এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • ভূতের_গল্প

    Abhijit Majumder লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১০ আগস্ট ২০১৭ | ২৬০১ বার পঠিত
  • পর্ব এক

    "মদন, বাবা আমার ঘরে আয়। আর গাছে গাছে খেলে না বাবা। এক্ষুনি ভোর হয়ে যাবে। সুয্যি ঠাকুর উঠল বলে।"

    মায়ের গলার আওয়াজ পেয়ে মদনভূত একটু থমকাল। তারপর নারকেলগাছটার মাথা থেকে সুড়ুৎ করে নেমে এল নীচে। মায়ের দিকে তাকিয়ে মুলোর মত বিরাট বিরাট দাঁত বার করে একটা ফিচকে হাসি হেসেই আবার উড়ান দিল পরের গাছটার উদ্দেশ্যে। মায়ের কথা শুনতে আজ ওর ভারি বয়েই গেছে। কতদিন বাদে এসেছে এমন শান্তির রাত। সব্বাই যে যার ঘরে খিল দিয়ে ঘুমোচ্ছে। নয়তো আজকাল রাত হলেও ছেলে-ছোকরারা ঘুমায় না। হাতে কি একটা যন্ত্র নিয়ে খুটখুট পুটপুট করে। কেউ কেউ আবার তার সামনে দাঁড়িয়ে ঠোঁট উল্টে ছবি তোলে। মা পইপই করে সাবধান করে দিয়েছে, ওইসব হাতে থাকলে মদন যেন মানুষদের সামনে না যায়। ওরা না কি ছবি তুলে বিশ্বসুদ্ধু সব্বাইকে সেই ছবি দেখায়। এই তো গেল বছর, ভূতনাথের পুজোর রাত্রে, ও পাড়ার মিনিরানী শাকচুন্নী খুব সেজেগুজে চুলে পমফ্রেট মাছের কাঁটা গুঁজে পাড়া বেড়াতে বেরিয়েছিল। হল কি, যেই না একটা বাড়ির জানালা দিয়ে উঁকি মেরে ভেতরটা দেখতে গেছে ওমনি খচাৎ। মিত্তিরবাড়ীর ছোটছেলে ওর নতুন ১২ এম পি ক্যামেরায় মিনিরানীর ছবি তুলেই শেয়ার করে দিল- "সেল্ফি উইথ নাইট ভিজিটর"। লজ্জায় তো মিনি মুখ দেখাতে পারত না কতদিন। বটগাছের পাশ দিয়ে যেতে গেলেই পাড়ার হাড়ে হারামজাদাগুলো গেছোভূতগুলো ঠ্যাং দুলিয়ে নাকি সুরে গাইত, "চুন্নী বদনাম হুয়ি"। শেষমেশ একদিন সকাল নটায় ভুতপাড়ার সবাই যখন অঘোরে ঘুমাচ্ছে, মিনি তুলসীপাতা খেয়ে সুইসাইড করল।

    এসব গল্প মদন ওর মায়ের কাছে অনেক শুনেছে। তবু যখন ওই মন্ডলবাড়ীর ছেলেটা রাত্রে আদুড় গায়ে ঘুমায়, মদন উঁকি না মেরে থাকতে পারে না। তার কেমন যেন শীত শীত করে, গায়ে কাঁটা দেয়। একথা সে কাউকে বলে নি। মানুষ দেখে ভূতের গায়ে কাঁটা দেয় একথা লোক জানাজানি হলে যে তাকেও তুলসীপাতা খেতে হবে।

    তবে আজকের রাতের কথা আলাদা। আজ সবার পুটপুট বন্ধ। কে কার কি ছবি এঁকেছে, তাই নিয়ে কি সব গোলমাল আর তাই সব থমথমে। মদন বুঝল, এই সুযোগ। আজ যদি ছবি তুলেও ফেলে, সবাইকে দেখাতে পারবে না। তার আগেই ওই পুটপুটের ভেতর ঢুকে সব সাফ করে দেওয়া যাবে। যদিও মদন জানে না কি করে ওটা করতে হয় তবে মল্লিকবাড়ীর রাসু মস্তানের কাছে ওটা কাটা বাঁ-হাতের খেল। রাসুর দিকেও মধ্যে মধ্যে তাকিয়ে থাকে মদন। রাসুভাইয়ের বিরাট চেহারাটা দেখলে কেমন একটা ঘোর লাগানো ভয় জাগে মনে। গলার কাছটায় মনে হয় নি:শ্বাস আটকে আসছে। মাথার ভেতরটা দপদপ করতে থাকে। গলায় দড়ি দিয়ে মরার এই একটা বিরাট অসুবিধে। একটু কিছু হলেই দমবন্ধ লাগে। মা বলে, মানুষজন্মের কথা মনে পড়লেই এই অসুখ সেরে যাবে। কিন্তু অনেক ভেবেও তো কিছুই মনে পড়ে না ছাই। সব সাদা পাতার মত খালি। এমনকি কোন কোন দু:খে ও গলায় দড়ি দিয়েছিল সেটা পর্যন্ত ঠিক করে মনে নেই। বিধান কবিরাজ বলেছে মরার সময় ব্রেনে অক্সিজেন যাওয়া আটকে গেলে না কি এমনটা হয়। সব সাফাই হয়ে যায়। রাসু ভাইয়ের কাটা বাঁ হাতের কাজের মত। সব সাফ।

