এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • রবীন্দ্রে গদগদ নজরুলে থতমত

    Parthasarathi Giri লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ৩১ মে ২০১৮ | ১৫৫৬ বার পঠিত
  • রবীন্দ্রে গদগদ নজরুলে থতমত

    #

    প্রয়াত গায়ক ভুপেন হাজারিকার একটি গানের কথা খুব মনে পড়ে। না পড়লেও চলত, তবে মনে পড়ে। খুব সম্ভবত শিবদাস বন্দোপাধ্যায়ের লিরিক। 'সবার হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ চেতনাতে নজরুল'। এটা বাংলা আধুনিক গান হিসেবে শুনতে মধুর।

    রবীন্দ্রনাথকে অ্যাসেট বানিয়ে ফেলেছিল আমবাঙালি নিজের মানসিকতার স্বার্থে। রবীন্দ্রনাথের কেবল বহুমুখী প্রতিভা ছিল, আর সমসময়ে তেমন কারুর ছিল না, এই বিভ্রান্তিকর ভাবনা ছিল বাঙালির প্রতিষ্ঠান ভজনার চিরন্তন রীতি ও প্রীতি। রবীন্দ্রনাথ নিজে এ ব্যাপারে অত্যন্ত পরিশীলিতভাবে সজাগ ছিলেন।

    রবীন্দ্রনাথ নিজে নজরুলকে যথেষ্ট স্বীকৃতি দিলেও, রবীন্দ্রভক্তরা এতে বড়ভাইয়ের শ্লাঘা ভেবে যৎপরোনাস্তি আহ্লাদিত হতেন। মনে হয় এক্ষেত্রেও সুক্ষ ধর্মীয় সংখ্যাগুরুর তত্ত্ব কার্যকরী ছিল। একজন মুসলমান 'বল রে জবা বল' এমন আশ্চর্য কলি লিখছেন, অথচ পুজোআচ্চা করেন টরেন না, এটা একটি বিরল মহত্ত্ব, ব্যাস ওই অবধি। তারপর যথারীতি রবীন্দ্রের পূজা পর্যায়ের গান।

    নজরুল প্রতিষ্ঠানকে পরোয়া করেননি কোনোদিন। সুরকার হিসেবেও হিজ মাস্টার্স ভয়েস বা মেগাফোনের মতো রেকর্ড কোম্পানিকে কাউকে রেয়াত করেননি। ফলে এই মতো মানসিকতার দৃঢ় পুরুষ যে হালে পানি পাবেন না, এটা সরল বাঙালি সত্য। নজরুল একজন একলষেঁড়ে ব্যক্তিত্ব হয়ে রয়ে গেলেন। পরে বিদ্রোহী কবি হিসেবে দেগে দেওয়া হয়, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে করে কম্মে খাওয়া লোকজন এতে নিশ্চুপে সায় দিয়ে চলেন।

    নজরুল যেন আমাদের অনেক কাছের জন। রবীন্দ্রনাথ সেই কবে থেকে সদনের মাঠে একটি দূরের স্ট্যাচু, জাতীয়সংগীত রচয়িতা, আকন্ধপদতল লং কোট পরে দাঁড়িয়ে রইলেন। আমার খুব হাঁসফাঁস লাগে ঐ ভাস্কর্যটির দিকে তাকালে। এত তীব্র গরমের দেশে যেখানে তাঁর মাথার ওপর উপবিষ্ট বায়সের মুখ হাঁ হয়ে গেছে কাঠফাটা তেষ্টায়, আমরা উলঙ্গ হয়ে পথে হাঁটলে যেন স্বস্তি পাব, সেখানে বেদির ওপর অমন মোটা পোষাকঢাকা দীর্ঘকায় মূর্তি, নাঃ রবীন্দ্রনাথ আকাশের তারাই বটে। শো-কেস টোকেসে, সদনের নিভৃত শীতাতপে দারুণ উপভোগ্য।

    নজরুলের দুখু মিঞা, তাকে তো আমরা রাঙামাটির পথে পথে কত কত বার দেখেছি। নজরুল আমাদের গ্রীষ্মদিনের হাতপাখা। চতুরঙ্গের শচীশ-দামিনীর মতো জটিল গভীর মনোভূমির খেলা তিনি আমাদের দেননি বটে, সুপ্রভা সরকার দিয়েছেন, ফিরোজা বেগম দিয়েছেন। নজরুলের চোখ বন্ধ করা বাঁশি বাজানোর ছবিটি তাঁকে রবীন্দ্রনাথ হতে দেয়নি, কেননা গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না। বাঙালি গরমে নরম থাকে, নরমে বেপথু হয়। রবীন্দ্রনাথ এমন জবরদস্ত আমলা পরিবেষ্টিত একটি প্রতিষ্ঠান, ভয়ে সম্ভ্রমে গুটিকয় গান হাঁই হাঁই করে গেয়ে বাঙালি স্বাভিমানের ঝুটা সিম্বল বানিয়ে চোঁয়া ঢেঁকুর তোলে। এতেই তার প্রাণের আরাম।

