এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • এই তবে... আরশিনগর!!?

    Sinjini Sengupta লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ০৮ জানুয়ারি ২০১৬ | ১৯৬০ বার পঠিত
  • সোজা রিভিউয়ে ডাইভ মারার আগে দু-একটা কথা বলে নেওয়া আবশ্যক। অর্থাৎ কিনা – আরশিনগর – চারিদিকে এতো সব শোনার পরেও – আদৌ দেখলাম কেন। দেখলাম, তার কারণটা ওই... বাঙালি রক্তদোষ। সবাই খারাপ বলছে, আমি আমি ততই ভাবছি – আর আপামর প্রত্যেকটা ভেতো বাঙালির মতন করেই, যে – ছ্যাঃ, ওই ব্যাটারা নিশ্চয়ই বোঝেনি... আমি তো ইয়ে, যাকে বলে গিয়ে... আমি, মানে, নিশ্চয়ই বুঝবো! অপর্ণা সেন আফটার অল, যিনি কিনা পরমা, পারমিতা, শনকা ভেবেছেন একদা, তিনি কি করেই বা কতই বা... ভুল, ভুল! আমি বুঝিনি!! সত্যি বলতে কি, এখন দেখার পর থেকে একটা অন্যরকম সন্দেহ হচ্ছে – টাইটেলকার্ডটা ভুল পড়িনি তো? মানে, অপর্ণা সেন... উনিই তো...?

    এবারে রিভিউয়ে আসা যাক, শেষমেশ।

    প্রথমেই ক্লিয়ার করে রাখা দরকার – আরশিনগর একটি আদ্যপান্ত হাসির সিনেমা। যদি অন্য কোনরকম আশা করা হয়ে থাকে, সেটা নেহাতই... ইয়ে... দুরাশা!!

    আরশিনগর একটা কাল্পনিক এরিয়া, সম্ভবত গ্রাম বা আধা মফঃস্বল। সেখানে দুইঘর বড়লোক বাড়ি আছে, যারা দুজনরাই বাঙালীমতে অসুর, অর্থাৎ কিনা প্রপার্টি প্রমোশনের বিজনেস। আর আছে এক পিস মিনিস্টার, আর একটা ক্যানপির মতো ছোট্ট গোল মন্দির, যাকে সারকম্ফারেন্স করে একটা বস্তি যেখানে হিন্দু মুসলিমরা ফি সকালে ফ্রিতে চা খায় আর পুরুতমশাইয়ের থেকে চন্দনের টিপ পরে। ও, আরেকটা মেলাও হয় - বোধ হয় সংবৎসর, কিন্তু সঙ-সিকোয়েন্স হলেই মেলা গ্রাউন্ড থেকে লোকজন বেবাক ভ্যানিশ হয়ে যায়। আরশিনগরের বস্তিতে সবার বাড়িতে ত্যারছা বা তিনকোনা ভাঙ্গা আয়নার টুকরো বাইরের দেওয়াল জুড়ে পেস্ট করা থাকে (ওই যে, আরশি!); আর বড়লোকের বাড়ি হোক বা মিনিস্টারের অফিস, আরশিনগরে অবস্থাপন্ন ঘরের ইন্টিরিওরগুলোয় ফার্নিচার থাকে কম আর দেওয়াল জোড়া ফার্নিচার থিমের মুরাল আঁকা থাকে অনেক বেশি। এবং – বলব কি – দু-একটা সিনে, ভুল করে কিনা বুঝলাম না, ডেস্ক, পড়ার টেবিল, কলেজের ব্যাগ হাতড়াতে হাতড়াতে যীশু দেওয়াল লিখন (আঁকন) বুকশেলফও পষ্ট দেখলাম হাতড়ে দেখলেন। বুঝলেন না, নিশ্চয়ই? সাররিয়াল দাদা, সাররিয়াল!!

