পছন্দ | জমিয়ে রাখুন | পুনঃপ্রচার |
একালে দেবী কালী বলতে যা বুঝি, তার ভিত্তি কালিকাপুরাণ। কালিকাপুরাণ মানেই কামরূপ মন্দিরের দেবী কামাখ্যাকে কেন্দ্রে রেখে দীর্ঘ, বহুস্তরীয় ডিসকোর্স। তার সূত্র ধরেই 'দেবী কালী'র প্রাসঙ্গিক ধ্যানধারণার সূচনা। এই চর্চার ফলশ্রুতি বর্তমান কালে কালী দেবী ভাবনার মূল রূপরেখা।
কালিকাপুরাণ প্রথম সংকলিত হয়েছিলো দশম শতকে। গ্রন্থটিতে আটানব্বইটি অধ্যায় এবং প্রায় ন'হাজারটি শ্লোক রয়েছে। পুরাণটি সর্বতোভাবে দেবী কালীকেন্দ্রিক। কালীর নানা রূপ নিয়ে এখানে বিশদ বিবরণ পাওয়া যাবে। এতে বর্ণিত নদী ও পর্বতের নামগুলি কামরূপ রাজ্যের সঙ্গে জড়িত। এই সংকলনে দেবী কামাখ্যা বা কামাক্ষীর পূজাপ্রকরণ বিষয়ে বিশদ আলোচনা পাওয়া যায়। বারো শতকে কৃত্যকল্পতরুর লেখক লক্ষ্মীধর বলেছিলেন কালিকাপুরাণ আদতে একটি উপপুরাণ। তিনি এও বলেছিলেন পুরাণটি সৃষ্টি হয়েছে আঠেরোটি মহাপুরাণের বিষয়বস্তুর সম্মিলনে। ক্রিয়ারত্নাকর প্রণেতা চন্দ্রশেখরও লক্ষ্মীধরকে সমর্থন করেছিলেন। বল্লালসেনের 'দানসাগরে' শাম্বপুরাণের সঙ্গে কালিকাপুরাণের নামও নেওয়া হয়েছে।
বল্লালসেন থেকে রঘুনন্দন পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে আদি কালিকাপুরাণ অবলুপ্ত হয়ে গিয়েছিলো। দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় সংকলিত কালিকাপুরাণে 'একপঞ্চাশত্তমোহধ্যায়' অর্থাৎ একান্নতম অধ্যায় থেকে দেবতা মহেশ্বর মানসপুত্র ভৈরব ও বেতালকে উপদেশের মাধ্যমে তন্ত্রশাস্ত্রের বিস্তৃত, জটিল সন্দর্ভের শিক্ষা দিচ্ছেন। কালিকাপুরাণের এই অংশটি দেবী কালীর পূজার্চনা ও তন্ত্রসাধনার মূল উৎস। প্রাপ্ত তথ্যগুলি বিচার করলে মনে হয় বর্তমানে প্রচলিত কালীধারণা ষোলো শতকের পরেই বিকশিত হয়েছিলো। অর্থাৎ সুলতানি আমলে। কালের বিচারে বর্তমান কালী সন্দর্ভটি নিঃসন্দেহে অর্বাচীন।
কালিকাপুরাণের খ্যাতি বা 'অখ্যাতি' দুইই রয়েছে। কালীপূজকদের জন্য এটি একটি আকর গ্রন্থ। অন্যদিকে এতে বর্ণিত নরবলি বা অন্যান্য বহু তান্ত্রিক আচার সাধারণ মানুষের ভীতি ও ঘৃণার কারণ হয়। প্রচলিত মূলস্রোতের পূজাবিধি ও গোপন তান্ত্রিক পদ্ধতির মধ্যে সমীকরণ করার প্রয়াস কালিকাপুরাণের একটি প্রধান উপজীব্য। এই পুরাণের সংকলকরা পঞ্চ-ম'কার সংক্রান্ত আচার আচরণ ভক্তজনের মধ্যে গ্রহণযোগ্য করে তোলার প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিয়েছিলেন । মনে করা হয়, দেবী কামাখ্যার অনুগামীরা পুরাণটির সূত্রপাত করেছিলেন। পরবর্তী কালে অন্যান্য প্রান্তের শাক্ত নিবন্ধলেখকরা এর মধ্যে নিজস্ব ধ্যানধারণা যোগ করেন। কালিকাপুরাণে নানা কল্পিত ও অসমর্থিত আখ্যানের ভিত্তিতে কালীমহিমার 'প্রামাণ্য' ও গ্রহণযোগ্য ইতিহাস সৃষ্টি করার চেষ্টা দেখা যায়। আরেকটি বিশেষত্ব হলো, এই পুরাণেই প্রথম ভক্তদের 'হিন্দু' বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। তার আগে এদেশের কোনও শাস্ত্রে ঐ শব্দটি দেখা যায়নি। এমনকি পরবর্তীকালেও বিষ্ণুবাদী আর্যশাস্ত্রগুলিতে হিন্দু শব্দটি এড়িয়ে চলা হয়েছে। আদি শংকর পরিভাষা হিসেবে 'হিন্দু'র পরিবর্তে 'সনাতন' শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। সম্ভবত 'হিন্দু' শব্দটির বিরুদ্ধে ম্লেচ্ছস্পৃষ্ট হবার অভিযোগ ছিলো।
কামাখ্যাদেবীর পূজার্চনার অধিকার নিয়ে আর্য ও আর্যেতর সমাজের মধ্যে প্রবল প্রতিযোগিতার আখ্যান কালিকাপুরাণের উপজীব্য। রাজা নরকের উপাখ্যান থেকে তা স্পষ্ট বোঝা যাবে।
