এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  বাকিসব  মোচ্ছব

  • আহিরণ নদীর বুক ফাটে, মুখ ফোটে না (৫ম পর্ব)

    Ranjan Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    বাকিসব | মোচ্ছব | ১৭ অক্টোবর ২০২০ | ১৭৮৫ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • ৮)

    রূপেশ বর্মা যে আজ কার মুখ দেখে উঠেছিল! মঙ্গলবার দিনের শুরুতে ভারি ভীড়। সোমবার সাপ্তাহিক অবকাশের পর আজ প্রথম কামকাজ কা দিন। তাই প্রথম দুটো ঘন্টা কাউন্টারের সামনে ঠেলাঠেলি দেখার মত। এই কয়মাসে ব্যাংকের গ্রাহক সংখ্যা বেশ বেড়ে গেছে। ভিলেজ প্রোফাইল রেজিস্টারে অন্ততঃ ১৫টি গ্রামের নাম। সবচেয়ে দূরের গ্রাম সতরেঙ্গা আহিরণ নদী পেরিয়ে প্রায় ২৭ কিলোমিটার। বর্ষার মরসুমে ও অনুমতি পেয়েছে ছোট ও সীমান্ত কৃষক পরিবারকে কৃষি ঋণ দেওয়ার। ট্রেনিং এর সময় বলা হয়েছিল এ হল সবচেয়ে সোজা; একর প্রতি কত টাকা সেটা ঠিক করে দেওয়া আছে। তুমি শুধু ওর জমির কাগজ দেখে ধারাপাতের হিসেবে গুণ ভাগ কর আর জমির টাইটেল ডীড এর দস্তাবেজ ব্যাংকে জমা রেখে নাও।

    কিন্তু হাতেকলমে করতে গিয়ে দেখল মহা খিটকেল ব্যাপার। আগে দস্তাবেজে দেখ ক’জন লোক; কে লম্বরদার বা কর্তা এবং সব্বাই বেঁচে আছে কিনা। তারপর দেখ, কোন নাবালিগ অথবা মাইনরএর নাম রয়েছে কিনা। সেসব মিটলে দেখ ওর পেছনের কোন পাতায় কোন মারপিট বা ঝগড়াঝাঁটির জন্যে আদালতে কেস খেয়ে এটাতে জামিনের সীল মোহর লেগেছে কিনা। সে জামিন নিজের বা পরিবারের কারও জন্যে হোক বা বন্ধুবান্ধব পাড়াপড়শির জন্যে হোক—একই কথা। দস্তাবেজের ঝামেলা মিটলে শুভঙ্করের আর্যার হিসেবে যতটুকু লোন দেওয়া যায় তা বেশির ভাগ সময় গ্রাহক ব্যক্তিটির মনোমত হয় না । সে বেশি আশা করে। ম্যানেজারকে ভুল বোঝে; লোভ দেখায়। নগদ পাঁচ পারসেন্ট অথবা মূর্গা ও এক বোতল ঘরে তৈরি মহুয়ার মদ।

    কিন্তু এই শেষ নয়। এর পরে যেতে হবে প্রি-ইন্সপেকশন করতে । দেখতে হবে সত্যিই চাষি পরিবারটি দস্তাবেজে লেখা গাঁয়ে থাকে কিনা। গত কয়েকবছর ধরে চাষ করছে কিনা; পাটোয়ারির রেকর্ড থেকে পাঁচসালা বলে একটি কাগজে লেখা থাকে গত পাঁচ বছর ধরে ও জমিতে কোন টুকরোয় কী কী ফসল ফলিয়েছে। আর কতটুকু জমিতে বাস্তবে চাষ হয় এবং কতটুকু পতিত জমিন। গাঁয়ে গিয়ে বৈঠক করলে ,চায়ের দোকানে ভাজিয়া খেতে খেতে গল্প জমালে জানা যায় যে অমুক পরিবারের কী রেপুটেশন, স্বভাব-চরিত্তির—মানে জুয়ো খেলার, মদ খাওয়ার বা মেয়েমানুষের পেছনে ছোটার বাই আছে কী না । শালা ! ব্যাংকের ম্যানেজার নাকি বিয়ের সম্বন্ধ করতে আসা ঘটকঠাকুর? আগে জানলে কি ব্যাংকের নৌকরি করতে আসত?

    না ; ও আসত, ওকে আসতেই হত। ওর সামনে আর কোন রাস্তা খোলা ছিল না ।

    সে না হয় হল। কলেজের পড়া আর সত্যিকারের চাকরি, তা ও এমন মেঠো চাকরি –জমিন আসমান তফাৎ। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হল ফোর্থ ডাইমেনশন—টাইম।

    একটা লোন দেবার আগে যদি এত পাঁপড় বেলতে হয়—চাষির ইনটারভিউ, ডকুমেন্ট চেক, ফিল্ড ভিজিট এসব একাহাতে করবে কী করে? কোন ক্লার্ক নেই , ওকেই ক্যাশ গুণে গুণে জমা নেওয়া ও পেমেন্ট করা –সবই করতে হবে। ক্যাশ বুক, ডে বুক, জেনারেল লেজার লিখে ট্রায়াল ব্যালান্স করে তবে ব্যাংকের লাইট নিভিয়ে ঘরে আসতে পারবে।

    ও হো, তার আগে তো ওকেই ক্যাশ মেলাতে হবে; যা তিনবারে গিয়ে মেলে। হয় পয়সা, নয় ছোট নোট, নয় নতুন একশ’ টাকার বান্ডিলে গড়বড়। এরপর চাষিদের ভীড়; মেজাজ অজান্তেই তিরিক্ষি হয়ে ওঠে। কিন্তু চাষের সময় , ফসল বোনার সময়—কাউকে ফেরানো যাবে না । কবিদের কী! ওরা গান লিখেই খালাস –

    “ ধান কী কটোরা ভাইয়া, ধান কী কটোরা।

    মোর ছত্তিশগড়িয়া কহথে ভাইয়া, ধান কী কটোরা”।।

    ‘ধানে ভরা ডালা আমার, ধানে ভরা ডালা।

    আমার ছত্তিশগড়, জেনো রে ভাই—ধানের ভরা ডালা’।

    কিন্তু রূপেশকে লোনও মেপে মেপে দিতে হবে। সবটা নগদ দিলে চলবে না । খাদ বা ফার্টিলাইজার ডেলিভারি অর্ডারে দিতে হবে, তারপর চাষি ঘরে ওই রাখড় (সুপার ফসফেট) ও ইউরিয়া (নাইট্রোজেন) ‘বোরা’ বা বস্তাভরে ঘরে নিয়ে এলে সারের ব্যবসায়ীকে চেক দিয়ে পেমেন্ট করবে। বীজধান ও হালবলদের খর্চা নগদে দেওয়া যায়। চাষি চায় সবটাই নগদে; ঝগড়া করে, বলে নগদা-নগদি নিলে শেঠ কিছু ক্যাশ ডিসকাউন্ট দেয় । চেকে পেমেন্ট হলে ব্যাংকের কমিশন চাষির ঘাড়ে চাপায়।

    রূপেশ নিরুপায়। নতুন চাকরি, সার্কুলারের বাইরে কোন কিছু করবে না ; কোন নিষিদ্ধ জানলা খুলবে না । ‘ হে কুমির তোর জলকে নেমেছি’—খেলবে না ।

    সবই ঠিক, কিন্তু হেড অফিস এত নির্দয় কেন? কেন এত অবুঝ! ও বারবার লিখছে অন্ততঃ একটা ক্লার্ক দাও। আমিও তো মানুষ। ঠিক আছে, আমি ভিলাইয়ের ইন্ডাস্ট্রিয়াল টাউনের ছেলে হয়েও ন’মাসে ছ’মাসে বাড়ি যাই। চাপরাশির বাবা রসেলু প্যাটেলের রাস্তার ধারের হোটেল থেকে পাঠানো টিফিন ক্যারিয়ারের একঘেয়ে রান্না করা ভাত-রুটি –ডাল- একটা শুকনো তরকারি-আচার খাই। বাজার রান্না এসব করি না । মাসে একটাও সিনেমা দেখি না । সেই সময়ে ছুটির দিনগুলোতে পেন্ডিং পেপার ওয়ার্ক কমপ্লিট করি; লোন দেওয়ার আগে প্রি- ও পরে পোস্ট ফিল্ড ভিজিট করি। কিন্তু এভাবে আর কতদিন টানতে হবে? কুবের দেবতা কি বোবা ও কালা?

    ক্লার্ক-কাম –ক্যাশিয়ারের নতুন ব্যাচ রিক্রুট হয়েছে দু’মাস হল। কিছু কিছু ব্যাংকে আমার ব্যাচ ফেলোরা ক্লার্ক পোস্ট হওয়ায় হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। কিন্তু আমি? মুঝকো ভী তো লিফট করা দেঁ। মেরা ক্যা কসুর? উইক এন্ডে চেয়ারম্যান অথবা জেনারেল ম্যানেজারের বাড়ি গিয়ে হেঁ-হেঁ করি না , তাই? করব কী করে? আমার ব্র্যাঞ্চ যে রোববারে নয়, সোমবারে বন্ধ হয়। কর্তারা ভাবেন আমি নিঘঘাৎ ছুটির দিনে ভিলাইয়ে আমার বাড়িতে মায়ের আদর বাবার প্রশ্রয় পেতে যাই। কিন্তু ওদের সত্যি কথাটা বলা যাবে না । বলতে পারব না যে সে রাস্তাটা আমি নিজেই বন্ধ করে দিয়েছি; হ্যাঁ, নিজের হাতে দরজায় পেরেক ঠুকে।

    কিন্তু সপ্তাহের কামকাজের দিন মঙ্গলবারে প্রথম দু’ঘন্টা ওর মাথায় এসব চিন্তা থাকে না । কাউন্টারের বসে খালি একের পর এক ভাউচার চেক করা, ক্যাশ গোণা, লেজারে পোস্ট করে পাসবুকে এন্ট্রি করে গ্রাহকের হাতে তুলে দেওয়া। পরের জন?

