ্ন। কিছু ধারালো অস্ত্রের ঘা', কিছু ভোঁতা ভারী জিনিসের আঘাত, আর ডাক্তার মিশ্র বল্লেন-- এই ১১টা চোট দেখুন! একটাও ফ্যাটাল নয়। ব্লেড বা ছুরি অথবা অমনি কিছু দিয়ে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে পুচিয়ে পুচিয়ে কাটা হয়েছে। মনে হয় আজিজ পালোয়ানের ওপর হত্যাকারীদের খুব রাগ ছিল; অনেকক্ষণ ধরে যন্ত্রণা দিয়ে মেরেছে।
    -- হত্যাকারীরা? একাধিক লোক বলছেন?
    --- হ্যাঁ, কোন একজনের পক্ষে আলাদা আলাদা হাতিয়ার দিয়ে এতক্ষণ ধরে আজিজকে যন্ত্রনা দেয়া?--ঠিক বিশ্বাসযোগ্য নয়। একাধিক লোক, আজিজকে বাগে পেয়েছিল। মানে, কোথাও বেঁধে রেখে টর্চার করেছে। দুটো হাত ও পায়ে গোয়ালঘরের দড়ি দিয়ে বাঁধার দাগ আছে। আর কোন রেজিস্ট্যান্সের চিহ্ন নেই।
    অথচ বডি পাওয়া গেছে গাঁয়ের প্রান্তে গরুমোষ ধোয়ানোর পুকুরপাড়ে, পাকুড় গাছের তলায় পড়েছিল।
    এবার ব্যাংক ম্যানেজার রূপেশ বলে-- পুকুরপাড়ে পাকুড় গাছের তলার জমিটা? ওটা কার?
    -- ওতে কি বোঝা যাবে? ওটা সরকারি জমিন। পঞ্চায়েতের রক্ষণাবেক্ষণে আছে। তবে আশেপাশে রক্তের দাগ নেই। জমিতে কোন ধস্তাধস্তির চিহ্ন নেই। তার মানে হল-
    -- খুনটা অন্য কোথাও করে এখানে বডি ফেলা হয়েছে। কিন্তু কে বা কারা আজিজকে এমন নৃশংস ভাবে মারল? কেন মারল? ম্যানেজার কিছু বল। আরে সায়েব তুমি তো এখানে বছরখানেক ধরে আছ। গাঁয়ে কার কার সঙ্গে ওর দুশমনি ছিল।
    ডাক্তার মিশ্র হেসে ফেলেন।
    -- কার সঙ্গে ছিল না সেটা জিগ্যেস করুন। কি হে ম্যানেজার সাহেব? সেই ছড়াটা শোনাবে নাকি? আরে লজ্জা কিসের? শুনিয়ে দাও। হতে পারে ওই ছড়াটা থেকেই আমাদের থানেদার সাহেব কোন ক্লু পেয়ে যাবেন?
    অজয় ডোঙ্গরে স্পষ্টত: বিরক্ত। ম্যানেজার আর উনি ঘন্টা দুই হল মহকুমা হাসপাতালে এসেছেন পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট নিতে আর ডাক্তারের মতামত শুনতে। রিপোর্টে ইশারা একাধিক খুনীর, অথচ গাঁয়ে কেউ কিছু জানে না। মনে হচ্ছে লুচুকদাসকে ছেড়ে দিতে হবে। ও শালা পাঁড় মাতাল আর নিঠল্লা আদমী। রহস্য ঘনীভূত। কাল কোরবার অ্যাডিশনাল এসপি শ্যাম সায়েবের কাছে রিপোর্ট পাঠাতে হবে। উনি আবার মহা হাঁউ-মাঁউ-খাঁউ, পয়সার গন্ধ পাঁউ। আর এই ডাক্তার বয়সে বড় বলে এয়ারকি দিচ্ছে! ছড়া শোনাবে?

    শুরু হো জাও ম্যানেজার!
    ভ্যাবা- গঙ্গারাম ম্যানেজার নিরুত্তাপ ভঙ্গীতে শুরু করে:
    " দরস কা লন্দফন্দ, যোশী কে সলাহ্‌ , অউর আজিজ কী গবাহী,
    এ তিনোমেঁ রহবে তো ঝাঁট চাট জাহি।''

    "ফাঁদ পেতেছে দরস,তায় বুদ্ধি যোগায় যোশী,

    আর আজিজ সাক্ষী? বাপ!

    এ ত্র্যহস্পর্শে ফেঁসেছিস কি

    ঝাঁটশুদ্ধু সাফ!"

    -- দরসরাম? যোশীজি? এরা কারা?
    -- সবই জানবেন, ক্রমশ: প্রকাশ্য। দরসরাম হল ব্যাংকের মকানমালিকের চচেরা ভাইয়া। অতি সাধারণ অবস্থা থেকে নিজের বুদ্ধি আর সাহসের জোরে গাঁয়ের প্রচুর জমির মালিক হয়েছে। আসলে অংগুঠা ছাপ। কিন্তু শুরুতে ছুরি গাঁয়ের জমিদার বাড়ির লাঠিয়াল এই আদিবাসী মানুষটি মুখে মুখে বলে দিতে পারে এত ফিট রাস্তা বা এত উঁচু ইঁটের দেয়াল বানাতে কত ইঁট, কত গরুর গাড়ি বালি আর কত ব্যাগ সিমেন্ট লাগবে। কম কথা নয়।
    -- আর যোশীজি?
    -- যোশী মহারাজ রাজস্থান থেকে আসা মাড়োয়ারি ব্রাহ্মণ; সব মারোয়াড়ি ব্যবসায়ীদের পুরুত। বুড়ো শকুনের মত দেখতে। কিন্তু বিষয়বুদ্ধিতে প্রখর। রেভিনিউয়ের সব আইনকানুন , মায় অধুনা পাস হওয়া সংশোধনী,- সব খবর রাখে। পাটোয়ারি, রেভিনিউ ইনে্‌স্‌পক্টর সবাইকে খুশি করতে পারে। সরকারি জমিন কেমন করে অবৈধ কব্জা করে নামমাত্র ফাইন দিয়ে নিজের করে নেয়া যায় তা ও তহশীলদারকে শেখাতে পারে।
    -- বাকি রইলো আজিজ পালোয়ান। ওর সম্বন্ধে আমার থানায় ফাইল আছে। লোককে ধমকানো, মারপিট, চোলাই মদের ধান্ধা আর গুন্ডাগর্দি, রংদারি ট্যাক্স ইত্যাদি। সব সময় জামিন পেয়েছে। আর কোর্টে কিছু প্রমাণ করা যায় নি, তাই খোলা ষাঁড়ের মত ঘুরে বেড়ায়, বহাল তবিয়তে।
    -- ফাইল যদি মন দিয়ে পড়ে থাকেন তবে এও হয়তো আপনার চোখে পড়েছে যে অধিকাংশ সময় ওর জামিন হয়েছে হয় দরসরাম তঁওর নয়তো যোশী।মহারাজ।
    ত্র্যহস্পর্শযোগ, বল্লাম না! তিনব্যাটার সাঁটগাঁট!