অনার্য কিরাত সম্প্রদায়ের সঙ্গে শক্তিদেবী ও শিবের পরম্পরা পরস্পর নির্ভরশীল । ব্রাহ্মণ্য উৎস অনুযায়ী পুরাকালে প্রাগজ্যোতিষে কামরূপ রাজ্যের কেন্দ্রে কামাখ্যা অঞ্চল ছিলো 'নায়িকা দ্বারা আকীর্ণ'। এই নারীরা নানারকম তান্ত্রিক ও যৌগিকশক্তির আধার ছিলেন। বহিরাগতদের তাঁরা জাদুবলে পশুতে পরিবর্তিত করে দিতে পারতেন। এই রাজ্যে এককালে দেবতা মহাদেব স্বয়ং 'রহস্য' নামে এক কঠোর তপস্যা করেছিলেন। কালক্রমে প্রাগজ্যোতিষ রাজ্যে শিবের মাহাত্ম্য ম্লান করে বিষ্ণুর পরাক্রম জারি হয়। বিষ্ণু রাজ্যটি দান করেন তাঁর আত্মজ নরককে। কিরাতরা ছিলেন কামাখ্যা নগরের মূল বাসিন্দা। সেখানে তাঁদের প্রবল প্রতাপ ছিলো । কামাখ্যা নগরীতে প্রতি গৃহের দ্বারে স্বর্ণপূর্ণ ঘট সাজানো থাকতো। চারিদিক ছিলো নানা রঙের ধ্বজপতাকায় সজ্জিত। কিরাতরা ছিলেন মদ্যমাংসপ্রেমী। তাঁদের রাজা ঘট্টিক, বিষ্ণু এবং তাঁর পুত্র নরকের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন ছিলেন। তাঁদের দেখলে তিনি কুপিত হতেন।
আর্য সভ্যতার প্রতিভূ দেবতা বিষ্ণু, শিবের অধিকারে থাকা প্রাগজ্যোতিষ রাজ্য দখল করতে চাইলেন। কিন্তু রাজা ঘট্টিক আর্যদের দখলদারি মানলেন না। 'দেবতা'দের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করতে বাধ্য হলেন। কিরাতরাজ ঘট্টিক, বিষ্ণু (নারায়ণ) এবং তাঁর পুত্রের উদ্দেশে যুদ্ধযাত্রা করলেন। যুদ্ধের সময় বীর কিরাত সেনাদের শরবর্ষণে অস্থির নারায়ণ পুত্র নরককে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে বললেন। কিংবদন্তি অনুযায়ী , সেই যুদ্ধে বীরত্ব সহকারে লড়াই করে নরক কিরাতরাজকে বধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। পরাজিত হয়ে কিছু কিরাত বীর নরকের শরণাপন্ন হলেন বটে, কিন্তু নারায়ণ নরককে জানালেন , অধিকাংশ কিরাত সম্প্রদায় দেবী দিগবাসিনীর (দিগম্বরী কালিকা) শরণ নিয়েছেন।
দেবী তাঁদের রক্ষা করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। নরক পুনরায় যুদ্ধযাত্রা করে বিদ্রোহী কিরাতদের পরাজিত করায় নারায়ণ তাঁকে বর দেন নরক প্রাগজ্যোতিষ কামাখ্যা রাজ্যের অধিপতি হবেন। কিরাতরা পূর্বদিকে সাগরপারে বিতাড়িত হবেন। নরক রাজা হবার পর কামাখ্যায় বেদাধ্যায়ী ব্রাহ্মণরা এসে বসবাস শুরু করেন। কিরাতদের আরাধ্যা আদ্যাশক্তি যোগমায়া কামাখ্যাদেবী আর্যরাজাদেরও পূজ্যা হয়ে উঠলেন।
কিন্তু কাহিনী এখানেই শেষ হয়না। রাজা নরক দীর্ঘদিন শাসন করার পর তাঁর সঙ্গে অসুরদের রাজা বলির পুত্র বাণের সৌহার্দ্য হলো। বাণ ছিলেন প্রবল শৈব। তাঁর প্রভাবে পড়ে নরক বেদ-ব্রাহ্মণের অধিকার, অর্থাৎ আর্যসংস্কৃতির প্রতিপত্তিকে অবহেলা করতে শুরু করেন। নিজেও বিষ্ণু দেবতাকে ত্যাগ করলেন। শৈবপ্রভাবে তিনি ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতিকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করতে উদ্যমী হয়ে উঠলেন। এই 'বিদ্রোহে'র ফলে বশিষ্ঠমুনির অভিশাপে তাঁর রাজ্য বিনষ্ট হয়ে গেলো। নারায়ণ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে শৈবপন্থী নরকের রাজত্বকে উচ্ছন্নে পাঠালেন।
আখ্যানটি থেকে স্পষ্ট, প্রাগজ্যোতিষের অধিকার নিয়ে শৈব ও বৈষ্ণবদের মধ্যে দ্বন্দ্ব নিরবচ্ছিন্নভাবে চলে এসেছে। যেহেতু কামাখ্যাদেবীর অধিকার পেলেই একসঙ্গে প্রাগজ্যোতিষ রাজ্যের অধিকারও অর্জন করা যায়, তাই উভয়গোষ্ঠীর মধ্যে বিসম্বাদ কখনও থামেনি। কালিকাপুরাণে বিধৃত আখ্যানের মধ্যে আবহমান কাল ধরে চলে আসা বাংলা ও অসমে শাক্ত ও বৈষ্ণবদের মধ্যে ক্ষমতাদখলের ইতিবৃত্ত লিপিবদ্ধ আছে।