    যাগগে! এই গেলো গিয়ে আরশিনগর-বিবরণ, এরপর আসা যাক আরশিনাগরিকদের কাছে।

    রোমিও –

    মিত্তির পদবী হলে রোমিওর নাম তো আর রোমিও হয় না, তাই রণজয়, আর ছোট করে ‘রণ’। তা, রণজয় থার্ড-ইয়ারে তিনবার ফেল করে, গান গায়, গান অর্থাৎ বন্দুক কাকে বলে জানেনা ভেরি আনলাইক এভরি আদার কিড ইন দ্য ব্লক, কিন্তু ক্লাইম্যাক্সে এসে নড়ন্ত প্রেমতুতো পিসতুতো হতে-পারে শালার খুলি উড়িয়ে দেয় কারণ সেই প্রথম সিনে মেলায় গিয়ে এয়ার-গান দিয়ে বেলুন ফাটিয়েছিল জাস্ট ইন কেস এনি দর্শক ডাজ সাম ঠ্যাঁটা তর্ক!! রণজয় নরম মনের মানুষ, তাই ওয়ারড্রবের গভীরে হ্যাঙ্গারঝোলা জামার আড়ালে প্রেমিকার সাথে তার বাবা-মায়ের ছবিও সমান রোমান্টিকতায় সাঁটিয়ে রাখে, আর কথায় কথায় বোরখা পরে। রণজয় গোটা সিনেমা জুড়ে আরও অনেক কিছু করে, অবশ্যই, কিন্তু সবচেয়ে স্যুইট যে ব্যাপারটা করে সেটা এক্কেরে লাস্ট সিনে। চোখের মণিতে মোটা আঙ্গুল গেঁথে আয়রনি বোঝাতে তখন মুসলিম নায়িকা সরু বাটারফ্লাই গোঁফ পরেছে আর মাথায় পাগড়ি (পায়েতে নাগরা ছিল কিনা খেয়াল করিনি) আর হিন্দু নায়ক রণজয় এই দুঘন্টার মধ্যে একান্নতমবার – আরও আরেকবার – বোরখা পরেছে। রেললাইনের ওপার থেকে হাত নেড়ে টেরে তৎসত্ত্বেও শেষরক্ষা না করতে পেরে ফাইনালি “লাইন-ক্রস” করে ‘কাফের’ হুঙ্কারিত গুলি-নিক্ষিপ্ততায় বিদ্ধ প্রেমিকার রক্তক্ষরিং মাথাটা কোলে তুলে নিতেই সেই অমোঘ মুহূর্ত, সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! ডেভিড ধাওানের সিনেমায় যাকে বলে কমিক টাইমিং। চক্ষু তুলে গলা কাঁপিয়ে আরও অনেক রকমের অনেক কিছু অনুভুতিকে চৌচির করে দিয়ে দেব তার একান্ত নিজস্ব, সিগ্নেচার মোক্ষমতায় সেই ভীষণ স্পেশাল বাংলা উচ্চারণে বলে ওঠে – “এই তবে শেষ...?”

    বিশ্বাস করুন, দিব্যি গেলে বলছি - আমি একা নই, হলে অন্য দর্র্শকরাও হেসেছিল!!

    জুলিয়েট –

    খান তো, তাই জুলিয়েটের কেসটা একটু ইজি করে দিয়ে সে ‘জুলি’। জুলি এক ভারী মিষ্টি মেয়ে, নাক টিপলে দুধ পড়ে মতন দেখতে, বোধ হয় ঘুমনোর সময় এখনো আঙ্গুল খাওয়া ছাড়তে পারেনি, তাই দাঁতগুলো উঁচুনিচু আর কথাবার্তা আধো-আধো, তাই সব মিলিয়ে অভিনয় এক্কেবারে না পারলেও খুকি-সুলভ একটা হাল্কা স্নেহ উদ্রেক করে মনে। আর জুলি না বড্ডো গোঁফ পরতে ভালবাসে, ওই বাটারফ্লাই গোঁফ। ও, আরেকটা ব্যাপার! জুলি প্রথমবার যখন বোরখা পরা রণজয়কে দেখে, ওকে ‘পাতলা পটির’ দাওয়াই ভেবে ভুল করে – তা, সে তো হতেই পারে! তবে কিনা, একটা ব্যাপার কিন্তু একটু... মানে, ড্রেস মেকআপ কমপ্লিট তবু শো-য়ের দিন শেষ মুহূর্তে যে নিজের নাটকদলকে অবলীলায় ডোবায়, তাকে কিন্তু ঠিক... তবে ওর প্লে-ডোয়ের মতো নিষ্প্রাণ, নিষ্পাপ উপস্থিতিতে কিছুই আর সেরম মনে থাকে না বিশেষ।

