এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • অনর্গল সেই আগল খুলে আজ যা যা দেখছি (১)

    উদয়ন ঘোষচৌধুরি লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ | ৮২৬ বার পঠিত
  • “Cinema is a foreign language, a language created for those who need to travel to the other sides of life.”

    আখাম্বা একটা বাড়ি, যেখানে বেড়ে উঠছে একটি শিশু। সে খুব গম্ভীর, চুপচাপ পৃথিবী জরিপ করাই যেন তার কাজ। ‘পৃথিবী’ বলতে ওই বিশাল বাড়ি, তার যুবতী মা, পঙ্গু প্রৌঢ় বাবা, আর এক প্রাচীন চাকর। জন্ম-ইস্তক বাবা তাকে মেরে ফেলতে চায়। বড় হতে হতে সে জানতে পারে, মায়ের স্বামী, যাকে সে ‘বাবা’ ডাকে, লোকটা আদতে ধ্বজভঙ্গ; অতএব যোগ্যতাহীন। মা বোঝায়, ওই চাকরটিই তার প্রকৃত প্রেমিক; স্থানীয় প্রথামাফিক যে কিনা মালিককে ডাকে ‘বাবা’ আর মালকিনকে ‘মা’; সুতরাঙে, চাকরটি শিশুটির ‘ভাই’। মানতে পারে না শিশুটি, যে আর ততদিনে ঠিক তত ‘শিশু’ নেই। রাতবিরেতে চাকরের ঘুপচি ঘরে মায়ের যাতায়াত তার অসহ্য লাগে। সে তো ছোট থেকে ওই পঙ্গুকেই ‘বাবা’ বলে জানে, পাড়াপড়শি সেটাই জানিয়েছে। বিষাক্ত এই বেঁচে থাকায় একদিন দুর্ঘটনায় মারা যায় বাবা। অবৈধ এই কাতরতায় ধুঁকতে ধুঁকতে প্রৌঢ়া হয় মা। মধ্যকৈশোরের সন্তান মেরে ফেলতে চায় চাকরটিকে, মানে, নিজেরই জন্মদাতাকে (জু দউ, ১৯৯০, ঝ্যাং ইমউ ও ইয়াং ফেংলিয়াং)। আর একটা ছুঁচলো প্রশ্ন গেঁথে যায় মনে – দুই পিতা – একজন সমাজমতে, অন্যজন জৈবমতে; সন্তান কেন ঝুঁকছে শুধুই প্রথম জনের দিকে? তাহলে ‘সম্পর্ক’ কি আসলে সেটাই, যেটুকু সমাজ আমাদের শিখিয়েছে? আমরা কি এক নির্দিষ্ট বেড়াজালেই কাটিয়ে ফেলছি এই মোমেলা আয়ুষ্কাল?