    এই পুটপুট সাফাইয়ের কাজটা রাসু ভাই অন্য ভূতের কাছ থেকে অর্ডার নিয়ে করে। চুন্নীর কেসটার পর থেকে সবাই সাবধান হয়ে গেছে। মার্কেটে এখন রাসু মস্তানের হেভি ডিমান্ড। এখন আবার মল্লিকবাড়ীর চিলেকোঠায় অফিস খুলেছে ও। নাম দিয়েছে "ভাই রাসুর ঠেক। এখানে যত্ন সহকারে মোবাইল খারাপ ও ডেটা ডিলিট করা হয়। প্রতি মোবাইল মাত্র পাঁচশো কুচো মাছ ও এক বোতল বাদুড়ের রক্ত। বি: দ্র: আইফোন রেট আলাদা: ফোন প্রতি কচি মাথার খুলি।" মদন আগে ভাবতো রাসুদা এত করোটি নিয়ে করেটা কি? পরে জেনেছে, রাসুদা মুলতানি গোবরের সাথে করোটির গুঁড়ো মিশিয়ে ফেসপ্যাক বানায়। তাতে না কি ফরসা রং কালো হয়। যত কচি মাথা, তত ভালো। আগে রং নিয়ে মাথা ঘামাত শুধু উঁচু জাতের ব্রম্হদত্যি মেয়েরা। এখন নতুন ফ্যাশনের যুগ। আজকাল ভূতেদেরও রং চাপা না হলে পেত্নীরা ফিরে তাকায় না। ওদিকে মল্লিকবাড়ীর ছেলে রাসুদার গায়ের রং ফ্যাটফ্যাটে সাদা। তাই জোছনা রাত্তিরে যখন অন্য ভূতেরা চট করে বের হয় না মানুষের চোখে পড়ে যাওয়ার ভয়ে, রাসুদা দিব্যি কলার তুলে ঘুরে বেড়ায়। এমন ফ্যাটফ্যাটে ফর্সা গায়ের রং কোনও পেত্নীর হলে সে মনের দু:খে গায়ে গঙ্গাজল দিত। নেহাৎ পুরুষভূত তায় মস্তান, তাই রাসুদাকে গায়ের রং নিয়ে কেউ কিছু বলে না। মদনের কিন্তু ওই রংয়ে রাসুদাকে বেশ লাগে।

    যাই হোক, মন্ডলবাড়ীর ছেলেটাকে ভালো করে কাছ থেকে দেখার চান্সটা আজ রাতেই মেরে নিতে হবে। রাসুদার জন্য একটা খুপরিও যোগাড় করে রাখা আছে, যদি লাগে। ছ বছরের কচি খোপরি, কি সব ঝামেলায় পাড়ার কজন খুন করে পুঁতে রেখে গেছিল। ভাবো, ছ বছরের বাচ্চার সাথে কি শত্রুতা শুনি? মদন ভাবে, এমন যদি ভূতদের মধ্যে হত, সমাজ তাকে একগাছ করত। মানুষগুলোর যেন কোনও হেলদোল নেই। মদনের আজকাল মানুষ দেখলে ভয় লাগে।

    খোপরিটা মদন কেউ না দেখে মত উঠিয়ে এনেছে। কাজে না লাগলে ওটাকে টেবিলের ওপর রেখে তাতে আশশ্যাওড়ার ফুল সাজাবে। ঘর সাজাতে মদনের খুব ভালো লাগে। মাছের কানকো দিয়ে ও কি সুন্দর ওয়াল হ্যাংগিং বানায়। এর পরেরটা বানালে সেটা রাসুদাকে দেবে বলে ঠিক করে রেখেছে। এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে যেই না মন্ডলদের জানলায় উঁকি মেরেছে মদন, অমনি খনখনে গলায় মায়ের হাঁক। আ, মরেও শান্তি নেই। বিরক্তিতে বেরিয়ে আসা দুটো চোখ কুঁচকায় মদন। আর অমনি দেখতে পায় উপুড় থেকে চিত হয়েছে মন্ডলদের ছেলে। খোলা বুক, মাজা রং, তাতে দুব্বোঘাসের মত কটি লোম। মদনের আবার শীত শীত করে। মদন নিজেই নিজেকে বুঝতে পারে না। একে দেখলে এমন গায়ে শীতকাঁটা দেয় কেন? গল্পটা কি?

    #ভূতের_গল্প

    পর্ব দুই

    বিকেল থেকেই গাটা কেমন ম্যজম্যাজ করছে রাসুর। মাথাটাও ভার হয়ে আছে। এই সময় দরকার সরোর হাতের এক কাপ গরমাগরম চা। আহা, সে কি চা, যেন অমৃত। তেমনি কড়ক চা লানেওয়ালি। কোমর দার্জিলিং, বুক নীলগিরি, পাছা অসাম। সকাল সকাল যখন বিছানার পাশে চা রেখে যেত, মনে হত ওই কোমরটাকে জড়িয়ে...। সে সব কিছু দিন ছিল বটে। মল্লিকবাড়ীর বড়ছেলে সে। জমিদারি গেছে তিন পুরুষ আগে কিন্তু রক্তের ধারা বলে একটা কথা নেই? আরে বাবা, শরীরটাতো সেই বনেদী রক্তের। ছোটলোকের মেয়ে দেখলে ও শরীর একটু জাগবে না? রাসু নজর করে দেখেছে, ছোটজাতের মেয়েগুলোর শরীরে যেন আগুন থাকে। কালো আগুন। সেই আগুনে হাত সেঁকতে গিয়েই তো..।

