এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  পড়াবই  মনে রবে

  • ছায়াঘন এক কবির জন্য

    চৈতালী চট্টোপাধ্যায়
    পড়াবই | মনে রবে | ২৬ ডিসেম্বর ২০২১ | ১৭৭৭ বার পঠিত | রেটিং ৪ (২ জন)

  • যদিও 'রাত বারোটার পর কলকাতা শাসন করে চারজন যুবক- 'এর মিথ আজ পঞ্চাশের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী, তবু। তাকে ছাপিয়ে উঠে, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়ের কবিতার পূর্বাপর পাঠক জানেন, সুনীল-শক্তি-শঙ্খ-উৎপল-অলোকরঞ্জন-তারাপদদের থেকে অনেক অনেক দূরে সরে এসে পঞ্চাশের এই কবি নিজের ডিক্সনের জন্ম দিয়েছেন ব্যক্তিত্বের সেই স্তব্ধতায়, যেখানে কোনো হুল্লোড় নেই, মিথ হয়ে যাওয়া নেই, খ্যাতি প্রতিপত্তি তো নেইই, আছে শুধু ব্যক্তিগত নিঃসীম অন্ধকার। সেই অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বহে যাওয়ার নামই যদি শরৎকুমারের কবিতা বলি তাহলেই বোধহয় একমাত্র বোঝানোর চেষ্টা করা গেল মনে হবে যে, 'কোথায় সেই দীর্ঘ চোখ'-এর 'আমি তো কামধেনু নই' কবিতায় শরৎকুমার 'নিজেকে নিংড়লে যত রক্তপাত' বলে ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছিলেন। এই রহস্যময় রক্তপাতের সঙ্গে নিঃসন্দেহে জড়িয়ে রয়েছে জীবন যাপনের সমস্ত প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির বিরল সেই উদ্ভাস, যাকে শরৎকুমার এই ছ-দশকে শুধু নিজেই নিজের গভীরে টের পাননি, তাঁর পাঠককেও তার জন্য গভীর অভিনিবেশে, তৈরি নয়, বরং বলা ভাল তিলে তিলে নির্মাণ করে তুলেছেন।

    শরৎকুমারের প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'সোনার হরিণ' প্রকাশিত হয় ১৯৫৭-তে, কৃত্তিবাস প্রকাশনা থেকে। কবি তথা চিন্তক হিসাবে নিজের সময়কে চিনিয়ে দিয়েছেন তিনি এ বইয়ের নাম কবিতাতেই। সেখানে তাঁর প্রজন্মের বনলতা সেন, নিরুপমা রায় এসে কবিকে শুধোয় না 'এতদিন কোথায় ছিলেন', বরং কবি নিচু অভিমানী গলায় উচ্চারণ করেন, 'আমি জানি এ জীবনে জীবনের নিরুপমা রায়/কোনোদিন শুধাবে না, প্রিয়তম চলেছ কোথায়?' যতদিন যাবে, স্বাধীনতা-উত্তর-বাঙালি-বাঙালি তথা, ভারতীয় প্রজন্ম যে নিস্পৃহতা অর্জন করবে এ কবিতায় কি তারই ইঙ্গিত রেখে গেছিলেন কবি সেই সেদিনেই! দেখেছিলেন কি এই ভবিতব্য, যে, 'এক এক করে এই জীবনের সমস্ত প্রহর/সাঁতরিয়ে পার হব। ঘুরে ঘুরে সব ক'টি ঘর/ঘুঁটি এসে স্থির হবে গোধূলির মুমূর্ষু আলোকে/তখন অবাধ্য কোনো স্বপ্ন যদি আসে ঘুমচোখে/সোনার হরিণ তুমি জীবনের নিরুপমা রায়/সেইদিনও বলবে না, প্রিয়তম এসেছ কোথায়! 'নিজের সময়ের বৃত্তে দাঁড়িয়ে শরৎকুমারের লেখার উড়াল সেই ১৯৫৭ তেই নিজের প্রজন্মের মোহভঙ্গের কোন ইশারা বহন করছিল তা বোঝাতে এই উদ্ধৃতি জরুরি বলে মনে হয় আমার।

    প্রকৃত কবিতার রহস্য বোধহয় এখানেই রে, সে যাঁকে ছোঁয় তা-ই যেন অনিবার্য আলো হয়ে হয়ে যায়। আকাশের মত ব্যাপ্ত। আর হয়ত-বা অনেকখানি একাও হয়ে যায় ভেতরে ভেতরে। না হলে, 'পৃথিবীর সঙ্গে মানুষের, সূক্ষ্ম এবং বিস্ময়কর সম্পর্ক আছে' কিংবা 'আমরা প্রাণবন্ত থাকি/যতদিন/ব্যক্তিগত মৃত্যুর প্রত্যাশা/আছে, আর আছে আমাদের/অপভ্রংশ, বুদ্ধিহীন ভাষা' বা, 'যাচ্ছ যখন, এমনভাবে যাও/থেকে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল/তেমন আঁচড়/দেয়ালে লেগে না থাকে কোথাও'-র মত উচ্চারণগুলি যে সম্ভব হত না একথা, আর যা-ই হোক, আলাদা করে বলে দেবার নয়।
    প্রখর, অভিমানী এবং স্পষ্টবক্তা। এই তিনটি অভিধায় কবি হিসাবে তো বটেই, গদ্যকার, ব্যক্তি হিসাবেও এমনকি, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়কে অনায়াসে চিনিয়ে দেওয়া যায়।
    অনায়াসে, কারণ সাম্প্রতিক বাংলা সাহিত্যে তিনিই হয়ত একমাত্র নন, কিন্তু অন্যতম ব্যক্তিত্ব, যিনি নিজের দাঁড়াবার জায়গাটা নির্দিষ্ট করে দিতে গিয়ে লেখালেখির প্রায় গোড়ার পর্বেই একরকম, বাধ্যতামূলক জানিয়ে রাখতে পারেন: 'ভাবালুতা আমি বিশেষ পছন্দ করি না!'

