এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • করোনার দিনগুলি - ষষ্ঠ কিস্তি

    ঐন্দ্রিল ভৌমিক লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ২৮ এপ্রিল ২০২০ | ২৫৪৩ বার পঠিত
  • করোনার দিনগুলি #২২
    গল্প যখন সত্যি

    ডাঃ চঞ্চল রায় কোনো মহাপুরুষ নন। তিনি ভালমন্দ মেশানো সাধারণ মানুষ। তাঁর জীবনে অনেক সাধ আহ্লাদ আছে। ডাক্তারি পেশার জন্য তিনি জীবনটাকে নষ্ট করতে ইচ্ছুক নন।

    তিনি একটি জেলা হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার। ডিউটি রোস্টার নিয়ে মাঝে মাঝেই সুপারের সাথে ঝগড়া করেন। আউটডোরে দু’শ রোগী দেখার পরে ধৈর্য হারিয়ে রোগীদের সাথে খারাপ ব্যবহার করে ফেলেন।

    তবে ডাঃ চঞ্চল রায় ফাঁকিবাজ নন। ডিউটির ব্যাপারে অত্যন্ত সিনসিয়ার। এক্সট্রা ডিউটি দিতে হলে গাইগুঁই করেন। কিন্তু ডিউটি শুরুর পনের মিনিট আগে হাজিরও হয়ে যান।

    আসলে ডাঃ রায় একটু ভীতু প্রকৃতির মানুষ। তিনি সুপারের ক্ষমতাকে ভয় পান, নেতাদের হম্বিতম্বি ভয় পান, রোগীর বাড়ির লোককে ভয় পান।

    এই ভীতু ডাক্তারকে আবাসনের অন্যান্য প্রতিবেশীরা শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। অন্তত ডাক্তার বাবুর তাই মনে হতো। বিপদে আপদে ডাক্তার বাবুই ছিলেন তাদের ভরসা।

    মাঝরাতে পেটে ব্যথা হলে তাঁরা নির্দ্বিধায় ডাক্তার বাবুর ফ্ল্যাটের বেল বাজাতেন। ডাক্তার বাবু ইনজেকশন দিয়ে ব্যথা কমাতেন। ঘুম চোখে ফিজিশিয়ান স্যাম্পেল ঘেঁটে ওষুধ খুঁজে দিতেন।

    সেই ভীতু ডাক্তার বাবুর যে এমন আমূল পরিবর্তন ঘটবে কে জানতো?

    করোনা মহামারী শুরুর পরে অনেক চিকিৎসকই এমারজেন্সিতে ডিউটি করতে ভয় পাচ্ছেন। আর ডাঃ রায় প্রায় প্রতিদিনই হাসিমুখে এমারজেন্সি করছেন। পি পি ই হিসাবে কয়েকটি কমদামি রেনকোট দেওয়া হয়েছে। চৈত্রের গরমে টানা আট ঘণ্টা প্লাস্টিকের রেনকোট পরে ঘামতে ঘামতে রোগী দেখছেন।

    বাড়িতে স্ত্রী নন্দিনী কেঁদে ভাসাচ্ছেন।  তোমার যদি কিছু হয়, আমরা কি করব?

    ডাঃ রায় হাসি মুখে বলছেন, বুঝলে নন্দিনী, আমার মনে হচ্ছে ঠিক যেন যুদ্ধ ক্ষেত্রে আছি।  স্টেথোস্কোপই আমার বন্দুক। শোনো, আজ থেকে আমি তোমাদের সাথে শোবো না।

    তাহলে কোথায় শোবে?