    প্রথম জালটা ফেলবে দরসরাম, তারপর ফাঁস গলায় এঁটে বসলে গেঁয়ো চাষী দৌড়ে যবে যোশীমহারাজের কাছে শলাপরামর্শ নিতে। ওনার মনোহারী পরামর্শে ফাঁসটা আরো ভালো করে গলায় আটকাবে। শেষে কোর্টে গেলে তহসীলদারের সামনে আজিজের শপথ নিয়ে মিথ্যে সাক্ষ্য বা গবাহী দেয়া। ফলম্‌ -ভিটেমাটি চাটি হয়ে যাওয়া। এই তিন শয়তানের দাঁও-প্যাঁচে কতজন যে পথে বসেছে। আর এরা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে সম্পত্তি বাড়িয়ে গেছে। এই লোকোক্তিটি হাসির নয়, অনেক লোকের হাহাকারের শ্বাস।
    -- ওসব সেন্টিমেন্ট ছেড়ে আপনারা বলুন তো --যখন আজিজ এমন ভাবে মারা গেলো , তখন বাকি দুই মাস্কেটিয়ার্স কি করছিলো বা কোথায় ছিলো?
    -- এটা আমি বলতে পারবো না। আমি তো সদরে থাকি। রূপেশ সাহেব জানলে বলুক। ও তো ছুরি গাঁয়েই থাকে।
    -- হ্যাঁ, প্রশ্নটা আমার মনেও এসেছিল। খোঁজ নিয়ে জানলাম যে ওই দিন ওঁরা দুজনেই গাঁয়ে ছিলেন না। যোশীমহারাজ চাঁপা নগরে ওনার যজমানের ছেলের পৈতের শুভকর্ম সম্পন্ন করতে দুদিন আগেই চলে গিয়েছিলেন। আর দরসরাম ওর শ্বশুরবাড়ি পেন্ড্রায় গিয়েছিল।

    কুমারসাহেব! কুমারসাহেব! করছ তুমি কী?

    ইংরেজ রাজত্বে ছত্তিশগড় সিপি অ্যান্ড বেরার স্টেটের মধ্যে বিদর্ভ (বেরার) রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। তখন ওর রাজধানী ছিল নাগপুর। সেখানে কমিশনার বসে সুদূর ছত্তিশগড়ে শাসন চালাতেন। ওনার লেখা একটি বইয়ে ছুরি গাঁয়ের ও সেখানের করদাতা রাজাদের কথা আছে।
    আবার বিংশ শতাব্দীতে চল্লিশের দশকে বর্গীদের বংশাবতংস মারাঠা রাজবংশীয়দের উদ্যোগে বিলাসপুর থেকে পচিস কিলোমিটার দূরে প্রাচীন রাজধানী রত্নপুর, বর্তমান রতনপুর, এর কাছে মা তুলজা ভবানী মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই প্রতিষ্ঠা করার সময় আয়োজিত বিরাট যজ্ঞের স্মারিকা গ্রন্থে যে আশী জন জমিদার তাতে দান দিয়েছিলেন তাদের মহিমাকীর্তন করা আছে। আমাদের গল্পের ছুরির রাজপরিবার তাদের অন্যতম।
    কাটঘোরার থানেদার অজয় আজ হাজির হয়েছেন সেই রাজপরিবারের প্রাসাদের আঙ্গিনায়। কারণ এই পরিবারের সেজকুমার উদ্যমেশ্বরশরণ মণিপালপ্রতাপ সিংহ এই গ্রাম পঞ্চায়েতের বর্তমান সরপঞ্চ।
    লাল ইঁটের বিশাল প্রাচীরে চুণ সুড়কির পলস্তারা খসে পড়ছে। ওপরে কোট অফ আর্মস এখনো পড়া যায়। ১৮৯০ এর কাছাকাছি কোন বছর লেখা। কিন্তু অজয় চারদিকে চোখ বুলিয়ে পিচ করে পিক ফেলে ব্যাংক ম্যানেজারকে ঠেট হিন্দিতে যা বল্লেন তার বাংলা অনুবাদ হল -- নামে তালপুকুর, তায় ঘটি ডোবে না।
    খবর পেয়ে ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছেন সেজকুমার, ছত্তিশগড়ি বোলি তে " সঝলাকুমার''। সাদা টেরিকটের সার্টের বুকপকেটের কাছে পানের পিকের লাল দাগ ধোবার হাত ফেরতা হয়েও পুরোপুরি ওঠেনি।

