মণিমালা নীচু হয়ে সুখশয্যায় শোয়া সুকান্তের মুখের সামনে হাত নিয়ে ঢেলে দিল ভাজা মৌরি। সুকান্ত মুখ বন্ধ করে জড়িয়ে ধরল মণিমালাকে, টেনে নিল নিজের বুকের ওপর। সুকান্তর বুকে মণিমালার বুক থেপসে গেল। একটুও আগুন জ্বলল না ঠিকই, কিন্তু সুকান্ত পুড়ে ছাই হতে লাগল। ছাড়ো, ছাড়ো আমার এখনো রাজ্যের কাজ বাকি। আমার পাশে শোয়াটাও তোমার একটা কাজ। ছাই কাজ। ঠিক তাই, সেই থেকে পুড়ে পুড়ে আমি ছাই হচ্ছি। ইস, আমি এখন তাহলে এসে ছাইয়ের গাদায় শুলাম? ছাইয়ের গাদা, উঁ, ছাইয়ের গাদা, দেখাচ্ছি কেমন ছাইয়ের গাদা। নরম ও আরামের সুখশয্যার ওপর সুকান্ত চেপে ধরল আগুনতপ্ত মণিমালাকে। তারপর মণিমালার মুখের কাছে মুখ নামিয়ে বলল মশলা খাবে? মণিমালার দু চোখে সর্বনাশের ডাক, তার আঁখিপাখি পাখা ঝাপটিয়ে বলল, খাবো। ... ...
করুণাদের বাড়ির দুদিক জুড়ে পুকুর আর সামনে বিশ্বাসদের আদিম উদোম বাড়ি। বাড়িটার জায়গায় জায়গায় পলেস্তেরা খসে গেছে। সেই বাড়ির ভেতর থেকে কখনো ভেসে আসে শরিকি খেউর, কখনো টেলিভিশনের সস্তা চটুল গান। এই বিশ্বাস বাড়ির চৌহদ্দিটুকুকেও কত্তারা ছাড়েনি। খুপরি ইটের ঘর বানিয়ে ভাড়া বসিয়েছে। ননা, মনি, সতুদের মত দিন আনা দিন খাওয়া লোকেরা ভাড়া নিয়েছে সেসব ঘর। ননার মা রাতদিনের কাজ করে, মনির বাপটা মিলে কাজ করত, এখন মিল বন্ধ। এখন কেবল নিয়ম করে মনির মাকে পেটায়। সতুর বাপ মুদির দোকানে মাল মাপে, ওরাই এখনো একটু ভালো আছে, গেরস্ত মতো। ... ...
পরীক্ষকের মুখে কোন বাক্যি নেই, পাতা ওলটাচ্ছেন। আমি বললাম আমার ইসরায়েলি ভিসার কাগজটা ওর ভেতরেই আছে আর যদি ব্রিটিশ ভিসা খুঁজছেন আমি সেই পাতাটা খুলে দেখাতে পারি। নিরুত্তরে চোখ তুলে তাকিয়েই আবার পাসপোর্টে মনোনিবেশ করলেন। এতো মন দিয়ে আমি দস্যু মোহন বা দীপক চ্যাটারজির বিশ্বচক্র সিরিজের বই পড়ি নি। পিছনের ভদ্রমহিলাকে আমার সুটকেসটি দিয়েছিলাম আমার অনুমতির অপেক্ষা না রেখে তিনি সেটি খুলে দেখেছেন। ... ...
হিন্দুস্থানের তাজ সেই দমদার পেহলোয়ানের দঙ্গলে কেন মেয়েরা থাকবে আর উত্তর দিয়েছে মেয়েরাই, তারাও হয়েছে সমান পেহলোয়ান। বসে আছে পেহলোয়ানের দল সারি দিয়ে। বেইজ্জতির মাহোলে বেইজ্জত হয়েছে কোন মেয়ে কুস্তিগির। সুরত উল ফজরের আভায় সত্যি দেখতে দেখতে যেন সত্যিই দেখা যাচ্ছে নাইনসাফির ক্ষত। একটু বেলা হতে তাজমহলের রূপটাও একটু অন্যরকমের খোলে। সেই রূপটাকে কোরানের আয়াতে বলল সুরত উল দোহা। তাজা সূর্যের চনমনে রূপ আবার সারিসারি কুস্তিগিরের ওপর দিয়ে ঠিকরে গিয়ে আকাশে ছড়িয়ে পড়ে। দেশের ঐসব তাজদের বিপন্ন মুখ দেখা গেলেও তারা বেশ চনমনে এমনটা ভাবার যথেষ্ট কারণ আছে। তারপর দুপুর বারোটা একটা নাগাদ সূর্য যখন ঠিক মাথার ওপর আর গনগনে দেখা যাচ্ছে, রোজ এই সময় -তাজমহলও তার রূপ বদলে নেয়। এইরূপে তাজমহল হল সুরত উল সামস। একইভাবে কুস্তিগীরদের সারটাও দেখা যাচ্ছে বদলে গিয়েছে। এরপর মধ্য আকাশে সূর্য সরে যায়। তার জায়গা নেয় দুরন্ত মেঘেরা। ... ...
