এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  অর্থনীতি

  • অর্থনীতি ও নোবেল প্রাইজ ২০২২

    হীরেন সিংহরায় লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | অর্থনীতি | ০৯ নভেম্বর ২০২২ | ৮০৪ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • অর্থনীতি ও নোবেল প্রাইজ ২০২২

    দ্বিতীয় পর্ব

    সকালবেলাতেই এরা এমন যুক্তি সাজিয়ে কথা বলে কী করে ? ইকনমিকস পড়লে বোধ হয় সবই পারে, ওর গলায় অবিকল ইকনমিকসের ছাত্র সুলভ গাম্ভীর্য, পৃথিবীর উপকার করার জন্য জন্মেছে তো!

    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আত্মপ্রকাশ, ১৯৬৫
     

    আপনার বাকসোয়  ভরে রাখলে একশ টাকা একশোই থেকে যেতো । ব্যাঙ্ক তার ভল্টে ভরে রাখলেও তাই । বাড়িতে সিন্ধুকের অভাব বলে তো আর ব্যাঙ্কে আসেন নি । এসেছেন টাকার  বিনিময়ে আয়ের  খোঁজে। আপনাকে পকেটে তা  পৌঁছে দেওয়ার জন্য ব্যাঙ্ক সেই টাকা  থেকে আরও টাকা বানাবে , খাটাবে,   মতান্তরে থার্ড পার্টিকে ধার দেবে আর তার সঙ্গে কিছু পরিষেবা ।

    আমার মতে  যত প্রকারের কাণ্ডকারখানা  ব্যাঙ্ক করুক না কেন আদতে তার  কর্ম প্রণালীকে  চারটি নির্দিষ্ট বিভাগে ভাগ করা যায় , আর প্রতিটি  বিভাগের পিছনে অবশ্যই দাঁড়িয়ে থাকে অপারেশন এবং অডিট দপ্তর ।

    এক। ব্যাঙ্ক ধার নেয় । সে আপনার অর্থ , অন্যান্য ব্যাঙ্ক বা  প্রতিষ্ঠানেরও  হতে পারে। ধার নেওয়ার সময় সীমা বিভিন্ন – এক সপ্তাহ , এক মাস কি পাঁচ বছর বা তারও বেশি।  আপনার টাকা আজ খরচ না করে যত বেশি দিন বাদে করবেন ব্যাঙ্ক আপনাকে ততো  বেশী সুদ দেবে  । একটি কর্মী বাহিনী এই ঋণ সংগ্রহের কাজে নেমে পড়েন (  দেশে থাকার সময় ‘ ডিপোজিট মোবিলাইজেশন ‘ কথাটির সঙ্গে পরিচয় ছিল) । এঁরা খবর কাগজে , ইন্টারনেটে সর্বদা বারতা বিতরণ করেন- এই ব্যাঙ্কে জমা রাখলে কোন কোন সুবিধা পাওয়া যেতে পারে ( আধুনিক বাঙলায় ‘  সুবিধা উপলদ্ধ’  হতে পারে ) । খুব বেয়াড়া ভাবে বলতে গেলে এঁরা কাঁচা মালের সন্ধানী । সেটি আবার ব্যাঙ্কের ভল্টে অলস শয্যা গ্রহণ করলে আয় বাড়ে না ,  খরচা বাড়ে । যেদিন আপনি সেই একশ টাকা ব্যাঙ্ককে ধার দিলেন , সেদিন থেকেই আপনার মিটার চলতে শুরু করে। যত সামান্যই হোক, দিন গেলে আপনার কিছু সুদ পাওনা হয় ।

    মনে করুন আমার বন্ধু চিন্ময়ের আলু কেনা পর্ব –সে আলু কেনে নগদে। তার মানেই খরচা । যতক্ষণ না সে আলু বিক্রি হচ্ছে , কোন আয় তো দূরের কথা, উলটে তাকে বইতে হয়  গুদামের বা কোল্ড স্টোরেজের ভাড়া।  

