লোকটা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আমি বুঝতে পারছি না। চাকরি দেওয়ার সময় বলা হয়েছিল যে মৃত মানুষ নিয়ে কারবার। চাকরি দরকার, আমি রাজি হয়ে গেছি। কিন্তু আমাকে নদীর পাড়ে, ঠিক শ্মশানের পিছনে নিয়ে আসল কেন বুঝে উঠতে পারছি না। এদিকে অন্ধকার থাকে সব সময়। শ্মশানে আগে আসলেও পিছনে আসা হয়নি। কিন্তু আমার সুপারভাইজারের কোন দিকে কোন খেয়াল নেই, তিনি হনহন করে হাঁটছেন আর বলছেন,
"আসেন, জলদি আসেন। কাজ ছোট, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সময়ের এদিক সেদিক হয়ে গেলে মহা কেলেঙ্কারি!"
আমি তার সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটার চেষ্টা করছি, আর ভাবছি, সমস্ত ব্যস্ততা শেষ করেই তো মানুষ শ্মশানে আসে, এখানে এত কিসের তাড়াহুড়া? আমার সুপারভাইজার, যার নাম মোহাব্বত, তাকে যে জিজ্ঞাস করব, তার সুযোগ তিনি দিচ্ছেন না। বিড়ি টানতে টানতে দ্রুত হাঁটছেন তিনি, পারলে দৌড় দেন!
হাঁটতে হাঁটতে মানে প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে ঠিক যেখানে ইলেকট্রিক চুল্লি তার পিছনে এসে গেলাম। আশ্চর্য হয়ে গেলাম আমি, কিংবা বলা চলে আশ্চর্য হওয়া শুরু হল আমার। সামনের মানুষজনকে দেখা যাচ্ছে। যার মৃতদেহ নিয়ে আসা হয়েছে তার আত্মীয় স্বজন যারা আসছে তারা আস্তে ধীরে ঠেলে লাশকে ঢুকিয়ে দিল চুল্লিতে। ঢুকিয়ে লক করে দিল ওই পাসের দরজা। সাথে সাথে আমার পাস থেকে মোহাব্বত ভাই হাতের বিড়িটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে লাফ দিয়ে চুল্লির পিছনের দিকের একটা দরজা খুলে ফেলল! আমি করে কী করে কী বলে চিৎকার করা শুরু করলাম। তিনি আমার দিকে নির্বিকার, নির্লিপ্ত একটা চাহনি দিল এক ঝলকে। আমি চুপ করে গেলাম, তার কাণ্ড দেখতে থাকলাম। তিনি টান দিয়ে লাশটা নিজের দিকে টেনে নিলেন। নিয়ে আমাকে বললেন,
"ধরেন, যে কাজের জন্য আসছেন, সেইটা করেন।"
আমি এই কাজের জন্য আসছি? চিন্তা করতে করতে হাত লাগালাম। দুইজনে ধরে লাশটা নামালাম। মোহাব্বত ভাই চট করে লাশের উপর থেকে কাফনের কাপড় সরিয়ে দিল। মাঝ বয়সই একজন পুরুষ। তিনি বুকে হাত দিলেন। দিয়ে চাপ দিলেন দুইটা। লাশ চোখ মেলে চাইল!! আমি খুশি হব না ভয় পাব কিছুই বুঝতে পারছি না। একবার ভাবলাম সামনে যে আত্মীয় স্বজন আছে ভদ্রলোকের, তাদের ডাক দেই। আবার চিন্তা করলাম, আরে হচ্ছেটা কী? এইতো সামনে সবাই দাঁড়ানো, তারা দেখছে না কিছু? আমার ভাবার মাঝেই মৃত, না, মানে একটু আগে যিনি মৃত ছিলেন তিনি উঠে বসলেন। মোহাব্বত ভাই তার দিকে একটা অমায়িক হাসি দিলেন। দিয়ে বললেন,
"কেমন লাগছে?"
ভদ্রলোক বললেন, "ফাস্ট ক্লাস!" বলে তিনিও একটা হাসি দিলেন। উঠে বসে কাফনের কাপড় গায়ে পেঁচিয়ে নিলেন। মোহাব্বত ভাই বললেন, "চলেন।"
এবার আর আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। লাফ দিয়ে সামনে দাঁড়ালাম। বললাম,
"ভাই, বলবেন, এখানে কী হচ্ছে?"
