এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • জোড়াসাঁকো জংশন ও জেনএক্স রকেটপ্যাড-৯

    শিবাংশু লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২৪ মে ২০১৯ | ১১৭৮ বার পঠিত
  • আমি যে গান গেয়েছিলেম, মনে রেখো…।

    '.... আমাদের সময়কার কথা আলাদা। তখন কে ছিলো? ঐ তো গুণে গুণে চারজন। জর্জ, কণিকা, হেমন্ত, আমি। কম্পিটিশনের কোনও প্রশ্নই নেই। ' (একটি সাক্ষাৎকারে সুচিত্রা মিত্র)

    বাবার কাছে গল্প শুনেছি। সাতচল্লিশ-আটচল্লিশে সেন্ট পলস কলেজে পড়াকালীন তিনি সেখানে ছাত্রসংগঠনের সাংস্কৃতিক সচিব ছিলেন। সেই সময় ভবানীপুরের দীর্ঘ সুদর্শন ছেলেটি, যে গল্প লেখে ( দেশ পত্রিকাতে ইতোমধ্যে তাঁর গল্প প্রকাশিত হয়ে গেছে) আর আবাল্য বন্ধু 'গায়ক' সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের চাপে এদিকওদিক গান গেয়ে বেড়ায়, তার কাছে বাবা'রা গিয়েছিলেন ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে কলেজ সোস্যালে গান গাইবার অনুরোধ নিয়ে। ততোদিনে অবশ্য তার বেশ কিছু রেকর্ডও করা হয়ে গেছে, শৈলেশ দত্তগুপ্ত, কমল দাশগুপ্তের সুরে। ১৯৪৪ সালে সে নিজের সুরে প্রথম রেকর্ড করে, '' কথা কয়োনাকো, শুধু শোনো''। মোটামুটি এই সময়েই 'প্রিয় বান্ধবী' ছবিতে তার গাওয়া ''পথের শেষ কোথায়....'' বিশেষ লোকপ্রিয়তা পেয়ে যেতে কলাম্বিয়া কোমপানি তাকে দিয়ে একটি রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড করেছিলো। দু'টি গান, ''আমার আর হবে না দেরি'' আর '' কেন পান্থ এ চঞ্চলতা'' সত্তর বছর পরেও একুশ শতকের মানুষ শোনে। জর্জদা বলতেন, হেমন্ত রবীন্দ্রসঙ্গীতের সেকেন্ড হিরো। প্রথম হিরো ছিলেন অবিসম্বাদী পঙ্কজকুমার।

    অনুষ্ঠানে পৌঁছোতে একটু দেরি হয়েছিলো যুবকটির। সেই শাদা হাতা গুটোনো শার্ট আর ধুতি, দীর্ঘ পদক্ষেপ। এসেই সোজা মঞ্চে, পর্দা ওঠার আগেই গান ধরা হয়ে গেলো তাঁর, '' আমার আর হবেনা দেরি ......'' । বাবার ভাষায় কলকাতার সতত অতিকথনশীল, প্রগলভ ছাত্রদল মূহুর্তে নিশ্চুপ। গায়নভঙ্গি পঙ্কজকুমারের মতো, কিন্তু পেশকারি অনেক আধুনিক । আর তাঁর কণ্ঠসম্পদ ? শৈশবকাল থেকে অসংখ্যবার শোনা ''আমার আর হবে না দেরি'', যা আমাদের শ্রবণে প্রায় একটি নৈসর্গিক সম্পদ, সম্পূর্ণ ভিন্ন মনোনিবেশ নিয়ে শুনছি এখন। এই গানটি রেকর্ড করার সময় হেমন্তের বয়স ছিলো মাত্র চব্বিশ বছর। তাঁর উচ্চারণ, ডিক্শন, সুর লাগানো, লয় ধরে রাখার পরিণত সামর্থ্য এবং সর্বোপরি সংযমবোধ, রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনের এক নতুন ভাষ্য তৈরি করতে পেরেছিলো। মনে রাখতে হবে এই সময়কালে জর্জদা'র কোনও একক রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড প্রকাশিত হয়নি।