ভৌত ধর্মের নিয়মে সে ক্ষয়ে যাচ্ছে টের পায় তিতাস। তিতাস বন্দোপাধ্যায়। তার ৫ফুট ১১ ইঞ্চির শরীর থেকে একটু একটু করে চুন বালি সুরকির আস্তরণ খসে পড়ছে সে বুঝতে পারে। গভীর রাতে সে জেগে ওঠে। আর তখন তার তীব্র জলতেষ্টা পায়। ক্ষয়প্রাপ্ত বাড়ির মতো তার শরীর খুব জল টানে। জোর হাওয়া দিলে ধুলো ওড়ে। জানলা দিয়ে সে দ্যাখে রাতের অন্ধকার ভেদ করে মিটমিটে আলো জ্বেলে প্লেন উড়ে যাচ্ছে দিল্লি কিংবা জয়পুরের দিকে। কতদিন সে প্লেনে চড়েনি! মনে পড়ে না তিতাসের। আর কতদিন? এভাবে চলবে? ... ...
বাংলা ভাষা একটি মিশ্র ভাষা। তার মধ্যে বৈদিক, সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষার অবদান যেমন আছে, তেমনি আছে খেরওয়াল বা সাঁওতালী সহ বেশ কিছু মুণ্ডা ভাষার অতি গুরূত্বপূর্ণ অবদান। বাংলা ভাষার ওপর বৈদিক, সংস্কৃত ও প্রাকৃতের মতো আর্য ভাষার প্রভাবের দিকটি নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে। কিন্তু অস্ট্রো এশিয়াটিক, দ্রাবিড় ও সিনো টিবেটিয়ান ভাষারও যে কম বেশি প্রভাব আছে বাংলা ভাষার গঠনে – তাই নিয়ে আলোচনা তেমন দেখা যায় না। অথচ ভাষাপ্রকৃতির দিক থেকে বিচার করলে বাংলা ভাষার গঠনে মুণ্ডা সহ এসব ভাষার প্রভাবের দিকটি কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ... ...
“শুনুন, এটা অনুসন্ধানের ইসরায়েলি কায়দা ! প্রথম জন আপনার সঙ্গে কথা বলে দ্বিতীয় জনকে পাঠাবার আগে রিপোর্ট দিয়েছে, আপনি কি বললেন। সেই লিস্টি মিলিয়ে দ্বিতীয় জন আপনাকে চেক করে। থিওরি হচ্ছে আপনি সত্যি বললে প্রতিবার তাই বলবেন, কোন ক্রিয়া পদ বিশেষ্য বিশেষণ একটু ওদিক হতে পারে,আপনার কণ্ঠস্বরে উষ্মা দেখা দিতে পারে। কিন্তু পর পর তিন বার ধারাবাহিক ভাবে মিথ্যে বলাটা শক্ত কাজ। নিরাপত্তার লোকেদের মনে সন্দেহ হলে আপনাকে পাঁচবারও প্রশ্ন করতে পারে। হিথরোতে আপনি ক্লিন চিট পেয়েছেন। যখন বেন গুরিওন হাওয়াই আড্ডায় নামলেন, আপনি একেবারে কোশার মানুষ ! এখন আপনি আমাদের অফিস কেন, এই উলটোদিকের পার্লামেন্টে গিয়ে একবার উঁকিঝুঁকি দিয়ে আসুন না !” ... ...