    এর মধ্যে কখন চাপরাশি ঠুল্লু এসে কাঁচের গ্লাসে চা রেখে যায়। আদ্দেক চুমুক দেওয়া হয়, বাকি চায়ে সর পরে যায়; তারপর অবধারিত ভাবে একটা মাছি এসে গোঁত্তা খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে ।

    আজ একঘন্টাও কাটে নি, প্রথম রাউন্ড চা আসবে আসবে এমন সময় ঠুল্লু এসে বলল—সাব, এক আদমি আপসে মিলনা চাহতে হ্যাঁয়।

    ও খিঁচিয়ে ওঠে। আভি নহীঁ, শাম কো, চার বাজে।

    --নহী সাহাব; দুসরা আদমি, হেড অফিস সে আয়া হ্যাঁয়।

    মরেচে, স্ন্যাপ অডিট করতে এল? এই পিক আওয়ারে। হেড অফিসেরও কোন গাঁড়-গর্দানের হোঁশ নেই । ও শশব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায়।

    একটি ছিপছিপে চেহারা এগিয়ে আসে। ওর পরনে ফুলহাতা সাদা শার্ট, ডার্ক স্ট্রাইপড ট্রাউজার , গলায় কেতাদুরস্ত টাই, পায়ে লেদারের ব্রাউন শু। অডিট? রিজার্ভ ব্যাংক?

    ছেলেটি ব্রিফকেস খুলে একটি বন্ধ লম্বা খাম বের করে। রূপেশ হাত বাড়ায়, কিন্তু ও খামটা ধরে রেখে ইংরেজিতে বলে—আমি ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করতে চাই।

    --ঠিক আছে, খামটা দিন।

    --না , মানে আমি এই ব্র্যাঞ্চের যিনি ইনচার্জ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাই। আমাকে খামটি তাঁর হাতেই দিতে বলা হয়েছে।

    উৎসুক ভীড় নতুন কোন তামাশা দেখার আনন্দে অধীর।

    রূপেশ রাগটা চেপে রেখে কেটে কেটে বলে—আমিই ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজার বা ইনচার্জ রূপেশ বর্মা। আপনার পরিচয় ?

    ছেলেটি হকচকিয়ে যায়। অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে রূপেশকে দেখে। ঘরের চারপাশে চোখ বুলিয়ে একটু হতাশ হয়। তারপর খামটি রূপেশের দিকে বাড়িয়ে বলে – মাই নেম ইজ টি পি পি রাজন। আই অ্যাম ইয়োর নিউ কাশিয়ার -কাম-ক্লার্ক। দিস ইজ মাই অ্যাপয়েন্টমেন্ট অ্যান্ড পোস্টিং লেটার অ্যাজ ওয়েল; অ্যান্ড দিস ইজ জয়েনিং রিপোর্ট।

    রূপেশ খাম ছিঁড়ে কাগজগুলো খুঁটিয়ে দেখে। রাগটা কমে আসছে, পাওয়া গেছে। একজন সাথী, হোকগে সাউথ ইন্ডিয়ান। তবু ব্যাংক বন্ধ হওয়ার পর নিজের মত কিছু কথা তো বলা যাবে। এবার ও হাত বাড়িয়ে দেয় । তারপর বলে টি পি পি? পুরো নামটা কী? আর বাড়ি কোথায়?

    --তুন্ডি পরমপিল্লে পাচন রাজন। আপনি আমাকে রাজন বলেই ডাকবেন। আমার বাড়ি ভিলাইনগর। স্টিল সিটি, নামটা নিশ্চয়ই শুনেছেন। আপনার বাড়ি?

    ভিলাইনগর! দশ হাজার ভোল্টের শক! উঃ ভগবান, আর কত পরীক্ষা নেবে?

    ও উত্তরটা এড়িয়ে গিয়ে বলে --- ও কে, রাজন। খাওয়া হয় নি নিশ্চয়ই; ঠুল্লুর সঙ্গে বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে ওর বাবার হোটেলে খেয়ে নিন। দাম দিতে হবে না। এটা আমার ওয়েলকাম ট্রিট মনে করুন। মালপত্রগুলো ঠুল্লু এখানে নিয়ে আসবে। তারপর কাজের কথা হবে।

    আজ রূপেশের কাছে ভিড় খুব হালকা মনে হল। ও সবার সঙ্গে খুব ভাল করে হেসে কথা বলল। একজন সম্পন্ন কৃষককে ধৈর্য্য ধরে বোঝাল যে এই ব্যাংক খালি গরীবদের লোন দেওয়ার জন্যে খোলা হয়েছে, তাই আপনাকে দিতে পারছি নে। আপনি ঘরের বাড়তি পয়সা এখানে জমা খাতা খুলে তাতে রাখতে পারেন, চোর-ডাকাতের ভয় নেই আবার সুদে বাড়বে।

    রাজন খেয়েদেয়ে মালপত্র নিয়ে ফিরে এসে হাজিরি খাতায় সই করতে গেলে রূপেশ বলল— জাস্ট এ মিনিট! এই লেটারে নির্দেশ দেওয়া আছে যে আপনার থেকে সিকিউরিটি ডিপোজিট হিসেবে দু’হাজার টাকা নিয়ে ফিক্সড করে হেড অফিসে জানাতে হবে। এটা আপনার জয়েনিং রিপোর্ট এর সঙ্গে যাবে।

    রাজন ব্রিফকেস খুলে একটি চেক বাড়িয়ে দেয় ।

    রূপেশ মাথা নাড়ে, হয় ড্রাফট নয় ক্যাশ। বিব্রত রাজন বলে আমার দাদার বুঝতে ভুল হয়েছে। আমি মালয়ালী; উইনাদের কাছে গাঁয়ে বাড়ি। ভিলাইয়ে দাদার সংসারে থেকে পড়াশুনো করেছি। ঘরে ক্যাশ ছিল না তাই চেক দিয়েছেন।

    --তাহলে ভিলাই ফিরে যাও; গিয়ে ক্যাশ নিয়ে এস। তারপরে জয়েন করতে পারবে।

    রাজন স্পষ্টতঃ হতাশ। ব্রিফকেসে চেক ঢুকিয়ে উঠে দাঁড়ায়। বলে –বস, আমাকে ভিলাই গিয়ে ব্যাংক থেকে ক্যাশ তুলে আবার ছুরিকলাঁ গাঁয়ে এসে আপনার কাছে ডিপোজিট করতে তিনদিন লেগে যাবে। আমার সিনিয়রিটি মার খাবে। দাদা বলছিল--। ঠিক আছে, আপনি কী আর করবেন, আমার লাক।

    রূপেশ কিছু দেখছে না । ব্যাংকের সাদা দেওয়াল, তাতে টাঙানো রিজার্ভ ব্যাংকের জারি করা লাইসেন্স; মন্ত্রীর উদ্ঘাটনের ছবিগুলো—কিস্যু না । ওর যেন গরম লোহার ছ্যাঁকা লেগেছে। দুটো শব্দ –‘দাদা বলছিল’।

    ও চেকটা চেয়ে নেয় । তারপর নিজের সেভিংস খাতা থেকে দুহাজার উইড্র করে ফিক্সড ডিপোজিটের ফর্ম ও ভাউচার ভরে রাজনকে বলে—সাইন কর; এখানে, এখানে –আর এখানে।

    হতভম্ব রাজন কলের পুতুলের মত সাইন করে। হাজিরি খাতাতেও।

    -আমি তোমার চেক আমার কাছে জমা রেখে সিকিউরিটির টাকাটা ধার দিলাম। এই ব্র্যাঞ্চ সোমবার বন্ধ থাকে। তুমি রোববার রাতে বাড়ি যাও, সোমবার ভিলাইয়ের ব্যাংক থেকে টাকা তুলে মঙ্গলবার ফিরে এসে আমাকে দিয়ে চেকটা ফেরত নাও।

    সাতদিন কেটে গেছে। রাজন যথারীতি মঙ্গলবারে ফিরে এসে রূপেশের দু-হাজার টাকা ফেরত দিয়ে দিয়েছে আর নতুন কাজটা শিখে নেবার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। কিন্তু একবারও ওই টাকাটা দেওয়া নিয়ে কিছু বলে নি। রূপেশ কি একটা ধন্যবাদ অথবা ওইরকম কিছু আশা করেছিল? অন্ততঃ ওর দাদার কাছ থেকে?

    নাঃ ; দাদাদের ভূমিকা নিয়ে ওর কোন মোহ নেই ; তবু?

