এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • দু-চার কথায়

    দু-চার জন লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ০২ আগস্ট ২০১৬ | ৯১৩ বার পঠিত
  • হুট করে লিখতে বললেই কি পাট করে প্রবন্ধ নেমে যায়? সব সময় হয়তো না। কিন্তু, কিছু কিছু বলার মতো কথা তো থাকেই যা অন্তত না বলে থাকা অনুচিত। অনুরোধ একান্তই ফেরাতে পারেননি যাঁরা, তাঁদের দু-কলম অনন্যোপায় লেখা এখানে একসঙ্গেই থাকল, নাহোক নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করার অছিলাতেই।


     

    কাঙাল মালসাট

    সুতনয়া

    এটা লিখতে বসেই মনে পড়ল সেই নবারুণভক্তদের। দুবছর আগে ফেসবুকে একদিন সাহস করে জানিয়েছিলাম কাঙ্গাল মালসাট নিয়ে দু চার অপছন্দের কথা। তাতে ভক্তরা আমাকে চার পাঁচ অপছন্দের কথা শুনিয়ে জানালেন, আমার মত ‘নারীবাদের বিশ্লেষক’দের মাথায় ফ্যাতাড়ুদের মলত্যাগ কর্তব্য, ও তাতেই কাঙ্গাল মালসাটের সার্থকতা। সেই কোন গল্পে ছিল, ‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, ভাগ্যিস গরু ওড়ে না’।

    কি লিখেছিলাম? নন্দিনীদির কথায় ওদের ব্লগ আয়নানগরের জন্য ওই পোস্টটাই একটু উদাহরণ সহকারে লিখেছিলাম, তার থেকেই কিছু অংশ তুলে দিচ্ছি।

    ফ্যাতাড়ু–চোক্তাররা লিঙ্গসাম্য নিয়ে বিশেষ চিন্তিত এমন কোন ইঙ্গিত গল্প থেকে পাওয়া যায় না। (কোন কিছু নিয়েই খুব সময় নিয়ে চিন্তা করেন তাঁরা এমন নয়।) ফ্যাতাড়ুপুঙ্গব ডি এস এক মেয়েকে কনুই মারেন, কবি পুরন্দর ভাট এক “একলা মেয়েকে সাইজ করার (মানে ঠিক জানিনা, তবে খুব সুবিধের বলে তো মালুম হয় না) ধান্দা” করেছিলেন, এক বড়লোকের গাড়িতে ঢুকে গিয়ে “ঢেমনি মাগি” প্ল্যান কেঁচিয়ে দিল। এবিষয়ে আরেক ফ্যাতাড়ু মদনের মত, অমন “হারামি মাগি”র “গলা টিপে দিতে হয়”। 

