এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • সত্যিটা

    স্বাতী রায় লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ৩০ অক্টোবর ২০১৯ | ১৩৩৫ বার পঠিত
  • প্রায়-শূন্য করিডোর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল তমালী। করিডোরের প্রান্তে হেডমিস্ট্রেসের ঘর। সেখানে মিটিং আছে। ক’দিন ধরে স্কুলে তোলপাড় চলছে। গুরুতর অভিযোগ। আজ সেই নিয়ে মিটিং। হেডমিস্ট্রেস ছাড়াও ম্যানেজিং কমিটির দু-একজন এসেছেন দেখেছে। আর আসার কথা অবন্তীর বাবা-মা’র। করিডরের পাশেই ছোট লন রোদে ভাজা ভাজা হয়ে এলিয়ে আছে। এক কোণের বকুলগাছটার তলায় একটুকরো ছায়া। তমালীর ইচ্ছে হচ্ছে ওই ছায়াটাতে গিয়ে বসে থাকতে। আসলে তমালীর মিটিংটাতে যাওয়ার ইচ্ছে নেই এতটুকু। তবু যেতে হবে। আক্টিভিটি কো-অর্ডিনেটর সে। নিজের দায়িত্ব কিভাবে এড়াবে!

    অবন্তী বসু। ক্লাস ইলেভেন। এই স্কুলে ভর্তি হয়েছে এ বছরই। এমনিতেই আইসিএসইতে দারুণ নম্বর না পেলে বাইরে থেকে এসে এখানে ভর্তি হওয়া যায় না। ইলেভেন-টুয়েলভে নিজেদের ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়েই ক্লাস ভরে যায়। তাই বাইরের বাচ্চাদের জন্য সিটের সংখ্যাও খুব কম। কাজেই যে কজন শেষ অবধি এসে ঢোকে তারা হল সেরার সেরা। অবন্তীও তাদের দলে। শুধু পড়াশোনায় না, মেয়েটা এক্সট্রা কারিকুলার আক্টিভিটিতেও ভালো। এই ক’দিনেই স্কুলের ডিবেট টিমে জায়গা করে নিয়েছে। সত্যি বলতে কি তমালীর একটু পক্ষপাতিত্বই আছে মেয়েটির প্রতি। ভদ্র, সভ্য, বুদ্ধিমতি মেয়ে। আর খুব ব্যালান্সড। ভালো না লাগার কোন কারণ নেই। আর সব থেকে বড় কথা যে ওদের স্কুলের ডিবেট টিমে এতকাল কোন মেয়ে ছিল না, শুধুই ছেলেদের রাজত্ব – এতদিন বাদে একটা মেয়েকে পাওয়াতে তমালী তো খুব খুশী হয়েছিল। মেয়েটা একটু চুপচাপও বটে। ক্লাসে নতুন বলে বন্ধুবান্ধব তেমন নেই। মন প্রাণ দিয়ে ডিবেট করে। কিন্তু এ যে কি ঝামেলা শুরু হল!