    অতএব আলু বিক্রি করে অর্থ উপার্জনের  সন্ধানে চিন্ময়ের সেলসফোরস পথে নামে ।

    ব্যাঙ্কেও সেই একই ফরমুলা । কোষাগারে জমা ধনকে  কাজে লাগানো প্রয়োজন । নহিলে খরচ বাড়ে।

    দুই। লোন মেলা ।

    এই প্রাপ্ত টাকাকে কাজে  লাগানোর জন্য আরেক বাহিনী পথে ঘাটে ঘুরে বেড়ান - ঋণগ্রহীতার খোঁজে (  এই পরম ব্রতে অনেক জুতোর সুকতলা খইয়েছি) । ব্যাঙ্ক না হয় ঘরে বসে আপনার টাকা পেলো,  সেখানে আপনি ঝুঁকি নিলেন। এবার এক গুচ্ছের লোকের কাজ হলো  খদ্দের খুঁজে সেই টাকা এবং তা থেকে বর্ধিত টাকা ধার দিয়ে জুতসই সুদ আদায় করা –ব্যাঙ্ক ঝুঁকি নেবে সেই খদ্দেরের ওপরে । তবেই না সেই জমা টাকা থেকে কোনো  আয়ের মুখ  এবং আপনার প্রসন্ন হাসি দেখা যাবে। এই বিভাগের কর্মী চায় বেশি ঋণ দিতে -  সেটি নগদ উধার, ক্রেডিট কার্ড, বাড়ি জমি কেনার মর্টগেজ , গাড়ি কেনা, বিদেশ ভ্রমণ যাই হোক না কেন ।  কারণ ব্যাঙ্কের মুনাফা,  তাদের দক্ষতা এবং বোনাস  মাপা হবে ঋণদানের পরিমাণ ও তা থেকে উৎপাদিত আয় দ্বারা। স্বভাবতই তাদের অ্যান্থেম হলো- প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে , আরও আরও দেবো  ধার ।

    সে পথে বাধা দেবার পবিত্র কর্তব্যে অবতীর্ণ হন  যে জন সমষ্টি  তাদের নাম ব্যাঙ্কের ঋণদান মার্গ দর্শক । এক এলাহি ক্রেডিট দপ্তর বিচার করবেন কাকে কতো টাকা কতদিনের জন্য ধার দেওয়া যেতে পারে। আমরা যারা অনেক মেহনত করে এক খদ্দের যোগাড় করেছি তার বাৎসরিক হিসেব দেখে আমাদের কর্তা হয়তো বলবেন , না , এ লোকটা তেমন সুবিধের নয়। অথবা , বড়জোর ছ মাসের ধার দেওয়া যায় (সে  চাইছে দু বছরের  মেয়াদ)।  আমরা নিজেদের মধ্যে আকছার বলাবলি করেছি ,  যে প্রশ্নই করুন না কেন,  উত্তরে না শব্দটি তাঁদের  ঠোঁটে ঝুলে আছে। । সেটাই তাঁদের কাজ- ঋণ দান ঠেকিয়ে রাখা ! অন্যভাবে বলতে গেলে আমরা যেন ধার দিয়ে টাকার হরি লুট করব – ব্যাঙ্ককে সেই ভয়াবহ পরিণতির হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখাটা  এঁদের জীবনের ব্রত । একজন কর্পোরেট ক্রেডিট অধ্যক্ষকে মনে আছে । তাঁর সামনে কোন ঋণের  প্রস্তাব নিয়ে হাজির হতে আমরা শঙ্কিত হতাম। চাকরির কঠিন ইনটারভিউয়ের চেয়েও ভয়াবহ । উলটো দিকের  চেয়ারে বসতে বলে নীরবে প্রপোজাল পড়তেন । কখনো বা আধ ঘণ্টা বাদে আকস্মিক মৌন ভঙ্গ করে বললেন এদের সি ই ওর ছেলে মেয়ে কোন স্কুলে পড়ে তা জানেন ? তার সঙ্গে কোম্পানির ঋণের কি সম্পর্ক সেটা আজ অবধি বুঝে উঠি নি।