    হেমন্তের 'শিক্ষক' বলতে শৈলেশ দত্তগুপ্ত, যাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রশিক্ষণের কোনও বিশেষ অভিজ্ঞতা ছিলো বলে জানা যায়না। সাহানা দেবী, কনক দাশের রেকর্ড হয়তো শুনেছিলেন তিনি, কিন্তু তাকে তালিম বলা যায়না। তিনি ছিলেন পঙ্কজকুমারের 'কানশুনি' শাগির্দ। অভিজাত বৃত্তের বাইরে সাধারণ শ্রোতারা যে দুজন অসাধারণ শিল্পীর রবীন্দ্রসঙ্গীতকে নিজের বলে গ্রহণ করেছিলেন, সেই পঙ্কজকুমার মল্লিক আর কুন্দনলাল সহগল ছিলেন তাঁর পথপ্রদর্শক। কিন্তু আজ একই সময়ে এই তিনজনের গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড শুনলে বেশ বিস্ময়বোধ হয়। যখন দেখি পঙ্কজকুমার তাঁর গায়নে, বিশ শতকের প্রথম ও দ্বিতীয় দশকের শিল্পীদের মতো সুর লাগানোর রেশ পুরোপুরি এড়িয়ে যেতে পারছেন না। যদিও রবীন্দ্রসঙ্গীতে স্পষ্ট উচ্চারণের যে বাধ্যতা পরবর্তীকালে অবশ্যকৃত্য হিসেবে স্বীকৃত হয়েছিলো, তার ভগীরথ ছিলেন পঙ্কজকুমার । এ ছাড়া কুন্দনলালের বাংলা উচ্চারণের মধ্যে অনুকরনীয় নিশ্চয় কিছু ছিলোনা এবং তাঁর সুর লাগানোর ধরনটি ছিলো একান্তভাবে উর্দু গজলের ধাঁচে। এই দুজন 'দ্রোণাচার্যে'র রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনার অভিজ্ঞতা স্বীকার করেও হেমন্ত কিন্তু সম্পূর্ণ নিজস্ব এবং সেকালের পক্ষে প্রায় চমকে দেওয়া একটা পরিশীলিত পরিবেশনার নমুনা পেশ করে ছিলেন। অথচ মজার কথা, তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়ন পারদর্শিতার যে বিপুল স্বীকৃতি তিনি পেয়েছিলেন সাধারণ আম শ্রোতার থেকে, তার ভগ্নাংশ সাধুবাদও তিনি পান'নি 'এলিট' শ্রোতামহল থেকে।
    আশির দশকে স্বয়ং সত্যজিৎ রায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের লোকপ্রিয় শৈলী বিষয়ে আলাপচারিতায় সুভাষ চৌধুরিকে বলেছিলেন, ''.... এক এক জন exceptional গায়কের গলায় আমরা গানের (রবীন্দ্রসঙ্গীতের) সুন্দর চেহারাটা বা শ্রেষ্ঠ চেহারাটা খুঁজে পাবো। অন্যদের ক্ষেত্রে পাবোনা এবং বিচারটা সব সময়েই Bestকে দিয়ে হবে। আরেকটা জিনিস- সব ঘরে ঘরে রবীন্দ্রসঙ্গীত চলছে- সেই ঘরে ঘরে গাওয়াটা তো আমরা প্রামাণ্য গাওয়া বলে ধরতে পারবো না।''
    এখানে সুভাষ যোগ করেন, ''.. মুশকিল হচ্ছে কি - Popular গাইয়ের গলায় তো এটা Popular হচ্ছে। সেখানে এটার সাদামাটা চেহারা পাচ্ছি। খুব Popular গাইয়ে কিন্তু তিনি - সেখানে খুব সাদামাটা চেহারা পাচ্ছি।''
    তখন সত্যজিৎ বলেন, ''..... এই তো হেমন্তই দেখনা (হাসি) অবশ্য এটা আবার উঠে গেল (হাসি)...... কিন্তু কথা হচ্ছে হেমন্তবাবুর গলায় ধরুন এটা নেই। একজন আমি বলছি যে এটা নেই-ই (জোর দিয়ে), সেক্ষেত্রে লোক কিন্তু হেমন্তবাবুর গলায় এটা শুনতে চাইছে। আপনি যে প্রশ্নটা তুলছেন সেটাতো চিরকালের আর্টের একেবারে গোড়ার প্রশ্ন। সাধারণ, মানে Lowest common denominator এর কাছে তার চেহারাটা কীরকম, তারা কী পছন্দ করছে, সে তো আমাদের সাহিত্যেও আছে, ফিল্মেও আছে, গানেও থাকবে। এটাতো নতুন কিছু না। কিন্তু তারা যখন classical গান শুনতে যাচ্ছে তারা তখন ভালটাই চাইবে - যারা classical গানের বোদ্ধা। কিন্তু যেখানে রবীন্দ্রসঙ্গীত এসে যাচ্ছে সেখানে তো মুশকিল হয়ে যাচ্ছে ঐখানেই যে খুব সাধারণ লোকেরা ঐ popular গানটাই পছন্দ করবে। এটা তো পাশাপাশি থাকবেই। এটার কোনও রাস্তা নেই।'' প্রসঙ্গত রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভবিষ্যত বিষয়ে প্রশ্ন তোলায় তিনি বলেন, ''..... রবীন্দ্রসঙ্গীত in a pristine form, মানে ভালো form, রবীন্দ্রসঙ্গীতের চল তো থাকবেই।''
    সুতরাং এটা স্পষ্ট যে একটা প্রভাবশালী ও স্বীকৃত শ্রোতাগোষ্ঠীর কাছে হেমন্ত বা তাঁর গায়নভঙ্গি Exceptional বা Best নয়, সেটা নেহাৎ 'Popular' এবং এখানে Popular শব্দটি প্রকারান্তরে উৎকর্ষের অভাবই সূচিত করছে। আবার Pristine ফর্ম, যা কি না 'ভালো' form, সেটাই বা আদতে কী কী লক্ষণকে আশ্রয় করে গঠিত হয়? এখানে উল্লেখযোগ্য, যে দু'জন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ও স্বীকৃত শ্রোতা এই আলোচনাটি করছেন তাঁরা স্পষ্ট কোনও বিশেষ নজির উপস্থিত করছেন না, Pristine formটি আসলে কোন শিল্পী সঠিকভাবে ধারণ করতে পারেন। এই মোড়টিতে এসে আলোচনাটি একটি অন্ধগলিতে আটকে যায়, যেখানে শ্রোতারা আপন আপন শ্রবণ অভ্যেস ও অভিজ্ঞতাকে নির্ভুল ভেবে নিশ্চিন্ত থাকেন।