    ঝামেলার সূত্রপাত মিঃ মুখার্জীকে নিয়ে। এই স্কুলে তিনি ভলান্টিয়ার। রিটায়ার্ড জার্নালিস্ট। দেশজোড়া নামডাক।অনেক পুরস্কারও আছে তাঁর ঝুলিতে। আবার নামী ডিবেটরও বটে। তিনি যে স্কুলের বাচ্চাদের কোচ করতে রাজী হবেন, সে তো সৌভাগ্য। অবশ্য এমনি এমনি কি আর হত! নেহাতই বৌ-এর কথায় রাজী হয়েছিলেন। ওঁর বৌ মানে তমালীদের মাননীয়া হেডমিস্ট্রেস। তমালী তো খুব খুশী হয়েছিল। খুশী আরও বেড়েছিল তার পরের থেকেই স্কুলের ডিবেট টিমের ক্রমাগত একের পর এক প্রাইজ জেতায়! তমালী নিজে মিঃ মুখার্জীর ক্লাসে কয়েকবার গিয়ে বসেছে। ভদ্রলোক সত্যিই খুব ভালো কোচ করেন। এমন মোক্ষম সব টিপস শেয়ার করেন যে ছেলেরা সব ওঁর ফ্যান। বিভিন্ন ইভেন্টের দৌলতে মাঝে মাঝেই তমালীর সঙ্গে কথা হয়, যেমন গম্ভীর সুরেলা গলার স্বর, তেমন সুচারু বাচনভঙ্গি। কথা শুনতেও ভালো লাগে। আর কি সুন্দর সব দিকে নজর! একটা শাড়ীর সঙ্গে মানানসই ব্লাউজ পড়লেও নজর এড়ায় না ওঁর। কি সুন্দর করে কমপ্লিমেন্ট দেন! সেই মিঃ মুখার্জীর নামেই কিনা অবন্তী অভিযোগ তুলল। সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের। ওদের সামনে ইন্টারন্যাশনাল ডিবেট কম্পিটিশনের ন্যাশনাল সিলেকশন। এর আগের কবার ওদের স্কুলের টিম নিজেদের জোনে প্রথম হলেও ন্যাশনাল লেভেলে সিলেক্টেড হয় নি। এবার সেজন্য জোর কদমে প্রস্তুতি চলছে। সেই সময়েই তিনি তমালীকে প্রস্তাব দেন যে অবন্তীকে তিনি স্পেশ্যাল কোচিং দিতে চান। সেই স্পেশ্যাল কোচিংএর সময়ই নাকি ওকে কুপ্রস্তাব দিয়েছেন।

    প্রথম অভিযোগটা অবন্তী তমালীর কাছেই করেছিল। তমালী তো শুনে অবাক! বার বার জানতে চেয়েছে, তোমার কোথাও বুঝতে ভুল হচ্ছে না তো? কিন্তু অবন্তীর লাল-হয়ে যাওয়া মুখটা সাক্ষ্য দিচ্ছিল। থেমে থেমে সে জানিয়েছিল, তাকে কি কি বলা হয়েছে। মাথা নীচু করে কথাগুলো বলছিল। তমালী একটু নিজেকে সামলে নিয়ে বলেছিল, “আচ্ছা তোমাকে এখন মিঃ মুখার্জীর ক্লাস আর করতে হবে না। তুমি নিজের ক্লাসে যাও।“ তারপর কি করবে ভাবতে বসেছিল। শেষে অবশ্য ওকে হেডমিস্ট্রেসের কাছে যেতেই হয়েছিল। কি যে অস্বস্তির ব্যাপার! একজন স্ত্রীর কাছে তার স্বামীর নামে এই সব কথা বলা! উনি সব শুনে ওকে শুধু চলে যেতে বলেছিলেন। বলেছিলেন পরে এ বিষয়ে কথা বলবেন। কিন্তু পরের সেই আলোচনা হয়ে ওঠার আগেই অবন্তীর বাড়ি থেকে একটি চিঠি পাঠান হয়। ব্যস তারপর থেকে সব থমথমে। স্টাফ রুম থেকে তমালী টের পায় দফায় দফায় মিটিং চলছে হেডমিস্ট্রেস আর ম্যানেজিং কমিটির মেম্বারদের মধ্যে। আর আজ এই মিটিং।

