এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  বাকিসব  মোচ্ছব

  • আহিরণ নদীঃ ১৭শ পর্ব

    Ranjan Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    বাকিসব | মোচ্ছব | ২৬ ডিসেম্বর ২০২০ | ২৫৮৫ বার পঠিত
  • | | | | | | | | | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | ১৫ | ১৬ | ১৭ | ১৮ | ১৯
    গত সপ্তাহে নীলিমাকে ভিলাইয়ে ওর বাড়িতে ছেড়ে এসেছি। কলিয়ারির হাসপাতালের প্যাথোলজিক্যাল ল্যাবে ধরা পড়েছে যে আমাদের দুজনের সংসারে তৃতীয় জন আসছে। আমার একটু সাবধান হওয়া উচিত ছিল । মোটরবাইকটা ভাল করে দাঁড় করানো হয়নি। নীলিমা নামতে গিয়ে ব্যালান্স হারিয়ে পড়ে যায় । বাইরে থেকে চোট লেগেছে কিনা বোঝা গেল না। কিন্তু আমার ভয় হল। যদি কিছু হয়ে যায় । তাই ভিলাই গিয়ে স্টিল প্ল্যান্টের সেক্টর নাইনের বড় হাসপাতালে দেখালে নিশ্চিন্ত হওয়া যাবে। ভাল খবরটা আমাদের বাড়িতেও দিতে হবে। আমি ঠিক করেছি এই ডেলিভারির সমস্ত খরচ আমিই দেব, নীলিমার বাড়ি থেকে নেব না । তবে নীলিমার ইচ্ছে – প্রথম সন্তান, ওর মায়ের কাছেই হোক ।

    তিনদিনের ছুটি দেখতে দেখতে ফুরিয়ে গেল। হাসিঠাট্টা খাওয়া দাওয়া। ওদের বাড়ির তুতো শালীর দল আর আমাদের বাড়িতে বড়ীভাবি—চিমটি কাটতে কেউ কম যায় না।

    --কি হল দেবরজী, তর সইল না? এখন ন্যাপি বদলানো শিখে নাও।

    -- ভাবী, আপ তো হমারী মাতা সমান হ্যায়।

    -- এ এ, ফালতু বাত নহীঁ। ম্যায় তুমহারী বড়ীশালী ইয়ানে ছত্তিশগড়ি মেঁ দেড়শাস হুঁ। নিমকি হমারী বহন ভী লগতী হ্যায়; ভুল গয়ে কা?

    ফেরার আগের রাতে নীলিমা আবার নিমকি হয়ে গেল।

    --শোন ম্যানেজার । একটা কথা। আমি আর ওই গাঁয়ে ফিরছি না।

    --কেন ? কী হয়েছে?

    -- কিচ্ছু হয়নি। দু’বছর তো তোমার সঙ্গে গাঁয়ে রইলাম। আমার শখ মিটে গেছে। আমি চাইনা আমার ছেলেমেয়ে ওই কুলিধাওড়ায় মানুষ হয় । বাচ্চা হয়ে গেলে আমি বাপের বাড়ি ছেড়ে তোমাদের বাড়ি গিয়ে থাকব। শ্বশুর-ভাসুর আমাকে পছন্দ করেন। বড় জেঠানী তো আমার তুতো দিদি। শাশুড়ি একটু ত্যাড়া মতন, কিন্তু নাতিনাতনির মুখ দেখতে পেলে সব ভুলে যাবেন। তোমারও আগামী বছরে ট্রান্সফার হবে। দেখ, যদি বিলাসপুর বা রায়পুরে হয়। একটু তদ্বির কর। তাহলে আমরা শহরে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকব। আমি একটা স্কুলে চাকরি নেব। নিজের বাচ্চাকে ওই স্কুলেই ভরতি করে দেব। গ্রাম-জঙ্গল-কয়লাখনি আর নয়।

    আর আমি চাই তুমি ওই এলাকা ছেড়ে দাও। যেদিন ছুরিগাঁয়ে নিয়ে গেছলে, ওই যে ভালুমার দ্রৌপদী না কে মেয়েটি এসেছিল। তুমি ওর সঙ্গে কথা বলছিলে আর আমি তোমাকে দেখছিলাম। তোমার চেহারায় চোখেমুখে যে ভাব ফুটে উঠেছিল তা আমার ভালো লাগেনি।

    তারপর নিমকি বা সরলা পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল-- সারারাত এককাতে।

    এটা কি একরকম মন্দের ভাল হল? আমিও কি ভেতরে ভেতরে হাঁফিয়ে উঠছিলাম? নীলিমার শরীরের মাদক গন্ধে আর জোড়া হাতের ফাঁসে কি দমবন্ধ হয়ে আসছিল? জানি না । আসলে আমি বোধহয় ঠিক ঘরসংসার করার জন্যে তৈরি হইনি।

    মুখের ভেতরে একটা বোদা স্বাদ নিয়ে ব্যাংকে ফিরলাম। গেওরা লোক্যাল ১৫ মিনিট লেট। ব্যাংকের দরজায় একটা জীপ দাঁড়িয়ে, নেমপ্লেটে গ্রামীণ ব্যাংকের নাম।

    কী ব্যাপার! হেড অফিস থেকে অডিট টিম? কোন কমপ্লেইনের এনকোয়ারি? শুনেছি নতুন চেয়ারম্যান কোন উড়ো চিঠি পেলেও এনকোয়ারি করতে বলেছেন। ভিতরে গিয়ে দেখি দু’জনের একটা দল বসে সিঙাড়া, কালাকাঁদ আর চা সাঁটাচ্ছে। ওদের মধ্যে একজনকে আমি চিনি— রামকুমার পান্ডে। তিন বছর আগে আমার ছুরি শাখার কাছে কাঠঘোরায় ম্যানেজার, আমাকে ওর বৌয়ের হাতের রান্না খাওয়াতে টিফিন ক্যারিয়ারে করে নিয়ে আসত। বর্তমানে হেড অফিসে স্ট্যাটিসটিকসের ডেস্কে।অন্যজনের পরনে জিনস , হালকা দাড়ি, একহারা চেহারা। চোখে একটা চাপা দুষ্টু হাসি।

    রামকুমার পরিচয় করিয়ে দিল—দেবাশীষ চ্যাটার্জি। তোর নতুন ও-এস-ডি। মানে অফিসার অন স্পেশ্যাল ডিউটি। এখন তিনমাসের জন্যে তোর ব্র্যাঞ্চে ডেপুটেশনে।

    আমার চোখে প্রশ্ন, ব্যাপারটা কী?

    আগন্তুক হাত বাড়িয়ে দেয়। বলে আমাকে চ্যাটার্জি বলেই ডাকবেন। ম্যানেজার আপনিই, আমি শুধু আপনার হেল্পিং হ্যান্ড।

    আমার মনের ধন্দ ঘোচে না । তখন পান্ডে ব্রিফকেস খুলে একটা বন্ধ খাম বাড়িয়ে দিয়ে বলে –এতে সব ডিটেইলস আছে। পরে দেখে নিস। আমি শর্টে বলে দিচ্ছি।

    আসলে এখানে যে আরেকটা কয়লা খাদান শুরু হচ্ছে তাতে কমপেনসন হিসেবে গাঁয়ের লোকের পকেটে আসবে বেশ কয়েক কোটি টাকা। এই মোচ্ছবে ঝাঁপিয়ে পড়ছে কোরবার সব ব্যাংক, বিশেষ করে স্টেট ব্যাংক ও সেন্ট্রাল ব্যাংক। আমাদের রিসোর্স নামমাত্র। তাই ডিপোজিট মবিলাইজেশনে অভিজ্ঞ অফিসার চ্যাটার্জিকে পাঠানো হয়েছে তোকে হেল্প করতে। এছাড়া কম্পেনসেশন পেমেন্টের দিন গাড়িভাড়া করতে পারবি। ক্লায়েন্টদের চা-জলখাবার খাওয়াতে খরচা করতে পারবি। বিলটিল সামলে রাখিস। মাসের শেষে ওগুলো জুড়ে স্টেটমেন্ট জমা করতে হবে। তাতে তোদের দুজনের সাইন লাগবে। চ্যাটার্জির থাকাখাওয়ার ব্যবস্থা তোকেই করতে হবে, ব্যস। এবার আমি চললাম দোস্ত, ওকে তোর জিম্মায় ছেড়ে।

    ক্যাশ কাউন্টার বন্ধ হওয়ার পর লাঞ্চ সেরে আমরা চায়ে চুমুক দিতে শুরু করি। চ্যাটার্জি একটা কাগজ নিয়ে এই দুরপা কলিয়ারি প্রোজেক্টের ক্ষতিপূর্তি জমা অভিযানের রোডম্যাপ ছকে ফেলে।