    লেখকও যে তাঁর বর্ণনায় লিঙ্গসাম্যের খুব পরোয়া করেছেন তা নয়। নারীচরিত্রগুলির বর্ণনায় চেহারা, পোশাক ও হাবভাবের বাইরে খুব বেশি কিছু আসেনি। ডি এসের বউ কালো, মোটা, “কোলাব্যাঙের” মত দেখতে, ডি এসকে ছেড়ে চলে গেছিল, বেচামণি হাসে কাঁদে কথা বলে, বেগম জনসন ফন্দি করে, বাকিরাও হাঁটে চলে কথা বলে। মোটের ওপর, কোন মানুষকে খুব ওপর–ওপর দেখলে যা চোখে পড়ে, নড়া–চড়া ইত্যাদি। তার কাজকর্মের পেছনে ভয় পাওয়া ইত্যাদির থেকে সূক্ষ্মতর কোন অনুভূতির কোন উল্লেখ নেই। এই উল্লেখ কিন্তু প্রধান–অপ্রধান বেশ কিছু পুরুষচরিত্রের ক্ষেত্রে আছে। ভদির ভাবনার (কথা বলা নয়) বর্ণনা এসেছে। কমরেড আচার্যর ভাবনার বর্ণনা আছে। বেচামণির নেই। এমনকি বেগম জনসনেরও নেই। বিভিন্ন ক্ষেত্রে পুরুষের পোশাকের উল্লেখ না থাকলেও মেয়েদের পোশাকের উল্লেখ এসেছে, সে পোশাক সমাজে ওই অবস্থায় সাধারণভাবে পরিহিত পোশাকের চেয়ে বিশেষ আলাদা না হলেও। দুটি ছেলের মধ্যে আলোচনার উদাহরণ পাওয়া যাবে কাঙ্গাল মালসাট বা ফ্যাতাড়ুর বোম্বাচাকে। দুটি মেয়ের মধ্যে আলোচনা – নেই। অপ্রধান নারীচরিত্রগুলি নিয়ে পুরুষদের ভাবনার উল্লেখটা নারীর যৌন আবেদনের রেটিং–কেন্দ্রিক – জোয়ারদার ‘বাবু’র স্বগতোক্তি রয়েছে তাঁর স্ত্রী ললিতার চেহারা সম্পর্কে। মেঘমালা সম্পর্কেও একাধিক পুরুষের অনুরূপ মন্তব্য রয়েছে। পুরুষের যৌন আবেদন নিয়ে নারী বা পুরুষের ভাবনার বর্ণনা – নেই। আর মেয়েদের চেহারার বর্ণনার ফোকাস মেয়েদের সেই অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বা হাবভাব যার সাথে যৌন “আবেদনে”র (হ্যাঁ, যৌন আবেদন শব্দটা অসুবিধেজনক) প্রচলিত ধারণা জড়িত। একটি উদাহরণ দেখা যাক – “গোলাপি লিপিস্টিক চুলবুলে ঠোঁট আবছা ফাঁক করে ট্রেইনি নার্স মিস চাঁপা এসে ফিসফিসিয়ে উঠল”।

    … কিন্তু, ফ্যাতাড়ু–কাঙ্গাল মালসাট নিয়ে বহু বিষয়ে প্রগতিশীল বামপন্থী রাজনীতির সাথে যুক্ত প্রচুর মানুষের বিপুল উচ্ছ্বাস রয়েছে, কিন্তু ফ্যাতাড়ু–কাঙ্গাল মালসাট যে দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা, এই গল্পগুলির মধ্যে যে নারীর চিন্তা–অনুভূতি অনুপস্থিত, সে কথাটা এত উচ্ছ্বাস যাঁরা দেখাচ্ছেন তাঁদের কেউ একবারো বলছেন না?

    হয়ত আজ লিখলে খানিক অন্য লিখব, কিন্তু ওপরের বক্তব্য বিশেষ বদলাবে না। নবারুণের লেখার সাথে আমার বিশেষ পরিচয় নেই, গুটিকয়েক ছাড়া। স্কুলে থাকতেই প্রথম পড়া হারবার্ট। মনে আছে, কেঁদে ফেলেছিলাম। লোক ঠকিয়ে খাওয়া একজনকে নিয়ে কেউ গল্প লিখেছে এত সংবেদনশীলতার সাথে! অ্যাদ্দিন অবধি দেখা, ট্র্যাজিক হিরোইন বা হিরো চুরি করে না, মিছে কথা বলে না, সবার সেবা করে ইত্যাদি। অলিভার ট্যুইস্ট যেমন। পান থেকে চুন খসলেই পাঠক-পাঠিকার সহানুভূতি থাকবে না যে! যারা চুরি করে, খিস্তি দেয়, লেখাপড়া জানে না, দেখতে সুন্দর নয়, দিনের শেষে যাদের গল্পে বড়লোকের বদান্যতার ‘হ্যাপি এন্ডিং’ অপেক্ষা করে নেই, সেসব ছোটলোকদের আবার অনুভূতির কথা ভাবতে হয় নাকি? এই ঘৃণ্য ভদ্রলোকীয়তাকে কি সাবলীলভাবে উপেক্ষা করে লেখা হারবার্ট! গল্পের মাধ্যমে, সিনেমার মাধ্যমে, আলাপচারিতার মাধ্যমে, শাসনের মাধ্যমে, শ্রেণীগত অবস্থান টিকিয়ে রাখার স্বার্থে ভদ্রলোক বাড়িতে যে সংকীর্ণতা ও অসংবেদনশীলতার ট্রেনিং চলে, সেই ট্রেনিং-এর উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে ছিল হারবার্ট তখন আমার কাছে। ন্যায্যতার যে ধারণা প্রধাণতঃ গরিব ও নিম্নবর্গের মানুষদেরই দোষী করে, সেই ধারণার মুখে একটা থাপ্পড় ছিল হারবার্ট। ধার নিয়ে পড়া বই, একবারের বেশি আর পড়া হয়নি।