    তুমি দুই মেয়েকে নিয়ে শোবার ঘরে শুয়ো। আমি যে ঘরে পড়াশোনা করি, ওঘরের তক্তপোশেই শুয়ে পড়ব। দুই মেয়েকে বুঝিয়ে বলো আমার ধারে কাছে যেন না আসে।

    কিন্তু তোমার মুখে গল্প না শুনলে ওরা যে ঘুমায় না।

    আমি এঘর থেকেই হোয়াটসঅ্যাপ এ গল্প শোনাবো। তুমিও আমার ধারে কাছে এসো না। দূর থেকেই খাবার দিয়ে যেও।

    আমার যে বড্ড ভয় লাগছে।

    ডাক্তার বাবু হাসলেন, দূর পাগলী, সৈনিকের স্ত্রী কে ভয় পেতে নেই। বিশ্বাস করো নন্দিনী,  এই প্রথম আমি চিকিৎসক হওয়ার জন্য গর্ব অনুভব করছি।

    কিন্তু পরের দিনই ডাঃ চঞ্চল রায় একটা ঝামেলায় পড়লেন। একজন বয়স্ক জ্বরের রোগী এমারজেন্সি তে এসেছেন। তাঁর শ্বাসকষ্টও হচ্ছে। ভদ্রলোক দশদিন আগে ইতালি থেকে ফিরেছেন।

    ডাঃ রায় রোগীর ছেলেকে বললেন, এনাকে এখানে অন্য রোগীদের সাথে রাখা যাবে না। এনাকে আই ডি হাসপাতালে নিয়ে যান।

    রোগীর পুত্র প্রথম থেকেই আক্রমণাত্মক। সামান্য সর্দি-জ্বরের জন্য বাবাকে আই ডি তে রেফার করছেন! এজন্যই আপনার মতো ডাক্তাররা মার খায়।

    সামান্য সর্দি-জ্বর! ডাক্তার বাবু চমকালেন। বললেন,  উনি ইতালি থেকে ফিরেছেন। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণও তো হতে পারে।

    রোগীর ছেলে বললেন, আমি এখানকার এম এল এ'র ভাইপো। আমি বলছি বাবা এখানেই ভর্তি থাকবে।

    ডাক্তার বাবু বললেন, স্বয়ং এম এল এ সাহেব বললেও আমি এনাকে এখানে ভর্তি করব না। এতে রোগী ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের জীবনের ঝুঁকি হতে পারে।

    কিছুক্ষণের মধ্যেই সুপার দৌড়ে এলেন। বললেন, ডাঃ রায়, আপনি ঝামেলা বাধাতে ওস্তাদ। ফালতু ফালতু এম এল এ'র কাছে আমায় একগাদা কথা শুনতে হলো। ওনাকে ভর্তি করুন।

    ডাঃ রায় গোঁয়ারের মতো বললেন, আমি সরকারি গাইড লাইনের বাইরে যাব না।

    সুপার বললেন, তাহলে আমিই ভর্তি করছি। তবে এর ফল আপনি ভুগবেন।

    রোগী ভর্তি হওয়ার পর ওয়ার্ডের সিস্টার দিদিরা বেঁকে বসলেন। তারা এমারজেন্সির সমস্ত ঘটনা শুনেছেন। সকলের দাবীতে রোগীর লালারস আর রক্ত পরীক্ষার জন্য পাঠানো হল।

    বাড়ি ফিরে চার মিটার দূর থেকে ডাঃ রায় তার স্ত্রীকে সব ঘটনা বললেন।

    নন্দিনী বললেন, আমার সত্যিই খুব ভয় করছে। কি যে হবে?

    কিছু করার নেই। চিকিৎসক হিসাবে এই সংকটের সময়ে সাধারণ মানুষের পাশ থেকে সরে যাওয়া সম্ভব নয়।

    নন্দিনী বললেন, কোন মানুষের জন্য তুমি এতো ভাবছো? খবরে দেখছো না, দিকে দিকে সাধারণ মানুষরাই ভাড়া বাড়ি থেকে ডাক্তার নার্সদের পথে বের করে দিচ্ছে। তাদের পাড়া ছাড়া করছে।

    ডাক্তার বাবু হাসলেন। বললেন,  সব মানুষ ওরকম নয়।

    দুদিন বাদেই ওই জ্বরের রোগীর রিপোর্ট এল। কোভিড ১৯ পজেটিভ। ডাঃ রায় সহ মোট বারো জন স্বাস্থ্য কর্মীকে বাড়ি থেকে কোয়ারান্টাইন সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হল। বিভিন্ন মিডিয়ায় সে খবর ফলাও করে দেখানো হল। এমনকি ডাঃ রায় ও বেশ কয়েকজন স্বাস্থ্য কর্মীর পরিচয় সমেত।

