এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • একটা অ-সমাপ্ত গল্প (পর্ব: ২২-২৪)

    Kaushik Ghosh লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ০৪ জানুয়ারি ২০১৪ | ১৫৭৪ বার পঠিত
  • ২২।

    শীতের দিনে সন্ধ্যেটা নামে বড় তাড়াতাড়ি; বিকেল আর সন্ধ্যের সন্ধিক্ষণের যে রঙটা - তা উপভোগ করবার সময়টুকু না দিয়েই। শুরু হয়েই যেন শেষ হয়ে যায়। একটু বেখেয়াল হলেই সেদিনের মতন উধাও হয় সেই রঙ। আবার প্রতীক্ষা আগামী দিনের জন্য।

    আজকে সেই রঙটা দেখা হল না সুবোধের। স্কুলের পর কয়েকজন ছাত্রকে নিয়ে বসেছিলেন পড়া দেখিয়ে দেওয়ার জন্য। এদের বাড়িতে পড়া বলে দেওয়ার মতন কেউ নেই। প্রাইভেট টুইশানির কথা তো স্বপ্নেও ভাবতে পারেনা এরা। অথচ এদের ইচ্ছে আছে। লেখাপড়ার প্রতি শ্রদ্ধা আছে। নিজে শিক্ষক হয়ে যদি এদের সাহায্য না করেন তো শিক্ষকতার সার্থকতা কোথায়?

    পড়াতে পড়াতে সম্বিৎ ফিরেছিল যখন বইয়ের লেখাগুলো ভালো করে দেখা যাচ্ছিল না। স্কুল বাড়িটার বাইরে কখন যে পায়ে পায়ে সন্ধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে, বুঝতে পারেননি। ছেলেদের আজকের মতন ছুটি দিয়ে সাইকেলটায় চেপে বসেছিলেন। নবদ্বীপের সংলগ্ন এই বাবলারি গ্রামে এখনও বিদ্যুৎ এসে পৌঁছোয়নি। রাস্তাঘাটও কাঁচা। এবড়ো খেবড়ো রাস্তাটা দিয়ে সাইকেল চালাতে হয় সাবধানে। রাস্তাটার একদিকে শুধুই ধুধুয়াড়ি। অন্যদিকটায় দেড়মানুষ উঁচু মাটির টিলা। সমান্তরাল ভাবে চলেছে রাস্তাটার সাথে সাথেই। তাই দৃষ্টি ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে বারে বারে ওই ধুধুয়াড়ির দিকেই। টিলাটার ওপর দিয়ে চলে গেছে রেললাইন। সেই আজিমগঞ্জ পর্যন্ত।

    এখন কোনো ট্রেন নেই এই লাইনে; ঘন্টা দেড়েক আগেই চলে গেছে কলকাতা থেকে আসা শেষ ট্রেনটা। থাকলে ভালো হত,অন্ধকার রাস্তায় একলা একলা বড় গা ছম ছম করে সুবোধের। অন্ধকারে মানুষ বড় একলা; নিজের ছায়াও সাথে থাকেনা সে সময়। কিন্তু পুরোপুরি একা হওয়া যায় কি? যুগযুগান্ত ধরে যে অতৃপ্ত আত্মারা ঘুরে বেড়াচ্ছে এই পৃথিবীরই বুকে,তারা কি অলক্ষ্যে লক্ষ্য করে চলে না জীবিত মানুষকে এই সময় গুলোতে? এই সময় গুলোতেই তো তারা বলতে চায় তাদের না বলে যাওয়া কথা গুলো পৃথিবীর মানুষকে!

    এই যেমন এখন। নিজের দ্রুত হয়ে যাওয়া নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কিছু কানে আসছেনা সুবোধের। দুরগত কোন বাড়ির সন্ধ্যা প্রদীপের মিটিমিটি ছাড়া আর কিছু চোখেও পরছে না। এরকম নির্জনতারই কি অপেক্ষায় থাকেন না তাঁরা? ভাবনাটা মাথায় আসার সাথে সাথেই শীতবোধটা তীব্রতর হল। এক মূহুর্তের জন্য সাইকেলটা থেমেও গেল নির্জন মেঠো পথে। পর মূহুর্তেই সর্ব শক্তি প্রয়োগ করলেন প্যাডেলটার ওপর। নবদ্বীপের সীমানার ভেতরে ঢুকতে হলে আরো কিছু দূর যেতে হবে এখনো। বিদ্যুতের আলোয় মনের মধ্যে এ জাতীয় ভাবনা লালিত হওয়ার সুযোগ পায়না। ওঁনারাও বোধহয় বিদ্যুতের আলোকে এড়িয়েই চলতে চান! বড় সোচ্চার, বড় কৃত্তিম ওই আলো।

