এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  বিবিধ

  • করোনার ছোবলে ইউরোপ-আমেরিকার বিপর্যয়ের কারণ -- বসন্ত মুখোপাধ্যায়

    শ্রমজীবী ভাষা লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ১১ মে ২০২০ | ১৩৯৬ বার পঠিত
  • করোনা ভাইরাস সংক্রমণে দিশেহারা উন্নত বিশ্বের নেতা ইউরোপ ও আমেরিকা। সংক্রমণ এবং মৃত্যুর হারে গোটা বিশ্বকে চমকে দিয়েছে এই দুই মহাদেশ। একটা বিষয় এখন স্পষ্ট, সংক্রমণ কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা জানার ও তাকে আটকানোর চেষ্টায় চরম গাফিলতি দেখিয়েছে ইতালি, স্পেন, পর্তুগাল, ফ্রান্স, ব্রিটেন ও আমেরিকার মতো শক্তিধর উন্নত দেশগুলি। মৃত্যুর হারে সবাইকে ছাপিয়ে গেছে ইতালি ও স্পেন। আমেরিকায় মৃত্যু কোথায় গিয়ে ঠেকবে এখনও জানা নেই হোয়াইট হাউসের কর্তাদের।


    কোভিড সংক্রমণ প্রতিরোধে যখন চীনের সাফল্য প্রমাণিত হল এবং ইউরোপ ও আমেরিকার ব্যর্থতা স্পষ্ট হল, তখন থেকে মানুষের দৃষ্টি ঘোরাতে সুপরিকল্পিতভাবে দুটি কাজ হাতে নিল পুঁজিবাদী দুনিয়ার শাসকেরা। এক, লোকে লকডাউন মানছে না ঠিকমতো। তাই এত সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। ক্রমাগত জোর দেওয়া হল এই প্রচারে। কিন্তু কেন সংক্রমণ এতটা গভীরে ছড়িয়ে পড়ল তার কারণ খোঁজা হচ্ছে না। হলে আসলে দায় নিতে হবে সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারকেই। উত্তর দেওয়া হচ্ছে না অস্বস্তি জাগানো এই সব প্রশ্নের— ইউরোপ ও আমেরিকার মতো উন্নত মহাদেশগুলিতে কেন নেই টেস্ট কিট, কেন নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসা কর্মী ও নার্স, কেন নেই দরকারি পোশাক, কেন নেই পিপিই, ভেন্টিলেটর, মাস্ক, রেসপিরেটর, গ্লাভসের মতো চিকিৎসার জরুরি সরঞ্জাম। নামে ঐক্যবদ্ধ ইউরোপের সব দেশ নিজ নিজ সীমান্তে বেড়া তুলে বসে আছে যাতে তাদের দেশ থেকে অন্যরা চিকিৎসা সরঞ্জাম নিয়ে যেতে না পারে। তাহলে কীসের ইউরোপীয় ইউনিয়ন? আমেরিকার এমন হতদশা যে বিভিন্ন এয়ারপোর্ট থেকে অন্য দেশের বরাদ্দ মাস্ক জলদস্যুর মতো ছিনতাই করে আনতে হচ্ছে। কেন মিডিয়ার সামনে মুখ খুললে নার্সদের চাকরি খোয়ানোর ভয় দেখাতে হচ্ছে? কেন হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন পেতে ভারতকে সরাসরি হুমকি দিতে হচ্ছে? এই সঙ্কটেও কেন আমেরিকা আমেরিকানদের জন্য নীতি চালিয়ে যাচ্ছেন ট্রাম্প? কোথায় গেল সংক্রমণের বিরুদ্ধে বিশ্ব সংহতি? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছতে হবে তাতে সরাসরি তীরবিদ্ধ হবে সরকার ও রাষ্ট্র।