    হেমন্ত বলতেন যে তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষকের নাম 'স্বরবিতান'। তিনি দোকান থেকে স্বরবিতান কিনে আনতেন আর হারমোনিয়মে সুর টিপে গান বাঁধার মহলা চালিয়ে যেতেন। গুরুবাদী 'শুদ্ধতা'পন্থিদের পক্ষে রীতিমতো স্যাক্রিলেজ বলা যেতে পারে। কিন্তু যেকোনও গান, বিশেষতঃ রবীন্দ্রসঙ্গীত' যাঁদের কথা ভেবে রচিত হয়েছিলো , যদি তাঁরা শঙ্খ ঘোষের অভিজ্ঞতা অনুসারে শুধু 'মধ্যবিত্ত রুচিপ্রকৃতি'র মানুষই হ'ন, তাঁদের কাছে বিপুল সমাদর লাভ করেছিলো। একথা একশোভাগ সত্যি যে সংখ্যাতত্ত্বের বিচারে ফেলে শিল্পের মূল্যায়ণ করা যায়না, কিন্তু সেই ফর্মুলাটি কি হেমন্তের রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে? সর্বকালের কথা বলতে পারিনা, কিন্তু আমার নিজের দেখা অন্ততঃ তিনপ্রজন্মের বাঙালি শ্রোতার প্রতিক্রিয়া দেখে বলতে পারি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন মানুষের হৃদয়ের গভীর তন্ত্রী'কে স্পর্শ করতে সক্ষম এবং তার নজির আমরা এখনও দেখতে পাই।