Tame birds sing of freedom, wild birds fly.... হাওয়াবিহীন দিনগুলিতে আকাশকে চুপসানো বেলুনের খণ্ড মনে হয় - ফ্রেমে আটকানো; যেদিন বাতাস ওঠে, নীল বেলুনের টুকরো ঢাউস শামিয়ানা হয়ে উড়তে থাকে, মেঘ আর ডানারা মোটিফ তৈরি করে - সাদা কালো লাল নীল মেঘ ছেনে ছোটো ডিঙি, বড় বড় পালতোলা নৌকো, বিশাল সব দুর্গ, হাতি, উট আর বুড়ো মানুষ। তার ওপর ঘুড়িরা লাট খায়, জেট চলে যাওয়ার ঘন সাদা লাইন ফিকে হতে হতেই একগুঁয়ে উড়োজাহাজরা উড়ে যায় আচমকা। পাখিরা চক্কর কাটে আর চক্কর কাটে, শেপ ফর্ম করে - ভি, ওয়াই, এম, এ, ডব্লিউ; কখনও তারা মানুষের কাছাকাছি নেমে আসে এমন, যেন ডানার কথা ভুলেই গিয়েছে। ঘাসের ওপর শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখি- ডান হাত মাথার নিচে, বাঁ হাত শুরু হয়েই শেষ হয়ে গিয়েছে, কাঁধের খুব কাছেই চেটো- তাতে তিনটে আঙুল। যেন ডানা। আমি হৃদয়রাম, পঁয়ত্রিশ বছরের এক্ট্রোড্যাকটাইলি পেশেন্ট। উড়তে পারি না অথচ বাঁ কাঁধে কারো হাত ঠেকলে খাঁচায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় পাই। আসলে এ'সবই ডানার গল্প। ... ...
উপত্যকার দিকে তাকিয়ে বেবাক পাহাড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কবি। মাথার ওপর যখন চাঁদ ওঠে তখন হাব্বা খাতুন পাহাড়ের বুকের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা সেই মেয়ে, জুন বা জুনি যার নাম ছিল, হঠাৎ কেঁদে ওঠে সে। সেই কান্না অথৈ জল হয়ে কিসেনগঙ্গার রূপ নিয়ে বয়ে চলে যায়। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কত রঙে সেজে ওঠে সেই পাহাড়। এখনও অপেক্ষায় আছে সে! ... ...
সাফল্যের সামান্য খতিয়ানে ধরা থাকে কয়েকটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মেধা পুরস্কার। আর থাকে প্রতিরোধের আখ্যান। বিশ্বব্যাপী হিংসা, দেশব্যাপী বিদ্বেষের আবহাওয়ায় পরিবেষ্টিত বাঙালি, এখনো রূপ - যশ - জয় আকাঙ্খার সঙ্গে উচ্চারণ করে : দ্বিষো জহি। এত ক্লেদের মাঝেও, জাতি বর্ণের ক্লেদ, পড়শীর প্রতি ঈর্ষার ক্লেদ বাঙালিকে সম্পুর্ণ পাড়িয়া ফেলিতে পারে নাই। ... ...
অনেককাল আগের কথা। দেশ থেকে চাকরিবাকরি ছেড়ে সব পেয়েছি'র দেশ আমেরিকায় এসে ফের ছাত্র হয়ে পি এইচ ডি করতে ঢুকেছি আটলান্টা শহরে অবস্থিত জর্জিয়া ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজিতে, সংক্ষেপে জর্জিয়া টেকে। তাও আবার সস্ত্রীক। একটা এক কামরার এফিশিয়েন্সি অ্যাপার্টমেন্টে থাকি দুজনে। সেখানে আমাদের রুমমেট কয়েক হাজার আরশোলা৷ অ্যাপার্টমেন্টের ছাত থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল ঝরে বলে সারাক্ষণ তলায় বসিয়ে রাখতে হয় একটা বালতি। শীতের কামড় থেকে বাঁচতে সেকেন্ড হ্যান্ড দোকান স্যালভেশন আর্মি থেকে কিনে আনি মৃত সাহেব-মেমের কোট। ... ...