    দ্বিতীয়ত, ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসকেরা খুব সুকৌশলে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে কাজে লাগাচ্ছেন চীনের বিরুদ্ধে কুৎসা প্রচারের অস্ত্র। চীনা ভাইরাস, উহান ভাইরাস দিয়ে শুরু। এরপর বলা হচ্ছে, আমেরিকা, ইউরোপকে বিপদে ফেলতে চীন জীবাণু অস্ত্র ব্যবহার করেছে। নিজেরা মৃতের সংখ্যা চেপে গেছে। নিজেদের সারিয়ে তুলে এবার বিশ্বজুড়ে ব্যবসা করছে। কত রকম চীন বিরোধী প্রচার যে চালানো হচ্ছে তা বলার নয়। যখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চীনকে সার্টিফিকেট দিচ্ছে তখন বলা হচ্ছে হু-কে টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছে চীন। এমনকি ট্রাম্প রীতিমতো হুমকি দিচ্ছেন হু-এর কর্তাদের। যেসব সরকারের মাথারা এসব প্রচার করছে তারাই আবার চীনের সরকারের কাছ থেকে হাত পেতে নিচ্ছে মাস্ক, ভেন্টিলেটর, পিপিই, রেসপিরেটর। তারাই আবার চীনকে এসবের বরাত দিয়ে বলছে, যত তাড়াতাড়ি পারো এগুলো পাঠাও। চীন যখন তা পাঠাচ্ছে তখন পুঁজিবাদী ইউরোপের মাথারা বলছে, এই রে! চীন যে সাহায্যের নাম করে ইউরোপ ঢুকে পড়ল! তাহলে কী হবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের, কী হবে ইউরোপীয়ান সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের ভবিষ্যৎ? ইউরোপের গরিব দেশ স্পেন, ইতালি, পর্তুগাল কি চীনের পক্ষে চলে যাবে? যে ট্রাম্প গত দু বছর ধরে বাণিজ্য চুক্তির নাম করে চীনকে প্যাঁচে ফেলার চেষ্টা করছেন, গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ তুলে চীনের হুয়ায়ে কোম্পানির ৫জি প্রযুক্তি ইউরোপে বিক্রিতে বাধা সৃষ্টি করছেন, তিনিই হাত পেতে নিচ্ছেন চীনের মাস্ক, ভেন্টিলেটর, পিপিই বা রেসপিরেটর। প্রশ্ন হচ্ছে গত একশ বছর ধরে দুনিয়া শাসন করা ইউরোপ, গত ৭৫ বছর ধরে দুনিয়া শাসন করা আমেরিকার জনস্বাস্থ্যের এই দুর্দশা কেন? কেন চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই, কেন পর্যাপ্ত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী নেই? কেন কাতারে কাতারে যুদ্ধক্ষেত্রের মতো লোক মরছে? এসব প্রশ্নের উত্তর রয়েছে ইউরোপ ও আমেরিকার নয়া উদারবাদী রাষ্ট্রের অর্থনীতি, সমাজনীতি, জনস্বাস্থ্য নীতি, শিক্ষানীতির মধ্যে। এই নীতির সারকথা হল, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এসবই হল পণ্য। সরকার তার ভাড়ার থেকে এসবে টাকা খরচ করবে না। যদিও সেই টাকা হল জনগনের করের টাকা। যার যতটা টাকা আছে, সে ততটা শিক্ষা পাবে, ততটাই স্বাস্থ্য পাবে। বাকিটা বুঝে নেবে বেসরকারি পুঁজি। স্বাস্থ্য নিয়ে হবে ফলাও ব্যবসা। ২০০৮ থেকে ২০২০, এই ১২ বছরে জনস্বাস্থ্যের কতদূর সর্বনাশ করেছে ইউরোপের নয়া উদারবাদী রাষ্ট্রগুলো, আগে একবার সেদিকে চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক।


    ইতালি


    উত্তর ইটালির ইঞ্জিনিয়ার ফ্রান্সেসকো। বয়স ৬০। ২০০৮ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার সময় ছাঁটাই হন। ওঁর আগের চাকরির ইতিহাস বলছে উনি বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা পাবেন না। কিন্তু ওঁর দাঁতের চিকিৎসা জরুরি। দরকার ৭৫০ ইউরো। সেই টাকা ওঁর নেই। এই রকম খারাপ দাঁত নিয়ে উনি ইন্টারভিউয়ে গেলে চাকরি হবে না। আবার ৬৫ র আগে মিলবে না পেনসন। কী পরিণতি হবে ফ্রান্সেসকোর। এবার উত্তর ইতালির লোম্বার্ডি অঞ্চলে কোভিড সংক্রমণে ফ্রান্সেসকোর মৃত্যু হয়েছে কিনা আমাদের জানা নেই।

