পছন্দ | জমিয়ে রাখুন | পুনঃপ্রচার |
দেবী দুর্গার ইতিহাস জটিল ও বহুস্তরীয়। খুব সহজে এই দেবীর সামগ্রিক পরিচয়টি হৃদয়ঙ্গম করা যাবেনা। তবে দেবীর যে রূপটির সঙ্গে 'আধুনিক' মানুষ স্বচ্ছন্দ, তা নিয়ে অতি সংক্ষেপে কিছু আলোচনা করা যায়। গত একশো বছর ধরে সাধারণ মানুষের কাছে দুর্গার 'পারিবারিক' দেবীর যে ভাবমূর্তি টি সব চেয়ে বেশি পরিচিত, সে প্রসঙ্গেই আজ কিছু কথা হোক।
উত্তরভারতের পিতৃকেন্দ্রিক ও পিতৃতান্ত্রিক সমাজে দুর্গাকে স্বাধীনা, স্বাধিকারপ্রমত্তা অনার্যদেবী হিসেবে দেখা হতো। পরবর্তীকালে এই দেবীর মধ্যে আবহমান 'ভারতীয়' ভার্যা ও কন্যার ভাবমূর্তিটি সঞ্চারিত করা হয়েছিলো। প্রয়াসটিকে অনার্য মূল্যবোধের উপর আর্য প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করার একটি কৌশল হিসেবে ধরা যেতেই পারে। আমাদের সংস্কৃতিতে এই ঘটনাটির রীতিমতো জলবিভাজক তাৎপর্য আছে। এই ধারণাকে প্রতিষ্ঠা দেবার জন্য একাকী, যুদ্ধপটিয়সী দেবী দুর্গাকে বড়ো মূল্য দিতে হয়েছিলো। তিনি আর্যমতের সমঞ্জস 'বিবাহ ' নামক একটি গুরুতর সামাজিক বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাঁকে ইচ্ছেমতো 'চালনা' 'করতে পারা পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য সমাজের একটি বৃহৎ কৃতিত্ব ছিলো। মূল 'পার্বতী' দেবী দুর্গার কোনও পুরুষ অভিভাবক সঙ্গী ছিলেন না। তিনি কারও ভার্যা বা দুহিতাও ছিলেন না। আর্য স্বভাব-মানচিত্রের বাইরে থাকা একজন স্বাধীনা নারী ছিলেন তিনি। প্রথমে পুরাণ, তার পরে তান্ত্রিক পরম্পরার ভিতর দিয়ে এসে এই দেবীকে শিব বা মহাদেবের বিবাহিত ভার্যা হয়ে পরিচিত হতে হয়েছিলো। তন্ত্রসাহিত্য পরম্পরায় জগতের চালিকাশক্তি হিসেবে এই দেবীকে স্বীকৃতি দেওয়া হতো। যদিও মৌল পরিচয়ে তিনি ছিলেন শিবের শক্তি। তাঁর কোনও একক অস্তিত্ত্ব ছিলোনা। ভারতবর্ষের সর্বত্র শিবভার্যা ও গণেশজননী হিসেবে তাঁর লোকপ্রিয় একটি ভাবমূর্তি গড়ে ওঠে।
দেবী দুর্গাকে নিয়ে বাঙালির সৃজনশীলতা এখানেই থেমে যায়নি। তাঁরা অনেকদিন ধরেই দেবীকে মাতারূপে আরাধনা করতেন। তার পাশাপাশি বহু মানুষ তাঁকে কন্যারূপে দেখতে আগ্রহী হয়ে উঠলেন। দেবীর নানা 'পারিবারিক' সম্পর্ককে ভিত্তি করে চার-পাঁচশো বছর ধরে তাঁর বহুস্তরীয় পরিচয় গড়ে উঠেছিলো । তিনি আদি যুদ্ধদেবীর রূপ থেকে অব্যাহতি পেয়ে গৃহস্থী ঘরনীর রূপ পরিগ্রহ করেন। যথা, হিমালয়কন্যা, শিবভার্যা ও গণেশজননী। পরবর্তীকালে তাঁর ‘সন্তান’ হয়ে এসেছিলেন কার্তিকেয়, লক্ষ্মী বা সরস্বতী। এই