এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • পুজোর চিঠি/ পর্ব 1

    Atanu Sanpui লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১৪ অক্টোবর ২০১৬ | ১৬৭৩ বার পঠিত
  • ।।।ষষ্ঠীর চিঠি।।।

    বিয়াস,
    সেলফি স্টিক দিয়ে বর্তমানকে আঁকড়ে ধরার ক্ষমতা আমার নেই, তুমি জানো। আঙুলের ফাঁক গলে হারিয়ে যাওয়া পেজার আর ফ্লপির সময়ের পুজোর মধ্যে দিয়েই আমি তোমাকে আমাকে খুঁজে পাই। গত বছর সেই মন খুঁড়ে পাওয়া কিছু মুহূর্ত পুজোর দিনগুলোয় তোমায় দিতে চেয়েছিলাম। যে পুজো আজ আর আমরা যাপন করি না। সে পুজোর হদিশ নিতে গেলে নিজেকে জাতিস্মর মনে হয়। তখন চতুর্থী থেকে ঠাকুর দেখা শুরু হত না। বরং উল্টোটা হত। ষষ্ঠী সকালেও পুজো আসছে পুজো আসছে .. রেশ রয়ে যেত। পুজোর জমানো নতুন জামার বদলে আগের বারের সবচেয়ে ভালো জামাটা বরাদ্দ থাকতো ষষ্ঠীর জন্য। এখন তো ষষ্ঠীতেই পুজো মাঝআকাশে। আর তখন বাড়ি বাড়ি নতুন জামা কাপড় দেওয়া চলতো ষষ্ঠীতেও। সেই ষষ্ঠীতে আমার উপর ভার পড়েছিল রাঙাপিসির জন্য কেনা ঝুম্পা লাহিড়ির 'নেমসেক', দমিনিক লাপিয়ারের 'ফাইভ পাস্ট মিডনাইট অ্যাট ভোপাল' আর একটা নতুন শাড়ি পৌঁছে দেওয়ার। রাঙাপিসিকে তোমার মনে আছে বিয়াস? সেই যে বাবার পাতানো দিদি। তিনকুলে কেউ নেই। চুঁচড়ায় থাকতেন। আগের দিন বাবা যখন চুঁচড়া যেতে বললেন, আমি তো 'না' বলতে পারলাম না। একে আমায় দিয়ে নাকি কোনও কাজই হয় না। তাও একটা দায়িত্ব দেওয়ার পর যদি আমতা আমতা করি.. কিন্তু এটাও জানতাম, চুঁচড়ায় আপ ডাউন মানে ষষ্ঠীটা গেল ট্রেন আর স্টিমারের খাতায়। যে খাতার কোনও পাতায় বিয়াস থাকবে না। মিনমিন করে তোমায় বলেছিলাম। লাফিয়ে উঠে বলেছিলে- "তোমার সত্যিই বুদ্ধি নেই। আমি বলে তাই এতদিন তোমায়....।" আমি বোঝাতে গেলাম, আমি সত্যিই নিরুপায়। তুমি বললে-"বুদ্ধুরাম, এটা তো আরও ভালো হল। আমিও যাব তোমার সঙ্গে। ট্রেনে চেপে, স্টিমারে চড়ে..তোমার গা ঘেঁষে। কেউ চিনবে না। জানতেও চাইবে না।" -"কিন্তু.. মানে.. রাঙাপিসিকে কী বলবো? আর বাড়িতে?".... "উফ্। বাড়িতে কিচ্ছু বলতে হবে না। আর তোমার রাঙাপিসিকে যা বলার আমি বলব। তুমি হাঁদারাম সেজে দাঁড়িয়ে থেকো। ওকে?" এরপর আর কী বলবো? নিজেই শুধু নিজেকে বোঝালাম, রাঙাপিসির বাড়ি টেলিফোন নেই। সুতরাং দুর্ঘটনা ঘটলেও তার আঁচ পেতে পেতে আরও মাসচারেক। ষষ্ঠী সকালে স্টেশনে যাওয়ার অটোতে উঠে বেশ বীরপুরুষের মতো বললাম,"তাহলে? চললে বিয়াস চুঁচড়ায়। তোমার পিসিশাশুড়ির সঙ্গে দেখা করতে.. "।.... "মোটেও না। আমি তো বাড়িতে বলেছি, দোয়েলের জ্যাঠতুতো দিদির হবু শ্বশুরবাড়ি বিরাট বড় পুজো হয়। সব বন্ধুদের ডেকেছে। তাই কোন্নগরে যাচ্ছি।"
    স্টেশনে টিকিট কাটতে গিয়ে বুঝলাম, কেমন যেন মনে হচ্ছে বড় হয়ে গেলাম। এই প্রথম ট্রেনে কারও সঙ্গে যাব। যার দায়িত্ব আমার। নৈহাটি পর্যন্ত ঘণ্টাখানেকের জার্নি। তার মধ্যে ওই বড় হয়ে যাওয়ার অনুভূতি আর কোনও কিছু মাথায় আসতে দেয়নি। এরপর ফেরিঘাট-স্টিমার.. এবং টেনশন। মাঝে বারদুয়েক জানতে চেয়েছিলাম, কী বলবে রাঙাপিসিকে? জবাব মেলেনি।