    মিটিংএ ঢুকে তমালী একটু অপ্রস্তুত হল, ও কাঁটায় কাঁটায় সময়ে এসে ঢুকলেও মিটিংএর মাথারা সব আগেই এসে গেছেন। একটাই বাঁচোয়া ওদের চাইল্ড কাউন্সেলর মিসেস পালিত ঢুকলেন ওর পরে পরেই। তিনি ঢুকতেই কথা শুরু হল। আড়ষ্ট প্রাথমিক পরিচয়ের পরে মিঃ বসু নিজেদের অভিযোগ নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। তমালী তো প্রথমেই অবন্তীর মা’র দিকে তাকিয়ে অবাক, আরে এতো তার ক্লাসমেট বল্লরী। অবন্তী তাহলে বল্লরীর মেয়ে! সেই বল্লরীর মেয়ে, তার কপালেও এই হেনস্থা! যাই হোক মিটিংএ মন দেওয়া দরকার। মিঃ বসু তখন বলছেন, “স্কুল হল বাচ্ছাদের সেকেন্ড হোম। সেখানে যদি বাচ্চারা এমন নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, তাহলে কি চলে? আপনাদের তো বেশ কিছুদিন হল আমরা লিখিত অভিযোগ জানিয়েছি, আপনারা তাহলে কি স্টেপ নিচ্ছেন?” ঘরে নিশ্ছিদ্র নীরবতা। পরের পর্বের জন্য তমালী তৈরি ছিল না।

    খুব ঠান্ডা গলায় হেডমিস্ট্রেস বললেন, “মিঃ বসু আপনি চিঠি পাঠিয়েছেন, আমরা দেখেছি। কিন্তু আপনি কিভাবে নিশ্চিত হলেন যে একটা ষোল বছরের মেয়ে যা বলছে সেটাই সত্যি বলছে? আপনি তো ঘটনাটার প্রত্যক্ষদর্শী নন, তাই না? জানেন তো এই বয়সের মেয়েদের অনেকের একটা অ্যাটেনসন পাওয়ার উগ্র ইচ্ছা থাকে। আপনার মেয়ে তো আগে গার্লস স্কুলে পড়ত, সেখান থেকে আমাদের কোএড স্কুলে এসে এমনিতেই ওর বোধহয় মানাতে অসুবিধা হচ্ছে, ক্লাসে তো কোন বন্ধুবান্ধবও নেই। এমন নয় তো যে অ্যাটেনসন পাওয়ার জন্যে সে এসব বলছে? ” মিসেস পালিতের ঘন ঘন মাথা নাড়া বলে দিচ্ছে এ থিওরীতে তাঁর পুর্ণ সমর্থন আছে।

    মিঃ বসু তো হতবাক। এরকম সম্ভাবনার কথা তিনি বোধহয় আগে ভাবেন নি। তাঁকে চুপ হয়ে যেতে দেখে মুখ খুললেন মিসেস বসু। ঈষৎ বিড়ম্বিত মুখে তিনি বললেন, “ম্যাডাম কি বলতে চাইছেন যে অবন্তী মিথ্যে কথা বলছে? আমার মেয়ে কিন্তু মিথ্যে কথা বলে না। ”

    ম্যানেজিং কমিটির ডঃ পাণিক্কর এবার যোগ দিলেন, সরাসরি মিসেস বাসুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “ সমস্যাটা কি জানেন , আমরা আপনাদের অভিযোগ পাওয়ার পরেই মিঃ মুখার্জীর সঙ্গে কথা বলেছি। উনি কিন্তু বলেছেন যে এমন কিছুই ঘটে নি। আপনারা চিঠিতে ঘটনার বিশদ বিবরণ দিয়েছেন বলে আমরা আলাদা করে অবন্তীর সঙ্গে কথা বলি নি। তবে আমরা সিসিটিভির ফুটেজ দেখেছি – সেখানে শুধু ছবি আছে, কথা বোঝা যাচ্ছে না। ছবিতে তো আমরা আপত্তিকর কিছু পাচ্ছি না। এবার আমরা কি করব বলুন?”

    মিসেস বসু হতভম্ব হয়ে বললেন, “এই রকম একটা জঘন্য ব্যাপারে আমার মেয়ে কেন মিথ্যে কথা বলতে যাবে? কি বলছেন আপনারা?”
    ডঃ পাণিক্কর উত্তর দিতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই মুখ খুললেন হেডমিস্ট্রেস। আবারো সেই শানিত ঠাণ্ডা গলায় বললেন, মিসেস বসু, আপনার বায়োডেটাতে দেখেছি আপনার পড়াশোনা দুর্গাপুরে, বোধহয় বাণীকন্ঠ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে ইলেভেন-টুয়েলভে পড়তেন, তাই না? ১৯৮৫ র ব্যাচ?”

