এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  অপর বাংলা

  • গ্রামের মহিলাদের কোনও বন্ধু নেই - প্রথম কিস্তি

    কাবেরী গায়েন লেখকের গ্রাহক হোন
    অপর বাংলা | ০৮ মার্চ ২০১১ | ১১৩৪ বার পঠিত
  • The interests of rulers require that their subjects should be poor in spirit, and that should be no strong bond of friendship or society among them, which love, above all other motives, is likely to inspire, as our Athenian tyrants learned by experience; for the love of Aristogeiton and the consistency of Harmodius had a strength which undid their power.” (Plato, Symposium)

    মেয়েতে-মেয়েতে নিখাদ বন্ধুত্বের বর্ণনা বাংলা সাহিত্যে ঠিক কী পরিমাণে আছে, মনে করতে পারি না। অগত্যা ঘুরে-ফিরে আবারও সেই রবীন্দ্রনাথে এসে থামে আমার মধ্যবিত্ত নাগরিক মন-""ওলো সই, আমারও ইচ্ছে করে তোদের মতো মনের কথা কই।'' ছড়িয়ে দিয়ে পা দুখানি এই সইরা কোণে বসে কানাকানি করেছিলেন বা কভু হেসে কভু কেঁদে মনের কথা বলেছিলেন যদিবা জানা যায় রবীন্দ্রনাথের জবানিতে কিন্তু তারা কি সই ছিলেন, না কি নেহাতই আত্মীয়-বান্ধব ছিলেন সেই তথ্য উদ্ধার আজ বুঝি আর সম্ভব না। আর সম্ভব হলেই বা কী, সে তো জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির কথা। নজরুলের গানে ভালো করে বিনোদ বেণী বেঁধে দেবার আকুতি আছে সই-এর কাছে যেন প্রেমিক তার বিনুনীর ফাঁদে বাঁধা থাকে। এর বাইরে কিছু সই সম্পর্ক আমরা পাই বই কি, যেমন "চোখের বালি', "গঙ্গা জল', কিন্তু একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে এই সম্পর্ক শুরু হয়েছে বিয়ে সূত্রে পাওয়া নতুন পরিচয়কে কেন্দ্র করেই। আর সম্পর্কের নামকরণগুলোও সার্থক বটে, বলিহারি বাংলা ভাষার রস, সইয়ে সইয়ে সম্পর্ক হলো "চোখের বালি' আর জায়া ও পতি হলো "দম্পতি', দন্দ্ব সমাস। বাংলার রূপকথায় বেকার রাজপুত্র-মন্ত্রীপুত্র-কোটালপুত্রের অক্ষয় বন্ধুত্ব, তাঁরা বনে যান, রাজকন্যা আর অর্ধেক রাজত্ব শিকার করে চারদিক উজল করতে করতে ঘরে ফেরেন, জয় তাঁদের বন্ধুত্বের জয়। রাজকন্যাদের কোন বন্ধু নেই কেন দাসী ছাড়া ? আশ্চর্য, কারোর কোন সই নেই, তাঁরা সদাই সচেষ্ট রাজকন্যা বা মহারানী রাজপুত্র-মহারাজের মন জোগাতে আর বেচারী রাক্ষসী তো রাজপুত্রদের সাথে যুদ্ধে যুদ্ধেই নি:স্ব, ক্লান্ত কিংবা মৃত। সই পাতানোর সময় কোথায় তাদের ? গল্প-উপন্যাসেও পুরুষে-পুরুষে বন্ধুত্ব বিস্তর, শ্রীকান্ত-ইন্দ্রনাথ, মহিম-সুরেশ, মহেন্দ্র-বিহারীলাল, নিখিলেশ-সন্দ্বীপ, যোগেন্দ্র-রমেশ, গোরা-বিনয়, শচীন-শ্রীবিলাস...