সব দেবতার সঙ্গে দুর্গার প্রথম যুগে কোনও সম্পর্ক ছিলোনা। তা সত্ত্বেও পরবর্তীকালে মানুষ তাঁদের 'জননী' হিসেবে দুর্গাকে দেখতে চেয়েছে। ইতিহাস অনুযায়ী সরস্বতী তাঁর থেকে প্রাচীনা দেবী। আর্যদেবী হিসেবে লক্ষ্মীর মহিমাও দুর্গার পূর্ববর্তী কালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। পুরাণযুগে লক্ষ্মী ও দুর্গা উভয়েই একযোগে 'বিষ্ণুমায়া'র প্রকাশ ছিলেন। এতো বিষম ব্যতিক্রম থাকা সত্ত্বেও লক্ষ্মীকে দেবী দুর্গার দুহিতা রূপে দেখতে চাওয়ার স্পৃহা বঙ্গীয় পারিবারিক আবেগের একটি নির্ভুল নমুনা।
'… দুর্গা দুর্গতিনাশিনীই হোন, দুর্গাসুরনাশিনীই হোন বা দুর্গরক্ষিণীই হোন, তিনি শস্ত্রধারিণী এবং অরিমর্দিনী; কিন্তু পার্বতী উমার কোনও প্রাচীন উল্লেখের মধ্যেই আমরা এই শস্ত্রধারিণী, অরিমর্দিনী রূপের উল্লেখ পাই না । উমাকে প্রথম পাইলাম কন্যারূপে- বহুশোভমানা হৈমবতী-রূপে। তাহার পরে পাইলাম শিবপ্রিয়া-রূপে-তাহার পরে পাই গণেশ-জননী ও কুমার-জননী-রূপে। তাহার পরে যখন লক্ষ্মী-সরস্বতীও তাঁহাদের স্বাতন্ত্র্য বর্জন করিয়া মায়ের কন্যাত্ব স্বীকার করিলেন তখন মায়ের সোনার সংসারকে পূর্ণরূপে দেখিতে পাইলাম। হাজার হাজার বৎসর ধরিয়া এই পার্বতী উমার প্রেমময়ী পত্নীত্ব এবং অনন্ত-স্নেহময়ী মাতৃত্বের রূপই প্রাধান্য লাভ করিয়া আসিয়াছে; শিবের সহিত প্রণয়-কলহ বা গৃহকলহ ব্যতীত মায়ের ভ্রূকুটিকুটিল মুখ কখনও বড় একটা দেখা যায় নাই-অস্ত্র-শস্ত্র ধারণ ত দূরের কথা। কিন্তু মহাদেবী যখনই ভয়ঙ্করী-রণোন্মাদিণী-অসুরনাশিনী-তখনই তিনি দুর্গা, চণ্ডী, কালী। মায়ের এই অসুরনাশিনী মূর্তির সহিত সর্বাপেক্ষা অধিক যুক্ত হইল মায়ের চণ্ডী-রূপ। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, দেবীর এই অসুরনাশিনী চণ্ডী বা চণ্ডিকার ধারা মায়ের পার্বতী উমার ধারা হইতে একটি পৃথক ধারা। পরবর্তী কালে দুই ধারা নির্বিশেষে মিশিয়া এক হইয়া গিয়াছে।'
(দেবীর বিচিত্র ইতিহাসঃ ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্যঃ শশিভূষণ দাশগুপ্ত)
বাঙালির শারদীয়া দেবী দুর্গার সঙ্গে বাংলার মেয়েদের বছরান্তে পিতৃগৃহে আসার আবেগটি নিপুণভাবে জুড়ে দেওয়া হয়েছিলো। এই দুর্গা ভয়াল-করাল হন্ত্রী দেবতা নন। উত্তর-পশ্চিম ভারতে প্রচলিত নবরাত্রের সঙ্গে চিহ্নিত যুদ্ধদেবী বা তান্ত্রিক মতের শক্তিস্বরূপা কোনও দেবীও ন'ন। তিনি 'ব্রহ্মরূপসনাতনী কাত্যায়নী'র মতো বিপুল গরিমাও প্রদর্শন করেন না। যদিও এই দুর্গা দেবীর পূজাপ্রকরণের