    তমালীরও স্কুল, তারই ব্যাচ । বল্লরীও ইলেভেনে এসেই ভর্তি হয়েছিল তমালীর স্কুলে, সায়েন্সে আর তমালীর ছিল আর্টস। আলাদা সেকশন। একসঙ্গে ক্লাস তারা প্রায় করেই নি। শুধু বাংলা-ক্লাস হত একসঙ্গে। সে কত যুগ আগের কথা।

    বল্লরী মাথা নাড়ছে। হ্যাঁ সে ১৯৮৫ সালের পাস-আউটই বটে। হেডমিস্ট্রেস জানতে চাইছেন, “নিবিড় দাশগুপ্তকে মনে আছে, মিসেস বসু? সেই যিনি আপনার মিথ্যে অভিযোগের জেরে আত্মহত্যা করেছিলেন, চিঠি লিখে রেখে গিয়েছিলেন যে সব মিথ্যে কথা! কি করে সে কেস ধামাচাপা দিয়েছিলেন আপনার বাবা? কত টাকা খাইয়েছিলেন পুলিশকে? ”

    বল্লরীর মুখটা পাংশু হয়ে যায়। তমালীর চোখের সামনে এক ঝলকে ফিরে আসে ক্লাস ইলেভেন। নিবিড়বাবু। তাঁদের বাংলার শিক্ষক। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস পড়াচ্ছেন।
    “দিনে দিনে উন্নত পয়োধর পীণ
    নিতম্ব বাড়ল, মাঝ ভেল ক্ষীণ”
    ক্লাসের পিছন থেকে ভেসে এল বেড়ালের ডাক। নিবিড় বাবুর ভ্রুক্ষেপ নেই।ওঁর সমস্ত মনোযোগ ক্লাসের প্রথম দুটো সারির বেঞ্চ-এ। সেখানে বসে ক্লাসের গোটা বারো মেয়ে। পয়োধর শব্দের ব্যাখ্যা করে বোঝাচ্ছেন। ওরা মেয়েরা অখন্ড মনোযোগে বইএর দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ মুখ তুলছে না। গোটা ক্লাস ধরে চলল এই সরস ব্যাখ্যা। ছেলেদের মধ্যে থেকে কে যেন জানতে চাইল, “স্যার মেয়েদের স্তনকে দাড়িম্ব-সম বলা হয়েছে কেন?” স্যার প্রবল উৎসাহে বললেন, “আজ তো সময় ফুরিয়ে গেল। পরের দিন ব্যাখ্যা করব, মনে করিয়ে দিস।” ক্লাস শেষের ঘন্টা পড়তে মেয়েরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। নিবিড়বাবু যে এই রকম তা সবাই জানত। সব মেয়েরা ওঁকে এড়িয়ে চলত। বল্লরী ছিল নতুন মেয়ে, ওকে আর কেউ সতর্ক করে দেয় নি। অবশ্য বল্লরীর সঙ্গে বিশেষ ভাবও ছিল না ওদের। সাকুল্যে একটাই তো ক্লাস ছিল একসঙ্গে। কতই বা ভাব জমবে! তারপর তো একদিন স্কুলে ফিসফাস, গুজগুজ। ইন্টারক্লাস কাবাডি ম্যাচে খেলতে গিয়ে বল্লরীর উপর-হাতে অনেকটা কেটে গিয়েছিল। তার ফার্স্ট-এইড দিতে দিতে নিবিড়বাবু অপ্রয়োজনে বল্লরীর শরীর ছুঁয়েছেন। বল্লরী কাঁদতে কাঁদতে গিয়ে গৌরীদিকে জানিয়েছে। মেয়েরা সবাই জানত নিবিড়বাবুর স্বভাবের কথা – কিন্তু কেমন যেন দুভাগ হয়ে গেল তারা এই ঘটনার পরে। একদল বলল, “ন্যাকা মেয়ে, কেন গেছিল ও একা একা ফার্স্ট এইড নিতে? কাউকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারে নি?” আরেকদল বলল, “বারে! তাই বলে একটা লোক স্কুলের মধ্যে এইসব করবে?”