    প্রথম, কলিয়ারির সাব-অফিসে গিয়ে রেভিনিউ অফিসার বা কোন পাটোয়ারির সঙ্গে ভাব করে যাদের জমি সরকার নিচ্ছে তাদের নাম-ঠিকানা আর কতটা জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে সেটার লিস্টি হাতানো, যাতে টাকার পরিমাণটা একটু আঁচ করা যায় ।

    দ্বিতীয়, কোন মহল্লার পেমেন্ট কবে হবে তার খবরটা আগাম বের করা।

    তৃতীয়, ওই মহল্লার কোন কোন জাত আছে আর তাদের ওপিনিয়ন লিডার কারা –তাদের নামঠিকানা জোগাড় করা ।

    চার, পোটেনশিয়াল গ্রাহকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা এবং হটশট ক্যামেরায় ওদের পাসপোর্ট সাইজ ফটো তুলে নেয়া।

    পাঁচ, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিজেদের ক্যাম্পেনের সেলিং পয়েন্ট ডিজাইন করা। অর্থাৎ, কেন কেউ স্টেটব্যাংকের মত বটগাছের নৌকো না বেঁধে আমাদের মত ভুঁইফোড় ব্যাংকে নাম লেখাবে, কী স্পেশ্যাল সুবিধে পাবে, সেটা গাঁয়ের লোকের কথা ভেবে ঠিক করা। এবং তাদের বোঝানো যে আমরা প্রাইভেট ব্যাংক নই , চিটফান্ড নই । আমরাও সরকারি ব্যাংক, স্টেটব্যাংকের মতই, তবে গাঁয়ের লোকজনের জন্যে ।

    আমার মাথা ঘুরে যায়।,

    তারপর একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। আমার কোয়ার্টার হবে অপারেশন ডিপোজিট এর কম্যান্ড পোস্ট। চ্যাটার্জি আমার সঙ্গে থাকবে। মনবোধি আমাদের জন্যে রান্না করবে—চা, জলখাবার এবং লাঞ্চ। রাত্তিরে নুর মুহম্মদের হোটেল। এই ব্যবস্থা চলবে তিনমাস, তারপর দেখা যাবে ।

    শুরু হয়ে যায় আমাদের ক্যাম্পেন—চ্যাটার্জির তৈরি ছক মেনে। আমরা জোর দিই সাধারণ মানুষ, চাষাভুষোর সঙ্গে আত্মীয় ব্যবহার এবং দরকার মত বাড়ি গিয়ে স্পেশাল সার্ভিসের উপর। এটাও বলি যে কোরবা শহরের বড় ব্যাংকে বিজনেসম্যান ও লেখাপড়া জানা বাবুদের ভিড়। সেখানে ইংরেজিতে ফর্ম ভরতে হয় । গাঁয়ের মানুষ এক কাউন্টার থেকে আরেক কাউন্টারে ধাক্কা খেতে থাকবে। ওরা বড় ব্যাংক তো কি হয়েছে? তোমার জলতেষ্টা পেলে আহিরণ নদীতে গেলাস নিয়ে যাও? নাকি ঘরের কুয়োতে বালতি ডুবিয়ে টেনে তোল?

    পরপর তিনটে পেমেন্ট হয়ে গেল। বেশিরভাগ লোক চেক জমা করল স্টেট ব্যাংকে। আমাদের জুটল খুদকুঁড়ো। আমি হতাশ। কিন্তু চ্যাটার্জি হাসে। বলে এ তো খেলার শুরু।হাফটাইমও হয়নি। হেড অফিস থেকে খবর এল—হতাশ হবার কিছু নেই। স্টেটব্যাংক অনেক বড় , লোকবল ধনবল সব বিশাল। আমাদের মোট ক্ষতিপূরণের টাকার তিনভাগের একভাগ পেলেই চলবে।

    এসব সান্ত্বনা আমার পোষায় না। আমি জিততে চাই। চ্যাটার্জি বলে—প্রতিপক্ষের থেকে শেখা উচিত। ওরা প্রত্যেক গাঁয়ে নিজেদের ভলান্টিয়ার বানিয়েছে। তাদের খাওয়ায়- দাওয়ায়, টার্গেট পুরো করলে গিফট দেয় ।

    আমরা ঠিক করি নিজেদের টিই বিল যা পাবো, সব ভলান্টিয়ারদের পেছনে খরচ করব। আমাদেরও টিম তৈরি হয়।

    আমরা গাঁয়ে যাই গোপনে, সন্ধ্যের পর রাত্তিরে। আমরা সম্পন্নদের ছেড়ে ছোট ছোট জমির মালিক গরীব এবং অন্ত্যজদের পাড়ায় যাই। জুটিয়ে নিই সেখানকার নানা বয়েসের কর্মহীন যুবকদের। তারা দলবেঁধে আমাদের সঙ্গে গিয়ে ঘরে ঘরে অ্যাকাউন্ট খোলায়। আমরা হ্যাজাক বা টেমির আলোয় পাসবুক বিলি করি। তারপর ওরা লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলে –এবার একটু ‘ঠান্ডা-চা’ খাব।

    আমি অন্যদিকে তাকাই। মনবোধি ওদের নিয়ে নুরের দোকানে যায়।

    পরের চারটে পেমেন্টে হাওয়া ঘুরতে শুরু করল। স্টেটব্যাংকের টিম অবাক, তারপর আমাদের সঙ্গে একটা বিচ্ছিরি ঝগড়া হল। না হলেই ভাল হত । আমাদের চেয়ারম্যান, জিএম –সবাই স্টেটব্যাংকের যে!

    পাঁচনম্বর গাঁয়ের পেমেন্টের দিকে সবাই তাকিয়ে। অনেক বড় গ্রাম। অনেক লোক, সাতটা পাড়া। অনেক টাকা। এর একটা নেশা আছে। আগের পেমেন্টে একজন আমাদের ব্যাংকে একটা চেক জমা করেছে, তাতে লেখা এক লক্ষ বিয়াল্লিশ হাজার। এমন চেক আমাদের ব্র্যাঞ্চে এই প্রথম। অনেকক্ষণ হাত বোলালাম। তারপর উত্তেজনায় ভেসে গিয়ে রাত্তিরে নুরের হোটেলে আমরা দু’জন দুটো করে বিয়ার মেরে দিয়েছিলাম।

    কিন্তু সব আশায় জল ঢেলে সেদিন পেমেন্ট হল না। গাঁয়ের কিছু লোকজন মিছিল করে এসে পেমেন্ট অফিসের সামনে শ্লোগান দিল, কোলিয়ারির অফিসারদের ঘেরাও করার হুমকি দিল। কিছুই বুঝলাম না। পেমেন্টের দিন পিছিয়ে গেল এক সপ্তাহ।

    আজ ইতওয়ার বা রোববার। খেয়েদেয়ে খাটিয়ায় গড়িয়ে খানিকটা সময় কাটল। গরম বাড়ছে।

    মনবোধি শোনাল যে আবহাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গাঁয়ের লোকজনের মেজাজও চড়ছে।
    গাঁয়ে এখন নাকি দুটো দল। একটা পুরনো মোড়লের আর একটা নতুন চ্যাংড়াদের। নতুনের দল চাষের জমির ক্ষতিপূরণের জন্যে আরো উঁচু দর দাবি করছে।
    কাল নাকি নগৈখারের দিকে লোকজন কয়লা কোম্পানির জমিকাটা ডোজার মেশিন আটকে দিয়েছে। পুলিশ এসে ফিরে গেছে। সোমবার সবাইকে নিয়ে সমঝোতা বৈঠক হবার কথা ছিল। কিন্তু কোথাও জমির ক্ষতিপূরনের ঝগড়ায় মারামারিতে টাঙি চলেছে। একজনের আঙুল কাটা পড়েছে।