    এ সব কথা অন্যকে বলে লাভ নেই। তর্ক করেও লাভ নেই। ওদেশে থাকা কালীন কাছাড়ি বাড়ির ছাদে নিজের চোখে মামদো দেখেছেন সুবোধ। অন্য লোকে তাই কি বিশ্বাস করল আর কি করল না , তাতে কিছু আসে যায় না।
    সুবোধদের জমিতে ভাগ চাষি ছিল দাউদ মিঞা। দু-দিনের জ্বরে মারা গেছিল মানুষটা। তা সেই দাউদকেই দেখেছিলেন সুবোধ। মারা যাওয়ার তিন দিন পর কাছারি বাড়ির ছাদে পায়চারি করছিল দাউদ। পায়চারি করতে করতে বলছে - গা খান যে পুইড়া যায় গো আল্লা! কেউ একটু পানি দেবে গো!
    মামদো ছাড়াও কানাওয়ালাকেও খুব ভয় সুবোধের। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হয়নি কখনও, কিন্তু সে ধরলে আর নিস্তার নেই মানুষের! গ্রামের ধূ-ধূ প্রান্তরে একলা পথিক কে কিছুতেই গন্তব্যে পৌঁছতে দেয়না কানাওয়ালা। রাতের আঁধারে একই রাস্তায় তাকে ঘুরিয়ে মারে বার বার।

    প্যাডেলে আরো জোরে চাপ দিলেন সুবোধ। কঠিন মাটির ওপরে টালমাটাল হয়ে উঠল সাইকেলটা। শক্ত হাতে হ্যান্ডেলটা ধরে নিয়ন্ত্রনে রাখতে চাইছেন সাইকেলটাকে। নাকি নিজের স্নায়ু গুলোকে?
    প্রায় নিকষ রাস্তাটার সামনে হঠাৎ সাদা মতন একটা চারপেয়ে জন্তু দেখতে পেলেন। একটা বাছুর। বাছুরটা সাইকেলের প্রায় গজ বিশেক আগে হেলে দুলে চলেছে। সাইকেলের গতি কমালেন সুবোধ। সরু রাস্তা। অসাবধান হলে পাশের ঝোপ ঝাড়ে পড়ে যাওয়াও কিছু অস্বাভাবিক নয়।বাছুরটাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া যায় কিনা চিন্তা করতে করতেই সারা শরীরে কাঁপুনি দিয়ে উঠল। অন্ধকারে বাছুরটাকে ভালো করে লক্ষ্য করা হয়নি। বাছুরটার সাথে এখন সাইকেলটার তফাৎ হাত দশেকের আর তাই দেখতে পেলেন - বাছুরটা স্কন্ধ কাটা! স্কন্ধ কাটা মানুষ ভূতের গল্প অনেক শুনেছেন সুবোধ, কিন্তু বাছুর ভূত দেখাও যে এ জীবনে লেখা ছিল তা ভাবেননি কখনও। ব্রেক কষে সাইকেলটাকে থামালেন সুবোধ। গায়ত্রী মন্ত্র জপতে জপতে এক পা এক পা এগোতে লাগলেন বাছুরটার পিছু পিছু। ভয় পেলে পেছন ঘুরে তাকাতে নেই - ছোটবেলায় শুনেছিলেন। এগিয়ে চলেছে বাছুরটা। পেছনে সাইকেল হাঁটিয়ে অর্ধচেতন একটা মানুষ চলেছে ভূতগ্রস্থের মতন; এক পা এক পা করে।

    মিনিট পাঁচেক এভাবে চলার পর রাস্তার ধারের বাতি স্তম্ভ গুলো দেখতে পেলেন। চার পাশের গ্রাম মুছে গিয়ে ধিরে ধিরে ফুটে উঠছে মফঃস্বলের দৃশ্যপট। সামনে চেয়ে বাছুরটাকে আর দেখা গেল না। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাড়ির দিকে জোরে চালিয়ে দিলেন সাইকেলটাকে।