    এখনো মুখের পান থেকে কথা বলার সময় কিঞ্চিৎ রঙীন ফোয়ারার ছিঁটে ওনার জামার গায়ে লাগছে, কিন্তু সেজকুমার নির্বিকার।
    থানেদার ইতিমধ্যেই জেনেছেন যে এই ব্যক্তিটি একেবারেই আজকের হিসেবে সরপঞ্চ হওয়ার উপযুক্ত নন। সজ্জন, বন্ধুবৎসল, আমোদপ্রিয় উদ্যমেশ্বরশরণ কুমারসাহেব আসলে ব্যক্তিত্বহীন। তাই সবাইকেই খুশি করতে চান, কাউকেই করতে পারেন না। উপরন্তু চালু লোকেরা , যেমন দরসরাম বা তার ছেলেরা ওনার মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খায়। গতবারও মন্দিরের পাশ থেকে পুকুরপাড় অব্দি রাস্তাটা বানানোর ঠিকে ওনাকে পটিয়ে দরসরাম হাতিয়ে নিয়েছিল, কাজ পুরো হওয়ার আগেই চাপ দিয়ে বিল পাশ করিয়ে নিয়েছিল। কাজ পুরো না হওয়ায় অডিটের পর বাকি টাকাটা সেজকুমারকেই ভর্তুকি দিতে হয়েছিল।

    -- আসুন, আসুন! কি সৌভাগ্য, সাহেব নিজে এসেছেন! আবার ম্যানেজার সাহেবও! ভাল হল। আজ দিন ভাল যাবে।
    যথারীতি কাঠের রং ওঠা চেয়ার পেতে সবাইকে ভেতরের বাগানে বসানো হল। চা-সিগ্রেট, শেষে মুখশুদ্ধির মশলা সব এল।
    ওঠার আগে অজয় জিগ্যেস করলেন-- কুমার সাহেব! আপনি তো জানতেন যে লুচুকদাস নির্দোষ, তাই না?

    হটাৎ এই অপ্রত্যাশিত বাম্পারে সেজকুমার ধরাশায়ী। ঘাবড়ে গিয়ে তো-তো করতে থাকেন।
    -- না , মানে আমি কি জানি- কে দোষী আর কে নির্দোষ? ওসব তো, মানে আপনি ঠিক করবেন।
    --বেশ কথা। লুচুকদাসকে ধরে বেঁধে কাঞ্জিহাউসে আনা হয়েছিল আপনার হুকুমে।
    তাহলে আপনি জানতেন যে ওই খুনী?
    -- না, না! আমি কিছু জানি না। আমি ঘরে বসে রেডিও শুনছিলাম। আসলে আমি এখানকার রেডিও শ্রোতা সংঘের প্রেসিডেন্ট তো। তখন সবাই এসে বললো-- কুমারসাহেব, খুনী ধরা পড়েছে, আপনার আদেশ পেলে চৌকিদার ওকে আজ কাঞ্জি হাউসে বেঁধে রেখে সারারাত পাহারা দেবে, সকাল থানায় খবর দিয়ে তারপর ওখানে সুপুর্দ করে দেবে। তাই আমি--।
    -- আচ্ছা? তা এই সবাই কারা?
    -- কার কার নাম নেব সাহেব? সবাই মিলে মিশে থাকি, দুশমনী বাড়বে। সবাই বলেছিল।
    -- অন্তত: পাঁচটা নাম বলুন। আর ওদের হিসেবে খুনটা কখন হয়েছিল?
    -- কর্মনলাল, হরিরাম, মদন গুণাইত, টেলু-মেলু-মহেত্তররাম ভাইয়েরা। অমৃতলাল দেবাংগন। আর সবাই বলল-- রাত বারোটার অনেক পরে। মানে তিনজন তখন লুচুকদাসকে তালাওয়ের পাড় থেকে , মানে যেখানে খুনটা হয়েছিল সেখান থেকে দৌড়ে আসতে দেখেছে।
    -- তা সেই তিনজন অত রাতে ওখানে কি করছিল? আর আপনিই বা সেই রাতে কোথায় ছিলেন?
    -- ওরা তালাওয়ের পাড়ে ছিল না, নিজেদের বাড়ির সামনে ঘুম ভেঙে পেচ্ছাপ করছিল। জানেনই তো, অজ পাড়াগাঁয়ে আপনাদের ভিলাই-রায়পুরের মত ঘরে ঘরে বাথরুম-পায়খানা নেই। পুরুষেরা সবাই রাত্তিরে নিজেদের ঘরের বাইরেই রাস্তার ওপর সেরে নেয়।
    -- আর আপনি?
    -- আমি? আমি ঘটনার একসপ্তাহ আগে থেকেই বাইরে ছিলাম। মাকে নিয়ে সপরিবারে পুরী বেড়াতে গিয়েছিলাম। ঘটনার পরের দিন ফিরেছি। স্যার, আমি সবসময় পুলিশের সঙ্গে কো-অপারেট করব, কিন্তু প্লীজ আমার ওই নাম বলার ব্যাপারটা--?

    ফেরার পথে রূপেশ বলে-- আপনার কি মনে হচ্ছে যে ও সব সত্যি বলছে? ওর পুরী থেকে ফেরার সময়টা একটু ভেরিফাই করলে হয় না,অজয়জী?
    অজয় হাসেন। না, না, ওসবের দরকার নেই। ও সত্যি কথাই বলছে, মোটের ওপর।
    চমকে ওঠেন ম্যানেজার।-- আপনি জানলেন কি করে?
    অজয়ের হাসি রহস্যময় হয়ে ওঠে।
    -- আমি জানি, মানে খুনীদের জানি। কিন্তু কেউ সাক্ষী দেবে না। এখন ধরলে সবাই বেকসুর খালাস হবে। তাই একটা কিছু করতে হবে যাতে সাক্ষী পাওয়া যায়।
    রূপেশের হাঁ-মুখ বন্ধ হয় না। তাই দেখে থানেদারি স্টাইলে মুচকি হেসে অজয় বলেন-- চলুন! আজ আপনাকে এক জায়গায় নিয়ে যাবো।
    অনেক কাজ হল আজকে। এখন একটু রিল্যাক্স করতে হবে না? আচ্ছা, আপনি কখনো বেশ্যাগমন করেছেন?
    রূপেশ এবার পুরোদস্তুর ভ্যাবাগঙ্গারাম হয়ে যায়।

    নগরবধু, শুধুমুধু?