    মনে রাখতে হবে ব্যাঙ্কের আয়ের এভিনিউ আর কিছুতে নয়,  ঋণে আকীর্ণ হয়ে আছে  । চিন্ময়ের সেলসফোরস  যদি আরও বেশি আলু বেচতে চায়, সে  তখন আরেক দলকে মেমারি পাঠায় আলু কিনতে । ব্যাঙ্কে আপনারা যে টাকা ধার দিয়ে গেছেন তাতে যদি না কুলোয়,  লোনের মেলা খুলে ঋণদান বৃদ্ধির অধীর বাসনায় ব্যাঙ্ক বাজারে নামে টাকা ধার করতে । এতদিন আপনারা ভালবেসে দুটো পয়সা সুদের আশায় আমাদের ঘরে এসে দিয়ে গেছেন – এবার ব্যাঙ্ক মাঠে  নামে ইতি উতি জায়গা থেকে ধার নিয়ে আসতে, বেশি সুদ দিয়েও । এখন  শুধু আপনার জমা টাকার ওপর সুদ আর সামান্য কিছু লাভ নয়, ব্যাঙ্ক হন্যে হয়ে ওঠে তার সামগ্রিক মুনাফা বাড়াতে । মারি তো গণ্ডার ।

    লাভ বা লোকসানের  হাজার  পথ খোলা ।  ব্যাঙ্ক বিদেশি মুদ্রা ভাও ওঠানামার ওপরে টাকা লাগায় , অমুক কোম্পানি শিগগির দেউলে হবে কি হবে না, তেলের ভবিষ্যৎ  কোন দিকে যাবে তার ওপরে বাজি ধরে  দু পয়সা লাভের আশা করে। এর সবটাই ঋণের খাতায় পড়ে। 

    ঋণ দানের ঝোপের পেছনে যে বাঘ লুকিয়ে আছে তার নাম ঝুঁকি। কিন্তু  গ্রিড  ইজ গুড ( উবাচ গরডন গেকো:
    ওয়াল স্ট্রিট,১৯৮৭) ।

    ক্রেডিট  এবং ঋণদান  মঞ্জুরি বিভাগের কর্ম পদ্ধতি একেবারে পরস্পর বিরোধী। আরও বিশদে বলতে গেলে অপারেশনের সঙ্গেও অন্য  দফতরের সংঘর্ষ লেগে থাকে।

    একটি  নিতান্ত কাল্পনিক বাণিজ্যিক উদাহরণ দেওয়া যাক ।

    ধরুন আমি রথমানস সিগারেট কোম্পানির সেলসম্যান । এ বছরে আমাকে দশ লক্ষ সিগারেট বিক্রির  টার্গেট দেওয়া হয়েছে তা সে যেখানেই হোক। গুগল ঘেঁটে স্থির করলাম রাশিয়া ব্রাজিল বা চীনে  অভিযান চালাবো । সে সব দেশে অনেক মানুষ বসবাস ও ধূমপান করে থাকে । সাঁও পাউলোতে আমার টিকিট লেগে গেলো । পেল্লায় অর্ডার পেয়ে দেশে ফিরেছি । এই অসাধারণ সফলতায় আমার সেলস বিভাগের কর্তা আনন্দে আটখানা হলেন । এ কোম্পানিতে আমার অগ্রগতি ঠেকায় কে ?

