এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • ধর্মান্ধরা, ফ্যাসিস্টরা কেন বাঙালিদের ভয় পায়? -- উত্তর মৃণাল সেন

    Partha Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১৫ মে ২০২৩ | ৮৩৫ বার পঠিত | রেটিং ৪.৭ (৩ জন)
  • পথিকৃৎ ছবিরাজকে শতবর্ষে শ্রদ্ধার্ঘ্য।
     
    মৃণাল সেনকে নিয়ে আগেও লিখেছি। নিজের বইয়ের বিজ্ঞাপন এই সুযোগে দিয়ে রাখি। গাংচিল থেকে প্রকাশিত বই "যে কলকাতাকে ভালোবেসেছি"তে মৃণাল সেনের ম্যাজিক নাম দিয়ে একটা পরিচ্ছেদ লিখেছিলাম।

    আজ আর একটু লিখি।

    সবাই জানি, মৃণাল সেন বামপন্থী চিত্রকর ছিলেন। এবং এ কথা সবাই জানে, ফ্যাসিস্টরা, ধর্মান্ধরা এবং ঘৃণার ব্যবসায়ীরা বামপন্থীদের, সোশালিস্টদের ঘৃণা করে, এবং মনে মনে ভয় পায়।

    শুধু হিন্দুত্ববাদী চরমপন্থীরা নয়। মুসলিম মোল্লাবাদী চরমপন্থীরাও সত্যজিৎ, মৃণাল, ঋত্বিক, তপন, রাজেন, তরুণদের মুখ খারাপ করে। সীমানার পূর্ব পারে ওরা চিরকাল ভয় পেয়েছে জহির রায়হান, তারেক মাসুদদের।

    ওরা সবাই রবীন্দ্রনাথকে ভয় পায়। ওরা সবাই ভয় পায় লালনকে, সিরাজকে, নজরুলকে। এবং ওরা সবাই ভয় পায় বাঙালির প্রগতিশীল চেতনাকে।

    কিন্তু সত্যজিৎ যেমন খ্যাতি পেয়েছেন, মৃণাল সেই তুলনায় কিছুই পাননি। এর প্রধান কারণ মিডিয়া। আমাদের বাঙালিদের কে-সর্বশ্রেষ্ঠ এই মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল হাস্যকর প্রতিযোগিতায় আমরা ঠিক করেছি, সত্যজিৎ সর্বশ্রেষ্ঠ, রবীন্দ্রনাথ সর্বশ্রেষ্ঠ, শেখ মুজিব সর্বশ্রেষ্ঠ।

    বাকীরা আছেন, কিন্তু তাঁরা সর্বশ্রেষ্ঠ নন। কারণ, বিবিসি, আনন্দবাজার, দেশ, প্রথম আলো, ভয়েস অফ আমেরিকা আমাদের বলে দিয়েছে।

    মৃণাল সেন ও সত্যজিৎ কিন্তু বন্ধু, সতীর্থ, একে অপরের প্রশংসাধন্য ছিলেন। যেমন ছিলেন হেমন্ত-মান্না, কণিকা-সুচিত্রা, অথবা আমাদের কল্পিত অন্য প্রতিযোগীরা। এবং ঘটনা হলো, বাংলার রেনেসাঁ বুদ্ধিজীবীরা এই অদ্ভুত, আশ্চর্য সাংস্কৃতিক গঙ্গা যমুনা পদ্মা ব্রহ্মপুত্র মেঘনাকে স্রোতস্বিনী রেখেছেন তাঁদের প্রতিযোগিতা দিয়ে নয়, একে অপরকে কমপ্লিমেন্ট করে, পরিপূরণ করে।

    সত্যজিতের অপু ট্রিলজি যদি গ্রাম বাংলার ছবি এঁকে থাকে, মৃণাল ছবি এঁকেছেন শহর কলকাতার এবং তার মার খেয়েও মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো মানুষগুলোর। তাঁর আকাশ কুসুম, তাঁর পুনশ্চ, তাঁর নীল আকাশের নীচে। যেখানে সর্বজয়া নেই, কিন্তু আছে বাসন্তী, মণিকা।

