এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  বিবিধ  শনিবারবেলা

  • নুড়িতলার বাঁকে - পর্ব ২

    কেকে
    ধারাবাহিক | বিবিধ | ২৪ এপ্রিল ২০২১ | ২২৮০ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • নাম তার ছিলো উল্ফ ফেনরীর
    ছিলো যেন জীবন্ত...



    আচ্ছা গান থাক। সেই গল্পের বাকিটুকু আজ বলি। কতদূর হয়েছিলো যেন? লোকীর ছেলে আর মেয়েকে দেবতাদের রাজা জলে ফেলে দিলেন, পাতালে পাঠিয়ে দিলেন। তাই তো? হ্যাঁ,তা এবার তৃতীয়্জনের পালা। অদিনের থেকে সবাই আঁচ পেয়েছে যে এ ছেলে সবচেয়ে ভয়ানক। সবার বুক ধুকধুক করছে। যুদ্ধের দেবতা তাঈর তাকে নিয়ে এলেন।

    একটা উইলো গাছের ডাল দুমড়ে তাই দিয়ে ঢাকা বানিয়ে ওর মুখে পরিয়ে দিয়েছে। গলায় লোহার শিকল বাঁধা। লোকীর সবচেয়ে ছোট ছেলে 'ফেনরীর'। ওর অন্য একটা নামও আছে। কেউকেউ ওকে ‘ফেনরিস উলফ’ বলেও ডাকে। উল্ফ? হ্যাঁ, নেকড়ে। ফেনরীর একটা কালো আর ছাই রং মেশানো নেকড়ে ছানা। এলোও তাঈরের পায়ে পায়ে। তাঈর ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেন, গলায় চুলকে দেন। ছানাটার আরামে চোখ বুজে আসে। একটা লাল জিভ দিয়ে সে ওঁর আঙুল চেটে দিলো। সব দেবতারা বলাবলি করতে লাগলেন "একে কি সত্যি অন্য কোথাও পাঠানোর দরকার আছে নাকি? এখানে আমাদের এই অ্যাসগার্ডেই রাখলে হয় না?"

    সর্বজ্ঞ অদিন ভাবেন "একে অন্য কোথাও চোখের আড়ালে রেখে বড় হতে দিলে না জানি কী হয়! কোনোভাবে আমাদের এই অ্যাসগার্ডেই যদি রাখা যায়।"

    তাঈর তো এদিকে তাকে বড্ড ভালোবেসে ফেলেছেন। শেষ অব্দি ঠিক হলো তিনিই ফেনরিসের ভার নেবেন। ফেনরিস না ফেনরীর? কোন নামটা তোমার বেশি ভালো লাগছে? আমার তো 'ফেনরিস'ই পছন্দ। বিদ্বান লোকেরা অবশ্য বলেন শুধু ফেনরিস বলাটা ভুল হয়। তাহলে বলতে হবে 'ফেনরিস উল্ফ', পুরা নাম। আর ছোট করে ডাকতে চাইলে ঐ 'ফেনরীর'ই। কিন্তু সেসব কচকচি থাক। নামে কী যায় আসে? আমি যদি তাকে রিমাস লুপিনই বলি,তাতেই বা কী!
    ফেনরিস উল্ফ, নেকড়ে। সে খায় কাঁচা মাংস, আর কথা বলে মানুষের গলায়। অদ্ভুত না? পুরাণের গল্পে অমনিই হয়। তাঈর রোজ নিজে হাতে ওকে ভেড়ার মাংস খাওয়ান। ফেনরিস তরতর করে বাড়তে লাগলো। প্রথমে ছিলো একটা সাধারণ নেকড়ে ছানার সমান। দুদিনেই বেড়ে হলো প্রমাণ মাপের একটা নেকড়ে। তার পরের দিনই একটা ভালুকের মত বড়। পরের দিন আরো,পরের দিন আরো! ওর থাবার নখগুলো শান দেওয়া বল্লমের ফলার মত হয়ে উঠছে। ঝকঝকে সাদা দাঁত ছুরির মত ধারালো। দেবতাদের বুক গুরগুর করে ওঠে। এ কী হলো? সেই মিষ্টি কুকুর বাচ্চার মত ফেনরিস দিনে দিনে এ কী হয়ে উঠছে?! তাঈরের কিন্তু কোনো হেলদোল নেই। তাঁর কাছে ফেনরিস সেই প্রথমদিনের মতই রয়ে গেছে।