    সপ্তাহ দুই যেতেই রাজন একটা প্রস্তাব দিল যে ওরা মাত্র দু’জন, হলই বা একজন অফিসার আর একজন ক্লার্ক, তবু কি একসঙ্গে মেস করে থাকা যায় না ? বস, আপনাকে কিচ্ছু করতে হবে না । আমি রাঁধতে জানি, খেয়ে দেখুন --আঙুল চাটবেন। খালি ঘর মোছা, কাপড় কাচার জন্যে একজন লোক রেখে নিন। নইলে ঠুল্লুকে কিছু এক্সট্রা টাকা মাসে মাসে দিয়ে এগুলো করিয়ে নিন। বাসন মাজা আর রান্না আমার জিম্মায়। মেসের খরচা, ইলেক্ট্রিক বিল দুজনে সমান ভাগ করে নেব। খামোকা বাসরাস্তার মোড়ে রসেলুর কামচালাউ হোটেল থেকে অখাদ্য খাবার খেয়ে পেটের বারোটা কেন বাজাচ্ছেন? পরে স্টাফ বাড়লে তখন দেখা যাবে।

    শুরু হল নতুন সংসার। রাজন ঘর থেকে নিয়ে এসেছে একটা টেবিল ফ্যান আর প্রাইমাস স্টোভ, রূপেশ কিছু থালাবাসন আর কড়াই কিনে নিল। গাঁয়ের থেকে কেনা হল দুটো নেয়ারের খাট । শুরুটা মন্দ হয় নি।

    তবে দুটো সমস্যা দেখা দিল।

    ব্যাংকে বাথরুম নেই , রয়েছে খাটা পায়খানা। একজনের যেমন তেমন করে চলে যায় , কিন্তু দু’জন হলে? নাকে কাপড় বেঁধে? পরিষ্কার করতে একজন মেথরাণী আসে, সকাল নটায়। ছোট বাইরের জন্যে পাশের গলিতে একটা চট টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে, তার আড়ালে একটা স্লেট পাথর পাতা, পাশে জলের হাঁড়ি ও বনস্পতি ডালডার টিন কেটে তৈরি মগ। কিন্তু ব্যাংকের সময় তাতে ওরা দুজন ছাড়া দূরের গ্রাম থেকে আসা লোকজনও চলে যায়, কে বারণ করবে!

    স্নানের জল, রান্নার জল ও খাওয়ার জল ঠুল্লুকে আনতে হয় মকানমালিক কলেশরাম গৌঁটিয়ার পেছনের উঠোনের কুয়ো থেকে, বালতি ভরে। কিন্তু মাঝেমাঝে কলেশরামের ভাই কুয়োর ঢাকনায় তালা লাগিয়ে দেয় , বলে জল নেমে যাচ্ছে।

    রাজন রোজ একবার করে তাগাদা দেয়—বস, এটা কী হচ্ছে! আপনি ল্যান্ডলর্ডকে বলুন পায়খানা পাকা করে দিতে, বাথরুম বানিয়ে দিতে, কলের ট্যাপ লাগিয়ে দিতে। এসব তো বেসিক নেসাসিটি। এগুলো না দিলে আমরা ব্যাংক অন্য বিল্ডিঙয়ে নিয়ে যাব।

    রূপেশ হেসে ফেলে। এটা ভিলাই স্টিল প্ল্যান্টের কোয়ার্টার নয় । এখানে গোটা গাঁয়ে কোন কলের জলের ব্যবস্থা নেই । রাস্তার ওপরে আর বামনদীঘির পাড়ে এজমালি কুয়ো আছে, পঞ্চায়েত বানিয়ে দিয়েছে। বাকি সবাই নিজের বাড়ির কুয়োর জল খায়, রান্না করে; স্নান করতে কাপড় কাচতে নারীপুরুষ নির্বিশেষে পুকুরে যায়। গাঁয়ে কোন বাড়িতে পাকা পায়খানা নেই। কলেশরাম গৌটিয়ার মত সম্পন্ন লোকজনের বাড়িতেও খাটা পায়খানা। আম জনতা এমনকি স্কুলের টিচার সবাই লোটা নিয়ে মাঠে যায়; মেয়েদের তিনটে ব্যাচ হয়। খুব ভোরে, দুপুরে স্নানের আগে আর সূর্য ডুবলে । ওরা যায় দলবেঁধে, বসে ঘোমটা টেনে। আর নিত্যকম্ম সেরে পুকুরে ডুব দিয়ে কাপড় কেচে ভিজে কাপড় গায়ে জড়িয়ে আব্রু রক্ষা করে বাড়ি ফেরে। গরীবঘরের মেয়েরা পুকুর থেকে কলসি ভরে খাবার ও রান্নার জল নিয়ে আসে।

    রাজনের ঘ্যানঘ্যান শুনতে শুনতে রূপেশ একবার কলেশরামের কানে কথাটা তোলে। কিন্তু গৌটিয়া মাছি তাড়ানোর মত করে হাত নেড়ে বলে বাড়িভাড়ার একরারনামা বা এগ্রিমেন্টে পায়খানা বাথরুম নিয়ে কিছু বলা নেই । আর বিলাসপুরের হেড অফিস থেকে বড়কর্তারা এসে বাড়ির অবস্থা দেখে শুনে তবে ব্যাংকের জন্যে বায়না দিয়েছিলেন। এখন নতুন করে কিছু করা মুশকিল।

    রাজন রেগে মেগে মগ নিয়ে পুকুরপাড়ে বেশরমের ঝাড়ের নীচে নিজেকে শুদ্ধ করে পুকুরে ডুব দিয়ে আসা শুরু করল। রূপেশ কিছু বলল না । তবে ওর জল ও পায়খানার চাপ অনেক হালকা হয়ে গেল।

    কেটে গেল পনের দিন।

    রাজন ব্যাংকে এসে কাজ করছে কিন্তু কথা বলছে ভাববাচ্যে। হলটা কী?

    রূপেশের এসব ন্যাকামি অসহ্য লাগে। দুপুরে লাঞ্চের সময় বেগুনপোড়া আর ডাল দিয়ে আধপোড়া চাপাটি খাবার সময় একটা লংকায় কামড় দিয়ে ও জানতে চাইল ব্যাপারটা কী?

    রাজন নিরুত্তর। অন্যদিকে তাকাচ্ছে, মাথা নীচু করে খাচ্ছে, চোখের কোণে একটু জলের আভাস কি?

    রূপেশ খিঁচিয়ে উঠল—কা বাত হ্যাঁয়? তুম মেরি গার্লফ্রেন্ড হো ক্যা ? ইতনা নখরা তো মৎ দিখাও। সাফ সাফ বাতাও।

    রাজন কিন্তু কিন্তু করে বলল যে ও আবার কাল থেকে ব্যাংকের খাটা পায়খানা ব্যবহার করার অনুমতি চায়। রূপেশ হাসি চেপে বলল যে কেন, খোলা মাঠে কী অসুবিধে? এতদিন তো ভালই চলছিল।

    রাজন মাথা নেড়ে বলল যে আজ একটা কান্ড হয়েছে। ও একেক দিন ঘুরে ঘুরে সাত তালাওয়ের এক একটার পাশে গিয়ে কাজ সেরে স্নান করে আসে। সাঁতারও জানে; ভিলাইয়ের সুইমিং পুলে শিখেছে।

    কিন্তু আজ পেটে মোচড় লাগায় একটা ডোবা মত পুকুরের পাশে বেশরমের ঝাড় আর একটু জমা জল দেখে বসে পড়েছিল। পুকুরে দুদিকে দুজন ছিপ ফেলে মাছ ধরছিল। ওরা হটাৎ ওর দিকে তাকিয়ে নিজেদের মধ্যে ছত্তিশগড়ি ভাষায় কিছু বলতে শুরু করে। রাজন ভিলাইয়ে পড়াশুনো করা মালয়ালি ছেলে, হিন্দির জ্ঞান কাম-চলাউ আর স্থানীয় ভাষার কিছুই বোঝে না । একটু পরে কিছু পরিচিত হিন্দি গালি কানে আসায় বুঝল যে ওই দুজন রেগে গেছে এবং ওকেই গাল পাড়ছে। কারণ ও নাকি ঠিক জায়গায় না বসে রাস্তার উপর বসে হাগছে এবং রাস্তাটি মেয়েদের পুকুর থেকে জল নিয়ে যাওয়ার জায়গা। ওর এই বেয়াক্কেলেপনায় গাঁয়ের মেয়েরা কি সারাদিন মাথায় কলসি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে? সর উঠাকে দেখলে ঠাকুর!

    ও চোখ তুলে দেখে পুকুর পাড়ে তিনজন মহিলা মাথায় কলসি নিয়ে ঘোমটায় আধখানা মুখ ঢেকে প্রায় হিন্দি সিনেমার নাচের ভঙ্গিতে স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

    কেন দাঁড়িয়ে আছে, চলে গেলেই পারে ।

    আরে গোমুখ্যু ! তুই ব্যাটা যে ‘সব খোলখালকে বৈঠে হস।‘ এভাবে কেউ খোলা রাস্তায় বসে?

    রূপেশ এঁটো হাত ওর মাথায় আলতো করে আশীর্বাদের ভঙ্গিতে ছুঁইয়ে দেয় ।

    ৯)

    অশোক ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির নীলরঙা বাসটি নগোইখার গাঁয়ের সামনে থেমে জনাতিনেক যাত্রীকে নামিয়ে দিয়ে পোড়া ডিজেলের কালচে ধোঁয়া ছেড়ে হুস করে কোরবা নগরীর দিকে বেরিয়ে গেল।

    একটা শাড়ি দিয়ে বাঁধা পোঁটলি, তাই মাথায় করে হাঁটতে থাকে দ্রুপতী বাঈ। বাসরাস্তা আড়াআড়ি পেরিয়ে ঢোকে নগোইখার গাঁয়ে।

    এখন ভরদুপুর। আশ্বিনের শেষ, তবু রোদ্দূরের যা ঝাঁঝ। ধূলোয় ভরা মেঠো রাস্তা। এখনও কয়েক কোশ পথ। এর পর আসবে আগারখার গাঁ, তারপর আহিরণ নদী। নদীর ওপারে বলগীখার গ্রাম। সেখানে ভারত সরকারের কোল ইন্ডিয়া কয়লা খাদান খুলবে। হবে ওপেন কাস্ট মাইনিং।

    বিশাল এরিয়া জুড়ে জমির অধিগ্রহণ হবে। পাটোয়ারির চেন ধরে ধরে জমির জরিপ, মাপজোক, গাঁয়ের লোকজনকে নোটিস, ক্ষতিপূরণের যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ, তা নিয়ে ঝগড়া ঝাঁটি সবই চলছে। মানে, জমিটি শুধু আড়ে বহরে কতখানি তাই নয়, সেটি বহেরা নাকি টিকরা, নাকি ভাটাজমিন? অর্থাৎ ধানচাষের নাকি শাকসব্জি ফলাবার বেলেমাটি, অথবা রুক্ষ পাথুরে? আবার তাতে কুয়ো আছে কি নেই , ফলদার বৃক্ষ অথবা ইমারতী, মানে আম-জাম-কাঁঠাল- সজনে অথবা সেগুন, বীজা, মেহগনি , সীসম, নিদেনপক্ষে শাল বা বাবুল? আবার জমিটি চাষের না হয়ে আবাদি বা বাসযোগ্য হলে তাতে বাড়ি আছে কি নেই ? থাকলে কাঁচা না পাকা? তার মাপজোক, চৌহদ্দি? খাজনা দেওয়া আছে নাকি বকেয়া? হ্যানো- ত্যানো- সাতসতেরো?

