এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • মুক্তির জন্য সাংস্কৃতিক প্রয়াস

    Salil Biswas লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫ | ১৬৫৩ বার পঠিত
  • কিছুদিন আগে কয়েকটি ছেলেমেয়ে আমার কাছে জানতে চায়, প্রথা বহির্ভূত শিক্ষা নিয়ে পড়াশুনা করতে হলে কোন কোন বই দিয়ে শুরু করা উচিত। স্বভাবতই পাওলো ফ্রেইরি-র নাম মনে এসেছিল। ইতিপূর্বে ‘মুক্তির জন্য সাংস্কৃতিক প্রয়াস’ নাম দিয়ে পাহাড়ী চৌধুরি অনুবাদ করেছিলেন ‘কালচারাল অ্যাকশন ফর ফ্রিডম’। প্রকাশ করেছিলেন ‘ইন্ডিয়ান পাওলো ফ্রেইরি ইনস্টিটিউট’ যাদের আরো কিছু বই আছে ফ্রেইরি-কে নিয়ে। কিন্তু ‘মুক্তির জন্য সাংস্কৃতিক প্রয়াস’ বহুল প্রচার পায়নি।
    পরিতাপের বিষয়, পাওলো ফ্রেইরি-কে নিয়ে বিশ্লেষণ-মূলক কাজ এখানে বেশি হয়নি। তাঁর শিক্ষাতত্ত্বের প্রয়োগও খুব বিস্তারিত ও সংগঠিত ভাবে হয়নি। বিদ্যায়তনের অন্দরে বসে কেউ কিছু গবেষণা করেছেন কি না তা অবশ্য জানা নেই। কিন্তু পাওলোকে নিয়ে কোনো অর্থপূর্ণ কাজ করতে গেলে চার দেওয়ালের বাইরে তো আসতেই হবে। না হলে মূল ব্যাপারটাই থেকে যাবে অধরা। সমস্যা হল, প্রথাবহির্ভূত শিক্ষাও এদেশে প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে পড়ে, হয়ে পড়ে বিদ্যায়তনিক। ‘শিক্ষা ব্যবস্থা’ নামক জরদগবটিকে ভাঙ্গতে হলে, ফ্রেইরি-র শিক্ষাচিন্তা অধ্যয়ন করা তাই অত্যন্ত জরুরি। অবশ্যই এই তত্ত্বকে সর্বরোগহর দাওয়াই ভাবলে চলবে না, তাঁর পদ্ধতিকে প্রয়োজনে বদলে নিয়ে আমাদের মত করে নিতে হবে। তরুণতর প্রজন্ম আজ ফ্রেইরি-কে নিয়ে ভাবছেন।
    ১৯৬৭তে প্রকাশিত হয় পাওলোর প্রথম বই ‘এডুকেশন অ্যাজ দ্য প্র্যাকটিস অব ফ্রিডম’ এবং ১৯৬৮তে প্রকাশিত হয় তাঁর সব চাইতে বিখ্যাত বই ‘দ্য পেডাগজি অব দ্য অপ্রেসড’। পাওলো-র শিক্ষাচিন্তার মূল কথা হল – প্রতিটি মানুষ এক একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন সত্তা যিনি পৃথিবীকে পরিবর্তন করতে পারেন এবং নতুন করে গড়তে পারেন। মানুষের চেতনা রূপ পায় আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি আর তার নিজস্ব পারিপার্শ্বিকের প্রভাবে। বিশ্লেষণী চেতনা মানুষকে ভাবনা থেকে কাজে অগ্রসর হতে শেখায়। শোষকের আরোপিত নৈঃশব্দের সংস্কৃতি নিপীড়ন জারি রাখতে সাহায্য করে এবং মিথ্যা কিছু ভাবনার মধ্যে আটকে রাখে। সেই নৈঃশব্দ ভাঙতে পারে একমাত্র শিক্ষা। সেই দিক থেকে শিক্ষাদান একটি নাশকতামূলক কাজ। জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যই হল শিক্ষার্থীর (সেই সঙ্গে শিক্ষকেরও) চেতনায়নের মাধ্যমে বাস্তব জীবনে মুক্তি অর্জনের পথ করে নেওয়া। সমগ্র শিক্ষাপ্রক্রিয়াকে তাই ‘কনশিয়েনটাইজ’ (Conscientize) করতে হবে। শিক্ষার ‘হজমী’ বা ‘ব্যাংকিং’ তত্ত্বকে খারিজ করে কথোপকথন-বিনিময় (ডায়ালজিক বা Dialogic) পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীকে (শিক্ষাব্রতীকেও) রপ্ত করাতে হবে বিশ্লেষণী চেতনা দিয়ে তার বাস্তবকে চিনে নেওয়ার তরিখা। পারিপার্শ্বিকের প্রতিটি উপাদান ও অংশকে ‘সমস্যায়িত’ (Problematize) করে তার ‘সঙ্কেতভেদ’ (Codify / Decodify) করে জানতে হবে কোথায় কী লুকিয়ে আছে। আর এই চিনে নেওয়া মানেই হল বাস্তবকে পাল্টানোর দিকে এক পা এগোনো।
    ‘কনশিয়েনটাইজ’ শব্দটিকে একটি দীর্ঘ বিস্তারের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের দিকে এগোনোর পথের সঙ্গে তুলনা করে বোঝার চেষ্টা করা যেতে পারে। এক দিকে যদি থাকে জ্ঞানার্জন পদ্ধতির (শিক্ষার্থী ও শিক্ষাব্রতী উভয়ে মিলিত ভাবে) চেতনায়ন (Consciousness অর্থে) বা জ্ঞানকে চেতনায় নিহিত করার প্রচেষ্টার আরম্ভ ও জারি থাকা, তাহলে অন্য দিকে থাকতে পারে জ্ঞানার্জন পদ্ধতির বিবেকীকরণ (Conscience অর্থে), জ্ঞান ও উপলব্ধিকে বিবেক-এ প্রবিষ্ট করিয়ে নিজেকে ও বাস্তবকে বা বাহ্যিক জগতকে শোষণ ও নিপীড়নের হাত থেকে মুক্ত করার প্রয়াসে ব্রতী হওয়া। একে হয়ত বিবেক-নির্মাণও বলা যায়। প্রথম প্রান্ত থেকে দ্বিতীয় প্রান্তে আরোহণ একটি সচেতন, সক্রিয়, চলমান, মতাদর্শগত অগ্রসরতা, কোনোভাবেই তা বাইরে থেকে ‘চাপিয়ে’ বা ‘ভরে’ দেওয়া বা ‘আরোপিত’ নয়। এর মধ্যে কোনো তথাকথিত ‘নৈতিক’ চাপের ব্যাপার নেই, না আছে কোনো ‘পরিচালিত’ হওয়ার সম্ভাবনা। এথেকে তৈরি হয়ে উঠবে পরিস্থিতির সচেতন মূল্যায়ণ এবং তাকে পরিবর্তন করার তাগিদ সৃষ্টির প্রয়াস। পুরো প্রক্রিয়াটিকে ‘কনশিয়েনটাইজেশন’ বলা যেতে পারে। এনিয়ে বিস্তারিত আলোচনা ও ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে। ‘পেডাগজি’-তে ‘কনশিয়েনটাইজেশন’-এর ধারণাটি নিয়ে পাওলো যা লিখেছেন, তার আলোতে পাঠক ধারণাটিকে আয়ত্ব করতে পারবেন। তবে মনে রাখতে হবে, পাওলো-র চিন্তা কিন্তু পুরোটাই তত্ত্ব-কর্ম-সমন্বয় (Praxis) নির্ভর, যা কেবল বই পড়ে বোঝা যাবে না।