    দেবতাদের ঘুম উড়ে গেলো। আজকাল ফেনরিসকে দেখলেই ভয় করে। কী গমগমে গলার আওয়াজ! কী জোরালো পেশিবহুল শরীর! সবাই মিলে অনেক যুক্তি করে তাঁরা এক মতলব ঠাউরালেন। স্বর্গের কামারশালে সবচেয়ে দক্ষ কারিগরদের দিয়ে এক মোক্ষম শিকল তৈরী হলো। এত্ত মোটা, এই লম্বা শিকল, এমন ভারী যে কোনো মানুষের সাধ্যি নেই তা হাতে করে তোলে! মহাবলী থর নিজে হাতে সেই শিকল বয়ে নিয়ে ফেনরিসের সামনে হাজির হলেন। অন্য সব দেবতারাও সঙ্গে এসেছেন। মুখে হাসি টেনে তাঁরা বললেন -- "ভাই ফেনরিস, দেখি তো তোমার গায়ে শক্তি কত? এই শিকল দিয়ে তোমায় বাঁধলে ছিঁড়তে পারো কিনা?"

    নিজের গায়ের জোর নিয়ে ফেনরিসের গর্ব কম নয়। পাটকিলে চোখ দিয়ে অপলকে খানিকক্ষণ দেবতাদের দিকে তাকিয়ে থেকে সে বললে --"ঐ ফিনফিনে দড়িটা দিয়ে বাঁধবে নাকি? ফুঃ!"

    তা সবাই মিলে তাকে বেশ কষে বাঁধলে একটা পাথরের সাথে শিকল দিয়ে। কিন্তু ঐ অব্দিই। দু মিনিটও গেলো না, ফেনরিস টান মেরে শিকল ছিঁড়ে কুটিকুটি করে দিলো!

    "হাঃ" -- ফেনরিস বললে, "এই তোমাদের সাধের শিকল? এই দিয়ে আমাকে বেঁধে রাখবে? এর দশাটা কি হলো তা যেন পরে ভুলে যেওনা।"
    তাঈর তার কাণ্ড দেখে হা হা করে হেসে উঠলেন । সেই হাসির শব্দে অন্য দেবতাদের বুকের ধকধক চাপা পড়ে গেলো। অদিন একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেললেন। না, তাঁদের 'সাধের শিকলের' দশাটা কি হলো তাঁরা কোনদিন ভুলবেন না।

    দিন যেতে থাকে। ফেনরিস আরো বাড়ছে, আরো ভয়ংকর দেখতে হয়ে উঠছে। একদিন তাঈরকে জিজ্ঞেস করলো -- "তোমার বন্ধুরা আবার আমার শক্তি পরীক্ষা করে দেখবে নাকি? কি বলো?" তাঈর নিঃশ্বাস ফেলে বললেন "দেখবে তো বটেই। কোনো সন্দেহ নেই।" দেবতারা এদিকে ভেবে ভেবে কূল পাচ্ছেননা কি করে কি করা যায়! শেষটা অনেক মাথা ঘামিয়ে, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে পরে নতুন এক শিকল তৈরি হলো। সত্যিই 'কাঠখড়' হলেই হয়েছিলো আর কী! এ শিকল তৈরী করলো পৃথিবীর আর আকাশের দুই লোহা মিশিয়ে। ন'ভুবনে তার থেকে শক্ত ধাতু আর কিছু নেই। সেই শিকলের নাম হলো 'ড্রোমি'। এমন শিকল কেউ আজ অব্দি চোখে দেখেনি! তার প্রতিটা কড়া যেমন ভারী, তেমনি শক্ত। দেবতাদের মনে একটু আশা জাগলো, হয়তো বা এবার একটা উপায় হবে।

    দুপুরবেলা, ফেনরিস থাবার মধ্যে মুখ রেখে ঝিমোচ্ছে। সেইখানে ড্রোমি শিকল নিয়ে দেবতাদের দলবল গিয়ে হাজির। একটা চোখ খুলে নেকড়ে রাজপুত্র জিজ্ঞেস করে -- "আবার কী?" দেবতারা ঢোক গিলে, এ ওর মুখ তাকিয়ে, ভারী মিষ্টি করে বললেন -- "তুমি তো আরো বড়্সড়টি হয়েছো। এই শিকলটা একবার পরখ করে দেখবে নাকি? দেখো, এটা যদি ছিঁড়তে পারো তো বুঝি, হ্যাঁ ফেনরিস আমাদের সত্যি বাহাদুর!"