    নাহ্, এসব ভাবতে নেই। মনকে শাসন করে রাসু। সে এখন ভুত। মানুষের মেয়েকে নিয়ে ভাবা অধর্ম। কেন, পেত্নী কি কম পড়েছে? এই দুধসাদা গায়ের রঙের কারনে তার মার্কেট ভ্যালু যদিও একটু কম, সে আর কি করা যাবে? তাই বলে মানুষের মেয়ে? নৈব নৈব চ। ওসব আজকালকার ছেলেছোকরাগুলোর নতুন ফ্যাশন। অল্প বয়স্ক ছেলে, মেয়ে দেখলেই, এদের নোলা সকসক করে। যদি সত্যি সত্যি খাওয়ার দেখে ছোঁকছোঁক করত, তাহলে রাসুর কিছু বলার ছিল না। ভূত হয়ে জন্মেছিস, মানুষ দেখলে তো জিভে জল আসবেই। তাই বলে প্রেম? এই রকম জাতে বেজাতে প্রেম করলেই হল? এই জন্যই এদেশটার কিসু হল না। ঐতিহ্য, ধর্ম কোনও কিছুরই কদর বুঝল না এরা। আরে বাবা, এতদিন সাহেবদের সঙ্গে থাকলি, না হয় আর্দালী হয়েই ছিলিস, কিছু গুন তো শিখবি? এই যে ড্রাকুলা সাহেব, সে কি কচি কচি মেয়েগুলোর সাথে পিরীত করত? পেয়েছিস হাতের কাছে, দে গলায় দাঁত বসিয়ে, চুষে দে ছিবড়ে করে। তা না, এনারা চললেন প্রেম করতে। আরে প্রেম হয় সমানে সমানে। তার বাইরে সব খাদ্য-খাদক।

    তবে এই নতুন ট্রেন্ডে রাসুর একটা সুবিধা হয়েছে। তার হাতে এখন অঢেল কাজ। আজকাল এইসব ছেলেছোকরাদের ছবি এখানে ওখানে উঠে যাচ্ছে। ব্যাস, আর যায় কোথায়? পড়িমড়ি করে এসে পড়ে রাসুর কাছে, রাসুদা বাঁচাও। মনে মনে হাসে রাসু। মরে ভুত হয়ে গেলি, এখনও বাঁচার শখ গেলো না। বাঁচাও কি রে, বল রাসুদা মেরে রাখো। ছ্যা।

    আগে কাজ আসত শুধু বড় বড় ক্লায়্ন্টের থেকে। কোনো পলিটিশিয়ান, পটাং করে গুলি খেয়ে কি হার্ট অ্যাটাকে মরে গেছে, এদিকে মোবাইলে ভর্তি কেচ্ছার প্রমান। সম্মান বাঁচাতে অগতির গতি রাসু। অথবা নামকরা পরিচালক, ড্রাগ ওভারডোজে গন, এদিকে মোবাইলে কাস্টিং কাউচের ভিডিও। মরনোত্তর পুরস্কার টুরস্কারগুলোও ছাড়তে রাজি নয়। অতএব সেই রাসু ভরসা। রাসুও ছাড়ত না এদের। ঝোপ বুঝে ভাল করে কোপ মেরে নিত।

    বিছানা ছেড়ে ওঠে রাসু। শুয়ে থাকলে চলবে না, কাজে বেরোতে হবে। কেটলিতে রাখা ছাগলের রক্তটা ইন্ডাকশানে বসায়। তারপর তার ওপরে কাঠ-কয়লার গুঁড়ো ছড়িয়ে আয়েস করে একটা চুমুক দেয়।

    নাহ্, মনটা আজ বড়ই উচাটন হয়ে আছে। একটু হাঁটাহাঁটি করে আসা দরকার। যাবে না কি একবার মন্ডলপাড়ার দিকে? উঁকি মেরে দেখে আসবে মন্ডলদের মেয়ে সরো মাগী কি করছে?

    হাওয়ায় ভেসে ভেসে মন্ডলদের বাড়ির দিকে এগোতেই রাস্তায় দেখা বুড়ো তারিণীর সঙ্গে। খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখে মোটা চশমা, পরনে সাদা ফতুয়া আর ধুতি। দেখা হলেই শুরু ভ্যজরং ভ্যজরং। দেশের চিন্তায় বুড়োর দিনে ঘুম হয় না। দেশের কি অবস্থা, সবাই শুধু নিজেরটা নিয়েই ব্যস্ত, আজ যদি গান্ধী, নেহেরু, নেতাজি থাকতেন এই সব যত আগড়ম বাগড়ম। হা হা হা, গান্ধী, নেহেরু, নেতাজি! শালা, রাসুর টসকে দশ সাল হতে চলল, এখনো এই ত্রিমূর্তির দেখা পেল না। ছিল কি না আদৌ তাই বা কে জানে? এদেশের মানুষগুলোকে দেখে তো মনে হয় না। নেতাজি না হয় অফ হয়েছে কি না জানা নেই, নেহেরু না হয় এমনিই পটকে ছিল, কিন্তু গান্ধীর তো অপঘাতে মৃত্যু। তার তো নিদেনপক্ষে দেখা পাওয়া উচিত ছিল। কেউ ছিল না। শালা, সব ঢপ, গপ্পো কথা।

    এই তারিণী বুড়োর কাছে বেঁচে থাকতে পড়েছিল রাসু। রাজনন্দিনী প্রাইমারি ইস্কুলে। তার বাপের ঠাকুমার নামে। তাই ভেতরে ভেতরে গরম হলেও মুখে কিছু বলে না রাসু। হুঁ, হাঁ করে কাটিয়ে দেয়। কিন্তু আজ তারিণীর কথা যেন শেষ হচ্ছে না। কোথায় কোন হিন্দুর ছেলে কি করেছে, তাতে মোছলমানরা ঘরে আগুন দিয়েছে, এইভাবে চললে ভূতেদের সংখ্যা বেড়ে যাবে, এইসব হাবিজাবি। রাসু বারবার আকাশের দিকে তাকায়। হঠাৎ বিদ্যুচ্চমকের মত ওর মনে পড়ে, এটা তো আসলে ওরই কাজ। পরশু রাত্রে ওই ছোকরার ফোন থেকে পোস্টটা তো রাসুই করেছিল। বেচারা তখন ঘুমিয়ে কাদা। আজকাল এই এক নতুন খেলা পেয়েছে রাসু। এর ফোন থেকে ওকে মেসেজ পাঠানো, এর অ্যাকাউন্ট থেকে ছবি পোস্ট করে দেওয়া এইসব। আর তারপর চুপচাপ রগড় দেখা। গেল হপ্তাতেই তো এক বর বউয়ের হাতাহাতি অবস্থা। কি না, বউয়ের ফোন থেকে বরের বন্ধুর কাছে মেসেজ গেছে "সেন্ড ন্যুডস"। বউ যত বলে "না, আমি করি নি", বর তত রেগে ফায়ার। শেষে তোৎলাতে তোৎলাতে বলে, "তবে কি ভূতে পাঠিয়েছে?" রাসুর সেদিন হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গেছিল।