    দ্রুপতী অতশত বোঝে না, এসব মালিকমন বা ক্ষমতাশীলদের ব্যাপার। ও হল আদার ব্যাপারি। বর্ষাকালে অলগুরামের ইঁটভাটার কাজ শেষ হয়েছিল। শুরু হবে সেই শীতের গোড়ায়, দীপাবলী তেওহারের পরে। কিন্তু ততদিন খাবে কী? পাপী পেট কা সওয়াল হ্যাঁয়!

    তা অলগুর ছেলে ফিরতরাম, ওর নবযৌবনের আশিক, ওকে একটা চিরকূটে দু’লাইন লিখে দিয়েছে। সেটা নিয়ে ওকে যেতে হবে আহিরণের পূবপাড়ে বলগীখার কয়লা খাদানের জন্যে খোঁড়াখুঁড়ির ঠিকেদার চামাররায়ের কাছে। ও ফিরতের বন্ধু, দুরুপতীকে মাটি বওয়ার রেজার কাজে নিয়ে নেবে। চাটাইয়ের বেড়ার দেওয়াল আর টিনের চালের মজদুর ঝোপড়া। সেখানে থাকা, হপ্তায় হপ্তায় বনিভূতি, মানে মজুরি। দুরুপতীর একরকম চলে যাবে। মাত্র কয়েক মাসের ব্যাপার। তারপর ইঁটভাট্টার কাজ শুরু হলে আবার নিজের গাঁয়ে ফিরে আসলেই হবে।

    এইসব কথাই ফিরত বলেছিল আগের দিন, তারাভরা রাতে আহিরণের পশ্চিমপাড়ে ছোটকি ছুরি গাঁয়ের সীমান্তে পলাশ গাছের গোড়ায়, পাশাপাশি শুয়ে। আরও বলেছিল যে এই সময়টা ওকে ছেড়ে থাকতে ফিরতের খুব কষ্ট হবে। কষ্ট ব্যাপারটা দুরুপতী ঠিক বোঝে না ।

    যন্ত্রণা বোঝে। সেই যে ছোট্টবেলায় বাপের সঙ্গে আহিরণের ওপারের জঙ্গলে কাঠ বয়ে আনার সময় ভালুর সঙ্গে লড়াই হয়েছিল তখন জন্তুটার বড় বড় বাঁকা নখের আঁচড়ে ছিঁড়ে যাওয়া খুবলে যাওয়া শরীরের যন্ত্রণা খুব মনে আছে। আর হাসপাতালে যখন নিয়মিত ব্যান্ডেজ খুলে ওষুধ লাগাত তার ব্যথাও মনে আছে। কিন্তু আর একরকম বোদা অনুভূতি আছে, যাকে দুরুপতী বাঈ ঠিক বুঝে উঠতে পারে না ।

    বছর চার আগে যখন বাপু বুখার আর কিরকম এক ব্যথায় ধনুকের মত বেঁকে বেঁকে উঠছিল আর গোঙাচ্ছিল, দুরুপতী কী করবে বুঝতে পারছিল না । ও খবর দিল আমোল সিং বৈগাকে। নিয়ে এল হলুদ, ধূনো, লাললংকা আর ঝাঁটা। গোবর দিয়ে ঘরের দাওয়া নিকিয়ে চট পেতে বাবাকে বৈগার সামনে শুইয়ে দিল। শুরু হল ঝাড়-ফুঁক। ওর কুঁড়েঘরের সামনে তামাশা দেখা লোকের ভীড় বেড়ে উঠল। কিন্তু বৈগা হার মেনে বলল—আমাকে খবর দিতে দেরি করেছ।

    চন্দু ডাক্তারও তাই বললেন—এত দেরিতে ডাকলি? এটা তো মনে হচ্ছে ধনুষ্টংকার। এই পায়ে ছোট্ট ঘা কিসের?

    তিনদিন আগে সাউজির ঘরে কাঠ চেরাই করার সময় পায়ে একটা পেরেক ফুটে গেছল, তারই ঘাও।

    ছোট্ট দুরুপতী বোঝেনি তার দোষটা কোথায়? কেন বাপু আর উঠবে না? সেটাই কি কষ্ট? মানে ওই বোদা ভাবটা? ওরকম আর একবার হয়েছিল। বাবা চলে যাওয়ার এক বছর পরে সাউজির বাড়িতে রান্নাঘরের দাওয়ায় বসে বাসন মাজার সময় হটাৎ তলপেটে একটা যন্ত্রণায় গুঙিয়ে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাত ধুতে ধুতে খেয়াল হয় ওর জামার তলায় ইজের ভিজে যাচ্ছে। তারপর অবাক হয়ে দেখে রক্তের একটি ধারা ধীরে ধীরে পা বেয়ে গড়িয়ে নামছে। ওর গা গুলিয়ে ওঠে। ওকে কি কোন অপদেবতার নজর লাগল? ভয় পেয়ে সোজা বাড়ির বড় গিন্নি তাঈমার কাছে গিয়ে নিজের ব্যথা ও ভয়ের কথা বলে ফেলে।

    সাউগিন্নির মুখচোখের ভাষা দ্রুত বদলে গেল। উনি কঠিন মুখে ওকে দূর করে দিয়ে বাড়ির অন্য নোকরাণীকে বললেন দ্রুপতীর ধোওয়া সমস্ত বাসনকোসন অপবিত্র হয়ে গেছে। সেগুলোকে আবার করে সাবান জল দিয়ে ধুতে হবে।

    তারপর অবাক চোখে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে দেখে খিঁচিয়ে উঠে বললেন—দাঁড়িয়ে আছিস কেন, হতভাগী? বাপকে খেয়েছিস! এখন তোর কালোছায়া আমাদের বাড়িতে যেন না পড়ে ।

    দুরুপতী সেদিনও বুঝে উঠতে পারে নি ওর দোষটা কী? কহাঁ গলতি হুয়ী? বড় বড় চোখে সাউগিন্নিকে দেখল, তারপর আস্তে আস্তে পেছনে সরতে সরতে এক ছুট। নিজের কুঁড়ে ঘরে।

    কিন্তু বাপ সেবার আকাশে তারা হয়ে যাওয়ার পর থেকে সেই ঘর আর নিজের রইল কোথায়? ওদের সমাজের পঞ্চায়েতের বৈঠকে চাচা বলল যে ভাইঝির খাওয়া-পরার দায়িত্ব ও নেবে বৈকি! কিন্তু ওদের কুঁড়ে ঘরটা কাগজপত্তরে চাচা অনন্দরামের হয়ে যাবে। মোড়ল বা ‘সিয়ান’দের কাছে এটা খুবই যুক্তিসংগত প্রস্তাব।

    তারপর থেকে দ্রুপতীর খাওয়া পরার চিন্তা ঘুচল বটে, চাচা ও চাচি ওর সঙ্গে ভালই ব্যবহার করে। ওর চাচেরা ছোটভাই ও বড়ী বহনের সঙ্গে কোন ভেদভাব করে না । দিদির শাড়ি ওকে দেওয়া হয়। আর বছরে একবার দিওয়ালির সময় সবার জন্যে জনতা শাড়ি অথবা লুগরা। তবে ঘরের কাজকম্মে ‘হাত বটানা পড়তা হ্যাঁয়’। আর গরীবের ঘরে সবাই কাজ করে। চাচি ও দিদি বর্ষার দিনে খেতে ধান রুইতে যায়, আবার কার্তিকের দিনে ধান কাটতে। ওরা মুঠো মুঠো করে পাকাধানের গোছা ধরে, যেন অবাধ্য মেয়ের চুলের মুঠি ধরেছে। তারপর কাস্তের এক পোঁচে ঘ্যাচাং!

    কিন্তু দ্রুপতী তঁখনও ছোট, তাই চাচি ওকে খেতের কাজে না পাঠিয়ে সাউগিন্নির কাছে ফুট -ফরমাস খাটতে লাগিয়ে দিয়েছিল, আর আজ এই কান্ড।

    আজ বাড়ি ফিরে দেখে ঘরের দরজায় শেকল তোলা, একটা শস্তার তালা ঝুলছে। ও হতাশ হয়ে দাওয়ায় বসে পড়ে । মাকে ওর মনে পড়ে না , কিন্তু দু’বছর আগে হটাৎ করে জ্বর ও ধনুষ্টংকারে আকাশে তারা হয়ে যাওয়া বাপের কথা খুব মনে পড়ে , বিশেষ করে অল্পবয়সে ভালুকের সঙ্গে বাপ-বেটিতে মিলে সেই মরণপণ লড়াই। আজ সেই বাপের কথা মনে করে ওর চোখ দিয়ে কখন জল গড়াচ্ছিল তা ও নিজেই টের পায় নি।

    চটকা ভাঙল চচেরি বহন নোনীবাঈয়ের কথায়ঃ ‘ কী রে! কী হয়েছে?