    কাঠঘোরা বাসস্ট্যান্ডের তেমাথার মোড়। একটা রাস্তা গেছে বিলাসপুর থেকে এসে ২৩ কিলোমিটার দূরে কোরবা থার্মাল পাওয়ার কেন্দ্রের দিকে। আর এর থেকে নব্বই ডিগ্রি কোণ করে আর একটি রাস্তা গেছে বাঙ্গো জলাশয় হয়ে অম্বিকাপুরের দিকে। এই রাস্তা ধরে গোটাকয় খাবারের দোকান, ফলমূল-শাকসব্জির দোকান, ট্রাকের টায়ার সারানোর, চাকায় হাওয়া ভরার দোকান ইত্যাদি ছাড়িয়ে প্রায় দু'শ পা হাঁটলে একটি ছোট চা আর ফুলুরির দোকান, স্থানীয় ভাষায় বলে ভাজিয়া।
    আপনি ছোট থেকে ছোট গাঁয়ে ঘুরে বেড়ান একটি ভাজিয়ার দোকান ঠিকই পাবেন। ছত্তিশগড়ের সম্পন্ন বা গরীব-গুর্বো মানুষ -- সবার সহজ জনপ্রিয় জলখাবার হল ভাজিয়া। সময়ে অসময়ে অতিথ-অভ্যাগত এলে তাদের খাতিরদারি করতে চাই ভাজিয়া।
    ছত্তিশগড়ের লোকজীবনে ভাজিয়ার গুরুত্ব বোঝাতে এই ইতরযানী লোকোক্তিটি যথেষ্ট।
    যেমন, আপনি যা ইচ্ছে করুন , চুলোয় যান, বোঝাতে ছত্তিশগড়ের লোকে বলবে--" চাহে ভাজিয়া খায়ে, চাহে গাঁড় মারায়ে।''
    অথবা দেখুন গ্রামীণ শ্রমজীবি মানুষের মুখে মুখে তৈরি দদরিয়া লোকগীতের জনপ্রিয় এই পংক্তিটি:
    " চানা কে দার রাজা, চানা কে দার রাণী,
    চানা কে দার গোঁদলী মেঁ কড়কয়থে,
    আরে টুরা রে পর-বুধিয়া, হোটেল মেঁ ভাজিয়া ঝড়কয়থে।।''

    ছোলা ডালের রাজা, ছোলা ডালের রাণী,
    ডাল আর পেঁয়াজ গরম তেলে নেচে নেচে ওঠে।
    আমার ছেলে বড় হাঁদা, টিকি অন্যের ঘরে বাঁধা,
    চেটে পুটে ভাজিয়া খেতে হোটেলেতে ছোটে।'

    এখন বেলা বাজে তিনটে; রোদের তাপ গায়ে লাগছে। বাসের সংখ্যা কমেছে। ফলে এদিকটা একটু বেশি ফাঁকা। ওই ভাজিয়ার দোকানেও উনুনের ছাই নিভু-নিভু; চাকর-বাকরেরা খেতে বসেছে। আর থানেদার অজয় ডোঙ্গরে ও তাঁর স্কুল জীবনের বন্ধু রূপেশ,( যিনি ব্যাংকের টেবিলে বেশিক্ষণ বসে থাকতে না পেরে কিছু নতুন বিজনেস ধরার বাহানায় খালি ছুরি- কাটঘোরা রুটে বড় রাস্তায় বা তার পাশের গ্রামগুলোতে একটি পুরনো রাজদূত মোটরসাইকেলে ঘুরে বেড়ান), জীপ থেকে দোকানের সামনে নাক কুঁচকে নামলেন।
    পুলিশ অফিসারের ধরাচূড়া পরা অজয়কে দেখে ছেলে-ছোকারাদের ডাল- ভাতের গ্রাস মুখের সামনে থেমে গেল।
    কিন্তু রাঁধুনী বুড়ো বিশালদাস যাদব তাড়াতাড়ি হাত ধুয়ে দুটো চেয়ার টেনে ওদের বসতে অনুরোধ করে। টেবিলের ওপর কাঁচের গ্লাসে জল দিয়ে জিগ্যেস করে-- কি খাবেন হুজুর?
    অজয় মাছি তাড়ানোর মত হাত নেড়ে বলেন-- তোদের মালকিন মালতী বাঈকে গিয়ে বল, দারোগাবাবু দেখা করতে এসেছেন।
    বুড়ো দৌড়ে ভেতরে গিয়ে প্রায় তক্ষুণি ফিরে এসে বলে--- ভেতরে আসুন, সরকার! মালকিন বসে আছেন।