    ইতালিতে গত এক দশকে ফ্রান্সেসকোর মতো দশা হয়েছে এমন অনেক লোকের। সাম্প্রতিক রিপোর্ট বলছে, ২০১৫ সালে ১ কোটি ১২ লক্ষ ইতালিয়র, মানে প্রতি ৫ জনে ১ জন ইতালিয়র কোনও মেডিক্যাল কেয়ারের ব্যবস্থা ছিল না। ৭৮ লক্ষ ইতালিয় তাদের পুরো সঞ্চয় খরচ করেছিলেন হেলথ কেয়ারে। এর জন্য ধারও করতে হয়েছে অনেককে। ২০০৮ সালে প্রায় ১৪ শতাংশ ইতালিয় এতই গরিব ছিলেন যে তাঁরা দাঁতের চিকিৎসার বীমাই করাতে পারেননি। ২০১৬ সালে সংখ্যাটা পৌঁছেছিল ১৬.৯ শতাংশে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিচারে ২০০০ সালে ইতালির জন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ছিল বিশ্বের ২ নম্বরে। ২০০৮ সালে বিশ্ব অর্থনৈতিক সঙ্কটের পর শুরু হয় ইতালির জনস্বাস্থ্যের অধঃপতন। ২০১২ সালে একগুচ্ছ আইন পাস করে ইতালি সরকার। ওই বছর জনস্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ কমে ৭ হজার ৭১৪ কোটি টাকা। ২০১৩ সালে কমে ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। ২০১৪ সালে বরাদ্দ কমে ২০ হাজার কোটি টাকা। এর জেরে ন্যাশনাল হেলথ ফান্ডের টাকা কমে যায়। কমে যায় জরুরি ওষুধ বাবদ বরাদ্দ। ২০০৯ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে জাতীয় স্বাস্থ্য প্রকল্পের ৪৬ হাজার কর্মীকে ছাঁটাই করা হয়। গত এক দশকে বন্ধ হয়েছে ৩৫৯টি হাসপাতাল। উঠে গেছে ছোটখাটো বহু হাসপাতাল। সেসব হাসপাতালের একাংশ দখল করেছে মাফিয়ারা। ফলে শয্যাসংখ্যা কমেছে ৭০ হাজার। এখন ইতালিতে এক লক্ষ জনসংখ্যা পিছু আইসিইউ বেডের সংখ্যা ৮.৫। জার্মানিতে ৩৫। ২০১২ সালের পর থেকে চিকিৎসা খাতে ইতালিয়দের পকেট থেকে দিতে হচ্ছে অনেক টাকা, যা স্পেন বা গ্রীসের সমান। ফলে চিকিৎসার খরচ যেমন বেড়েছে, তেমন বেড়েছে ভোগান্তি। শুধু একটা উদাহরণই যথেষ্ট যে, ২০১৭ সালে কোমরের হাড়ের অপারেশনের জন্য তিন মাসের বেশি অপেক্ষা করতে হয়েছে ৩৩% রোগীকে। আর্থিক সঙ্কটের শুরু থেকে ২০১৫ পর্যন্ত পাওয়া হিসাবে ১৫.৫% গরিব ইতালিয় চিকিৎসার জন্য দেয় টাকা জমা দিতেই পারেননি। তার মানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেল আউট প্যাকেজের ঋণের বোঝা ইতালিকে এতটাই নিঃস্ব করে দিয়েছে যে তার জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা গত এক দশকে ঝুরঝুরে হয়ে গেছে।