    অনুপম রায়ের 'আমাকে আমার মতো থাকতে দাও' এবং রবীন্দ্রনাথের 'তুমি রবে নীরবে' বাঙালি এক পাতে সহজে চেটে খেতে চেয়েছে। সে যেমন দ্বিজেন্দ্রলাল-অতুলপ্রসাদ-রজনীকান্তকে শুনে এক পাশে সরিয়ে রেখেছে, তেমনি নজরুলকেও এক পাশে সরিয়ে রেখেছে সহজে পাওয়ার বাসনা থেকে এবং বহুল প্রচারিতের প্রতি ভক্তিতে। রবীন্দ্রনাথের গান একটা সময় বড্ড সহজলভ্য হয়ে গিয়েছিল। বরের বাড়ির লোক মেয়ে দেখতে এলে হারমোনিয়ামে হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে 'পুরানো সেই দিনের কথা' গাওয়াটা জাতীয় কর্তব্য পর্যায়ে গিয়েছিল। অথচ রবীন্দ্র সাহিত্যের প্রতি তেমন একটা নজর কোনোকালেই বাঙালির ছিল না। ব্যতিক্রম 'আজি এ প্রভাতে রবির কর...ইত্যাদি' গদগদ কণ্ঠে আবৃত্তি।

    একবার ভেবে দেখা যাক নজরুল সৃষ্ট উদাসী ভৈরব রাগাশ্রিত 'সতীহারা উদাসী ভৈরব কাঁদে' এই গানটিতে বক্রসুরের ব্যবহার। কীর্তন, বাউল লোকগীতি সমৃদ্ধ বাঙালির গানে এই পরীক্ষা নিরীক্ষার সুর অপরিচিত রয়ে গেল। বাঙালি রাত জেগে ডোভার লেন মিউজিক কনফারেন্স শুনবেই, কিন্তু কালোয়াতি গান গাইতে অনীহা। সহজ নয় যে! ওস্তাদ পণ্ডিত বিদুষী উপাধি বাঙালির ঝোলায় গুটিকয়।

    অথচ ভাবতে আরেক রকম অবাক লাগে বাংলা বেসিক ডিস্কের গান একটা সময় বাঙালির মর্মে পৌঁছে গিয়েছিল। "শাওন রাতে যদি" গানটিতে জগন্ময় মিত্রের সুরটিকে বেমালুম নজরুলগীতিতে ঢেলে দিয়ে উত্তমকুমারের লিপে শুনে শুনে কেঁদে কেটে একসা। বাঙালি সম্ভবত নজরুলে ভড়কি খেয়ে থতমত হয়ে গেছে, কীভাবে নিতে হত অমন আনপ্রেডিক্টেবল সত্তাকে। নজরুলগীতিকে ব্রাত্য করেছে তবু কলকাতা বেতার কেন্দ্রের 'রম্যগীতি' শুনেছে নিয়ম করে ভালোবেসে। অদ্ভুত দ্বিচারিতা বৈকি!

    রবীন্দ্রনাথ নিজের গানের পায়ে নিজ নিয়মের বেড়ি পরিয়ে দিয়ে গেছিলেন। একটি ঘরানার প্রেক্ষাপট নিপুণভাবে গড়ে গেছিলেন। নজরুল কেবল সুরকে ভালবেসে নিজের সৃষ্টিকে দশহাতে প্রহরীহীন করে রেখে গেছেন। গুণীজনে যে-গান সহস্রার, চালবাজের কণ্ঠে 'টুনির মা'। নজরুল কি বাঙালির নার্ভ পালস বুঝতেন না? অবশ্যই বুঝতেন। কিন্তু তিনি কার্বন পেপার রেখে চিঠি লিখতে শেখেননি। তিনি হয়ত ভেবে দেখেননি তাঁর সৃষ্টির কতখানি আর্কাইভাল ভ্যালু রয়েছে। 'খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে/ বিরাট শিশু আনমনে' আসলে এ তাঁর নিজেরই নির্ভেজাল স্বীকারোক্তি।

    যে যেভাবে জীবনকে দেখেন, কেউ ওপর থেকে কেউ শিশুসুলভ মিশে থেকে। যাঁরা গেছেন তাঁরা তো পাঁচভূতে বিলীন হয়ে গেছেন, আমরা পিছনে থেকে তাঁদের রেখে যাওয়া সৃষ্টি নিয়ে যদি ক্যাবলামি করি, তার দায় আমাদের, তাঁরা দায়ী নন।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ৩১ মে ২০১৮ | ১৫৫৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • R2h | 233.186.196.170 (*) | ০১ জুন ২০১৮ ০৩:৩০62488
  • উফ, আবার সেই রবীন্দ্র বনাম নজরুল।
    একটা বক্সিং ম্যাচ না হলে আমাদের ঠিক পোষায় না। ঃ)
  • Du | 182.56.7.146 (*) | ০১ জুন ২০১৮ ০৭:৪৭62489
  • বনাম লেখা পড়ে দুটৈ হাফ জানা যায় এইভাবে দেখো ঃ)
  • Indra | 57.15.81.211 (*) | ০১ জুন ২০১৮ ০৭:৫৩62486
  • নজরুল আর শরত্চন্দ্র বাঙ্গালা ভাশার যে মডেল দিয়েছিলেন তার থেকে বেরোতে আমাদের একটা কমলকুমার বা কবির সুমন দরকার হয়েছিলো। চলুক।
  • বিপ্লব রহমান | 113.231.161.74 (*) | ০১ জুন ২০১৮ ১২:৩৭62487
  • "বিশ্বাস করুন আমি কবি হতে আসিনি, আমি নেতা হতে আসিনি- আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম- সে প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নীরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম..."
    - কাজী নজরুল ইসলাম-
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খারাপ-ভাল মতামত দিন