    ভুল। বেশ কয়েকজন এই কাজে এগিয়ে এলেন।

    প্রডাকশন ইউনিট বললে , দশ লক্ষ সিগারেটের অর্ডার ? ডেলিভারি কবে ?
    তিরিশ দিন সময় সীমা শুনে তারা বললে , অসম্ভব । কম করে তিন মাস লাগবে।

    ফাইনান্স  দপ্তর জানতে চাইলে কোন চুক্তিতে ( টারমস) বিক্রি করেছো ? ক্যাশ ?  ক্রেডিট বুঝি ?  কতদিনের? কি বললে? ছ মাসের ক্রেডিট ? এই ব্রাজিলিয়ান কোম্পানির নামটাও জানা নেই। তাকে ধারে বিক্রি ? ভুলে যাও।

    আমার বেলুনটি যখন প্রায় ফেটে এসেছে , রথমানসের শিপিং বিভাগ তাতে একটি পিন ঠুকে দিল – হবে না, ওদের বলে দিন। ফ্যাক্টরি বানিয়ে দিলেও  তিরিশ দিনে দশ লাখ  সিগারেট ব্রাজিলে  পাঠানো আমাদের দ্বারা সম্ভব নয়। ক্ষেপে ক্ষেপে পাঠাতে হবে।

    এক হিসেবে রথমানসের চারটে দপ্তর পরস্পর বিরোধী কাজ করে ।  অ্যাট ক্রস পারপাসেস   । ব্যাঙ্কেও তাই ।

    ডায়মন্ড / ডিবভিগ মডেল জানায় মানুষের যে সঞ্চিত অর্থ বালিশ বা বিছানার ( আণ্ডার দি ম্যাট্রেস ) তলায় অথবা সিন্দূর লাগানো সিন্ধুকের গহ্বরে লুকিয়ে ছিল সেই অর্থকে  ব্যবসায়ের কাজে লাগিয়ে ব্যাঙ্ক সমাজের কল্যাণ সাধন করে অর্থাৎ - সেভিংস=ইনভেস্টমেন্ট ঠিক যেমন অর্থনীতির পাঠ্য পুস্তকে পড়া যায়।  এরূপ মহান কাজে একমাত্র বাধা হলো: সঞ্চয়ী চান স্বল্প মেয়াদি জমা  আর ঋণ গ্রহীতা খোঁজেন মধ্য বা দীর্ঘ মেয়াদ । এই দু তরফের বিপরীত অভিলাষের  কারণে ব্যাঙ্কের সমস্যা শুরু - সকল সঞ্চয়ীকে যুগপৎ টাকা ফেরত দিতে গিয়ে ভল্ট উজাড় হয়ে যায়  ( অ্যাসেট লায়াবিলিটি মিসম্যাচ)। বাণিজ্যে  ঋণদানের ঝুঁকি সুলভ কোন বিপদ আপদ  ডায়মন্ড / ডিবভিগের চোখে পড়ে নি ।

    সংগঠিত ব্যাঙ্কিং ব্যবসার প্রথম উদয় হয়েছিল ইতালির  সিয়েনা শহরে ৫৫০ বছর আগে। জমা এবং প্রাপ্য টাকার হিসেব ব্যাঙ্ক প্রত্যহ করে থাকে যার ভব্য নাম ডেলি ব্যাল্যান্স শিট ।  ব্যাঙ্কিং ব্যবসায়ে আমাদের মতো নিমজ্জিত মানুষদের ডায়মন্ড / ডিবভিগ নতুন কিছুর ব্যাপারে অবহিত করেন নি ।  এই মিসম্যাচ একটি আপদ, একমাত্র নয়।