মধ্যে পুরাণ ও তন্ত্রমতের ব্যাপক প্রভাব চোখে পড়ে। পুরোহিততন্ত্রের অধিকারপ্রমত্ত আচার-আচরণও যথেষ্ট প্রকট । কিন্তু বাঙালিদের জন্য সেই সব 'শাস্ত্রীয়' লোকাচারের আবেদন বিশেষ তাৎপর্য রাখেনা। তাঁরা দেবী দুর্গার শারদীয় যাত্রাটিকে মেয়ের বাড়ি ফেরা হিসেবে দেখতেই ভালোবাসেন। সেজন্য দেবীপক্ষের শুরু থেকে কোজাগরী পূর্ণিমা পর্যন্ত সময়টি বাঙালির জন্য প্রকৃতপক্ষে ‘দেবীপক্ষ’ নয়। তাকে 'কন্যাপক্ষ' বলাটাই হয়তো সমীচীন। বাংলার সাধারণ মানুষ সারা বছর অপেক্ষা করে থাকেন। কখন কন্যারূপী দুর্গার আগমনে চিরাচরিত দুঃখময় জীবনে আনন্দের ফুল্ল মুহূর্তগুলি জেগে উঠবে। দেবীর রূপের এই বিবর্তন একান্তভাবেই বঙ্গীয় পারিবারিক লোকবিশ্বাসের অঙ্গ। শরৎকালীন এই উপলক্ষকে কেন্দ্র করে বাঙালি শিল্পীরা একটি বিশেষ ধারার সঙ্গীত পরম্পরাও সৃজন করেছিলেন । অন্যান্য শিল্প মাধ্যমেও দেবী দুর্গার দুহিতারূপী সত্ত্বাটিকে গরিমান্বিত করার প্রয়াস পাওয়া হয়েছে।
সমাজের পারিবারিক একক গুলি ছিলো পুরাণযুগ এবং পরবর্তীকালের আর্যসভ্যতার ভিত্তি । পারিবারিক মূল্যবোধের ছাঁচ ছিলো একান্তভাবে পিতৃতান্ত্রিক ও রক্ষণশীল। তারা তৈরি হয়েছিলো 'সমাজবন্ধন’ নামক একটি বিমূর্ত তাড়না থেকে। বৈদিকযুগ থেকে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতিতে পৌঁছে যাবার পরে এই বাঁধাবাঁধি তীব্রতর হয়ে উঠতে থাকে। ক্রমশ পারিবারিক রক্ষণশীলতার চাপ একক মানুষের আত্মপরিচয়কে আচ্ছন্ন করে ফেলে। তার প্রভাবে আমাদের ব্যক্তিগত আত্মবিশ্বাস চূর্ণ হয়ে যায়। এ জন্যই ভারতীয় সভ্যতার দীর্ঘদিন ধরে গড়ে তোলা সৌধ, বহিরাগতদের সামান্য আক্রমণে বালুর প্রাসাদের মতো ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছিলো। পারিবারিক রক্ষণশীল 'পবিত্রতা'র দায় পালন করতে গিয়ে ব্রাহ্মণ্য ব্যবস্থা দৈবী চরিত্রদের সাহায্য নিতো। বিভিন্ন আখ্যানে নানা রকম দেবতাদের পাত্রপাত্রী করে গল্প বাঁধার কৌশল নেওয়াটাই স্বাভাবিক পদ্ধতি ছিলো তখন। এই রকম একটা সময়ে পুরাণকাররা ত্রিকালপতি, দেবাদিদেব মহাদেবকেও মানুষী সংসারবন্ধনে বেঁধে ফেলেছিলেন। তাঁকে মানুষের পারিবারিক যাপনের অনুকরণে দৈনন্দিন ধুলোখেলার শরিক করে ফেলা হয়। পুরাণযুগ থেকেই সতী বা উমা এবং পার্বতীর সঙ্গে শিবের একটা সাংসারিক বন্ধনের উপাখ্যান প্রচলিত ছিলো। নানা কাব্যকাহিনীর মাধ্যমে তার প্রচার ছিলো অব্যাহত। যদিও শিবের অবস্থান বিশেষ বদলায়নি । কিন্তু নানা কারণে পার্বতীর রূপ পরিবর্তন হয়েছে বহুবার। এই সব রূপের মধ্যে