বহু দিন ধরে ঐতিহাসিকরা, তাত্ত্বিকরা উৎস খুঁজতে চেষ্টা করেছেন এই দশকব্যাপী ভয়ানক, বিষময় সংঘর্ষের। কেউ দায়ী করেন অটোমান সাম্রাজ্যের পতনকে, কেউ ব্রিটিশ চক্রান্ত বা ১৯১৭-র বেলফোর ঘোষণাকে, কেউ বা বারংবার ব্যর্থ হওয়া শান্তিপ্রস্তাব অথবা বহু শতাব্দীর বঞ্চনার ইতিহাসকে। সেইসব কূট তর্কের মধ্যেই দ্রুত বদলে যায় জেরুজালেম, ইতিহাসের চিরস্থায়ী রক্তাক্ত রঙ্গমঞ্চ, যা একইসাথে ক্রিশ্চান, ইহুদি ও ইসলাম ধর্মবিশ্বাসী মানুষের পবিত্র ভূমি। কারুর বধ্যভূমি, কারুর নির্বাসন, কারুর বা প্রতিশ্রুত নিজভূম। ইতিহাসের ক্লাস নয়, একজন সাধারণ মানুষের ডায়রির পাতায় ধরে রাখা সেই আমূল বদলের একটুকরো ছবি, হীরেন সিংহরায়ের কলমে। ... ...
বাংলার বুকে বহুদিন বাদে গণআন্দোলনের ময়দানে খেটে খাওয়া মানুষের এই বিপুল অংশগ্রহণ এত দিনের নৈশব্দ ভেদ করে সকলের কাছেই আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। স্বাধীনভাবে মাথা উঁচু করে জীবিকা নির্বাহ করার লড়াইয়ের পাশাপাশি কেন্দ্রের আগ্রাসী হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান প্রকল্পের বিরোধিতা ধারাবাহিকভাবে করে এসেছে জাতীয় বাংলা সম্মেলন। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক। অর্থনৈতিক দাবীদাওয়া এবং মর্যাদার প্রশ্নে লড়াইয়ের পাশাপাশি এই আন্দোলনের আরও দুটো দিক রয়েছে। একটি হল ৯৬ সালের অপারেশন সানসাইন বিরোধি আন্দোলন থেকে শুরু করে ২০০৬-২০০৭-এর উচ্ছেদ বিরোধী আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় কর্পোরেট উন্নয়নের এই মডেলকে চ্যালেঞ্জ করার প্রশ্ন। বাংলার বুকে হকার আন্দোলনের ঐতিহ্যকে মনে রেখে এখানে কয়েকটা কথা বলি। ১৯৯৬ সালে হকার উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিল বামফ্রন্ট সরকার। সে প্রকল্পের নাম ছিল 'অপারেশন সানশাইন'। যুক্তিটা প্রায় একই রকম ছিল। আজ যেমন বলা হচ্ছে স্টেশনকে উন্নত করা হবে, স্টেশনটা যাত্রীদের, হকারদের নয়। সেদিনও বলা হয়েছিল ফুটপাথে হকার বসলে তা শহরের সৌন্দর্যের পক্ষে হানিকারক এবং সেই দৃশ্য মহানগরীর অন্ধকার ছবি তুলে ধরে। ... ...
বড়দাদীর ভাষায়, রিজিকে যা আছে তা জুটে যাবেই। তাই আজ এই দু-পদের সাথে যুক্ত হলো মাছ সুক্তোও। আর এই পদের যোগানদার – স্বয়ং মুসা। এমনিতে স্কুলে যাবার কথা শুনলে মুসা পালিয়ে যায়। কিন্তু আজ কোন ফাঁকে চলে গেছে স্কুলের উঁচু মাঠে – তা কারো জানা নেই। সেখান থেকে তুলে এনেছে এক গোছা বথুয়া শাক। আর এনেই বড়দাদীর কাছে বায়না ধরেছে বিক্রির। বড়দাদীও কম বোদ্ধা ক্রেতা না। বড়দাদী দরদাম করে এক টাকার বথুয়া শাক তিরিশ পয়সায় কিনেছে মুসার কাছ থেকে। সেই শাকই ভাগযোগ হলো বড়বাড়ির দুই ঘরে। ... ...
মায়ের চিন্তার কি আর শেষ আছে? সংসারের হাজারো খুঁটিনাটি কাজ সামলে একটু সময়ের জন্যও নিজের কথা ভাববার জো নেই মেনকার। সারাক্ষণ নানান চিন্তা মাথাতে জাঁতার মতো বনবন করে ঘুরে চলেছে। এদিকে আকাশপটের রঙ বদলানো মানেই হলো মেয়ের বাপের বাড়ি আসার দিন ঘনিয়ে আসা। উঠোনের বাইরে রাখা বড়ো পাথুরে চাট্টানের ওপর খড়ি দিয়ে আঁক কেটে কেটে শুভ সময়ের হিসেব রাখার পর্ব ... ...