    পুরনো দিনের বাড়ি। খুব বড় নয়। তবে কোয়ার্টারে বড় হওয়া আমার চোখে জমিদার বাড়ির থেকে ছোটও নয়। একাই থাকেন, সঙ্গে পঞ্চু কাকা সবসময়। রিকশ থেকে নামতেই দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন কচ-দেবযানী-নোয়ার নৌকো-ইব্রাহিম আর শার্লামেনের গল্প বলা রাঙাপিসি। আমার জীবনের খুব কম মানুষদের একজন, যাঁকে দেখলেই পা ছুঁতে ইচ্ছে করে। ঘরে ঢুকে প্রণাম করে বললাম,-" ওই ও হল বিয়াস.. " থামিয়ে দিয়ে বললেন, "কথা বলতে পারে না বুঝি? কি গো মেয়ে?" তারপর তোমার হাত ধরে জানতে চাইলেন, বাড়িতে সবাই ভালো আছেন কি না? ঘাড় হেলিয়ে তুমি বলেছিলে "জানো রাঙাপিসি, ও আমায় আনতে চাইছিল না।" সত্যিই বিয়াস। সে দিন আরও একবার মনে হয়েছিল "দেয়ার আর মোর থিংস ইন হিভেন অ্যান্ড আর্থ হোরাশিও.." কী নিষ্ঠুরের মতো আমায় ঠেলে দুজন দুজনকে আপন করে নিয়েছিলে সে দিন
    । জলখাবারের পরে রাঙাপিসি গেলেন রান্না করতে আর আমার উপর ভার পড়ল বাড়ির পিছন দিকের ওই হিজলের ছায়া মেলে দেওয়া রাস্তা ধরে তোমায় যেন গঙ্গার ঘাট পর্যন্ত ঘুরিয়ে আনি। আধভাঙা ঘাটের সিঁড়িতে বসে তোমার দিকে তাকিয়ে ছিলাম .. ঢাক বাজছিল অনেক দুরে .. সেও এক ষষ্ঠী। কতক্ষণ পরে জানিনা, পঞ্চুকাকার ডাকে ফিরে এলাম নেশাতুর দুটো মন। দুপুরে খেতে বসে দেখলাম, একজনের জন্যেই থালা সাজানো। উত্তর এল -"মা বেটিতে পরে খাব আমরা। তুই আগে খেয়ে নে।"
    নিরালা দুপুরে ঘুঘুটাও ডাকতে ডাকতে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে তখন। বড় পালঙ্কের একধারে হেলান দিয়ে রাঙাপিসি, তাঁর কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছো তুমি। সামনে বসে আমি পড়ে শোনাচ্ছি হেলাল হাফিজ। "এখন তুমি কোথায় আছো কেমন আছো, পত্র দিয়ো/এক বিকেলে মেলায় কেনা খামখেয়ালী তাল পাখাটা/খুব নিশীথে তোমার হাতে কেমন আছে, পত্র দিয়ো.." একবার চোখ তুলে দেখলাম, তোমার মাথায় পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন রাঙাপিসি। তুমি আর পিসি দুজনেরই চোখ জানালা ছাড়িয়ে অনেক দূরে..আবার পড়তে শুরু করলাম, "আমি না হয় ভালোবেসেই ভুল করেছি ভুল করেছি/নষ্ট ফুলের পরাগ মেখে/পাঁচ দুপুরের নির্জনতা খুন করেছি, কী আসে যায়?"
    ফেরার সময় সারা রাস্তা তুমি একটাও কথা বলোনি সেদিন। একবার শুধু বলেছিলে, "কথা দাও, আমাদের বিয়েতে রাঙাপিসি কনেপক্ষ হবে।" তোমার বিয়ের পরে আর একবার চুঁচড়ায় গিয়েছিলাম। সেই শেষবার। সারাদিন ছিলাম। অনেক গল্প করেছিলাম। কিন্তু তোমার কথা রাঙাপিসি একবারও তোলেননি। আসার সময় শুধু মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন,-"ভালো থাকিস। বিয়াসের সঙ্গে আবার যে দিন দেখা হবে, সে দিন যেন তোকে দেখে মেয়েটা কষ্ট না পায় দেখিস।"

    বিয়াস, তোমার আমার আর রাঙাপিসির কোনও গ্রুপ্ফি তোলা নেই। তাই এই চিঠিই সম্বল।

    শুভষষ্ঠী।।

    #পুজোর_চিঠি
    -অতনু।।
    7 অক্টোবর, 2016
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১৪ অক্টোবর ২০১৬ | ১৬৭৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • রৌহিন | 233.223.133.211 (*) | ১৪ অক্টোবর ২০১৬ ০৭:২৩59105
  • পরের লেখাটার লিঙ্ক আগের লেখাটায় এড করে দে। দারুণ লেখাগুলো
  • সিকি | 165.136.80.161 (*) | ১৮ অক্টোবর ২০১৬ ০৯:২৫59106
  • এইটা আমি মিস করে গেছিলাম? কী করে সম্ভব?
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। কল্পনাতীত প্রতিক্রিয়া দিন