বারো-তেরো শতকে কালিকাপুরাণের কেন্দ্রে ছিলেন শৈবমতের সঙ্গে সংলিপ্ত দেবী যোগমায়া। এই দেবী শিবের অন্যতম শক্তি হিসেবে গণ্য হতেন। বর্তমান কালিকাপুরাণে যে প্রবল তান্ত্রিক আনুগত্য চোখে পড়ে, তখনও তা দানা বাঁধেনি। এই পুরাণের পরবর্তী সংস্করণে আরও একটি অসঙ্গতি দেখা যায়। এর মধ্যে বৈষ্ণব আগমের প্রভাবও স্পষ্ট । প্রবণতাটি সম্পূর্ণ শাক্ত পরম্পরায় রচিত একটি পুরাণে বেমানান। মনে করা হয় কালিকাপুরাণে বিষ্ণুর উপস্থিতির মূলে রয়েছে 'পঞ্চরাত্র' আন্দোলনের প্রভাব। এককথায় বর্তমানে প্রাপ্ত কালিকাপুরাণ একটি শাক্ত ও বৈষ্ণব আগমশাস্ত্রের মিশ্রিত ডিসকোর্স। ষোলো শতকে নির্মিত বর্তমান কামাখ্যা মন্দিরের সর্বত্র বিষ্ণুমূর্তির প্রাধান্য এই ধারণার সাক্ষ্য দেয়।
বিষ্ণুর ঔরসে জাত বরাহরূপিনী পৃথ্বীদেবীর সন্তান মহাবীর নরকাসুর যখন বন্ধু বাণাসুরের প্রভাবে শৈবমত গ্রহণ করেন, তখন বিষ্ণু নিজে তাঁকে বিনাশ করার জন্য এগিয়ে আসেন। রাজা নরকের সঙ্গে যুদ্ধে বিষ্ণুর সঙ্গী ছিলেন কালিকা ও কামাখ্যা দেবী। বিষ্ণুর শক্তি হিসেবে রক্ত-অক্ষী, রক্ত-আনন কালিকা ও কামাখ্যা দেবীকে দেখা যায় কালিকাপুরাণের এই পর্বে। শিবের শক্তি হয়ে ওঠার অনেক আগে কালী ছিলেন বিষ্ণুর শক্তিরূপ। বিষ্ণুকে দিয়ে শুরু হলেও সামগ্রিকভাবে কালিকাপুরাণের মতে শক্তিদেবী কালীর পুরুষসঙ্গী ছিলেন শিব। কালীর নামান্তর ছিলো রুদ্রাণী, শংকরী বা শিবদূতী। দেবী জন্ম-জন্মান্তর ধরে নানারূপে আবির্ভূতা হয়েছিলেন শিবের শক্তি হয়ে। শিবের মনোযোগ আকর্ষণ, তাঁকে জয় করাই ছিলো শক্তিদেবীর প্রধান উদ্দেশ্য।
উদ্ভবকাল থেকেই কালিকাপুরাণ বৈষ্ণব ও শাক্তমতের পরস্পর বিপরীত মেরুর মধ্যে দোলায়মান থেকেছে। প্রথম পর্বে বিষ্ণুর সঙ্গে দেবীর সংলিপ্তি বিষয়ে আলোচনা আছে। পুরাণটির সূচনায় হরির প্রতি প্রণাম জানাবার পর দেবীর প্রতি আনুগত্য জানানো হয়েছে। দেবী এখানে 'বিষ্ণুমায়া'। বিষ্ণু তাঁকে সৃষ্টি করেছেন ভক্তজনের আশ্রয়, জ্ঞান ও মুক্তিদায়িনীরূপে। 'মায়া তোমাদের রক্ষা করুন। তিনি বিষ্ণুমায়া। সূর্যালোকে যেমন অন্ধকার দূরীভূত হয়, তাঁর দয়ায় মানুষের অজ্ঞান (অবিদ্যা) দূর হবে। তিনিই মুক্তির হেতু এবং পাপচিন্তা দূর করে মানুষকে শুদ্ধ করবেন।'
কামরূপ রাজ্যটি আর্য ভারতের ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে ভৌগলিক ভাবে বহুদূরে। পর্বত-অরণ্যানী পরিবৃত এই জনপদ এবং বাকি দেশের মধ্যে পাহাড় ছাড়াও রয়েছে দুর্বার ব্রহ্মপুত্র নদ। বঙ্গদেশের শিলহট্ট অঞ্চল হয়ে স্থলপথের সংযোগটিই ছিলো যোগাযোগের প্রধান উপায়। এই পথও সুগম নয়। বর্তমান কালের মেঘালয় রাজ্যের নানা দুরূহ মানচিত্র পেরিয়ে এখানে পৌঁছোতে হতো। এই রাজ্যের মূল অধিবাসীরা এসেছিলেন উত্তর ও পূর্ব দিক থেকে। উত্তরের পার্বত্য মূলের মানুষ ও পূর্বের বর্মা, শ্যামদেশের জনধারা থেকেই এখানকার বাসিন্দাদের প্রধান স্রোতটি তৈরি হয়েছিলো। এঁদের মধ্যে বৌদ্ধ বজ্র ও লামাতন্ত্রযানের প্রভাব ছিলো প্রবল। এই জনগোষ্ঠীর আনুগত্য অর্জন করতে ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতি তন্ত্রমন্ত্রের প্রথা-প্রণালী নিজেদের মধ্যে আত্মস্থ করে ফেলেছিলো। তা সত্ত্বেও শৈব মূল নিবাসী ও বিষ্ণুবাদী বহিরাগত শক্তির মধ্যে টানাপোড়েন সমানে চলতে থাকে।
ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি আর্যেতরদের কিছু কিছু যাপন গ্রহণ করেছিলো। আবার অনেক কিছুই করেনি। আজকের দিনেও দেশের উত্তরপূর্বের রাজ্যগুলিতে আমরা জনজাতিক মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা দেখতে পাই। একসময় কামরূপ এই ব্যবস্থার কেন্দ্র ছিলো। স্বাভাবিক ভাবেই এই রাজ্যের মেয়েরা ছিলেন পুরুষদের থেকে উজ্জ্বলতর মানবগোষ্ঠী। বর্ণাশ্রমী ব্রাহ্মণ্য ব্যবস্থা এটা মেনে নিতে পারতো না। নারীদের এতো প্রভাব-প্রতিপত্তি তাদের পীড়িত করতো। কিন্তু সরাসরি বিরোধিতাও করতে পারতেন না