    তারপর বহুদিন পর পড়া ফ্যাতাড়ু ও কাঙ্গাল মালসাট। হারবার্টে যা পেয়েছিলাম ছোটবেলায়, এতেও পেলাম বটে। আবার হারবার্টে যা পাইনি, এতেও তা পাইনি। পাইনি লিঙ্গভিত্তিক অবদমন সম্পর্কে সংবেদনশীলতা। কনুইয়ের মার খাওয়ার অভিজ্ঞতাও হয়েছে, রাস্তায় একলা মেয়ে বলে ‘সাইজ’ও হয়েছি। ‘বুকি’র মতই সংক্ষেপে মাপা হয়েছে আমার অস্তিত্বকে। ডি এসের বৌয়ের মতই চেহারাসর্বস্বতায় দেখা হয়েছে আমাকে। নতুন কোন অভিজ্ঞতা নয়। অসংখ্য মেয়ের প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতা এগুলো। এই অভিজ্ঞতার চাপে পিঠ বেঁকে যায়, শরীর কুঁকড়ে যায়, মনোবল ভেঙ্গে যায়, অনেক কিছু করার ক্ষমতা হারিয়ে যায়, অনেক কিছু স্রেফ করতেই দেওয়া হয় না। এই অত্যাচারগুলোকে যত ছোট করে কিছু মানুষ দেখতে পারেন, তত ছোট করে দেখার মত নয় এগুলো। আপনারা অনেকে স্রেফ ভাবতেই পারেন না, ঠিক কেমন লাগে সারাদিন রাস্তায় নিজের শরীর সম্পর্কে সচেতন থাকতে, বুক দেখা যাচ্ছে কিনা! ঠিক কেমন লাগে, যখন রাস্তায় ল্যাম্পপোস্ট ছুঁয়ে যাওয়ার মত লোকে আপনাকে ছুঁয়ে যায়, বুকে ধাক্কা মেরে, পেছনে হাত দিয়ে, কোন ছেলে আপনার সামনে দাঁড়িয়ে নির্জন রাস্তায় প্যান্ট খুলে নিজের যৌনাঙ্গ দেখায়, আর আপনার নিজের বেঁচে বাড়ি ফেরা নিয়ে তাৎক্ষণিক সন্দেহ উপস্থিত হয়। আপনার পুরুষ বন্ধুরা রাত দুটোর সময় নির্জন রাস্তায় হাঁটতে কি ভাল লাগে বলে, আর আপনার মনে পড়ে রাত সাড়ে দশ’টার সময় লোক কমে গেলে রাস্তা দিয়ে আপনি ভয়ে প্রায় দৌড়তে থাকেন ঘরে ফেরার জন্য। সামান্য হাঁটার আনন্দটুকুও আপনার জন্য বরাদ্দ নেই – ভাবতে পারেন? এই ‘একলা মেয়েকে সাইজ’ করার চরম হিংস্রতাকে এত সহজে কি করে উপেক্ষা করি আমরা, বলুন? সাইজ করতে গিয়ে সেই ‘ঢেমনি মাগি’দের ‘গলা টিপে’ দেওয়া লাশগুলোই বা কি করে ভুলে যাওয়া যায়? যখন আপনি নিজের নামের পাশে ফেসবুকে ‘ফ্যাতাড়ু’ বসান, এই লাশগুলোর কথা ভাবেন? শ্রেণীস্বার্থের দোহাই যখন পাড়ছেন, শ্রেণীর মধ্যে অবদমিত নারী ও অন্যান্য লিঙ্গের মানুষদের কথা ভাবছেন কি? সেইসব পুরুষদের কথাও ভাবছেন কি, যারা ‘পৌরুষের’ হিংস্রতা আর নিয়ে উঠতে পারছেন না? এটাও কি বুঝতে পারছেন, যে শ্রেণীস্বার্থকে স্রেফ লিঙ্গ-অবদমনের অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করছেন? লিঙ্গভিত্তিক অবদমন কিচ্ছু দিয়ে জাস্টিফায়েড নয়। কিচ্ছু দিয়ে নয়।