মোহাব্বত ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
"চলেন, সামনে সব বুঝতে পারবেন।"
আমি অনড়। আগে বলতে হবে, তারপর যাওয়ার আলাপ।
মোহাব্বত ভাই এবার একটু হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন। বললেন,
"সোজা হিসাব বুঝেন না? আমরা কাওকে মরতে দেই না। এখানে শ্মশানে দেখছেন, কবরেও আমরা একই কাজ করি। আমাদের কাছে কিছু মেডিসিন আছে, যা দিয়ে মৃতের শরীরে প্রাণ ফিরিয়ে আনা যায়।"
কালকে সকালে যদি শুনি হিমালয় পর্বত হঠাৎ হেঁটে বেড়ানো শুরু করছে বা সুন্দরবনের বাঘ টুথব্রাশ হাতে নিয়ে দাঁত ব্রাশ করছে তবুও এত অবাক হয়ত হতাম না আমি যতটা এই কথা শুনে হলাম।আমতা আমতা করে বোকার মত বললাম,
"তাহলে তাকে তার আত্মীয় স্বজনের কাছে ফিরিয়ে দেন।"
তিনি মৃত মানে একটু আগের মৃত মানুষের দিকে এক নজর তাকিয়ে আবার আমার দিকে ফিরলেন। বললেন, আপনিই জিজ্ঞাস করেন, তিনি আত্মীয় স্বজনের কাছে ফিরে যেতে চান কি না? আমি আরও অবাক এবার। বললাম, আপনি ফিরে যেতে চান না?
ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন, না, তিনি ফিরে যেতে চান না। মোহাব্বত ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, সময়ের নষ্ট করবেন না। সামনে চলেন, সব পরিষ্কার হবে। যেতে যেতেও শুনতে পরবেন আরও কিছু।
আমি ঘাড় নেড়ে বললাম, চলেন।
চলা শুরু করতেই মোহাব্বত ভাই কথা বলা শুরু করলেন। বললেন,
"আসলে একটু ভুল বলছি। আমরা কাওকে মরতে দিই না এটা সত্য না। যে দুনিয়া থেকে ইনি এসেছেন, সেখানকার হিসাবে তিনি মৃত, এতে সন্দেহ নাই। আমরা অন্য জগতে যাওয়ার আগে একটা বাই পাশ সিস্টেম দাঁড় করিয়েছি। এতে চিরতরে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া থেকে বাঁচানো যায় মানুষকে। আমরা যেখানে যাচ্ছি চলেন সেখানে, আপনার অনেক পরিচিত মানুষদের দেখতে পাবেন। তারা সবাই এক সাথেই আছে। এখানে আমরা এমন এক জগত বানিয়েছি, এখান থেকে কেউ আর আবার ফিরে যেতে চায় না আগের পৃথিবীতে।" আমি কথা গিলতে গিলতে হাঁটতে লাগলাম।
কতক্ষণ হাঁটছি আর মনে পরছে না। কিন্তু কেন জানি তেমন ক্লান্তিও লাগে নাই। এতে আর অবাক হই নাই, আমি অবাক হওয়া ভুলে গেছি। চলছি শুধু এক রহস্যময় গন্তব্যের দিকে। আমার জ্ঞান, আমার পড়াশোনা সমস্ত কিছু ফালতু মনে হচ্ছে। এই লোক কী বলছে কোন আগামাথা পাচ্ছি না। আবার একটু আগে চোখের সামনে যা ঘটল তাকে অস্বীকারও করতে পারছি না।
আমরা বড় একটা গেটের সামনে দাঁড়ালাম। মোহাব্বত ভাই গেটের কাছে গিয়ে কিছু একটা করল। গেট খুলে গেল। আমরা প্রবেশ করলাম। বিশাল এক বাগান। অনেক মানুষ বাগানে ঘুরছে, কিন্তু তবুও যেন ফাঁকা ফাঁকা সব। একটু দূরে একটা দালান দেখা যাচ্ছে। আমরা সেদিকে পা বাড়ালাম। কাছে গিয়ে বুঝতে পারলাম, এটা একটা অফিস ঘর। মোহাব্বত ভাইয়ের সাথে সাথে আমিও ঢুকার জন্য পা বাড়াতেই তিনি আমাকে থামালেন। বললেন,
"আপনি ঘুরে ফিরে দেখেন, অনেক চমক আছে আপনার জন্য। আমরা এই ফাঁকে ইনার এন্ট্রি করায় ফেলি। এরপর আরও যত প্রশ্ন আছে সব কিছুর উত্তর দিবনে।"
আমি একটু দমে গেলেও মেনে গেলাম। কী একেবারে চমক আছে? আমার পরিচিত কেউ যদি থাকেও এখানে তাহলেই কি চমক হবে তা? আচ্ছা, পরিচিত মানে কী মৃতদের কথা বুঝিয়েছে? আরে, তাই তো!