কিন্তু সেই অর্থে মেয়েদের মধ্যকার বন্ধুত্ব নিয়ে তেমন কালোত্তীর্ণ কাহিনী কি আছে আসলে? এক বঙ্কিমের Rajmohon’s Wife-এর রাজমোহনের স্ত্রী তথা মাতঙ্গিনীর সাথে কুলিন মেয়ে কনকের বন্ধুত্বকে বাদ দিলে সংশপ্তক-এ রাবেয়া আর রানুর মধ্যে বন্ধুত্বের উল্লেখ পাওয়া যায় কিন্তু গোটা উপন্যাসে ক'বারই বা দেখা হয়েছে তাদের ? তাও তো সে যোগাযোগের মধ্যস্থতাকারী বালক মালু। এরকম বিচ্ছিন্ন এবং আরোপিত এক-আধটা কাহিনী বাদ দিলে মেয়েদের সত্যিকারের বন্ধুত্ব নিয়ে সাহিত্য কোথায় ? তাহলে কি মেয়েতে মেয়েতে বন্ধুত্ব কখনো ছিলোই না, না কি মেয়েরা বিয়ে সূত্রে পাওয়া সম্পর্ক কাঠামোতে এতই নিয়তি-নির্দিষ্টভাবে আবদ্ধ যে বন্ধুত্বের মতো অকেজো সম্পর্কের ভারে তাদের আর পীড়িত করতে চাননি কেউ। যে বয়সে দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদারের রাখাল আর রাজপুত্র পরস্পরের বন্ধুত্বটানে বটবৃক্ষের তলে সমবেত হন, রাখালপুত্র বাঁশি বাজান আর রাজপুত্র শোনেন সে বয়সে রাখালকন্যা হয়তো কয়েক সন্তানের মা হয়ে শাকচুন্নি-গেছোপেত্নীর রূপ ধরে প্রায় শাশুড়ি হবার পথে, আর রাজকন্যা শত্রুপুরীতে ঘুমে অচেতন রাজপুত্রের দাক্ষিণ্যে উদ্ধার হবার আকাঙ্খায় অথবা রাজমহিষী হয়ে দুয়োরানী, ন'রানী, কনে রানীর সাথে সন্তান কামনায় সন্ন্যাসীর দেয়া শেকড় বাঁটছেন। শেকড় বাঁটা ভাগে পেলে ফুটফুটে রাজপুত্রের (রাজকন্যার নয়) মা হচ্ছেন, আর ভাগে না পেলে শিল-নোড়া ধোয়া জল খেয়ে বানর বা পেঁচা জন্ম দিয়ে রাজপ্রহরীর গলা ধাক্কায় ছিটকে পড়ছেন ছাইগাদার ওপারে। এইসব দিন পালটেছে নিশ্চয়ই। অন্তত শহরে। মেয়েরা এখন পড়ছেন, চাকরি করছেন, বন্ধুত্ব তাদের শুধু মেয়েদের সাথেই নয়, ধারণা করি ছেলেদের সাথেও। সেসব বন্ধুত্ব বিয়ের আগ পর্যন্তই বুঝি, খুব কম মেয়েই হয়তো সে সম্পর্ক বিয়ে পরবর্তী জীবনেও টেনে নিতে পারেন। "হয়তো' বলছি সতর্কতা থেকে, যেহেতু কোন গবেষণা এ'বিষয়ে এখনো চোখে পড়েনি। তবুও জীবনের একটি পর্যায়ে তারা বন্ধুত্ব তো পাচ্ছেন ! কিন্তু এই পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে কি আমাদের গ্রামেও ? কত "উন্নয়ন কর্মকাণ্ড' গ্রামকে ঘিরে, কতশত উন্নয়ন সংস্থার বিস্তার, নারীর ক্ষমতায়ন আর ক্ষুদ্রঋণ, দশক ওয়ারী উন্নয়ন সূচক...পরিবর্তন হয়েছে কিছুটা নিশ্চয়ই গ্রামের মহিলাদের, অন্তত ভাবতে ইচ্ছে করে। এই পরিবর্তনের পটভূমিতে কেমন সম্পর্ক কাঠামোতে বাঁধা আমাদের গ্রামের মেয়েরা ? কিংবা গ্রামে কি কোন মহিলা বাস করেন মা, ছেলের বউ, ননদ, জা, শাশুড়ি এসব সম্পর্কের বাইরে ? আছে কি কোন বিয়ে-নিরপেক্ষ সম্পর্ক ? বালিকার খোলস ছাড়তে না ছাড়তেই তো বিয়ে আর ভিনগাঁয়ে পারাপার, তারপর কেমন তাদের সম্পর্ক কাঠামো, তারই খানিকটা আভাস পাওয়ার একটি প্রয়াস হিসেবে দেখা যেতে পারে এই কাজটিকে। বলে নেয়া ভালো কেবল এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই গবেষণাটি করা হয়নি বরং Modelling the Influence of Communications on Fertility Behaviour of Women in Rural Bangladesh শীর্ষক আমার পিএইচডি গবেষণার তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে গ্রামের মহিলাদের সম্পর্ক কাঠামোর মুখোমুখি হই, উন্মোচিত হয় এক "জানা' জগতের "অজানা' কাহিনী, গ্রামের মহিলাদের কোন বন্ধু নেই।

