(এই কবিতার শুরুতে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। এপ্রিল-মে মাস তখন। কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের সৌজন্যে প্রতিদিন খবরের কাগজে, সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা ছবি ভেসে উঠছে। আমরা অনেকেই সেই সময়টাকে ছবি দিয়েই মনে রেখেছি -- দিল্লির অস্থায়ী শ্মশানে একসঙ্গে চল্লিশটি দাহকুন্ডের উদ্বাহু নৃত্য; সাদা চাদরের উপর দিয়েই শবের কপালে এক বৃদ্ধ, শীর্ণ হাত টিপ পরিয়ে দিচ্ছে। স্বাধীন দেশের পঁচাত্তরে পা দেওয়ার কালে ভেঙে, মুখ থুবড়ে পড়লো স্বাস্থ্যব্যবস্থা। মানুষ, ডাক্তার হাহাকার করে গেল অক্সিজেনের জন্য, বেডের জন্য। অথচ নেতা-নেত্রীরা মেতে রইলেন ভোটক্রীড়ায়। রাজ্যের পর রাজ্য স্রেফ ছারখার হয়ে গেল জনসভা আর পথসভায় সমাগমের দাক্ষিণ্যে। অচেনা অতিমারীর ভয়ের চেয়েও ভয়াবহ, অবিশ্বাস্য এক সময়!
এত সবকিছুর মাঝে যে মানুষেরা ‘স্বজন’ না হয়েও বহু মুখে আগুন দিলেন এই দুঃসময়ে, পরিজনহীন দেহকে শেষ স্বাভাবিকতায় পৌঁছে দিলেন, এই কবিতা তাঁদের উদ্দেশ্যেই লিখেছিলাম।)
শ্মশানে দেহ রাখি, বন্ধুভারহীন
শ্মশানে এই দেহ আমার নয়
নীরব সব, শুধু বাতাসে হাপরের
আলাপ। চিতাতেও সে বাঙ্ময়
গুনেছি হাতে কর, সবে চুয়াত্তর
এখনও বহু লাশ আসবে ঠিক
এখনও কুঠারের আঘাতে ফাটা কাঠ
মেলাবে উঁচু ঘর ও প্রান্তিক
মেলাবে ওষুধের না-মেলা হাহাকার
জুড়িয়ে যাবে বুকে বায়ুর টান
বেবাক স্বাধীনতা, শোষণ, খোদগারি
মিলিয়ে দেবে এই আগুনগান।
ওই যে জ্বলে চিতা! জিভের লকলক
ওই তো, পুড়ে যায় সর্বনাশ
মানুষ জড়বৎ ফিরেছে পশ্চিম
পূর্বে ধমনীর নাভিশ্বাস
শিশুর পোড়া হাত, বৃদ্ধ কটিদেশ
মধ্যবয়সের করোটিফাঁক
লেগেছে কাঠে কাঠে বিষম ঠোকাঠুকি
ধোঁয়ায় ওরা সব মুক্তি পাক
যে ধোঁয়া বাঁধা ছিল কোটরে, ফুসফুসে
যে ধোঁয়া নিয়েছিল আপন-পর
আজকে আগুনের স্বগত কৌতুকে
দাহ্য হোক তার আড়ম্বর
ওই তো জ্বলে চিতা উঠোনে, ঘরে ঘরে
ওই তো মড়া শোঁকে কুকুরদল
ওই তো চেখে দ্যাখে রোগের বাহাদুরি
রাষ্ট্র, প্রশাসন, গঙ্গাজল।
আহা রে, আগুনের নাচন লকলক
নিজেরই বাড়া ভাতে পোয়াতি ছাই
শুমারি বলে দেবে সুস্থ কতজন
ক' ঘর বানভাসি? একাকী ঠাঁই?
শ্মশানে দেহ এনে রেখেছি রোজকার
বন্ধু সেজে দেব আগুন গায়ে
আবার যদি কাল কবরে দেয় ডাক
দেখবো, মাটি কার রোষ মেটায়!
আমার ধর্ম কি রাম? না শ্বাসবায়ু?
রুটি, না ফেজটুপি পেটের টান?
বললে কাফনেই ছড়িয়ে দেবো ফুল
শ্মশানে জ্বেলে দেবো দাহের গান!
খুঁচিয়ে দেবো নাড়ি, ফাটাবো হাড় মাথা
গড়িয়ে যাবে দেহ জলের ধার
আমার হাতে আছে এমন রোশনাই
দু' চোখে তবু এত অন্ধকার!
কখনও ছুটে চলি চিতার থেকে দূরে
কখনও পোড়া মাঠে পেতেছি কান
শুনেছি, রোগ ভোগ ঘেন্না জরা ভয়
আসলে শেষে গিয়ে সব সমান
তাই তো হাতে এই মশাল উদ্গ্রীব
যা কিছু গহ্বর পোড়াবো আজ
আয় রে দেশ কাল, দেখবি নেচে নেচে
শ্মশানবন্ধুর আগুনসাজ।
ছবি © Reuters
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।