সময়টা ২০০২। তখন কলেজের বেশ কয়েকজন বন্ধুবান্ধবের মতো আমিও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পর এম.বি.এ. করার কথা ভাবছি। চাঁদা তুলে পোস্টাল কোচিং-এ এনরোলমেন্ট, জেরক্স করে স্টাডি মেটিরিয়াল ভাগ করা, দল বেঁধে পেপার সলভ্, গ্রুপ-ডিসকাসন চলছে। আর সেই সঙ্গে চাঁদা তুলে বিজনেস টুডে, ইত্যাদি পত্র-পত্রিকাও কেনা চলছে।
এই সব পত্র-পত্রিকায় মাঝেমধ্যেই দেশের বিজনেস স্কুলগুলোর র্যাঙ্কিং বেরোতো, যার প্রথম চার-পাঁচে (স্বাভাবিক ভাবেই) আই.আই.এম. আমেদাবাদ, ব্যাঙ্গালোর, কলকাতা, লখনউ-এর, তারপর এফ.এম.এস., এক্স.এল.আর.আই.-এর মতো কয়েকটি ইনস্টিটিউশানের নাম থাকতো। মজা শুরু হতো সাত-আট নম্বরের নামগুলো থেকে। র্যাঙ্কিংয়ে এরা আই.আই.এম. ইন্দোর বা কোজিকোরেরও ওপরে (বাকিগুলো তখনো তৈরি হয়নি), অথচ সেখানে ভর্তি হতে ক্যাটের বদলে ম্যাটের (অপেক্ষাকৃত কমা একটি এন্ট্রান্স টেস্ট) স্কোর থাকলেই চলে (না থাকলেও অসুবিধে হয় না)। সবারই টাই-ব্লেজার শোভিত ইউনিফর্ম আর (নাকি) ‘হান্ড্রেড পারসেন্ট প্লেসমেন্ট’! পরে চাক্ষুষ দেখেছি ওই কলেজগুলির বেশিরভাগেরই ক্যাম্পাসের মাপ বড়জোর বিঘেখানেক, লাইব্রেরি বলতে গোটা সাকুল্যে তিন-চারেক আলমারি, শিক্ষক বলতে কাছে-পিঠের কোনো নামকরা ম্যানেজমেন্ট কলেজ থেকে ধার করা পার্ট-টাইমার...। আসলে পশ্চিমবঙ্গ বা কর্ণাটকের স্যাকরা/ গোয়ালা/ প্রোমোটরদের তৈরি নিকৃষ্টতম প্রাইভেট ইঞ্জিনিারিং কলেজটির থেকেও খারাপ পরিকাঠামো!
তবে এদের সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছিল অরিন্দম চৌধুরী-খ্যাত দিল্লির আই.আই.পি.এম. নামের একটি কলেজ। সেই সময়ে শুরুতেই তারা প্রত্যেক ছাত্রকে ল্যাপটপ দিত (সেই সময়ে ল্যাপটপ আমাদের স্বপ্ন ছিল)। সেই সঙ্গে (নাকি) বিদেশের ইউনিভার্সিটির যৌথ ডিগ্রি, (নাকি) বিদেশে ইন্টার্নশিপ ও অস্থায়ী ওয়ার্ক-পারমিট, ইত্যাদি ইত্যাদি। সে’সময় যারা ভদ্রস্থ র্যাঙ্ক করে মোটামুটি পদস্থ কলেজে ভর্তি হয়েছিল তাদের অনেককেই পস্তাতে দেখেছি,- ‘ইশ্ যদি বাড়ির ফিনান্সিয়াল অবস্থা আরেকটু ভাল হতো, তাহলে-।’ সে এক দিন ছিল বটে! ততদিনে দেশের বিভিন্ন শহরে তাদের ক্যাম্পাস খোলা শুরু হয়ে গিয়েছে, চৌধুরীসাহেব একের পর এক মোটিভেশানাল বই লিখে চলেছেন, টিভিতে এসে দেশকে ‘ব্যাকডেটেড’ বলে খিস্তি করছেন, ইত্যাদি ইত্যাদি!