    গবেষণা পদ্ধতি
    ..........

    বাংলাদেশের ছয়টি বিভাগ থেকে ছয়টি গ্রাম বেছে নেয়া হয়েছে। গ্রামগুলো হলো : চৈতন্যপুর (রাজশাহী বিভাগ), বলাইনগর (ঢাকা বিভাগ), ব্রাহ্মণশাসন (সিলেট বিভাগ), জোবরা (চট্টগ্রাম বিভাগ), রায়ের কাঠি (বরিশাল বিভাগ), এবং পয়গ্রাম (খুলনা বিভাগ)। একটি গ্রাম বাড়তি নেয়া হয়েছে, যে গ্রামের বেশীর ভাগ মানুষ হিন্দু ধর্মাবলম্বী, ধর্মভিত্তিক সাংস্কৃতিক পার্থক্য কিছু আছে কী না দেখার জন্য। গ্রামটি হলো দিনাজপুর জেলার মহুগাঁও। এছাড়াও বন্ধু ও সহকর্মী শাতিল সিরাজ (সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়) জয়পুর হাট জেলার আক্কেলপুর মিউনিসিপ্যালিটির পুরাতন বাজার মহল্লা থেকে পাইলট সার্ভে করে দিয়েছিলেন ৩০ জন মহিলার সাক্ষাতকার নিয়ে।

    গ্রামের মহিলা (মেয়েরা যে কত বয়সে মহিলা হন আসলে!), যাঁদের বয়স ১৪ থেকে ৪৯ বছরের মধ্যে, এইসব মহিলাদের মুখোমুখি সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে। গ্রামের প্রতিটি বাড়ি থেকে অন্তত একজন মহিলার সাথে কথা বলা হয়েছে। ফলে যোগাযোগ নেটওয়ার্কের ম্যাট্রিক্স যখন তৈরী করা হয়েছে, তখন প্রতিটি বাড়ির প্রতিনিধিত্বকারী অন্তত একজন সেখানে রয়েছেন।

    যদিও মূল গবেষণায় রীতিমতো ছকে বাধা প্রশ্নপত্র ধরে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে, তবে এই লেখায় গ্রামে থেকে গ্রামের মহিলাদের সাথে আলাপ, পর্যবেক্ষণ এবং মাঠ জার্ণালের টোকাও (field journal accounts) তথ্যসূত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, বিশেষ করে পাওয়া তথ্যের অর্থ (meaning) নিরূপণের ক্ষেত্রে এবং ফলাফল ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে আলাপ এবং টোকার বিস্তর সাহায্য নেয়া হয়েছে গুণগত ব্যাখ্যার জন্য।

