এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • ফোর-ফোর-টু

    সুকান্ত ঘোষ লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬ | ৬৪০ বার পঠিত | রেটিং ৩ (২ জন)
  • আমরা প্রফেশনাল জীবনে কতটা ‘স্বাধীন’, তার কবল থেকে আমাদের ‘মুক্তি’র সংজ্ঞা কি ইত্যাদি ইত্যাদি চর্বিত চর্বণ আলোচনার প্রায় শেষের দিকে এসে সেদিন হঠাৎ করে কয়েক বছর আগে পড়া জনাথন উইলসন-এর (মূলত ক্রীড়া সাংবাদিক) একটি লেখার কথা মনে পড়ে গেল। আপাত দৃষ্টিতে আমাদের শুরুর আলোচনার সাথে ফুটবলের কোন সম্পর্ক ছিল না - কিন্তু কোথা থেকে কি হয়ে গেল – আমার মাথার মধ্যে ‘মুক্তি’ কথাটি গাঁথল এবং তার সাথে প্রফেশনাল জুড়ে থাকার জন্য মনটা হঠ করে ফুটবল-ফুটবল করে আনচান করে উঠল!

    জনাথনের ততদিনে বেশ নামডাক হয়ে গেছে ফুটবল সাংবাদিক হিসাবে এবং তার থেকেও বড় কথা ট্যাকটিক্স নিয়ে আলোচনার জন্যে। খ্যাতির বিড়ম্বনাতে অনেক ফাউ প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। ইতালিতে খেলার কভারেজ করতে গিয়ে ইতালিয়ান ফুটবল ফেডারেশনের একজন তাকে জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা, আপনার কি মনে হয় – ফুটবলারদের কি আর কোনদিন কোচেদের ট্যাকটিক্স থেকে ‘মুক্তি’ দেওয়া যেতে পারবে এবং এমন দিন কি আসবে যে তারা শুধুই খেলবে আবার? সে ঘাবড়ে গেল বেশ – ঠিক বুঝতে পারল না প্রশ্নটা কিংবা বোঝার চেষ্টা করল সে ঠিক বুঝেছে কিনা। আসলে ফুটবল সাংবাদিক হবার জন্য সে জানত যে এই প্রশ্নটি ফুটবলের অন্দরমহলে বিগত কিছু বছর ধরেই ঘুরপাক খাচ্ছে, যেন উইং এ এসে ওয়েট করছে রঙ্গ মঞ্চে প্রবেশ করার জন্য – সময় বুঝে। ভাঙা ভাঙা ইতালিয়ানে সে মিনমিন করে বলে উঠল – মানে, খেলোয়াড়-রাই হল গিয়ে ট্যাকটিক্স এবং ট্যাকটিক্সই আবার হল গিয়ে খেলোয়াড় ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু মনে মনে সে জানত এগুলো আসলেই বাগরম্বর এবং কথার কথা। সময় নিয়ে উত্তর দিতে হলে বরং ফিরে যেতে হবে সেই ভিত্তি প্রশ্নতে – ‘ট্যাকটিক্স’ আসলে কি? এবং ট্যাকটিক্স ঠিক কতটা পরিমাণে ফুটবল খেলার মধ্যে প্রযুক্ত হতে পারে?

    প্রশ্ন সহজ হলেও উত্তর কি আর এত সোজা হবে? কোন খেলা শুরু হবার আগে থেকেই কি পুরোপুরি নিশ্চিত ভাবে বলে দেওয়া যায় যে আজকের খেলার মধ্যে থাকবে ঠিক শতকরা এত ভাগ ট্যাকটিক্স এবং বাকি হল গিয়ে আবেগ, টেনশন, প্যাশন, ব্যক্তিগত স্কিল, মাথা ঠান্ডা রাখার ক্ষমতা, অভিজ্ঞতা, ফুটবলাররের ট্যেকনিক্যালিটি ইত্যাদি ইত্যাদি? যদি দুই দলের ফুটবলাররা স্কিল, ফিটনেশ ইত্যাদি প্রায় এক ভিত্তিক হয়, তাহলে কোন দলের জেতার সম্ভাবনা বেশী থাকবে – যাদের মধ্যে ফুটবলীয় আবেগ বেশী আছে নাকি যারা পেইড মেশীনারীর মত কেবল প্রফেশনাল ফুটবলার কিন্তু ট্যাকটিক্স দিয়ে গাঁথা?