    ঋণের মেয়াদ নয় , ঋণগ্রহীতাদের যোগ্যতা  ( ক্রেডিট কোয়ালিটি ) জরুরি বিচার্য বিষয় যা নিয়ে ব্যাঙ্কের ক্রেডিট দপ্তর মাথার  চুল ছিঁড়ে থাকেন । এ বিষয়ে ডায়মন্ড / ডিবভিগের  নীরবতা লক্ষণীয় । ঠিক যখন (১৯৮৩)  তাঁরা  তাঁদের  মডেল বানাচ্ছেন , শিকাগোর কনটিনেনটাল ইলিনয় ব্যাঙ্ক দেউলে হয়ে সরকারের আঁচলের তলায় আশ্রয় নেয়: আমেরিকার ইতিহাসে এই প্রথম ব্যাঙ্ক যা রাষ্ট্রায়ত্ত হয় । তার দু বছর আগে অবধি কনটিনেনটাল আমেরিকার বেষ্ট ম্যানেজড ব্যাঙ্ক আখ্যায় বিভূষিত হয়েছিল। বিপর্যয়ের কারণ  স্বল্প সময়ের জমা বেশি দিনের ধার বা মিসম্যাচ নয়। কারণ বেহিসেবি দুর্নীতিপূর্ণ  ঋণদান । আমি সেই সময়ে ব্যাঙ্কের ফ্রাঙ্কফুর্ট শাখায় কাজ করেছি। ভুক্তভোগী।  গ্রহীতার ঋণের মেয়াদ শুধু নয়, সে সেই ঋণ শোধ দিতে সক্ষম কিনা সেটি ডায়মন্ড / ডিবভিগের বিচার্য বিষয় নয়।  

    যে সকল অর্থনীতিবিদ  ডায়মন্ড / ডিবভিগ সাতিশয় অধ্যয়ন করেছেন তাঁদের কোন দ্বিমত থাকলে দয়া করে জানাবেন।
    বেঞ্জামিন শালোম বেরনানকের  তত্ত্ব আলোচনার সময়ে এ বিষয়ে আবার আসবো ।

    তিন। ব্যাঙ্ক আপনার আদেশ অনুসারে  আপনার টাকা প্রিয়জন পরিজন আমাজনকে জম্মু,  ঝুমরিতিলাইয়া এমনকি ঝাড়সুগুদায় পাঠাতে পারে । কিঞ্চিৎ পারিশ্রমিকের বিনিময়ে। ঠিক চিন্ময় যেমন বিহারে ওডিশায়  আলু পাঠায়।

    চার। চিন্ময়ের ব্যবসায়ে আলু আলুই থেকে যায় । আলু কাবলি বানানোর ব্যবসা তার নয়। কখনো অবশ্য খানিক আলু পচে নষ্ট হতে পারে, লোকসানে বিক্রি হয় । ব্যাঙ্ক কিন্তু একটি ভেল্কি দ্বারা আপনার ভারতীয় টাকাকে ডলার ইউরো পাউনড সহ বিভিন্ন বিদেশি মুদ্রায়  বদলে দিতে পারে , পাঠাতে পারে জম্মু , ঝুমরিতিলাইয়া , ঝাড়সুগুদা ছাড়িয়ে দূরে আরও অনেক দূরে -  জ্যাকসন সিটি , জেকবসওয়েল , জেরিকো। ব্যাঙ্কের জোটে পারিশ্রমিক ( যা আপনি দেখেন এবং সানন্দে বহন করেন) আর মুদ্রা কেনা বেচার দরের পার্থক্য (যা  আপনি কখনোই  জানবেন না )।

    একটু ইতিহাসে উঁকি দিই।

    দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার এক বছর আগে ব্রেটন উডসে অনুষ্ঠিত  কনফারেন্সের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ফরেন এক্সচেঞ্জ বা বিদেশি মুদ্রা  বাজারি দর নয়, পূর্ব নির্ধারিত হার মাফিক  ( পাঁচ টাকায় এক ডলার ছিল আমার বাল্যকালে) বিনিময় করা সাব্যস্ত হয় । শুক্রবার বাইশে নভেম্বর ১৯৬৩ সালের সকালবেলা এক ব্রিটিশ পাউনডের মূল্য ছিল ২.৮০ আমেরিকান ডলার । ২৩শে নভেম্বর  সকালেও সেই একই দর । ইতিমধ্যে আমেরিকান রাষ্ট্রপতি জন কেনেডি টেক্সাসে আততায়ীর গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন।  বিনিময় হারে কোন ব্যত্যয় হয় নি।