তাঁরা। শেষ পর্যন্ত কামরূপের নারীদের বিরুদ্ধে ডাকবিদ্যা চর্চার অভিযোগ তুলে বহিরাগত আর্য পুরুষদের জন্য সাবধানবাণী প্রচার করা হতো। কামরূপের স্বাধীনা, রূপসী, বরনারীদের আকর্ষণে যেন আর্য বীরেরা মোহগ্রস্ত না হয়ে পড়ে। এক কথায় ঐ নারীরা ডাকিনী -যোগিনী- জাদুকরী। তারা মোহগ্রস্ত পুরুষদের রুধির পান করে থাকে। তাদের প্রতি মোহ জয় করতে না পারলে দিগ্বিজয়ী ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ও বীর ক্ষত্রিয়রা 'মেষজন্ম' লাভ করবে। এই সব প্রচারে যে বিশেষ লাভ হয়েছিলো, তা নয়। বহিরাগত আর্য পুরুষরা স্থানীয় নারীদের সঙ্গিনী করে তন্ত্র-মন্ত্র চর্চায় সুখে দিনাতিপাত করতেন। তা আর্যাবর্তের পুরোহিতরা যতো রাগই করুন না কেন। যেমন, সব সুস্থ, স্বাভাবিক নারীর দল 'শাশুড়ি' পদ পেয়ে গেলেই মনে করতে থাকেন তাঁদের সোনার চাঁদ পুত্রকে বধূটি ‘ভেড়া’ বানিয়ে দিয়েছে। ইতিহাস নিজেকে পুনরাবৃত্ত করে।
এই সব মানুষই আধুনিক অহোম সভ্যতার জন্ম দিয়েছিলেন।
কামরূপ জনপদটি এ দেশের নারীশক্তির আদি বৈজয়ন্তী কেন্দ্র। সেই উত্তরবৈদিক যুগ থেকে সারাদেশে যখন পুরুষতান্ত্রিকতার আতিশয্যকে কেউ কখনও চ্যালেঞ্জ করতে পারেনি, একমাত্র কামরূপ সভ্যতাই চিরকাল নারীশক্তির শ্রেষ্ঠত্বকে শিরোপা দিয়ে এসেছে। চিত্রাঙ্গদা থেকে রানি গুইদালো, কিছুই ব্যতিক্রম নয়। জনজীবনে ও ব্যক্তিযাপনে দেশের এইপ্রান্তে কৌমসংস্কৃতির প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিলো দেবী কালীর প্রবল প্রভাব । তাকে স্বীকৃতি দিতে ঔপনিবেশিক আর্য সংস্কৃতি বাধ্য হয়েছিলো। তাকে নিজেদের অধ্যাত্মচর্চার অঙ্গ করে ফেলেছিলেন তাঁরা। সমাজ বিবর্তনের এই 'বিজয়ী' ধারাটি এখানকার মেয়েদের আত্মবিশ্বাসী করেছিলো । তাঁরা ‘রূপসী’ তো ছিলেনই । উপরন্তু ব্যাপক মাত্রার আত্মবিশ্বাস তাঁদের আরো আকর্ষণীয় করে তোলে। কামরূপ কামিনীরা ইতিহাসের একটা সময়ে পুরুষতন্ত্রের তোয়াক্কা করতেন না। তাঁদের এই ক্ষমতা অর্জনের উৎসে ছিলেন কালিকাপুরাণের দেবী কালী। ছিলো মহাদেবীর যোনিপীঠ ভিত্তিক গুহামন্দিরের আত্মবিশ্বাসী ঐতিহ্য। দেবী কালীর ইতিহাস খুঁজতে গেলে এই সত্যটিও মনে রাখতে হয়।
পছন্দ | জমিয়ে রাখুন | গ্রাহক | পুনঃপ্রচার |
ডাকবিদ্যাই কথাটা ? না ডাকিনী বিদ্যা ?
অত্যন্ত সুলিখিত নিবন্ধ। তবে মনে হয়েছে দেবী কালিকার সঙ্গে প্রাগজ্যোতিষদের কামিনীদের যোগসূত্র আর একটু বিস্তারিত হলে ভালো হতো। মাতৃমুখী সমাজ ব্যবস্থার পেছনে আর্থ-সামাজিক কারণ আর কিছু আছে কি?
@Prativa Sarker,
'ডাক' সম্বোধনটি তিব্বতি ভাষায় বজ্রযানী জ্ঞানী পণ্ডিতদের উদ্দেশে ব্যবহার করা হতো। এঁরা লামাতন্ত্রযানের প্রধান প্রতিভূ ছিলেন। তাঁরা গোপ্য তান্ত্রিক আচার ব্যবহার প্রণয়ন ও চর্চা করতেন। এটিই 'ডাকবিদ্যা'। তাঁদের সাধনসঙ্গিনীদের 'ডাকিনী' বলা হতো। অপভ্রংশে 'ডাইনি'।
দ্বিতীয় বিষয়টি একটু বিস্তৃত প্রসঙ্গ। তিব্বতি লামাতন্ত্র 'মাতৃতান্ত্রিক' ছিলোনা। কিন্তু সামগ্রিকভাবে তন্ত্রশাস্ত্র যেহেতু প্রকৃতিবাদী শক্তি ব্যবস্থায় আস্থা রাখে , দেশের পূর্ব প্রান্তে তাঁদের আপোশ করতে হয়েছিলো। উত্তর-পূর্ব প্রান্তের মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রায় প্রাগ ইতিহাস কাল থেকে চলে আসছে। বস্তুত জনজাতি সংস্কৃতি প্রভাবিত সব সভ্যতায় অল্পবিস্তর মাতৃতান্ত্রিক প্রবণতা দেখা যাবে। কামাখ্যা সংস্কৃতিতে পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রভাব এসেছে অপেক্ষাকৃত দেরিতে। তা নিয়ে ভিন্ন আলোচনা হতে পারে।
লেখককে একটা প্রশ্নঃ বিভিন্ন কালীক্ষেত্রের অধিষ্ঠিত ভৈরব বিভিন্ন হয় বলে জানি। এই বিষয়ে কোন তথ্য পাওয়া যায়?