    একটু উশখুশ করছি এমন সময় চ্যাটার্জির হুকুম-- মনবোধি ! বড়িয়া কড়ি মিঠঠি চায় বনাও, হম দোনো থোড়া গাঁও ঘুমনে জায়েঙ্গে।
    তারপর আমার দিকে চোখ মেরে বলল--- চল না রে রূপেশ! আবার কবে এ গাঁয়ে আসা হবে কি না হবে?
    মাত্র এক কিলোমিটার পায়ে হাঁটা পথ। তারপর শিমূল গাছের পাশে একটা চায়-পান-বিড়ি-সিগ্রেট আর বিস্কুটের দোকান। কিছু চাল-ডাল-নুন-তেলও পাওয়া যায়।
    এই সময়টা দোকানের সামনে চার গাঁয়ের লোকজন জড়ো হয়। গুলতানি কেনাকাটা গপশপ সবই চলে।
    চ্যাটার্জির আশা এখানে ফোটানো দুধের চা খেতে খেতে গাঁয়ের আসলি খবর পাওয়া যাবে।
    কিন্তু সে গুড়ে বালি!
    মোড়ের মাথায় লোকের ভিড় নেই। হৈচৈ কেনাকাটা কিচ্ছু নেই।
    দোকানের সামনে মাত্র জনাচারেক লোক বসে চা খাচ্ছে। আমরা গিয়ে দাঁড়াতেই রুক্ষ স্বরে প্রশ্ন হল-- ক্যা চাহিয়ে?
    আমরা মুখ চাওয়া চাওয়ি করে বলি-- দো কাপ কড়িমিঠি চায় অউর--।
    আমাদের কথা কেটে দেয় দোকানদার -- নহী মিলেগা, দুধ নহী হ্যায়।
    আমরা অবাক। নেই মানে কী? ওই তো কড়াইয়ে ফুটছে!
    দোকানদার জবাব দেবার আগেই উপস্থিত চারজনের একজন বলে ওঠে-- ও দুধ আপনাদের জন্যে নয়।
    আমরা এবার কোন কথা না বলে গাঁয়ের ভেতরে পা বাড়াই।
    কি আশ্চর্য! গাঁয়ের ভেতরের ছোটখাটো দোকানগুলো আজ বন্ধ দেখছি যে! রাস্তাঘাটে জনমনিষ্যি নেই, শুধু ছোট বাচ্চারা খেলছে। পাতকুয়োর সামনে বালতি নাবিয়ে জল তুলতে থাকা বৌ-ঝিয়ের দল অন্যদিন চোখে চোখ পড়লে সলজ্জ হাসি হাসত বা কেউ কেউ সাহস করে 'রাম-রাম সাহাবমন!' বলত।
    আজ আমাদের দেখে কলসী-দড়ি-বালতি সব ফেলে দুদ্দাড় করে ছুটে পালাল।
    কিছু না বুঝে আমরা গাঁয়ের মোড়ল বা সরপঞ্চের বাড়ির দোরগোড়ায় গিয়ে দাঁড়ালাম।

    সদর দরজা ভেজানো, সামনে দু-চারটে ন্যাংটোপুঁটো বাচ্চা খেলছে। আমরা গিয়ে দাঁড়াই, উস্‌খুশ্‌ করি।
    চ্যাটার্জি হাঁক পাড়ে--- কৈসে গা গোটিয়া, ঘর মা হবে কা?
    কি গো মোড়ল? ঘরে আছ নাকি?
    কোন উত্তর নেই। বার দুয়েক হাঁক পেরে বিরক্ত হয়ে ওর দরজার কপাট থেকে ঝুলতে থাকা লোহার শেকল ধরে জোরে জোরে নাড়াই।
    হটাৎ দরজা খুলে যায়। দরজার ফ্রেমের মাঝে আধো ছায়ায় হেটো ধুতি আর পিরান পরা সমারুরাম গৌটিয়ার শুকনো কড়া চেহারা আমাদের চমকে দেয়। আরো চমকে দেয় ওর রস-কষহীন রুক্ষ কেজো প্রশ্নঃ
    --- কা বাত হ্যায়?
    আমি কি বলব ভেবে পাই না। এতদিন ওর দরজায় এলে এই গৌটিয়া আমাদের হাসিমুখে – আও গা সাহাবমন! বৈঠো, বলে খাটিয়া টেনে এনে বসিয়েছে। কাঁসার বাটিতে কাঁসার ছোট গেলাস বসিয়ে চা দিয়েছে, তাতে এক চামচ ঘি! আর আজ?
    চ্যাটার্জি তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে হাসিমুখে বলে-- কা বাত হ্যায় গৌটিয়া? আজ খড়ে খড়ে বিদা করবে কা? চুঙ্গি-উঙ্গি পিলাইকে মন নাহি হাবয়?
    কী ব্যাপার মোড়ল? আজ দরজা থেকেই বিদেয় করবি নাকি ? বিড়ি- টিড়ি খাওয়াবি না?
    সমারুরাম যেন ঘোরের থেকে জেগে ওঠে। একটু লজ্জা পায়। খাটিয়ার জন্যে বাড়ির ভেতর দিকে কাউকে হেঁকে বলে।
    তারপর বলে-- না, না! বিড়ি দেব না কেন? আসলে কি জান সাহেবরা? এতসব গন্ডগোলে মাথার ঠিক নেই আমার।

    তারপর ধীরে ধীরে শোনায় ওর বিপদের কাহিনী।

    ওর এক ছেলে, এক মেয়ে।

    সরকার যে জমির টুকরো কয়লাখনির জন্যে নিচ্ছে তাতে দেবে একটা চাকরি। তা জামাই জিদ ধরেছে ওই চাকরি ছেলেকে নয়, ওকে দিতে হবে। নইলে ওর বৌকে সরকারি কাগজে দস্তখত করতে দেবে না।
    এই নিয়ে শালা-ভাটোর মধ্যে কথা কাটাকাটি, বচসা; শেষে ছেলেটা রাগের মাথায় ভগ্নিপতির ওপর মারলো টাঙির কোপ! মেয়েটা বেওয়া হতে হতে বেঁচে গেল। কিন্তু জামাইয়ের বাঁ-হাতের তিনটে আঙুল চলে গেছে। তো ঘরের একজন হাসপাতালে, আর একজন হাজতে। গৌটিয়া বুড়ো দৌড়ুচ্ছে গাঁ থেকে শহর, শহর থেকে গাঁ।
    জামিন হয় নি। আগামী সোমবার কেস আদালতে তুলবে; উকিলবাবু দু'হাজার নিয়েছে। সেদিন বেশ কয়টা নম্বরি নোট নিয়ে যেতে হবে।
    এবার ও ঘটি থেকে ঢক্ঢক করে জল খায়।
    আমরা মিনিট খানেক চুপ করে থাকি।
    অস্বস্তি এড়াতে চ্যাটার্জি মুখ খোলে।
    ---- বহোত বুরি বাত। কিন্তু আমাদের কী দোষ? আমরা কী করেছি?
    ফুঁসে ওঠে গৌটিয়া সমারুরাম।
    --- কী বললে? তোমাদের কোন দোষ নেই? তবে কার দোষ? কে করেছে এসব?
    --- আমি? কী করলাম?
    --- তুমি নিজে না, তোমরা!

    আমরা জানতাম জমি হল মায়ের মতন; ও আমাদের খাইয়ে পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখে। জমি বেচতে নেই। তোমরা দেখালে লোভ,-- জমি দে, টাকা নে, চাকরি নে।
    আমরা ক্ষেতে চাকর রাখি, কামিয়া রাখি। নিজেরা গোমাতার সেবা করি, বাঢ়রাজা-বাররাণী-ঠাকুরদেব এর থানে মাথা ঠেকাই।
    আমরা কারো চাকর নই। এখন আমাদের ছেলেপুলেরা সরকারি অফিসে চৌকিদার হবে, পিয়ন হবে, চাপরাশি হবে!
    আমরা জানতাম সবাই মিলে একটা পরিবার। তোমরা শেখালে আপন আপন বাঁচ গে যাও। আমাদের হিসেবে বড় বা সিয়ান বা কর্তার কথাই শেষ কথা। তোমাদের প্রশ্রয়ে সেদিনের ছোঁড়াগুলো চোখ তুলে কথা বলে!
    আমার জামাই ও ছেলে! কত ভাব-ভালবাসা! দুই ভাইয়ের মত। এখন সেই ছেলে জামাইয়ের ওপর টাঙি চালিয়ে দিল--- এর জন্যে তোমরা শহুরে বাবুরা দায়ী নও?
    শোন গো! আজকের চা তোলা রইল। আকাশের মতিগতি ভাল নয়। আঁধি আসছে মনে হয়। অব তুমন জলদি রেঙ্গ। উঠ, রেঙ্গ। নহী তো ফঁস জাও গে।
    এবার তোমরা গা তোল, পা চালাও। নইলে এখানেই আট্কা পড়ে যাবে।

    আমরা চুপচাপ বেরিয়ে আসি। চ্যাটার্জি সিগ্রেট ধরায়, তারপর একদলা থুতু ফেলে বলে-- না এলেই ভাল হত।
    আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে--দূর্‌! মেঘ কোথায়? ওই যে এককোণে একটা ছোট্টমত? ওতে কিস্যু হবে না। মন খারাপ করিস নে রূপেশ! চল্‌, তোকে ওদের দেবতার থান দেখিয়ে নিয়ে যাই। ওখান থেকে আমাদের লেবার কলোনি ফেরার একটা শর্টকাট রাস্তা আছে।
    আমি কোন কথা না বলে ওর পেছন পেছন চলতে থাকি।
    গাঁয়ের বাইরে জঙ্গলের মধ্যে একটা বাঁশঝাড় এড়িয়ে খানিকটা সাফসুতরো জায়গা। বিশাল বটগাছ, বয়সের গাছপাথর নেই, অসংখ্য ঝুরি নেমেছে, উইয়ের ঢিবি।
    এইখানে বটের ছায়ায় গোবরলেপা একটু বেদি মতন, তাতে তিনখন্ড এবড়ো খেবড়ো পাথর-- একটা খানিকটা বাড়ির মশলা পেষা শিলনোড়ার মত। ওটার গায়ে সিঁদূর লেপা। আর সামনে কিছু হলুদ চাল, লংকা ও আদার টুকরো মত ছড়িয়ে রয়েছে।
    কিন্তু ওদের ভগবান কই?
    চ্যাটার্জি আমার অজ্ঞতায় হাসে। আঙুল তুলে দেখায় যে শিলনোড়ার মত দেখতে পাথরটাই বাঢ়রাণী, বাকি দুটো বাঢ়রাজা ও ঠাকুরদেব।