    নবারুণের সাহিত্য আমি বিশেষ পড়িনি। হয়ত পরে পড়ব, হয়ত পড়ব না। নবারুণের সাহিত্যের বা ব্যক্তিত্বের পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণের জ্ঞান আমার নেই। নবারুণের সাহিত্য আমার কাছে নিষ্ঠুর ‘ভদ্রলোকীয়তা’র মুখে থাপ্পড় হয়ে এসেছে। আর এসেছে নারীর অবদমন হয়ে। ‘মেয়ে’ হিসেবে অবদমনের জন্য কোন সহানুভূতি আমার পড়া নবারুণের লেখা থেকে আসেনি, বরং উল্টোটা এসেছে অনেক। ‘মেয়ে’ হওয়ার জন্য সমাজ থেকে যত মেটাফরিক্যাল লাথি জোটে, তার মধ্যে একটা লাথি পেয়েছি নবারুণের লেখা থেকে। সেটা উপেক্ষা করতে পারব না, করা সম্ভব নয়।

     


    নবারুণ পড়া আমার কাছে Acquired Taste

    সুচেতনা দত্ত

    নবারুণকে নিয়ে লেখার, আদৌ কোনোকিছু লেখার সবচেয়ে বড় বাধা হল ওনার ভক্তগণ। এমনকি "নবারুণ পড়ি নি", "নবারুণ বুঝি না", "নবারুণ ভালো লাগে না" বললেও মুক্তি পাওয়া যায় না। কারণ ওনারা মানতেই পারেন না যে নবারুণও পাঠক টানতে ব্যর্থ হতে পারেন।

    আমার ক্ষেত্রে নবারুণ ব্যর্থই হয়েছিলেন। কোলকাতা শহরে থেকে, বড় হয়ে, বাংলা মাধ্যমে পড়াশুনা করা সত্বেও আমি কখনো নবারুণের নামই শুনি নি ২০০৪ সাল অব্দি। প্রথম শুনলাম আমার থেকে দশ বছরের ছোট ভাইয়ের কাছে, যে কিনা জীবনে ফেলুদা আর টেনিদা ছাড়া কিছু পড়লই না! সেই ছেলে দেখি বালিশের তলায় নবারুণ লুকিয়ে রাখে! দেখি তো কী এমন বই!

    কয়েক পাতা উল্টেই নালিশ, "মা, এই দেখো, ভাই আজকাল কী পড়ছে, পাতায় পাতায় গালাগালির বন্যা!"

    ব্যাস সে এক বড় ধাক্কা! নবারুণ আর খুলে দেখার ইচ্ছে হয় নি এরপর অনেকদিন। এদিকে দেখি চারপাশের লোকজন কী এক মজায় মেতে কথায় কথায় সাঁই সাঁই ফ্যাত ফ্যাত বলে, ফ্যাতাড়ুর রেফারেন্স দেয়। অ্যাকাডেমিতে নাটকও হয়ে গেল, হাউসফুল হল। এরপর নবারুণের বই  সিনেমাও হয়ে গেল। তখনও সেই পাতা উল্টানোর ধাক্কা কাটে নি। ফলে সিনেমাটা দেখতে যেতেও ইচ্ছে করে নি।

    এর অনেকদিন পরে ভাইই কথায় কথায় হারবারটের বিছানার গল্প বলে। এবার কৌতূহলী হয়ে উঠি। ভাইয়ের বইয়ের তাকে আবারও হাত বাড়াই। এবার জোর করেই প্রথম দুইতিন পাতা পড়ার চেষ্টা করি। কিন্তু একেবারেই আকর্ষণ বোধ করি না। ভাষা একটুও টানে না। একটানা পড়তে ইচ্ছে করে না। বন্ধ করে রাখি বই। দুইদিন বাদে আবার বইটা খুলি। এবার আর ততটা বিকর্ষণ বোধ করি না। পড়া এগোয়।  একবারে চল্লিশ পাতা পড়ে ফেলি। অন্য কাজে উঠে যাই।  কিন্তু এবার একটা টান টের পাই। পরের পাতাগুলো পড়ার জন্য। এভাবেই থেমে থেমে পড়ে পড়ে একসময় বই শেষ হয়ে যায়। 