    গোঁড়ামি + গেঁড়েমি সরালে, সত্যিটা হল, যে কোনও সম্পর্কের একমেবদ্বিতীয়ম ভিতকাঠি ‘যৌনতা’। যে জ্ঞানে ও অভিজ্ঞানে মা-ছেলে; বাবা-মেয়ে; ভাই-বোন; প্রেমিক-প্রেমিকা। যেখানে অন্তর্লীন বৈধ-অবৈধর রসায়ন, অজাচার-অপরাধের ফর্মুলা। কোনও ঘটনায় বা দুর্ঘটনায়, ধরা যাক, স্বামীর পুরুষাঙ্গ বসিয়ে দিতে হয় ছেলের শরীরে; যে অঙ্গের বৈধ ভোগী স্ত্রী, মানে, ছেলেটির মা। দুর্দম মা উপগতা হয় সন্তানের দেহে। বাবা পোড়ে টানাপোড়েনে, খুন করতে চায় স্ত্রী ও ছেলেকে। ছোট্ট একটা বিছানায় অস্ত্রধারী বাবা, প্রায়-নগ্ন মা, আর নিরুপায় সন্তান যখন ফেটে পড়ে জান্তব গোঙানিতে; দর্শকের গুলিয়ে যায় আদতে কোন অবস্থান ন্যায্য (মোবিয়াস, ২০১৩, কিম কি দুক)। ছাপোষা মনন নিয়ে এরকম ডায়লগহীন দগদগে সিনেমা, বোধ হয়, এখনও আর হয়নি। দেড় ঘণ্টার শেষে পরিচালক ‘সম্পর্ক’ সম্পর্কে ক্লান্ত করে তোলেন আমাদের। ফিল্ম ক্রিটিকস সার্কল অফ অস্ট্রেলিয়া-র আঁদরু শ্যান বলেছেন, “To call Moebius ‘daring’ is actually an understatement, as it is more than that, it is a film that will haunt you, lingers with you and perhaps disturbs you till you never think about it again.”। যে বাবা ধর্ষণ করে পুত্রবধূকে, নিজের ছেলে ও মেয়েকে উদ্দীপ্ত করে সন্তানার্থ সঙ্গমে; ক্লাইম্যাক্সে তাকে ‘শয়তান’ দ্যাখাতে হয়, নচেৎ গণমনতুষ্টি হয় না (দ্য ডেভিল’স অ্যাডভোকেট, ১৯৯৭, টেইলর হ্যাকফোর্ড)। দৃশ্যত আলাদা অথচ স্পর্শত এক হয়েও, পুরুষালি আদিখ্যেতায়, অয়দিপাস যত খ্যাতি পেয়েছে, ইলেক্ট্রা পায়নি। অথচ মেয়েরও তো থাকে বাবার প্রতি চোরাতৃষ্ণা, থাকে মায়ের সঙ্গে আদিম প্রতিযোগিতা। মৃতপিতার সামনে মেয়ে সেই পিপাসা জানায় ভাইকে; আর জেনে আশ্চর্য হয়, ভাইয়েরও রয়েছে মায়ের প্রতি তৃষ্ণা। ধ্বংসই হয় এই খেলাঘরের একমাত্র পরিণতি (ইলেক্ট্রা, ২০১০, শ্যামাপ্রসাদ)। নেশালু কিশোর লিপ্ত হয় সাররিয়াল সঙ্গমে; আধা-রমণে ভ্যাবাচ্যাকা দ্যাখে নিচে শায়িতা শীৎকারিনী তার কল্পতরুণী নয়, নিজেরই মা (গান্ডু, ২০১০, কিউ)। লোমকূপের চোরাবালি ছিঁড়ে ছিটকে ওঠে আমাদের মজ্জাগত যৌন-অকটোপাস।