@ar,
অনার্য শিবের প্রধান অনুচরদের ভৈরব বলা হতো। শিব-শক্তি তন্ত্র পরম্পরায় তন্ত্রোক্ত শক্তিদেবীদের সঙ্গী হিসেবে বহু জায়গায় শিব নিজেই ভৈরবরূপে আবির্ভূত হয়েছেন। বিশেষত একান্ন পীঠের সঙ্গে যে সব শক্তি দেবী চিহ্নিত হয়ে আছেন, সেখানে দেবীর 'সঙ্গী' ভৈরব। 'সঙ্গী' মানে তাঁরা পার্বতীর 'মহেশ্বর' ন'ন। পুরাণের মতে শিব বা মহেশ্বর পার্বতীর 'স্বামী'। কিন্তু তন্ত্রমতে ভৈরব কোনও দেবীর 'স্বামী' ন'ন, শুধুমাত্র সাধনসঙ্গী। এ প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে সামগ্রিকভাবে যে দেবতাকে আমরা 'শিব' নামে জানি, তিনি 'ভৈরব' ন'ন। সব ভৈরবের মধ্যে কালভৈরব নামে একটি চরিত্র নানা মহিমায় ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ তন্ত্রচর্চার আবশ্যিক অঙ্গ। শিবের তন্ত্রজাত অনার্য চারিত্র্যটি বুঝতে গেলে কালভৈরব একটি প্রয়োজনীয় ধারণা। দেবতা বা উপদেবতা হিসেবে কালভৈরবের নাম নানা সূত্রে পাওয়া গেলেও তাঁর প্রধান পরিচয় হয়ে উঠেছে তিনি শিবের প্রধান ও বিশ্বস্ততম অনুচর।
@শিবাংশু,
অনেক ধন্যবাদ। ভৈরব যে দেবীর সাধনসঙ্গী এইটা বুঝলাম। কিন্তু এই যে বিভিন্ন শক্তি-পীঠের সাধনসঙ্গী বা ভৈরবরা আলাদা, এইটার কোন ব্যাখ্যা আছে? উদাহারণস্বরূপ, নলহাটি, কালীঘাট আর কামাখ্যা মন্দিরের তিন পৃথক ভৈরব, এর নিশ্চয় কোন পূর্বনির্ধারণ পদ্ধতি আছে।
@ar,
ব্যাপারটা বুঝতে একটু পিছিয়ে যেতে হবে।
আমাদের দেশে শক্তি আরাধনার প্রচলন ছিলো শুধু মাত্র আর্যেতর সমাজে। প্রাগ বৈদিক, বৈদিক বা উত্তর বৈদিক কোনও আর্য সংস্কৃতিতেই 'শক্তিদেবী'র উল্লেখ নেই। অন্য দেবীদের কথা কিছু পাওয়া যায়। আর্যদের প্রকৃতিপূজার মুখ্য প্রতীক ছিলেন পুরুষ দেবতারা। তাঁদের আগে থেকেই আর্যেতর সম্প্রদায়ের প্রকৃতি আরাধনার 'বিগ্রহ' হতেন দেবীরা। তাঁদের পূজা পদ্ধতির নামই 'তন্ত্র', অর্থাৎ তাঁত। যার মূল ছিলো আগমশাস্ত্রে। মানবশরীরকে তাঁতের সঙ্গে তুলনা করা হতো। তা পুরুষ ও নারী, দুই ধরনের টানা ও পোড়েনের সুতো দিয়ে বোনা কাপড়ের মতো। গুপ্তযুগের সময় থেকে এই দুই সংস্কৃতির মধ্যে আদানপ্রদান শুরু হয়। কারণ মহাযানী পরম্পরা দ্রুত আর্যেতর সম্প্রদায়ের মানুষদের নিজেদের সঙ্গে শামিল করে নিচ্ছিলো। ব্রাহ্মণ্য সমাজ তা আটকাতে সচেষ্ট হয়। বৌদ্ধ তন্ত্রের উদ্ভবই আর্যেতর লৌকিক বিশ্বাসের সূত্র ধরে হয়েছিলো। এই সময় থেকেই আর্যেতর সম্প্রদায়ের অসংখ্য লৌকিক গ্রামদেবীরা হয় মহাযানী অথবা ব্রাহ্মণ্য অনুমোদন পেয়ে স্বাধীন 'শক্তি'দেবীর মর্যাদা লাভ করতে শুরু করেন। পুরাণে 'একান্ন পীঠ' তত্ত্বের সূচনা সেখান থেকেই হয়েছিলো। মধ্য পুরাণযুগে যখন তন্ত্রচর্চা মোটামুটি ব্রাহ্মণদের অধিকারের মধ্যে চলে আসে, তখন থেকে সংস্কৃতে অসংখ্য ধরনের তন্ত্রশাস্ত্র রচিত হতে থাকে। বাংলায় দশম শতকে চর্যাপদের কালে বৌদ্ধ তন্ত্রসাধনা শীর্ষে উঠেছিলো। বারো শতক নাগাদ তুর্কি আক্রমণে এদেশে মহাযানী পরম্পরা বিনষ্ট হয়ে যেতে বজ্রযানী তান্ত্রিক বৌদ্ধরা তিব্বত, নেপাল ইত্যাদি পার্বত্য প্রদেশে চলে যান। অবশ্য ওসব দেশে ছয় শতক থেকেই বজ্রযানী তন্ত্রসাধনার প্রচলন ছিলো।
ভৈরবদের আলাদা হবার কারণ তাঁরা যে সব দেবীর সঙ্গে যুক্ত, তাঁরাও সবাই আলাদা। কোনও দুই শক্তি দেবী এক ন'ন। প্রত্যেকেই স্থানীয় লোকবিশ্বাস থেকে বিবর্তিত হয়ে বর্তমান রূপ পরিগ্রহ করেছিলেন। শিবশক্তি তন্ত্র পরম্পরা অনুযায়ী প্রতি দেবীরই একজন পুরুষ দেবতার সঙ্গ প্রয়োজন। ভৈরব 'দেবতা'রাও সেই সূত্রেই উদ্ভাবিতও হয়েছিলেন। তাঁদের কোনও পৃথক মাহাত্ম্য ছিলো না।