    বাসন্তী বোধহয় আধুনিক বাংলা সিনেমার প্রথম নায়িকা, যে ছবির প্রধানতম চরিত্র। অর্থাৎ, বাসন্তীই সে ছবির কেন্দ্রবিন্দু। নায়ক নয়, নায়িকাই এ ছবির আসল কথা। তার লড়াইয়ের গল্প। নায়ক পার্শ্বচরিত্র।

    হিন্দু ও মুসলমান রক্ষণশীলরা এ গল্প শুনতে চায়না। তারা চায়না আমরা লড়াই করি, মাথা উঁচু করে বাঁচি। তারা চায়না, মেয়েরা সমাজের কেন্দ্রবিন্দু হোক। তারা চায়, সমাজ যেন চরম রক্ষণশীল, পুরুষতান্ত্রিক থাকে।

    হিন্দুত্ববাদী চরমপন্থীরা ধর্ষকদের মালা দিয়ে পুজো করে। মুসলমান চরমপন্থীরা সুযোগ পেলেই মেয়েদের ওপর অত্যাচার করে। তাদের জোর করে পাঠিয়ে দেয় অন্ধকার অন্তঃপুরে কালো বোরখায় মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢেকে জীবন কাটাতে।

    মৃণাল সেন সারা জীবন মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকা, লড়াই করা বাঙালি মেয়েদের গল্প বলেছেন। ভারতীয় মেয়েদের গল্প বলেছেন। একদিন প্রতিদিনের সেই মেয়েটা। ভুবন সোমের সেই মেয়েটা। নীল আকাশের নীচে ছবিতে একদিকে যেমন স্মরণীয় আমরা যাঁকে উত্তমকুমারের সুখী সুখী ছবির আড়ালে হারিয়ে ফেলেছি, সেই কালী ব্যানার্জীর চীনা ফেরিওয়ালার অভিনয়, তেমনি স্মরণীয় মঞ্জু দের স্বাধীনতাসংগ্রামী বিপ্লবী গৃহবধূর চরিত্র।

    কিংবা আকালের সন্ধানের সেই যে গ্রামের গরীব মেয়েটি। অবিস্মরণীয় শ্রীলা মজুমদার।

    মৌলবাদী ধর্মান্ধ নারীবিদ্বেষীরা এসব গল্প মোটেই চায়না। মৃণাল সেন তাই তাদের কাছে ভয়। মৃণাল সেনকে, অমর্ত্য সেনকে কমিউনিস্ট, অতি-বাম, মার্ক্সবাদী, সেকু মাকু বুদ্ধুজীবী ইত্যাদি বলে রাস্তার ধুলোয় টেনে নামাতেই হবে। মৃণাল সেনের সৃষ্টি তাদের কাছে আতঙ্ক।

    সত্যজিতের কলকাতা ট্রিলজি যেমন রক্তের শিরা উপশিরায় কাঁপন ধরায়, মৃণালের কলকাতা ট্রিলজিও তাই। তাঁর ইন্টারভিউ, তাঁর কলকাতা-৭১, তাঁর পদাতিক। ইন্টারভিউয়ের সেই হ্যান্ড-হেল্ড ক্যামেরা। পদাতিকে বিজন ভট্টাচার্য্যের মিছিলে হেঁটে যাওয়া। একদিন প্রতিদিনে শেষ পর্যন্ত জ্বলে ওঠা গীতা সেন। খারিজের সেই মরে যাওয়া বাচ্চা চাকরটা।
     
    আরএসএস বিজেপি এবিভিপি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলাম এই সব ছবির অদৃশ্য জাদুর টানে। তখন বুঝিনি। এখন বুঝি।