    দূরদর্শন পূর্ববর্তী যুগে, যে সময় বাঙালি শ্রোতা বিভিন্ন ছোটোবড়ো আসরে সরাসরি শিল্পীদের থেকে বাংলাগান শোনার সুযোগ পেতো, তখন একটি প্রথা বেশ প্রত্যক্ষ ছিলো। শিল্পীরা অনুষ্ঠানের প্রথম নিবেদনটি শুরু করতেন রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়ে। যাঁরা পূর্ণসময়ের বা বহুস্বীকৃত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী ন'ন, তাঁরাও মুখবন্ধ হিসেবে রবীন্দ্রসঙ্গীতকেই আশ্রয় করতেন শ্রদ্ধাসহকারে। এখনও হয়তো কেউ কেউ করে থাকেন। কয়েকজনের কথা আমার নিজের মনে আছে। মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, পিন্টু ভট্টাচার্য, নির্মলা মিশ্র, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা তো এই মূহুর্তে মনে পড়ছে। এই প্রথাটি প্রথম শুরু করেছিলেন হেমন্ত। প্রশ্ন উঠতে পারে পঙ্কজকুমার ন'ন কেন? তাঁর সমস্ত পরিবেশনায় তো রবীন্দ্রসঙ্গীত আবশ্যিক অংশ হয়ে থাকতো। এই প্রসঙ্গে বলা যায় পঙ্কজকুমারের সময় থেকে হেমন্তের সময়ের মধ্যে বাংলাগানে একটা বড়ো পালাবদল ঘটে গিয়েছিলো। হেমন্তের শ্রোতাদের মধ্যে রবীন্দ্রপ্রজন্মের মানুষ কেউ ছিলেন না বললেই চলে। উপরন্তু নানা আর্থসামাজিক কারণে শ্রোতাদের মানসিকতার ফ্রেমও আমূল বদলে গিয়েছিলো। নতুন প্রজন্মের বাঙালি শ্রোতাদের কাছে রবীন্দ্রনাথের গান উপযুক্ত মর্যাদায় গ্রহণ করানোর জন্য যে ধরনের গ্ল্যামর কোশেন্ট প্রয়োজন ছিলো, হেমন্ত ব্যতীত সেই মূহুর্তে আমাদের মধ্যে আর কোনও শিল্পী ছিলেন না। তাঁর মাপের লোকপ্রিয় শিল্পীর যোগদান শিল্পবস্তুর মহিমা বিষয়ে শ্রোতার মনে অন্যধরণের তাৎপর্য বহন করে আনে। পরবর্তীকালে কিশোরকুমার এগিয়ে এলেও হেমন্ত ছিলেন তাঁদের পথিকৃৎ। এইখানে সত্যজিতের Pristine ঘরানার যাথার্থ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। কারণ কিশোর ছিলেন সত্যজিতের আশিসধন্য রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী। এখনও ভাবি, কিশোরকুমারের রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়নের মধ্যে এমন কী 'রাবীন্দ্রিক উৎকর্ষ' ছিলো, যা তিনি হেমন্তের রবীন্দ্রসঙ্গীতে খুঁজে পাননি?

    রবীন্দ্রসংগীত নামক শিল্পধারাটির একজন অতিস্বীকৃত দিগগজ সুবিনয় রায় হেমন্তের রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্বন্ধে বলেছিলেন, “হেমন্ত যেভাবে সুর লাগায় সেটা বাংলা গানের পক্ষে আদর্শ। সা রে গা মা দু’রকমভাবে লাগানো যায় গলা দিয়ে, একটা sophisticated, অন্যটা unsophisticated। হেমন্ত unsophisticatedভাবে সুর লাগায়। এর তুলনা নেই। ওর গান নির্বাচন অতুলনীয়। কোনটা ও justice করতে পারবে ওটা ঠিক বুঝতে পারে। তার বাইরে বেরোয় না। এই গুণ খুব কম শিল্পীর থাকে। তোরা ভাবিস হেমন্ত-র ক্লাসিক্যালের উপর দখল নেই - সেটা একদম ভুল। আমি তো বহুদিন ধরে ওর সঙ্গে মিশছি, আমি জানি। নিজে গলা দিয়ে ওই চর্চাটা করেনি, কিন্তু ভেতরে ক্লাসিক্যাল সেন্স প্রখর। ওর মত উচ্চারণ বাংলা গানে খুব কম শোনা যায়। ‘প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায়’, ‘কেন পান্থ এ চঞ্চলতা’ ভালো করে শুনিস, দেখবি মনে হবে ঝর্ণা বইছে”। ( পুত্র সুরঞ্জন কথিত)