    ‘সম্পর্ক’ কি প্রাকৃতিক? হতে পারে? যুক্তিগ্রাহ্যতায়, না। ধূর্ত, দীর্ঘায়িত, ও বায়বীয় এক প্রতিষ্ঠান, যার নাম ‘সমাজ’ – ব্যাপারটা তারই ঘিলুপ্রসূত। আমরা যা যা পেতে চাই, আসলে সে সব পাওয়ার ভান দ্যাখাই। হাহাহিহিআহাউহুর মলম আঁকড়ে হায়াৎকে সাজদার চেষ্টা; মানে, আয়ুপ্রণতির ভঙ্গি। মানুষ যদ্দিন ভবঘুরে ছিল, এত টালবাহানা ছিল না। চাষবাস আঁকড়ে থিতু হতেই শুরু হল সম্পত্তির ঝামেলা, যা থেকে নিশ্চিন্ত হতে সমাজ দিল সম্পর্কের প্রস্তাব। নারীকে দেওয়া হল সম্পদের (মতান্তরে, পণ্যের) রূপ, যার কোনও নির্দিষ্ট স্বত্ব + শর্তভোগী থাকবে। যেহেতু একমাত্র নারীই পারে সন্তান ধারণ করতে, সেহেতু তার কন্দরে প্রোথিত বীজ রক্ষার দায়িত্ব নিল পুরুষ। প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমাপে, ব্যক্তি-ইচ্ছাকে ‘থামসাপ’ করে, চাপানো হল একগামীতা ও বহুগামীতার গপ্পো। এল ধর্ম, বর্ণ, জাতির গ্যাঁড়াকল। ফাঁপানো হল ‘প্রেম’ ও ‘মাতৃত্ব’-র মহত্ব। দেওয়া হল ‘পবিত্রতা’-র ধারণা; ‘অন্য’-পুরুষের বীজ যেন গর্ভকে ‘কলুষিত’ না করে, পাহারায় রাখা হল নানান নিয়ম। নিদান হল, নারী বেহাত হলে খুন করো তাকে – ‘অনার কিলিং’। বাবা যুক্তির বুকে যুক্তি সাজিয়ে ছোট ভাইকে দিয়ে কুপিয়ে মারে তরুণী বোনকে; সমাজ ও ধর্ম তাকে সেটাই শিখিয়েছে (ল্যান্ড-গোল্ড-উমেন, ২০১১, অবন্তিকা হরি)। বিয়ের সম্বন্ধ করলে, রক্তপরীক্ষা না করিয়ে, আমরা এখনও যে গুষ্টিকুষ্ঠি আর হাবিজাবি খুঁজি, এর পেছনেও কয়েক হাজার বছরের এই সংস্কার – সমাজ ও ধর্মমতে নিজবীজ রক্ষা। এই কারণেই লন্ডনের মুসলিম বাবা মেয়ের ক্রিশ্চান প্রেমিককে পছন্দ করে না; মেয়েকে বেড়াতে আনে খাইবার পাখতুনখার দুর্গম এলাকায়, জবরদস্তি বিয়ে দ্যায় তুতোভাইয়ের সঙ্গে (খুদা কে লিয়ে, ২০০৭, শোয়েব মনসুর)। কথাবার্তায় আচরণে তুখোড় দার্শনিক ও মারাত্মক নিঃস্পৃহ অন্ধকারের শরতাজ যে লোকটার আঙুলে এক সমান্তরাল শাসনব্যবস্থা, সে যখন জানতে পারে স্ত্রী লুকিয়ে গর্ভপাত করিয়েছে, জন্মাতে দ্যায়নি তার ছেলেকে, অপরাধ-পরম্পরাকে ঘৃণা করে স্ত্রী, জন্ম দিতে চায় না আর কোনও সন্তান; রাগে নিরুপায় হয়ে স্ত্রীকে থাপ্পড় মারে সে, যা আদতে তার চরিত্রবিরুদ্ধ (দ্য গডফাদার ২, ১৯৭৪, ফ্রান্সিস ফোর্ড কোপোলা)। এখানে ঈশ্বরীয় ছাপে প্রচ্ছন্ন পুংদণ্ডের অধিকার। প্রসঙ্গত বলি, নারীশক্তির ফিল্মিজয় নিয়ে যতই নাড়ানাড়ি হোক, নামকরণে ‘মর্দানি’ এখনও ঘোচেনি। নিজেদের প্রবল আধুনিক ভাবলেও, মানসিকতা বেআব্রু হলে আমরা আজও আদিম ও একবগ্গা পুংমুখী। উত্তর প্রদেশের কিছু গ্রামে এখনও সোহাগরাত-উত্তীর্ণ সকালে বিছানার চাদরে রক্তচিহ্ন দর্শাতে হয় দুলহনকে, কৌমার্য-ছিন্নের পরীক্ষায়। আফঘানিস্তানের কিছু জায়গায় পুত্র-জন্মদান আজও সামাজিক গৌরব; বাবা-মা লজ্জায় বাধ্য হয় কন্যাসন্তানকে ‘ছেলে’ সাজিয়ে রাখতে, এমনকি বয়ঃসন্ধির পরেও (তথ্যসূত্র : দ্য আন্ডারগ্রাউন্ড গার্লস অফ কাবুল, জেনি নর্ডবার্গ)।

    (ক্রমশ)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ | ৮২৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। সুচিন্তিত প্রতিক্রিয়া দিন