    কিন্তু শেষ হয়ে গেলেও একবারের জন্যও মনে হয় না, একটা কোনো মহৎ সাহিত্য পড়লাম। বরং অবাকই হই এই বই নিয়ে সব্বার এত মাতামাতির কি আছে বুঝতে না পেরে। ঠিক আছে, কাঙাল মালসাট পড়া যাক এবার। এবারেও প্রথমে বিরক্তি। তারপর কৌতূহলের টানে ধীরে ধীরে, খুবই ধীরে ধীরে পড়তে থাকি। এবং তখনই, তখনই বুঝতে পারি - নবারুণ পড়ার মজা ওই ধীরে ধীরে ছোট্ট ছোট্ট চুমুক দেওয়ার মধ্যেই, তাতেই আসল আমেজ।

    হ্যাঁ, নবারুণ প্রথমবার পড়তে গিয়ে আমার ধাক্কা লেগেছিল, বিকর্ষণ হয়েছিল। "Acquired Taste" কথাটার কি বাংলা অনুবাদ হয়! নবারুণ পড়া আমার কাছে ওই অনেকটা "Acquired Taste" এর মত ব্যাপার।

     


    নবারুণের মেয়েরা কথা বলে না

    যোষিতা 

    মেয়ে পাঠকরা আলাদা করে কেন তাদের পাঠপ্রতিক্রিয়া লিখবে এইটে আমি বুঝতে পারিনি। মেয়ে পাঠক কি তবে অন্য ধরণের পাঠক? তারা যখন গদ্য বা পদ্য পড়ে,  তখন অন্যরকম করে পড়ে বা ভাবে লেখাগুলো নিয়ে? জানিনা। হয়ত ছেলে পাঠক যেভাবে পড়ে বা ভাবে, সেভাবে পড়েনা মেয়ে পাঠকেরা।  এভাবে আলাদা করা যায় কি পাঠকদের? তেমন করে দেখতে গেলে তো প্রত্যেক পাঠকেরই তো দেখবার জায়গা ভিন্ন। কম হোক কি বেশি, আলাদা তো তারা একে অন্যের চেয়ে। নাকি মেয়েদের যেমন আলাদা ম্যাগাজিন থাকে সেরকম কিছু ব্যাপার। যাইহোক, আমি একজন অত্যন্ত সাধারণ পাঠক এবং এই শ্রেণীবিভাজনে একজন মেয়ে পাঠকও। নবারুণ ভট্টাচার্যের বেশ কিছু প্রকাশিত গদ্য পড়েছি, নিজের মত করে বুঝতে চেষ্টা করেছি। তাঁর যেকোনো একটি লেখা নিয়ে কিছু লিখবার মতো সাহিত্যের জ্ঞান বা পড়াশুনো আমার নেই। এইটুকু গেয়ে নিয়ে লিখতে শুরু করি।

    ফোয়ারাকে নিয়ে নবারুণের গোটা তিনেক গল্প আছে, তার মধ্যে দুটো পড়েছি। "ফোয়ারার সেই মানুষজন" এবং "ফোয়ারার জন্য দুশ্চিন্তা"। দুটোই লাভ স্টোরি। দুটোই ফোয়ারার লাভারের ন্যারেটিভে। 