    এর পর আমাদের মতো অনধিকারীর কোনও মন্তব্য নিতান্ত বৃথা ও মূঢ় শোনাবে। অর্ধশতকেরও বেশি শোনার পর ব্যক্তি আমি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রসঙ্গীতকে শুধুমাত্র সঙ্গীতপরিবেশনা হিসেবে ধরিনা। বহিরঙ্গে বিভ্রমজনক সারল্যের আড়ালে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিবেদিত শ্রোতার কাছে অগণন চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসে। চিরকালীন হিরণ্ময় পাত্রে লুকিয়ে থাকা উপনিষদের সত্যের মতো যেন তাকে ধরে ফেললেও ধরা দেয়না। কোথাও যেন একটা কাচের দরজা থেকে যাচ্ছে স্রষ্টা ও শ্রোতার মধ্যে। হেমন্তের কাছে ছিলো ঐ দরজাটি খোলার চাবিকাঠি। রবীন্দ্রসঙ্গীতকে মসৃণভাবে উন্মোচিত করে শ্রোতাকে ভাসিয়ে দেওয়ার ধ্যান আমি তাঁর পরিবেশনায় পেয়ে যাই। যা শুধু আর 'গানশোনা' হয়ে থেকে যায়না। একজন তদ্গত শ্রোতা যে কথাটি একবার নিজের মতো করে জানিয়েছিলেন আমাদের।

    "....রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে বসে, উনি যেন ঠিক গান নয়, সাধনায় বসতেন। আর ওঁর এই ভাবটা ছড়িয়ে পড়ত শ্রোতাদের মধ্যেও।

    রঞ্জি স্টেডিয়ামের একটা অনুষ্ঠানের কথা মনে পড়ছে। মঞ্চে মহম্মদ রফি। দর্শক উত্তেজনায় ফেটে পড়ছে। তাদের উল্লাস সাগরের ঢেউকেও হার মানায়। তুমুল চিৎকারের মধ্যে মঞ্চ ছাড়লেন রফি।

    এর পরেই উঠবেন হেমন্তদা। আমরা রুদ্ধশ্বাস। এমন উত্তাল জনতাকে কী করে বাগে আনবেন তিনি? মঞ্চে উঠলেন। হারমোনিয়াম ধরলেন। তার পরেই অতি পরিচিত সেই জলদগম্ভীর স্বরে বেজে উঠল— ‘আমার কণ্ঠ হতে গান কে নিল…’।
    তখন কোথায় সেই আছড়ে ওঠা সাগর-ঢেউ! মুহূর্তে কোন এক জাদুমন্ত্রের মায়ায় নিশুত রাতের নৈঃশব্দ্য ঘনিয়ে এল যেন…"
    (পত্রিকা-সুবীর মজুমদার, ২০শে জুন ২০১৫)
    সারাজীবনের অমেয় সঙ্গীতসিদ্ধি তাঁর জন্য হয়তো তেমন তাৎপর্য বহন করতো না। নিস্পৃহ প্রজ্ঞায় জীবনের সালতামামি করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন,
    "....গুরুদেবের গান আমার মৃতসঞ্জীবনী। আমার সঙ্গীত জীবনে আমি যা কিছু পেয়েছি রবীন্দ্রকোষ থেকে। আমি রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়া বাঁচবো না।"
    একজন ইতর শ্রোতা হিসেবে আমি রবীন্দ্রসঙ্গীত ও বেঁচে থাকার মধ্যে এই সমীকরণটিই শেষ কথা মনে করি। কেন আমরা রবীন্দ্রসঙ্গীতে দ্বিতীয় হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর পাইনি, সেই রহস্যটি এই বোধের উৎসেই রয়েছে।

    আমাকে যখন কেউ প্রশ্ন করে, এতো এতো গান শোনো সারাদিন, কিন্তু কোন গান তোমাকে সব চেয়ে বেশি তদ্গত করে রাখতে পারে? কোনও চিন্তা না করেই বলি, হেমন্তের গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত। একটা উপমা মনে পড়ে যায়। কথামৃতে আছে। নুনের পুতুল সাগরে গেলো জল মাপতে। মাপা আর হলো না, নিজেই মিলে গেলো সাগরের জলে। হেমন্তের হাত ধরে রবীন্দ্রসাগরে যাই। কখন মিলে যাই ঐ জলে বুঝতে পারিনা। তিনি নিজে তো আমাদের অনেক আগেই মিশে গেছেন। অনন্ত সাগর হয়ে গেছেন, আমাদের বুঝতে না দিয়ে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ২৪ মে ২০১৯ | ১১৭৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • শিবাংশু | 561212.187.6745.8 (*) | ২৪ মে ২০১৯ ০৪:৫৭48523
  • Popular না Pristine? কেমন হবে রবীন্দ্রসঙ্গীত? কোন স্তরের শ্রোতার কাছে গ্রহণযোগ্য বোধ হলে রবীন্দ্রসঙ্গীত একটি সফল শিল্পের গরিমা পেতে পারে? এর উত্তর খুঁজতে চলে গেছে বহুকাল। বিতর্কের তোয়াক্কা না করে এই দেবতা নিঃশব্দে পেতে নিয়েছেন তাঁর সিংহাসন আমাদের হৃদয়ের মধ্যে।

    কীভাবে?