    যদি আরো একটু গভীরে ঢোকা যায় তাহলে দেখা যাবে যে ঐ সাংবাদিক প্রথমে একেবারে ভুল কিছু বলেন নি – আসলে ঘটনা এই যে, ট্যাকটিক্স খেলোয়াড় গড়ে আর খেলোয়াড়দের উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে ট্যাকটিক্স এবং এই দুইয়ের মধ্যে যোগসূত্রটাই খুব গুরুত্বপূর্ণ। খুব সাধারণ উদাহরণ হল – ধরুণ গিয়ে টোট্যাল ফুটবল – আপনি এক আনফিট এবং অসংলগ্ন টিম নিয়ে এই খেলা খেলতে পারবেন না। কিন্তু সেটাই পুরো পুরি সত্যি নয় - আংশিক সত্য কেবল।

    ফুটবল কি চিরদিনই এমন ট্যাকটিক্স নির্ভর খেলা ছিল? আমি ফুটবল ইতিহাসবিদ নই – এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন অনেকে, এবং এই লেখাতেও সেই বিষয়ে কিছু বলার চেষ্টা করব। কিন্তু মোদ্দা কথা হল, ট্যাকটিক্স ছিল আগেও, কিন্তু সেই নিয়ে এতো আদিখ্যেতা ছিল না। এই আদিখ্যতারর কারণ কি? আমার ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয় আরো অনেক কিছুর মত এর পিছনেও আছে তথ্য-প্রযুক্তি – প্রযুক্তির ব্যবহার এবং তথ্যের সহজ লভ্যতা। এ শুধু ফুটবল নয়, বরং প্রায় সব খেলাতেই প্রযোজ্য। তবে ফুটবলে আমি তার সাথে যোগ করব ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের উদ্ভাবন এবং তার প্রায় এক সর্বগ্রাসী প্রসার সারা পৃথিবীতে। এক বিষয়ে কোন সন্দেহ থাকার কথাই নয় যে প্রিমিয়ার লীগ এই মুহুর্তে সব চেয়ে জনপ্রিয় লীগ। আমাদের ছোটবেলায় মেমারীর মত ছোট মফস্বলেও ক্লাবের নাম ছিল জুভেন্তাস! কিন্তু ইতালিয়ান ক্লাবগুলি হারিয়েছে তাদের সেই ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর – মারাদোনা চলে যাবার পর কোন পাড়ার ছেলে আর তাদের ক্লাবের নাম রাখে নেপোলি?

    কিন্তু আমরা আবার এও দেখব যে প্রিমিয়ার লীগ সবচেয়ে জনপ্রিয় হলেও ফুটবল ট্যাকটিক্স এর ক্ষেত্রে গত পঁচিশ বছরে এই লীগের অবদান কি সেই নিয়েও সন্দেহের অবকাশ থেকে যাচ্ছে। অনেকে যুক্তি দেন, যা কিছু আলোচিত নতুন যুগের ট্যাকটিক্স তার প্রায় কোনটারই আঁতুর ঘর প্রিমিয়ার লীগ নয়! সেই প্রথম দিকে ছিল ম্যাচ-অব-দ্যা-ডে যেখানে আলোচিত হত হাইলাইটস এর শেষে কিছু ট্যাক্টিক্যাল আলোচনা। তাও সে কত ক্ষণ? আর কেমন করেই বা? মাঠের গোললাইনের সমান্তরাল লাইন টেনে দেখানো হত ডিফেন্স কত নিচে নেমে খেলছে বা পুস করছে। মাঝে মাঝে আয়তক্ষেত্র মাঝেমাঠ বা পেনেল্টি বক্সে এঁকে দেখানো হত কত ফাঁকা জায়গা আছে বা সব ডিফেন্ডার কেমন এক জায়গায় জড়ো হয়ে স্ট্রাইকারকে খালি ছেড়ে দিয়েছে। আবার মাঝে মাঝে ফ্রীজ ফ্রেম করে দেখানো হত যে ডিফেন্ডারের কেমন ভাবে স্ট্রাইকারকে ইনসাইডে আসতে দেওয়া উচিত হয় নি, বা সাইড ব্যাক ওভার ল্যাপে গিয়ে আর ফিরে আসে নি, মাঝমাঠ থেকে কেউ সুইপ করছে না, কেউ ট্যাকেল করতে গিয়ে তাড়াতাড়ি কমিট করে বসে আছে, কেউ একটাও ভালো ক্রশ করতে পারছে না – স্ট্রাইকারের কাছে বলের সাপ্লাই লাইন কেটে গ্যাছে – এই সব আর কি।