    আমরা খেয়াল করিনি-- ঈশানকোণে একটু আগে দেখা ছোট্ট কালির ফোঁটা কখন যেন আকাশের সাদা টেবিল ক্লথে ছড়িয়ে গেছে। দূর থেকে একটা গোঁ-গোঁ-সোঁ-সোঁ আওয়াজ। পাক খেয়ে আকাশে উঠে যাচ্ছে শুকনো পাতা ও লাল ধূলো।
    ---- সেরেছে! বড় করে আঁধি আসছে। মনবোধি, দৌড়ো।
    আমরা দৌড়োতে থাকি। একটু পরেই চারদিক অন্ধকার করে সেই ধূলোর ঝড় আমাদের গায়ে মাথায় আছড়ে পড়ে। কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি নে। চোখে মুখে বালি কিচকিচ করছে।
    ভাবছি কোথাও দাঁড়ালে হয়; তেষ্টায় গলা শুকিয়ে কাঠ। চ্যাটার্জি খিঁচিয়ে ওঠে-- থামিস না, সামনের দিকে দৌড়ো। আঁধি আমাদের পেছনে চলে যাবে। কিন্তু বৃষ্টি আসছে, তার আগে কলোনি পৌঁছতে হবে।
    আমরা অন্ধের মত সামনে দৌড়ে চলি।
    হ্যাঁ, ওই আঁধি বা ধূলোর ঘুর্ণি আমাদের টপকে গাঁয়ের দিকে চলে গেছে। এখন সামনে দেখতে পাচ্ছি। ওই তো আমাদের কলোনি! আর পঞ্চাশ গজ।
    ওয়েল্ডিং এর তীব্র ফুলকির মত এক আলোর রেখা ইস্পাতনীল আকাশটাকে ওপর থেকে নীচ অবদি ফালাফালা করে দিল। আর কড় কড় শব্দে বাজ।
    শেষ ল্যাপে চ্যাটার্জিকে হারিয়ে সোজা কোয়ার্টারের তালা খুলে ভেতরে ঢুকে দম নিলাম। ততক্ষনে বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি শুরু হয়েছে।

    হাঁপাতে হাঁপাতে মাথা মুছে চায়ে চুমুক দিয়েছি কি বিদ্যুৎ চলে গেল। ঘুটঘুটে অন্ধকারে বেশিক্ষণ থাকতে হল না, মনবোধি নিপুণ হাতে হ্যাজাক জ্বেলে দিয়েছে।
    বাইরে শুরু হয়েছে তান্ডব। কালো মেঘের চাঁদোয়ার নীচে ভেসে বেড়াচ্ছে পেঁজা তুলোর মত জলভরা সাদা মেঘ। মাটি ডাকছে আকাশকে। আকাশ সাড়া দিয়েছে সে ডাকে। বিজলির জিভ দিয়ে চেটে দিচ্ছে ধরতীর শরীর, লালায় ভরিয়ে দিচ্ছে। আর ধরতী মুঠো করে খামচে ধরছে গাছপালা, নুইয়ে দিচ্ছে মাথা।
    কোয়ার্টারের জানলায় ছাদে পায়খানার টিনের চালে বৃষ্টির চড়বড় চড়বড় যেন মাদলের বোল। এর ওপর শুরু হয়েছে 'ওলে' বা শিলাবৃষ্টি। আস্তে আস্তে ছাদ আর দেওয়াল ঠান্ডা হয়ে এল। বাইরে ঝড়ের দাপট কমেছে, কিন্তু বৃষ্টির জোর সেই একরকম।
    জানলা বন্ধ করতেই হল, নানারকম পোকামাকড় ঢুকছে। কানে আসছে অসংখ্য সোনাব্যাঙ ও ঝিঁঝির ঐকতান।
    কিছু করার নেই। এই আবহাওয়ায় টিভি চলার প্রশ্ন নেই, ট্রানজিস্টারেও শুধু খড়খড়ানি।
    খেয়েদেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ি। আর দুটো দিন। আর একটা রাত্তির। তারপর কমপেন্সনের পেমেন্ট শুরু হবে। দেবতা কি গ্রামীণ ব্যাংকের উপর প্রসন্ন হবেন?
    শীত শীত করছে। গায়ে চাদর টেনে এক ইঁটের পাতলা ছাদের ওপর বৃষ্টিধারার তবলা লহরা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ি।



    লল্লন মহারাজের সঙ্গে দেখা

    গ্রাম লখনপুর। গত আদমসুমারিতে জনসংখ্যা দশহাজার পৌঁছেচে। সেই সুবাদে ছত্তিশগড় রাজ্যের সরকার মুখ তুলে এদিকপানে চেয়েছেন। গতবছর এখানে খুলে গেছে একটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা পিএইচসি এবং কাছেই কয়লা খাদানের পাশে গেওরাতে খুলেছে একটা আস্ত ব্যাংক-- গ্রামীণ ব্যাংক। তাতে লকার বা এটিএম নেই তো কী? টাকা রাখা যায়, আবার তুলে নেওয়া যায়।এবছর থেকে চাষের সময় বীজধান- সার ও মুনিষের জন্যে লোন নেওয়া যাবে। নতুন ম্যানেজার এসেছে।ধীরে ধীরে মুদিখানা, কাপড়ের দোকান, পান-সিগ্রেট ও চা এবং ভাজিয়ার দোকানের জন্যেও লোন দেওয়া শুরু হয়েছে।

    লোকজন খুশি। মেয়েরাও রূপো বা সোনার গয়না বন্ধক রেখে টাকা তুলছে। ব্যাংকের সিন্দুকে ঢুকছে রূপোর তৈরি কোমরের গোট বা করধন, হাতে পরার নাগমুহুরি বা সাপমুখো আমুলেট; আর রয়েছে গালা ভরা সোনার হার মটরমালা , নাকফুল ও কানপাশা বা ঢার। গাঁয়ের শকুনিবুড়ো মিশ্রজি ও হিটুমল সিন্ধি পোস্ট অফিস ও দশ কিলোমিটার দূরের মহকুমা সদর থেকে কিনে মজুত করছে বেশ কিছু ১ টাকা দামের রেভিনিউ স্ট্যাম্প ও ১০ টাকা দামের নন-জুডিসিয়ল স্ট্যাম্প পেপার। ব্যাংক থেকে লোন তুলতে প্রমিসরি নোট ও এগ্রিমেন্টে দস্তখত করার সময় কাজে লাগবে। তবে দিতে হবে দুনো দাম। তা হোক গে, সবাই জানে সরকারি কাজে কিছু খচ্চা আছে।

    কয়েকজন বুদ্ধিমান নিজের নিজের ক্ষেতের 'জমিন কী পর্চি' বা ল্যান্ড রেকর্ডের পাট্টা সীলমোহর লাগিয়ে আপ-টু-ডেট করে রেখেছে। ওরা ব্যাংকে কেউ লোন নিতে গেলে জামানতদার হবে। লোন মঞ্জুর হলে কৃতজ্ঞ ব্যক্তিটি ওকে নিয়ে যাবে,বাসরাস্তার মোড়ে প্যাটেলের চায়-নাস্তার দোকানে। এক কাপ কড়ি-মিঠি চায় , এক খারা (নোনতা)অউর এক পিস মীঠা ( মিষ্টি) তো হোনা হী হ্যায়। এছাড়া আছে একদিন কী বনীভূতি --একদিনের মজুরি;-- আহা, ও যে নিজের কাজকম্মো ছেড়ে সারাদিন তোমার সঙ্গে সঙ্গে ছায়ার মত ঘুরেছে, ব্যাংকের সরকারি কাগজে টিপছাপ দিয়েছে , বল্লে হবে? খচ্চা ঠিকই আছে।

    গেওরা ব্র্যাঞ্চের থেকে এই গ্রামটি দশ কিলোমিটার দূর। রূপেশ কয়লাখাদানের জমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ হিসেবে লোকের অ্যাকাউন্ট খুলে ডিপোজিট বাড়াতে ব্যস্ত ছিল। এবার এই গ্রামে গ্রাহক বাড়ানোর টার্গেট ঠিক করেছে। ।