    ও জলভরা চোখে দিদির দিকে তাকিয়ে দেখায় পা বেয়ে একটু আগে নেমে আসা রক্তের দাগ, এখন একটু কালচে দেখাচ্ছে।

    নোনীবাঈ গোল গোল চোখ করে ওকে দেখতে থাকে। তারপর একটা অস্ফুট উল্লাসের শব্দ, ও জড়িয়ে ধরেছে ছোট বহনকে। --আরে তু বড়ী হো গয়ী। জয় কোসগাঈ মহতারী কী!

    দ্রুপতী কান্না ভুলে অবাক হয়ে তাকিয়েছিল দিদির দিকে। ও তালা খুলতে খুলতে বলে –চল, ঘর লে কপড়া লেকর হমন আহিরণ যাবো; নহাকে সাফসুতরা হোকে আনা পড়ি। ওকর বাদ মন্দির মা পূজা চড়ানা পড়ি। তু অব মা বননে কী লায়ক বনে হস।

    ঘর থেকে কাপড়চোপড় নিয়ে আমরা দু’বোন আহিরণ যাব। নদীতে চান করে সাফসুতরো হয়ে ফিরে এসে মন্দিরে পুজো দিতে হবে যে ! আরে তুই এখন মা হবার যোগ্য হয়েছিস বোন।

    দ্রুপতী ওর কথার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারে নি। নোনীবাঈ হেসে গড়িয়ে পড়ে ।

    --অইসন জোজোয়া কস তাকতস কাবর? নদী যাওত যাওত তোলা সমঝাবো । কোনও ডরে কে বাত নো হাবে।

    অমন হাঁদার মত তাকাচ্ছিস কেন? নদী যেতে যেতে তোকে সব বুঝিয়ে দেব। ভয় পাওয়ার কিছু নেই ।

    সত্যিই সব বুঝিয়ে দেয় নোনীবাঈ। মা-বাপ হারানো এই খুড়তুতো বোনের জন্যে হটাৎ ওর মনে জেগে উঠেছে মমতার এক চোরাস্রোত; কেন? তা ও নিজেও জানে না ।

    দ্রূপতীর ভয় কেটে গেছে। অবাক বিস্ময়ে শুনেছে মানবজন্মের চিরন্তন রহস্য । নোনীবাঈ এও জানায় যে আগামী অগহনে (অঘ্রাণ মাসে) ওর বিয়ে। তারপর ও চলে যাবে জাঁজগীর জেলার বলোদা গাঁয়ে, ওর শ্বশুরবাড়িতে। ওর আদমি ওখানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পিওন। নোনীবাঈ দ্রুপতীর থেকে কথা আদায় করে ওর অবর্তমানে মা-বাবা আর ছোট ভাই দুকালুরামকে দেখাশুনো করার।

    তারপর একদিন দ্রুপতীরও বিয়ে হবে। ততদিনে দুকালু বড় হয়ে ওর বাবা-মার দেখাশুনো করবে।

    মানুষ ভাবে এক, হয় আর। নোনীর বিয়ের পরে বছর ঘোরার আগেই চাচা-চাচি দ্রুপতীর ‘হাত পীলা’ করার বন্দোবস্ত করে ফেলল। চাচি ওর সুন্দর করে চুল বেঁধে চোখে কাজল লাগিয়ে নোনীবাঈয়ের একটি শাড়ি পরিয়ে হাজির করল বারান্দায় কাঠের রংচটা চেয়ারে বসা একজন পুরুষমানুষের সামনে। সে ওকে হাঁটিয়ে চুল খুলিয়ে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে একটা টাকা তুলে দিল চাচির হাতে।

    সাতদিন পরে ‘ফলদান’, তারপরের সপ্তমী শুক্লাতিথিতে বিয়ে। কানাঘুষোয় শুনল যে ওর হবুস্বামী দোজবরে। আগের পক্ষের তিনটে ছোট ছোট মেয়ে আছে, ছেলে নেই । এরা তানাখার গ্রামের মাঝারিগোছের কিষাণ পরিবার, একই জাতের। বংশের ধারা ধরে রাখতে ছেলে চাই। বিয়ের আগে ওদের ‘সিয়ান’ ও গুরুগোঁসাইয়ের ওকে দেখে বেশ লক্ষ্মীমন্ত মনে হয়েছে। তাই চাচা-চাচির কোন বড় খরচা হল না । উলটে কিছু লক্ষ্মীলাভ হল। তাতে নিমন্ত্রিতদের চা ও পটেলের দোকানের ভাজিয়া খাওয়ানো গেল। সাহুপরিবার থেকে একটি লালের উপর কালো ডোরাকাটা শাড়ি উপহার পেল দুরুপতী।

    বিয়ের সময় মন্ডপ মানে জঙ্গলের গাছ কেটে সাজানো আসর বা মড়োয়ায় চাঁদোয়ার নীচে বসা বরের টোপর ও মালায় জড়ানো মুখে কোন ভাব প্রকাশ পেল না । বর হাসে না কেন?

    বিয়ের পর্ব চুকে যাওয়ার শেষ অনুষ্ঠানে যজ্ঞের আগুন নিভিয়ে আমপাতা দিয়ে শান্তিজল ছিটিয়ে দেবার পর বৈগা পুরোহিত ওদের আশীর্বাদ করে বলে এবার তোমরা পতি-পত্নী হলে। সুখে-দুঃখে একসঙ্গে থাকবে। সাতো- বচন নিভাওগে। সাতটি শপথ মেনে চলবে।

    আর শোন, কার্তিক পূন্নিমের রাতে চিড়িয়ামন ঘোঁসলা মা জেইসন করথে তুমন এইসন করিহ। কার্তিক পূর্ণিমার রাতে পাখিরা নিজেদের বাসায় যা করে তোমরাও—

    দ্রুপতীর মাথায় কিছু ঢোকে না , ওর ঘুম পায়। খালি চোখে পড়ে পুরোহিতের শেষ কথাটির সময় ওর নতুন দুলহা কেমন জুলজুলে চোখে ওকে দেখছে।

    বিদায়ের সময় চাচি ও নোনীদিদির সুর তুলে বিলাপ করে কান্না দেখে ছোট ভাইটাও কেঁদে উঠল। চাচা ধুতির খুঁট দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ধরা গলায় বিড়বিড় করলেন—বেটি হোথে পরায়া ধন। ভাইয়া উপর সে জরুর দেখ রহে। ম্যায় ওকর বেটি লা সময় পর বিহা করাই ডারে। জরুর খুশ হোয়থে।

    মেয়ে হল পরের আমানত। দাদা নিশ্চয় উপর থেকে সব দেখছেন, খুশি হচ্ছেন যে আমি ওঁর খুকিকে সময়মত বিয়ে দিয়েছি।

    বর-বৌ চলেছে সাইকেল করে। সীটের উপর বর, সামনে রডের উপর কনে। তবে বর প্যাডল মারবে না। অন্যেরা ঠেলে নিয়ে যাবে ঠেলা গাড়ির মত।

    সাইকেলটা ওর চাচা যৌতুক দিয়েছে সিন্ধি দোকান থেকে ধারে, মাসিক কিস্তিতে শোধ দেবার কড়ারে। ওদের সাইকেল ঠেলে নিয়ে চলেছে দুজন ছুরিগাঁয়ের যুবক, ওদের সমাজের। তানাখার গাঁয়ে মেয়ের শ্বশুরবাড়ি অবধি পৌঁছে দিয়ে তবে ওদের ছুটি। বরের বাড়ি থেকে ওদের খাওয়ানো হবে ‘ঠান্ডা চা’(মহুয়ার মদ) ও গরম ভাজিয়া। আর ফুলশয্যার দিন তানাখার গাঁয়ে বরপক্ষের পার্টিতে ওরা নিমন্ত্রিত থাকবে; খাবে ‘বোগরাভাত’—খাসির মাংসের ঝোলভাত।

    এই শোভাযাত্রার সামনে চলেছে ঢম ঢম শব্দে গাঁয়ের কুকুরদের পিলে চমকে দিয়ে তিনজন ‘গাড়া বাজা’র দল। এর খরচা সরপঞ্চ কুমারসায়েবের। গাঁয়ের সাহসিনী ‘ভালুমার’ দ্রুপতী বিদায় হচ্ছে যে! পেছন পেছন চলেছে গাঁয়ের ছেলে ছোকরার দল, এরা সবাই যাবে ছুরিগাঁয়ের ‘সরহদ’ বা সীমানা পর্য্যন্ত।

    কিন্তু ‘ভালুমার’দ্রুপতীর ফুলশয্যা আর হল না ।

    দ্রুপতী শ্বশুরবাড়ি দেখে বেশ ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল। পাকাবাড়ি , অনেকগুলো ঘর, কিন্তু কেমন যেন অগোছালো। অনেকটা সাঊবাড়ির মত। কিন্তু পেছনে গোটা চারেক দেশি বলদ আর হাইগ্রেড মুররা ভৈঁস বাঁধা রয়েছে । তাই গোটা বাড়িতে গোবর গোবর গন্ধ। ওর যে ঘরটা তার কোনায় ও কিছু খড় গাদা করে রাখা; তার উপর চটের বস্তা ও একটা হাঁসুয়া।

    কাঠের ফ্রেমে নেয়ারের বোনা খাটিয়ায় মশারি টাঙানো। ঘরের দেয়ালের কুলুঙ্গিতে একটা টেমি জ্বলছে। একথালা ভাত খেয়ে জামাকাপড় বদলে ও মশারির ভেতরে ঢুকল। বড্ড গরম, নাকের পাটায় ও কপালে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জমছে। চাচি কী যেন বলেছিল?