    তাই নিয়ে এই পর্বটি....
  • Kushan | 561212.187.1256.91 (*) | ২৯ মে ২০১৯ ০৫:১১48524
  • অসম্ভব ভালো মূল্যায়ন করেছেন। এ আমারও মনের কথা।
    সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁর সম্বন্ধে বলতেন ' গানের কিন্নরকণ্ঠ'।
    রবীন্দ্র সঙ্গীতকে বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছেন হেমন্তই। আর বাংলা গানকে পরিশীলিত উচ্চারণ শিখিয়েছেন তিনিই।
    মুশকিল হলো, হেমন্তের অবদানকে বাঙালিমনন স্বীকৃতি দিতে চায় না।
    এই লেখার দরকার ছিল।
    আরো লিখুন। ধন্যবাদ।
  • Du | 237812.58.890112.97 (*) | ২৯ মে ২০১৯ ০৫:৫৪48525
  • এখানকার রেডিওতে এ জি চিনি বলে এক ভদ্রলোক রেডিওতে খুব ভালো অনুষ্ঠান করেন। একদিন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কে নিয়ে অনুষ্ঠানে বলেছিলেন ওনার গলায় এমন একটা মন্ত্রোচ্চারণের ধর্ম আছে যে ওনার গান বাজ্লে চুপ হয়ে যেতে হয় - আপনার স্টেডিয়ামের গল্পটা পড়ে সেইটা মনে পড়লো।
  • শিবাংশু | 561212.187.6745.26 (*) | ৩০ মে ২০১৯ ০৫:০৫48526
  • @কুশান,
    'বাঙালি মনন' নামে কোনও ধ্রুব মানসিকতা কখনই ছিলোনা, এখনও নেই। তাই হেমন্তের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কোনও সমষ্টিবিশেষের মনোভাব তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। গান গাওয়ার মতো গান শোনাটাও শিখতে হয়। এই সরল কথাটি বললে অনেকে চেঁচামেচি করেন। 'এলিটিস্ট' ইত্যাদি 'গালাগালি'ও দিয়ে দেন সুবিধে মতন। কিন্তু সঙ্গীত শুধু কলাশাস্ত্র নয়, গণিতশাস্ত্রের বহুবিধ নিয়মও মেনে চলে সে। গণিত যেমন বিশ্লেষণসাপেক্ষ, সঙ্গীতও তাই। কানে শুনে আমার 'ভালো' লেগেছে, তাই সেটি 'ভালো'। অন্যথায় আর কিছু। এটিও এক ফ্যাসিবাদী মনোভাব। কানে তো শুনতেই হবে। কিন্তু সঙ্গীতের রসগ্রহণ প্রস্তুতিহীন, বিশ্লেষণহীন বিবেচনার কম্মো নয়। যাঁরা এই শ্রমস্বীকারে প্রস্তুত, তাঁদের কাছে হেমন্তের অবদান নিয়ে কোনও সংশয় নেই। বাকিদের সম্পর্কে মনে হয় মৌন থাকাই শ্রেয়।

    @Du,
    আপনি কোথাকার রেডিওর উল্লেখ করেছেন, জানিনা। তবে হেমন্তের কণ্ঠস্বরের সঙ্গে মানুষের মনে divinityর যে ছবি রয়েছে তার মিল তো দেবতারাই স্বীকার করেছেন। শ্রদ্ধেয়া লতাজি বলেছিলেন হেমন্তের কণ্ঠ শুনলে মনে কোনও এক নির্জন দেবালয়ে একজন সাধু ঈশ্বরের উদ্দেশে সঙ্গীত নিবেদন করছেন। স্বয়ং সলিল চৌধুরী বলেছিলেন ঈশ্বর যদি কখনও গান গাইতেন তবে তাঁর কণ্ঠস্বর হেমন্তের মতো শুনতে লাগতো। এই সব প্রশস্তির ছাপ তো মানুষের মনে চিরকালের জন্য দৃঢ়মূল হয়ে গেছে। হয়তো শ্রীযুক্ত চিনি তার থেকেই প্রভাবিত হয়েছেন।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। চটপট মতামত দিন