    তার পর এল অগুণতি টিভি চ্যানেল – এবং সব চ্যানেলের সাথে জুড়ে থাকা গাদা গাদা ফুটবল প্রোগ্রাম এবং ততোধিক বেশী ফুটবল বিশেষজ্ঞ! জিনিস ভজকট হয়ে গেল – কে কাকে কি ভাবে টেক্কা দিয়ে অডিয়েন্স টানবে সেই মারামারি শুরু হয়ে গেল। কিছু ভালো অ্যানালিষ্ট এল – আর এল প্রচুর বেনোজল। দেখা গেল কিছু পুরানো প্লেয়ার নিজেরা খেলার সময় লেজেন্ড থাকলেও হলেও ফুটবল স্টুডিওতে ঢুকে মুখ খুলে প্রায় লোক হাসাতে শুরু করে দিল। গাদা গাদা নতুন অ্যানালিসিস সফটওয়ার আবির্ভুত হল। বিশাল স্ক্রীণের সামনে দাঁড়িয়ে খেলার আগে, পরে এবং সপ্তাহের নানা সময়ে প্লেয়ার, টিম এবং ট্যাকটিক্স নিয়ে কাঁটাছেঁড়া শুরু হল। প্লেয়ারকে ড্র্যাগ করে পজিশন চেঞ্জ করে বোঝানো শুরু হল। আর্মচেয়ার ফুটবল জনতা বেশ মজা পেয়ে গেল – নানা দিকে শুরু হল ফ্যান্টাসি লীগ জাতীয় জিনিস পত্র। এবার ফ্যান্টাসী লীগ খেলতে হলে ট্যাকটিক্স নিয়ে কিছু জ্ঞান থাকা দরকারী যদি আপনি সিরিয়াসলী খেলতে চান। ইংল্যান্ডে সোমবার ফার্ষ্ট হাফে ইউনিভার্সিটি ল্যাবে কাজ কর্ম বন্ধ হয়ে গেল। শুধু উইকএণ্ডের খেলার আলোচনা এবং ফ্যান্টাসী লীগের ট্যাক্টিক্যাল আলোচনা সাথে প্রিমিয়ার লিগ ফাউ। এবং তার পর স্টুডিও প্রবেশ ঘটল গ্যারী নেভাল-এর!

    খবরের কাগজেগুলিতে ট্যাকটিক্স নিয়ে কলাম তার আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল, অনেক গুলি ট্যাকটিক্স নিয়ে লেখা ব্লগ চালু ছিল এবং ‘ফলস্‌ নাইন’ বা ‘ইনভারটেড উইঙ্গার’ জাতীয় শব্দগুলি গেরস্থ ঘরেও ঢুকে গিয়েছিল। এমন সময় গ্যারী নেভালের ট্যাক্টিক্যাল কাটাছেঁড়া যেন জলন্ত উনুনে আরো কিছু জ্বালানী ছুঁড়ে দিল। এই করতে করতে গিয়ে দেখা গেল কিছু জনতার ট্যাকটিক্স নিয়ে ইন্টারেষ্ট একটু বেশীই এগিয়ে গিয়ে প্রায় অব্‌শেশন-এ পরিণত হল।

    ফিরে আসা যাক আসল প্রশ্নে – ট্যাকটিক্স কি সত্যই এতটা গুরুত্ব পূর্ণ? এই বিষয়ে আমার নিজের মত জনাথন উইলসনের সাথে অনেকটা কাছাকাছি। আমি বিশ্বাস করি না যে ট্যাকটিক্স-ই হল একমাত্র জিনিস যা ঠিক করে দেয় একটা দল কেমন খেলবে বা ট্যাকটিক্স-ই ‘সবসময়’ নির্ধারণ করে দেয় একটা ফুটবল ম্যাচ কেমন দাঁড়াবে। এবং অনেক ফ্যাক্টারের মত ট্যাকটিক্স-ও একটা ফ্যাক্টর – অনেকে হয়ত বলতে পারেন যে একটা অবহেলিত ফ্যাক্টর। আগে উল্লিখিত ফুটবলের আরো অনেক ফ্যাক্টর - আবেগ, টেনশন, প্যাশন, ব্যক্তিগত স্কিল, ক্ষমতা, অভিজ্ঞতা, ভাগ্য – এদের মত ট্যাকটিক্সও হল একটা ফ্যাক্টর। ট্যাকটিক্স-কে আলাদা করে অনেক সময় সনাক্ত করে দেওয়া যায় না কারণ তার সাথে জুড়ে আছে বাকি কিছু ফ্যাক্টর। যেমন একটা ক্লান্ত টিম অবশ্যই আলাদা ভাবে খেলার চেষ্টা করে একটা ফিট টিমের থেকে, একটা টিমের যাদের আত্মবিশ্বাস কমে এসেছে তারা নিশ্চই প্রথম থেকে অলআউট আক্রমণে যাবে না – সবকিছুই একে অপরের সাথে যুক্ত এবং আপেক্ষিক।