প্রধান 'মহিষমর্দিনী' অবতার । অন্য রূপগুলি নানা তন্ত্রোক্ত শক্তিদেবীর নামে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে দেওয়া হয়েছিলো। দেবীর রূপগত বিবর্তনের নানা ধারা সমান্তরাল চলে এসেছে প্রায় হাজার দুয়েক বছর। এদের মধ্যে তাঁর হিমালয়দুহিতা হিসেবে সতী, উমা বা পার্বতী রূপটির চিরন্তন লোকপ্রিয়তা আছে । গুপ্তযুগের অনেক আগে থেকেই শিবের এই সাংসারিক গার্হস্থ্য যাপনটি নিয়ে লোকের আগ্রহ চোখে পড়ে। কালিদাসের 'কুমারসম্ভব' আবহমান ধারণাটিরই কাব্যিক প্রকাশ। দুই পুত্র নিয়ে ভার্যাসহ কৈলাশে শিবের সংসার নির্বাহ, এদেশের সাধারণ মানুষের সাইকির মধ্যে গভীরভাবেই প্রোথিত হয়ে গিয়েছিলো। পার্বতী ক্রমাগত রূপ পরিবর্তিত হয়ে কখনও 'মহাদেবী' হয়ে গেছেন; কখনও বা 'আদ্যাশক্তি' অথবা সুপরিচিত মহিষমর্দিনী । এই পরম্পরাটিকেই আধ্যাত্মিক চিন্তায় প্রাথমিকতা দেওয়া হয়েছিলো। তা সত্ত্বেও 'কন্যা' উমা বা 'জামাতা' মহেশ্বরের ইমেজ কখনও ম্লান হয়নি। অধিকন্তু, সময়ের সঙ্গে তাতে নানা নতুন মাত্রাও যোগ হয়েছে। বৈদিককালে দেবী সরস্বতী স্বাধীনা ছিলেন। পুরাণযুগে তিনি ব্রহ্মার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যান। নানারূপে দেবী লক্ষ্মীর সঙ্গে বিষ্ণুর যোগাযোগও আদিকাল থেকেই রয়েছে। কিন্তু সম্ভবত ভাগবত পুরাণের কালে এসে লক্ষ্মী এবং সরস্বতী দুজনেই 'আদ্যাশক্তি' বা পার্বতীর অংশ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গিয়েছিলেন। মোটামুটিভাবে ষোড়শ শতক থেকে পূর্বভারতে এই দুই দেবী ব্রহ্মা বা বিষ্ণুর পুরোনো ‘আশ্রয়’ ছেড়ে শিবের সংসারের সঙ্গে পাকাপাকি ভাবে যুক্ত হয়ে যান।
মধ্যযুগে বাংলা, অসম ও ওড়িশা অঞ্চল পিতৃতান্ত্রিক, ব্রাহ্মণ্য সমাজব্যবস্থায় ওতপ্রোত ছিলো। তার সঙ্গে এই সব দেশে কৌম শাক্তসংস্কৃতির ব্যাপক চর্চাও চোখে পড়ে। ফলে এখানে সমাজজীবনে যথেষ্ট পরিমাণে মাতৃতান্ত্রিক ঝোঁক দেখা যেতো। দেবী দুর্গা'র ভগবতীরূপ ব্রাহ্মণ্যমতে মহাদেবীর পালনকর্ত্রী ভাবমূর্তির প্রতীক। যৌথপরিবারের গৃহলক্ষ্মী হিসেবে দেশের এ প্রান্তে সেই রূপটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলো। সপ্তমাতৃকা বা চৌষট্টি যোগিনী পরিবৃতা চামুণ্ডা বা ছিন্নমস্তারূপ যুদ্ধদেবী ক্রমে হয়ে গেলেন স্নেহময়ী, সন্তাননিষ্ঠ মাতা। মাতা এবং তাঁর সন্ততিরাই দ্রুত পাদপ্রদীপের আলোটি আত্মসাৎ করে নিলেন। 