আমি দ্রুত পা চালাতে লাগলাম। কে আছে? কারা কারা আছে? কোথায় আছে তারা? এদিক সেদিক ঘুরতে ঘুরতে হুট করে এক পা জমে গেল আমার। সামনে টেবিল বিছানো, গোল হয়ে বসে আছে কয়েকজন। সম্ভবত সবাই চা খাচ্ছে। আমি দেখলাম আমার মাকে! পাশে নানু বসে আছে। সবাই হাসছে কি নিয়ে জানি। মা হুট করে আমার দিকে তাকালেন, খুশিতে ভরে উঠল উনার চেহারা। উঠে আসলেন দ্রুত আমার দিকে। বললেন, তুই? এখানে? কবে আসলি? আমি জরিয়ে ধরলাম মাকে। আমি খুশিতে আত্মহারা তখন। আমাকে ধরে মা নিয়ে গেলেন টেবিলে। দেখলাম নানু মুচকি মুচকি হাসছে আমাকে দেখে। যেন খুব মজার একটা কাণ্ড হয়েছে। মা আমাকে পাশে বসালেন। বললেন, "বললি না, কবে আসছিস?
আমি বললাম,
"আমি তো চাকরি নিয়ে এখানে আসছি! কিন্তু আপনি এখান থেকে গেলেন কেন? ফিরে গেলেন না না কেন? মোহাব্বত ভাই তো বলল কেউ চাইলে ফিরে যেতে পারে, আপনি ফিরলেন না কেন?" ভাল মন্দের খোঁজ নেওয়ার আগেই আমি আমার অভিযোগ ঢেলে দিলাম। মা কিছু বলার আগে নানু বললেন,
"কেন ফিরে যাব? আমরা এখানে কত আরামে আছি তোর কোন ধারনা আছে? এখানে আমাদের অখণ্ড অবসর। কোন ক্লান্তি নাই, কোন তাড়াহুড়ো নাই। আমরা এখন প্রকৃত বিশ্রামে। কেন ফিরে যাব?"
নানুর কথা নিষ্ঠুর লাগল আমার কাছে। আমরা কত কাঁদছি তার জন্য, মার জন্য। আর এঁরা বসে বসে আরাম করছে এখানে! আমি কিছু বলার আগেই মা বললেন,
"তুই এখানে চাকরি নিয়েছিস, এ কথা কে বলল?"
আমি বললাম,
"মোহাব্বত ভাই, না, কে বলল? কে জানি চাকরি দিল? আরে, কিছুই মনে পরছে না কেন? মৃতদের নিয়ে কাজ করতে হবে, আরও কী কী জানি বলছিল, কে বলছিল?"
মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
"অস্থির হওয়ার কিছু নাই। এটা তোর মাথায় ঢুকিয়েছে মোহাব্বত। ও মাঝে মাঝে এমন করে। একা একা যেতে চায় না। কাওকে আনতে যেতে হলে নতুন কাওকে এমন বুঝ দিয়ে নিয়ে যায়।"
মা কী বলছে এসব? আমি নতুন কেউ মানে? আমি মারা গেছি নাকি? তা কীভাবে সম্ভব? আমার তো এখনো রবীন্দ্র রচনাবলী শেষ করা হয়নি, বিছানার উপরে না মিহির সেনগুপ্তের লেখা সিদ্ধিরগঞ্জের মোকাম উপুড় করে রাখা? আমি ফিরে গিয়ে শেষ করব ভেবে রেখেছি না?
দেখলাম এবার নানু আর মা দুইজনই মুচকি মুচকি হাসছে আমাকে দেখে!