    স্পেন


    ২০০৮ সালে সাব প্রাইম সঙ্কটের জেরে ধসে পড়েছিল স্পেনের অর্থনীতি। তখন থেকেই শুরু পতনের। ২০১২ সালে চাপে পড়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেল আউট প্যাকেজ মেনে নেয় স্পেন। পরিণামে বাড়ে দারিদ্র, বেকারি, বৈষম্য। এর জেরে ব্যাপক রদবদল করা হয় স্বাস্থ্য পরিষেবায়। বিক্ষোভ এড়াতে পার্লামেন্টকে এড়িয়ে রাজকীয় নির্দেশে জারি করা হয় নয়া স্বাস্থ্যনীতি। আগে সর্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার খরচ যোগাত সরকার। তার বদলে নতুন নিয়ম হল, স্বাস্থ্য পরিষেবা পেতে হলে গুনতে হবে ট্যাঁকের কড়ি। আগে নাগরিকদের স্বাস্থ্যরক্ষার দায়িত্ব ছিল রাষ্ট্রের। নতুন নিয়মে স্বাস্থ্য হল পণ্য। টাকা থাকলে মিলবে চিকিৎসা। না থাকলে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু। ২০১২ সালে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ কমল ১৪%, ২০১৩ সালে হ্রাস ২৩%। টাকা দিয়ে স্বাস্থ্য পরিষেবা কেনার ব্যবস্থা করতে গিয়ে দেখা গেল একদল লোক স্বাস্থ্য পরিষেবা পাবেই না। কারণ তাদের যথেষ্ট টাকা নেই। ২৬ বছরের বেশি বয়স কিন্তু চাকরি জোটেনি স্পেনের এমন নাগরিক, বিদেশি অভিবাসী— এদের স্বাস্থ্য পরিষেবা থেকে একেবারে ছেঁটে ফেলা হল। বাজেট বরাদ্দ কমায় বন্ধ হল হাসপাতাল। কমে গেল শয্যার সংখ্যা। মাঝারি ও উচ্চ আয়ের কর্মীদের ওষুধ বাবদ খরচ বেড়ে গেল ৪০ থেকে ৫০% পেনসনভোগীদের আরও বেশি টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা চালু হল। নতুন নীতি চালুর আগে অবসরপ্রাপ্তরা ওষুধ পেতেন নিখরচায়। নতুন নিয়মে পেনসনভোগীদের ওষুধের খরচ বেড়েছে ১০ থেকে ৬০% পর্যন্ত। এর ফলে দেখা গেল মদ্যপান সংক্রান্ত রোগ বেড়ে চলেছে। মানে দারিদ্রের হতাশা থেকে স্পেনের লোক মুক্তি খুঁজছেন মদের গ্লাসে। সবচেয়ে বড় কথা ইউরোপে মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু যে ফ্লু, তার টিকা দেওয়া কমানো হল। আগে এই টিকা পেতেন জনসংখ্যার ৭৩% এখন কত শতাংশ এই টিকা পান কেউ জানে না। এমনি এমনি কি স্পেনে কোভিড ১৯এ এত লোক মরছে?


    ব্রিটেন


    সাবপ্রাইম সঙ্কট ধাক্কা দিয়েছিল ব্রিটেনকেও। তবেএই দেশকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো শাইলকের ঋণফাঁদে পড়তে হয়নি। অবস্থা সামাল দিতে ব্রিটিশ সরকার স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ ব্যাপক ছাঁটাই করেছিল। ২০০৮এর সঙ্কটের ধাক্কায় জনস্বাস্থ্য খাতে খরচের ভার কেন্দ্রীয় সরকারের বদলে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল স্থানীয় সরকারের হাতে। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য দপ্তর থেকে বরাদ্দ পেত স্থানীয় সরকারগুলি। ২০১৩ সালের পর এই বরাদ্দ বেড়েছিল ৫% কারণ দেশে বয়স্কের সংখ্যা বাড়ছিল। ২০১৫ সালে এসে দেখা গেল বাজেট বরাদ্দ কমানো হয়েছে ২০০ মিলিয়ন পাউন্ড। বাড়তি হিসাবে শিশুদের জনস্বাস্থ্যের দায় চাপানো হয়েছে স্থানীয় সরকাররে ওপর। একেবারে দ্বিগুণ কোপ। এই ব্যবস্থা জারি ছিল ২০১৮ পর্যন্ত। এরপর সমীক্ষা আর হয়নি। এর জেরে স্বাস্থ্যখাতে খরচ কমিয়েছে স্থানীয় সরকারগুলিও। বন্ধ হয়েছে ছোটখাটো হাসপাতাল, হেলথ ক্লিনিক। কমেছে হাসপাতালের শয্যা সংখ্যাও। এক কথায়, স্বাস্থ্য পরিষেবার দাম হয়েছে চড়া। এবং যারা সেই দাম মেটাতে পারেন না তাঁরা মরেন বিনা চিকিৎসায়।