    নন্দিনী ধাতস্থ হওয়ার আগেই আরেক আঘাত পেলেন। এতদিন যাদের ডাঃ রায় যন্ত্রণার উপশম করেছেন,  আজ তারাই ডাক্তার বাবুর বিরুদ্ধে একজোট হয়েছেন। ডাক্তার বাবুর পরিবারকে এই আবাসনের মধ্যে ফ্ল্যাটে থাকতে তারা দেবেন না।

    দুই শিশুকন্যার হাত ধরে নন্দিনী রাস্তায় নামলেন। কোথায় যাবেন জানেন না। লকডাউনের মধ্যে একটা গাড়ি যদি বা জোগাড় করতেও পারেন, কিন্তু কোনো আত্মীয় কি তাদের আদৌ আশ্রয় দেবেন। দুই শিশু কন্যার হাত ধরে এক ডাক্তারের স্ত্রী হাঁটতে শুরু করলেন।  অনিশ্চয়তার লং মার্চ।


    করোনার দিনগুলি #২৩

    সারাদিনে অসংখ্য ফোন আসে। এই করোনা মহামারীর  সময়ে বেশ কিছু অদ্ভুত ফোনও পাচ্ছি।

    একটা ফোন পেলাম। ‘ডাক্তার বাবু, আপনার গাড়ি কি ভাড়া পাওয়া যাবে?'

    শুনে আমি থতমত খেয়ে গেলাম। বললাম, 'আপনি ভুল জায়গায় ফোন করেছেন। আমি ডাঃ ভৌমিক বলছি।'

    ওপাশ থেকে উত্তর এল, 'আমি আপনাকেই ফোন করেছি। আপনার গাড়িটা ভাড়া দেবেন ঘন্টা আটেকের জন্য? যা ভাড়া লাগে দেব।'

    কি দিনকাল পড়েছে! মহামারীতে মনে হয় লোকজনের মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আমার গাড়ি ভাড়া চাইছে! আমার সবেধন নীলমনি একটা স্কুটার। ওটা ভাড়া দিলে এই করোনার মরশুমে চারিদিকে ঘুরে ঘুরে রোগী দেখব কি করে?

    আমি বললাম, 'ভাড়া নিয়ে আপনি কী করবেন?'

    উত্তর এল, 'বর্ধমানে যেতাম। ওখানে আমার স্ত্রী লকডাউনে বাপের বাড়ি আটকে পড়েছে। তাকে নিয়ে আসতাম।'

    আমি ব্যাপারটা কল্পনা করার চেষ্টা করলাম। বড্ড রোমান্টিক। স্বামী আমার স্কুটার চালাচ্ছেন। নতুন বউ তার কোমর জড়িয়ে বসে আছেন। আহা.. এই পথ যদি না....

    কিন্তু আমার ঝড়ঝড়ে স্কুটার অতটা সহ্য করতে পারবে? মধ্যমগ্রাম থেকে বর্ধমান কম দূর নয়।

    বললাম, 'স্কুটার চালিয়ে যেতে পারবেন অতো দূর? লকডাউনের ঠিক আগেই পেছনের চাকার তিনটে লিক সারিয়েছি। রাস্তায় কিছু হলে পরে আমাকে দোষ দেবেন নাতো?'

    অন্যদিক থেকে হাহাকার শুনলাম, 'সেকি, আপনার চারচাকা গাড়ি নেই? শুনেছিলাম ডাক্তারের গাড়ি দেখলে পুলিশ আটকায় না।'

    অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে ফোন কেটে দিলাম।

    আগেও এরকম অদ্ভুত অদ্ভুত ফোন পেতাম। একাগ্রচিত্তে একজন শ্বাসকষ্টের রোগীর হৃদপিণ্ডে গ্যালপ আছে কিনা স্টেথো দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছি, এমন সময় বুকপকেটে ফোনের ভাইব্রেশনে নিজের হৃদপিণ্ডে গ্যালপ শুরু হল। ফোন ধরতেই অভিযোগের তীর ছুটে এল, 'আমি বুড়ো মানুষ। না খেয়ে রয়েছি। সাড়ে ন’টা বাজে। রক্ত নিতে কখন আসবে?'