    "ফোয়ারার জন্য দুশ্চিন্তা"য় ফোয়ারার অসুখ হয়, একটা দুরারোগ্য রোগ সম্ভবত। এই থিমটা তেমন নতুন নয়; আমরা আগেও দেখেছি ভিক্টর হুগোর লে মিসেরাব্ল (Les Misérables) তে। কোসেৎ (Cosette) এর মা ফঁতিন (Fantine), ফোয়ারার মতন যার পেশাও বেশ্যাবৃত্তি, সেই ফঁতিনের টিবি হয়েছিল যেটা দুরারোগ্য ছিল সেকালে। ফোয়ারার এমন একটা অসুখ করেছে, গল্প পড়ে মনে হচ্ছে তার সেরে ওঠার কোনো আশা নেই। ফোয়ারা ক্রমশঃ শুকিয়ে যাচ্ছে। আরো একটা ব্যাপার একটু ক্লিশে লাগে সেটা হচ্ছে ফোয়ারার এই মিস্ট্রি ডিজিজ। যে মেয়ের নিজের শরীরের ওপরে নিয়ন্ত্রণ (Agency over own body) রয়েছে, সে ই একটা অজানা রোগে আক্রান্ত হয়, অথচ ফোয়ারার লাভারের বউয়ের, কিন্তু গল্পের শেষ অবধি এরকম কোনো অসুখে পড়বার কথার উল্লেখ নেই। লাভারের বউয়ের সেভাবে নিজের শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ কোথায়? যদিও তার ভয়েস আমরা শুনতে পাই না, যেমন শুনতে পাই না ফোয়ারার ভয়েস। কিছুটা আঁচ করি, যে ময়ুরী সিনেমার পাশে দেশি মদের দোকানের উল্টো ফুটের গলিতে যে ফোয়ারা থাকে, সে ঝাঁজালো পানীয় খেতে ভালোবাসে, সে ভিমটো খেতে চায়, ভিমটোয় গ্যাস বেশি ঝাঁজ বেশি। ফোয়ারার লাভারও ঝাঁজালো টাইপের লোক, গুন্ডা মাস্তান। ও, হ্যাঁ ফোয়ারার এই যে মিস্ট্রি ডিজিজ, এই নিয়েও কিছু বলার আছে। অ্যামেরিকান জাহাজিরা এলো, তারা সাদা এবং কালো, তারা ফোয়ারার খদ্দের। আমরা ধরেই নিলাম যে মারণরোগ ফোয়ারার হয়েছে তা অ্যামেরিকান সেইলরদের থেকেই এসেছে। তারপরে অ্যামেরিকান ডাক্তার এল, ফোয়ারার ব্লাড স্যাম্পল অ্যামেরিকায় চলল ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য। পাঠক হিসেবে মনে হয়, লেখকের খানিকটা বায়াস অ্যামেরিকার প্রতি। 

    মেয়ে পাঠক হিসেবে দেখলাম ফোয়ারা কাঁদছে মৃত্যুভয়ে, আবার হাসপাতাল থেকে ফিরবার সময় রাস্তায় অল্প হেসেওছে, তার ঘোর ঘোর লাগছে। ফোয়ারা মিঠুনের ফ্যান, ভিমটো খেতে ভালবাসে। ব্যস, এইটুকুই। ফোয়ারা নিজে কতটা কী চায়, সেসব নেই। সবটাই তার লাভারের ন্যারেটিভ। 