    ও হ্যাঁ, শ্বশুরবাড়িতে সবাইকে খুশ করতে হবে। বড়দের সম্মান করতে হবে। পতি পরমেশ্বর হোয়থে। ওকর বাত মাননা পঢ়হি, ওলা খুশ রখনা পঢ়ি।

    পতি হল পরমেশ্বর। ওর কথা শুনতে হবে, ওকে সন্তুষ্ট করতে হবে, তবে সবাই ধন্য ধন্য করবে। ও যেন এমন কিছু না করে যাতে চাচাচাচির বা ছুরিগাঁয়ের বদনাম হয়।

    এইসব সাতকাহন ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত দুরুপতী কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল। ছেঁড়া মশারির ফুটো দিয়ে ঢোকা মশকবাহিনীর অবিরাম আক্রমণ ও টের পেল না । অভ্যাসের বশে কখনও হাত নেড়ে দু-একটাকে সরিয়ে দিচ্ছিল, কখনও রক্তচুষে কচ্ছপ হয়ে পড়া মশা ওর হাতের থাবড়ায় চেপটে যাচ্ছিল।

    ঘুমটা ভাঙল এক দুঃস্বপ্নের ঘোরে।

    সেই আহিরণের পাড়ে ছোটকি ছুরি গাঁয়ের জঙ্গল। সেই কোসম ও মহুয়াগাছের আড়াল থেকে ভালুকের হামলা। তবে সেবার ভালুক আক্রমণ করেছিল বাপুকে, ও ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাপুকে বাঁচাতে, আর সেবার হাতে ছিল কুড়ুল। কিন্তু এবার ভালুকটা আক্রমণ করেছে সোজা ওকে আর একেবারে বুকের উপর সওয়ার হয়েছে।

    খুবলে খাচ্ছে ওর শরীর, ছিঁড়ে খুঁড়ে দিচ্ছে ওর জামাকাপড়। ভালুকের মুখের লালায় ভিজে যাচ্ছে ওর গাল, ওর গলা। আর ভালুকের শরীর ও মুখে মহুয়ার গন্ধ। ও প্রাণপণ চেষ্টা করেও ওকে বুকের থেকে নামাতে পারছে না । কিন্তু স্বপ্নে বাপু নেই কেন? কুড়ুলটা কই? বাপুকে ছাড়া একা ও কী করে পেরে উঠবে? ভয়ে ওর হাত পা অবশ হয়ে আসে। কপালের পুরনো সেলাইয়ের জায়গাটা ছুঁয়ে যায় ভালুকের জিভ আর চিনচিনে ব্যথায় মরিয়া হয়ে জেগে ওঠে সেই পুরনো ভালুমার দ্রুপতী। একঝটকায় ভালুককে সরিয়ে ভালুর তলপেটে পা ও হাঁটুর গুঁতোয় ওকে কাবু করে ফেলে। ভালু অপ্রত্যাশিত এই পালটা হামলায় মশারি ছিঁড়ে দ্রুপতীকে নিয়ে হুড়মুড়িয়ে মাটিতে পড়ে যায়।

    ঘরের মধ্যে ভালুর হামলা! টেমি কখন নিভে গেছে।

    দ্রুপতী কোনরকমে উঠে পরে দৌড়য় ঘরের কোনায়, খড়ের গাদায় হয় কুড়ুল নয় কিছু একটা পাবে এই দুরাশায়। কিন্তু ভালুক বড় সেয়ানা, তায় মহুয়ায় মাতাল। এই চুহা-বিল্লি খেলায় ও বেশ মজা পেয়েছে। খিল খিল হেসে ওকে কায়দা করে ধরে ফেলে খড়ের গাদায় পটকে দেয়। এবার ওর নিস্তার নেই । শরীরের শক্তি যেন ফুরিয়ে গেছে। ও লড়াই করা ছেড়ে দেয় । ও বিশ্বাস করতে চায় যে যা ঘটছে তা দুঃসপ্ন, সত্যি নয়। এমন তো আগেও দেখেছে। খালি এবার বাবা সঙ্গে নেই । ওর বুকের উপর আবার ভালুক সওয়ার হয়েছে। আর খড়ের গাদায় ওর নড়াচড়ার বিশেষ সুযোগ নেই । ভালু যেন কিঞ্চিৎ শান্ত হয়েছে, ওর শ্বাস পড়ছে বিলম্বিত লয়ে। দ্রুপতী এবার গাঢ় ঘুমে তলিয়ে যেতে চায়।

    দুই জানুর সন্ধিস্থলে প্রচন্ড যন্ত্রণায় ওর বোধ হল যে যা ঘটছে তা স্বপ্ন নয়। ভীষণ এক ভয়ে আচ্ছন্ন দ্রুপতী ছটফট করে হাতড়ায়। হাতে ঠেকে হাঁসুয়া।

    এবার একটা প্রচন্ড চড়ে ওর গাল ও মাথা ঝনঝনিয়ে ওঠে। আর তার পরেই এক আসুরিক চিৎকার—মোলা মার ডারিস এ ডাইন ! মোলা বাঁচালে!

    ডাইনিটা আমায় মেরে ফেলল গো! আমায় বাঁচাও !

    দ্রুপতী কিছু না ভেবেই যন্ত্রের মত চালিয়ে দিয়েছিল হাঁসুয়াটা। ভালুকের কোথায় লেগেছে কিচ্ছু বোজে নি। এবার বিজলির মত এক চমকে পরিষ্কার হয় যে ওর আঘাতে আহত হয়েছে একজন মানুষ। তার আর্তনাদে জেগে উঠছে অন্য ঘরের লোকজন, শোনা যাচ্ছে নানান গলার স্বর, জ্বলে উঠছে টেমি ও মোমবাতি। পরিস্থিতি বুঝতে ওর একটুও দেরি হয় না । এক ঝটকায় উঠে পড়ে ও দরজার খিল খুলে প্রাণপণে দৌড়তে থাকে। পেরিয়ে যায় শ্বশুরবাড়ির আঙিনা, ঢুকে পড়ে পেছনের সজনে ও কুলগাছের জঙ্গলে। রাতচরা পাখিরা ডানা ঝাপটায় , ও থামে না । কোনদিকে দৌড়ূচ্ছে তাও জানে না । খালি জানে ওকে নদীর দিকে যেতে হবে। সাঁতরে আহিরণ পেরিয়ে গেলে ও নিরাপদ। শ্বশুরের পরিবার বা তানাখারের লোকজন ওর নাগাল পাবে না ।

    কতক্ষণ হল ও জানে না । তবে ও পেরিয়ে গেছে নদীর পার। আহিরণের এ পাড়ে পঞ্চায়েত হল ছুরিকলাঁ গাঁয়ের, সরপঞ্চ কুমারসাহেব। কিন্তু এটা কোন গাঁ ? আকাশ ফরসা হয়ে আসছে। দেরি করা চলবে না । লোকজন ভোর ভোর লোটা নিয়ে প্রাতকৃত্য করতে নদীর পাড়ে জঙ্গলের দিকে আসে। মেয়েরা আসে স্নান করে কলসি ভরে জল নিয়ে যেতে। ওদের কাউকে জিজ্ঞেস করে ছুরি গাঁয়ের রাস্তা জেনে নেওয়া যাবে।

    কিন্তু তার আগে ওকেও স্নান করে পরিষ্কার হতে হবে। এমনিতেই হাঁটু জল পেরোতে গিয়ে পায়ের দিকে শাড়ি ভিজে গেছে। বড্ড অশুচি লাগছে নিজেকে।

    ১০)

    কতক্ষণ ধরে হেঁটেছে দ্রুপতী? তা ঘন্টাখানেক হবে নিশ্চয়ই। ঘামে ভিজে গেছে পিঠ। একটু জল খেতে পারলে হত। এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে চোখে পড়ল ‘আঙনবাড়ি’ বা একধরণের সরকারি ক্রেচ। ওর সামনেই একটা টিউকল, নাকি হাথপাম্প। ও পোঁটলা নামিয়ে রাখে আঙনবাড়ির বারান্দায়। তারপর একহাতে জোরে পাম্প করে আরেক হাত চটপট পাম্পের মুখে লাগিয়ে শুষে নেয় জল। এভাবে খেতে গিয়ে ভিজে যায় ওর জামা, ভেজে কপাল মুখ সামনের চুল।

    আঃ, কী শান্তি! কী আরাম! আঙনবাড়ি থেকে ভেসে আসছে বাচ্চাদের কলকল; আর আয়া ও দিদিমণির উঁচু আওয়াজ। একটু বড় বাচ্চাদের শেখানো হচ্ছে দুইয়ের ঘরের নামতা। --দো একম দো; দো দুনে চার! দো তিয়া ছে--!

    দ্রুপতীর চেহারায় একটা মুচকি হাসি খেলে যায়। ভুলে যাওয়া কোন দিনের কথা। না , ওদের সময় কোন আঙনবাড়ি, বালবাড়ি এসব ছুরিগাঁয়ে হয় নি। তবে ও গেছল কয়েক বছর ছুরির সরকারি আদর্শ বালিকা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে; সেই ভালুকের সঙ্গে লড়াইয়ের পরের বছর। শিখেছিল হিন্দিতে নিজের নাম দাগা বুলিয়ে লিখতে। জেনেছিল --লেজওলা ছোট্টমত দৌড়ে পালানো ধানচালের বস্তায় ফুটো করা কাপড় ‘কুতর কুতর কে’ কুটকুটিয়ে কেটে ফেলা দুষ্টু মিষ্টিটাকে ‘মুসুয়া’ বলে না, বলতে হয় ‘চুহা’ অথবা শুদ্ধ করে বললে ‘মূষিক’। আর শিখতে হয়েছিল কিছু ‘পাহাড়া’, অর্থাৎ নামতা। বেশ সুর করে দুলে দুলে উঁচুগলায় বলতে হত। ওর পাঁচের ঘরের ‘পাহাড়া’ অনেকটা মনে আছে। হাতের পাঁচ আঙুল নেড়ে নেড়ে ‘পাঁচ একম পাঁচ, পাঁচ দুনে দশ, পাঁচ তিয়া—‘ নাঃ , মনে পড়ছে না তো!