তারপর সেই আই.আই.পি.এম. প্রায় কুড়িহাজার ছাত্রের দুহাজারের কাছাকাছি মামলার মুখোমুখি হল।– মোটামুটি সবই প্রতারণার। একসময় ঝড় তোলা, ছাত্র-ছাত্রীর কোর্স-ফি দিয়ে বলিউডি সিনেমা অবধি বানিয়ে ফেলা ম্যানেজমেন্ট গুরু অরিন্দম চৌধুরী জেলের ঘানি অবধি টেনেছেন, তার কলেজও বন্ধ হয়েছে। (এমনকি যৌথ ডিগ্রির জন্য বেলজিয়ামের কলেজের সঙ্গে টাই-আপের কথা প্রচার করা হয়েছিল, সেই কলেজটির মালিক তিনিই, আর খোদ বেলজিয়ামে সেই কলেজের কোনো মান্যতাও ছিল না)।... তবে আরো অনেক মেজো-সেজো-ছোট চৌধুরীর কপাল ততটা খারাপ হয়নি। তারা ও তাদের কলেজগুলি আজও বহাল তবিয়তেই ঝুড়ি-ঝুড়ি এম.বি.এ. উৎপাদন করে চলেছে। (তবে বেশ কয়েকটি কলেজ অবশ্য বলার মতো উন্নতিও করেছে।)
কিন্তু প্রশ্ন হল, ওই সময়টায় একের পর এক ম্যানেজমেন্ট কলেজ খোলার বা তাদের ‘পেইড্-রিভিউ’ প্রকাশের এমন কী কারণ ছিল?- উত্তর: মধ্যবিত্ত ও মধ্যমেধা। ১৯৯১-এর উদারীকরণের বয়স তখন এক দশক। আমাদের মতো যারা ছাত্র, তাদের প্রত্যেকেরই কোনো না কোনো ‘তুতো’ দাদা আমেরিকায় বা ইংল্যান্ডে চাকরি করে, দেশেও বাবার আবসরের বছরের মাইনের সমান স্যালারি প্যাকেজ নিয়ে ছেলে-মেয়েরা চাকরিজীবন শুরু করছে। হর্ষদ মেহেতা বা কেতন পারেখ জাতীয় দু-একটা ঝটকা খেলেও অর্থনীতির চাকা তখন ভালই দৌড়চ্ছে।... মোট কথা যে সৎপথে বিলাসব্যসন তার আগে উচ্চবিত্ত আর উচ্চমেধাবীদের জন্যই বরাদ্দ ছিল (ও বাকিরা সেই বাস্তবতা মেনেও নিয়েছিল), তখন সে-সব হাতের নাগালে আসতে শুরু করেছে। ওই কলেজগুলো তখন স্বপ্নপূরণের মসিহা, তাদের টিউসান ফি থাকত দুই থেকে ছ’লাখের মধ্যে। অর্থাৎ সেই সময়ের একজন মধ্যবিত্ত চাকরিজীবীর পক্ষে নিজের প্রভিডেন্ট ফান্ড ভেঙে বা এডুকেশান লোন নিয়ে যা চোকানো সম্ভব।
প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি সেদিনের এই ম্যানেজমেন্ট ছাত্রদের সিংহভাগ আজ পেশাগত ভাবে উচ্চ-মধ্য-নিম্ন যে অবস্থানেই থাকুক না কেন, সেই কৃতিত্ব বা ব্যর্থতায় তাদের ম্যানেজমেন্ট কলেজ বা ম্যানেজমেন্ট শিক্ষার ভূমিকা নেহাৎই গৌণ।... বলাই বাহুল্য, এই মধ্যবিত্ত-মধ্যমেধাবীদের আকাঙ্খাপূরণের ব্যাবসা শুধু ম্যানেজমেন্ট কলেজগুলোতেই সীমাবদ্ধ ছিল না।
তারপর দুটো দশক কেটেছে। সেদিনের ছাত্র-ছাত্রীরা আজ সন্তানের বাবা-মা । পেশাগত দিক থেকেও তারা প্রতিষ্ঠিত।– আগের প্রজন্মের তুলনায় তাদের রোজগারও বেশি। কিন্তু, আমার মতো এই মধ্যমেধাবীদের (মুখে প্রকাশ করি বা না করি), একটা গভীর ক্রাইসিস আছে।– উচ্চমেধা আর মধ্যমেধার পার্থক্য আমরা হাড়েহাড়ে জানি। আর এটাও জানি, ‘লেখাপড়ার ভিত মজবুত নাহলে পরে সমস্যা হয়’।– আর সেই সঙ্গে (মাত্রায় কিছু তারতম্য থাকলেও) প্রত্যেকেই বিশ্বাস করি, আমার ‘ঠিক যতটা ভেবেছিলাম ততটা না হওয়া’র কারণ কোনোভাবেই নিজের বুদ্ধিমত্তার সীমাবদ্ধতা নয়, শুধুমাত্র প্রস্তুতির ঘাটতি!