    তাহলে সেই ইতালিয়ান কর্মকর্তার প্রশ্নের জবাব কি আমাদের জানা? আমার নিজের মনে হয় আগত বেশ কিছু সময়ে এই ট্যাকটিক্স নিয়ে নাড়াঘাঁটা চলতেই থাকবে এবং প্লেয়াররা প্রায়শঃ কোচের ঠিক করে দেওয়া ট্যাকটিক্স-এর থেকে মুক্ত হতে পারবে না। কারণ বের করা কিন্তু খুব বেশী জটিল নয় – কোন প্লেয়ারই হারতে পছন্দ করে না, তাও আবার যদি সে টপ লেভেলের ফ্যান-ফলোয়ার সহ সেলফ-প্রাইড যুক্ত খেলোয়ার হয়। প্রাইড খেলাতে চিরকালই আছে – সে পেশাদার বা অপেশাদার যাই হোক না কেন। কিন্তু আজকাল তার সাথে যুক্ত হয়েছে বাণিজ্য ব্যাপারটা। খেলা তো আর শুধুমাত্র আনন্দ দেবার খেলা নেই – ছোট বা বড় ক্লাব যাই হোক না কে তারা সিজন শুরুই করছে একটা টার্গেট নিয়ে। কারো টার্গেট টপ ফোর, কারো চ্যাম্পিয়ান্স লীগ কোয়ালিফাই করা আর কারো সেটা জেতা, কারো লীগ জেতা – আরো আবার অবনমন বাঁচানো! আর প্রথমের যদি টার্গেট ঠিক হয়ে যায় – তাহলে সেটা পাবার জন্য রিয়েলেষ্টিক প্ল্যান রাখতে হবে। আর এমন তো নয় যে সব ক্লাব একই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থেকে শুরু করছে! কোন টিমের এক তারকার সপ্তাহের মাইনে, অন্য এক টিমের সবার মাস মাইনের যোগ ফলের থেকে বেশী! তাও আমি বিভিন্ন ডিভীশনের টিমের তুলনা করছি না! তথাকথিত বড় টিমের সাথে সেই লীগের এই শেষের দিকের টিমের।

    আপনি এবার সেই ছোট টিমের কোচ – আপনি জানেন যে বড় টিমের সাথে ওদের খেলা খেলতে হলে আপনার টিম পারবে না। আপনার হাতে কমপিট করার মত অস্ত্র নেই – তাহলে আপনি কি করবেন? যা করবেন, তাই হল হালকা ভাবে বলতে হলে ‘ট্যাকটিক্স’ ঠিক করা। ওদিকে বড় টিমের কোচ জানে যে আপনার মানসিকতা – আপনি কি করতে পারেন, কি ট্যাকটিক্স খাড়া করতে পারেন। কিন্তু সে পুরোপুরি জানে না, আপনিও জানতে দিতে চান না। আপনার প্র্যাক্টিশ সেসনে কারো ঢোকা বন্ধ হয়ে যায়, বন্ধ দরজার ওদিকে আপনি নিজের চাল চালেন। ম্যাচ শুরু হলে বড় টিমের কোচ বুঝতে শুরু করে আপনি কি করছেন – সে অ্যাডজাষ্ট করতে শুরু করে, আপনি রি-অ্যাডজাষ্ট। প্রায় দাবা খেলার মত এক আকর্ষনীর চাল-পাল্টা চাল শুরু হয়। কিন্তু ওই, সে জিনিস উপভোগ করতে হলে আপনাকে দাবা খেলাটা জানা চাই! না হলে আপনার শুধু চোখে পড়বে দুই ব্যাক্তি গালে হাত দিয়ে চুপ করে বসে আছে –