    সেক্স!!

    এই সেক্সের ব্যাপারে বাঙ্গালিদের এই না ধরি জল না ছুঁই পানি গোঁড়ামি চিরকালের, কিন্তু তবু... যিনি একদা, আজ থেকে পাক্কা দু দশকেরও আগে “আমার তো কোন অপরাধবোধ নেই!” মুহূর্ত সপাটে রচনা করে দিতে পেরেছিলেন, তিনি – সত্যিই – এতোটা প্রেমের মধ্যে সেক্স বোঝাতে পারেননা সেটা কি হতে পারে কখনো, সম্ভব আদৌ? অথচ, সেরকমই তো দেখলাম, এইমাত্র! পষ্ট, চাক্ষুষ দেখলাম – গুনে গেঁথে ঠিক প্রথম দিন, দ্বিতীয় দর্শন এবং দু-চারখানার চেয়ে কম বই বেশি নয় বাক্য বিনিময়ের পরেই একটা গা-জোয়ারি ঠোঁট চুম্বন, অতঃপর “এটা কি তোমার প্রথমবার?” মার্কা হাল্কা ন্যাকামি বিতরণের পর দ্বিতীয়বার ‘ওই’ এবং তদৎপর নায়কের নায়িকাকে দেওয়া দিলদরিয়া সার্টিফিকেট – এই তো দ্বিতীয়বার ঠোঁট ফাঁক করলে, হাউ কারেক্ট! – ভাবুন!! (সত্যি বলছি, সিনেমাটার ডায়ালগগুলো এই মাপেরই।) তারপর কি হল? সেটাই তো!! তারপর অন্তত ডজন খানেক অভিসার দৃশ্যে দুজনের ট্যোটাল সেলিবেসি – লাস্টের মামলায় ট্যোটাল ফাস্টিং। অর্থাৎ, দুজন প্রেমিক-প্রেমিকার সম্পর্কে সেক্স একবার ঢুকেও নিপাট ভদ্রতায় এক্কেবারে গ্রাউন্ড ছেড়ে বেরিয়ে গেলো – সময় সুযোগ কার্যকারণ সবকিছু পুরোপুরি নো-প্রব্লেম, গ্রীন সিগনাল হলেও তারা দুজনে কখনো কিচ্ছু করে না, বরং আলাদা আলাদা পিলারের গায়ে সাবধানী ছোঁয়া বাঁচানো দুরত্বে হেলান দিয়ে বসে ডাইরির ছেঁড়া পাতায় আনাড়ি ইন্টিরিওর ডেকোরেশনের কোর্স করে যায় আর বিলকুল লিপ-মিলল-না গলায় গান গেয়ে যায়। একদম লাস্টের দিকে আরেকবার লাস্টের চেষ্টা জারি হয় যদিও, চরম আরজেন্সি আর ‘এই-গেল-এই-বুঝি-ধরে-ফেললো’ মুহূর্তে আর তারই মধ্যে নায়ক নায়িকা অফ শোল্ডার বেড-শীট পরে যদিও বা অ্যাপারেন্টলি ঘুমোলো, তারপরই “আর কি এ জীবনে দেখা হবে” মুহূর্তে আরেকদফা ভীষণ পরিষ্কার, নিষ্কাম, নিস্তেজ, নির্ভেজাল গুড-বাই... কি মুশকিল! এর চেয়ে ভাইবোন হলেই তো পারত!!