    আগস্ট ২০০২ থেকে জানুয়ারী ২০০৩ পর্যন্ত মাঠে কাজ করে মোট ৭২৪ জন মহিলার আন্ত:ব্যক্তিক যোগাযোগ নেটওয়ার্কের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। মূল গবেষণার প্রয়োজনে যদিও বিবাহিত মহিলাদেরই সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে নির্দিষ্টভাবে, তবে তথ্য সংগ্রহের শুরুতেই প্রথম গ্রাম অর্থাৎ রাজশাহী বিভাগের চাঁপাই নববাগঞ্জ জেলার ধাইনগর ইউনিয়নের চৈতন্যপুর গ্রামে কাজ করতে গিয়ে কয়েক বাড়ির তথ্য সংগ্রহ করতেই কৌতূহলী হয়ে পড়ি অবিবাহিত মেয়েদের অবস্থাটাও যাচাই করতে। শুরু হয় ডায়েরীতে নোট নেওয়ার পালা। ১৪ থেকে ৪৯ বৎসর বয়সী অবিবাহিত মেয়ের সংখ্যা খুব বেশী নেই। সাত গ্রাম মিলিয়ে সাকুল্যে ৩৭ জনকে জিজ্ঞেস করা সম্ভব হয়েছে।

    এই কাজে আন্ত:ব্যক্তিক সম্পর্কের বাইরে যে-কোন সামাজিক গবেষণার মতই কিছু ব্যক্তিগত প্রাথমিক তথ্য এবং আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও দৈনন্দিন খবরাখবর আদান-প্রদানের তথ্যও বিশ্লেষণ করা হয়েছে এসব মহিলার যোগাযোগ আবহ সম্পর্কে (Communication Environment) খানিকটা ধারণা নেয়ার জন্য।

    তথ্য সংগ্রহের কাজে আমাকে সাহায্য করেছেন বিভিন্ন পেশার মোট ৪৩ জন, ৬ থেকে ৭ জন প্রতি এলাকায়। রাজশাহী বিভাগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ বিভাগের শিক্ষক শাতিল সিরাজ শুভ আর ৬ জন ছাত্র তথ্য সংগ্রহকারী দলে কাজ করেছেন। পরে চৈতন্যপুর গ্রামের পরিবার পরিকল্পনার মাঠকর্মী আনোয়ারা বেগম এবং গ্রাম্য দাই রাহেলা বেগম যুক্ত হয়ে পড়েন এই দলে। এছাড়াও টীমের সদস্য গণযোগোযোগ বিভাগের ছাত্র বেনাউল ইসলামের বাড়িতে থেকে এই গ্রামে কাজ করা হয়েছে ফলে বেনাউলের বোন, স্থানীয় কলেজছাত্রী নুরুন্নাহার কেয়া জুটে যান এই দলে। সিলেট বিভাগে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীরা তথ্য সংগ্রহ করেছেন। চট্টগ্রাম বিভাগের টীমে ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীরা। বরিশাল বিভাগে কাজ করেছেন পিরোজপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসারের নেতৃত্বে পিরোজপুর সরকারী কলেজের দু'জন ছাত্রী, একজন শিক্ষক এবং ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, স্থানীয় এনজিও "সকলের জন্য করি'র কয়েকেজন কর্মকর্তা, সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচীর একজন সদস্য, একজন গৃহবধূ, এবং প্রাক্তন জমিদার ও বর্তমানে সমাজকর্মী গৌরাঙ্গ রায় চৌধুরী। খুলনা বিভাগের দলে ছিলেন মূলত পয়গ্রামের ফুলতলা কলেজের বাংলার প্রভাষক, পত্রিকা হকার, প্রাক্তন ভধি,?বাসিন্দারা ফুলতলা কলেজের দু'জন ছাত্র, সরকারী বি.এল. কলেজের অনার্স ছাত্রী। ঢাকা নাগরপুর?বিভাগের টীমে কাজ করেছেন একেবারেই ভিন্ন ধরনের পেশার মানুষেরা ইউনিয়ন পরিষদের একজন সদস্য, নাগরপুর আলিয়া মাদ্রাসার একজন শিক্ষক, দুঞ্চজন গৃহবধূ এবং একজন মৌমাছি পালক। মহুগ্রামে তথ্য সংগ্রহ করেছেন সৌমেন দাস আর রওনক ফেরদৌস স্থানীয় মানুষের সাহায্য নিয়ে, তাঁরা ইতিমধ্যেই হাত পাকিয়েছেন চৈতন্যপুরে কাজ করে।