    বললাম, 'আপনি ভুল জায়গায় ফোন করেছেন।'

    'হুঁ, আমাকে ঠিক ভুল শেখাচ্ছো! তোমার মতো ইরেস্পন্সিবল ছেলে আমি দেখিনি।'

    'দেখুন আপনি ভুল করছেন...'

    'হ্যাঁ, ভুল আমি করেছি। তোমাকে দায়িত্ব দেওয়াই আমার ভুল হয়েছে। তোমার চেহারা দেখেই বোঝা উচিৎ ছিল।'

    'সত্যি সত্যিই আপনি ভুল...'

    'চোপরাও। আমি সুগারের পেশেন্ট। এতো বেলা অবধি উপোস থাকার ফলে যদি কোনো ক্ষতি হয়, তাহলে তোমার বিরুদ্ধে মামলা করব।'

    'কি আশ্চর্য,  আপনি তো আমার কথাটাই শুনছেন না।'

    'সাড়ে ন’টার সময় এখন কথা শোনানোর চেষ্টা করছ। ছোটোলোক, ইতর, লজ্জা করেনা তোমার?'

    বাধ্য হয়েই ফোন কেটে দিলাম। পরক্ষণেই আবার ফোন। ধরলাম না। ফোন সাইলেন্ট করে দিলাম।

    ঘন্টা দুয়েক রোগী দেখার পর হঠাৎ খেয়াল করলাম ফোন এখনো সাইলেন্ট করা আছে। খুলে দেখলাম বত্রিশটা মিসকল। তার মধ্যে কুড়িটাই ওই ভদ্রলোকের। যার রক্ত আনতে যাওয়ার কথা সে যদি সত্যি সত্যি যায়, খবর আছে।

    ইদানীং আরো অদ্ভুত অদ্ভুত ফোন পাচ্ছি। অনেকেই ফোন করে জানতে চাইছেন এসময় রোগীদের প্রেশার দেখছি কিনা।

    প্রথম প্রথম অবাক হচ্ছিলাম। 'প্রেশার দেখব না কেন?'

    জবাব পেলাম, 'প্রেশার দেখতে হলে আমাকে ছু্ঁতে হবে। এই মহামারীর সময়ে আপনি কি রোগীদের ছোঁবেন?'

    মনে মনে হাসলাম। রোগের ভয়ে রোগীকে ছোঁবো না! জ্বরের রোগীর হাঁ করে গলা দেখব না? শ্বাসকষ্ট রোগীর বুকে স্টেথো চেপে ফুসফুসের শব্দ শুনব না? পেটে ব্যথা রোগীর পেট টিপব না?

    চিকিৎসকের স্পর্শে রোগীরা যেমন ভরসা খুঁজে পান, তেমন রোগীর দেহ স্পর্শ করে একজন চিকিৎসকও পুনরুজ্জীবিত হয়ে ওঠেন। কোনো মহামারীই চিকিৎসক রোগীর এই সমীকরণ নষ্ট করতে পারবে না।

    এই বিশ্বাস টুকু সম্বল করেই চিকিৎসকরা উপযুক্ত সুরক্ষা ছাড়াই এক ডেথ মিশনে নেমে পড়েছেন। সেই বিশ্বাস টুকু রক্ষা করার দায় কিন্তু আপনারও।


    করোনার দিনগুলি #২৪

    রোজই বেরোতে হচ্ছে। আগে সোদপুরে স্কুটারে যেতে সময় লাগত কুড়ি মিনিট। এখন আট মিনিটেই পৌঁছে যাচ্ছি।

    প্রথম প্রথম রোমাঞ্চ লাগত ফাঁকা রাস্তায় স্কুটার চালাতে। মনে হত অন্যরা যখন ঘরে দরজা জানলা বন্ধ করে এক অজানা শত্রুর ভয়ে কাঁপছে, আমি তখন সেই ভয়ঙ্কর শত্রুর চোখে চোখ রেখে লড়াইয়ে নেমে পড়েছি। এই লড়াইয়ের সুযোগ অনেক চিকিৎসক সারাজীবনেও পায় না। আমি সেই সুযোগ পেয়েছি।

    কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, সেই রোমান্টিকতা বদলে যাচ্ছে। বড্ড একঘেয়ে লাগতে শুরু করেছে। কিসের যুদ্ধ? কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ? কাদের জন্য যুদ্ধ?