    টাইবাল্ট

    এখানে টাইবাল্ট হল তায়াব অর্থাৎ যীশু সেনগুপ্ত, যে কিনা জুলির পিস্তুত ভাই। যীশু ছুরি হাতে ব্যালেট ডান্স করে বেড়ায় যত্রতত্র, মেলা থেকে ডেজারট, আর সম্ভবত জুলিকে হাল্কা ইয়ে করে। গানের খাতিরে রোমিওকে হাল্কা প্রায়োরিটি দিতে গিয়ে মেলার সিনে ভুলিয়ে-ভালিয়ে ওকে ঘরে পাঠিয়ে দিলেও ভবি-ভোলে-নাই করে তায়েব গান শেষ হলেই ছুরি মারে, কারণ ও ছুরি মারতে খুব ভালবাসে। এতটাই ভালবাসে, যে – ক্লাইম্যাক্স সিনে আমাদের ক্লাস নাইনের ফিজিক্সে পড়া স্পীড অফ সাউন্ডের যাবতীয় থিওরি নস্যাৎ করে দিয়ে ও কপালে রিভল্ভারের গুলি খেয়েও হাত দিয়ে ছুরি মারে এবং একইসাথে মরে। অভিনয়ের কথা বলতে গেলে – যীশু সত্যি বলতে চেষ্টাটা করেছিলো – কিন্তু ওই... সাররিয়ালিজমের দায় সর্বগ্রাসী, নির্মম বড়!!

    ফতেমা -

    ছবিতে একমাত্র (হ্যাঁ, ঠিকই বলছি – একমাত্র) ঠিকঠাক অভিনয় করেছেন জাস্ট একজনই – তাঁর নাম স্বাগতা মুখার্জি। তিনি ওই সাররিয়ালিজমের চক্করেই কখনো পুতুলখেলার মাধ্যমে ন্যারেটর এবার কখনো আসলি গল্পে নায়িকার আয়া, ফতেমা। চোখ টিপে বুঝিয়ে দেন রোল swap-এর ব্যাপারটা। মানে, একবার চোখ টিপলে ব্যাক তো পুতুল খেলা, দুইবার টিপলেই ব্যাক তো ন্যানি - মিসেস 'ফতে'। ভদ্রমহিলা একদম গোড়াতেই দর্শক-সমকুলকে সাবধান করে দিলেন যে গপ্পটা কিন্তু আদতে - সে যে যাই বলুক গে - সেক্সপিয়ারের গপ্প (অ্যাঁ? -এর উত্তরে স্তোক – সেক্সও আছে, তবে অল্প!)। ভদ্রমহিলা ভালো টেনেছেন সত্যিই, যদিও লাস্ট সিনে ওনাকে মরন্ত নায়িকার কাছে কেন যেতে দেওয়া হলনা, দুঃখে-তাপে অটো চেপে বসলেন গিয়ে, এই ব্যাপারটা চেষ্টা করেও বুঝলাম না। অন্য সিনের রূপা গাঙ্গুলির মতন করে পাল্লা দিয়ে কাঁদতে পারবেননা, তাই? কিন্তু সে যাই হোক, চেষ্টা করেছেন এবং অনেকটাই উৎরেছেনও!

    ইন্টলারেন্স... “বলছে, শুনছি... দিচ্ছে কি?”

