এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • হুজুক

    Prativa Sarker লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ৩০ মার্চ ২০১৭ | ১৬৭১ বার পঠিত
  • হুতোম সেই কবে বাঙালীদের খোঁচা মেরে লিখে গেছেন "হুজুকে কলকাতা "।
    শাইনিং ইন্ডিয়াতেও এখন নিত্যি নতুন হুজুক, তাতে মিথ্যাকে আটপৌরে হাফ প্যান্ট বা ঘরে পরা নাইটির মতো ব্যবহার করা চলছে দেদার। জড়িয়ে নিলেই হলো।

    নেড়ে বা কাটাদের নিয়ে হুজুকের শেষ কবেই বা ছিলো। তীব্র শ্লেষের সঙ্গে হুতোম একটির উল্লেখ করেছেন। কাবুলি মেওয়াওয়ালারা নাকি ছেলে ধরে কাবুলে নিয়ে যায়, তারপর ছেলেটাকে ছেড়ে দেয় মধু মিষ্টি মেওয়া বাগানে। মেওয়া খেয়ে খেয়ে সে একেবারে ফুলে ওঠে, গায়ের রঙ যেন দুধে আলতা। টুস্কি মারলে রক্ত বেরোয়।
    আর তখনই শুরু হয় আসল খেল।
    উনুনে এক কড়া আসলি ঘি চড়িয়ে ছেলেটাকে ঐ কড়ার ওপর উল্টো করে ঝুলিয়ে দেয়। টগবগে ঘিয়ের ওপর টপ টপ করে রক্ত পড়তে থাকে ছেলের মুখ থেকে। সারা শরীর নিংড়ানো হলে পর অনেক মেওয়া আর মিছরির ফোড়ন দিয়ে কড়াটি নাবানো হয়। নবাব ও বড় বড় মোল্লারা তাই খান।
    "আমরা এই ভয়ানক কথা শুনে অব্দি একলা বাড়ির বাইরে প্রাণান্তেও যেতেম না," হুতোম এবার শ্লেষের নির্দয় চাবুক কষালেন, "ও সেই অবধি নেড়েদের প্রতি বিজাতীয় ঘৃণা জন্মে গ্যালো। "

    এরকম বিজাতীয় ঘৃণারই রমরমা চলছে কিনা, তাই মানুষখেকো হুজুকে কালো আফ্রিকানদের দেদার পেটানো চলছে এ দেশের শহরগুলোতে। কলেজ, ইউনিভার্সিটি, শপিং মল, ভাড়া বাড়ি, অটো বাস ট্রেণ যেখানে দেখবে হাড্ডি গুঁড়িয়ে দাও।
    একে কাকেশ্বর কুচকুচে, তার ওপর বিধর্মী এবং মানুষখেকো। পড়তে এসেছে না ঘন্টা। থ্যাবড়া নেকো, হাঁড়ির তলার মত গায়ের রঙ এবং ওলটানো ঠোঁটের হিজবিজগুলো সব জালিয়াতি, সাইবার ক্রাইম,ড্রাগের ব্যবসা আর মানুষ খাওয়ায় জড়িত। ট্রাম্পের দেশে অনেকটা ঠিক এইরকম কারণেই আমাদের ছেলেগুলোর হাড্ডি পিলপিলিয়ে দেওয়া হচ্ছে সেকথা হাতের সুখ করবার সময় মনে না রাখলেই হলো।

    তাহলে দেখা যাচ্ছে হুজুকের আড়ালে থাকতে পারে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, ধর্মের কারণে ঘৃণা, বিশেষ খাদ্যাভ্যাস নিয়ে অকারণ আপত্তি, আবার কখনো কৃষ্ণ গাত্রবর্ণ নিয়ে জাতীয় ঘৃণার চোরা ইন্ধনও। আর এই হুজুক তুলে দিলেই বেমালুম চাপা পড়ে যায় সত্যিকারের মানুষখেকোদের রক্তপিপাসা--- বস্তার, ওড়িশার জল জঙ্গল তুলে দেওয়া কর্পোরেটের হাতে, ক্ষমতার লোভে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ইন্ধন, ধর্মীয় গোঁড়ামোর কারণে বহু মানুষের খাদ্যাভ্যাস রাতারাতি পালটে ফেলার অপচেষ্টা, মানেসরের লড়াকু শ্রমিকদের যাবজ্জীবন, অবৈধ ব্যবসা বন্ধের নামে গরীবের বৈধ উপার্জন ছিনিয়ে নেওয়া ( মাংসবিক্রেতা যদি মুসলমান, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পশুপালকটি হিন্দু), মেয়েদের অবরোধবাসিনী করে তোলার নব প্রচেষ্টা, আরো কত কি !

    ঘালিবের কথা মনে পড়ে : উমর ভর ঘালিব এহি ভুল করতা রহা / ধূল চেহরে পে থি / আউর আইনা সাফ করতা রহা !