    কিন্তু পুরো খেলাটা ঘুরে গেল নিবিড়বাবু স্যুইসাইড করায়। চিঠি লিখে রেখে গেলেন সব নাকি মিথ্যে অভিযোগ। এবার সবাই খড়গহস্ত হয়ে উঠল বল্লরীর উপর। একজন শিক্ষক, বিবাহিত সংসারী মানুষ – দুদিনের একটা বাইরের স্কুল থেকে আসা মেয়ে তার নামে এমন মিথ্যে অভিযোগ আনে! পুলিশ ক’দিন স্কুল চত্ত্বরে বার বার এল! টিচারদের সঙ্গে দফায় দফায় কথা বলল। নিবিড়বাবুর স্ত্রীও স্কুলে এসেছিলেন একবার। গৌরীদির সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলেছিলেন। কেস-টেসও হয়েছিল।কিন্তু তার আর কি হয়েছিল তমালীর সেটা জানা নেই। বল্লরী বোধহয় তারপর থেকে আর স্কুলেও আসে নি। একেবারে ক্লাস টুয়েলভে এসে টেস্ট পরীক্ষা দিয়েছিল। রেজাল্ট তেমন ভালো কিছু করে নি। আর দেখাও হয় নি। কে যেন পরে বলেছিল ওর বাবা অন্য কোথাও ট্রান্সফার হয়ে গেছেন। বাড়ির সকলে চলে গেছে সেখানে।

    বল্লরীর মুখে আর কোন কথা নেই। মিঃ বসু কেমন হকচকিয়ে গিয়ে বলেন, “এসব আপনি কি বলছেন ম্যাডাম?”

    হেডমিস্ট্রেস বলেন, “ঠিকই বলছি মিঃ বসু। আপনি বোধহয় ব্যাপারটা জানেন না মনে হচ্ছে। বাড়ি গিয়ে আপনার মিসেসকে জিজ্ঞেস করে দেখবেন। আমার কাজিন ওই স্কুলে পড়ত। আমি তার কাছেই শুনেছি ঘটনাটা! ছিঃ ছিঃ – একে তো কোল্ড ব্লাডেড মার্ডার বললেও কম বলা হয়! ”

    সারা ঘরে একটা গুঞ্জন ওঠে। সবাই এক যোগে ছিছিক্কার তোলে! মিঃ বসু মাথা নিচু করে বসে। বল্লরী কি একটা বলার জন্য মুখ খুলতেই মিঃ বসু তাকে থামিয়ে দিয়ে হেডমিস্ট্রেসকে বলেন, “আমি তো এসবের কিছুই জানতাম না। আমি অত্যন্ত দুঃখিত। অবন্তীর ব্যাপারে মিঃ মুখার্জী বলেছেন যে এসব কিছুই ঘটে নি? কি আর বলব! আমি সারাদিন অফিসে থাকি। মেয়ে বাড়ি এসে কান্নাকাটি করল, মেয়ের মাও তাতে সায় দিল, তাই আমি ভাবলাম, কিছু একটা ঘটেছে। কিন্তু এখন তো আর কি ঠিক, কি ভুল তাই বুঝে পাচ্ছি না। মেয়ের সঙ্গে আমি কথা বলে নেব। তবে চিঠিটা আমি উইথড্র করে নিতে চাই। সে সুযোগ কি দেবেন ম্যাডাম?”

    ভদ্রলোকের শক্ত হয়ে যাওয়া মুখটা দেখে বল্লরীর জন্য মায়া হয় তমালীর। বোকাটা বরকে এতবড় একটা ব্যাপার আগে জানায় নি! কে জানে কতটা ওপেন সম্পর্ক ওদের!