    অনেকে বলতে পারেন পাওলো ফ্রেইরি যেসব কথা বলেছেন, তার কোনোটাই সে অর্থে নতুন নয়। তাঁর ভাবনার মধ্যে মিশে আছে সক্রেটিস আর প্লেটো, কার্ল মার্ক্স, ক্যামিলো তোরেস আর চে গেভারা, হুসার্ল আর চোমস্কি প্রভৃতির ভাবনা, মিশে আছে ‘মুক্তির জন্য ধর্মতত্ত্ব’-র মনন। এই বহুধার মিশেলই হয়ত পাওলো-র চিন্তাকে অন্যতর শক্তি দিয়েছে। শিক্ষা-ছাত্র-শিক্ষক-জ্ঞানার্জন-মুক্তি সম্পর্কিত ভাবনার ও প্রয়োগকর্মের আজ অবধি বহতা স্রোতে যে এক অসামান্য মোড় পাওলো ফ্রেইরি তাঁর চিন্তা দিয়ে নিয়ে এসেছেন, সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
    পাওলো ফ্রেইরি মানুষকে দেখেন স্বাধীন চিন্তাশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব হিসেবে যিনি তাঁর পারিপার্শিককে ছাড়িয়ে উঠতে পারেন শুধু নয়, তাকে বদলে ফেলে নতুনতর দুনিয়া সৃষ্টি করতেও পারেন। অন্যান্য প্রাণী থেকে মানুষ আলাদা, কারণ যৌক্তিক চিন্তা ও সক্ষম প্রয়াস দ্বারা মানুষ তার দুনিয়ায় এগিয়ে চলতে পারে। চিন্তা মানুষকে জগত সম্পর্কে সচেতন করে বিভিন্ন স্তরের মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে। প্রথমে মানুষ বিনা প্রতিরোধে জগতের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেন কোনো অধিকতর ক্ষমতাশালী শক্তির আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী গতানুগতিকতার শিকার হয়ে। তখন তাঁরা তাঁদের জীবনে ঘটমান অবিচার প্রসঙ্গে কিছুই বলেন না। নীরব সেই সব মানুষ মাথা নিচু করে থাকেন বিনা প্রতিবাদে। এর পরের ধাপে মানুষ পারিপার্শ্বিকের সমস্যা সম্পর্কে সচেতন হন, কিন্তু সে সব সমস্যার কারণ যে বাইরের জগতে বিদ্যমান সেকথা তাঁরা ধরতে পারেন না। তাঁদের মনে হয় সমস্যাগুলি দেখা দিচ্ছে ঘটনাচক্রে। পরের ধাপ বা উচ্চতম পর্যায়ে দেখা দেয় একটি গুণগত পরিবর্তন। মানুষ বুঝতে পারেন যে তাঁদের সমস্যাগুলি বস্তুত সমাজের কাঠামোয় নিহিত। তাঁরা তখন সমাজের আর্থসামাজিক দ্বন্দ্বের সঙ্গে সমস্যাগুলির যোগসূত্র খুঁজে পান, বাস্তবের দিকে খোলা চোখে তাকান, এবং দ্বন্দ্বগুলির বাস্তবতাকে হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন। এই পর্যায়ে উপনীত হতে সাহায্য করবে পাওলো ফ্রেইরির শিক্ষা পদ্ধতি। বিস্তারিত পদক্ষেপগুলো বিভিন্ন জায়গায় পাওলো নিজে লিখেছেন এবং বিভিন্ন কথোপকথনে বিধৃত করেছেন।
    ফ্রেইরি তাঁর ভাবনা-চিন্তায় জগতের ব্যাখ্যা শ্রেণীবিশ্লেষণের মাধ্যমে না করে, করেন নিপীড়নের বিভিন্ন ধারা বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে। এই বিশ্লেষণ নানা ধরনের পরিস্থিতিতেই প্রয়োগ করা যেতে পারে। তাঁর বর্ণনায় কোনো বিশেষ দলের রাজনৈতিক চিন্তা প্রাধান্য পায় না। তাঁর চেতনা-উত্তরণের পদ্ধতি বলে যে প্রত্যেক মানুষকে নিজের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জগতের