    প্রায়ান্ধকার গলির মধ্যে দিয়ে ভেতরের উঠোনে পৌঁছুবার সময় অজয় রূপেশকে বল্লেন-- এখানে একদম মুখ খুলবে না, ম্যানেজার! আজ শুধু শুনে যাও। আর ভুলে যাও।
    ভেতরের উঠোনটা বেশ বড়, গাছের ডাল আর তারকাঁটা দিয়ে ঘেরা। একপাশে সবুজ রঙের কিছু চানাবুট আর রেড়ির তেলের বীজ ডাঁই করে রাখা, অন্যদিকে দুটো মুর্‌রা মোষ জাবনা খাচ্ছে। চোখ গেল আঙিনার উল্টো দিকে জং ধরা একটি জীপের দিকে। তার পেছনে রং দিয়ে বড় করে লেখা-- পোঙ্গা লা বাজা না গা! অর্থাৎ হর্ন প্লীজ!
    একটা হাফপ্যান্ট পরা ছেলে গোবরলেপা উঠোনের রোদ্দূরে একটা খাটিয়া টেনে এনে তারপর আধময়লা কাঁথা পেতে দিল। আর সামনের একটি কাঠের টুলে কাঁসার বাটিতে করে লাড্ডু, পেঁড়া ও কালাকাঁদ। একটি শ্রীময়ী মেয়ে নিয়ে এসেছে কাঁসার লোটায় খাবার জল ও সঙ্গে দুটো ঝকঝকে মাজা গেলাস।
    থানেদারের ইশারায় রূপেশ একটি কালাকাঁদ তুলে নিয়ে চিবুতে থাকে। বড্ড মিষ্টি। এক লোটা জল দুজনের দুই চুমুকে শেষ। এবার আসে পানামা সিগ্রেট ও দু'খিলি পান, মিঠি পাত্তি ও মিঠা মশলা। কিন্তু গুলকন্দ দিয়ে স্বাদটা খারাপ করে দিয়েছে।
    অজয় ডোঙ্গরে প্রায় একবছরের থানেদারিতেই স্থুল ব্যাপারগুলো আয়ত্ত করে নিয়েছেন। ওখানে বসে উঠোনেই পিচ্‌ করে থুতু ফেললেন। লাল পিকের দাগ মাটি শুষে নিতে অপারগ।
    কখন পেছনের দরজাটা খুলে গিয়েছে আর সেখান থেকে গঙ্গারামকে প্রায় চমকে দিয়ে বেজে উঠেছে একটি চড়া খনখনে কন্ঠস্বর-- প্যার লাগথন, ও সাহাবমন্‌! আজ কেইসে আয়ে হো মোর জেইসে গরীব বেসহারা আওরতকে দুয়ার মা? রদ্দা ভটক গইসে কা? গড় করি গো সাহেবেরা! আজ আমার মত গরীব অসহায় মেয়েমানুষের দরজায় কি মনে করে? রাস্তা হারিয়েছ নাকি?
    মুচকি হাসেন অজয়। -- অসহায় মেয়েমানুষ বটে! চাইলে গোটা কাঠঘোরাকে কিনে নিতে পারে। বাসস্ট্যান্ড পাড়ার কোন শেঠ আছে যে আজ অব্দি তোর ঘাটে মাথা মুড়োয় নি? বল্‌, তার নামটা বল্‌। আমার বন্ধুটিকে সত্যি কথাটা বল্‌!
    --- বললে কি করবে গো তুমি সায়েব?
    --- গ্রেফতার করে নিয়ে এসে তোর সামনে ফেলে দেব। আমি থাকতে কার এত সাহস যে আমার মালতী বাঈয়ের দরবারে হাজিরা দেয় নি!
    ফিল্মি লফ্‌ফাজিতে অজয়ের জুড়ি মেলা ভার। দারোগা বটে! গঙ্গারামের অস্বস্তি বাড়ে। মালতী কিছু বলে না। বড়মানুষের বারফট্টাইয়ের সময় কিছু বলতে নেই যে!
    রূপেশ তাকিয়ে থাকে মালতী বাঈয়ের দিকে। ছরহরে বদন মহিলাটির তেলতেলে কালো চেহারায় বেশ জৌলুষ আছে, মানতে হবে। বয়স? আটাশ বছরের ভ্যাবাগঙ্গারাম রূপেশের চেয়ে একটু বেশিই হবে। তেলমাখা কালো চুল শস্তা ফিতে দিয়ে আঁটোসাঁটো করে বাঁধা। পরনে ছাপা শাড়ি আর কালো ব্লাউজ, কপালে একটি কাঁচপোকা টিপ।
    হঠাৎ গলায় সুর পাল্টায় অজয়ের। এবার উনি পুরোদস্তুর থানেদার।
    -- তো খবর পাক্কি?
    -- জী সাহাব! ঝুঠ নহী বোলথন্‌।
    --- কে বাজে কী বাত? কোন কোন রইসে?
    মালতী অস্বস্তিভরা চোখে রূপেশের দিকে তাকায়। কিছু বলে না। অজয় সেটা খেয়াল করে বলেন-- এ হামার খাস মিত্র। এখর সামনে কুছু ছিপাইকে জরুরত নো হে। অব্‌ বোল, খুলকে গোঠিয়াবে ও।