    বাড়িতে ঢুকে কোনক্রমে অবসন্ন দেহটাকে টেনে নিয়ে গেলেন বিছানা অবধি। রোজকার মতন ছবি জলের গেলাস হাতে ঘরে ঢুকলে পর বললেন - পাখাটা একটু চালায়ে দাও। অন্যদিন হলে ছবি ওঁনার মুখ দেখলেই বুঝতে পারতেন কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে; নইলে এই শীতে কর্তা পাখাই বা চালাতে বলবেন কেন আর কেনই বা ওনার পাঞ্জাবিটা ঘামে ভীজে সপসপে হয়ে রয়েছে। কিন্তু আজকের দিনটা একটু অন্যরকমের। বিকেলের ট্রেনে খোকন ফিরেছে; সঙ্গে সরকারি চাকরি। খবরটা ছেলেকে দিয়েই দেওয়াবেন বলে পাখাটা চালিয়ে ঘর থেকে চলে গেলেন ছবি; জলের গেলাসটা কর্তার হাতে না দিয়েই।

    মূহুর্ত খানেকের মধ্যেই খোকন এসে ঘরে ঢুকল। বাবাকে প্রণাম করে সুখবরটা দিল। নিমেষের মধ্যে সুবোধ ভুলে গেলেন মনের ভেতরে বয়ে চলা এতক্ষণের চাপা ঝড়টাকে। ছেলের মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন। তারপর বুক পকেট থেকে কলমটা বের করে দিলেন ছেলের হাতে। দেওয়ার মতন অন্য কিছু আর নেই এই মূহুর্তে ওঁনার কাছে। পার্কার। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় রমেশ মজুমদার নিজে দিয়েছিলেন সুবোধ কে। সেদিন থেকে একদিনের জন্যও কলমটাকে কাছছাড়া করেননি। প্রায় তিরিশ বছরের সাথীর দুরে যাওয়ার অনুভূতিটা দানা বাঁধতে পারলনা মনের ভেতরের বাঁধ ভাঙ্গা খুশিতে। ঈশ্বর করুণাময়! মনে মনে তাঁকে ধন্যবাদ জানাতে ভুললেন না সুবোধ। বড় আরাম লাগছে! কাঁধের থেকে আধ মনি জোয়ালটা কেউ যেন খুলে রেখে দিয়েছে এতদিন পর। সকলের ঘর থেকে চলে যাওয়ার অপেক্ষা করতে লাগলেন সুবোধ। অ-নেক দিন পর হঠাৎ খুব ঘুম পাচ্ছে আজ।

    অনেক দিন পর শান্তির ঘুম ঘুমবেন আজকে।

    ২৩।

    তাল লয় রাগ আলাপ - সব মিলেমিশে যেন বিশ্বনাথ'দার মুখটায় গিয়ে মিলেছে; গুরুজী কি বলছেন কানে ঢুকছে না শোভার। শোভাকে কিছু নির্দেশ দিয়ে গুরুজী ফিরেছেন বিশ্বনাথ'দার দিকে; গাইতে বললেন বিশ্বনাথ'দা কে। আলাপ শুরু করল বিশ্বনাথ'দা।

    ধীরে ধীরে গানের ভেতরে ঢুবে যাচ্ছে বিশ্বনাথ'দা, ডুবিয়ে দিচ্ছে শোভা কেও। গাইছে বিশ্বনাথ'দা আর আবাক বিস্ময়ে সমস্তটা চেটেপুটে নিচ্ছে ও। মন ভরে গান শুনছে শোভা - অথবা কিছুই শুনছে না যেন। ওর গান শিখতে আসা, বিশনাথ'দা, এই গান, গুরুজীর বর্ণময় উপস্থিতি - সব কিছু মিলেমিশে ওর বুকের ভেতরে একটা তালগোল পাকানো ঘূর্ণী তুলেছে। সেদিন বিশ্বনাথ'দা ওদের বাড়িতে গিয়ে গান শোনানোর পর থেকেই এমনটা হতে শুরু করেছে ওর মনের ভেতর। কাউকে কিছু বলে উঠতে পারেনি, কি বলবে? এ কথা তো কাউকে বলার নয়।
    শুধু অনেক সাহস সঞ্চয় করে মা কে গিয়ে বলেছিল যে ও গান শিখতে চায়।