ধারণাকে নিজেই খুঁজে বার করতে হবে; তাই তাঁর কর্তৃত্ববাদ-বিরোধী ভাবনা নতুন কোনো সমাজ ব্যবস্থার একক কোনো চিত্র তুলেও ধরতে দেয় না। এই কারণে কট্টরপন্থী মার্ক্সবাদীরা অনেক ক্ষেত্রে তাঁর বিরোধিতা করেছেন। সমস্ত কিছু পার্টির নেতৃত্বে ঘটবে এই ধরণের যান্ত্রিক চিন্তা থেকে তাই অনেক সময় উদ্ভূত হয়েছে নিপীড়িতের শিক্ষাচিন্তার ভ্রান্ত ব্যাখ্যা। মনে রাখতে হবে, সাম্যবাদী ভাবনার মূল চিন্তনের সঙ্গে ফ্রেইরি-র চিন্তার কোনো বিরোধ তো নেই-ই, মূলত আছে সাযুজ্য।
    পাওলোর শিক্ষাচিন্তায় ‘নৈঃশব্দের সংস্কৃতি’ ধারণাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিপীড়ক তার শোষণভিত্তিক ‘সংস্কৃতি’, মূল্যবোধ আর আদর্শ দিয়ে নিপীড়িতকে এমন অভিভূত করে যে তাকে নীরবতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়তে হয়। এই নৈঃশব্দের সংস্কৃতিকে ভেঙে ফেলতে হবে, যা ভাঙ্গতে হলে চাই উচ্চতম পর্যায়ে চেতনার উত্তরণ। এই নৈঃশব্দের বিভিন্ন রূপ প্রতিনিয়ত আমাদের চোখে পড়ে, কিন্তু সে বিষয়ে সম্যক ধারণা আমাদের থাকে না। এই নৈঃশব্দে আচ্ছন্ন প্রান্তিক মানুষ হীনমন্যতায় ভুগতে ভুগতে এক সময় মাথা নীচু করে থাকতে অভ্যস্থ হয়ে পড়েন এবং মনন ও প্রয়োগের মধ্যে দিয়ে জীবন ও পারিপার্শ্বিককে বদলে ফেলার ক্ষমতার কথা বিস্মৃত হন। পাওলো এই নৈঃশব্দের বাহ্যিক প্রকাশ, কারণসমূহ এবং তত্ত্বগত সূত্রগুলিকে একত্রে উপস্থাপিত করেছেন। সব চাইতে বড় কথা, তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে এই নৈঃশব্দকে খণ্ডন করা যেতে পারে, কীভাবে ‘মূক’ মুখে ভাষা জোগানো যেতে পারে, অথবা, সাহায্য করা যেতে পারে উচ্চারণহীনতা থেকে সরব হয়ে উঠতে।
    ‘এই ধন কেহ নাহি নিতে পারে কেড়ে’, ‘বিদ্যারত্ন মহাধনম্’, ‘অনেক পড়েছে, কিন্তু হজম করতে পারেনি’, ‘জ্ঞানভাণ্ডার’, প্রভৃতি কথাগুলিকে একত্র করা যায় শিক্ষার ‘হজমী তত্ত্ব’-র আওতায়। এই তত্ত্বকে ভুলে যেতে হবে, ভুলে যেতে হবে শিক্ষার ‘ব্যাংকিং তত্ত্ব’কেও। মনে রাখতে হবে ব্যাংকে শিক্ষকের জ্ঞান জমা রাখার সেভিংস বা কারেন্ট অ্যাকাউন্ট নেই, যেখান থেকে তিনি অল্প অল্প জ্ঞান বিতরণ করবেন শিক্ষার্থীদের মধ্যে। মনে রাখতে হবে শিক্ষার্থীরা থলে নয় যাকে শিক্ষক ‘শিক্ষা’ নামক বস্তুসম্ভার দিয়ে ভরে দেবেন। শিক্ষার্থীরা এক একটি পাকস্থলীও নয় যা ‘শিক্ষা’ নামক খাদ্যদ্রব্য দিয়ে মাস্টার মশাই ঠেসে ভরে দেবেন। এইসব চিরাচরিত, সোজা কথায়, জনবিরোধী ধারণা নিপীড়কের হাতের ‘অ-নিগ্রহী’ বা ‘নন-কোয়ারসিভ’ (non-coercive) অস্ত্র ছাড়া কিছুই নয়। জ্ঞানার্জন কখনই এই ধরণের শিক্ষাভাবনার অঙ্গ হতে পারে না। কিন্তু আমাদের গোটা বিদ্যায়তন ব্যবস্থাই চলছে এই শিক্ষাভাবনার বশবর্তী হয়ে। স্বভাবতই শিক্ষার্থীরা হাঁ-ও করে না, হুঁ-ও করে না। আর আমরা হা হুতাশ করে চলি, এদেশে কেউ কিছু শিখছে না কেন।