    এ হল আমার বিশেষ বন্ধু; এর সামনে খোলাখুলি কথা বলতে পারো।
    তারপর ম্যানেজারকে উদ্দেশ্য করে বল্লেন--শী ইজ এ প্রস্টিটিউট্‌, নজদিগকে দশ গাঁও মেঁ মশহুর। কিন্তু এ আবার আমাদের পে-রোল্‌ এ আছে, চালু শব্দে -- পুলিশের খবরী বা মোল্‌। বাকিটা আপনি ওর মুখেই শুনুন।
    মালতী বাঈ মুখে একখিলি পান ঠুঁসে বলতে থাকে।
    - আপনারা ওই ছড়াটা তো জানেনই? সেই যে ‘দরস কী লন্দফন্দ’?
    ওকে হাত নেড়ে থামিয়ে দিয়ে অজয় বলে ওঠেন--হ্যাঁ, হ্যাঁ,সেই ‘ঝাঁট চাট জাহি' তো? ওসব ফালতু কথা ছেড়ে কাম কী বাত শুরু কর্‌।
    --সেই তো বলছি। খুনটা অনেক দিন আগেই হত। শুধু সুযোগের অপেক্ষা।
    তিনটে শয়তানের মধ্যে সবচেয়ে হারামী ছিল আজিজ। এক্‌নম্বরের আওরতখোর। গাঁয়ের বহুবেটির দিকে হাত বাড়াতে কোন লিহাজ করে না। একটা বউ মরেছে, আর একটাকে ও নিজে তালাক দিয়েছে। ওর কু-নজর পড়ায় ছেলেটা বৌ নিয়ে কোরবা শহরে চলে গেছে। সেখানে মোটর সাইকেল মেরামতের গ্যারেজ চালায়। বাপের সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই।
    গড়বড় হল যখন আজিজের নজর গেল রসেলু যাদবের মেয়ের দিকে। রসেলুরা চার ভাই। দুধের ব্যবসা, ভাল ক্ষেতিও আছে। মেয়েটাকে জামাই ছেড়ে দিয়েছে, বাপের বাড়িতে আছে কিছু দিন। রসেলু সম্বন্ধীবাড়িতে লোকজন পাঠাচ্ছে- একদিন জামাইয়ের মন গলবে , এসে মেয়েকে নিয়ে যাবে এই আশায়। কী করে যেন শয়তান আজিজ বশ করল ওই বাচ্চা মেয়েটাকে। নিঘ্‌ঘাৎ জাদুটোনা করেছিল। জানেনই তো, ছুরি গ্রামকে দশকোশের মধ্যে জাদুটোনার জন্যে সবাই জানে। ব্যাংকের পাশের বাড়ির গোঁড় পরিবারের বৌ, লাইনপাড়ার ডোমনের বিধবা, রহসবেড়ার টেঁটকি কোস্টিন(তাঁতিবৌ টেটকি)-- সবকটা ডাকসাইটে টোনহি।(ডাইনি) । একবার যদি লংকাপোড়া হাতে নিয়ে আপনার দিকে তাকিয়েছে--! সেবার হরেলি-অমাবস্যার রাতে--।
    -- ফের ফালতু বকবক শুরু করেছিস? কাজের কথা বল। আমার সময় নেই।
    ধমক খেয়ে মুষড়ে পরে মালতী বাঈ। গঙ্গারামের আগ্রহ হচ্ছিল টোনহি-উপাখ্যান শুনতে। কিন্তু থানেদারের চোখের দিকে তাকিয়ে চেপে যায়।
    -- সেই কথাই তো , আপনি বলতে দিচ্ছেন কই? গতবছর হরেলি-অমাবস্যার রাতে সহেলুরা সদলবল লাঠিসোঁটা নিয়ে আজিজকে ওদের ঘরের পেছনে কোলাবাড়িতে ( বড়সড় কিচেন গার্ডেন, যাতে শাকসব্জি-লংকা-টম্যাটো-পেঁপেগাছ ও অন্তত: একটি পাতকূয়ো থাকবে) মেয়েটার সঙ্গে ঘিরে ফেলে। কিন্তু আজিজ ন্যাংটো অবস্থায় চাড্ডি হাতে পাঁচিল টপকে পালিয়ে যায়। কথা চাউর হয়ে যায়। মেয়ের শ্বশুর আর ভাসুর বাড়ি বয়ে সহেলুদের যা-নয়-তাই বলে যায়। দুমাস পরে মেয়েটা ভেদবমি হয়ে মরে।
    একসঙ্গে এতগুলো কথা বলে মালতী বাঈ একটু দম নেয়, জল খায়।
    সেই সুযোগে অজয় ডোঙ্গরে সরু চোখে তাকান ওর দিকে।
    -- ভেদবমি? আমি তো শুনেছিলাম জ্বরজারি!
    -- সত্যি সত্যি কী হয়েছিলো আমিও জানিনা। কু-লোকে বলে ঘরের লোকই খাবারের সঙ্গে ধান কে কীড়ে মারনে কী দাওয়াই মিলিয়ে মেয়েটাকে মেরে ফেলেছে, ওকর পেট হো গয়ে রইস না? দু মাহিনাকে। কা লা কা বোলবে তঁয় সহাব! কাকে কী বলা যায়?
    রূপেশ জিগায়-- কোন হল্লা হয়নি? থানা-পুলিশ? চীড়ফাড়?
    -- আরে গাঁওকে আর এম পি ডাক্তার সার্টিফিকেত লিখ দিস্‌, পহলে কে থানেদার সাহাব ঘলো কুছ খুরচন-পানি লেকর মান গইস্‌। কা লা কা বোলবে, সাহাব?
    তারপর রসেলুরা সবকটা ভাই গাঁয়ের ঠাকুরদেবের থানে গিয়ে কসম খেল যে ওরা একদিন আজিজকে মারবেই মারবে। যদ্দিন না পারে তদ্দিন নিরামিষ খাবে। আজিজও সতর্ক ছিল। বিনা হাতিয়ার চলা ফেরা করত না। তবু রাত্তিরে কাঠঘোরা থেকে ছুরি ফেরার পথে দুবার হামলা হল। একবার জেজরা গাঁয়ের নালার পাশে , আর একবার ধনরাস গাঁয়ের ভাটায়। অন্ধকারে ওৎপেতে ছিল রসেলু আর তার দলবল। কিন্তু দু'বারই দরসরাম আগেভাগে খবর পেয়ে আজিজের বডিগার্ড বাড়িয়ে দেয়। ওদের কাছে কাট্টা ( দেশি পিস্তল) থাকে।
    --- এবার কি করে ভুল হল?
    -- এবার যোশীমহারাজ আর সহসরাম কেউ গাঁয়ে ছিল না। সরপঞ্চ সঝলাকুমার সাহেব ও নেই। সহসরাম পইপই করে মানা করে গেছিল-- ওরা ফিরে না আসা অব্দি আজিজ যেন ঘর থেকে না বেরোয়। আজিজ ও বেরোয় নি,-- একদিন, দুদিন, তিনদিন। তারপরই জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা করে বসল।
    দারু কা চক্কর।