    প্রথমত যেহেতু প্রত্যন্ত গ্রামে থাকার ভালো কোন ব্যবস্থা নেই এবং দ্বিতীয়ত যে গ্রামে কাজ করা হবে সেই গ্রামের কোন প্রতিপত্তিশালী বা সম্মানিত কারো বাড়িতে থেকে তাঁদের মাধ্যমে পরিচিত না হলে গ্রামে ঢুকে গ্রামের মহিলাদের সাথে কথা বলা যাবে না, এই দুই বিবেচনা থেকে যে-সব এলাকায় পরিচিতজন আছেন তাঁদের আতিথেয়তার উপর নির্ভর করতে হয়েছে এবং বাংলাদেশে এখনো "অতিথি নারায়ণ সেবা' চলে বলেই কোন অসুবিধা কোথাও হয়নি। রাজশাহীর চাঁপাই নবাবগঞ্জে বেনাউলদের বাড়ি অর্থৎ মেম্বার বাড়ি, বরিশালে পিরোজপুরের জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার কুলদানন্দ রায়ের সরকারি বাসভবন, চট্টগ্রামে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক বন্ধু আতিকুর রহমানের ফ্ল্যাট, সিলেটে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক অবন্তী হারুনের মেসভবন, খুলনায় বন্ধু আনন্দময়ী মজুমদারের আত্মীয় বাগেরহাট পি.সি. কলেজের দুই অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মুক্তি মজুমদার ও মোহাম্মদ কায়কোবাদ-এর পয়গ্রামের বাড়ি আরণ্যক, আর ঢাকায় টাঙ্গাইল জেলার গয়াহাটা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল হোসেন চেয়ারম্যানবাড়ি ছিলো আমার থাকার আর কাজ চালানোর অফিস। এঁরা শুধু আমার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাই করেননি বরং পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন স্থানীয় মহিলাদের সাথে, জুটিয়ে দিয়েছেন তথ্য সংগ্রহকারী দলের সদস্যদের। কাজেই যাঁরা তথ্য সংগ্রহ করেছেন আর যাঁরা সবকিছুর বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন, তাঁদের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। বরং বলে নেয়া ভালো এটি একটি যৌথ কাজ এবং এঁরা প্রত্যেকেই আমার সহলেখক।

    কিছু প্রাথমিক তথ্য [যোগাযোগ আবহ]
    .........................