    নৈঃশব্দের অবসান ঘটানোর প্রথম পদক্ষেপ হল চেতনার বিকাশ। সেই বিকাশের জন্য বিশ্লেষণী চেতনা দিয়ে বাস্তবকে চিনে নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। পারিপার্শ্বিকের প্রতিটি উপাদান ও অংশকে ‘সমস্যায়িত’ (Problematize) করতে হবে। ফ্রেইরি দেখিয়েছেন কেমন করে। দৈনন্দিন কোনো পরিস্থিতিকে, কোনো পরিচিত বস্তুকে, কোনো ঘটনাকে একটি ‘কোড’-এর (Code) আকার দিয়ে, সেই সঙ্কেত-এর পাঠোদ্ধার বা সঙ্কেত-ভেদ বা ‘ডিকোড’ (Decode) করতে হবে। এই প্রক্রিয়ায় কথোপকথনের মধ্য দিয়ে নতুন করে পারিপার্শ্বিককে জানার মাধ্যমে নতুন সমাজচেতনা, নতুন জাগরণ, নতুন দৃষ্টিভঙ্গী গড়ে উঠবে। এমন যে হতে পারে তা হাতেকলমে করে দেখিয়েছেন ফ্রেইরি। শিক্ষক – যাঁকে এই পরিসরে ‘শিক্ষাব্রতী’ বলাই অধিকতর সমীচীন হবে – সেখানে হবেন সহায়ক, ভাবনাটা তিনি শুধু ধরিয়ে দেবেন, জ্ঞানার্জনের বাকি প্রক্রিয়া থাকবে পুরোপুরি শিক্ষার্থীর মন ও বুদ্ধি সঞ্চালনে জড়িত। ব্যাপক কর্মকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে পাওলো এই তত্ত্বকে কাজে পরিণত করেছিলেন, যে কাজের অনুরণন আজও দেশেবিদেশে শিক্ষাব্রতীদের সশস্ত্র করে তোলে।
    এই কলকাতাতেই আমরা কয়েকজন মিলে এই পদ্ধতি বাস্তব প্রেক্ষাপটে প্রয়োগ করে অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে দেখেছিলাম কতটা সাফল্যের সঙ্গে জ্ঞানার্জনের পরিস্থিতির সৃষ্টি করা যায়। নানা কারণে আমাদের সেই প্রয়াস ব্যাহত হয়েছিল। কিন্তু সম্পূর্ণ ব্যর্থ যে হয়নি তার প্রমাণ পেয়েছিলাম বেশ কিছুদিন পরে এক ছাত্রের সঙ্গে দেখা হওয়ায়। ছেলেটির কথায় আর কাজের মধ্যে দেখেছিলাম, বিশ বছর পরেও সেই সময় তার মনে জেগে ওঠা ভাবনা অনেক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও হারিয়ে যায়নি।
    সম্প্রতি (সম্প্রতিই বলব ২০১৩র মার্চে শুরু হওয়া সত্ত্বেও) শ্রমজীবী হাসপাতালের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় শ্রমজীবী বিদ্যালয়। সেখানে ফ্রেইরি-র পদ্ধতি প্রয়োগ করার সুযোগ আমরা পেয়েছি। শিক্ষার্থীরা আসছে বেশির ভাগ শ্রমজীবী গ্রামীণ পরিবার থেকে। সাফল্য অসাফল্য সঠিক ভাবে বিচার করার সময় এখনও আসেনি, কিন্তু অভিমুখ বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না।