    দারু কা লত তো থা পর ও দিন শর্মা গুরুজী লে পইসা মাঙ্গ বইঠে। গুরুজী ইন্‌কার কিয়ে তো ওলা মা-বহিন কী গালি দে দিস অউর কসকে দু’ তামাচা লাগাইস। ওকর লেইকা মন কে সামনে।
    গুরুজী লাজশরম কে মারে ফুট-ফুট কর রো দিস। খানা-পিনা ছোড় দিস। ফির পঞ্চকে পাস জাকে বোলিস -- তুমন ন্যায় কর। মোলা ন্যায় চাহিয়ে, তব তক অন্নজল গ্রহণ নহী করহুঁ।

    গুরুজী থাপ্পড় খেয়ে আর মা-বোনের গালি শুনে কেঁদে কেটে এক শা’। পঞ্চদের কাছে গিয়ে বিচার চাইলেন, বললেন এর একটা বিহিত না হলে উনি অন্নজল গ্রহণ করবেন না ।
    -- ফির?
    -- ফির ক্যা? সরপঞ্চ পুরী গিয়ে ছিলেন। তাই উপসরপঞ্চ কর্মনলালের বাড়িতে বৈঠক হল। সবাই বললো-- পাঠানের বড্ড বাড় বেড়েছে। বাহমণ গুরুজীর( ব্রাহ্মণ স্কুলটিচার) গায়ে হাত? গালি গালাজ? পাপ কে ভান্ডা ফুট গয়ে। অব কুছু করনা পড়ি। সব মিলকর এক পিলান কীস। শ্যামলাল পটেল, সমেলাল সারথী অউ ইতোয়ারু যাদব লা পাঠান লা খাল্লাস করে কে ঠেকা দে দিস। জব তক ওমন জেল মা রহি ওমনকে মাইপিলাকে র‍্যাশনপানি কী জুগাড় হো জাহি। ছুরি গাঁওকে দামাদ কাঠঘোরাকে পরসন উকিল বিনা ফীস ওমনকে কেস লড়ি।

    শ্যামলাল পটেল, সমেলাল সারথী ও ইতোয়ারু যাদবকে ঠিকে দেওয়া হল পাঠান ব্যাটাকে খাল্লাস করতে । ওরা যতদিন জেলে থাকবে ততদিন ওদের বৌ-বাচ্চাকে খাওয়ানোর ভার বাকি সবার। ছুরি গাঁয়ের জামাই কাঠঘোরার পরসন উকিল বিনে পয়সায় ওদের কেস লড়বে।

    থানেদার ও ব্যাংকার যেন মালতী বাঈয়ের জাদুটোনায় পাথর হয়ে গিয়েছে।

    -- সব বুঝলাম। কিন্তু ওকে মারল কখন? আর কি করে?

    --আজিজ পাঠানকে লাইনপাড়ার ভাট্টিতে মদ খাইয়ে চুর করে নিয়ে এল ওরা তিনজন। তারপর বাজারের তেমাথায় ইতোয়ারুর পানঠেলার সামনে সিমেন্টের বিজলীখাম্বার গায়ে পিছমোড়া করে বাঁধল। সারা গাঁয়ের লোক ফিরিতে মজা দেখল। কেউ কেউ থুতু ছেটাল, কেউ দু-ঘা জুতোর বাড়ি লাগাল। ওরা তিনজন ওকে দেখিয়ে দেখিয়ে মদ খেল আর ওকে একটু একটু করে পুচিয়ে পুচিয়ে কাটল। কয়েক ঘন্টা ধরে। ও মরলো সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ। তখন নিয়ে গিয়ে পুকুর পাড়ে ফেললো।
    -- এত লোক দেখেছে, কেউ কিছু বলবে না?
    -- না সাহেব! উকিল এবং উপ-সরপঞ্চ শিখিয়ে পড়িয়ে রেখেছে-- কেউ কিছু দেখেনি।
    তবে একটা উপায় আছে। ঐ মোড়ের মাথার সিন্ধি দোকানদারদের ধরুন। ওরা বাইরের লোক, এদিকের গাঁয়ের কেউ নয়। একটু চাপ দিলে উগরে দেবে। তায় ওদের মাথা রামচন্দর সিন্ধিটা বড্ড ভীতু। ওকেই আগে ধরুন।

    শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি তো কী?
    না, মালতী বাঈয়ের ফর্মূলা খাটে নি। কালোগাড়ি ও একঝাঁক পুলিশ দেখেও গাঁয়ের কারো হেলদোল নেই। কেউ কিচ্ছু দেখেনি।
    সিন্ধি দোকানদারেরাও মনে হয় কয় দশক ধরে ছুরি গাঁয়ে থাকতে থাকতে ওদেরই একজন হয়ে গেছে। রামচন্দর সিন্ধি বললো-- এই তেমাথায় ওরকম বীভৎস কিছু হয় নি।
    ওকে যখন বলা হল যে পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট অনুযায়ী মৃত্যু হয়েছে সন্ধ্যে ছ'টা থেকে রাত ন'টার মধ্যে তখন ও বলল-- সন্ধ্যে ছ'টা? আমাদের তো হুজুর পাঁচটার পর মানে সূর্য ডুবতেই দোকান বন্ধ হয়ে যায়। একি কাঠঘোরা না বিলাসপুর? এ হল হদ্দ পাড়া গাঁ। এখানে সন্ধ্যে হতেই সব সুনসান, সন্নাটা।
    ফিরে গেল কালো ডগ্গা বা গাড়ি নিয়ে পুলিশবাহিনী। কিন্তু থানেদার অজয় ডোঙ্গরের গোঁফের ফাঁকে যেন হাসির রেখা!