'গৃহকর্তা' শিব সেখানে উপলক্ষ মাত্র। সাবেকি ভূমিনির্ভর কৃষি অর্থনীতির শর্ত পূরণ করতে ভারতবর্ষ একদিন যৌথ পরিবারব্যবস্থাকে আশ্রয় করেছিলো। তার ফলশ্রুতি, উমা, হৈমবতী, পার্বতী ইত্যাদি চরিত্র মিলিয়ে মিশিয়ে তৈরি শারদীয় দেবী দুর্গা বাঙালির কাছে নতুন ভাবমূর্তিতে আবির্ভূত হলেন। এই দেবীর আনুকূল্যে যৌথ পারিবারিক ব্যবস্থাটি সংখ্যাগুরু মানুষের আনুগত্য লাভ করে। অষ্টম-নবম শতক নাগাদ সংকলিত ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে গণেশজননী ও শিবের প্রিয়তমা পত্নী দুর্গাকেই সর্বজন আরাধ্যা পূর্ণব্রহ্মসনাতনী বলা হয়েছিলো। দুর্গার এই রূপের সঙ্গে মার্কণ্ডেয়পুরাণ, দেবীপুরাণ বা দেবীমাহাত্ম্যে বর্ণিত ভয়ংকরী মহিষমর্দিনী রূপের কোনও সম্পর্ক নেই।
সময়ের সঙ্গে পণ্ডিতদের এতো মাতামাতি তুচ্ছ হয়ে গেলো। কোনও আরোপিত ধর্মীয় চাপ কাজ করলো না। সনাতন আবেগপ্রবণ বাঙালি অপত্যস্নেহের রূপ হয়ে দুর্গা কবির হৃদয়ে পরম স্নেহের দুহিতা রূপেই শাশ্বত স্থান করে নিলেন,
'.... পরাণপুতলি উমা যে আমার
আসি বলে গেল, আসিল না আর
আমি নিবারি কেমনে নয়নের জল
না হেরি আমার নয়নতারারে ।।'
(দাশরথি রায়- আগমনী)
(সৌজন্যে: প্রথম আলো)
পছন্দ | জমিয়ে রাখুন | গ্রাহক | পুনঃপ্রচার |
বেশ লেখা।
শুরুতে দুর্গা এক স্বাধীন নারী ছিলেন এই রেফারেন্সটা কোথায় পাব?
@'দ',
অনেক ধন্যবাদ।
রেফারেন্স তো অনেক রয়েছে। তবে তাদের এক জায়গায় করে বিশদ আলোচনা করেছি আমার 'হিন্দু দেবতা-এক অনির্বেদ অডিসি ' নামের বইটিতে।
বর্তমান শারদীয়া দুর্গোৎসব বৈদিক, অবৈদিক, দ্রাবিড়, আদিবাসী জনগোষ্ঠী- সবার দ্বারাই প্রভাবিত। বিভিন্ন সংস্কৃতির অপূর্ব সংমিশ্রণ এই শারদীয়া পূজা। তবে এই লেখায় অনেক তথ্যগত ভুল আছে।
লেখক বলেছেন ভারতীয় সাহিত্যে দুর্গার পরিচয় স্বাধীন, অনার্য দেবী হিসাবে। এ তথ্য সঠিক নয়। ভারতীয় সাহিত্যে দুর্গার প্রথম উল্লেখ পাই যজুর্বেদের তৈত্তিরীয় আরণ্যকে যেখানে দেবীকে অগ্নিবর্ণা, স্বীয় তেজে শত্রুবিনাশকারিণী রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। এটিই দুর্গার প্রাচীনতম বর্ণনা।
অন্যদিকে দেবীকে শবর, বর্বর, পুলিন্দ, ম্লেচছ, সকলের দ্বারা বহূপূজিতা রূপে স্তুতি করা হয়েছে। মহাভারত, হরিবংশে দেবীকে বিন্ধ্যবাসিনী রূপে বর্ণনা করা হয়েছে যিনি মদ্যমাংসবলিপ্রিয়া। ভবভূতি, বাণভট্ট, সুবন্ধু প্রভৃতি লেখকদের লেখায় এই শবরপূজিতা মদ্যমাংসবলিপ্রিয়া দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়।
এই শারদীয়া উৎসবে মিলিত হয়েছে শরৎকালীন রুদ্রযজ্ঞ, সিংহবাহিনী দেবীর উপাসনা, শস্যসম্পদশালিনী পৃথিবী দেবীর উপাসনা। এই সমস্ত কিছুর মিলিত রূপ আজকের দুর্গাপূজা।