    বেলা একটা বাজে, গ্রাহকদের প্রথম ভিড়টা সামলে দিয়ে ও বাইক হাঁকাচ্ছে লখনপুরের জন্যে শুরু করবে ওই পিএইচসি বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে। মোটর বাইকে দশমিনিটের পথ। উদ্দেশ্য যদি ডাক্তার, কম্পাউন্ডার ও ড্রেসারের অ্যাকাউন্ট খোলা যায়।

    আজ হল "নৌতপা" বা বছরের সর্বোচ্চ গরম নয়টি দিনের দ্বিতীয়টি। এইসময় সূর্যদেব নাকি আকাশ থেকে নব্বই ডিগ্রি কোণে কটমটিয়ে ধরিত্রীর দিকে চেয়ে থাকেন। এ গাঁয়ের পাশ দিয়ে এঁকে বেঁকে বইছে আহিরণ নদী। তবে এই ভরা জৈষ্ঠে এখন গোড়ালি জল। ফলে আগুনে হাওয়ার তেজ কমছে না। পারা চড়েছে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি। বইছে হলকা। চলতি ভাষায় লু। তাই নাক-কান-মাথা সাদা গামছায় জড়ানো-- যেন শিশুপাঠ্য বইয়ের তুরেগ দস্যু।

    স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভিড় ঠেলে মাথা গলিয়ে দেখে প্রৌঢ় ডাক্তার চিঞ্চলওয়ারের তিরিক্ষি মেজাজ, সামনের একটি কিষাণকে বলেছেন পায়খানা পরীক্ষা করতে হবে, বোধহয় ক্রিমি আছে। কাল সকালে উঠে ওটা নিয়ে এসে এখানে জমা দিতে হবে। সে জানতে চাইছে কতটা আনতে হবে?

    ব্যস্‌, উনি অগ্নিশর্মা।

    -- কতকা লাবে? হামলাভর লাবে। খাবো কা?

    (কতটা আনবি? গামলা ভরে আনবি? আমি খাব নাকি?)

    জনতার মধ্যে একটা চাপাহাসির ঢেউ।

    চোপ্‌! উনি ধমকে উঠেছেন। নীচুগলায় বিড়বিড় করছেন।

    যেদিন থেকে এই চুতিয়া পাবলিক নীচজাতের লোককে এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর গদ্দিতে বসিয়েছে , সেদিন থেকে সব জাতধম্মো গেছে। আচার-বিচার-সংস্কারের নামগন্ধ নেই। হোম ডিস্ট্রিক্টে ট্রান্সফারের জন্যে কবে থেকে দরখাস্ত দিয়ে বসে আছি! এখন ছোটলোকেরা মাথায় উঠেছে। কী হবে তা প্রভু গজাননই জানেন।

    আমি ব্রীফকেস একপাশে নামিয়ে রেখে আবহাওয়া ঠান্ডা হওয়ার অপেক্ষা করি।

    সবে গামছা খুলে মাথা মুখ আর গলার ঘাম মোছা শুরু করেছি এমন সময় এক নতুন আপদ। কোণার বেঞ্চিতে বসে থাকা এক বৃদ্ধ আর তার সঙ্গী চোখাচোখি করে এগিয়ে আসে আর তারপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ডাক্তারের পা জাপটে ধরে মুখ ঘসতে থাকে।

    সবাই হতবাক।

    ভিড়ের মধ্যে উৎকর্ণ লোকজন এর ওর পাশ থেকে বকের মত গলা বাড়ায়। কোন কোন মহিলার মাথার ঘোমটা খসে যায়।

    --- মহারাজ! তঁয় মোর গুরুদেব, তঁয় মোর মাঈবাপ! মোলা বাঁচা লে!

    -- আগে খুলে বল, তোর সমস্যাটা কী, আর পা ছাড়, লাগছে।

    -- মহারাজ, মোর সাধু মহারাজ মন্দির মা প্রবেশ নহী কর পাতে, দ্বার পে হী মুড় পটক দেথে! অব তঁয় কুছু দবা-দারু করকে মোলা বাঁচা লে।

    আমার সাধু মহারাজ মন্দিরের দরজাতেই মাথা ঠুকে মরে, ভেতরে যেতে পারে না। তুই কোন ওষুধ-বিষুধ দিয়ে আমাকে বাঁচা।

    চিকিচ্ছের জন্যে ধর্ণা দেওয়া জনতার আমোদগেঁড়ে চরিত্র জেগে ওঠে। ওদের খুক খুক হাসিতে হতভম্ব ডাক্তার চিঞ্চোলকর এর ওর মুখের দিকে তাকান। আরে, কী হয়েছে কেউ কিছু বলবে? কম্পাউন্ডার ঢোঁক গিলে বুড়োর সঙ্গীটিকে শুধোয়-- অ্যাই, তুই না ওর সঙ্গে এয়েছিস? এবার বল কে ওর সাধু মহারাজ? আর কোন মন্দিরে তাকে ঢুকতে বাধা দেওয়া হচ্ছে? আমাদের ডাক্তারবাবু তার জন্যে কী করবেন?

    সঙ্গীটি দু'পা পিছিয়ে তোতলাতে থাকে।

    জনতা অধীর অপেক্ষায়।

    এমন সময় ভিড়ের মধ্যে ধ্বনিত হল এক গম্ভীর জলদ কন্ঠস্বর।

    -- ও বলতে লজ্জা পাচ্ছে, আমিই বলে দিচ্ছি ডাক্তার।

    সবাই চমকে তাকায়। তারপর সাদা কাপড় পরা গৌরবর্ণ চোখা চেহারার এই আগন্তুককে ঢিপ ঢিপ করে প্রণাম করতে থাকে। উনি আশীর্বাদের ভঙ্গিতে হাত তুলে মুখে 'খুশ্‌ রহো, খুশ্‌ রহো' বলে ওদের নিবৃত্ত করে ডাক্তারের দিকে তাকালেন।

    -- শোন হে ডাক্তার!

    এই বুড়ো হল চারপারা গাঁয়ের 'গৌটিয়া' (মোড়ল) নয়নদাস। গত সপ্তাহে বিয়ে করে ঘরে এনেছে একটি নাতনির বয়সী নওলকিশোরীকে। এদিকে বয়েসের সাথে ওর গুপীযন্ত্রটি হয়ে গেছে ঢিলে। প্রতি রাত্রে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়, ছেঁড়া তারে সুর বাজে না। সেই সমিস্যের কথা ঠারে ঠোরে বলতে চায়। একে সারানো তোমার কম্মো নয়। ওকে আমার হাতে ছেড়ে দাও। তুরতুরিয়া মঠে গিয়ে সন্ধ্যের সময় কয়েকবার আমার প্রবচন শুনুক। সব কিছু জোর করে হয় না।

    এই তবে তুরতুরিয়া মঠের মোহন্ত লল্লন মহারাজ! আমি কয়েকদিন ধরে ভাবছিলাম মঠের সেভিংস অ্যাকাউন্ট খুলতে দশ কিলোমিটার দূরে ওই মঠে গিয়ে আলাপ পরিচয় করব। ভালই হল। এখানেই হয়ে যাক।

    উনি কি অন্তর্যামী?

    সোজা আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন-- আরে! আমাদের নতুন ম্যানেজার সাহেব যে! আপনাকে যেতে হবে না। কাল আমিই আপনার ব্যাংকে আসব, ঠিক এই সময়ে। কিছু কাজ আছে।

    মহারাজ এলেন পরদিন, বেলা দুটো নাগাদ। রোজকার টাকাপয়সা জমা ও বের করার রুটিন কাজের ভিড় অনেকখানি পাতলা হয়ে এসেছে।

    ওঁর পেছন পেছন এসেছে ওঁর শিষ্য সিমেন্টের স্থানীয় দোকানদার ছোটু শেঠ, পোষাকি নাম দ্বারিকাপ্রসাদ আগরওয়াল। ওর হাজার পঞ্চাশের ক্রেডিট লিমিট চাই। আমি বলেছিলাম ভাল জামিন বা গ্যারান্টর নিয়ে আসতে, তা ওর গুরুদেবকেই ধরে নিয়ে এসেছে।

    ওঁকে কষ্ট দেওয়ার কী দরকার ছিল বলায় শেঠ ফিচেল হেসে বলে উঠলো --কী আর করি! আপনি এমন নাছোড়বান্দা। বললাম আমার গোডাউনের ডুপ্লিকেট চাবি ব্যাংকে গচ্ছিত রাখছি, আর কী চাই? কিন্তু আপনার সেই এক রা! ভাল গ্যারান্টর চাই। ওঁর চেয়ে বড় সম্মানীয় গ্যারান্টর এই তল্লাটে আর কে আছে!