মধ্যবিত্তের এই ক্রাইসিসটাই এখন নতুন ব্যাবসাক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। মুঠোমুঠো প্রাইভেট স্কুল খুলতে শুরু হওয়া (যার অনেকগুলিরই মালিকানা ওই ম্যানেজমেন্ট কলেজগুলির ডিরেক্টারদের হাতেই) যদি এই সেই ব্যাবসার একটা দিক হয়, অন্য দিকটা হল প্যারালাল স্কুলিং। জয়েন্ট এন্ট্রান্সের প্রস্তুতির জন্য কোটা বা কানপুরের টিউশান নয়ের দশকেও ছিল, সেখানে মাফিয়ারাজও ছিল, এমন বহু কোচিং সেন্টারও ছিল যেখানে ভর্তি হতে চাইলে প্রথমে তাদের এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাশ করতে হতো, কিন্তু এখন যেমনধারা চল হয়েছে,- অর্থাৎ যে পরীক্ষায় দ্বাদশ শ্রেণীর পর বসতে হয়, কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করে অষ্টম শ্রেণী থেকেই তার প্রস্তুতি নেওয়ার কথা সেই সময়ের টপ র্যাঙ্কাররাও ভাবত বলে মনে হয় না।
প্যারালাল স্কুলিংয়ের এই ধারাটাও মোটামুটি একদশকের পুরোনো। এখন আর অষ্টম শ্রেণী নয়, প্রি-প্রাইমারি থেকেই তা শুরু হয়ে যাচ্ছে।– অনলাইনে বা মোবাইলেও। বাচ্চাগুলোর মানসিক বিকাশ-টিকাশের মতো ‘ঘ্যানঘ্যানে-প্যানপ্যানে’ বিষয় আলোচনার বাইরে রেখেই ভেবে দেখুন, অমন এক-একটি অনলাইন স্কুলের কী পরিমাণ টার্নওভার হলে বলিউডের ওপরদিকের নায়ক/ নায়িকা তার ব্র্যান্ড-অ্যাম্বাসাডার হয়, বা তারা একের পর এক আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার সহ-স্পনসর ও বিশ্বের অন্যতম ধনী একটি ক্রীড়াসংস্থার মূখ্য-স্পনসর হয়ে উঠতে পারে!- কোত্থেকে আসে এই টাকা? কীসের বিনিময়ে?- চলুন, তার বৈষয়িক দিকটাই দেখা যাক।
প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণী অবধি মোটামুটি বছরে পঞ্চাশ হাজার টাকা করে কোর্স ফি। সেখানে আবার ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের ধাঁচেই একসঙ্গে তিনবছরের বেতন দিলে পঁচিশ-তিরিশ শতাংশ ছাড়! চতুর্থ থেকে দশম শ্রেণী অবধি (শুধু অঙ্ক ও বিজ্ঞানের জন্য) প্রতিবছর তিরিশ-চল্লিশ হাজার টাকা। একাদশ-দ্বাদশে এসে সত্তর হাজার থেকে দু’লাখ টাকার বিভিন্ন প্যাকেজ, তার সঙ্গে মক্-টেস্ট, ক্রাশ-কোর্স বাবদ আরো হাজার-পঞ্চাশেক টাকা।...
এই ছয়-সাত লাখটাকা খরচ করার পর অভিভাবক হিসেবে আপনি কী কী পাবেন?- শুরুতেই একটি ল্যাপটপ, আর তারপর ‘ও তো বেশ মেধাবী, কিন্তু...’, ‘ও তো খুবই পরিশ্রম করছে, কিন্তু...’, ‘আমরা সবরকম চেষ্টাই করছি, কিন্তু...’। বলাই বাহুল্য, এই বেশিরভাগ সময়েই এই ‘কিন্তু’গুলোর রহস্যের সমাধান হবে না। তবে আপনার ছেলে বা মেয়ে প্রথম চেষ্টায় জয়েন্ট উৎরোতে না পারলে দ্বিতীয়বার নাম নথিভুক্ত করানোর সময় সেই পঁচিশ-তিরিশ শতাংশের ছাড় পেতেই পারেন। আর হ্যাঁ, প্যাথোলোজিক্যাল ল্যাবগুলোর যেমন অনেক ডাক্তারের সঙ্গে বোঝাপড়া থাকে, ঠিক তেমন ভাবে এই সংস্থাগুলো বহু শিক্ষককেই ‘ধরে রাখে’। ফলে পরামর্শ ও সৎ-পরামর্শের তফাৎ করাও কঠিন হয়ে যায় মাঝেমাঝে।
দয়া করে ভুল ভাববেন না, এত খেদোক্তি মানুষের আকাঙ্খা বা পরীক্ষার প্রস্তুতির বিরুদ্ধে নয়, সেগুলিকে ঘিরে গজিয়ে ওঠা ‘অনৈতিক’ ও অমানবিক ব্যাবসার প্রতি। শাহজাদ ফিরদৌসের ‘ব্যাস’ উপন্যাসে একটি অসাধারণ কথা ছিল,- লোভ-কে আকাঙ্খা আর ভোগ-কে প্রাপ্তি ভাবাটা ভুল।... মধ্যবিত্ততা বা মধ্যমেধা কোনো অভিশাপ বা কলঙ্ক নয়, যা যে কোনো মূল্যে তা ধুয়ে ফেলতে হবে। ভেবে দেখার বিষয় হল, ওপরের অনুচ্ছেদগুলোয় যার বর্ণনা করা হয়েছে, তাকে কোনো দিক থেকেই ‘শিক্ষা’ বলা যায় কী?...