    মানে, সত্যিই বলছি – সিনেমা তো শেষ হয়ে গেলো, কিন্তু কোথায় ইন্টলারেন্স? গোটা কাহিনি জুড়ে যেটুকু বিয়ে-দেব-কি-দেব-না ভাব দেখা বা শোনা গেলো, বিয়ে সেইভাবে ঠিক করতে না চাওয়া সত্ত্বেও দ্যাট ইজ, সেটা নেহাতই বাঙালিদের স্কেলে “ওদের তো ব্যবসা” লেভেলের যাকে বলে ঈষৎ দোনামনা – এর চেয়ে অনেক অনেক ঘোরতর আপত্তি ইলোপের চেয়ে অনেক কম প্রতিরোধে মিটে যায় বিয়ের বাজারে, লাখ কথার চেয়ে অনেক কম কথায়! কোন সাইকোলজিকাল প্রেসার, কোন ডিল্যেমা, কোন হৃদয় বিদারক দোটানা... কোথায়? ইন ফ্যাক্ট – ট্রেলারে দাদীজান অর্থাৎ ওয়াহিদা রেহমানের জবানিতে “ তু সাচমুচ পেয়ার করতি হ্যায়, আব্বু কে কাতিল সে?” – ভুল বুঝেছিলাম, আর সোজা ভেবেছিলাম এইতো জাত-দুশ্মনি, জন্ম -ক্রোধ ইত্যাদি, অর্থাৎ একজন হিন্দু কোন এক কালে কোন এক মুসলিমকে – অবশ্যই অন্যায়ভাবে – মেরেছিল, বা উল্টোটা, তাই আজকে, এখানে, এদেরকে... কিন্তু, ও হরি!! সিনেমায় গিয়ে দেখি ওটা আব্বু নয়, তাব্বু, আর বাক্যটার অর্থ বা আপ্লিকেশনও পুরোই আলাদা। মানে, সত্যিই জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, সারকাস্টিকভাবেও নয়, প্রশ্নাত্মকভাবেই, যে সত্যিই কি জুলি রণজয়কে ভালবাসে, যে কিনা (সেলফ-ডিফেন্স হোক বা না হোক) তায়াবকে মেরেছে...? আরও কি, বাক্যটা এইখানে মোটেই শেষ নয়, সেমিকলনের বাকি অংশটুকু হচ্ছে – যদি ভালবাসে তাহলে নো প্রব্লেম, নো টেনশন, নো চাপ... র‍্যাদার, রাত্তিরে প্যাকিং করে রাখিস, আয়া হেল্প করবে ইলোপ করতে। ভাবুন, দাদিজান ইন সাপোর্ট!! অফ কোর্স এতে কেউ “তুমি সন্ধ্যার মেঘ”-এর যৌবনবতীর ভীষণ স্যুইট ঠাকুমার সকরুণ প্রশ্রয়ের স্বাদ পেলে পেতেই পারেন, কিন্তু যেই জাত-বিদ্বেষে আজও মানুষ মরছে, আজও... সেটা কই?

    ইত্যাদি প্রভৃতি...

    কথাবার্তা ডায়ালগ সব অন্ত্যমিলে ঠাসা, হয়ত নতুনত্বের অথবা ট্রিবিউটের খাতিরে। কিন্তু তার ফলে যে ভীষণভাবে স্বতঃস্ফূর্ততা আহত হয়েছে, তাতে কিন্তু সিনেমার নিজস্ব ছন্দ বেশ খানিকটা ঘেঁটে গেছে। অনেকবার, বার বার, এই তাল কাটল, এইটা মিলল না গোছের অস্বস্তিবোধ ঘুরেফিরে আসছিলো, সেটাকে পাশে সরিয়ে রেখে ডায়ালগের বক্তব্যের প্রতি মনঃসংযোগ করার দায়টা দর্শকদের ওপর একটা নিদারুণ এক্সট্রা প্রেসার। ছন্দ মেলানোর তাগিদে কথ্য ভাষা চলিত ভাষা এক পংক্তিতে ওষ্ঠাগত হয়েছে, ভীষণভাবেই গায়ের (মানে, গলার) জোরে। কিন্তু এই সব কটা কারণের চেয়ে বড় আপত্তির কারণটা হোল – এই ছন্দমিলের ক্ষেত্রে দ্যাট ইজ – এই যে একটা সংলাপ তার বক্তার চরিত্রায়ণের খাতিরে, গল্পের গতি এবং প্রকৃতির কারণে যে স্বাভাবিক এবং স্থান-কাল-পাত্র বিশেষ অনুভূতি দাবী করে, যে ভাবে বললে যে কথাটা যে মানেতে যে যাকে বলতে চাইছে তা বলা হয়ে ওঠে, সেটার সাথে বারবার ঠক্কর খেয়েছে এই রাইমিং-এর অনর্থক চাহিদা। সেই ক্ষতিপূরণটা স্রেফ নতুনত্বের অজুহাতের পক্ষে পূরণ করা সম্ভব নয়।