    শোভা জানে ওদের যা আর্থিক সঙ্গতি,তাতে গান শিখতে চাওয়াটা বিলাসিতা প্রায়। যদিও এখন দাদা চাকরি পেয়েছে, মেজদিও বছর খানেকের মধ্যে বি।এ। পাশ করে যাবে - তবু মধ্যবিত্তেরই তো সংসার! বোঝে শোভা, সবই বোঝে। শুধু বোঝে না এই নতুন অনুভূতি কে, যা ওকে প্রতিদিন রাত্রে সবার অলক্ষ্যে কাঁদায়। এই দুঃখের মোড়কে সুখের নামই প্রেম হয়ত! নাকি সুখের মোড়কে দুঃখ?
    শোভা জানেনা।

    গান শেখার ইচ্ছের কথা শুনে মা কিছুক্ষণ ওর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। কিছুক্ষণই, কিন্তু শোভার মনে হচ্ছিল অনেকটা সময় পার হয়ে যাচ্ছে যেন মায়ের কাছ থেকে উত্তর পেতে। চুপ করে থাকা শেষ হলে পর মা বলেছিল - বিশ্বনাথের সাথে কথা বলে দেখি তাহলে। ওর গুরুর কাছেই না হয় নাড়া বাঁধিস।

    আনন্দে লাফিয়ে উঠতে যাচ্ছিল শোভা কিন্তু তার আগেই মায়ের একটা কথায় ধরা পরে যাওয়ার লজ্জায় আনন্দটা চাপা পড়ে গেল ওর। কতকটা যেন আপন মনেই বলেছিল মা, "কষ্ট পাবি, বড় কষ্ট পাবি তুই। ভালোবাসাতে বড় কষ্ট রে! ঈশ্বর তোকে শক্তি দিন সেই কষ্ট সহ্য করবার।"
    মায়েরা কি সবই বোঝে!

    বিশ্বনাথ'দা এখন যোগ রাগ গাইছে। শোভা সবে দু দিন হল গান শিখতে শুরু করেছে; পকড়, মিড়, সম - কিছুই বোঝেনা। গুরুজীর নির্দেশে গলা সাধার সাথে সাথে চলছে গান শোনার পালা। গুরুজী বলেন, না শুনলে গাইবে কি করে? আগে কান তৈরি করতে হবে, তারপর না হয় হবে গান!
    তবে কান তৈরির প্রক্রিয়ায় বুকের ভেতরে তুমুল ভাঙচুর চলছে শোভার - এই যেমন এখন।

    "সজন মোরে ঘর আয়ে....."। গুরুজী বলছেন, " বেটা বিশ্বনাথ, পা টা কখন লাগবে ওয়হ বাৎ সুননে ওয়ালোঁ কো পতা নহি চলনা চাহিয়ে। সবাই ভাববে এই লাগলো, এই লাগলো - তোমার কাজ হচ্ছে খেলানো। খেলিয়ে খেলিয়ে গাইতে হবে বেটা!"
    মুখ থেকে পানের রস পিক দানিতে ফেলে দিয়ে আবার বললেন - ভালো জিনিস কম কমই ভালো! পা ইঁয়াহা লগাও; লেকিন হর বখৎ নহি! ছু কর ভাগ যাও!

    আশ্চর্য মানুষ এই গুরুজী! থাকতেন বেনারসে, এখন এই মফঃস্বলে। হিন্দু, কিন্তু কথাতে উর্দূর প্রচ্ছন্ন প্রভাব। বড় অবাক লাগে শোভার! ওঁনার সম্পর্কে বিশ্বনাথ'দা কে একদিন সমস্ত জিজ্ঞেস করতে হবে। তবে "জিজ্ঞেস করতে হবে" - ওই পর্যন্তই! এত যে কইয়ে বলিয়ে মেয়ে শোভা, কিন্তু বিশ্বনাথ'দা কে দেখলেই মনের কথা মনেই রয়ে যায় ওর। এভাবেই চললেই হয়েছে! গোপন কথাটি আর কোনদিন বিশ্বনাথ'দা কে হয়ত জানানোই হয়ে উঠবে না! কিন্তু তাতেই বা কি আসে যায়! বিশ্বনাথ'দার জন্য ওর মনের গভীরে যে অনুভূতি - সে তার নাম যাই হোক আর নাই হোক - সেটা তো মিথ্যে নয়!