    গ্রীস


    ২০০৮-এর আর্থিক সঙ্কটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছিল গ্রিসের। ২০০৮ থেকে ২০১৩র মধ্যে দেশে বেকারির হার বেড়েছিল ২০ শতাংশ বিন্দু এবং ২০০৬ থেকে ২০১১র মধ্যে দেশের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল জিডিপির ১৭০%। ২০০৮ সালে জনস্বাস্থ্যের আওতায় ছিলেন দেশের ১০০% নাগরিক। ২০০৮ সালে তা কমে হয়েছিল ৮৬%। বাদ পড়া ১৪% নাগরিক স্বাস্থ্য বিমার টাকাই দিতে পারেননি। স্বাস্থ্যবিমার জন্য বেতন থেকে টাকা কাটা হত, বাড়ানো হয় ওষুধের দাম, এমনকি নতুন করে প্রেসক্রিপশন চার্জ ধরা হয় ১ ইউরো। আগে প্রেসক্রিপশন লেখাতে টাকাই লাগত না। কন্ডোম বিলি, বেআইনি ড্রাগ ব্যবহারে চিকিৎসা, সিরিঞ্জ বিলি, মশা মারার তেল স্প্রে করা—এসব প্রাথমিক পরিষেবায় খরচ দারুনভাবে কমানো হয়। ২০১০ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ কমে ২০% অথচ মানসিক রোগ বেড়ে যায় ১২০%। বাজেট কমানোর জেরে চলে কর্মী ছাঁটাই। বন্ধ করা হয় নতুন নিয়োগ। এর জেরে সিনিয়র চিকিৎসকরা বাড়তি কাজের চাপ এড়াতে আগেভাগে অবসর নেন। ফলে নার্স ও চিকিৎসকের অভাব দেখা দেয়। টাকার অভাবে বহু লোক ক্রনিক রোগের চিকিৎসা বন্ধ করে দেন। স্বল্প ওজনের শিশুজন্ম এবং শিশুমৃত্যু, দুয়েরই হার বেড়ে যায়।


    মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র


    মনে রাখতে হবে ইউরোপের মতো আমেরিকায় কোনও সরকারি স্বাস্থ্যরক্ষা প্রকল্পই নেই। এদেশে ব্যবস্থা হল ফেলো কড়ি মাখো তেল। সুতরাং চিকিৎসা খাতে যখনই কেউ খরচ করুক না কেন, টাকাটা কাউকে না কাউকে মেটাতেই হবে। এবং এই ব্যবস্থায় খরচ খুব বেশি। আমেরিকার সরকারের হিসাব অনুযায়ী, পা ভাঙলে চিকিৎসার খরচ ৭ হাজার ৫০০ ডলার। যদি এর জন্য তিন দিন হাসপতালে থাকতে হয় তবে খরচ হবে ৩০ হাজার ডলার। তাই আমেরিকায় বেশিরভাগ লোকেরই রয়েছে স্বাস্থ্যবিমা। তার খরচও খুব বেশি। ২০১০ সালে ৫০ মিলিয়ন মার্কিনির (মোট জনসংখ্যার ১৬%) কোনও বিমাই ছিল না। গ্রামাঞ্চল ও সীমান্ত এলাকায় পরিষেবার হাল খুবই খারাপ। প্রাথমিক চিকিৎসা ব্যবস্থা দুর্বল। নেই যথেষ্ট সংখ্যায় পারবারিক চিকিৎসক। স্বাস্থ্যরক্ষা, ফার্মাসির জিনিসপত্র এবং মেডিক্যাল সরবরাহ পেতে গেলে রোগীকেই পকেট থেকে অনেক টাকা দিতে হয় বলে চিকিৎসা পরিষেবা পাওয়াটাই সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। প্রায় এক তৃতীয়াংশ মার্কিন পরিবার মেডিক্যাল বিল মেটাতে পারেন না। সম্প্রতি সংখ্যাটা আরও বেড়েছে। এভাবে তথ্যের পর তথ্য জুড়ে দিলে আমেরিকার স্বাস্থ্য পরিষেবার আসল চেহারাটা বেরিয়ে আসে। পুরোপুরি বাণিজ্যিক ভাবে চলা এই পরিষেবা পেতে গেলে অনেক টাকার দরকার। ইদানিং সাধারণ মার্কিনিদের চাকরি ও আয় কমে যাওয়ায় স্বাস্থ্য পরিষেবা থেকে বঞ্চিত বহু নাগরিক।