    সে যে কতটা বাহাদুর তা ফেনরিসের অজানা নয়। বটে? পরখ করবে? করেই দেখো তাহলে! সে নিজের পা বাঁধার জন্য এগিয়ে দিলে। আবার আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধলেন ওকে দেবতারা। জড়িয়ে মড়িয়ে একেবারে একশা! বেঁধেই সরে গেলেন অনেকটা দূরে। ফেনরিস শরীরটা টানটান করে। শিকলটা যেন কেটে বসেছে। ওর চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। ও পা ছুঁড়ছে, গা মোচড়াচ্ছে, সবকটা পেশী দিয়ে জোর খাটাচ্ছে। ড্রোমি শিকল ওকে জাপ্টে ধরে থাকে। দেবতাদের চোখেমুখে চাপা আনন্দ ঝলমল করছে। অবশেষে পারা গেলো তাহলে, অ্যাঁ?

    কিন্তু... কিন্তু... ফেনরিস শেষ একটা জোর ঝটকা দিলো। অমনি বিকট শব্দ করে দুনিয়ার সবচেয়ে শক্ত শিকল খানখান। টুকরো গুলো উড়ে গিয়ে কোথায় যে পড়লো তার হদিশ অব্দি পাওয়া গেলোনা। ফেনরিস আকাশের দিকে মুখ তুলে বুক হিম করা গর্জন করে উঠলো। দেবতাদের হাঁটু কেঁপে উঠলো। তাঈরের কপালে একটা গভীর ভাঁজ পড়লো সেদিন। অদিন কপালের ঘাম মুছলেন।

    আতঙ্ক সবার মনেই চেপে বসছে। যত দিন যায় ফেনরিস আরো দুর্দান্ত হয়ে ওঠে। ওর ক্ষিদে বাড়ছে, শরীর বাড়ছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হিংস্রতা বেড়ে উঠছে। একমাত্র তাঈর ছাড়া কেউ তার ধারেপাশে যাবার সাহস করেনা। অদিনের তো রাতের ঘুম বিদায় নিয়েছে। লোকীর এই ছেলেটা যে পুরো সৃষ্টি নাশ করবে তা তিনি জানেন। তাই বলে এখনই? এত তাড়াতাড়ি?

    অদিন ভাবেন আর ভাবেন। তাঁর জ্ঞানের ভাণ্ডার উথালপাথাল করে ফেলেন। শেষটায় একদিন তিনি 'স্কিরনির'কে ডেকে পাঠালেন। স্কিরনির একজন এল্ফ। সেই যে, আলোর এল্ফ। অদিনের দূত হয়ে স্কিরনির যাবেন নিডাভেলির। সেখানে বামনরা থাকে।

    ন'খানা দুনিয়ার মধ্যে কারিগরী বিদ্যায় সবচেয়ে পটু হলো বামনদের দল। এই নিডাভেলির হিন্দু পুরাণের বিশ্বকর্মার কর্মশালারই মত। কিম্বা যেমন গ্রিক গল্পে হেফেস্টাসের কারখানা। স্কিরনির তো অদিনের ফরমাশ নিয়ে গিয়ে হাজির হলেন। সবকথা শুনে বামনরা বললে "বুঝেছি। গ্লেইপনির শিকল চাই। তা দাম দিতে পারবে তো বাপু?" ঐ 'গ্লেইপনির' না কী যেন যে আদৌ কী তার মাথা মুণ্ডু স্কিরনিরের জানা নেই। কিন্তু দামের বহর শুনে তাঁর চোখ কপালে উঠলো! এরা বলে কী?