    আজকের মতন গানের ক্লাস শেষ হল। গুরুজীকে প্রণাম করে উঠে পরল সবাই। গুরুজীর বাড়ি থেকে বেড়িয়ে বিশ্বনাথ'দার দিকে একবার তাকাল শোভা। না, বিশ্বনাথ'দা ওর দিকে তাকাচ্ছে না। মুখ ঘুরিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দিল শোভা। দু পা যেতেই পেছন থেকে কাঙ্ক্ষিত গলাটা কানে এল - দাঁড়াও, সন্ধ্যে হয়ে গেছে। তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছি।
    অন্য কেউ এ কথা বললে শোভা বলত - ইল্লি রে! কে আমার এলেন বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার! যা যা, ঘর যা।
    কিন্তু বিশ্বনাথদার কথাটা শোনা মাত্র বুকের ভেতরে এমন মেঘ ডাকতে শুরু করল....!

    চুপচাপ পাশাপাশি হাঁটছে দুজনে। প্রয়োজনের চাইতে একটু বেশিই আস্তে হাঁটছে শোভা - পনের মিনিটের পথটাকে টেনে লম্বা করতে চাইছে আপ্রাণ। দুজনের কেউই কথা বলছে না। মনের ভেতরে তাই হাজারো কথা চিন্তা আর কল্পনা ভীড় করে আসছে শোভার। সেদিন দা-রুন আনন্দ হয়েছে শোভার! দাদা হঠাৎ করে এসে বলে চাঁপাদের বাড়িতে নিয়ে চল! প্রথমে কিছু বুঝতে পারেনি ও! তারপর দাদাকে অনেক চাপাচাপি করাতে জানতে পারল ব্যাপারটা।
    উফ্‌! চাঁপা যদি সত্যি সত্যিই ওদের বাড়িতে আসে বৌ হয়ে - খুব মজা হয় তাহলে! কিন্তু তার এখনও অনেক দেরি। চাঁপা আগে বি.এ. পাশ তো করুক অন্তত!

    নির্জন রাস্তায় কান পেতে প্রিয় পুরুষের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে চেষ্টা করল শোভা। শোনা গেল না; ওদের পায়ের শব্দে চাপা পড়েছে বোধহয়।

    বাড়ির সামনে এসে বিশ্বনাথ'দাই প্রথম কথা বলল - আমি আসছি, পরের দিন আবার গানের ক্লাসে দেখা হবে। কেমন?
    ঘাড় নাড়ল শোভা। অস্ফূটে কিছু একটা বললও হয়ত, কিন্তু নিজের কানেই তা দূর্বোদ্ধ ঠেকল যেন। বিশ্বনাথ'দা চলে যাচ্ছে। এক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকল শোভা।আর কটা মাত্র মূহুর্ত, তারপর আবার এক সপ্তাহের জন্য চাতকের অপেক্ষা।

    গলির বাঁকে সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরা অবয়বটা অদৃশ্য হলে পর পায়ে পায়ে বাড়ির দরজার দিকে এগোল শোভা। মাইকে নতুন হিন্দি সিনেমার গান বাজছে। সুনীল দত্তের নতুন সিনেমা - ওয়ক্ত। আগে ভী জানে না তু, পিছে ভী জানে না তু, জো ভী হ্যায় বস্‌ ইঁয়হী ইক পল ম্যায় হ্যায়....

    ২৪।

    রবিবার। ঈশ্বরের বিশ্রাম নেওয়ার দিন। ইংরেজদের থেকে অল্প কিছু ভালো যা নেওয়া গেছে, সপ্তাহান্তে এই ছুটির দিনের ধারনাটা তাদের মধ্যে অন্যতম। এই একটা দিনে আগামী কাজের দিনগুলোকে স্বাগত জানানোর প্রস্তুতি নিয়ে নেওয়া যায় পুরো দমে। প্রাত্যহিকের গতানুগতিকতার থেকে বিরাম নিয়ে মনকে ভরিয়ে তোলা যায় নতুন চিন্তা দিয়ে। কখনও বা জন্ম দেওয়া যায় নতুন দর্শনের। দিনটা তাই সুবোধের বড় প্রিয়!

