এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • বুদ্ধদেবের ঘুমঘর *

    উদয়ন ঘোষচৌধুরি লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৫ | ৮৯০ বার পঠিত


  • একটানা গোঁগোঁ হাওয়া আর ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। দু জনেই একটা করে গাছের ডাল কুড়িয়েছি, ওয়াকিং স্টিকের বদলে। অন্ধের মতো হাতড়ে পা ফেলছি। রাস্তার শেষটুকু যেন উঁচু হয়ে ঠেলে উঠেছে। বরফের হাঁচোড়-পাঁচোড়ে ক্যারদানিটা কিছু বেশিই। খাদ যথেষ্ট খাড়াই। নিশ্চিত জানি, অল্প এদিক ওদিক পা রাখলেই হড়কে খাদে ঢুকে যাব। সিঙ্গালিলার জঙ্গলে ঝিঙ্গালিলা জন্তু-টন্তু বেরিয়ে আসা বিচিত্র নয়। হঠাৎ অনেকটা ওপরে একটা আলোর চলাফেরা, কিছু যেন কেউ বলছে। হ্যাঁ, ওই তো বাপির হেডটর্চ, আমাদের খুঁজছে। চেঁচিয়ে সাড়া দিই, আওয়াজ ওদিকে পৌঁছয় না। একসময় মুখোমুখি, আলোর ভরসা পেয়ে সোয়াস্তি। আরও ওপরে দেবুদা দাঁড়িয়ে। সামনে আর্মি ক্যাম্পের টিমটিমে আলো। আটটা বাজে। দুর্যোগের আদিমতায় সব শুনশান। নিঝুম হোটেলগুলো ডুবে আছে ফুট দুয়েক বরফে। ছেঁড়াখোঁড়া মেঘে নক্ষত্রদের জলসা। বাপি এসে আগেই একটা থাকার ঘর জুটিয়ে ফেলেছে। থ্রি-বেডেড খুপরিতে চারজনের ঠাঁই। পৌঁছে-যাওয়া মাত্র চন্দ্রানীর তিড়িংবিরিং শুরু। কোত্থেকে একটা সান্তাক্লজের টুপি জুটিয়েছে, সেটা পরে লাফায় খানিক। অতঃপর ডিনারে গরম ডাল-রুটি সাঁটিয়ে জানলার ফুটোয় কম্বল গুঁজে খুশিয়াল ঘুম।

    সকালে ঘনঘোর মেঘ। সঙ্গে কাঁদুনে বরফ। দাপুটে হাওয়ায় বরফকুচিরা ঢুকছে ঘরে। আমি গ্লাভস নিয়ে যাইনি, বেকায়দায় তালু ঘষে ঘ্যাম নিচ্ছি। এদিকে আর-এক কেলো, হোটেলের মালিক এক বালতির বেশি জল দিচ্ছে না। দুর্যোগের দুনিয়ায় তার পাইপে জল উঠছে না, নিচে থেকে টেনে তুলতে হচ্ছে। অধঃপতনের দিকে আঙুল দেখিয়ে সে যা বোঝাল, মনে হল, এখান থেকে প্রায় গঙ্গাসাগরের ডিসট্যান্স। ওদিকে দেবুদা পার্শ্বঘরবাসিনী দুই মেম-যুবতী পেয়ে খুশগপ্পে মশগুল। বাপি উলটো দিকের জানলায় একটি সানগ্লাসিনীকে দেখে আপ্রাণ তেষ্টায় স্মার্ট। সাহায্যের আশা-লতা কিছুই না পেয়ে সঙ্গে আনা নিউজ-পেপার নিয়ে টয়লেটে ঢুকি। বুঝতে পারি, মানবসভ্যতায় কাগজের ব্যবহার এখনও অনেক দিন টিকবে।

    সান্দাকফু থেকে এভারেস্ট, কাঞ্চনজঙ্ঘা, লোৎসে, আর মাকালু দ্যাখা যায়। সামনের শৈলমালাকে বলে ‘স্লিপিং বুদ্ধ’, একসঙ্গে দেখলে মনে হয় যেন শ্বেতশুভ্র বুদ্ধ শুয়ে ঘুমোচ্ছেন। এই ধুমাধার মেঘালু পরিবেশে ক্যামেরা বের করে কোনও লাভ নেই, কিছুই ঠাওর হয় না। হোটেলের দেয়ালে টাঙানো ছবিতেই বুদ্ধকে ঘুমোতে দেখি। উনি নিশ্চিন্তে ঘুমোন, আমি বরং ব্রেকফাস্ট সেরে ছাতা মাথায় নামার রাস্তা ধরি। আজ পৌঁছতে হবে তুমলিং, এখান থেকে উনিশ কিমি। জীবনে কখনও নিচে যাওয়ার মধ্যেও কোনও তৃপ্তি যে লুকিয়ে থাকতে পারে, সেটা একমাত্র এই পাহাড়ে উঠলেই বোঝা যায়।