@শিবাংশু,
আপনাকে আবার ধন্যবাদ জানাই। আরেকটা ব্যাপার আমার কাছে খুবই আশ্চর্য লাগে। আপাত নিরীহ বৌদ্ধ-ধর্মে কীভাবে অনার্য লৌকিক দেবদেবীর/শক্তি-তন্ত্রের আত্তীকরণ হল। সম্ভবতঃ প্রাচীন জৈন সাধকদের মধ্যেও তন্ত্র-চর্চার প্রচলণ ছিল।
শুভেচ্ছান্তে,
@ar,
আপনার প্রশ্নে একটা বিশেষণ বেশ কৌতুহল জাগালো। 'ধর্ম' বলতে যদি কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় সম্প্রদায় বিশেষের অনুসরণীয় কিছু বিশ্বাস ও নির্দেশকে বোঝায়, তবে তার সঙ্গে 'নিরীহ' বিশেষণটির প্রয়োগ অবশ্যই একটা মাত্রা যোগ করে। তা আপাত বা মৌলত, যাই হোক। এ নিয়ে পৃথক আলোচনার অবকাশ আছে।
ইতিহাস অনুসরণ করলে দেখা যায় 'ধর্ম' যখন থেকে প্রতিষ্ঠান বা সম্প্রদায় হয়ে উঠেছে তখন থেকেই তার স্বভাবটি রাজনীতির নিয়ম মেনে চলে। অর্থাৎ সব গোষ্ঠীবদ্ধ ধর্মই ছলে-বলে-কৌশলে অধিকতম সংখ্যক মানুষের আনুগত্য পেতে চায়। সভ্যতার উন্মেষ থেকেই অসংখ্য ধরনের আধ্যাত্মিক বিশ্বাস, দেব-দেবী, 'ধর্মগুরু', লৌকিক মান্যতা জন্ম নিয়েছে, আবার লুপ্তও হয়ে গেছে। যে সব গোষ্ঠী টিকে গেছে তাদের মন্ত্র ছিলো মানবসমাজে ক্রমান্বয়ে ভিত্তির বিস্তার করে যাওয়া। এদেশে বড়ো মাত্রায় উদ্যমটি শুরু হয়েছিলো সম্রাট অশোকের আমল থেকে। তা শীর্ষে পৌঁছোয় প্রথম থেকে চতুর্থ খ্রিস্টিয় শতকে কুশান রাজত্বের কালে। মনে রাখতে হবে শাক্যমুনি বুদ্ধ কোনও নতুন ধর্মবিশ্বাস প্রস্তাব করেননি। তিনি সারা জীবন ধরে মানুষকে নানা রকম উপদেশ দিয়েছিলেন। যেসবের লক্ষ্য ছিলো মানবসমাজের বৃহত্তর কল্যাণসাধন। তাঁর উপদেশকে কেন্দ্র করে 'ধর্মীয় সম্প্রদায়' সৃষ্টি হয় প্রায় চার-পাঁচশো বছর পরে। মূলত মহাসাঙ্ঘিকদের নেতৃত্বে মহাযানী সঙ্ঘ এবং থেরবাদীদের নেতৃত্বে 'হীনযানী' সম্প্রদায়।
চতুর্থ শতক থেকে আর্যাবর্তে গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রাধান্য স্থাপিত হতে শুরু করে। তখন থেকেই দেশের সংখ্যাগুরু কৌম সমাজের মানুষদের উপর কাদের আধিপত্য থাকবে তা নিয়ে মহাযানী ও ব্রাহ্মণ্য সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষমতার যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
মহাযানী সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আচার্য নাগার্জুন, অসঙ্গ ও বসুবন্ধু প্রমুখ। অন্যদিকে ব্রাহ্মণ্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে রাজকীয় সমর্থন ছিলো। এদেশের আর্যেতর কৌম সমাজে বিপুল মাত্রায় তন্ত্র-মন্ত্র, জাদু ও অলৌকিক আচার ব্যবহারের প্রতি বিশ্বাস বর্তমান ছিলো। তাঁদের এই সব বিশ্বাসকে যদি স্বীকার না করা হতো, তবে সংখ্যাগুরু অনার্য সমাজ মহাযানী বা ব্রাহ্মণ্য উভয় শক্তিকেই প্রত্যাখ্যান করতেন। এক কথায় 'দল ভারি' করার জন্যই মহাযানী ও ব্রাহ্মণ্য সমাজ উভয়েই এই সব অনার্য লোকবিশ্বাসকে নিজেদের 'ধর্মে'র মধ্যে জায়গা করে দিয়েছিলেন। তার ফলেই পরবর্তীকালে সমান্তরাল ভাবে মহাযানী বা পৌরাণিক সংস্কৃতির মধ্যে ব্যাপক মাত্রায় তন্ত্রমন্ত্র চর্চার প্রচলন হয়ে যায়। জৈন মতেও তন্ত্রচর্চার প্রবেশ এভাবেই হয়েছিলো।
খুবই তথ্য সমৃদ্ধ লেখা। এটি উপহার দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
আচ্ছা, আমার একটা প্রশ্ন আছে, সারা ভারতীয় উপমহাদেশব্যাপী এই শক্তি সাধনার স্থানগুলি সতীপীঠের
মাধ্যমে এক সূত্রে বাঁধার যে কাজ শুরু হয়েছিল, তা কি ভাবে শুরু হল ?