    প্রতিবেশী দেশের সাথে যুদ্ধ করার সময় এদেশের সৈনিকেরা সব রকম সুযোগ সুবিধা পান, আধুনিক অস্ত্র শস্ত্র পান। দেশের মানুষের কাছে সম্মান পান।

    আর আমরা হতভাগ্য চিকিৎসকেরা না পাচ্ছি অস্ত্র শস্ত্র। না পাচ্ছি সরকারি সহযোগিতা। বরঞ্চ প্রতি মুহূর্তে মাথার উপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা। সন্দেহ হলেও কাউকে সাথে সাথে কোভিড-১৯ এর পরীক্ষা করা যাবে না। এমনকি কারো মৃত্যু হলে মৃত্যুর কারণ ঠিক করবে আলাদা একটি কমিটি।

    আর দেশের অনেক মানুষ সম্মান প্রদর্শন তো দুরের কথা, মহামারীর সাথে যুদ্ধরত স্বাস্থ্যকর্মীদের পাড়া ছাড়া করতে পারলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।

    তাছাড়া শত্রু কি একটা! কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ের ক্রসিং’এ স্কুটার নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। যদিও রাস্তায় আর কোনও গাড়ি নেই, তবু সিগন্যালের রঙ লাল হয়ে আছে। একটি বাচ্চা ছেলে ডাকল, ‘বাবু এক কেজি চাল কিনে দেবে? ভাত খাবো।’ এর আগে অনেক ভিক্ষুক দেখেছি। অনেকে পয়সা না চেয়ে চা খাওয়াতে বলেছে, বিস্কুট কিনে দিতে বলেছে। কিন্তু এরকম ভাবে কেউ চাল চায়নি।

    মহামারীকে ঠেকানোর জন্য আমরা লক ডাউনকে অস্ত্র করেছি। কিন্তু সেই অস্ত্রের সত্যিকারের ব্যবহার আমরা আদৌ জানি তো? বহু গরীব মানুষের চোখের জলে ভেজা এই লকডাউন আমরা আদৌ কাজে লাগাচ্ছি কি?

    এসময়ে দরকার ছিল সন্দেহজনক রোগীদের প্রচুর টেস্ট করা এবং পজিটিভ রোগীদের আইসোলেটেড করা। টেস্টের সংখ্যা সমস্ত ভারতবর্ষে হতাশাজনক ভাবে কম। আর সবচেয়ে কম আমাদের পশ্চিমবঙ্গেই।

    এমন ভাবে চললে দ্বিতীয় দফা লকডাউনের শেষে ৩ই মে তারিখে আমরা একই অবস্থায় বা আরও খারাপ অবস্থায় থাকবো। তখন কি হবে? আরও কুড়ি দিন লক ডাউন বাড়বে? সেই কুড়ি দিন পরে কি হবে? একটা মহামারীর হাত থেকে বাঁচতে আমরা একটা মন্বন্তর সৃষ্টি করছি নাতো?

    আসলে মহামারীতে সব শ্রেণীর জনগোষ্ঠীর আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। কিন্তু মন্বন্তরের আঁচ উচ্চবিত্ত এবং উচ্চ মধ্যবিত্তের উপর তেমন পড়ে না।

    দুবেলাই নিম্নবিত্ত মানুষের অসহায়তা দেখছি। কিন্তু সেসব লেখার মতো কলমের জোর আমার নেই। আজ দরকার ছিল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় অথবা শরৎচন্দ্রের মতো মরমী কলমের। একজন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রতিনিধি হিসাবে আমি মধ্যবিত্তদের অসহায়তার কথা বলতে পারি।