    ট্যাকটিক্স জগতে ‘অ্যাবসলিউট’ বলে খুব কম জিনিস আছে। আমরা কিছু পরে ফরমেশন নিয়ে আলোচনায় ঢুকব। সেখানে দেখব যে প্রায়শই দুই ফমেশনের মধ্যে পার্থক্য খুব কম। ৪-৪-২ এর সাথে ৪-৪-১-১ এর পার্থক্য ঠিক কোনখানে? দ্বিতীয় ট্রাইকার প্রথম ট্রাইকারের ঠিক কতটা পিছনে খেললে ৪-৪-২ হয়ে যায় ৪-৪-১-১? আবার ওয়াইড-মিডফিল্ডার দের পজিশন কতটা এগিয়ে থাকলে এটাই আবার পরিনত হবে ৪-২-৩-১ এ? এবার যদি সাপোর্ট স্ট্রাইকার একটু পিছনে (ডিপ) এসে খেলতে শুরু করে, কিন্তু ওয়াইড-মিডফিল্ডার এগিয়েই থাকে তাহলে কি আমরা এবার সেটাকে এখনো ৪-২-৩-১ বলব, নাকি ৪-২-১-৩ বা এমনকি ৪-৩-৩? আমরা আজকাল দেখি যে ফুলব্যাকরা প্রায়ই উপরের দিকে পুশ করে, এতটাই যে তাদের পজিশন হোল্ডিং মিডফিল্ডারের খুব কাছাকাছি হয়ে যায়। তাহলে কেন আমরা কিছু ৪-২-৩-১ কে ২-৪-৩-১ বলে দাগাবো না? তাহলে দেখা যাচ্ছে যে ফরমশনেও ‘অ্যাবসলিউট’বলে অনেক সময় কিছু থাকে না – যা থাকে তা হল খেলার শুরুতে লাইন-আপ নিয়ে একটা আইডিয়া দেওয়া। এটা এই ফাঁকে বলে দেওয়া দরকার যে আমার কাছে ফরমেশন হল ওভারঅল ট্যাকটিক্স-এর একটা সাবসেট। শুধু ফরেমশন দিয়ে ট্যাকটিক্স হয় না, যদিও ফরমেশন খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা জিনিস ট্যাকটিক্স, মনে হয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্নই। এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে ট্যাকটিক্স এবং ফরমেশন অনেকসময় সমঅর্থে ব্যবহৃত হয়।

    তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে যে শ্রেষ্ঠ ফরমেশন বলে কি আদৌ কিছু হয়? আমার মনে হয় না এমন কিছু হয়। এটা অনুমান করা যেতেই পারে যে যদি শ্রেষ্ঠ ফরমেশন বলে কিছু থাকে তাহলে তাতে অ্যাটাক এবং ডিফেন্স-এর একটা ব্যালেন্স থাকবে। কিন্তু বাকি সব কিছুই নির্ভর করবে বাস্তব প্রেক্ষিতের উপরে – ওই দিক সব ফার্ষ্ট চয়েস প্লেয়ার ফিট কিনা, কার কেমন ফর্ম, প্লেয়ারদের মানসিক অবস্থা কেমন, খেলার পরিবেশ কেমন, সেই খেলা থেকে টিম-এর টার্গেট কি, প্রতিপক্ষ কে, তাদের ফর্ম, ফিটনেস, ফরমেশন ইত্যাদি ইত্যাদি। তাহলে দেখা যাচ্ছে এরা শুধু একে অপরের সাথে সম্পর্ক যুক্তই নয় এবং তার থেকেও আরো বেশী কিছু – সব কিছুই আপেক্ষিক।

    মোদ্দা কথা, আপেক্ষিক-ই হোক আর নন-অ্যাবসলুউট-র হোক, আধুনিক ফুটবলে সফল কোচের ট্যাকটিক্স নিয়ে জ্ঞান থাকা জরুরী। কিন্তু এর ভাইস-ভার্সা টি আবার সত্যি নয় – অর্থাৎ ট্যাক্টিক্যাল জ্ঞান থাকলেই যে সফল কোচ হওয়া যাবে এমন নয়। এই প্রসঙ্গে সেই স্টুডিওতে কাটা-ছেঁড়া করে আলোড়ন সৃষ্টিকারী গ্যারী নেভালের কথাই ভাবা যাক – সেই মনে হয় নিজের এত নাম ডাকে একটু বার খেয়ে গিয়েছিল, নিজেই মনে হয় বুঝতে পারে নি যে সে অ্যান্যালেসিস এত ভালো করতে পারে। যাকে বলে নিজের সাফল্যে নিজেই অবাক – এবার নিয়ে ফেলল একটা এক্সট্রা স্টেপ। স্টুডিওর অ্যানালেসিসকে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতে গেল স্পেনে লা-লীগায় ভ্যালেন্সিয়ার কোচ হয়ে। সেই কোচিং সময়কার গল্প মনে হয় গ্যারী নিজেও মনে রাখতে চায় না – সুখবর যে সেই যন্ত্রনা থেকে মুক্তি হয়েছে। অ্যালেন শিয়েরারকে দেখে যে গ্যারী শেখেনি এটাও একটা তার ভুল বলেই গণ্য করা হবে।