হলেও কি সব জায়গায় তা একসাথে হয়েছিল না আলাদা আলাদা সময়ে ?
এই যে দেহাংশ পড়ার আখ্যান, এই মিথ গড়ে ওঠার পিছনে কি কোনো প্রাকৃতিক বা মহাজগতিক কোনো ঘটনার হাত থাকতে পারে ? না কি নিছক বিশ্বাসের দ্বারাই পরে কাহিনীটি গড়ে ওঠে। অনেক শক্তি পীঠেই তো দেহাংশ রাখা আছে বলে শোনা যায়, তো তার পিছনের প্রকৃতার্থ কি ?
এই বিষয়টি নিয়ে আমার অনেকদিনের কৌতূহল। আপনি আলোকপাত করলে বাধিত হব।
ধন্যবাদ
@Ramit Chatterjee
আপনার প্রশ্নটির দুটো অংশ আছে। প্রথমটি 'সতী' প্রসঙ্গে, দ্বিতীয়টি শক্তিপীঠ সংক্রান্ত।
যতো দিন পর্যন্ত 'সৎ'-য়ের সঙ্গে সতী যুক্ত ছিলো, অর্থাৎ বৈদিক সভ্যতার প্রথম দিকে, ততোদিন এই শব্দটি ছিলো একটি বিশেষণ পদ মাত্র। কিন্তু পরবর্তীকালে আর্যদের মধ্যে পুরুষতান্ত্রিকতা যতো বাড়তে থাকলো, সতী শব্দটির ব্যঞ্জনাও গেলো পাল্টে। বিশেষত পুরাণ যুগের ঘোর বর্ণাশ্রমী সমাজে, যখন গোধন ও স্ত্রীধনের মধ্যে ফারাক ঘুচে গিয়েছিলো, 'সতী' শব্দের সঙ্গে Chastity-কে ওতপ্রোত করে দেওয়া হয়েছিলো। আদর্শ ‘পুরুষ’ হিসেবে দেবতা শিবের যে ভাবমূর্তি প্রস্তুত করা হয়, তারই বিপরীতে পার্বতী দেবীর ছায়া হয়ে এলেন দেবী 'সতী'। দেবী পার্বতীর স্বভাবে নানা মাত্রা দেখা যায়। কিন্তু পুরাণকারদের দৌলতে দেবী সতীর একমাত্র 'গুণ' তাঁর পতি-আনুগত্য। প্রকৃত পক্ষে এটি 'পুরুষ-আনুগত্য' ছাড়া আর কিছু নয়। আর্যেতর সমাজে শক্তিদেবীদের 'সতীত্ব' নিয়ে কোনও মাথাব্যথা ছিলোনা। তাঁরা ছিলেন স্বাধীনা।
একান্তভাবেই রাজনৈতিক প্রয়োজনে যখন আর্যেতর সম্প্রদায়ের মানুষদের ব্রাহ্মণ্য ব্যবস্থার মধ্যে আত্তীকরণ করতে হয়েছিলো, তখন এই সব অনার্য-মূলের দেবীদেরও উপযুক্ত পুনর্বাসন করা জরুরি হয়ে পড়লো। ব্রাহ্মণ্য সভ্যতায় 'দেবী'দের এহেন মর্যাদা ছিলোনা। সত্যি কথা বলতে কী, তাঁদের কোনও বলার মতো দেবীই ছিলেন না। আমাদের সভ্যতায় দেবীদের ক্ষমতায়ণের ব্যাপারটা আর্যেতরদের সঙ্গেই এসেছিলো। অনার্য দেবীরা ছিলেন প্রকৃতির অংশ। তাঁদের কোনও প্রতিমা বা বিগ্রহের কল্পনা করা হয়নি কখনও। তাঁরা কখনও একটি বৃক্ষ, কখনও প্রস্তর খণ্ড, কখনও বা গুহাকন্দরের একটি কোণ হয়েই বিরাজ করতেন। তাঁরা প্রকৃত পক্ষে ছিলেন গ্রামদেবী। অপেক্ষাকৃত ভাবে অল্প সময়ের মধ্যেই এই রকম বহু দেবীকে ব্রাহ্মণ্য প্যান্থিয়নের মধ্যে জায়গা করে দিতে হয়েছিলো। ব্যাপারটি নিয়ে ব্রাহ্মণ্য ব্যবস্থাতেও নানা বিরোধাভাসের খবর পাওয়া যায়। গোঁড়া আর্য-পুরোহিত ব্যবস্থার বহু সদস্য এর বিরোধিতা করেছিলেন। তখন আর্যায়িত পার্বতী দেবীর প্রতিবিম্ব সতী দেবীর মাধ্যমে একটা সমন্বয় করার চেষ্টা হয়েছিলো। এই সমস্ত লোকপ্রিয় গ্রামদেবীরা সতীর অংশ হিসেবে চিহ্নিত হন। দেশের যেসব জায়গায় এঁদের প্রভাব বেশি ছিলো, সেই সব স্থানেই সতীর দেহাংশের প্রতীকে শক্তিপীঠের স্থাপনা করা হয়।
ধন্যবাদ আপনার উত্তরে আমার ধারণাটা অনেক পরিস্কার হল।
একটা কৌতূহল রয়ে যায়, তা হল এভাবে ভারতজুড়ে বা ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে সতী দেহ পড়ার মিথের পিছনে কি কোনো উল্কাপাত জাতীয় ঘটনার ইন্ধন থাকতে পারে ?