    কারিগরদের সর্দার বামন বললে "তা হবে নাই বা কেন? কী কী জিনিস দিয়ে এই শিকল তৈরি হবে তা জানো? প্রথমেই লাগবে বেড়ালের পায়ের আওয়াজ। তারপরে লাগবে কোনো মেয়েমানুষের দাড়ির একটা চুল। তারপর পাহাড়ের শিকড় চাই, ভালুকের নাড়ি চাই। আর চাই মাছের নিঃশ্বাস। আর সবশেষে, পাখির থুতু।"

    এইসব জিনিস আবার সত্যি করে হয় নাকি?! না, হয়না তো। যা হয়না তাই দিয়ে তৈরি বাঁধন ছিঁড়বে কেমন করে তাহলে কেউ?
    স্কিরনির দীর্ঘ্শ্বাস ফেলেন -- "যা দাম চাও পাবে। রাজা বলে দিয়েছেন দরাদরি না করতে"।

    বামনেরা কাজ শুরু করে দিলো। চাঁদ উঠলো কতবার, কতবার অস্ত গেলো, কেউ তার হিসেব রাখে না। কামারশালায় গনগনে আগুন জ্বলছে, হাপর ওঠে, হাপর পড়ে। যেসব জিনিস হয়না তাই দিয়ে তৈরি হচ্ছে গ্লেইপনির। অপরাজেয় শিকল। শেষমেষ স্কিরনিরের হাতে একটা কাঠের বাক্স দিয়ে সর্দার কারিগর বললে --"এই রইলো তোমাদের শিকল। এখন এসো গিয়ে।" স্কিরনির বাক্স খুলে দেখেন পাতলা ফিনফিনে দড়ি একটা। হাওয়ার মত হাল্কা, রেশমের মত নরম, চাঁদের আলোর মত রং তার। অবাক হতে গিয়েও তাঁর মনে পড়লো স্বয়ং বিশ্বপিতা অদিন এই জিনিসের ফরমাশ দিয়েছেন, সেরার সেরা বামন কারিগরেরা এই জিনিস তৈরি করেছে। এ কখনোই সামান্য কিছু নয়!

    কাঠের বাক্সে রেশমের ফিতের মত শিকল নিয়ে স্কিরনির যখন অ্যাসগার্ডে ফিরে এলেন তখন সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। অদিন অন্য সব দেবতাদের সঙ্গে নিয়ে ফেনরিসের কাছে গিয়ে পৌঁছোলেন।

    ঘাড় বেঁকিয়ে পুরো দলটাকে দেখে নিয়ে সে বললে -- "আবার এসেছো তোমরা? এবার কী এনেছো? আরো মোটা দড়ি?"
    তার গলায় ঠাট্টার সুর উপেক্ষা করে থর বাক্স খুলে দেখান।

    --"এই যে, এটা দেখেছো? এই দিয়ে শেষ একবার শক্তি পরীক্ষা হয়ে যাক ফেনরীর। এবারও যদি তুমি জেতো, আমরা সব্বাই বরাবরের মত মেনে নেবো তুমি দুনিয়ায় সবার থেকে বেশি শক্তি ধরো।"

    ফেনরিস অবজ্ঞায় মুখ বাঁকায়। "ঐ ফিতেটা? ইয়ার্কি মারতে এসেছো ফেনরিস উল্ফের সাথে? ওসব ছেঁদো ছেলেখেলা তোমরা করো গিয়ে। আমার এসবে কোনো রুচি নেই।"

    অদিন ফিসফিসিয়ে কিন্তু জোরে জোরে বলেন "বুঝেছি, ও ভয় পেয়েছে।"
    "ভয়? ফেনরীর জগতে কাউকে ভয় পায়না। একটা রেশমী সুতোর বাঁধন ছিঁড়ে আমার চতুর্বর্গ কী লাভটা হবে শুনি? এই তোমাদের শক্তির পরীক্ষা? ননীর পুতুলের দল! এই ফালতু কাজে আমি সময় নষ্ট করিনা। এখান থেকে কেটে পড়ো। যত্তসব বিরক্তিকর লোক!"

    অদিন এবার তাকে সরাসরি বললেন -- "শোনো ফেনরিস, তুমিও বোকা নও, আমিও একজন বয়স্ক রাজা। বাজে কথায় আমারও কাজ নেই। এই ফিতেটার নাম গ্লেইপনির। তোমার জন্যই আমরা বানিয়ে এনেছি। সত্যি শক্তি থাকে তো পিছিয়ে যাও কেন?"