    মূল গবেষণায় যে মহিলাদের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে তাঁদের গড় বয়স ২৮ বছরের একটু বেশী। গড় বিয়ের বয়স সাড়ে পনের বছর, প্রথম বাচ্চার জন্ম দিয়েছেন গড়ে সাড়ে সতের বছর বয়সে আর তাঁদের স্বামীরা গড়ে তাদের চেয়ে প্রায় দশ বছরের বড়, সাড়ে ৩৭ বছর। এসব মহিলারা এইসব গ্রামে বসবাস করছেন প্রায় সাড়ে বারো বছর ধরে। একেবারে পাকা হিসেব, সাড়ে পনের বছরে বিয়ে + সাড়ে বারো বছর ধরে স্বামীর গ্রামে বসবাস, কাজেই গড় বয়স ২৮ বৎসরের একটু বেশী। এসব মহিলাদের ৪২ শতাংশ কখনো স্কুলে যাননি, যাঁরা গিয়েছেন তাঁদের ১৫.৮ শতাংশ প্রাইমারী পার করেছেন, ২.৪ শতাংশ কলেজে গেছেন আর মাত্র ১.৪ শতাংশ ডিগ্রি পর্যায়ে পে?ঁছুতে পেরেছেন। যদিও ৫৮ শতাংশ মহিলা স্কুলে গিয়েছেন জীবনের কোন একটা সময়ে কিন্তু শতকরা ৪৯ জন বাংলায় লেখা কোন চিঠি পড়তে বা লিখতে পারেন না। তাঁদের স্বামীদের বিদ্যা-বুদ্ধির দৌড়ও তেমন চমকপ্রদ নয়। গড়ে ৩২.২ জন কখনোই কোন স্কুলে যাননি অর্থাৎ স্কুলে যাওয়ার ক্ষেত্রে স্বামীরা স্ত্রীদের চেয়ে মাত্র ৯.৪ শতাংশ বেশী। এক দুর্মুখ তথ্য সংগ্রহকারী ফোড়ন কাটলেন যে মেয়েরা স্কুলে গেলে গম পায় সেজন্যই নাকি প্রাইমারিতে ছেলে-মেয়ের ব্যবধান তত বেশী নয়। কথাটা হয়তো সত্যি, প্রাইমারীর পরে মেয়েদের আর দেখা পাওয়া যায় না, বাড়তে থাকে ছেলে-মেয়ের স্কুল উপস্থিতির বৈষম্য। ৯২.৭ শতাংশ মহিলা নিজেদেরকে গৃহবধূ বলে দাবি করেছেন, ২.৮ শতাংশ কুটির শিল্প বা কারখানায় কাজ করেন। ২.৩ শতাংশ চাকুরী করছেন, ০.৭ শতাংশ কৃষিকাজে নিয়োজিত আর ১.৫ জন নিয়োজিত কাঁথা সেলাই, মাদুর তৈরী, তালপাতার হাতপাখা বানানো, ধনী লোকের বাড়িতে ঝি-গিরি, বা রাস্তা নির্মাণ কাজে দিনমজুরিতে। এঁদের স্বামীদের পেশা মূলত কৃষিকাজ, ৩৩.৮ শতাংশ, বেশীরভাগই অন্যের জমিতে দিনমজুরি করেন বা বর্গা খাটেন। এছাড়াও শতকরা ২৪.৪ জন ছোটখাটো ব্যবসা, ১৩ জন ড্রাইভিং, ১০.২ জন চাকুরী আর ১০.১ জন দিনমজুরের কাজ করেন। শতকরা ৪০ জন মহিলা এনজিও-র ক্ষুদ্র ঝণ প্রকল্পে জড়িত। যদিও এসব মহিলারা নানাধরনের কাজের মধ্য দিয়ে পরিবারের আয় বাড়াচ্ছেন কিন্তু তাঁরা নিজেরা মনে করেন না যে বাড়ির আয়ে তাঁদের কোন অংশভাগ আছে। এই মহিলাদের দৈনন্দিন খবরাখবর জানার মাধ্যম হলো প্রথমত তাঁদের স্বামীরা যাঁরা হাটে-বাজারে, অফিসে-মাঠে যান, তারপর ""মাইনষের মুহে মুহে''। ৬৪ শতাংশ মহিলা জানিয়েছেন তাঁদের একাকী চলাচলের স্বাধীনতা নেই, যদিও মহুগাঁও-এর (হিন্দু গ্রাম) অবস্থা একটু ভিন্ন। শতকরা ৮৬.৪ জন মহিলা দাবী করেছেন যে তাঁরা নিজেরাই চলাচল করতে পারেন। শতকরা ৫৩ জন মহিলা জানিয়েছেন এমনকি ঘর-গেরস্থলির কাজ বা কী রান্না করবেন বা ছেলেমেয়েকে ভালোমন্দ কিছু কিনে দেবেন কী দেবেন না এ-জাতীয় কোন বিষয়েই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তাঁদের নেই। সবধরনের সিদ্ধান্ত নেন প্রথমত তাঁদের স্বামীরা, তারপর শাশুড়ি, শ্বশুর বা শ্বশুর বাড়ির অন্যান্য আত্মীয়স্বজন। গড়ে প্রত্যেকের বাচ্চা রয়েছে ২.৬৪ জন এবং প্রত্যেকেরই রয়েছে আরো ছেলের আকাঙ্খা, মেয়ের তুলনায় ছেলের আকাঙ্খা প্রায় তিনগুণ বেশি। এই আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশে, কিংবা বলা ভালো এই যোগাযোগ আবহে মহিলাদের আন্ত:ব্যক্তিক যোগাযোগ কাঠামোর সুলুক-সন্ধান করা হয়েছে।