@Ramit Chatterjee,
ভাই, যে কোনও 'ধর্মীয়' ভাবনার দুটো সত্ত্বা থাকে। একটা আধ্যাত্মিক, অন্যটা লৌকিক। 'আধ্যাত্মিক' সত্ত্বাটি মোটামুটিভাবে সর্বদেশে, সর্বকালে মানবিক নৈতিকতার দর্শনের সঙ্গে যুক্ত। সেজন্য পৃথিবীর তাবৎ এপিস্টেমিক 'ধর্মগ্রন্থে'র মলাটটা যদি বাদ দিয়ে দেওয়া হয় তবে তাদের মধ্যে কোনও তফাৎ পাওয়া যায়না। সে ব্যাপারটা আব্রাহামিক বা অ-আব্রাহামিক সব ধর্মবিশ্বাসের জন্যই প্রযোজ্য। তফাৎ হয়ে যায় স্মৃতি ও পুরাণ গ্রন্থগুলির বিষয়বস্তুর মধ্যে। মজা হলো পৃথিবীতে নিরানব্বই ভাগ মানুষই স্মৃতি ও পুরাণের লৌকিক 'ধর্মীয়তা'কে আধ্যাত্মিক বিশ্বাস বলে মনে করে। এই শাস্ত্র দুটি নির্মিত হয় রাজা ও পুরোহিতের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য। এটাও সবাই জানে রাজা ও পুরোহিত দুইই আসলে মিথ ছাড়া আর কিছু নয়। এই দুই শ্রেণীর মধ্যে পরস্পর বোঝাপড়া থাকে। পুরোহিত বলবেন রাজা ঈশ্বরপুত্র, আর রাজা বলবেন পুরোহিতের আজ্ঞাই ঈশ্বরের ইচ্ছা। এভাবেই চলে আসছে চিরদিন। এখনও চলছে। মিথ না থাকলে মানুষের সমাজে এতো অবিচার, অনাচার থাকবে কী করে?
লৌকিক 'ধর্ম'বিশ্বাসের ইতিহাস একান্ত ভাবেই রাজনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোত। মিথ তৈরি করতে প্রাকৃত, অতিপ্রাকৃত নানা কল্পনার আশ্রয় নিতে হয়। মানব ইতিহাসের যে ঘটনাক্রম সমাজতত্ত্ব দিয়ে অনায়াসে ব্যাখ্যা করা যায়, তা শাসক ও যাজকদের খুশি করতে পারে না। তাদের দরকার নস্ত্রাদামুস বা দানিকেনের মতো প্রতারক মিথ-জাদুকরদের। একালে আমাদের দেশে এদেরই তো রমরমা। 'মানুষের ধর্মে' মিথ মিশে গেলেই তা ফ্যাসিবাদ হয়ে যায়। শয়তানের পুনরাবৃত্ত চক্র যেন।
ঠিক বলেছেন আপনি। অনেক মিথ ই প্রয়োজনে তৈরি। রাজা বা শাসক এর প্রয়োজনে।
@শিবাংশু,
"আপাত নিরীহ"; বিশেষণটি অনেকটাই পশ্চিম-্সঞ্জাত, আর বাকীটা "হিজ হোলিনেস" যে ভাবে পশ্চিমের নিকট (দীর্ঘ দিন ধরে) উপস্থাপন করে এসেছেন। বাকীটা, মানে আত্তীকরণের রাজনীতির ব্যপারটা বুঝলাম।
তন্ত্র বা অন্যান্য ধর্ম সংক্রান্ত আলোচনায় যে জিনিষটা আমার কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বলে মনে হয়, সেটা হল ভাবনার বিভিন্নতা। আপাতদৃষ্টিতে এলোমেলো মনে হলেও তা কিন্তু এক কাঠামোগত (দীর্ঘমেয়াদি) প্রক্রিয়ার ফল। এই চিন্তার বৈচিত্র্যতা ও সংযুক্ত দর্শন আমাদের বৈভব হতে পারত, কিন্তু তা আর হল কৈ??!!
@ar,
'...আপাতদৃষ্টিতে এলোমেলো মনে হলেও তা কিন্তু এক কাঠামোগত (দীর্ঘমেয়াদি) প্রক্রিয়ার ফল। এই চিন্তার বৈচিত্র্যতা ও সংযুক্ত দর্শন আমাদের বৈভব হতে পারত, কিন্তু তা আর হল কৈ??!!'
এইটাই সার কথা। এটাই ভারতবর্ষের ট্র্যাজেডি। তবু ছেড়ে দিতে পারি না। ঐ বৈভব আমাদের 'বাপের সম্পত্তি'। কয়েকটা পলিটিক্যাল জন্তুর চাপে তাদের থিওরি মেনে পিছিয়ে যাওয়া যায় না। মানছি, হয়তো সে অনেক জন্মের, অনেক মনীষীর কাজ । কিন্তু যুদ্ধটা চলবে।
@শিবাংশু
তা আর বলতে। তাদের বোঝাতে বোঝাতে, তর্ক করতে করতে প্রায়শঃই অসামাজিকতার মুখোমুখি হতে হয়। কিন্তু যুদ্ধ চলবেই। এ বৈভবের দর্শন বনাম সমকালীন রাজনীতির পথ বা অ-দর্শন। দেখা যাক, কে জেতে।
@ar,
ঠিক তাই। এই দীর্ঘ জীবনে 'পলিটিক্স' করছি প্রায় জ্ঞান বয়স থেকেই। কিন্তু এ অবস্থা হয়নি কখনও। গত ছ'বছর ধরে কতো 'আত্মীয়-বন্ধু' বিচ্ছেদ হয়ে গেলো তার ইয়ত্তা নেই। প্রথম প্রথম একটু বিষন্ন লাগতো। মনে হতো, এরা কারা? এদের তো চিনতুম না। তার পর অভ্যেস হয়ে গেছে। শুম্ভ-নিশুম্ভ আমাদের ভিতরে ঘুমিয়ে থাকা অন্ধকারের দানবকে জাগিয়ে তুলতে পেরেছে। তারা চলে যাবার পরেও সেই শয়তানকে ঘুম পাড়ানো হয়তো সম্ভব হবে না।