    ‘দ্য পেডাগজি অব দ্য অপ্রেসড্’ বই-তে পাওলো ফ্রেইরি তাঁর শিক্ষাচিন্তার প্রায় পূর্ণাঙ্গ দার্শনিক প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছেন, যদিও যত দিন গেছে সে চিন্তা বিকশিত হয়ে পূর্ণাঙ্গতর হয়েছে। সেই চিন্তা ও তার আরও প্রসার নিয়ে আলোচনা চলছেই। সে আলোচনা প্রাসঙ্গিক হলেও সে দিকে আমরা আপাতত যাবো না।
    পরবর্তী দিনে পাওলো লেখেন ‘দ্য পেডাগজি অব্ হোপঃ রিভিসিটিং ‘দ্য পেডাগজি অব দ্য অপ্রেসড্’’ (১৯৯২), এ বই জানায় কেমন করে কোন দিকে এগিয়েছে তাঁর চিন্তা আর কাজ। এই বই তে চিন্তা-মতাদর্শ-কর্মচিন্তা-বাস্তবতাকে ব্যবহার সব মিলে যে ঘনত্ব তা অনেকাংশে ‘দ্য পেডাগজি অব দ্য অপ্রেসড্’ থেকে সহজতর, যদিও চিন্তার প্রাণিত উড়াল ‘পেডাগজি’-র তুলনা মেলা ভার। ব্রাজিলের সমাজকে অনেকেই বলত (এখনো বলে) ‘সেসপুল’ – আবর্জনার কুণ্ড। সেই আবর্জনার জগতের উত্তরে লিখেছিলেন পাওলো। ‘দ্য পেডাগজি অব দ্য হোপ’।
    (ক্রমশ)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫ | ১৬৫৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • nahin | 113.244.13.34 (*) | ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৪:৪৯66125
  • খুব ভালো লাগলো পড়ে ধন্যবাদ লিংক টা দেবার জন্য আসলে আমরা তো পড়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছি । ধন্যবাদ আবার ও ।
  • pi | 24.139.209.3 (*) | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৭:২৪66126
  • পরের পর্বের অপেক্ষায়।

    'দৈনন্দিন কোনো পরিস্থিতিকে, কোনো পরিচিত বস্তুকে, কোনো ঘটনাকে একটি ‘কোড’-এর (Code) আকার দিয়ে, সেই সঙ্কেত-এর পাঠোদ্ধার বা সঙ্কেত-ভেদ বা ‘ডিকোড’ (Decode) করতে হবে।'.... এটা একটু উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যাবে ?
  • Salil | 126.203.133.39 (*) | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ১১:২৪66127
  • পরের পর্ব।
  • ranjan roy | 192.69.73.221 (*) | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ১১:৫৫66128
  • অনেক ধন্যবাদ সলিলবাবু।
    পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
    এদিকে দেখছি কেউ কেউ প্র্যাক্সিস এর কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে যত্র তত্র পেডাগজি অফ অপ্রেসড কোট করেন, নিজের বিদ্যে ফলানোর জন্যে।
    আপনি দাঁড়িয়ে আছেন এর বিপরীত মেরুতে; তাই বিশেষ আগ্রহ।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে মতামত দিন