    ফেনরিস তার পোখরাজের মত ঝকঝকে চোখ অদিনের চোখে রেখে স্থির হয়ে থাকে। তারপর বলে -- "আমি মিথ্যে কথার গন্ধ পাই। এর মধ্যে তোমাদের চালাকি আছে কোনো। তোমরা আমাকে ঠকাতে এসেছো, তোমরা অন্যায় কিছু করবে বলে এসেছো। দেবো না বাঁধতে যাও। কী করবে করো।"
    অদিন জোর করে কাঁপা গলা স্থির করে বললেন -- "ফেনরিস, এর মধ্যে কোনো মিথ্যে কথা নেই। বাঁধন যদি ছিঁড়লে তাহলে তো হয়েই গেলো। যদি না পারো, আমরা জেনে নেবো তোমাকে আমাদের ভয়ের কিছু নেই। তোমাকে কোনদিন বেঁধে রাখার আমাদের প্রয়োজন পড়বে না। ভদ্রলোকের এক কথা!"
    -- "বটে? ভদ্রলোকের কথা? বেশ, আমিও ভদ্রলোকের মত শর্ত আনি তাহলে। তোমাদের মধ্যে কেউ একজন তার ডান হাতটা আমার মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখো। কথা দিচ্ছি, মুখ আমি বন্ধ করবো, কিন্তু দাঁত বসাবো না। যতক্ষণ আমি বাঁধন ছিঁড়তে না পারি, হাত থাকবে আমার মুখের মধ্যে। ছিঁড়ে ফেলার সাথে সাথে আমি মুখ খুলে দেবো, অক্ষত হাত নিয়ে ফেরৎ যেও। কেমন? রাজি আছো? ভদ্রলোকের দল?"

    ওর দাঁত গুলো একেকটা মানুষের একটা গোটা হাতের সমান লম্বা, দামাস্ক ইস্পাতের তরোয়ালের মত ধারালো। সেদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে বল্ডার থাকান থরের দিকে। হেমদল তাকান অদিনের দিকে। হোয়েনীর ফ্রে'র দিকে। কেউ এগিয়ে আসেনা। ফেনরিস হেসে উঠলো।

    একজন দেবতা ওর কাছে এসে দাঁড়ালেন খালি। তাঈর। ফেনরিসের মাথায় একটা হাত রেখে বললেন -- "তুই যদি চাস তো তাইই হোক। এই আমার ডানহাত বাজি রইলো। মুখ খোল ফেনরীর।"

    ফেনরিস তাঁর হাতটা মুখে ভরে নিয়ে চুপ করে চোখ বুজে, পাশ ফিরে শুলো। তাঈর, তার ছোটবেলাকার বন্ধু। বাচ্চা বয়েস থেকে সে ওঁর সাথে এইভাবে কত খেলেছে!

    থর আর হেমদল দুজনে মিলে হাওয়ার মত হাল্কা, রেশমের মত নরম, চাঁদের আলোর রঙের গ্লেইপনির ফিতে দিয়ে ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধলেন।
    "কই ফেনরিস, এবার দেখাও কত শক্তি তোমার!"

    ফেনরিস গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করে। কিন্তু লিকলিকে দড়িটা ওকে একেবারে অনড় করে বেঁধে রেখেছে। গায়ের সমস্ত জোর এক করে সে বাঁধন ছেঁড়ার চেষ্টা করে। যত চেষ্টা করে গ্লেইপনির তত শক্ত হয়ে কেটে বসে! ফেনরিস রাগে গরগর করছে। আরো জোর খাটায়, আরো জোর। কিছুতেই কিছু কাজ হয়না। রেশমের ফিতে অচ্ছেদ্য ফাঁস হয়ে তাকে জড়িয়ে আছে। দেবতারা প্রথমে মুচকি হাসেন, তারপরে ফিকফিক, তারপর খোলামেলা হো হো।

    --"বেশ। হার মানলাম। তোমাদের গ্লেইপনিরের শক্তি আমার থেকে বেশি।" ফেনরিস ঝটপটানি ছেড়ে চুপ করে শুলো। শর্ত মানুক ওরা, এসে বাঁধন খুলে দিক।

    কে খুলবে বাঁধন? দেবতাদের হাসির কলরোলে কান পাতা দায়। থর হাসছেন যেন গুমগুম বাজ ডাকছে। মহাজ্ঞানী অদিনের বাঁকা হাসি। সুদর্শন বল্ডারের মিহিন হাসি। "আরে, বোকা নেকড়েটা শেষমেষ বাঁধা পড়েছে রে!!"