    তবে রাসু বুঝতে পারে এইবারেরটা একটু বেশী ডোজ হয়ে গেছে। এতটা হবে ও নিজেও বুঝতে পারে নি। একটু একটু অনুশোচনা হয় রাসুর। ছোটবেলায় বাপ বলত, গতস্য শোচনা নাস্তি মানে দু একটা নাস্তিক গন হলেও সোচনা মৎ। কিন্তু এখানে তো শালা আস্তিকগুলোর লাশ পড়ছে। নাহ, পরের বার একটু ভেবে চিন্তে খেলতে হবে।

    তারিণীবুড়ো একটু এদিক ওদিক তাকাতেই হাওয়ার মধ্যে স্যাঁত হয়ে যায় রাসু। বুড়োর কথা শুনে রাসুর মনে হল, বাওয়ালটা কতটা হয়েছে, সেটা একটু সরেজমিনে দেখা দরকার।

    #ভূতের_গল্প

    পর্ব তিন

    হারু মন্ডলের ঘুমটা মাঝরাত্তিরে হঠাৎ ভেঙে গেল। মনে হল কেউ যেন জানলা দিয়ে তাকে বেশ গভীরভাবে দেখছে। গত কয়েকদিন ধরেই এমনটা হচ্ছে হারুর। কেমন একটা অস্বস্তিতে রাত্রে বারবার ঘুম ভেঙে যাচ্ছে। চোর নয় কেননা তাদের গ্রামে চোর ছ্যাঁচোড়ের উপদ্রব নেই। এক ছিল সুবল, সেও রঘু দারোগা গ্রামে আসার পরের থেকে চুরি ছেড়ে দিয়েছে। তবে এতদিনের একটা শিল্প, তা যাতে নষ্ট না হয় তাই গ্রামের লোকেরা মিলে একটা বন্দোবস্ত করে নিয়েছে। কোনো কিছু ফেলার হলে তাতে সুবলের নাম লিখে সেটাকে উঠোনে কি দাওয়ায় রেখে দেয়। ভোরের আলো ফোটার আগে সে জিনিষ সুবল উঠিয়ে নিয়ে চলে যায়। তাতে ওরও প্র্যাকটিস বজায় থাকে, গ্রামের লোকের কাজও হয়। তবে কি কোনও নতুন চোরের আমদানি হল ফুলবেড়িয়া গ্রামে?

    হারু বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে জানালার দিকে এগোয়। এমনিতে এই গ্রামে ডাকাবুকো বলে নামডাক আছে তার। সে অমাবস্যার রাত্রে পোড়ো জমিদারবাড়িতে যাওয়াই হোক কি রাত জেগে মড়া পাহারা দেওয়া, কোনো কিছুতেই না নেই হারুর। আসলে তার খুব জানার ইচ্ছে মরে যাওয়ার পর মানুষের সত্যিই কি কোনও অস্তিত্ব থাকে। ছোটবেলায় দিদি সরোজ দাওয়ায় বসে আকাশ দেখিয়ে বলত ওইখান থেকে না কি বাবা মা তাদের দেখছেন। হারু যদি দিদির কথা না শোনে, ইস্কুলে না যায় তবে তাঁরা খুব দু:খ পাবেন। হারু বিশ্বাস করত দিদির কথা। দিদি ছাড়া আর কেই বা আছে তার? মল্লিকদের বাড়িতে কাজ করে বয়সে বারো বছরের বড় এই দিদিই তো তাকে মানুষ করেছে। তবে ইস্কুলের অভিজিৎ মাস্টার যখন বলে, ভূত-ফুত কিছু নেই সব মানুষের কল্পনা, তাকেও উড়িয়ে দিতে পারে না হারু। সত্যিই তো, মরার পর আত্মা থাকলে একবারের জন্যও কি তার মা তার কাছে আসত না?

    জানলা খালি, কেউ নেই। খালি জানলার শিকের এক জায়গাটা খুব ঠান্ডা মনে হয়। যেন বরফশীতল হাতে কেউ ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। চিন্তিত মুখে দিদির ঘরের দিকে এগোল হারু। আজকাল চারিদিকে অনেক অশান্তি হচ্ছে। কখন কি হয়ে যায় কিচ্ছু বলা যায় না। দিদির ঘরে উঁকি মেরে দেখে সরোজিনী অঘোরে ঘুমোচ্ছে। আহা, সারাদিনে অনেক পরিশ্রম করে মেয়েটা। যদিও একটু বড় হওয়ার পরের থেকে দিদিকে আর ঘরের কোনও কাজ করতে দেয় না হারু।

    চোখে মুখে জল দিয়ে আবার ঘরে ফিরে আসে হারু। আবার জানলার কাছে যায়। হঠাৎ নজরে পড়ে জানলার কাছে ঘরের ভেতর কি একটা যেন পড়ে আছে। উবু য়ে হারু দেখে আশশ্যাওড়ার ফুল। এটা এখানে এল কোথা থেকে? এদিক ওদিক অনেক আশশ্যাওড়ার ঝাড় আছে বটে কিন্তু সেখান থেকে এ ফুল তো নিজে নিজে উড়ে আসবে না। আর এ তো একেবারে গোছা করা।

    ডাকাবুকো হারুর বুকটা হঠাৎ ছ্যাঁত করে উঠল। তাড়াতাড়ি জানলাটা বন্ধ করে দিল হারু। তারপর বিছানার চাদর জড়ো করে দিদির ঘরের দিকে এগোল হারু। আজকের রাতটা ওই ঘরের মেঝেতে শুয়েই কাটিয়ে দেবে। কথায় বলে, সাবধানের মার নেই।