@দীপ,
'তবে এই লেখায় অনেক তথ্যগত ভুল আছে।'
....ভারতীয় সাহিত্যে দুর্গার প্রথম উল্লেখ পাই যজুর্বেদের তৈত্তিরীয় আরণ্যকে যেখানে দেবীকে অগ্নিবর্ণা, স্বীয় তেজে শত্রুবিনাশকারিণী রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। এটিই দুর্গার প্রাচীনতম বর্ণনা।'
'অনেক 'তথ্যগত 'ভুল' বলতে তৈত্তিরীয় আরণ্যকের উল্লেখ করেছেন। কিন্তু শ্লোকটি বা তার Context কিছু লেখেননি। মনে হচ্ছে কোনও লিংক থেকে তথ্যটি জেনেছেন আপনি। বাকি যা কিছু লিখেছেন তা মূলত কিছু জনপ্রিয় গ্রন্থ থেকে পাওয়া সংক্ষিপ্ত আলোচনার অংশ। যেমন শশিভূষণবাবুর বই। তা 'ভুল' নয়। কিন্তু সামগ্রিকও নয়। আমার বইটির অতি দীর্ঘ একটি আলোচনা থেকে সামান্য উদ্ধৃতি রাখছি এখানে। আপনার অবগতির জন্য। আশা করি কারও 'তথ্যগত ভুল' আবিষ্কার করার আগে ভবিষ্যতে বিষয়টি নিয়ে একটু বিশদ পাঠ করে নেবেন। বইটিতে অসংখ্য উৎস ও আকরের তালিকা রয়েছে। আগ্রহী হলে সন্ধান করে দেখতে পারেন।
'দুর্গা' নামপদের উৎস ঠিক কোথায় তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। ব্রাহ্মণ্যশাস্ত্র, অর্থাৎ পুরাণ ইত্যাদিতে সচরাচর দেবীকে দুর্গতিনাশিনী বলা হয়। এই ক্ষমতার জন্য নামটি প্রচলিত হতে পারে। শব্দকল্পদ্রুমে পাওয়া উল্লেখ অনুযায়ী এই দেবী 'দুর্গ' নামক এক দৈত্যকে নাশ করেছিলেন। এছাড়াও তিনি বহু ঐহিক পারত্রিক দুর্ভোগ থেকে ত্রাণ করেন। তাই হয়তো তিনি 'দুর্গা'। মার্কণ্ডেয় চণ্ডী অনুসারে দেবী দুর্গারূপে দুর্গম ভবসাগর পার করানোর কাণ্ডারী। অবশ্য এই পুরাণেই আবার বলা হয়েছে 'দুর্গম' নামক মহাসুরকে বধ করার কৃতিত্বে তিনি দুর্গা। অধিক প্রচলিত মত হলো দুর্গ ও নগররক্ষাকারিণী দেবী হিসেবে তাঁর নাম দুর্গা হয়েছিলো। এই মতটির সপক্ষে রয়েছে দেবীপুরাণ, দেবীভাগবত,খিল হরিবংশ ইত্যাদি পৌরাণিক সংকলনগুলি। প্রাচীন গ্রিক শষ্যদেবী, কুমারী শক্তি ভার্গো'র (Virgo) সঙ্গেও দুর্গা নামপদের সমীকরণ করার প্রয়াস হয়ে এসেছে।
বৈদিক সাহিত্যে 'দুর্গা' নামটি দেখা যায় (তৈত্তিরীয় আরণ্যক-১০।৭।৭)। কিন্তু এই দেবী পরবর্তীকালে ব্যাপকভাবে প্রচারিত যোদ্ধৃদেবতা নন। তখন দুর্গা ছিলেন একটি বিশেষ যজ্ঞাগ্নির নাম।
তামগ্নিবর্ণাং তপসা জ্বলন্তীং
বৈরোচনীং কর্মফলেষু জুষ্টাম ।
দুর্গাং দেবীং শরণমহং প্রপদ্যে
সুতরসি তরসে নমঃ ।।
(নারায়ণীয় উপনিষদঃ তৈত্তিরীয় আরণ্যক)
অপর রূপটি একেবারে আলাদা। তার বর্ণনাও পাওয়া যায় নানা জায়গায়। যেমন, শব্দকল্পদ্রুমে দেওয়া হয়েছে দেবীর সম্পূর্ণ অন্য একটি রূপের ব্যাখ্যান।