    ওঁদের বসিয়ে চা আনিয়ে লোন ডকুমেন্টগুলো তাড়াতাড়ি ফিল আপ করা হচ্ছে, মহারাজ উসখুস করতে লাগলেন-- ওঁকে যেন সইসাবুদ করিয়ে তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেওয়া হয়। মঠের মন্দিরে কিছু কাজ বাকি আছে।

    -- মহারাজ, কিছু মনে করবেন না, আপনি শেঠজির ব্যাংক লোনের জন্যে গ্যারান্টিতে সই করছেন, কিন্তু এর তাৎপর্য্য ঠিক ঠিক জানেন তো?

    লল্লন হেসে উঠে বললেন-- এর মানে হল ছোটু শেঠ যদি সময়মত শোধ না দেয় তো তোমার ব্যাংক আমার থেকে আদায় করবে, এই তো? শুনে রাখ; ওসব আইন আমি খুব জানি। আর তার চেয়ে বেশি জানি নিজেকে। শুধু সইসাবুদ কেন, তুমি যদি দশ জায়গায় আমার দু'হাতের ও দু'পায়ের দশ-দশ করে কুড়িটা আঙুলের ভুসোকালি মাখিয়ে ছাপ লাগিয়েও নাও -- হবে কাঁচকলা! আমি যদি ভাবি যে পয়সা দেওয়া হবে না, তো তোমার ব্যাংক আমার থেকে একটি কানাকড়িও আদায় করতে পারবে না। তোমার বয়েস অনেক কম হে ম্যানেজার!

    সে যাত্রা ভালয় ভালয় কাটল। উনি যাওয়ার আগে আমাকে ওঁর মঠে এসে প্রসাদগ্রহণ করতে অনুরোধ করে গেলেন। তবে তুরতুরিয়া মঠের মোহান্তের মুখের কথা যে আসলে আদেশ , অন্ততঃ আশপাশের দশটা গাঁয়ের জন্যে-- সেটা বুঝতে আমার একটু সময় লেগেছিল।

    ধীরে ধীরে এই বিচিত্র মানুষটির বহুবর্ণরূপ আমি দেখতে পাচ্ছিলাম, যেন পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানো হচ্ছে। উনি তুরতুরিয়া মঠের প্রধান মোহান্ত, গুরু গোঁসাই। বহু মানুষ ওঁর কাছে আসে, সাষ্টাঙ্গ দন্ডবৎ হয়, আর নানান বিষয়ে পরামর্শ নিয়ে যায়-- আধিদৈবিক এর চেয়ে আধিভৌতিকই বেশি। লক্ষ করলাম-- হেন বিষয় নেই যা নিয়ে উনি পরামর্শ দেন না, সে মেয়ের বিয়ের সম্বন্ধই হোক, কি নতুন কোন ধানের ক্ষেত কেনা; এমনকি শিষ্যটির পঞ্চায়েত চুনাও বা নির্বাচনে কোন পদের জন্যে প্রার্থী হওয়া শুভ বা ইলেকশন জিততে কী স্ট্র্যাটেজি ভাল হবে --সব ব্যাপারেই ওঁর এক্সপার্ট কমেন্ট শিরোধার্য।

    বোঝা যায় যে শাস্ত্রজ্ঞ বেদ-উপনিষদ পড়া মানুষটির ভেতরে লুকিয়ে আছে একটি সুচতুর ব্যবসায়ী ।

    উৎকোচের রকমফের

    জানুয়ারির শেষ। শীত পড়েছে জাঁকিয়ে। ধানকাটা সারা। গাঁয়ের লোকের হাতে অফুরন্ত সময় ও অল্পস্বল্প পয়সা। সাতদিন ধরে চলছে তীজাপোলার মেলা। নতুন ফসল উঠেছে, মেলার চারদিকে অসংখ্য দোকান, নাগরদোলা ও ট্যুরিং টকীজ। দেখাচ্ছে 'নদীয়া কে পার' সিনেমা। মেয়েরা কিনছে চুলের ফিতে, আলতা; গুড়ের মুড়কি আর বাচ্চাদের জন্যে মাটির তৈরি ছোট ছোট পুতুল-- গরুর গাড়ি, গ্রাম্যদেবতা। বাচ্চারা খাচ্ছে পাঁপড় ভাজা আর বায়না করছে গোলাপি রঙা 'বুড়ির চুল' কিনে সখ করে ঠকবে বলে।

    মেলার শেষ প্রান্তে দুটো সরকারি মদের দোকান--বিক্রি হচ্ছে মহুয়া ও কমলালেবু থেকে তৈরি দেশি মদ। এককোণায় এক সরদারজি একটি ব্রিফকেস ও আর একটি রাইটিং প্যাডের ভরসায় চালিয়ে যাচ্ছে তার সুদের ব্যবসা বা হেটো ব্যাংক-- স্থানীয় ভাষায় হাটকি বেংক।

    সন্ধ্যের দিকে ঘুরতে ঘুরতে আমিও হাজির হয়েছি মেলায়। কিছু ডিফল্টার ক্লায়েন্টকে তাগাদা দেব, নতুন লোন নেওয়া দোকানিদের-- যেমন মিষ্টির দোকান, তেলেভাজার দোকান, ছিপিয়া বা মেয়েদের প্রসাধন সামগ্রীর দোকান-- স্টক ভেরিফিকেশন এর কাজটাও সেরে নেব। রথ দেখা ও কলা বেচা দুটোই হবে।

    একবার এয়ারগান দিয়ে বেলুন ফাটানোর কিছু চেষ্টা করে গেলাম একটি বৃত্তের পাশে। সেখানে ঘেরা জায়গার মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা আছে কিছু পণ্য--যেমন সাবান, ক্রীম, রুমাল সেট, এসেন্সের শিশি, আলতা ও সিঁদূর কৌটো। একটি বেতের রিং ছুঁড়তে হবে। যদি সেই রিং কোন একটি দ্রব্যকে ঘিরে মাটিতে পড়ে, তবে সেটা আমার। পাঁচটাকা দিলে পাঁচবার রিং ছোঁড়া যাবে।

    প্রথম তিনবার ফসকে গেল; চতুর্থ বারে আমার টপকানো রিংয়ে ফাঁসল একটি বোরোলীনের টিউব! সবাই হাততালি দিল। আমি যুদ্ধ জেতার ভঙ্গিতে সেটি নিয়ে হাত বুলিয়ে পকেটে ভরতে যাব, পেছন থেকে গম্ভীর গলায় শোনা গেল--" ভো ভো রাজন্‌, শৃণ্বন্তু মম বাক্যম্‌!"

    চমকে পেছনে ফিরে দেখি লল্লন মহারাজ।

    -- জিতেছেন বলে মনে পুলক জেগেছে? বেশ, কিন্তু খবরদার ওটি গায়ে মাখবেন না। ওগুলো সব নকল। দেখবেন?

    খেলাওয়ালা ওঁর ইশারায় টিউবটি এনে আমার হাতে দেয়। সবুজ রঙা প্যাকেটটি, বোরোলীনই তো!

    উনি আঙুল দিয়ে দেখালেন -- নামটি কোরোলীন। কিন্তু অক্ষরের টাইপ, সাইজ ও রঙ একেবারে বোরোলীনের নকল। জানলাম যে রাজধানী রায়পুর থেকে চল্লিশ কিলোমিটার দূরের ভাটাপাড়া শহরটি এইসব নকল ওষুধ ও প্রসাধন তৈরির আখড়া। ওখানে ফেয়ার এন্ড লাভলির নকলে তৈরি হয় 'কেয়ার এন্ড লাভলি'-- গাঁয়ের মেলায় ও দোকানে লোকজনকে বোকা বানাতে।

    ওনাকে আমার ফাইনান্স করা চায়ের দোকান থেকে আদা দেওয়া গরম চা খাওয়ালাম। কিন্তু দোকানদার পয়সা নিল না। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম যে বিনে পয়সায় কিছু নিই না।

    লল্লন হেসে হাত তুলে আমাকে নিরস্ত করলেন।

    -- সংকোচ করবেন না। ও চায়ের দাম নেবে না আমার জন্যে। আমি যে এই এলাকার গুরুঠাকুর--একমেবাদ্বিতীয়ম্‌।

    কথা বলতে বলতে আমরা গেটের দিকে এগোতে থাকি।

    আমি কিন্তু কিন্তু করে বলি--মহারাজ, দ্বারিকাপ্রসাদ, মানে ছোটু শেঠের তিনটে কিস্তি বাকি পড়ে গেছে। একটু বলে দেবেন। ওঁর চোখ একটু সরু হল বোধহয়। তারপর হাত নেড়ে বুঝিয়ে দিলেন --হয়ে যাবে।

    আমরা বেরিয়ে আসছি এমন সময় একটা চেঁচামেচির আওয়াজ। বিস্তর লোকজনের হৈচৈ । ভাবছি এইসব ফালতু ঝামেলায় নাক না গলিয়ে কেটে পড়ব, কিন্তু লল্লন যেন আমার মনের ভাব বুঝে হাত চেপে ধরে বললেন--চলুন।

    তারপর প্রায় টেনে নিয়ে চললেন গোলমালের উৎস খুঁজতে।

    মেলার একটি তাঁবুতে 'মৌত কা কুয়াঁ' বা মৃত্যুকূপের খেলা দেখানো হচ্ছিল। সেইখানে প্রচুর চেঁচামেচি। মালিক হাতজোড় করে বলছে যে আজ আমার খেলোয়াড় অসুস্থ হয়ে পড়েছে, বমি করছে। আমি টিকিটের টাকা ফেরত দিয়ে দিচ্ছি।

    কিন্তু বেশ কিছু পাবলিক জিদ ধরেছে যে ওরা বিশেষ করে এই খেলাটাই দেখবে বলে দূরের গাঁ থেকে এসেছে। এমনি এমনি ফেরত যাবে না। খেলোয়াড় অসুস্থ হলে মালিক নিজে খেলা দেখাক। কী ঝামেলা!