    মহামারি, মৃত্যু ও কিছু প্রশ্ন


    ওপরের আলোচনায় ২০০৮ সালের পর থেকে ইউরোপের একাধিক দেশ ও আমেরিকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ক্রমান্বয়ে অধোগতির চেহারাটা স্পষ্ট। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সঙ্কট সামাল দিতে গিয়ে আইএমএফ, ইউরোপীয় কমিশন ও ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের চালু করা ব্যয়সংকোচের নীতি মেনে চলতে গিয়ে ঋণের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছে একাধিক দেশ। ফলে বিপুল বরাদ্দ কমেছে জনস্বাস্থ্যে। এবং ব্যয় সঙ্কোচের ধাক্কায় পুরো কাঠামোটাই নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। আমেরিকার দশাও তথৈবচ। স্বাস্থ্যে সরকারি বিনিয়যোগ নেই। বাড়ছে দারিদ্র, কর্মহীনতা ও বেকারি। ফলে দুর্বল হচ্ছে জনস্বাস্থ্য পরিকাঠামো। বহু লোক থেকে যাচ্ছেন স্বাস্থ্যবিমার বাইরে। এই পরিস্থিতিতে যখন এসে পড়ল কোভিড মহামারি, তখন অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই নৌকা ঝড়ের সামনে পড়লে যা হয় তাই ঘটছে। রব উঠেছে— নেই, নেই, নেই। হাসপাতাল নেই, আইসিইউ বেড নেই, মাস্ক নেই, ভেন্টিলেটর নেই, রেসপিরেটর নেই, গ্লাভস নেই, পিপিই নেই। ইউরোপের সব রাজধানী থেকে আমেরিকার সব বড় শহর, সর্বত্র ধ্বনিত হচ্ছে এই আতঙ্ক। ভয়ঙ্কর বিপদের মুখে চিকিৎসা কর্মীরা। গত এক দশকের বেশি সময় ধরে অর্থবরাদ্দ কমিয়ে এনে জনস্বাস্থ্য নামক যে ব্যবস্থাটিকে ধাপে ধাপে পঙ্গু করে ফেলা হয়েছে, সেখানে কাতারে কাতারে মানুষ মরাটাই তো স্বাভাবিক। প্রতিরোধের কোনও শক্তিই তো ব্যবস্থাটার ভিতরে আর অবশিষ্ট নেই। ট্রাম্প থেকে ইউরোপের কোনও শাসক, এই পরিস্থিতির দায় এড়াতে পারেন না। কোভিডে এত মৃত্যুর জন্য দায়ী তাঁদের নয়া উদারবাদী স্বাস্থ্যনীতি, যে নীতিতে স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক বিষয়ে সরকারের ভূমিকাকে ছেঁটে ফেলে তাকে তুলে দেওয়া হয়েছে বেসরকারি বিমা কোম্পানিগুলির হাতে। আর নিজেদের এই অপরাধ লুকোতে তাঁরা চীনকে শত্রু খাড়া করে জনতার রোষ থেকে রেহাই পেতে চাইছেন। একইসঙ্গে চীনের মেডিক্যাল উপকরণ নিয়ে নিজের দেশের লোকেদের চিকিৎসা করছেন। একদা দোর্দন্ড প্রতাপশালী ইউরোপ ও আমেরিকাকে এমন অবস্থায় দেখে কবির ভাষায় বলতে ইচ্ছে করে , ‘এরে ভিখারি সাজায়ে কী রঙ্গ তুমি করিলে, হাসিতে আকাশ ভরিলে’।

     


    সুত্র:

    ১। Centre for Economic and Social Rights এর-ওয়েবসাইট।

    ২। PUBLIC HEALTH IN EUROPE DURING THE AUSTERITY YEARS - A RESEARCH REPORT FROM ILC-UK Ben Franklin, Dean Hochlaf and George Holley-Moore, November 2017.

    ৩। US. Health in International Perspective: Shorter Lives, Poorer Health.



    [শ্রমজীবী ভাষা-র এপ্রিল মাসের ডিজিটাল সংখ্যাটি পিডিএফ আকারে প্রকাশিত হয়েছে। সেখান থেকে বিভিন্ন লেখা ধীরে ধীরে এই ব্লগে প্রকাশিত হবে।]
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ১১ মে ২০২০ | ১৩৯৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • sm | 162.158.89.96 | ১১ মে ২০২০ ১৪:৩৭93185
  • চীনের দুটি বড় ভুল।
    ১) ডিসেম্বর থেকে অজানা রোগ শুরু হয়।জনুয়ারিয়ে প্রথম থেকে জানতে পারে,এই রোগ কিভাবে ছড়াচ্ছে।কিন্তু উহান থেকে লোকজন বিভিন্ন দেশে ভ্রমন করেছে।
    ২)হু কে ইনফ্লুয়েন্স করার চেষ্টা।অর্থাৎ অল দ্যাট গ্লিটার্স আর নট গোল্ড।।
    https://www.sangbadpratidin.in/world/who-denies-report-of-xi-jinping-dialed-tedros-to-delay-global-warning/
  • | ১২ মে ২০২০ ২২:৩০93241
  • বেশ ডিটেল ভাল লেখা
  • d | 162.158.207.135 | ১২ মে ২০২০ ২৩:৩১93245
  • পড়ে উপকৃত হলাম।

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে মতামত দিন