" দুর্গো দৈত্যে মহাবিঘ্নে ভববন্ধে কুকর্মণি।
শোকে দুঃখে চ নরকে যমদণ্ডে চ জন্মনি ।।
মহাভয়েহতিরোগে চাপ্যাশব্দো হন্তুবাচকঃ ।
এতান হন্ত্যেব যা দেবী সা দুর্গা পরিকীর্তিতা ।।" (শব্দকল্পদ্রুম)
মাননীয় লেখক, আমি বেশকিছু বই এ বিষয়ে পড়েছি। তবে ব্লগে লিখতে অভ্যস্ত নই, তাই সংক্ষেপে লিখি। আপনি এখানে দুর্গাকে একটি বিশেষ যজ্ঞাগ্নি রূপে দেখাতে চাইছেন। কিন্তু যোগেশচন্দ্র বিদ্যানিধির ব্যাখ্যা অনুযায়ী এখানে দেবীকে ই বন্দনা করা হয়েছে। দেবী শক্তিস্বরূপিণী, তাই তিনি অগ্নিরূপা। শুধুমাত্র যজ্ঞাগ্নি নন। মনে হয় শরৎকালীন রুদ্রযজ্ঞ ও দুর্গরক্ষয়িত্রী দেবীর কল্পনা মিলেমিশে গেছে।
আমার কোনো কথায় আঘাত পেলে দুঃখিত।
@দীপ,
দেখুন ভাই, বিষয় হিসেবে 'দুর্গা' একটি অত্যন্ত বিস্তৃত ও জটিল প্রপঞ্চ। তা নিয়ে ব্লগে আলোচনা হয়না। এ বিষয়ে আমি একমত। অনেকেই করেন বটে, কিন্তু তা বস্তুত অন্ধের হস্তী দর্শনের মতো হয়ে যায়। এই লেখাটি একটি সংবাদপত্রের জন্য লেখা । সে কারণেই ব্লগে দিয়েছি। সর্বতোভাবে আংশিক আলোচনা। কোনও গভীর অনুসন্ধানের পরিসর নেই এখানে।
বেদের নানারকম ব্যাখ্যা হয়। মৌলত ব্রাহ্মণ্য ও অব্রাহ্মণ্য ব্যাখ্যা। দুয়ের মধ্যেই সত্য আছে। কেউই পরিত্যজ্য নয়। তবে দু হাজার কুড়ি সালে মানুষের যুক্তিবোধের দিকচিহ্নগুলি অনেক বদলে গেছে। পাল্টে গেছে ধর্ম ও জিরাফকে একাসনে বসানোর রীতিটিও । যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি প্রণম্য পণ্ডিত। তাঁর থেকে অনেক কিছুই শিখেছি আমরা। তিনি যে যজ্ঞাগ্নির যে ব্যাখ্যা করেছেন, সেই একই ধরন আমরা স্বামী অভেদানন্দের ব্যাখ্যাতেও পাই। শুধু 'দুর্গা' ন'ন, 'কালী'ও একটি যজ্ঞাগ্নি শিখার নাম। যজ্ঞশিখা থেকে আমাদের চেনা দেবীতে উত্তরণ একটি ঐতিহাসিক ব্যাপার। শুধু মাত্র ব্রাহ্মণ্য ব্যাখ্যা দিয়ে তার উত্তর পাওয়া যায় না। আমার 'দেবতাচর্চা'র ভিত্তি দ্বান্দ্বিক দর্শন। সেখানে ভক্তিবাদী দর্শনের মতো 'যুক্তি'কে একমুখী মাহাত্ম্য দিয়ে বিচার করা যায় না। উল্লেখিত বইটি থেকে আরেকবার সামান্য অংশ উদ্ধৃত করছি। কী বলতে চাই, সেটা স্পষ্ট করতে।
'দেবীর উৎস সরাসরিভাবে বেদের মধ্যে আছে এমত প্রচারও করা হয়। যাঁরা এই মতবাদ পোষণ করেন, তাঁদের জানাই, ঋগবেদ অনুযায়ী দেবীর উৎপত্তি যজ্ঞের আগুন থেকে হয়েছিলো।
" বি পাজসা পৃথুনো শোশুচানো
বাধস্ব দ্বিষো রক্ষসো অমী বাঃ ।
সুশর্মণো বৃহতঃ শর্মণি
স্যামগ্নেরহং সুহবস্য প্রণীতৌ ।।" (ঋগবেদ-৩/১৫/১)