    প্রথম জীবনের খুকি সিরিজ এবং মধ্য জীবনের শেষ মুহূর্তে এসে লেখা স্ট্রেস সিরিজ অবশ্যই ওঁর স্মরণীয় কাজ। তিনি আবেগ এড়িয়ে চলতে চাইতেন সবসময়, তিনি কী করে এই সিরিজে এসে পৌঁছলেন ভাবতে অবাক লাগে। একের পর এক এই সিরিজের কবিতাগুলো আজও তাড়া করে বেড়ায় আমাকে। একটা কবিতা সেই সিরিজ থেকেই তুলে দিলাম এখানে:

    হালকা গোলাপী আলোয় আঙুল তুলে
    আমার সঙ্গে কথা বলো কেন।
    তোমার অস্বাভাবিক উঁচু নাক আমায় তাড়া করে ঘুমের মধ্যে।তর্ক
    করি না, তবু তোমার অকরুণ প্রশ্ন, উচিত কথাগুলো আমি বলেছি,
    সত্যি? না ভীতু কাপুরুষ, চুপ করে
    মেনে নিয়েছি অপমান? বিব্রত
    করো কেন শংকরপ্রসাদ, আমি লজ্জায় কুঁকড়ে যাই।
    রাজগীরের নিসর্গ সামনে, আমার অতীত নোটবুক খুলে দেখাও। তুচ্ছ
    দানখয়রাতের তালিকা মেলে ধরো। বই
    কিনি,পড়ি না, শুধু পেজমার্ক দিয়ে রাখি
    কেন জানতে চাও। কতোকাল আগে
    খেলতে খেলতে আমার
    ভাইয়ের সামনের দাঁত–মনে হয় পেছন
    থেকে ঠেলেছিলাম–আমি
    ভুলতে চাই।
    কাত হয়ে শুয়ে থাকি, তুমি আমার ওপর
    তারের খাঁচা চেপে ধরো।
    শিক দিয়ে খোঁচাও। শান্তি নষ্ট হয়। চোখ
    বাঁচাতে লেজ বেরিয়ে
    পড়ে, আমার কষ্ট হয়। লোম ফুলিয়ে ভয়
    দেখাতে চাই, কিন্তু গলার
    কাছে ধুকধুক করে প্রাণ।
    সাম্রাজ্য ফিরে পাবার আশায় কতো
    শাহেনশা পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
    সাম্রাজ্যের লোভ নেই আমার। ঘুমোতে দাও শংকরপ্রসাদ। আমি
    মহৎ নই, সাহসী নই। আমি লেখাপড়া
    কিছু শিখিনি।
    নারকোলগাছের ওপর মলমের মত জ্যোৎস্না পড়েছে। ব্যানডেজ
    বাঁধা শাদা বাড়িটা অন্ধকারে, দাঁড়িয়ে,
    একলা। তুমি যাও। আর একটু
    পরে আলো ফুটলে শান্তি। বসিরহাট
    বারুইপুর থেকে কলকাতায়
    ঢুকবে সারি সারি ট্রাক বোঝাই আরাম।


    শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়ের একটা পারিবারিক সম্পর্ক আছে আমার সঙ্গে। শরৎদা, বিজয়াদি বলতাম। কিন্তু বস্তুত, পিসি-শাশুড়ি ও পিস-শ্বশুর। একথা বলতে গেলেই বিজয়াদি বলবেন, খবরদার! আমি দিদি হই তোর। শরৎদা, সহাস্য, বলবেন, যা খুশি বলতে পার। নাম ধরেও ডাকতে পার।
    মেঘমল্লার বাড়ির ওই ফ্ল্যাটটিতে, যে কোনো অজুহাতে, যাওয়া আমার চিরকালের মত ঘুচে গেল। মুছে গেল, সেখানে পৌঁছে তিরস্কার ও স্নেহ সমেত, খাদ্য ও পানীয় সহকারে নানাবিধ গল্প শোনার সম্ভাবনাটুকুও। স্মৃতি রয়ে গেল।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • পড়াবই | ২৬ ডিসেম্বর ২০২১ | ১৭৭৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পার্থ মুখোপাধ্যায় | 110.225.114.6 | ২৭ ডিসেম্বর ২০২১ ১৫:৪৯502344
  • দারুন। দারুন।
  • সন্দীপন | 2401:4900:3a25:3885:eb00:59a6:33c:4bc8 | ০৪ জানুয়ারি ২০২২ ১৫:০০502491
  • ব্যক্তিগত  অনুভব  এবং নৈর্ব্যক্তিক  বিশ্লেষণের  সম্মেলনে যথার্থ  শ্রদ্ধার্ঘ্য।
  • অমিতরূপ চক্রবর্তী | 2401:4900:3a11:2888:50b9:57ce:9d14:7408 | ১৬ জুন ২০২২ ২০:১৩509075
  • খুব ভাল লাগল।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে মতামত দিন