    আরেকটা কথা, ইন আ সেপারেট নোট – একজন বাউলিনি যখন স্থানে অস্থানে জটা ঘুরিয়ে গান গান, দৃশ্য হিসেবে আলাদা করে মিউজিক ভিডিও বানালে খারাপ লাগবে না নিশ্চই। কিন্তু গল্পের মেজাজ এবং ঘটনার স্রোতের সাথে এই পুরোপুরি অন্য মেজাজ আনার চেষ্টায় ওনাকে দিয়ে (পিরিং পিরিং লাফ সহযোগে) যেটা করানো হচ্ছিল, তাতে গল্প বলায় বিঘ্ন ঘটে অবশ্যই। এটা কি কোনোভাবে মন্দির পুড়ছে আর বাউলিনি দোতারা বাজাচ্ছেন টাইপের অ্যানালজির চেষ্টা...? কি জানি!

    আরও অনেক আপত্তির ঘটনা ঘটল পুরো সময়টা ধরে, সেগুলো থাক। বরং কি কি ঘটল না সেটা বলি – কোন চরিত্রই কেমন যেন ঠিক ডেভেলপ করলো না, কোথাও কোন কঞ্জেকচার বা প্রজেকশন ঘটলো না। কোন একটাও প্রেম, রাগ বা দোটানা এক মুহূর্তের জন্যেও ছুঁয়ে গেলনা, ইন্ট্রস্পেক্সন বা ইমোশনাল কানেক্ট তো বাদই দিলাম। সব কিছুই কেমন বড্ড বেশি সাজানো, বড্ড মেকি, বড্ড জোর করে...

    বড্ড নিন্দে করে ফেললাম, জানি! একটা সিনেমা বানাতে যে দীর্ঘ প্রসেস – এতো লোকজন মিলে একটা স্বপ্ন দেখা আর কুমোরটুলির আর্টিস্টের মতন করেই একটু একটু করে খড়, মাটি, রঙ... একটা চেষ্টা, যেন একটা জন্মগ্রহণের প্রসেস, অল্মোস্ট! সেটাকে নাক সিটকে খারাপ বলতে বিবেকে লাগে, অন্তত আমার লাগে। তাই ভেবেছিলাম লিখবো না, সত্যি বলছি। তবু পারলাম না... লিখলাম, লিখেই ফেললাম। কারণ? কারণ অপর্ণা সেন, আপনি!!

    কারণ – আপনি তো অপর্ণা সেন। আপনার থেকে তো আমরা এই আরশিনগর আশা করিনা!
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ০৮ জানুয়ারি ২০১৬ | ১৯৬০ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    Epitaph - Sinjini Sengupta
    আরও পড়ুন
    বকবকস  - Falguni Ghosh
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • 0 | 132.163.63.145 (*) | ০৮ জানুয়ারি ২০১৬ ০৯:৫৬58122
  • "চারিদিকে এতো সব শোনার পরেও – আদৌ দেখলাম কেন। দেখলাম, তার কারণটা ওই... বাঙালি রক্তদোষ।"

    রিভিউ তো দিব্যি হয়েছে, কিন্তু ওই একই দোষে দুষ্ট কিনা, তাই পশ্শুরোব্বার যাচ্ছি :-)
  • de | 24.139.119.174 (*) | ০৮ জানুয়ারি ২০১৬ ১০:২০58123
  • পার্বতী বাউল আছেন শুনেছিলাম - অসাধারণ তো ওনার গান!