    পাবনায় থাকতে রবিবার আর সোমবারের পার্থক্য যে কি, তা বোঝেননি কখনও। ঢাকায় পড়তে যাওয়ার পর সপ্তাহের এই বিশেষ দিনটার তাৎপর্য ও মাধুর্য ধরা দিয়েছে সুবোধের কাছে। তখন থেকেই দিনটা ওঁনার কাছে নিজের ভাবনা গুলোকে নিয়ে নাড়াচাড়া করবার।

    জগন্নাথ হল। যেন আর কোনো জন্মের কথা!
    ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রাবাস গুলোকে বলত হল। ওনাদের সময় ছিল মোটে তিনটে হল, এখন নিশ্চয়ই বেড়েছে তাদের সংখ্যা! তাদের মধ্যে নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠতম সুবোধদের জগন্নাথ হল। আজকে যে চিন্তনের তিনি অধিকারি, তার বীজটি নিঃসন্দেহে বপন হয়েছিল ওই জগন্নাথ হলেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনোর বাইরে অধীত বহু বিষয়ের ধাত্রী গৃহ ওই ছাত্রাবাসটি। ছাপার অক্ষরের বাইরে বেড়িয়ে ভাবার শিক্ষা পেয়েছিলেন ওখানে থাকতে থাকতেই। ওখানেই প্রথম আলাপ রমেশ বাবুর সাথে। রমেশচন্দ্র মজুমদার - বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানিন্তন উপাচার্য। ইতিহাসবিদ রুপে ওনার নাম অবশ্য তার আগেই খ্যাত হয়ে গেছে।

    কোনো একটা ছুটির দিনে এসেছিলেন জগন্নাথ হলে; উদ্দেশ্য ছাত্রদের সাথে আলাপচারিতা। সুবোধের বিষয় যদিও ইংরাজি, তবু মানুষটার সম্পর্কে কৌতুহল ছিল বরাবরই। সকলের সাথে অনেকক্ষণ গল্প করেছিলেন সেদিন হাসিখুশি বছর পঞ্চাশের মানুষটা। ভারতের ঔপনিবেশিক অতীত তার ভবিষ্যতের ওপর কি প্রভাব ফেলবে - এই নিয়ে বেশ একটা তর্ক লাগিয়ে দিয়েছিলেন ছেলেদের মধ্যে। মাঝে মাঝে ফুট কাটছিলেন ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে যারা, তাদের হয়ে।
    সুবোধের মত ছিল বিপরীত । ঔপনিবেশিকতার গরলের সাথে সাথে কোনো অমৃত ওঠেনি - এমনটা মানতে তিনি নারাজ ছিলেন। রমেশবাবু যাওয়ার সময় সুবোধকে দিয়ে গেছিলেন পার্কারের কলমটা। অনেকদিনের সাথী ছিল কলমটা! আজ ওটা খোকোনের পকেটে শোভা পায়।

    সুবোধ জিজ্ঞেস করেছিলেন - আমাকে কেন স্যর?
    -আরে বুঝলা না?তুমিও মজুমদার আর আমিও মজুমদার! রাখো, রাখো!

    স্মৃতিচারনায় ছেদ পড়ল। ছবি ঘরে ঢুকলেন।

    - তোমার সাথে একটু কথা ছিল।
    - কও।
    - খোকনের তো এখন চাকরি হয়েছে, লিপির বিয়ের কথাটা তো এবার ভাবতে হবে!
    - তুমি আমারে কি ভাবো কও দেহি! আরে, ভটচায ঘটকরে আমি আগেই কয়া দিসি পাত্র দেখনের জন্যে।

    শেষের কথাটাতেও ছবিকে যথেষ্ঠ আশ্বস্ত দেখালো না।
    তা কবেই বা পেরেছেন উনি ছবিকে বুঝতে। এতগুলো বছর কেটে গেল, ছবি আজও রয়ে গেল অচেনাই। সুবোধ বোঝেন, ওঁনার আর ছবির বড় হয়ে ওঠার মধ্যে একটা ফারাক আছে, একটা অনতিক্রম্য ফারাক। ফারাকটা বিত্তের নয়, মানসিকতার। কলকাতার সাহেবিয়ানা থেকে উঠিয়ে ছবিকে সকলে স্থিতু করেছিল শালগেড়িয়া নামক এক জনপদের তথাকথিত গ্রাম্যতায়। সেই সকলের মধ্যে তিনি নিজেও যে একজন, তা নিজের কাছে কোনদিন অস্বীকার করেননি সুবোধ।

