সংবিধানের ৩৭০ ধারা তুলে দেবার পর, যখন দাবী করা হচ্ছে "এক দেশ এক আইন", ঠিক তখনই আসামের এন-আর-সি-তাড়িত মানুষজন দেশের মধ্যে নিজের নাগরিকত্ব প্রমাণ করার জন্য এক অদ্ভুত অবস্থার মধ্যে দিয়ে চলছেন। সারা দেশের আইন তাঁদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। বন্যাপীড়িত আসামের বাংলাভাষীদের উপর নিজের নাগরিকত্ব পুনঃপ্রমাণের যে চাপ, তাতে তাঁরা মানসিক ভারসাম্য হারাচ্ছেন, হারিয়ে যাচ্ছেন, আত্মহত্যা করছেন, সরাসরি আহত হচ্ছেন, মারা যাচ্ছেন। বন্যা হোক, বা ঘরদোর ভেসে যাক, কোনো ছাড় নেই। কারণ, বাকি দেশের আইন তাঁদের উপর প্রযোজ্য নয়। কোনো এক আসাম চুক্তি, সরকারি এবং আইনী সিদ্ধান্তের ফলে তাঁদের নতুন করে প্রমাণ করতে হচ্ছে নিজের নাগরিকত্ব, যা গোটা দেশে কাউকে কখনও করতে হয়নি।
আসামের বাসিন্দা আব্দুল কালাম আজাদ তাঁর ফেসবুকের একটি লেখায় জানাচ্ছেন, নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য যাওয়া গাড়িগুলি দিনে অন্তত একটি করে দুর্ঘটনার মুখে পড়ছে। বিগত চার দিনে অন্তত চার জন মারা গেছেন এবং শতাধিকজন গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন। এ শুধু ঘটনাচক্রে হয়ে গেছে এমন না, আজাদ লিখেছেন, যাতায়াত এবং পরিবহনের ব্যবস্থাটিই এরকম অমানবিক, যে, শুধু শুনানিতে হাজির হতে গেলেই কিছু দুর্ঘটনা, কিছু মানুষের বেঘোরে মৃত্যু এবং আরও অজস্র ক্ষয়ক্ষতি অনিবার্য। পুরো পরিকল্পনাটিই এইভাবে তৈরি।
এই পুরো পদ্ধতিটিই চলছে অমানবিক এবং আধা-বেআইনী ভাবে। সর্বোচ্চ আদালত খুব স্পষ্ট করে বলেছে, যাঁরা ইতিমধ্যেই নাগরিকত্বের প্রমাণ দিয়েছেন, তাঁদের পুনঃপ্রমাণের নামে আবার হেনস্থা না করতে, শুনানির নামে বহু দূরে টেনে না নিয়ে যেতে। প্রয়োজনীয় শুনানির ক্ষেত্রেও অন্তত ১৫ দিনের অগ্রিম নোটিস দেওয়ার কথা। কিন্তু এসব কিছুরই ধার না ধেরে, গ্রামের বিরাট সংখ্যক লোককে দিনের-দিনই শুনানিতে হাজিরা দিতে ডাকা হচ্ছে। মানুষগুলি ইতিমধ্যেই বন্যাদুর্গত। শুনানির জায়গাও ৪০০ বা ৬০০ কিলোমিটার দূরে। সেখানে হাজির মতে হবে ২৪ ঘন্টার বা আরও কম সময়ের মধ্যে। পুরো পদ্ধতিটিই এমন, যাতে করে সাধারণ গণপরিবহন ব্যবহার অসম্ভব। তাই জোগাড় করতে হচ্ছে অন্য কোনো গাড়ি। গ্রামেগঞ্জে এত অল্প সময়ে গাড়িও খুব প্রতুল এমন নয়। তার ভাড়া উঠছে ১০ থেকে ৫০ হাজার টাকা অবধি। সেই গাড়িতে গাদাগাদি করে উঠছেন মানুষজন। ড্রাইভার তারপর বিদ্যুৎগতিতে গাড়ি ছুটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে গন্তব্যে। সেখানে না যাবার কোনো উপায় নেই। কারণ, শুনানিতে হাজির না হলে মাথার উপর ঝুলছে নাগরিকত্বের তালিকা থেকে চিরতরে বাদ যাবার খাঁড়া। আর এইভাবে যাতায়াত করলে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটতে বাধ্য। যা অবধারিত, তাইই হচ্ছে, ঘটছে দুর্ঘটনা। পুরো ব্যবস্থাটিই এমন, যাতে ক্ষয়ক্ষতি, মৃত্যু বা আঘাত থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই।
আজাদ তাঁর লেখায় নিজের দেখা একটি উদাহরণ দিয়েছেন। রাত একটায় খানাপাড়ায় দেখা গেল একটি অটো ভ্যান। তাতে গরুছাগলের মতো গাদাগাদি করে আছে মানুষজন। বাচ্চা, বুড়ো, মহিলা, শিশু। সকাল নটার মধ্যে তাদের পৌঁছতে হবে শিবসাগরে। দূরত্বের হিসেবে যা সাড়ে তিনশো কিলোমিটার। রাস্তা দিয়ে দ্রুতগতিতে ছুটবে এই গাড়ি, সেই কড়ারেই ভাড়া হয়েছে। ফলে রাস্তার ডিভাইডারে বা রাস্তার ধারের গাছে ধাক্কা মারার সম্ভাবনা যে প্রচুর, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
এই পদ্ধতিতেই চলছে নতুন আসামের নাগরিকত্ব তালিকার প্রস্তুতি। বন্যায় বাড়ি-ঘর ভেসে গেলেও লোকে কোনোক্রমে বাঁচাচ্ছেন নাগরিকত্বের প্রমাণ, কোনো এক কাগজের টুকরো। তারপর কোনো একদিন হঠাৎ ডাক পেয়ে ভাড়া করা ম্যটাডোরে গাদাগাদি করে দৌড়চ্ছেন বহুদূরের কোনো এক কেন্দ্রে অগ্নিপরীক্ষা দিতে। রাস্তায় দুর্ঘটনা ঘটছে। মাথার উপর ঝুলছে অনাগরিক হিসেবে চিহ্নিত হবার খাঁড়া। ভারতবর্ষের মধ্যে একটি রাজ্যে, কেবলমাত্র একটি রাজ্যেই নাগরিকত্বের এরকম পরীক্ষা দিতে হচ্ছে মানুষকে। মূলত একটি বিশেষ ভাষাভাষী মানুষকে। আর অন্যদিকে ৩৭০ ধারার অবলোপ ঘটিয়ে চলছে "এক দেশ এক আইন" এর জয়ধ্বনি।