    যাক - রিভিউ পড়ে বুঝলাম যে দেখার চাপ নিতে হবে না -
  • মনোজ ভট্টাচার্য | 113.51.149.52 (*) | ০৮ জানুয়ারি ২০১৬ ১১:৪৭58124
  • শিঞ্জিনি,

    আপনার রসিয়ে রসিয়ে এই আরশিনগরের রিভিউ পড়লাম । আমি আবার দ্বিতীয় দিনের শোতেই দেখেছিলাম । তখনো কিন্তু আমার অপর্ণার ওপর একটু আশা ছিল । হাজার হোক - অনেক ভালো মন্দ বই আমাদের উপহার দিয়েছে !

    আরশিনগর দেখার পর - বুঝতে কষ্ট হল না - অন্য ধান্দা করতে গিয়ে সিনেমার আর্ট কাকে বলে তাও কি ভুলে গেছে । দু দুটো বিখ্যাত সিনেমা থেকে কপি করেও একটা সিনেমা দাঁড় করাতে পারলো না ! একমাত্র শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের অবশ্য খুব ভালো লেগেছে - কাগজে দেখলাম ।

    পুরো একটা সিনেমা - ছন্দে ছন্দে করে - খুব সিরিয়াস সময়েও - যে দাঁড়াতে পারে না - সেটা বুঝতে পারেনি ! সিনেমার নায়ক রোমিও - দৈত্যাকার চেহারার - খুবই দৃষ্টিকটু । - লিখেছে অবশ্য রোমিও জুলিয়েট থেকে নেওয়া - কিন্তু বেশিরভাগ নেওয়া হয়েছে ওয়েস্ট সাইড স্টোরি থেকে । - কপি যেখানে বোঝা যাচ্ছে - সেখানে মন্দ হয় নি । কিন্তু যেখানে মৌলিক দেখাবার ভান করেছে - সেখানেই ডুবেছে ! শেষ দৃশ্যে - যে কত ঝুল - সে আর বলার নয় । বিয়োগান্ত তো হয়েই নি ! বরং হাস্যকর !

    তবে কিছু কিছু ভালো সিকোয়েন্স আছে বৈকি ! - যেখানে বিপরিত গোষ্ঠীর লড়াই - পুরো অপেরাধর্মী - বেশ স্বপ্নময় ! আর রূপার শেষ দৃশ্যে হাহাকার করা কান্না !

    যে জিনিষটা অনেক চেষ্টা করেও বুঝতে পারিনি - সেটা একটা মারাত্মক সিরিয়াস সিকোয়েন্সে - পার্বতী বাউল ওরকম তিরিং বিরিং করে লাফাতে লাগলো কেন ! ওটা কি বাউল নৃত্য !

    নাকি আমাদের নাচালো - পয়সা দিয়ে দেখতে গেছি বলে !

    মনোজ
  • avi | 125.187.41.211 (*) | ০৯ জানুয়ারি ২০১৬ ১০:২৩58125
  • আমাকে এক প্রবাসী বন্ধু সদ্য কলকাতায় এসে খুব ধরেছিল আরশিনগর দেখার জন্য। তাকে জঘন্য রিভিউ পেয়েছি জানানোয় সে আবেগদীপ্ত ভাবে জানালো যে আমরা নাকি নিজেদের মত তৈরি করার জায়গায় বহুদিন চলে এসেছি, নিজে না দেখে কোনো মতামতে প্রভাবিত হওয়া চলে না ইত্যাদি ইত্যাদি। তো তাকে বলতে হল যে, সপ্তাহে ৪-৫টা সিনেমার সব তো আর নিজে দেখে মতামত তৈরি করা যায় না, কিছু জায়গায় নির্ভর করতেই হবে। কিছু রিভিউ পড়ে, সিনেমা না দেখেও কেমন সন্দ জাগে, যেমন আরশিনগরের শীর্ষেন্দুকৃত রিভিউ। আর দ্রোণা বা য়ামলা পাগলা দিওয়ানা ২ হলে গিয়ে দেখে যতটা খারাপ লাগবে, তার চেয়ে অনেক খারাপ লাগবে অপর্ণা সেনের অবক্ষয় দেখলে। তাই, থাক।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আদরবাসামূলক মতামত দিন