    এবার একটা প্রশ্ন ভাবা যাক – যদি সমকালীন ধারাবাহিক সফল বা বিখ্যাত কোচেদের সফলতার কারণ জানতে চাওয়া হয়, তাহলে কি সর্বপ্রধান কারণ হিসাবে উঠে আসবে তাঁদের ট্যাকটিক্যাল জ্ঞান? দেখা যাক জ্যাবি অলন্সো এক ইন্টারভিউতে কি বলছেন – অলন্সোর উদাহরণ দিচ্ছি কারণ ওই একমাত্র প্লেয়ার যে মর্ডান সময়ের ট্যাক্টিক্যালি বিখ্যাত চার কোচের অধীনেই খেলেছে বা খেলছে – রাফায়েল বেনিতেজ, হোসে মরিনহো, পেপে গুর্দিওলা এবং কার্লো অ্যাঞ্জেলোত্তি। অলন্সোর কাছে জানতে চাওয়া হচ্চিল যে এই চার জনের মধ্যে কে সবচেয়ে ভালো বা এরা কেন অন্যদের থেকে ভালো বলে বিবেচিত হন বা এদের মধ্যে মিল কোথায়। অলন্সো বলছে, “আমার উত্তর শুনলে খুবই সাধারণ মনে হবে, কিন্তু খুব গভীরে আমার মতে এরা সবাই এক একজন লীডার। এরা হচ্ছে সেই ধরণের কোচ যারা খুব ভালো ভাবে জানে কেমন ভাবে প্লেয়ারদের চাপ এবং চিন্তা থেকে দূরে রাখা যাবে”। হয়ত অলন্সোর উত্তরকে জেনারেলাইজ করা যায় না – হয়ত ট্যাকটিক্স এ ভালো হওয়া এতটাই বেসিক জিনিস যে ব্যাক্তিগত সাক্ষাতকারে কেউ আর ওটা নিয়ে মাথায় ঘামায় না। ট্যাকটিক্স নিয়ে কচাকচি পণ্ডিতদের জন্য তোলা থাকে, প্লেয়ারের কাছে কোচের অন্য গুণ বেশী প্রাধান্য পায়।

    প্লেয়ারদের কাছে কোচেরা অন্যভাবে স্মৃতিচারিত হলেও এর পর আমরা দেখব যে পণ্ডিত সমাজ বা ফুটবল অ্যানালিষ্টদের কাছে কোচেরা কিভাবে ট্যাকটিক্স এর জন্য উল্লিখিত এবং প্রশংসিত হন।

    [ক্রমশঃ]

    ঋণ স্বীকারঃ “Inverting the Pyramid: The History of Football Tactics”, by Jonathan Wilson, Orion Books, London, 2014.
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬ | ৬৪০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • + | 92.6.16.193 (*) | ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০২:৩৬51405
  • ফর্মেশন নিয়ে ডিটেলস লেখা চাইঃ)
  • + | 92.6.16.193 (*) | ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০২:৩৬51404
  • পড়ছি। ভালো লাগছে।

    খাপছাড়াভাবে সবাই আমরা বোধহয় খেলা দেখতে দেখতে এরকম মাঝেমাঝে ভেবে ফেলি। কিন্তু গুছিয়ে উঠতে পারিনা।

    তবে এখনো ম্যাচ অফ দ্য ডে দেখেই ট্যকটিক্স বুঝতে হয় আমাকে অন্ততঃ) লিনেকার-শিয়ারার-এর থেকে।

    আরো লেখা আসুক।

    আমার বিশেষ-অজ্ঞের মত -

    ট্যাক্টিকসের কচকচানির হাত থেকে বেরোতে গেলে কয়েকজনকে কোচ চাই।

    রোনাল্ডিনহো- কোলো টোরে- মারাদোনা- ইব্রা- বালোতেলি

    এরা একসাথে কোচিং করালে, কোনো ট্যাকটিক্স থাকবেনা স্যিওর
  • Robu | 11.39.57.205 (*) | ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০২:৫৬51406
  • বাহ, চমতকার লাগছে।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে মতামত দিন