    বিকেভঞ্জন থেকে বরফ তীব্রতর। শশী কপুরের প্রেমাতুর দৃশ্যের মতো, অবিরল ঝরঝর। হাতে, মাথায়, জুতোয় বরফদানা। রাস্তায় কোথাও আঠালো বরফ-কাদা, কোথাও হার্ড-আইস। হার্ড-আইস এক অতি মারাত্মক জিনিস। স্বচ্ছ কাঁচের মতো, দেখে বোঝাও যায় না। পা পড়লেই নিমেষে পপাত, ঠ্যাং ভাঙা বা মাথা ফাটার জন্যে যথেষ্ট। তার মধ্যেই বাপি আমাদের মার্চপাস্ট করিয়ে স্নো-ফলের ভিডিও নেয়। রক্ষে এইটুকু যে, এদিকের রাস্তা অনেক চওড়া আর কম খাড়াই। কুঁড়ে পর্বতপ্রেমীদের জন্যে এদিক দিয়ে ল্যান্ডরোভার চলে। কালপোখরি পৌঁছে চা-ডিমভাজা খেতে খেতে পর দিনের আমোদটা ছকা হল, তুমলিং থেকে টংলু উঠে ধোত্রে হয়ে নামব। শুনেছি, ধোত্রের পথে ঘন গাছগাছালি – আমার লোভটা তাই কিছু বেশিই। বাইরে বরফ এতক্ষণে থেমেছে, তবে মেঘ জমাট। কালপোখরির মিশকালো জলে প্রেম ফোটাচ্ছে মেঘমল্লার। দেখতে না দেখতে নেমে এল বৃষ্টি। গা ও গায়ের বরফদানা ঝেড়ে তার ভেতরেই আবার শুরু হাঁটা।

    গৈরিবাস পর্যন্ত হুড়মুড় বৃষ্টি। আমার জগার্স চপচপে। তবে পাহাড়ি বৃষ্টির মজা হচ্ছে, একবার থামলে শুকোতে সময় নেয় না। দেবুদার সঙ্গে বাপি এগিয়ে গেছে। পেছনে আমরা দু জন। ধীরে সুস্থে পা ফেলছি। গৈরিবাসের আর্মি ক্যাম্পের পাশে এক সৈনিক মাছ ধুচ্ছে, দুপুরের আয়োজন। এখান থেকে জৌবাড়ির পথ খাড়াই আর গাম্বাট এবড়োখেবড়ো পাথর। খারাপ ওয়েদারের জন্যে পথ একদম ফাঁকা, ওপরে উঠতে কেউই বোধ হয় সাহস নিচ্ছে না। তাতে আমাদের আনন্দ দ্বিগুণ। যত দূর চোখ যায়, নিঃসীম শিলালিপি। যত দূর বুক যায়, অপরিসীম নিঃশ্বাস। পেছন থেকে গান ভেসে আসে। দেখি, পেটাই স্বাস্থ্যের এক যুবক। পরনে পুরনো বেলবটম। হাতে ঢাউস ব্যাগ। পকেটের মোবাইলে কিশোর কুমার। দূরের কোনও গ্রামে থাকে। নেপালি আশ্রিত নয়, একদম খাঁটি বাংলা বলে। এদিকের হোটেলে আর আর্মিদের কাছে মাছ বিক্রি করে। আশ্চর্য হয়ে যাই তার পেশার মাধুর্যে। ভোর থেকে, কিছু না হোক, তিরিশ কিমি স্বচ্ছন্দ একা হেঁটে মাছ দিয়ে যায় রোজ। এমন বাঙালির জন্যে গর্ব হয়। আমাদের ল্যাদ-মার্কা পদক্ষেপে তাল মেলাতে না পেরে একসময় সে বিদায় নেয়। পাথুরে আঁকাবাঁকায় দৃপ্ত মিলিয়ে যায় ‘মুসাফির হুঁ ইয়ারোঁ, না ঘর হ্যায় না ঠিকানা...’।

    ধুঁকতে ধুঁকতে জৌবাড়ি। নেপালের ছোট্ট গ্রাম, যদিও রাজনৈতিক সীমানায় কারুরই কোনও বিশেষ মাথাব্যাথা নেই। পৌঁছে দেখি, বাপি-দেবুদা একটা রেস্টুরেন্টে চা-টোস্ট বলে রেখেছে। আহা, দুপুর তিনটের চোঁচোঁ খিদেয় অমৃত। জৌবাড়ি ছাড়িয়ে আদিগন্ত বুগিয়াল। নেপালের আর্মি ক্যাম্প, এক কামরার কাঠের ঘর, কেউ কোত্থাও নেই। মেঘ সরে গেছে, স্কুল-বালিকার প্রথম প্রেমের মতো মাসুম রোদ্দুর। ঝর্ণায় স্নান করছে পুঁচকে ওয়ালক্রিপার। ক্যামেরা তাক করতেই লাল-কালো বাহারি পালক দুলিয়ে ভীষণ ব্যস্ত উড়ে গেল সে। বিকেল পাঁচটা। দূরে ডান দিকে দ্যাখা যাচ্ছে নীলাদির মায়ের চোর্তেন, ওটাই তুমলিং। নীলাদি এই অঞ্চলের জনপ্রিয় মহিলা। বিয়ে-থা করেননি, স্কুলে পড়ান, নানান রকম উন্নতির কাজ করেন, এবং দারুণ দক্ষতায় একটি হোটেল চালান। আমরা ওখানেই আজ রাত কাটাব। আর হঠাৎ বাঁ দিকে চোখ পড়তেই চমকে যাই। তোলা-উনুনের ধোঁয়ার মতো মেঘকুণ্ডলী ফাটিয়ে উঁকি দিচ্ছে মোলায়েম কাঞ্চনজঙ্ঘা। দিনের শেষ আলোয় তাকে দ্যাখাচ্ছে যেন ছিঁড়ে যাওয়া ভোরবেলার অস্বচ্ছ স্বপ্ন।

    (শেষ)

    * 'আগামীকাল' পত্রিকায় প্রকাশিত
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৫ | ৮৯০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ক্যাবাত বা দুচ্ছাই মতামত দিন