    "ফোয়ারার সেই মানুষজন" ও আরেকটা লাভ স্টোরি। গোটা গল্পে ফোয়ারা থাকে ব্যাকগ্রাউন্ডে। পুরো গল্পটাই তার জন্য। তবু তার কথা আমরা শুনতে পাই না। যেমনি শুনতে পাইনা "বেঁটে"র মরা যাওয়া বউ কি বোবা মেয়ের কথা। লাভস্টোরি সে সব ঠিক আছে, জান লড়িয়ে দিয়ে ভালবেসে যাচ্ছে ফোয়ারার লাভার। কেবল মেয়েরা কথা বলে না।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ০২ আগস্ট ২০১৬ | ৯১৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • pangash | 233.191.26.216 (*) | ০৫ আগস্ট ২০১৬ ০৫:১২81247
  • কথা বলে না, আমাদের সে কথা শোনবার মতো হৃদয়বত্তা নেই সেব্যাপারে ধন্দ বাড়লো এই সংকলনটা পড়ে।
  • দিব্যকুসুম | 24.139.217.137 (*) | ০৫ আগস্ট ২০১৬ ০৫:৫৮81246
  • সম্ভবত গোটা ইস্যুটার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ এই লেখা-ক'টি।সুতনয়া এবং যোষিতা বিশেষ করে আমার অভিবাদন নেবেন,সুচেতনার লেখাটিও প্রাসঙ্গিক, কিন্তু এখানে আমার আগ্রহ একটু টপিক্যাল। বাঙ্গালী বামপন্থীর একটা আর্কিটাইপ নারীবিদ্বেষ এবং লিঙ্গবৈষম্য, লালের গাঢ়ত্ব নির্বেশেষে সেটা ফুটে ওঠে। নবারুণ-ও আপাদমস্তক তাই-ই, এবং মৃত্যুর আগে ওনার ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তাবৃদ্ধি'র পেছনে এই 'রিলেটেবিলিটি' কিছুটা কাজ তো করে-ই। মেয়েদের 'এজেন্সি' অনুপস্থিত, নারী-অস্তিত্ব মানেই হেটেরোসেক্সুয়াল ক্যান্টাসি, হয়রানি=হাস্যরস-- প্রতিটা সমস্যা দৃষ্টি আকর্ষণ করে, বা করে না, এবং না করার মধ্য দিয়ে আমরা নিজেদের 'পুরুষ' প্রতিপন্ন করি। এ কথা বলা সম্ভব শুধু 'নারী' হলেই-- এই উপপাদ্যটি যোষিতা চ্যালেঞ্জ করেছেন দেখলাম। সঠিক। অসাম্যের লিঙ্গ-পরিচিতি আছে অবশ্যই, কিন্তু প্রতিবাদীর নেই, বা থাকা উচিত নয়।

    একটা দায়স্বীকার করে কথা শেষ করবো। আমার স্নাতকোত্তর গবেষণা নবারুণের ওপ্র। প্রচুর প্রশংসা করেছিলাম, 'রিহ্যাবিলিটেট' করেছিলাম তার-ও বেশি, এবং লিঙ্গ-প্রসঙ্গ একবারও তুলিনি। এখন খুব অনুতাপ হয়, এবং কাজটার 'পিতৃত্ব' অস্বীকার করতে পারলে খুশি হই। আপনারা পেরেছেন। আরো বেশি লিখলে ভালো হতো।
  • ranjan roy | 24.97.140.92 (*) | ০৫ আগস্ট ২০১৬ ০৬:০৩81248
  • হয়ত এখানে প্রাসঙ্গিক নয়; কিন্তু আমার মনে হয়েছে অন্য সব ধর্মের মত ক্ল্যাসিক্যাল মার্কসবাদেও নারীবৈষম্যের একটা চোরাস্রোত রয়েছে-- ঠিক ইউরোসেন্ট্রিক মডেলের মতই।
    নারীমুক্তি?
    সে তো ঠাকুরও বিনোদিনীকে বলেছেন-- মা তোর চৈতন্য হোক।
    অর্থাৎ ধর্মে ও বামপন্থায় নারীর মুক্তিও পুরুষের নির্ধারিত মূল্যবোধের মাপদন্ডে। নাস্তিক বৌদ্ধধর্মও ব্যতিক্রম নয়। আম্রপালীরা বৌদ্ধসংঘে ব্যতিক্রম মাত্র।
    নারীর প্রশ্নে নবারুণের লেখাও বামপন্থার নিহিত প্যাট্রিয়ার্কির ছাঁচ থেকে বেরোতে পারেনি মনে হয়, চেষ্টাও চোখে পড়েনি। এটা ঠিক নবারুণের অভীষ্ট ছিল না।
  • উৎসুক | 15.254.97.68 (*) | ০৭ আগস্ট ২০১৬ ০৫:৫৪81249
  • সুতনয়া এবং বিশেষ করে দিব্যকুসুমের বক্তব্যে খুবই একমত হলাম। আসল কথা সুতনয়া যা লিখেছেন সেটি একেবারে ঠিকমত অনুধাবন ক্ষমতা সম্ভবত আমার নেই। থাকা সম্ভব নয়। দিব্যকুসুম জায়গামত হাত দিয়েছেন।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে প্রতিক্রিয়া দিন