    এই সুব্যবস্থার বিনাশ ঘটে ১৯৭১ সালের ১৫ই আগস্ট । সেদিন প্রেসিডেন্ট নিকসন জানালেন এক আউন্স সোনার বদলে ৩৫ ডলার বিনিময়ের  যে প্রতিশ্রুতি তাঁর দেশ ১৯৪৪ সালে দিয়েছিল , সেটির সম্মান রক্ষা করতে  তাঁরা এবে অপারগ।

    এবার খেলা  বদলিয়ে গেলো । বিভিন্ন মুদ্রার বিনিময় মান স্থির হতে থাকল  চাহিদা,  যোগান , সুদের হার ইত্যাদি ছটি নিরিখে – সকল মুদ্রা ভাসতে থাকল খানিকটা হাওয়ায় , খানিকটা ট্রেডারের মরজিতে  । এই ঘটনার আগে অবধি ব্যাঙ্ক বিদেশি মুদ্রার কেনা বেচা করতো তার খদ্দেরের প্রয়োজন মাফিক । এবার নানান মুদ্রার  ট্রেডিং শুরু হলো ।

    ৩০শে মার্চ ১৯৮১  স্থানীয় সময় দুপুর আড়াইটে নাগাদ ওয়াশিংটনে  আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রোনালড রেগান গুলি বিদ্ধ হলে ডলারের বিনিময় মূল্য তৎক্ষণাৎ নিম্নগামী হয়। তিনি বেঁচে গেছেন জেনে বাজার আগের মূর্তিতে ফেরে।

    একটা সহজ পরিসংখ্যান দেওয়া যাক – এই আজ সোমবার  লন্ডনের বাজারে যে পরিমাণ ডলার কেনা বেচা হবে তার বড়জোর দশ শতাংশ খদ্দেরের প্রয়োজন  মেটাতে -কেউ বিদেশে কিছু কিনেছেন তাঁকে ডলার পাঠাতে হবে কেউ বা রপ্তানির ডলার পেয়েছেন, সেটিকে পাউনডে পরিবর্তিত করতে হবে। বাকি নব্বুই শতাংশ ট্রেডিং। ভাও বুঝে কারেন্সি কিনে বেচার  দাঁও লাগানো । এই খেলায় দেউলে হয়েছে এমন ইউরোপীয় আমেরিকান ব্যাঙ্ক অগুনতি । ডায়মন্ড / ডিবভিগ মডেল এ ব্যাপারে কোথাও কোন  আশঙ্কা প্রকাশ করেন নি । অনেক খুঁজেও বোঝা গেলো না ব্যাঙ্ক বলতে সর্বশ্রী  ডায়মন্ড / ডিবভিগ কাকে বুঝিয়েছেন – রিটেল , হোলসেল, বিল্ডিং সোসাইটি , ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্ক, ছায়া ব্যাংক ?  তাঁরা অবশ্যই বলেছেন ব্যাঙ্কের  নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন।  কোন টাইপের  ব্যাঙ্কের নিয়ন্ত্রণ কার কর্তব্য ?  সব ব্যাঙ্ক কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের ছাতার তলায় আসে না , আসার কথা নয়। যে কোনো  ধাক্কা সামলানোর জন্য ব্যাঙ্কের সমিচিত মূলধন থাকতে হবে । কোন হিসেবে ?  কিন্তু নিয়ন্ত্রকের কাজটা কি ? তাঁরা ক্রেডিট ডিফল্ট সোয়াপ চেনেন ? সেটা কি বস্তু ? খায় না পেতে শোয় ?