    ফেনরিস তাঈরের মুখের দিকে তাকালো। নীরব চোখ তার -- "তুমিও?"
    তাঈর মাথা নেড়ে ফিসফিস করে বললেন - " না। আমি না, ফেনরীর। নে, কামড় বসা।"

    যুদ্ধের দেবতা, আইন আর সততারও দেবতা। এই ভয়ংকর জানোয়ারটা তাঁর আদরের বন্ধু। বন্ধুর সাথে তিনি বিশ্বাসঘাতকতা করেন না।

    ফেনরিস অসহ্য রাগের এক রক্তজল করা ডাক ছেড়ে এক কামড়ে তাঈরের ডান হাতখানা ছিঁড়ে ফেললে। তাঈর রক্তের ফোয়ারা বাঁ হাত দিয়ে চেপে ধরে চুপচাপ উঠে আসেন। অন্য দেবতারা ভয়ে ভয়ে এ ওর দিকে তাকাচ্ছেন তখন।

    সবাই মিলে গ্লেইপনির শিকলের অন্য প্রান্তটাকে বড় এক পাহাড়ের সঙ্গে শক্ত করে বাঁধলো। পাহাড়টাকে আবার গেঁথে দেয়া হলো মাটির সঙ্গে ঠুকে ঠুকে। যাতে কোনমতেই উপড়ে না আসে। ফেনরিস, বাঁধাপড়া চলচ্ছক্তিহীন নেকড়েটা অদিনের দিকে তাকিয়ে বললো -- "দেবতাদের রাজা, বিশ্বপিতা অদিন তুমি, এরকম মিথ্যে বললে? যদি বিশ্বাস রাখতে, আমি তোমাদের সবচেয়ে বড় বন্ধু হতে পারতাম। এখন লিখে রাখো। তোমাদের শেষ না দেখে আমি ছাড়বো না। প্রতিজ্ঞা করছি, তোমাদের আকাশ থেকে আমি চাঁদ সূর্য মুছে দেবো। আর তোমার গলার নলি ছিঁড়েখুঁড়ে না দেওয়া অব্দি আমার শান্তি নেই। আমি প্রতিজ্ঞা রাখি, মনে রেখো ভদ্রলোক!"

    অদিন জবাব দেন না। কে একজন দেবতা একটা খোলা তরোয়াল ফেনরিসের দুই চোয়ালের মধ্যে গেঁথে দিলে। যাতে তার আর মুখ খোলা বন্ধ করার উপায় না থাকে। এতদিনের মূর্তিমান ত্রাস আজ পুরো দস্তুর অসহায়। তাকে শিকল শুদ্ধু, পাহাড় শুদ্ধু, মুখে গাঁথা তরোয়াল শুদ্ধু, 'লিংভি' বলে একটা দ্বীপে বন্দি করে রেখে সবাই চলে গেলো।

    ফেরার পথে দেবতারা এ ওর পিঠ চাপড়ান, একে অন্যকে বাহবা দেন। তাঁদের বড় আনন্দের দিন আজ। তাঁদের হাসির দমকে রাস্তার গাছপালা কেঁপে ওঠে। বাসায় ঘুমন্ত পাখি চমকে জেগে ডানা ঝাপ্টায়। একা তাঈর শুধু চুপচাপ। তাঁর মুখে আজ হাসি ফুটছে না। ডানহাত খুইয়েছেন বটে, কিন্তু যুদ্ধের দেবতা অঙ্গহানির পরোয়া করেন না। হাতের থেকে অনেক গভীরে আরো বড় এক ক্ষত থেকে অবিরত তাঁর রক্ত ঝরছে। তাঈরের গলার কাছে ব্যথা করতে থাকে।



    * অনুপ্রেরণা -- নীল গাইম্যান, সোফিয়া ভিসকন্তি, এমি হিউজেস
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ২৪ এপ্রিল ২০২১ | ২২৮০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Ramit Chatterjee | ২৪ এপ্রিল ২০২১ ১৩:৪২105107
  • দুর্ধর্ষ লাগলো পড়ে। নীল গাইম্যান ও পুরোটা পড়া। কিন্তু বাংলায় এভাবে উপস্হাপন খুব  সুন্দর লাগলো।