    কেটে গেল আরো দশটা দিন।

    তারপর এল এক বেস্পতিবার, স্থানীয় ভাষায় গুরুবার,-- বৃহস্পতি যে দেবগুরু! রাত্তির আটটা হবে। দরজা বন্ধ করে রূপেশ সেভিংস ব্যাংক লেজারগুলোর ব্যালান্সিং করতে ব্যস্ত ছিল। এমন সময় চ্যাঁ-চ্যাঁ করে কলিং বেজে উঠল। খুলে দেখে নেভি- ব্লু সোয়েটার গায়ে থানেদার ডোঙ্গরে স্বয়ং।
    -- চলো দোস্ত! বন্ধুকৃত্য কর। উইটনেস হতে হবে।
    -- সে কি? কোথায় যাব?
    -- ঐ বাজারের তিগড্ডায়। রামচন্দর সিন্ধির দোকানে। কালো গাড়ি গাঁয়ের বাইরে রেখে পেছনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে এসেছি। এখন তোমার রাজদূত স্টার্ট কর। তবে তো " জানদার সওয়ারি, শানদার সওয়ারি'' স্লোগানটার কোন মানে হবে!
    রাত সওয়া আটটার সময় মোটরবাইক থেকে নেমে দুজনে এগিয়ে গেলেন সিন্ধির দোকানে। আলোয় ঝলমল করছে চারদিক। সবকটা দোকানে চলছে কেনাকাটা, গ্রাহকের ভীড় একেবারে কম নয়। পান দোকানে ফিল্মি গানের ক্যাসেট বাজছে। কথামত ম্যানেজার এক প্যাকেট পানামা আর এক ডজন ডিমের অর্ডার দিলেন।
    একগাল হেসে দোকানদার মাল প্যাক করে দেয়। রূপেশ পয়সা দিতে যাবে এমন সময় পেছন থেকে অন্যদের ঠেলে এগিয়ে আসেন অজয় ডোঙ্গরে। খপ করে চেপে ধরেন রামচন্দর সিন্ধির কব্জি।
    --- কী রে! শালা সিন্ধি! সেদিন কী বলেছিলি? পাঁচটায় সব দোকান বন্ধ হয়ে যায়? চারদিক সুনসান হয়ে যায়। সবাই ঝাঁপ ফেলে ঘরে ঢোকে? এখন ঘড়িতে কটা বাজে? কটা বাজে ঘড়িতে? ঠিক করে বল হারামখোর!
    ওয়াকি টকিতে নির্দেশ পেয়ে পাঁচমিনিটের মধ্যে এসে যায় কালো গাড়ি। হাতকড়ি পরিয়ে গাড়িতে তোলা হয় সবকটা সিন্ধি দোকানদারকে।

    পরের দিন দুপুর বেলা। রূপেশ গেছে লাঞ্চের ফাঁকে স্থানীয় আর এম পি ডাক্তার চন্দু কাশ্যপের ডিসপেন্সারিতে। ডাক্তার নেই, কলে গেছেন ভিন গাঁয়ে। আধঘন্টার মধ্যে এসে পড়বেন। ও চেয়ার টেনে বসে কম্পাউন্ডার ধলা সদনের সঙ্গে গল্প জুড়ে দেয়। সদন মহা ফক্কড়। সাইনবোর্ডে লেখা আছে--" হম সেবা করতে হ্যায়,ঈশ্বর চাঙ্গা করতে হ্যায়।'' আমরা চিকিচ্ছে করি, ঈশ্বর ভাল করেন।
    সেদিকে চোখ পড়তেই শংকর মিচকে হাসে।
    -- ভুল লেখা আছে ম্যানেজার সাহেব। লেখা উচিত--" ঈশ্বর চাঙ্গা করতে হ্যাঁয়, হম নাঙ্গা করতে হ্যাঁয়।''
    ঈশ্বর সারিয়ে তোলেন, আমরা ন্যাংটো করি।
    দুজনের হাসির ফাঁকে হটাৎ রাস্তা থেকে একটা হৈ-চৈ এর আওয়াজ, এদিকেই এগিয়ে আসছে। ওরা বারান্দায় বেরিয়ে আসে। রাস্তা দিয়ে চলেছে একটা ভীড়, তাতে গাঁয়ের গণ্যমাণ্য ভদ্রজন ছাড়াও তাতে আছে ছোট ছোট বাচ্চার দল। সবার আগে কোমরে দড়ি আর হাতে হাতকড়ি বাঁধা অবস্থায় চলেছে শ্যামলাল, সমেলাল ও ইতোয়ারু। গন্তব্য বড় রাস্তার মোড়ে দাঁড়ানো পুলিশ ভ্যান।
    রূপেশের মন খারাপ হয়ে যায়। মাত্র তিনমাস আগে এই তিনজনকেই ও গ্রুপ-গ্যারান্টিতে আই আর ডি স্কীমের লোন দিয়েছিল। প্রত্যেক কে পাঁচ-পাঁচ হাজার। তখন এদের বেশ শান্ত, ভদ্র মনে হয়েছিল। এরা কি করে অমন কাজ করতে পারলো?
    হটাৎ ওর দিকে চোখ পড়তেই শ্যামলাল হাত তোলে, হাতকড়ায় বদ্ধ জোড়াহাত।
    -- প্যার পরথন হো সাহাব। শ্বশুরাল যাথন। ব্যাংক লোন বর চিন্তা ঝন করবে। ও পইসা পট জাহি।
    ব্যাংক লোন নিয়ে ভাববেন না। শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি তো কী? কিস্তি ঠিক আদায় হবে।
    তিনজনই হেঁটে যাচ্ছে মাথা উঁচু করে। নীচু গলায় নিজেদের মধ্যে কোন চুটকি শুনিয়ে হেসে উঠছে। চেহারায় কোন গ্লানির চিহ্ন নেই।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • অরিন | ০৬ নভেম্বর ২০২০ ১২:৩৯733152
  • অনবদ্য। অন্যরকম একটা দুনিয়ায় নিয়ে যাচ্ছেন প্রতিবার। ভারি চমৎকার গল্প বলেন। 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে প্রতিক্রিয়া দিন