    বটগাছের ডালে পা দোলাতে দোলাতে মদন দেখতে পেল হারু নিচু হয়ে জানলা গলিয়ে ফেলা আশশ্যাওড়ার ফুলটা কুড়িয়ে নিল। মদনের বুকের মধ্যে একটা খুশির বুদ্বুদ গুরগুরিয়ে উঠল। ইশ্, ও যদি লেখাপড়া জানতো তাহলে সাথে সাথে একটা চিঠিও ফেলে দিয়ে আসতে পারত হারুর নামে। কিন্তু ওই, মরার সময় ব্রেনে অক্সিজেন না যাওয়ায় মনুষ্যজন্মে যা কিছু শিখেছিল সব ভুলে গেছে।

    কিন্তু একি, ও জানলা বন্ধ করে দিল কেন? ওহ্, নিশ্চই লজ্জা পেয়েছে। কথাটা মনে হতেই মনটা আরও খুশিয়াল হয়ে উঠল মদনের। হাওয়াতেই একবার সাঁ করে পাক খেয়ে নিল ও। তারপর ঝুপ করে নেমে এল মাটিতে। এগিয়ে গেল জানলার দিকে। এ জানলা খোলা তো ভুতেদের কাছে নস্যি।
    ঠোঁটদুটোকে ছুঁচোলো করে ফুঁ দিল মদন। আর জানলাটা হাট করে খুলে গেল।

    এ কি, হারু ঘরে নেই তো! তবে কি অন্য ঘরে। সরোজিনীর ঘরের জানলার দিকে গুটিগুটি পায়ে এগোল মদন। কিন্তু এত রাতে একলা মেয়েমানুষের ঘরে উঁকি মারা কি ঠিক হবে? তাও আবার হারুর দিদি? একটু দ্বিধায় পড়ে গেল মদন।
    *****
    তারিণীখুড়োর কাছে গন্ডগোলের খবর শোনার পর রাসু মল্লিক খানিক ইতিউতি ঘুরে বেড়াল। না, খুড়ো খুব একটা বাড়িয়ে বলেনি। গোলমাল একটা বেধেছে ভালোই। কোথাও ঘর পুড়েছে কোথাও গাড়ী। রাস্তায় রাস্তায় পুলিশ টহল দিচ্ছে। হাসপাতালের সামনে ভিড় দেখে মনে হল হাতাহাতি হয়েছে নিশ্চয় একটা। তারিণীবুড়োর কাছে ব্যাপারটা শোনার পর প্রথমদিকে একটু খারাপ খারাপ লাগলেও, এখন নিজেকে বেশ একটা কেউকেটা মনে হল রাসুর। বুকের ছাতি গর্বে যেন ছাপ্পান্ন হয়ে গেল। অনেকটা ওপর থেকে মনে হল নীচের সব মানুষগুলো একেকটা পুতুল আর তাদের সুতো বাঁধা আছে রাসুর কাটা বাঁ-হাতে। এই ভাবনাটা মাথায় আসতেই রাসুর মনটা সদ্যভাজা পাঁপড়ের মত ফুরফুরে হয়ে গেল।

    আর দেরি করা চলে না। রাত শেষ হতে চলল। এবার একবার চট করে মন্ডলদের বাড়ি না ঢুঁ মারলেই নয়। কে বলতে পারে হয়তো সরো বুকের আঁচল সরিয়ে আলুথালু হয়ে শুয়ে আছে। ওহ্, সে যা একখানা দৃশ্য হবে না!

    *********
    হঠাৎ জানলা খোলার আওয়াজে সরোজিনীর ঘুম ভেঙে গেল। ঘুমচোখে তাকিয়ে দেখল ভাইটা মেঝেতে বিছানা পেতে শুয়ে আছে। সরোজিনীর মন স্নেহে আর্দ্র হল। নিশ্চই গন্ডগোলের খবর পেয়ে দিদিকে পাহারা দিতে এসেছে। একটু ঝুঁকে ভাইয়ের মাথায় পরম মমতায় হাত ঠেকাল সরোজিনী। বাবা-মার রেখে যাওয়া ছোট্ট ছেলেটা দেখতে দেখতে কত বড় হয়ে গেল। তারপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে উঠোনের দিকে পা বাড়াল সরোজিনী। একটু বাইরে যাওয়া দরকার।

    *******
    রাসু খানিকক্ষণ মন্ডলবাড়ীর ওপর উড়ে বেড়াল। সবে নিচে নামতে যাচ্ছে এমন সময় দরজা খুলে বেরিয়ে এল সরোজিনী। এ তো মেঘ না চাইতেই জল। হাওয়ায় ভেসে নেমে এসে সরোজিনীর পেছনে দাঁড়াল রাসু। এই মাগীর কাছে এলেই রাসুর কাটা বাঁ হাতটা তিরতির করে কাঁপতে থাকে। গোয়ালঘরে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরতেই বিচুলি কাটার হেঁসো দিয়ে এখানেই প্রথম কোপটা বসিয়েছিল শালি। তারপর আরেক কোপ মারে রাসুর মাথায়। অচৈতন্য দেহটাকে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে ফেলে দিয়েছিল পাশের পানাপুকুরে। তিনদিন বাদে যখন রাসুর দেহ ভেসে ওঠে তখন ফুলে ওঠা সে দেহ রক্তশূন্য, ফ্যাকাশে সাদা। সেই সাদা রং আর কাটা হাত এখনো বহন করছে রাসু। রাগে আরও একবার মাথায় রক্ত চড়ে যায় রাসু মস্তানের। ইচ্ছে করে মাগীর ঘাড় মটকে রেখে দিতে। দাঁত কিড়মিড় করে রাসু। ১৯৫০-এ বানানো ভূত সংহিতাটাই যত গোলমালের মূলে। ওইটার নিয়মমত কোনো নির্দোষ মানুষের ওপর আক্রমণ নিষেধ। ওই বিধিনিষেধ না থাকলে কবেই মাগীর গুমোর ভেঙে দিত রাসু। অক্ষম আক্রোশে মাটিতে পা ঘষল ও। বুকের ভেতর থেকে একটা আহত জন্তুর মত ঘড়ঘড় আওয়াজ উঠে এল। শালা, যত নিয়ম শুধু তার বেলা না? আর ওই রঘু দারোগা যে সব জেনেশুনেও সরোজিনীকে ছেড়ে দিয়েছিল তা কি আর জানে না রাসু।