    ১৯৩০ সালের মহা মন্দায় ন হাজার আমেরিকান ব্যাঙ্ক দেউলে এবং সাত বিলিয়ন ডলার ধূলায় হয়েছে ধূলি । বেরনানকে এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেছেন । তাঁকে  মহা মন্দার শ্রেষ্ঠ বেত্তা ও বোদ্ধা  বলে মানা হয়। তাঁর ১৯৮৩ সালের পেপারে লিখেছেন  ফেডারাল  রিজার্ভ  ( ১৯১৩ সালে স্থাপিত পৃথিবীর অন্যতম তরুণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক)  এই মন্দার শুরুতেই বিরাট ভুল করে । তারা   সুদের হার বাড়িয়ে অর্থ সরবরাহকে সঙ্কুচিত করার ফলে অর্থনীতিক উদ্ধারের আশা বিলীন হয়ে যায়। ২০০২ সালে মিলটন ফ্রিডম্যানের নব্বই বছরের জন্মদিনে বেরনানকে  বলেন (তিনি তখন ফেডারাল রিজারভের বড়ো সাহেব): “আপনি ঠিক বলেছিলেন । ১৯৩০ সালে ফেড ভুল করেছিল । আমি মেনে নিচ্ছি । আর হবে না “ **।

    গত শতাব্দীর বিশের দশক ।  ওয়াল স্ট্রিট হু হু করে ঊর্ধ্বগামী । এমনিতেই হাওয়ায় উড়ছে  টাকা। তাতে কুলোর বাতাস  দিচ্ছে  অফুরন্ত অর্থ সরবরাহ ।  আজ কেউ  হাজার ডলারের শেয়ার কিনলেন , সাত দিনে  তার দাম বেড়ে দু হাজার  ডলার । এবার  ব্যাঙ্কে গিয়ে সেটি জমা করে অনায়াসে দেড় হাজার  ডলার ধার নিয়ে  তিনি বাজারে লাগালেন । সাপ লুডো খেলার সিঁড়ি ওপরে উঠে যায় , সাপের মুখ চোখে পড়ে  না। বেলুনের মতো ফেঁপে ওঠে কাগুজি ধন ( অ্যাসেট বাবল)।

    আমেরিকান ফেডারাল রিজার্ভরূপী  কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের দায়িত্ব ছিলো  ব্যাঙ্ক ব্যবসায়ের  তত্ত্বাবধান, অর্থ সরবরাহের  নিয়ন্ত্রণ করা । শেয়ারের দাম কোনো কারণে কমলে ব্যাঙ্কের দেওয়া ঋণ অরক্ষিত হয়ে পড়ে না কি ?  ব্যাঙ্কের কর্ম পদ্ধতি নয়,  শুধু সুদের হার তাদের  বিবেচ্য বিষয় ?  তারা  দেশের ব্যাঙ্ককে কোন সাবধানবাণী   দেয় নি- একটা অদেখা , অচেনা বেলুন ফুলে উঠছে?  সম্ভল কে চলো?  

     তিন নোবেল বিজেতা নীরব।

    সাত দশক বাদে, ২০০৮ সালে , এক চমকানো ঘূর্ণায়মান  মঞ্চে  আমরা দেখব একই  নাটকের পুনরাভিনয় , গালা  রি রান।  কেবল বদলিয়ে যাবে  ফুলে ওঠা বেলুনটির নাম এবং ডলারের সংখ্যা।  

    ক্রমশ:

    সবিনয় নিবেদন

    * “Let me end my talk by abusing slightly my status as an official representative of the Federal Reserve. I would like to say to Milton and Anna: Regarding the Great Depression. You're right, we did it. We're very sorry. But thanks to you, we won't do it again”.: Benjamin Bernanke speech at 90th birthday celebration for Milton Friedman Nov 8, 2002
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ০৯ নভেম্বর ২০২২ | ৮০৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি মতামত দিন