    তবে সাথে সাথে এও জানেন যে শুধু মাত্র অবস্থার পরিবর্তন ছবির মতন একজন পরিনত মনস্ক মানুষের চিরস্থায়ী বিষাদের কারন হতে পারেনা; এর শিকড় আরো গভীরে কোথাও যেখানে পৌঁছনর আশা আর রাখেন না সুবোধ!

    আজও ভাবলে অবাক লাগে। কোনো সম্ভাবনাই ছিলনা সুবোধের সাথে ছবির দেখা হওয়ার। একবার বঙ্গীয় ভূস্বামীদের সমিতি র মিটিঙ হল কলকাতায়। ছোটোকাকার শরীরটা ভালো ছিলোনা বলে সুবোধকেই আসতে হয়েছিল ওঁনার প্রতিনিধি রুপে। টাউন হলের সামনে একটা বেপরোয়া বুয়াতি গাড়ি এসে ধাক্কা মারে দাঁড়িয়ে থাকা একটা অস্টিনে। মিটিঙের কথা ভুলে এক ছুটে পৌঁছে গেছিলেন সেখানে। জখম সওয়ারি কে নিয়ে দৌড়ে গেছিলেন হাসপাতালে। ওই সূত্রেই আলাপ হল ছবির বাবার সাথে; উনিও এসেছিলেন একই মিটিঙে অংশ গ্রহণ করতে। আহত অবস্থাতেও বারে বারে ক্ষমা প্রকাশ করছিলেন সুবোধের কাজের ক্ষতি হওয়ায়।

    ওই বুয়াতি গাড়িটার চালক যদি সেদিন একটু দেখে চালাত তা হলে হয়ত এ জীবনে ছবির সাথে দেখাই হত না!

    কথোপকথনের মাঝেই খোকন এসে দাঁড়াল ঘরের দড়জায়।
    কলকাতায় পোস্টিং। শনিবার রাতে বাড়ি আসে আর সোমবার ভোরের ট্রেন ধরে।

    একটু ইতস্ততঃ করে খোকন বলল, "মা একবার শুনবে!"
    - ও ঘরে যাও। তোমার বাবার সাথে কটা সেরে যাচ্ছি।

    দু-চার কথার পরে চলে গেল ছবি। অনেকদিন হ্যামলেট পড়া হয়নি। খাট থেকে নেমে বইয়ের তাক থেকে টানলেন কাঙ্ক্ষিত বইটা। টেবিলে এসে বসলেন সুবোধ। পাতা উল্টে চলে গেলেন হ্যামলেটের সাথে তার বাবার আত্মার কথোপোকথনের জায়গাটায়।

    ...but know, thou noble youth, The serpent that did sting thy Fathers life, Now wears his crown

    একটু পরেই ডুবে যাবেন বহুবার পড়া উপাখ্যানটির ভেতরে।

    চিন্তার সরণীতে আজ বারে বারে বাধা অসছে। এক ঝটকায় বইয়ের পাতা থেকে সরে গেল মনসংযোগ -
    খোকনের মুখটা অত থমথমে লাগছিল কেন?
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ০৪ জানুয়ারি ২০১৪ | ১৫৭৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • jhiki | 233.255.225.66 (*) | ০৯ জানুয়ারি ২০১৪ ০৫:৪৫74046
  • লেখাটা শেষ হয়ে গেলে পিডিএফ বানিয়ে বাড়ীতে শুয়ে শুয়ে পড়ব। এভাবে অফিসে বসে ফোনে পড়ার জন্য নয় লেখাটা। কৌশিক বাবু আপনি লিখতে থাকুন।
  • kiki | 69.93.245.16 (*) | ১১ জানুয়ারি ২০১৪ ০৮:০৮74047
  • ঝিকিকে লাইকিয়ে গেলাম।
  • Kaushik Ghosh | 190.215.165.126 (*) | ১২ জানুয়ারি ২০১৪ ০১:৫৪74048
  • অনেক ধন্যবাদ!
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি মতামত দিন