    ফেনরির এর শিকল কে এমন করেও ভাবা যায়, যে আসলে কোন শিকল ছিলই না।এই অবাস্তব শিকল টা পরানো তার মনে। উলঙ্গ রাজার জামার মতো।

  • Ramit Chatterjee | ২৪ এপ্রিল ২০২১ ১৩:৪৫105108
  • পুরানো নরওয়ের ভাষাতেও gleipnir মানে হল মুুক্ত বা খোলা। 

  • &/ | 151.141.85.8 | ২৫ এপ্রিল ২০২১ ০৬:৪৬105125
  • এই ত্তো!!! এসে গেছে এসে গেছে!!!! ঃ-) অনেক ধন্যবাদ কেকে। খুবই ভালো লাগল।

  • দু | 47.184.13.36 | ২৫ এপ্রিল ২০২১ ০৭:০৯105126
  • বড় কষ্ট লাগল ফেনরিরের জন্যে। কেকের জাদু পুরোদস্তুর

  • ইন্দ্রাণী | ২৫ এপ্রিল ২০২১ ১১:৪৮105141
  • নিয়মিত পড়ে যাই। বলা হয় নি।
    সিরিজটির জন্য লেখক ও কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ।

  • kk | 97.91.195.43 | ২৮ এপ্রিল ২০২১ ২০:৪৫105250
  • যাঁরা পড়েছেন, ভালোলাগা জানিয়েছেন সবাইকে ধন্যবাদ। সবচেয়ে বেশি ধন্যবাদ শরণ্যা কর ভৌমিককে। প্রথম পর্বের অত সুন্দর ছবিটা এঁকে দেবার জন্য!

  • Ramit Chatterjee | ২৮ এপ্রিল ২০২১ ২২:২২105255
  • @kk আপনি তৃতীয় পর্বে কোন দিকটায় যাবেন ?

  • &/ | 151.141.85.8 | ২৮ এপ্রিল ২০২১ ২৩:১২105256
  • কেকে, তারপর কী হল?

  • kk | 97.91.195.43 | ২৮ এপ্রিল ২০২১ ২৩:৩৪105257
  • রমিতবাবু,
    এই সিরিজটা শুধু মাইথোলজির ওপরে নয়। জীবনের বাঁকে কুড়িয়ে পাওয়া অনেক রকম নুড়ি, অনেক রকম গল্প। তবে মাইথোলজি আমার খুব পছন্দের একটা ফিল্ড। সেরকম গল্পও আবার আসবে হয়তো। ঐ বিষয়ে লিখলে গ্রীস, রোম, মিশর, চীন সব দেশের গল্পই হয়তো উঠে আসবে। এই মূহুর্তে আমি নিজেই জানিনা তৃতীয় পর্ব কী নিয়ে লেখা হবে। দেখি কী খুঁজে পাই।

    অ্যান্ডর,
    অনেক কিছু হয়েছিলো তো। কোনোদিন সেরকম নুড়ি তুললে আবার বলবো অখন। ঐ যেমন ওপরে বললাম :-)

  • &/ | 151.141.85.8 | ২৮ এপ্রিল ২০২১ ২৩:৪৩105258
  • কেকে, সেই কুড়িয়ে যে ঘাসের মধ্যে কুড়িয়ে পাওয়া চকচকে বোর্ড, সোনার? সেই যে জঙ্গলের মধ্যে বেঁচে যাওয়া লীফ আর লীফ্থ্রাশির, ওদের ছেলেমেয়েরা আবার মানুষে ভরিয়ে তুলল রাগনারাকের পরের নতুন পৃথিবী। একদিন কয়েকটা ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ে মাঠে খেলতে খেলতে কুড়িয়ে পেল ওটা। দেবতারা পাশা খেলতেন ওর উপরে। সেই গল্পটা বলবে একদিন?

  • Ramit Chatterjee | ২৮ এপ্রিল ২০২১ ২৩:৪৬105259
  • যাই নিয়ে লিখুন, ভাটে একবার দুতিন দিন আগে একটু বলবেন। বেশ ভালো লাগবে। 

  • moulik majumder | ২১ মে ২০২১ ২০:০২106241
  • ভালোলাগা

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে মতামত দিন