    গতকাল এক স্কুলের বন্ধু ফোন করেছিল। ওর মায়ের চার্নক হাসপাতালে ডায়ালিসিস চলছিল। একজন ডায়ালিসিস রোগীর কোভিড-১৯ ধরা পড়ার পরে ও তাঁর মৃত্যুর পরে রাতারাতি চার্নক হাসপাতাল বন্ধ হয়ে গেছে। ঐ হাসপাতালের নাম শুনলে অন্য কোনও হাসপাতাল ডায়ালিসিস করতে রাজি হচ্ছে না। কাকিমার সপ্তাহে তিনদিন ডায়ালিসিস লাগে। ঐ বন্ধু পাগলের মতো এখানে ওখানে ছোটা ছুটি করছে।

    মাঝে মাঝেই বিভিন্ন হাসপাতাল বন্ধের খবর আসছে। আজ মেডিকেলের প্রসূতি বিভাগ বন্ধ হচ্ছে, তো কাল এন আর এসের মেডিসিন বিভাগ। দলে দলে চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী কোয়ারাণ্টাইনে যাচ্ছেন। মহামারী প্রতিরোধে পরিকল্পনার অভাব মাঝে মাঝেই অত্যন্ত হতাশাজনক ভাবে বেআবরু হয়ে যাচ্ছে।

    এসময় যারা অন্যান্য মারাত্মক অসুখে ভুগছেন, তারাও সমস্যায় পড়েছেন। ক্যানসার রোগীদের কেমো থেরাপি, রেডিও থেরাপি বন্ধ। নানারকম সার্জারির ডেট পিছিয়ে যাচ্ছে। সরকারি হাসপাতালে বহুদিন অপেক্ষা করে যারা বিভিন্ন সার্জারির ডেট পেয়েছিলেন, তাঁরা অকুল পাথারে। লকডাউন ওঠার পর আবার কবে ডেট পাবেন, ভগবানও বলতে পারবেন না। যারা সরকারি হাসপাতাল থেকে সুগার, প্রেশারের ওষুধ নিয়মিত খেতেন, অনেকেই যানবাহনের অভাবে হাসপাতালে যেতে পারছেন না। তাঁদের মধ্যে অনেকেই ওষুধ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়ে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন।

    এই সময়ে জাত-পাত, রাজনীতির রঙ ভুলে আমাদের সকলের দৃঢ় কণ্ঠে বলার সময় এসেছে, স্ক্রিনিং আর টেস্ট, টেস্ট, টেস্ট, টেস্ট এবং টেস্ট...। একমাত্র টেস্ট ও পজিটিভ রোগীর আইসোলেশনই পারে লকডাউনের সময় সীমা কমাতে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ২৮ এপ্রিল ২০২০ | ২৫৪৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • b | 172.68.146.79 | ২৮ এপ্রিল ২০২০ ১৪:৪৮92763
  • এই সিরিজটার জন্যে বসে থাকি।
    চঞ্চল রায়ের ঘটনাটা সত্য?
  • বিপ্লব রহমান | ২৮ এপ্রিল ২০২০ ২০:১২92771
  • "একটা মহামারীর হাত থেকে বাঁচতে আমরা একটা মন্বন্তর সৃষ্টি করছি নাতো?"

    এপারে এই প্রশ্ন আমাদের অনেকেরই। পরিস্থিতি মোটাদাগে একই। 

    #

    চঞ্চল রায়রা আছেন বলেই টিনের তলোয়ার নিয়ে এখনও লড়ে যাচ্ছে টিপু সুলতান। সেল্যুট ডক্টর। 

  • সারণ ঈষিকা | 162.158.165.93 | ২৯ এপ্রিল ২০২০ ১২:৩০92808
  • মানবিকতা, অমানবিকতা, অবিমৃষ্যকারিতা সব রকম সংবেদন এর এক অপূর্ব মিশেল আপনার এই স্নিপেট। সাহস যোগাচ্ছে মনে। 

  • সারণ ঈষিকা | 162.158.165.93 | ২৯ এপ্রিল ২০২০ ১২:৩০92807
  • মানবিকতা, অমানবিকতা, অবিমৃষ্যকারিতা সব রকম সংবেদন এর এক অপূর্ব মিশেল আপনার এই স্নিপেট। সাহস যোগাচ্ছে মনে। 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় মতামত দিন