    অপুর স্রষ্টা মাটির কোমল বাঁশির সুর থেকে শুরু করে কলকাতার রাস্তার ধাতব শব্দ, বোমার শব্দ আমাদের শুনিয়েছেন। মৃণাল শুনিয়েছেন স্ট্রাইকের শব্দ। ঘাতক পুলিশের বন্দুকের গুলির শব্দ। শুনিয়েছেন রাস্তার মিছিলের শব্দ।

    এসব শব্দ আরএসএস বিজেপি কিংবা জামাত ইসলামী মুজাহিদীনরা শুনতে চায়না। কর্পোরেট মিডিয়া, হলিউড, বলিউড চায়না। তারা চায়, আমরা যেন ওই সুখী সুখী প্রেম কাহানি নিয়েই সুখী থাকি। হিন্দি কিংবা বাংলায় অর্থহীন গান গাই শ্মশানে দাঁড়িয়ে, মরুভূমিতে দাঁড়িয়ে। বিপিন বাবুর কারণসুধা পান করেই আমরা যেন বুঁদ হয়ে থাকি।

    আমরা যেন সত্যকে, বাস্তব জগৎকে, মানুষের সংগ্রামকে অস্বীকার করি।

    মৃণাল সেনের ছবি বার বার আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় সেই মাথা উঁচু করে লড়াই করা নারী ও পুরুষদের কাছে।
    _______________________

    ব্রুকলিন, নিউ ইয়র্ক
    ১৫ই মে, ২০২৩
     

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১৫ মে ২০২৩ | ৮৩৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Arijit | 2405:8100:8000:5ca1::288:d536 | ১৮ মে ২০২৩ ১১:১৮519869
  • খুব সত্য কথা । নারীবিদ্বেষীরা মুখ্যমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি বলে একজন নারীকে মেনে নিতে পারেনা । মনুবাদীরা দলিত বা মুসলিমকে রাষ্ট্রপতি বলে মানতে পারেনা । মৃণাল সেনের ছবি তাদের কাছে আতঙ্ক ।
     
  • Amit | 163.116.203.80 | ১৮ মে ২০২৩ ১২:০১519871
  • "মনুবাদীরা দলিত বা মুসলিমকে রাষ্ট্রপতি বলে মানতে পারেনা । " ???? তাই নাকি ? 
     
    বাজপেয়ীর সময়ে রাষ্ট্রপতি হলেন আবুল কালাম। মোদির সময় রাষ্ট্রপতি হলেন রামনাথ কোবিন্দ আর দ্রৌপদী মুর্মু। তাহলে বাজপেয়ী বা মোদী কে যথেষ্ট মনুবাদী বলা যাবেনা - তাই তো ? 
     
  • একক | ১৮ মে ২০২৩ ১৪:৩৭519873
  • কেও ভয় টয় পায়না। বাঙালিরা ওরকম ভাবতে ভালবাসে। 
  • কি আর করা | 2402:3a80:1cd0:ae77:178:5634:1232:5476 | ১৮ মে ২০২৩ ২৩:৩৫519898
  • অমিতের বক্তব্য আর একটু এগিয়ে দি।মমতা মুখ্য মন্ত্রী হয়েছে -এটা একদম সহ্য করতে পারে না,সিপিএম আর বিজেপি।
    তাহলে তাদেরকে কি বলা যাবে?  :--)))
  • ছন্দা মিত্র | 103.245.3.27 | ১৮ মে ২০২৩ ২৩:৪৯519899
  • ভীষণ ভালো লাগলো
  • সত্যেন্দু সান্যাল | 2401:4900:1c1b:7065:18a0:b0e3:91ed:8683 | ২০ জুন ২০২৩ ২২:৪০520574
  • লেখক-কে প্রশ্ন, বর্ত্তমান মা-মাটি-মানুষের সরকার কি অনীক দত্ত-কে ভয় পায়? 
     
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে মতামত দিন