    --তঁয় ছুরিগাঁওকে দুরুপতী নো হস?

    ও চমকে ওঠে। এখানে কে ওকে চিনে ফেলল? পাঁচবছর হয়ে গেল ও এদিকের ছায়া মাড়ায় নি। তাহলে? ও লোকটির দিকে ভাল করে তাকায়। ঘামে তেলতেলে মুখ, মাথার মাঝখান দিয়ে পরিপাটি করে সিঁথে কাটা, কায়দা করে পরা রঙিন কুর্তা আর ছোট জ্যাকেট, হলদে ছোপানো ধুতি হাঁটুর নীচে। তবে পায়ে রঙিন মোজা ও গাঁয়ের মুচির তৈরি নাগরা জুতো। না , একে দ্রুপতী কস্মিনকালেও দেখেনি।

    --কস না ও! তঁয় ওহ ভালুমার টুরি নো হস?

    এ তো দেখছি আমার জনমপত্রিকা (ঠিকুজিকুষ্ঠি) খুলে বসেছে! এর মতলবটা কী? দ্রুপতী সতর্ক হয়, আত্মরক্ষার তাগিদে কাঁটা উঁচিয়ে খ্যারখ্যার করে ওঠে।

    --মহু টুরি হন , কোনো গাঁওকে, তোর কা মতলব? তঁয় আপন বাত লা বাতা।

    আমি যে গাঁয়ের মেয়ে হই , তাতে তোর কী? কাজের কথা বল।

    --ধৎ তেরিকে! তু তো বুরা মান গয়ী। আরে আমি কি খারাপ কিছু বলেছি?

    --তুই ব্যাটা কে- সেটাই বলিস নি।

    -- আমি বিসরু, মনগাঁওয়ের বিসরু; আমার আছে সর্বমঙ্গলা নাচা পার্টি। যাচ্ছি ছুরি গাঁওয়ের সরপঞ্চ কুমারসাহেবের কাছে। নগৈখার পৌঁছে বড়রাস্তায় বাস ধরব। আগামী গণেশপূজোয় আমার দলের প্রোগ্রাম হবে তার বায়না করতে এসেছি। এবার নতুন পালা লিখেছি—ধানকাটার পর গাঁ থেকে দলে দলে মানুষ দিল্লি এলাহাবাদ ভোপালে জন খাটতে যায়, সেই সমস্যা নিয়ে। পালার নাম দিয়েছি ‘পলায়ন’। গাঁ ছেড়ে পালানো। একেবারে মারকাটারি পালা; জনতা কো, জনগণেশকো জগানা হ্যাঁয় না? মেরা কাম এহি হ্যাঁয়, গাঁও গাঁও মেঁ ঘুম ঘুম কর অলখ জগানা। তুই তো গণেশপঞ্চমীর সময় ছুরিতে থাকবি, তখন দেখিস আমার পালাগান।

    [ ‘নাচা’ হল ছত্তিশগড়ের ‘যাত্রা’ ।]

    এই লম্বা ‘ভাষণ’ শুনতে শুনতে দ্রুপতী হেসে ফেলে। এই মূর্তিমান বিসরুই বটে, বিসরু নাচাওলা। কিন্তু ওকে দ্রুপতী দেখেছে মুখে রং মাখা অবস্থায়, কখনও মূল পালাগায়ক, কখনও ভিলেন, কখনও ‘জোক্কার’ বা’ভাঁড়’ সাজা অবস্থায়।

    ও বলে যে গণেশপূজোর পালাগান অনেক পরের ব্যাপার, তখন দেখা যাবে’খন। এখন ও নদী পেরিয়ে ওপারে যাবে । বলগীখার কয়লাখাদানে রেজার কাজ পাওয়া যাচ্ছে।

    বিসরু গম্ভীর হয়, তারপর বলে –শোন, তোর সঙ্গে একটা জরুরী কথা ছিল । তোর ভালর জন্যেই।

    দ্রুপতী কঠিন চোখে ওকে দেখে; দম নেয়। --বলে ফ্যাল।

    -- তানাখার গ্রামের দিকে যাস না ।

    --মানে?

    -- বলগীখার যেতে হলে তোকে তো ওপারে তানাখার গ্রামের পাশ দিয়েই যেতে হবে। মানে তোর শ্বশুরবাড়ির গাঁয়ের?

    ঠিক কথা নদী পেরোলেই বলগীখার আর তার গায়ে লাগা গ্রাম হল তানাখার ।

    --কাল বিকেলে তোর সোয়ামী মারা গেছে। তুই এখন বিধবা। সিঁদুর মুছতে হবে, আরও কত কী আছে।

    দ্রুপতী বোবাচোখে তাকায়। তারপর বলে যে সেসব বছর তিন আগের কথা। ও শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে ছুরিগাঁয়ে চলে এসেছিল। আর যায় নি; ওর ‘গৌনা’ হয় নি। ফুলশয্যা হয় নি। সে বিয়ে তো দুধভাত। ফেরত এসে ও তো আর সিঁদুর পরে নি; কাজেই মোছার কথা উঠছে কেন?

    বিসরু পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে ধূলোয় দাগ কাটে। তারপর বলে যে আসল কথা হল সেই যে হাঁসুয়ার আঘাত, সেটা বিষিয়ে গেছল। অনেক ওষুধপত্তর করে তিনবছর ধরে ভুগে কাল লোকটা মারা গেছে। ওদের গুরুঠাকুর বলেছেন যে আসলে গ্রহণ লেগেছে। ওর ডাইনি বউয়ের কালোছায়া পড়েছে। তাই গোটা পরিবার আর ওদের পাড়ার লোক ক্ষেপে উঠেছে। এখন সামনে দুরুপতী এসে পড়লে রাগের মাথায় কী হয়ে যায় কেউ বলতে পারে না ।

    তাহলে?

    তাহলে এর সমাধান হতে পারে ছুরিগাঁয়ে ফিরে যাওয়া এবং মাসখানেক পরে শ্রাদ্ধশান্তি প্রেতশুদ্ধি দেবীভাগবত পাঠ, নওধা রামায়ণ ( টানা নয়দিন ধরে মঞ্চে বিভিন্ন গানের দল মিলে পালা করে রামায়ণ গান)—এসব চুকে গেলে তবে কাজের খোঁজে এ তল্লাটে আসা।

    ততদিন খাবে কী?

    বিসরুর সঙ্গে বাসে করে ফিরে চলুক দুরুপতী। ও তো সরপঞ্চ সায়েবের কাছেই যাচ্ছে। উনি ঠিক পঞ্চায়েতের কোন রাস্তা তৈরি বা অমনি কোন কাজে লাগিয়ে দেবেন।

    দুরুপতীর মাথা ঘুরতে থাকে।

    এ যেন আগে মেলায় দেখা কোন সিনেমা এ বছর আবার দেখছে।

    তিনবছর আগের সেই কাকভোরে আহিরণের হাঁটুজলে স্নান করে ও রাস্তা খুঁজে নিয়ে ছুরিগাঁয়ে ফিরে এসে চাচা-চাচির দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল ।

    ওরা অবাক। সাতসকালে এ কী কান্ড! সব শুনে চাচার চেহারা গম্ভীর। ওরা গরীব মানুষ ভেবে পাচ্ছে না এর পরিণাম কী হবে! চাচা জানালেন যে রাস্তা এক হী হ্যাঁয়। দুরুপতীকে শ্বশুরবাড়িতে ফিরে যেতে হবে। বিয়ে হবার পর ওটাই ওর আশ্রয়। ও ঘোর অন্যায় করেছে। ওকে স্বামী শ্বশুরের পায়ে ধরে ক্ষমাভিক্ষে করতে হবে।

    ও চাচার পায়ে পড়ল। বলল তোমরা শাস্তি দাও, যা বল সব মেনে নেব। কিন্তু ওখানে ফিরে যাব না । ওমন আদমী নো হে, জানোয়ার হাবে। জঙ্গলী ভালু হাবে। চাচির মন অজানা ভয়ে কাঁপছিল। ওকে আগে একথালা বোরেবাসি (পান্তাভাত) লংকাপোড়া দিয়ে খাইয়ে ভেতরের ঘরে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুইয়ে দিয়ে বলল যে বাকি কথা পরে হবে। নোনীদিদি কোন কথা না বলে একটা পোঁটলা বাঁধছিল; সন্ধ্যেবেলা ওর স্বামী ওকে নিতে আসবে। ও ফিরে যাবে শ্বশুরবাড়িতে, জাঁজগীর জেলার বলোদা গাঁয়ে । চাচা-চাচি বাইরের ঘরে কথা বলছে। ও কাঁথা জড়িয়ে নোনীর জেরার জবাবে সব কথা খুলে বলল।

    কথা ফুরোয় নি, এর মধ্যে ঘরের সামনে বেশ কিছু লোকের উঁচুগলায় কথাবার্তা শোনা গেল।

    নোনী একবার উঁকি দিয়ে দেখেই দৌড়ে ভেতরে এসে বলল –শীগগির ওঠ। আঁচলে এই দশটা টাকা বেঁধে নে। আর তোর বোঁচকা তুলে পেছনের দরজা দিয়ে পালা। দৌড়ো যত জোরে পারিস। বস্তিএলাকা এড়িয়ে নদীর দিকে যাবি। নদী পেরিয়ে ঝোড়াসিরকি গাঁয়ের দিকে যাবি। কোথায় থাকবি কী খাবি জানি নে। যদি এ যাত্রা কোসগাইদেবীর দয়ায় বেঁচে যাস তো আমার শ্বশুরবাড়ি বলোদা গাঁয়ে পৌঁছে যাস। আমার পতি সরকারি চাপরাশি। আমার কথা ফেলবে না । কোথাও রাস্তা তৈরি কি পুকুরকাটার কাজে লাগিয়ে দেবে। যা বোন, আর দেরি করিস না ।