    অথচ TOI এর একটা লিঙ্ক দেখে উৎসাহিত হয়ে যেই না পুরোন বই বার করা, অমনি দেখি ব্যাশাম সাহেব, হাবিব স্যারের The Wonder That Was India আর Medieval India :The Study of a Civilization এ ভারত ইতিহাসে এই কালো মানুষদের অবদান নিয়ে কত কথা, কত অজানা তথ্য। যোদ্ধা হিসেবে তাদের কৃতি, বিশ্বস্ততায় সেরার শিরোপা, এ দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে যাবার ঔদার্য, বীরত্ব, প্রেম, শিল্পচর্চা।

    একথা ঠিক, আরব ব্যবসায়ীদের দাস হিসেবে আফ্রিকানরা প্রথম এদেশে আসেন। কিন্তু ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকেই তারা প্রাচীন ভারতের বহুত্ববাদের সার্থক ধারক। মুঘল সম্রাটের সৈন্য বাহিনীতে অনেক আফ্রিকান ছিলেন। খোজা হাবশি হারেমের পাহারাদার বা রাজনন্দিনীর গুপ্ত প্রেমিকের তকমা পেছনে ফেলে তারা বুদ্ধি ও বাহুবলে হয়ে ওঠেন সেরারও সেরা। মালিক কাফুর (ব্যাশামের মতে ইনি ধর্মান্তরিত হিন্দু) ছিলেন হাজার দিনারে কেনা বৃহন্নলা দাস। সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির ডান হাত হয়ে ইতিহাসে জায়গা পান নবাব হাজার দিনারি হয়ে।

    বাহামনি সাম্রাজ্যের স্থপতি ছিলেন আর এক কালো মানুষ। মালিক অম্বার। ভারতে গেরিলা যুদ্ধের প্রথম রূপকার মারাঠি অশ্বারোহী বাহিনীকে এমন ঝটিকাযুদ্ধ শিখিয়েছিলেন যে সম্রাট জাহাঙ্গীর তাকে মনে করতেন পয়লা নম্বর দুশমন। মহারাষ্ট্রের মুরুদ জঞ্জিরা ফোর্ট তার স্বাধীনতা স্পৃহা ও বিপুল বীরত্বের সাক্ষী হিসেবে আজও দাঁড়িয়ে আছে।

    সুলতানা রিজিয়ার প্রেমিক আবিসিনিয়ান জেনেরাল জামাল উদ দিন ইয়াকাতের কথা বলে শেষ করি। গৌরবর্ণ তুর্কীস্থানী ওমরাহ্‌রা তাকে ঘেন্নায় হাবশি বলে ডেকে এসেছে চিরকাল। কিন্তু প্রাসাদের যে ষড়যন্ত্র মালেকা রিজিয়াকে সিংহাসনচ্যুত করলো তার বিরুদ্ধ আমৃত্যু পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন একা বীর ইয়াকাত।

    লাল কেল্লার প্রদর্শনী কক্ষে দেখেছিলাম একটি ছবিতে ছুটন্ত ঘোড়ার পিঠে বসে আছেন দৃপ্তা রিজিয়া। মুখে প্রসন্নতা, বজ্রমুষ্টিতে অশ্বের লাগাম। পায়ের নীচে সবুজ ঘাস ছাওয়া জমিতে অজস্র নামহীন ফুল আর মাথার ওপর গোটা আকাশ জুড়ে অগুনতি উড়ন্ত পাখি। যেন সুলতানারই মুক্ত স্বতন্ত্র সত্তার অজস্র প্রতীক !
    কোথায় যাচ্ছিলেন মালেকা ?
    আমীর ওমরাহ্‌দের গভীর চক্রান্তের ফাঁস গলায় এঁটে বসবার আগে একটু নিজস্ব সময়ে মিলিত হবার বাসনা কি ভরসেমন্দ ইয়াকাতের সঙ্গে ? কিছু আশ্বাস, কিছু প্রতিশ্রুতি, প্রত্যাশায় কি অমন অসম্ভব দ্যুতিময় তাঁর মুখ ?
    ছবিতে অপূর্ব সুন্দরী সুলতানার গাত্রবর্ণ কিন্তু হাতীর দাঁতের মতো ! তবে সব বাধা অবলীলায় অতিক্রম করে যাওয়া প্রেম কবেই বা গায়ের রঙের পরোয়া রেখেছে !

    এখনো ভারতবর্ষে ইন্দো-আফ্রিকানদের সংখ্যা মোটেও ফ্যালনা নয়। কর্ণাটক, হায়দ্রাবাদ, গুজরাট মিলে পঞ্চাশ ষাট হাজারেরও বেশি।

    কাল দিনমানে মানুষখেকো " হুজুকে" গা ভাসিয়ে দেবার আগে যেন এই ঐতিহাসিক তথ্যগুচ্ছ স্মরণে রাখি।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ৩০ মার্চ ২০১৭ | ১৬৭১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • de | 192.57.32.117 (*) | ৩১ মার্চ ২০১৭ ০৩:০২61056
  • কি করে যে এই চুড়ান্ত অসভ্যতাগুলো মানুষ করে! "মানুষখেকো" শুনে এতো অবাক হয়েছিলাম! এতো রেসিস্ট ইন্ডিয়ানরা কেনো হবে?
  • মনোজ ভট্টাচার্য | 160.129.64.53 (*) | ০৪ এপ্রিল ২০১৭ ১১:৩২61057
  • মানুষখেকো কে ?

    এই তো কিছুদিন আগে নয়ডার এক বাড়ির পাশে নিস্পাপ শিশুদের রক্তহীন ও অঙ্গবিশেষ-হীন দেহ পরেছিল নালার পাশে - সে কি নরখাদক ছিল না !

    যে ছেলেগুলো এদেশে পড়তে আসে - কেন তাদের পেছনে লাগা ! এটা কি শুধু বর্ণবিদ্বেষ ! আমার টা মনে হয় না ! পুলিশই বা কেন এত নিস্ক্রিয় ! - এর পেছনে কি রহস্য - পুলিশ তদন্ত করে দেখছে না কেন ?

    এই একই অভিযোগ তো আফ্রিকান দেশগুলোরও !

    মনোজ
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঝপাঝপ মতামত দিন