    নাহ্, অনেক অন্যায়, অপমান সহ্য করেছে রাসু। তার জলে ডোবা ফ্যকাশে রঙের জন্য যে পেত্নীরা পেছনে তাকে টিটকিরি দেয় তা কি আর রাসুর অজানা। তা না হলে আজ স্বর্গীয় বাবু রাসবিহারী মল্লিকের জন্য পেত্নীদের লাইন লেগে যেত। সব কিছু শালা এই মেয়েছেলেটার জন্য।

    গুলি মারো ভূতসংহিতায়। আজ একটা এসপার ওসপার হওয়া দরকার। একটা ফয়সলা না হওয়া অব্দি রাসুর আত্মা শান্তি পাবে না।

    #ভূতের_গল্প

    পর্ব চার

    সরোজিনী বাইরে এসে দেখল আকাশে গোল থালার মত চাঁদ উঠেছে। চরাচর যেন এক অপূর্ব মায়াবী আলোয় ভেসে যাচ্ছে। একেই বোধহ্য় শুভ্রজ্যোৎস্না পুলকিত যামিনী বলে। সরোজিনীর মনটা এক কোমল স্নিগ্ধ আনন্দে ভরে উঠল। চোখ বুজে বুক ভরে নি:শ্বাস নিল ও। এমন শান্ত রাত কচ্চিৎ কদাচিৎ আসে। নিজের মনেই একটা গান গুনগুন করতে লাগল সরোজিনী। গলাটা খারাপ ছিল না ওর। বেঁচে থাকতে মা দু:খ করে বলত গরীবের ঘরে না জন্মালে আর ঠিকমত তালিম পেলে ও না কি একদিন বড় গায়িকা হত। মায়েরও যেমন কথা। সব মায়েরাই নিজের মেয়েকে লতা নয়তো সন্ধ্যা ভাবে।
    মা-বাবার কথা মনে পড়লে সরোজিনী ভাবে আজ যদি ওঁরা বেঁচে থাকতেন তাহলে জীবনটা কতই না অন্যরকম হত। ওকে মল্লিকবাড়ীতে কাজ নিতে হত না, দশ বছর আগে মল্লিক বাড়ীর গোয়ালঘরে ওই ভয়ঙ্কর ঘটনাটা ঘটত না, আর তারপর থেকে এই দশ বছর ধরে জেলে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচতে রঘু দারোগার হাতের পুতুল হয়েও থাকতে হত না। জেলে যেতে ভয় ছিল না বিপ্লবী পরান মন্ডলের নাতনী সরোজিনীর। কিন্তু ছয় বছরের হারুর মুখের দিকে তাকিয়ে রঘু দারোগার কুপ্রস্তাব মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল ও। ও জেলে চলে গেলে কে দেখত ওই বাপ মা মরা ছোট্ট ছেলেটাকে? নিজের জীবনের কথা ভাবলে সরোজিনীর একের সময় গলায় দড়ি দিতে মন হয়। তারপরই আবার ভাবে এই তো নরকযন্ত্রণা শেষ হওয়ার সময় হয়ে এল। আসছে বোশেখে হারুর ষোল পূর্ণ হবে। আর বছর দুই। আঠেরোয় পড়লেই হারুকে সব খুলে বলবে সরো। তারপর দুই ভাইবোনে মিলে পাড়ি জমাবে কলকাতায়। ওই বড় শহরে কেউ জানবে না ফুলবেড়িয়ার সরোজিনীর অতীতের কথা। আর সব শোনার পর যদি হারু ওকে ঘেন্না করে? তাহলে দড়ি আর ফুলবেড়িয়ার শ্মশানের ধারের অশ্বত্থ গাছ তো রইলই।

    সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বাইরের প্রয়োজন সেরে সবে ঘরের দিকে পা বাড়াতে যাবে সরো, হঠাৎ শাড়ীর আঁচলে একটা টান পড়ল। ঝোপেঝাড়ে আটকে গিয়েছে ভেবে পেছন ফিরতেই সরোজিনী দেখল আঁচলটা শূন্যে ভাসছে। দেখলে মনে হবে যেন সেটা কোনও অদৃশ্য খুঁটিতে বাঁধা। ভয়ে সরোজিনীর বুকটা ধড়াস করে উঠল। হারুকে চিৎকার করে ডাকতে গিয়ে বুঝল ওর গলা দিয়ে স্বর বেরোচ্ছে না। মনে হচ্ছে যেন একটা ঠান্ডা হাত ওর গলার ওপর ক্রমশ চেপে বসছে। অসহ্য কষ্টে সরোজিনীর মুখ দিয়ে একটা বোবা গোঙানির মত আওয়াজ বের হতে থাকল। শরীরের সমস্ত শক্তিকে জড়ো করে ওই অদৃশ্য হাতটাকে ছাড়াতে গিয়ে স্পর্শে অনুভব করল ওই হাতছার ওপর রয়েছে একটা গভীর কাটা দাগ। আতঙ্কে জ্ঞান হারাল সরোজিনী।