    প্রশ্ন: পাঁচজন বন্ধুর নাম বলুন

    প্রত্যেক মহিলাকে বলা হয়েছিল পাঁচজন মানুষের নাম বলতে যাঁদের সাথে তাঁরা নিয়মিত সুখ-দু:খের কথা (পেটের কথা) বলেন, যাঁদের মতামত তাঁদের কাছে গুরুত্বপুর্ণ এবং সবচেয়ে বড় কথা যাঁদেরকে তাঁরা বন্ধু/সই মনে করেন। তাঁরা পুরুষ বা মহিলা যে কেউ-ই হতে পারেন।

    প্রত্যেক বন্ধুর জন্য আরো যে সহযোগী প্রশ্নগুলো করা হয়েছিলো সেগুলো হচ্ছে :

    ১. সম্পর্কের ধরণ : বন্ধু ? সহকর্মী ? আত্মীয় ? মুরুব্বি ? অন্যান্য ?

    ২. কতদিন ধরে চেনেন : ৩ মাসের কম ? ৬ মাস -১ বছর ? ১-২ বছর ? ৩-৫ বছর ? ৫ বছরের বেশী ? অন্যান্য ?

    ৩. কত ঘন ঘন দেখা হয় : প্রত্যেকদিন ? সপ্তাহে অন্তত একবার ? মাসে অন্তত একবার ? অন্যান্য ?

    ৪. যোগাযোগের মাধ্যম : মুখোমুখি ? চিঠি ? টেলিফোন ? অন্যান্য ?

    ৫. কোথায় থাকেন এই বন্ধু : একই বাড়ি ? একই পাড়া ? একই গ্রাম ? একই শহর ? নিকটবর্তী গ্রাম/শহর ? অন্যান্য ?

    ৬. দেখা করার জায়গা : কাজের স্থান ? একে অপরের বাড়ি যাই ? কোন সামাজিক বা সাংস্কৃতিক সংগঠন ? বাড়ি ? অন্য কোন জায়গা ?

    ৭. আপনার দৈনন্দিন সমস্যায় তথ্য পরামর্শের জন্য কি এর কাছে যান ?

    কখনোই না ? মাঝেমধ্যে ? প্রায়ই ? সবসময় ?

    ৮. বিভিন্ন ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে কি এই ব্যক্তির কোন প্রভাব থাকে ?

    কখনোই না ? মাঝেমধ্যে ? প্রায়ই ? সবসময় ?

    চৈতন্যপুর : "কোন সই নাই কা'
    .......................

    চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলার ধাইনগর ইউনিয়নের চৈতন্যপুর গ্রাম। কৃষিই মুল জীবিকা। দুই ধরনের মানুষের বসবাস এই গ্রামে। এক যাঁরা প্রচুর জমির মালিক, টাকা খাটান আম আর আখের চাষে। এঁদের সংখ্যা কম। বাকীরা হলেন যাঁরা কামলা খাটেন এইসব আম আর আখের ক্ষেতে। রয়েছেন কিছু স্কুল শিক্ষক, ছোট দোকানদার, চাকুরে। মাদ্রাসা আর মসজিদ রয়েছে বেশ জোরেসোরে। কিছু এনজিও কাজকর্মও রয়েছে। মহানন্দা নদীর যে-পাড়ে চাঁপাই নবাবগঞ্জ শহর, তার ঠিক অন্য পাড়ে এই গ্রাম। ছোট লঞ্চ বা বড় নৌকায় চাঁপাই নবাবগঞ্জের সাথে এই গ্রামের যোগাযোগ।