    এদিকে ধুন্ধুমার লেগে গেছে।

    তানাখার গাঁ থেকে দ্রুপতীর শ্বশুর ও বেশ কয়েকজন পুরুষ লাঠিসোঁটা নিয়ে ওদের উঠোনে ঢুকে তড়পাচ্ছে—বের করে দিক দ্রুপতীকে, ওদের খুনি ডাইনি ছেলেবৌকে। ওরা নিশ্চিত যে মেয়েটা পালিয়ে এদিকেই কোথাও এসেছে। ওর চাচি হাতজোড় করছে। কিন্তু ওরা কোন কথা শুনতে রাজি নয়। দ্রুপতীর বর হাঁসুয়ার ঘায়ে রক্তপাতের ফলে অচৈতন্য, অবস্থা ভাল নয়। কাঠঘোরা সদর হাসপাতালে ভর্তি। যদি ওর কিছু হয় তো দ্রুপতীর গোটা খানদান বাড়িঘর সবাই খাল্লাস !ওদের এত স্পর্ধা! নিশ্চয়ই বাপের বাড়ি থেকে ফুসমন্তর দেওয়া হয়েছে। নইলে অতটুকু মেয়ের কী করে এমন আস্পদ্ধা হয়! অথবা মেয়েটার স্বভাব চরিত্র খারাপ, নইলে বিয়ের প্রথম রাতেই কি কেউ সোয়ামিকে মেরে ফেলতে চায়?

    দেখতে দেখতে ভীড় করে এল গোটা পাড়া; এল পাশের সতনামী পাড়া থেকে জোয়ানমদ্দ-বুড়োর দল। এরা প্রথমে এল তামাশা দেখতে। সাতসকালে ওদের জীবনের একঘেয়েমির মাঝে এমন মনোরঞ্জন! সবাই মানল যে এমন অলক্ষুণে কান্ড ছুরিগাঁয়ে না কেউ দেখেছে, না শুনেছে। প্রথমে তো কারও বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে ওদের গাঁয়ের নতুন বিয়ে হওয়া বাচ্চামেয়ে দ্রুপতী এমন কিছু করতে পারে । হলেও বা ভালুমার, তা বলে নিজের স্বামীকে?

    দ্রুত পারদ চড়ছিল তানাখারের আগন্তুক দলটির। সবাই সহমত হল যে দুরুপতীকে ফেরত পাঠাতে হবে আর স্ত্রীকে শাসন করার অধিকার শ্বশুরবাড়ির আছে এবং ওদের চৌদ্দপুরুষের কপাল ভাল যে ওরা থানায় গিয়ে খুনের মামলা দায়ের না করে ঘরের বৌকে নিজের হাতে শাস্তি দেবে ঠিক করেছে।

    এবার একটাই কাজ বাকি, মেয়েটাকে ওর শ্বশুরবাড়ির লোকজনের হাতে তুলে দেওয়া। চোখের জল মুছতে মুছতে চাচি ও তার মেয়ে নোনী গেল ঘরের ভেতর।

    টান টান উত্তেজনা। মেয়েটা অন্যায় করেছে শাস্তি পাবে। ওকে চুলের মুঠি ধরে হেঁচড়ে তুলে নিয়ে যাবে তানাখারের ওরা। একটু খারাপ লাগবে, কিন্তু ওর কৃতকর্মের ফল তো ওকেই ভুগতে হবে। কেউ নড়ছে না , কথাবার্তা চলছে নীচু পর্দায়।

    অনেকক্ষণ হল, ওরা যে ঢুকেছে আর বেরোয় না কেন!

    বধ্যভূমিতে জল্লাদ প্রস্তুত; ভক্ত ও দর্শকেরা আগ্রহে অধীর। কিন্তু ‘বলি’ কোথায়?

    সবার ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙল বলে। শেষে সবাই তাড়া দেওয়ায় চাচা গেল ভাইঝিকে বাইরে বের করে আনতে। কয়েক মিনিট; তারপরেই কান্নার রোল।

    বলি পালিয়ে গেছে। শূন্য হাড়িকাঠ।

    কোথায় গেছে? সকালবেলায় চারদিকেই লোকজনের চলাচল। কারও চোখে পড়ল না?

    এই পাড়ার কাছেই দুটো পুকুর। তবে কী তাতে ডুব দিল? সে সম্ভাবনাও কেউ কেউ তুলল। কালামুহী! জনম-জলী! জন্মের সময় মাকে খেয়েছে। কয়েকবছর আগে বাপকে। আপদ বিদেয় হয়েছে। পরিবার এবং গোটা পাড়ার মুখে কালি লেপে দিয়েছিল।

    কিন্তু তানাখার বাহিনী অত সহজে ভোলে না । ওদের বলি চাই। সুর চড়তে লাগল। মেয়ের চাচা জোচ্চোর, ঠগ প্রমাণিত হল। বিয়ের খরচা নিয়ে এখন পাত্রপক্ষকে বোকা বানিয়েছে। টাকা ফেরৎ দিক, নইলে—

    নইলে থানায় নালিশ হবে। হত্যার চেষ্টা , টাকা হাতানো—গোটা পরিবারকে কোমরে দড়ি বেঁধে গাঁ ঘুরিয়ে জেলে পোরা হবে। পাড়ার সবাই হাতজোড় করতে লাগল। বাচ্চামেয়ের অপরাধে পরিবারকে জেলে পোরা! না , না , এ হতে পারে না; এটা বাড়াবাড়ি।

    এদের দুর্বল ভেবে তানাখারের দল সুর আরও চড়াল। একজন মাত্রা ছাড়িয়ে মুখ ফসকে বলে ফেলল যে ছুরিকলাঁ গ্রাম হল জোচ্চোরের গ্রাম; যত ঠগ আর চলতা পূর্জা মানুষের মেলা। সবাই ষড় করে মেয়েটাকে আগেভাগে লুকিয়ে ফেলেছে।

    ব্যস, আতসবাজিতে আগুন লেগে গেল। গ্রাম তুলে কথা! ছুরিকলাঁকে ইজ্জত কী সওয়াল!

    সতনামী ও রাউতপাড়া থেকে বেরিয়ে এল অনেকগুলো লাঠি। সংখ্যায় তানাখারের লেঠেলদের থেকে আড়াইগুণ। ব্যাপারটা মাথা ফাটানোর দিকে গড়ানোর আগেই প্রবীণেরা মাঠে নামলেন। সরপঞ্চ, রসেলু, কর্মণলাল এঁরা মাঝখানে দাঁড়ালেন। বেগতিক দেখে পাত্রপক্ষের সুর নরম হল।

    শেষে ফয়সালা হল যে এই মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি আর ফেরত নেবে না । থানাপুলিশও করবে না । বদলে মেয়ের চাচাকে বিয়ের খাইখরচা বাবদ নেওয়া তিনহাজার টাকা ও দলটিকে ‘বোগরা-ভাত’ খাওয়ানোর জন্যে আরও পঞ্চাশটাকা নগদ গুণে দিতে হবে। আর ওই অলক্ষুণে ‘ডায়ন’ যেন আগামী দু’বছর তানাখার গাঁয়ের ছায়াও না মাড়ায়। এর অন্যথা হলে মেয়েটার ভালমন্দের দায়িত্ব ওর শ্বশুরবাড়ির অথবা ওই গাঁয়ের সমাজের নয়।

    নগদ টাকা ! ‘দিন আনি দিন খাই’ পরিবার কোথা থেকে দেবে? ডাক্তার চন্দু কাশ্যপ তিনহাজার টাকা গুণে পাত্রপক্ষের হাতে তুলে দিলেন আর কুমারসাহেবের পকেট থেকে বেরোল পঞ্চাশ টাকা। কৃতজ্ঞতায় গলে মুসুরির ডাল হয়ে চাচা ডাক্তারসায়েব ও কুমারসায়েবের পায়ে পড়ল।

    তবে ওকে হাতকাগজে টিপছাপ দিয়ে কবুল করতে হল যে মাসে দু’পার্সেন্ট হারে ওকে সুদ দিতে হবে। আর খেতের কাজের সময় ওকে ওই দুই ঋণদাতার জমিতে আগে জন খাটতে হবে, পরে অন্যদের জমিতে।

    সাতদিন পর ঘরে ফিরল দ্রুপতী। ও কারও কথা শোনে নি, দিদির শ্বশুরবাড়িতেও যায় নি। সহজবুদ্ধিতে সোজা নদীর ওপারে কোসগাই পাহাড়ের চুড়োয় দেবীমন্দিরে আশ্রয় নিয়েছিল। পূজারী মহারাজ সব কথা শুনে ওকে মন্দিরে রাত কাটাতে এবং প্রসাদান্ন খেয়ে পেট ভরাতে অনুমতি দিয়েছিলেন। হ্যাঁ, নিরাপদ আশ্রয়।

    বিসরু নাচাওলার সঙ্গে ফিরতি বাসে বসে দ্রুপতী ভাবছিল—সেই পুরনো খেলা আবার! সেই কুমারসাহেবের দয়াভিক্ষা!

    অনেক ভেবেও এছাড়া কোন উপায় দেখতে পেল না দ্রুপতী। বাস ছুরিকলাঁ গাঁয়ের স্টপে থেমেছে।

    ( প্রথম ভাগ সমাপ্ত)
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। কল্পনাতীত মতামত দিন