    --সব চুপ হো যাও! খেল হোগা। হো কে রহেগা।

    গর্জে উঠেছেন লল্লন মহারাজ।

    হঠাৎ যেন বাজ পড়েছে। সবাই অবাক।

    আমার হাতে ওঁর কাঁধের ঝোলা ও চশমা । উনি পরনের ধুতিটি আঁটোসাটো করে মালকোঁচা মেরে নিলেন। হতবাক মালিকের থেকে চেয়ে নিলেন ইয়েজদি মোটর সাইকেলের চাবি। তারপর চোখ বুজে বিড়বিড় করে কোন মন্ত্র আউড়ে চড়ে বসলেন। স্টার্ট নিয়ে অ্যাকসিলারেটরে চাপ দিতেই গুঙিয়ে উঠল ইঞ্জিন। প্রথমে ধীর লয়ে ওঁর মোটরসাইকেল বৃত্তাকার রিঙের মধ্যে পাক খেতে লাগল। তারপরে গতি বাড়তে বাড়তে গাড়ি বাঁদিকে কাত হয়ে ঘুরতে লাগল। আচমকা দুপাশের দেয়ালের গায়ে চড়ে গিয়ে প্রায় টিকটিকির মত দেয়াল বেয়ে পাক খেতে লাগল। তীব্রগতিতে পাক খাচ্ছে ওই মোটরবাইক।জনতা রুদ্ধশ্বাস। গোটা চার পাক খাওয়ার পর গতি কমতে লাগল। মোটরসাইকেল মাটিতে নেমে দাঁড়াল। নেমে এলেন লল্লন।

    ঘামে পিঠ ভেজা, কপালে নাকে জমে উঠেছে স্বেদবিন্দু। একটু যেন হাঁফ ধরেছে। আমার হাত থেকে চশমা ও ঝোলা নিয়ে সামান্য হাসলেন। সমবেত জনতার থেকে জয়ধ্বনি উঠল।

    এবার মৃত্যুকূপের মালিক এসে ওঁর পায়ে পড়ল। উনি মাথায় হাত ছোঁয়ালেন।

    আমি হতভম্ব। কোনরকমে বললাম-- এসবের কি কোন দরকার ছিল? বয়েস তো কমছে না।

    উনি হেসে বললেন-- সেইজন্যেই তো আড়াআড়ি মানে প্যারালাল চালালাম, উল্লম্ব বা ভার্টিক্যাল বাদ দিলাম। সেটাও পারি।

    আমার ঘোর কাটেনি।

    --কোথায় শিখেছিলেন?

    -- বলব, সবই বলব। তার জন্যে আমার সঙ্গে বসে মালিকের তাঁবুতে দু'কাপ কড়িমিঠি চা খেতে হবে যে! কোন সংকোচ কর না।

    পড়েছি মোগলের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে!

    মৃত্যুকূপের মালিক শুধু চা নয়, কিছু জলযোগও করালেন। তারপর একটি স্টিলের থালায় বেশ কিছু একশ' টাকার নোট ও সিঁদূর মাখানো একটি রূপোর টাকা সামনে ধরলেন। মহারাজ নির্বিকার মুখে গোটাটাই ওঁর ঝোলার গহ্বরে চালান করলেন।

    আমার অস্বস্তি ওঁর নজর এড়ায় নি।

    --শোন হে, ম্যানেজার। এটা ঘুষ নয়, মঠের জন্যে দান। চাই নি, খুশি হয়ে দিয়েছে।

    তারপর উনি আমাকে বোঝালেন যে প্রাচীন সময় থেকেই আমাদের দেশে উৎকোচ প্রথা রয়েছে। উৎকোচ হল তিন রকমের-- নজরানা, শুকরানা আর জবরানা।

    নজরানা হল যা প্রজাদের রাজদর্শনে বা ভক্তদের দেবদর্শনে দেওয়া প্রণামী--এটা ঘুষ নয়।

    শুকরানা হল সরকারিতন্ত্রের কেউ সহজে কোন বিহিত কাজ করে দিলে উপকৃত ব্যক্তি খুশি হয়ে স্বেচ্ছায় যা উপঢৌকন দেয়। এটাও ঘুষ নয়।

    ঘুষ হল 'জবরানা' -- যা জবরদস্তি করে লোকের থেকে আদায় করা হয়, কাজ হোক বা না হোক।

    উনি যা নিলেন তা হল 'নজরানা' ও 'শুকরানা' দুটোর মিশ্রিত রূপ। আজ খেলা না দেখালে খ্যাপা পাবলিক ওর ক্যাশবাক্স লুঠ করত, তাঁবুতে আগুন ধরিয়ে দিত। অনেকেই মহুয়া টেনে এসেছিল।

    আমার জিভে চায়ের স্বাদ তেতো হয়ে গেল। মহারাজের মৃত্যুকূপে মোটরসাইকেল চালানো শেখার গল্প শোনার আর আগ্রহ রইল না।

    বণিকপুত্র লিঙ্গবৎ

    সেদিন থেকে আমি লল্লন মহারাজকে একটু এড়িয়ে চলছিলাম। হোলির সময় তুরতুরিয়া মঠে যাওয়ার নিমন্ত্রণেও সাড়া দিই নি। কিন্তু এমনই গ্রহের ফের যে আমাকে ওঁর কাছে যেতেই হল।

    কারণটি গুরুতর।

    ছোটু শেঠের ব্যাংকের কিস্তি বাকি পড়েছে। তাগাদা করলেও কোন ফল হচ্ছে না। ওর এক কথা। আমি কি পালিয়ে যাচ্ছি নাকি? দেখছেন এখন সময় খারাপ চলছে। আমিও তো ধারে মাল দিয়েছি। আমার গ্রাহক সব কৃষক। গোলায় ধান উঠলে তবে পয়সা পাব।তখন আপনাকে দেব। আপনারা শহুরে লোক।গোটা দুই পরীক্ষে দিয়ে ম্যানেজার হয়েছেন। কিন্তু গ্রামীণ ব্যাপার চক্র বা বিজনেস সাইকেল বোঝেন না।

    তা ছোটু শেঠ আমাকে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে ছাড়ল। কিষাণের গোলায় ধান উঠল; বিক্কিরিও হল, কিন্তু শেঠ হস্ত উপুড় করল না।

    আরে ধান বিক্রি হয়েছে কৃষি মন্ডিতে, ওরা চাষীদের কোঅপারেটিভ ব্যাংকের চেক ধরিয়ে দিয়েছে, সেই চেকগুলো এখনও ক্যাশ হয় নি। তবে না!