    হেডমিস্ট্রেস ক্ষমার হাসি হেসে বলেন, “বাচ্চারা ভুল করেই থাকে। সেটা সংশোধনের জন্যেই আমরা এখানে আছি মিঃ বসু। অন্য স্কুল হলে কি করত জানি না , আমরা আপাতত এটা নিয়ে আর মাথা ঘামাচ্ছি না। তবে ভবিষ্যতে এরকম চিঠি লেখার আগে আপনি একটু সতর্ক হবেন। আপনি বরং আর একটা চিঠি দিয়ে দেবেন আগের চিঠিটা উইথড্র করছেন বলে, তাহলেই হবে।” ডঃ পাণিক্করও সায় দেন তাতে।

    ব্যস মিটিং খতম। তমালী বেরিয়ে আসছিল ঘর থেকে। অবন্তীর লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া মুখটা মনে পড়ে। সব মিথ্যে? কি জানি! কিছুই করার নেই তার। বল্লরী কোন রকমে খড়কূটো আঁকড়ে ধরার মত গলায় বলে, “তমালী তুই তো সেদিন আসছিলি আমার সঙ্গে ফার্স্ট-এইডের ঘরে, তুই কিচ্ছু দেখিস নি? বল না সবাইকে সত্যি কি হয়েছিল?”

    আধ-খোলা দরজার নবে হাত রেখে তমালী চুপ করে দাঁড়িয়ে পড়ে। শুধু সেই জানে সত্যিটা! সত্যিই বল্লরীর সঙ্গে সেদিন ছিল সে, জল খাওয়ার জন্য দাঁড়িয়েছিল দু-মিনিট। বল্লরী এগিয়ে গিয়েছিল ফার্স্ট-এইড ঘরের দিকে। কলের থেকে জল খেয়েই ও –ও গিয়েছিল সে ঘরে। তবে ঢোকে নি , দরজা থেকেই পালিয়ে গিয়েছিল। বাড়ি গিয়ে মাকে বলেছিল, মা হিসহিসিয়ে ধমক দিয়ে বলেছিলেন, যাই দেখে থাকো, এসব নোংরা ব্যাপার নিয়ে একদম মুখ খুলবে না। খবরদার। মুখ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তমালীর। আজ কি বলতে পারবে সত্যিটা?

    মুখ তুলে চাইতেই দেখে হেডমিস্ট্রেস হিমশীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ওর দিকে। আর দরজা খোলার শব্দে উঠে দাঁড়িয়েছে বাইরের হলে অপেক্ষা করে থাকা অবন্তী - ম্যামদের উপর অনেক ভরসা তার।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ৩০ অক্টোবর ২০১৯ | ১৩৩৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • স্বাতী রায় | 236712.158.786712.59 (*) | ৩০ অক্টোবর ২০১৯ ০৫:১৭51279
  • মেয়েরা সেটা পারলে তো কথাই নেই, কিন্তু সেও তো মেয়েদের জন্ম থেকে শেখানো হয় মারামারি ভালো মেয়েরা করে না! নিজের রক্ষার ভার নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে সবাই - এর থেকে ভালো স্বপ্ন আর কি হয়!

    তবে আমাদের জেনারেসনের অনেক অভিভাবকরাও বড্ড গন্ডগোলের ছিলেন কিন্তু। আমাদের জেনারেসনে কিছুটা শুধরেছে।
  • | 237812.68.454512.114 (*) | ৩০ অক্টোবর ২০১৯ ১০:৫৫51278
  • হ্যাঁ এরকমই হয়। ঠিক এইরকমই হয়। এইভাবেই মেয়েগুলো প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সব লজ্জা মাথায় নিয়ে চলে।
    এইজন্যই আমি সব মেয়েদের মারধোর দেবর জন্য হাত পা চালু রাখার প্র্যাকটিসের পক্ষপাতী।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে মতামত দিন