    "খবরদার রাসুদা, সরোদিদিকে ছেড়ে দাও বলছি। ভূত হয়ে মানুষকে মারা কিন্তু বেআইনি।"
    মদনের খোনা গলার চিৎকারে পেছন ফিরে থাকাল রাসু। তারপর একটা রক্তজল করা হাসি হেসে বলল - "সেদিনের ছোকরা, আমায় আইন শেখাতে এসেছিস। আগে এটাকে নিপটে নি, তারপর তোর ব্যবস্থা করছি।"

    সরোজিনীর মুখের রং নীল হয়ে এসেছে। মদন বুঝল এরপর খুব দেরী হয়ে যাবে। ও তীরের বেগে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল রাসুর ওপর। আচমকা ধাক্কায় হাতটা সরে গেল সরোজিনীর ওপর থেকে আর গলার চাপটা আলগা হতেই সংজ্ঞাহীন সরোজিনী লুটিয়ে পড়ল মাটির ওপর।
    পর্ব পাঁচ

    হাতের শিকার ফসকে যেতে রাসু আরও ক্ষেপে গেল। একটা হিংস্র গর্জন করে ও মদনের গলা টিপে ধরল। কিন্তু গলায় দড়ি দেওয়া ভূতের আর গলা টেপায় কি হবে? মদন সুড়ুৎ করে নিজের গলাটা একটু সরু আর লম্বা করে নিল যাতে চাপটা কম পড়ে। সেটা বুঝতে পারতেই গলা ছেড়ে দিয়ে রাসু ধরল মদনের চুলের মুঠি আর তারপর ওকে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে যেতে লাগল মল্লিকবাড়ীর চিলেকোঠার দিকে।

    চুলের টানে শূন্যে উড়তে উড়তে হঠাৎ মদনের মনে হল আগেও যেন কখনও এমনটাই হয়েছে তার সাথে। যেন কোনও এক পূর্বজন্মে কেউ তাকে এমনই হিড়হিড় করে টানতে টানতে বাড়ি থেকে রাস্তায় বার করে দিয়েছিল। বলেছিল "কুলাঙ্গার, হিজড়ে, আর যেন কখনও তোর মুখ না দেখি"। মদনের মুখ আর দেখতে হয় নি ওর মনুষ্যজন্মের বাবার। সেই রাত্রেই পরনের ওড়না গাছে বেঁধে গলায় দড়ি দিয়েছিল মদন ওরফে মধুশ্রী।

    সব কিছু যেন সিনেমার মত দেখতে পেল মদন। এমনকি দেখতে পেল সেই গাছটাও যেখান থেকে তার প্রাণহীন দেহ নামিয়েছিল রঘু দারোগা। তার মানে এই গ্রামেই থাকত সে। তবু মা তাকে কিছু বলে নি কেন? আহ্, বিদ্যুচ্চমকের মত সেটাও পরিস্কার হয়ে গেল মদনের কাছে। মা চায় নি সে আবার ফিরে যাক তার মানুষজন্মের ভালোবাসা হারু ওরফে হর্ষবর্ধনের কাছে। ভূত মানুষে প্রেম যে বারন। শুধু হারুই নয়, রাসুর চুলের টানে উড়তে উড়তেই মদনের মনে পড়ে গেল এ স্কোয়ার প্লাস বি স্কোয়ারের ফর্মুলা। মরেছে বেশিদিন তো হয় নি, বছর দেড়েক মাত্র।

    রাসুর হুংকারে চমক ভাঙল মদনের। "শালা, বেঁচে থাকতে বেলেল্লাপনা করে শিক্ষে হয় নি, এখন আবার গেছিস ওই মন্ডল বাড়ীতে। জানি না, তুই কি লোভে ওখানে যাস? তোর কান্ডে সারা গ্রামে ছিছিক্কার পড়ে গেছিল। নেহাৎ তোর ভূত মা আমাদের হাতে পায়ে ধরে বলেছিল তোকে যেন কেউ কিছু না বলে, তাই এতকাল চুপ ছিলাম। এই জন্যই বলে স্বভাব যায় না মলে। আজ তোর মাজাকি ঘোচাচ্ছি।"

    ও হরি, ভূত মা? তাই তো, এ মা তো ওর নিজের মা নয়। ভূত সমাজে কজন আর নিজের মা পায়? এ তো আসলে হারুর মরা মা। মদন বুঝতে পারল মানুষ বাবা-মা হারুর প্রতি ওর ভালোবাসা বুঝতে না পারলেও, হারুর ভুত-মা ঠিক সেটা পেরেছে। আর তাই ভূত-সংহিতা মেনে প্রেতদত্তক নিয়েছিল মদনকে।

    মদনের চোখের কোণে জল আসে। আর কি কখনও দেখতে পাবে ভূত মাকে? লোকে বলে রাসু না কি মল্লিকবাড়ীর চিলেকোঠায় নিয়ে গিয়ে গায়ে গঙ্গাজল ঢেলে গঙ্গাপ্রাপ্তি ঘটিয়েছে অনেক ভূতের। এবার কি তবে ওর পালা?

    হঠাৎই একটা ঝাঁকুনিতে মদনের চিন্তা ছিঁড়ে গেল। রাসুর পথ আটকে দাঁড়িয়েছে তারিণীখুড়ো। পাশে ওর ভূত মা।

    "ভালো চাস তো বাচ্চাটাকে ছেড়ে দে রাসু" চিৎকার করে বললেন তারিণীখুড়ো।

    "রাস্তা থেকে সরে যাও বলছি বুড়ো। টীচার বলে অনেক সম্মান দেখিয়েছি। আর পারবো না। আজ এই হিজড়ের বাচ্চাকে শেষ করে তবে ছাড়ব" হিসহিসে গলায় বলল রাসু।

    "আমি মরে থাকতে নয়" শান্ত গলা তারিণীর।

    "চলো, আজ তাহলে তোমাকেও সালটে দি" বলেই তারিণীর দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল রাসু। আর তখনই তারিণী আর মদনের মাকে ঘিরে তৈরী হল এক জ্যোতির্বলয় আর তাতে ধাক্কা খেয়ে শরতের শিশিরকণার মত গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ঝরে পড়ল রাসু।

    অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকা মদনের দিকে স্মিত হেসে তারিণী বললেন, "রাসু ভুলে গেছিল, জ্ঞান আর ভালোবাসা পাশাপাশি দাঁড়ালে তাকে ধ্বংস করার ক্ষমতা কোনো অপশক্তির নেই।"

    মদন ছুট্টে গিয়ে ওর মাকে জড়িয়ে ধরল। তারিণী মদনের ঝাঁকড়া চুলে হাত বুলিয়ে বললেন, "এবার তো সব মনে পড়ে গেছে। তাহলে কাল থেকে স্কুলে এসে নাইনে ভর্তি হয়ে যেও, কেমন? যাও, এখন বাড়ী যাও, সুয্যি উঠল বলে। রাতভর অনেক ধকল গেছে। দুটি পান্তা খেয়ে ঘুমিয়ে নাও।"

    তারপর হঠাৎ কি একটা মনে পড়ে গেছে এমনভাবে বললেন, "আর হ্যাঁ, যদি মন চায় তাহলে পেত্নীদের সেকশানেই ভর্তি হয়ে যেও। আমি খাতায় তোমার নাম মধুশ্রী মন্ডলই লিখব, কেমন? আর হারুকে নিয়ে বেশী ভেবো না। এক জীবনে কি আর সব পাওয়া যায়?"

    ঠিকরে বেরিয়ে আসা ড্যাবড্যাবে চোখদুটো নামিয়ে নিল মদন। মুলোর মত দাঁতগুলো বার করে হেসে মাথা নাড়িয়ে কোনোমতে হ্যাঁ বলল। লজ্জায় বেচারার মুলোর মত কানগুলো সবুজ হয়ে গেছে।

    আস্তে আস্তে হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেন তারিণী। মধুশ্রী দেখতে পেল গুরুপূর্ণিমার থালার মত অস্তচাঁদ তার দিকে তাকিয়ে হাসছে।

    (শেষ)

    উৎসর্গ: এ লেখা সেইসব ঝরে যাওয়া সম্ভাবনাদের স্মৃতিতে যাদের মা বাবারা সন্তানের সুখের চেয়ে সমাজ আর সংস্কারের বাঁধনকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। এ লেখা সেইসব মা-বাবাদের জন্যও যাঁরা অন্য যৌনতার ছেলেমেয়েদের পাশে দাঁড়াতে দুবার ভাবেন নি। যেমন, জাস্টিস প্রয়াত লায়লা শেঠ। তাঁর লেখার একটা লিংক রইল এখানে।

    http://m.timesofindia.com/home/sunday-times/deep-focus/A-mother-and-a-judge-speaks-out-on-section-377/articleshow/29383723.cms
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১০ আগস্ট ২০১৭ | ২৬০১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • dd | 59.207.59.112 (*) | ১১ আগস্ট ২০১৭ ০২:৩৯60750
  • বাঃ, বেশ লাগলো। ভালো।
  • | 144.159.168.72 (*) | ১১ আগস্ট ২০১৭ ০৫:৩৯60751
  • হ্যাঁ বেশ ভাল্লাগলো।
  • pi | 57.29.243.238 (*) | ১১ আগস্ট ২০১৭ ০৫:৫২60753
  • ব্রেশ হয়েছে।
  • pi | 57.29.243.238 (*) | ১১ আগস্ট ২০১৭ ০৫:৫২60752
  • ব্রেশ হয়েছে।
  • robu | 213.132.214.83 (*) | ১১ আগস্ট ২০১৭ ০৬:৪৪60754
  • এ তো দারুণ লেখা! অসম্ভব ভালো লেখা!
  • Arindam | 213.132.214.83 (*) | ১১ আগস্ট ২০১৭ ০৭:২৪60755
  • বেড়ে ! তবে একটা কথা, "লজ্জায় বেচারার মুলোর মত কানগুলো সবুজ হয়ে গেছে।" ।। মদন ভূতের কান কুলোর মত নয়? মূলোর মত?? ঃ
  • Phutki | 55.123.161.186 (*) | ১১ আগস্ট ২০১৭ ০৭:৩৮60756
  • দারুণ তো!
  • Abhijit Majumder | 113.21.125.78 (*) | ১১ আগস্ট ২০১৭ ০৭:৫৬60757
  • ভুল হয়ে গেছে। কুলোর মতো লিখতে চেয়েছিলাম
  • শঙ্খ | 52.110.190.188 (*) | ১১ আগস্ট ২০১৭ ০৯:১৪60758
  • একটানে পড়ে ফেললাম। অনেকগুলো জিনিস মেলানো মেশানো রয়েছে। তবে ঘেঁটে যায়নি, সুখপাঠ্য হয়েছে।
  • de | 220.212.192.130 (*) | ১৩ আগস্ট ২০১৭ ০৩:৫৬60759
  • বাঃ, ভালো লাগলো!
  • ঋক আর কিছুনা | 113.242.198.70 (*) | ১৩ আগস্ট ২০১৭ ০৪:০৭60761
  • দারুণ দারুণ ...।খুব ভালো লাগলো।
  • রৌহিন | 113.214.139.253 (*) | ১৩ আগস্ট ২০১৭ ১১:৪৫60760
  • দারুণ দারুণ। ভীষণই ভালো - আর কী বা বলব
  • জিজি | 125.118.216.131 (*) | ১৪ আগস্ট ২০১৭ ০৬:৫৭60762
  • আরিব্বাস! জম্পেশ গল্প! দারুণ।
  • Arin | 167.49.4.187 (*) | ১৪ আগস্ট ২০১৭ ০৭:০৭60763
  • বড্ড প্রিচি হয়ে গেছে, নইলে হয়তো ভালোই লাগতো।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে মতামত দিন