    আমি ধৈর্য্য হারালাম। কাঁহাতক সয়! ওকে দিলাম রিকভারি নোটিস।

    ও না দিল জবাব, না পয়সা। কিন্তু আমি রিজিওনাল অফিস থেকে প্রেমপত্র পেলাম -- আমার নামে একটি বেনামি কমপ্লেন এসেছে যে আমি নাকি ছোটু শেঠকে একলাখ টাকার ক্রেডিট লিমিট দেব বলে দশহাজার টাকা কমিশন চেয়েছি। শেঠ অতিকষ্টে পাঁচহাজার টাকা দেওয়ায় আমি মাত্র পঞ্চাশ হাজার লিমিট রিলিজ করেছি, আর চাপ দিচ্ছি যে বাকি পাঁচহাজার টাকা পেলে তবে পুরো লিমিট রিলিজ করব।

    আমার এবম্বিধ আচরণের একটি তথ্য সমৃদ্ধ ব্যাখ্যা অতি আবশ্যক,-- সাতদিনের মধ্যে আমার দিক থেকে স্যাটিসফ্যাকটরি রিপ্লাই না গেলে রিজিওনাল অফিস থেকে ভিজিল্যান্স অফিসার প্রাথমিক এনকোয়ারি করতে আমার ব্র্যাঞ্চে আসবেন।

    এবার আমি খেপে গেলাম।

    একে তো এই প্রথম অফিস থেকে কোন প্রেমপত্র পেলাম। তায় কানাঘুষোয় শুনলাম যে এই বেনামি কমপ্লেন এর পেছনে লল্লন মহারাজের হাত ও মাথা দুই সক্রিয়।

    ব্যাংক থেকে তুরতুরিয়া মঠ প্রায় দশ কিলোমিটার। কিন্তু মোটরসাইকেলে পনের মিনিটের বেশি লাগে না। মঠের বাউন্ডারিওয়ালের গায়ে বাইক ঠেকিয়ে আমি একটু হাঁফাচ্ছিলাম। একজন সেবায়েত এসে বলল-- মহারাজ মন্দিরের পেছনে দীঘির পাড়ে রয়েছেন, আপনাকে ওখানেই ডাকছেন। দুপুরের রোদ মাথায় চড়ছে। আমি ব্রিফকেস থেকে ফাইলটা বগলদাবা করে সেবায়েতের সঙ্গে হাঁটতে লাগলাম।

    প্রায় কুড়ি বিঘে ধানি জমি ও পুকুর নিয়ে গড়ে উঠেছে তুরতুরিয়া মঠ। লালচে গিরিমাটিতে ছোপানো দেওয়াল। তাতে মন্দির ও গোটাকয়েক কামরা । ভেতর থেকে ভেসে আসছে ঘন্টাধ্বনি।

    দীঘির পাড় অব্দি যেতে যেতে চোখে পড়ল তরিতরকারি শাকসব্জির বাগান, বেশ যত্ন করে লাগানো।

    মহারাজ দুজন ঘেসেড়ের সঙ্গে বাগানের আগাছা পরিষ্কার ও ঘাস কাটা নিয়ে দরাদরিতে ব্যস্ত। আমাকে একনজর দেখে চোখের কোণে হাসলেন। দরে বোধহয় পোষায় নি। উনি ওদের হাত নেড়ে বাতিল করে দিলেন। ওরা এককোণে গিয়ে বসে রইল।

    এবার আমার দিকে তাকিয়ে আকর্ণ হেসে বললেন-- তাহলে মহামহিমের আমার এই গরীবদের মঠে আসতেই হল? জানতাম।

    এই মশকরায় আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। সোজা অফিসের চিঠিটি বের করে ওঁর দিকে বাড়িয়ে দিলাম--এসব কী হচ্ছে? আপনি এই ডিফল্টার শেঠের গুরুদেব? ওর কানে ফলস্‌ কম্প্লেন করার ফুসমন্তর দিচ্ছেন?

    ওঁর হাসি আরও চওড়া হল।

    -- রেগে যাবেন না সায়েব। তাতে ক্ষতি বই লাভ নেই। মহাভারতে বনপর্বে আছে রুষ্টা দ্রৌপদীকে যুধিষ্ঠির বলেছিলেন—

    ক্রোধে পাপ ক্রোধে তাপ ক্রোধে কুলক্ষয়,

    ক্রোধে সর্বনাশ হয়, ক্রোধে অপচয়।

    -- হেঁয়ালি ছাড়ুন। এই কম্প্লেইনটি আপনি করান নি?

    -- ধীরে ম্যানেজার সাহেব, ধীরে! প্রথমতঃ আমি এমন ছেঁদো কাজ করাই তার কোন প্রমাণ নেই। আপনার স্টেটমেন্ট মানহানিকারক; ইংরেজিতে ডিফেমেটরি!

    আর শেঠোয়া হল বণিকপুত্র; সে ওর স্বভাব অনুযায়ী কাজ করেছে, এই আর কি!

    বুঝলেন না ? 'বণিকপুত্র লিঙ্গবৎ'।

    লিঙ্গের স্বভাব কেমন? না অগ্র নম্র, মধ্য দৃঢ়, পুনঃ নম্র। গোড়ায় নরম, তারপর শক্ত আবার নরম।

    তা বানিয়া যতক্ষণ লোন না পাচ্ছে ততক্ষণ একেবারে বিনয়ের অবতার। আইয়ে , আইয়ে সব আপকা হী হ্যায়। আরে মাল লে জাইয়ে, রোকড়া বাদ মে ভেজ দেনা।

    লোন পেয়ে গেছে, তখন আর আপনাকে চিনবে না। আপনি তাগাদা করুন, ও মুখ ফিরিয়ে নেবে, খেঁকিয়ে উঠবে, উল্টে আপনার নামে কমপ্লেইন করবে।

    সব মিটে গেলে আবার নম্র, সেই আইয়ে, আইয়ে।

    আমি ঘামছি; এই বিষ্ণুগুপ্তের কূটবুদ্ধির কাছে হেরে গেছি।

    সেবায়েতের আনা চিনি-লেবুর সরবত চোঁ চোঁ করে খেয়ে নিয়ে বললাম-- বলুন, আমি কি করব?

    -- আপনিও আপনার ধর্ম পালন করুন। আমাকে নোটিস দিন।

    কী হল, বুঝতে পারছেন না? শুনুন।

    একজন ব্রহ্মচারী নদীতে স্নান করছিল, চোখে পড়ল একটি বৃশ্চিক জলে হাবুডুবু খাচ্ছে। উনি দয়াপরবশ ওকে যেই জল থেকে তুলে হাতের তেলোয় রেখেছেন ও ওঁর হাতে হুল ফুটিয়ে দিল। উনি বিষের জ্বালায় ছটফট করতে করতে গুরুদেবের কাছে গেলেন। বললেন--খুব শিক্ষে হয়েছে, আর কখনও গায়ে পরে কারও উপকার করব না।

    গুরু বললেন- ভুল করছিস। কখনও স্বধর্মচ্যুত হতে নেই। দেখ, এই কীটযোনি বৃশ্চিক, ও কিন্তু স্বধর্ম ভোলে নি, পরিত্রাতাকেও ডংক মেরেছে। আর তুই বিবেকসম্পন্ন ব্রহ্মচারী ! তুই এতেই বিচলিত হয়ে স্বধর্ম ত্যাগ করবি?

    ছোটু শেঠ ব্যাংকের কিস্তি না দিয়ে আপনার নামে মিথ্যে নালিশ করেছে --ওটা ওর ধর্ম, যাতে একটু বেশি সময় পায়। তা আপনিও ম্যানেজারের ধর্ম পালন করুন। আমাকে, মানে গ্যারান্টরকে নোটিস দিন।

    -- আর এনকোয়ারি?

    --ওঃ, ওটা? আচ্ছা, আমার পরামর্শ শুনবেন?

    আমার গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোয় না। কোনরকমে ঘাড় কাৎ করি।

    -- আমি বলি কি-- আপনি ওর লিমিট বাড়িয়ে একলাখ করে দিন, একেবারে ফ্রেশ লিমিট। ও আগের পঞ্চাশ হাজার কালই জমা করে দেবে।

    আজকাল পঞ্চাশ হাজারে কোন বিজনেস হয় না। তারপরে অফিস থেকে এনকোয়ারি এলে আমি ও ছোটু শেঠ দুজনেই স্টেটমেন্ট দেব যে ওসব কু-লোকের মিথ্যে নালিশ। ম্যানেজার অতি সৎ লোক। আগে পঞ্চাশ দিয়ে বাজিয়ে নিয়েছেন যে ছোটুর বিজনেস বুদ্ধি কেমন; তারপর সন্তুষ্ট হয়ে একলাখ করে দিয়েছেন।

    --বলছেন কী, মহারাজ?

    -- ঠিকই বলছি। আর ছ'মাস কাটলেই আপনার তিনবছর পূর্ণ হবে। এখানকার মেয়াদ শেষ। ভালো কাজের জন্যে আপনার আগামী পোস্টিং বড় জায়গায় হবে। গল্প শেষ।
    | | | | | | | | | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | ১৫ | ১৬ | ১৭ | ১৮ | ১৯
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • syandi | 2a01:c23:7cb0:a400:b420:292d:9de7:36f3 | ২৬ ডিসেম্বর ২০২০ ২২:৫৪733430
  • অধাসারণ রন্জনদা! 

  • Prativa Sarker | ২৭ ডিসেম্বর ২০২০ ০৯:৪৩733431
  • লেখকের গ্রাহক হয়েছি। কিন্তু সব নোটিফিকেশন পাচ্ছি কি !!

  • অরিন | 161.65.237.26 | ২৭ ডিসেম্বর ২০২০ ১০:৪৪733432
  • মন ভরে গেল। 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ক্যাবাত বা দুচ্ছাই মতামত দিন