এটি বস্তুত যজ্ঞাগ্নির প্রার্থনামন্ত্র। এই মন্ত্রটির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে স্বামী অভেদানন্দ বলেছিলেন ' ঋগবেদে অগ্নিরূপিণী দুর্গাদেবীকে শত্রুবধকারিণী ও রাক্ষসহন্ত্রী বা অসুরনাশিনী বলা হইয়াছে।" মন্ত্রটির এই ব্যাখ্যা সম্প্রসারিত অর্থের সূত্রে এসেছে। গতশতক থেকে প্রাসঙ্গিক হতে থাকা নতুন মাত্রার আধ্যাত্মিক ব্যঞ্জনা হিসেবে তাকে ধরা যেতে পারে।
বৈদিক দুর্গার সঙ্গে পরবর্তীকালের বহুল প্রচারিত রণরঙ্গিনী দেবীর কোনও সম্পর্ক নেই। উত্তরবৈদিক ও পুরাণযুগে দুর্গা নামে এক দেবীর প্রসঙ্গ বারবার এসেছে। তিনি দু' ধরনের পরস্পর বিপরীতরূপে প্রকটিত হ'ন। তাঁর রণদুর্মদ যোদ্ধৃ মূর্তিটি অপেক্ষাকৃত প্রত্যক্ষ। কিন্তু, অপর অবতারটিও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে তিনি প্রজননমুখী শষ্যদেবীর মূর্তি ধরে আবির্ভূতা হ'ন। উল্লেখ্য, দুই কল্পনারই আদি শিকড় রয়েছে অনার্য মনন ও সভ্যতার ভূমিতে। আর্য সভ্যতার অন্দরমহলে দুর্গাকে সরাসরি খুঁজে পাওয়া যায়না। বৈদিক সাহিত্যে তাঁর মূল খোঁজা একান্তভাবে 'নিপাতনে সিদ্ধ'। আর্য পুরাণসাহিত্যে দুর্গার যাবতীয় কল্পনা পর্বত-অরণ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তা সে হিমালয় হোক বা বিন্ধ্য পর্বত। বিবর্তনের স্তরে তাঁর একটি কল্পিত রূপ পর্বতরাজ হিমালয় কন্যা পার্বতী। যিনি অনার্যদেবতা শিবঠাকুরের শক্তি বা সঙ্গিনী। এটি আর্য প্যান্থিয়নের সংযোজন। কিন্তু অন্যরূপটি অধিক প্রাচীন এবং ইতিহাসসম্মত। এদেশে আর্যদের আসার বহু আগে থেকে বিন্ধ্যপর্বত ও তার অরণ্যপ্রদেশে শবর, আভীর প্রভৃতি পার্বত্য আদিম উপজাতিদের বসবাস রয়েছে। তাদের মাতৃশক্তি হিসেবে একজন দেবী বহুদিন ধরেই পূজিত হয়ে আসছেন। নাম, বিন্ধ্যবাসিনী। এই দেবীর পূজাপদ্ধতিতে সামিল রয়েছে মদ্য-মাংস-রুধির পানের বিধি। হরিবংশ, বিষ্ণুপুরাণ ও মহাভারতে (বিরাট পর্ব) এই পূজাপদ্ধতিকে একান্তভাবে অনার্য সুলভ বলা হয়েছে। বস্তুতঃ আর্যমতেও একসময় 'বনদুর্গা' নামে এক দেবীকে স্বীকার করা হয়েছিলো, যিনি বিন্ধ্যবাসিনী দেবীর নিকটতম বিগ্রহ, সম্ভবতঃ অরিজিন্যাল 'দুর্গা'। একটা ব্যাপার মোটামুটি স্বীকৃত। খ্রিস্টিয় চতুর্থ শতক, অর্থাৎ গুপ্তযুগের সময় থেকে দুর্গা তাঁরা অনার্য বাসভূমি ও ধারণা থেকে ক্রমশ মুক্ত হতে শুরু করেছিলেন। আর্যপুরাণের নিজস্ব রূপকল্পে যুদ্ধপরা, দানবদলনী দুর্গার মূর্তি প্রবর্তিত হয়ে যায়। '
তবু লোকে ব্রাহ্মণ্য ব্যাখ্যা দিতে এবং শেখাতে চায়।