    চৈতন্যপুরে প্রথম যে বাড়িটায় আমরা ঢুকেছি সেই বাড়ির গৃহকত্রী (৩৮) জানালেন সাফ কথা,

    কোন সই নাই কা। বাড়ির বউ-ছেল্যার আবার সই থাকবে ক্যানরে ব্যাটা ? আমরা ওই রকম মাইয়্যা-ছেল্যা না। আমরা স্বামীর সাথে কথা ব্যুলি, তার বাদে শাউড়ি আছে, জাল আছে। কাম কুর্যাই দিশা নাই আবার প্যাটের কথা, না না বেটি আমরা তেমুন মাইয়্যা-ছেল্যা না। আমাগের ইজ্জত আছে।

    ঠিকই, সবারই ইজ্জত আছে এই গ্রামে। মহানন্দা নদীর পাড়ে এই অপূর্ব সুন্দর গ্রাম, কেউ এমনকি নদীতে জল আনতে যাওয়ার কথাও স্বীকার করতে চান না।

    আল্লায় চাহে তো আমাদের বাড়ির পারাই টিপ কল আছে। নদীত যাত্যে হবে ক্যান্‌ ? আমাদের বিটি ছ্যালারা ঘোরাঘুরি কেহই ক্যরে না। স্বামী পছন্দ করে না ব্যাট্যা।

    এই গ্রামেই হিন্দুপাড়া হলো কামারপাড়া-অবশ্য বর্ধিষ্‌ণু কাজিবাড়ির লোকেরা দাবি করছেন পাড়ার নাম কাজিপাড়া, বেশ চাপা কলহও আছে এই নিয়ে। বেনাউলের বোন কেয়া কাজি বাড়িতে বসে জোর দিয়ে বললেন এটা কামারপাড়া আর কাজিবাড়ির বউ জোর দিয়ে জানালেন এটা কাজিপাড়া, নতুন সাইনবোর্ডও টাঙানো হয়ে গেছে। কামারপাড়ার অবিবাহিত মেয়ে, কলেজ ছাত্রী রমা (১৭) [প্রকৃত নাম নয়] জানালেন কোন সই নাই তার। কলেজে যান মাটির দিকে মুখ করে আবার ফিরে আসেন নতমুখে।

    মা রে, মায়েট্যো যতক্ষণ বাহিরে থাকে কাটা হয়্যা থাকি রে মা। একটা বিয়া-থা দিতে পারত্যুক যুদি ! ঘরের বাহির হত্যে দেই না কো মা... রমার মা'র কুন্ঠিত উত্তর।

    কলেজেও যায় রমা সপ্তাহে একবারের বেশী না। কেয়া-রও প্রায় একই অবস্থা। সবাই বিয়ের প্রহর গুনছে। কলেজের বাইরে রমা কাজ করে মা-কাকী-ঠাকুরমাঞ্চর সাথে, বাবা-কাকাকে জোগালও দেয়।

    কাজি বাড়ির তিন বউই জানালেন তাদের কোন "সই নাই ক্যা'। তাহলে কি এই গ্রামের বউরা-মেয়েরা কোন কথাই বলেন না কারো সাথে ? অবশ্যই বলেন। স্বামীর সাথে বলেন, শাশুড়ির সাথে বলেন, বলেন জা-ননদের সাথে। এক-এক বাড়ি-ভিত্তিক এক-এক পাড়া। আত্মীয়-স্বজনরাই আছেন চারপাশে। যাঁরা বিবাহিত বছরে এক-আধবার যান বাপের বাড়ি, "ব্যুনের সাথেই দেখা হয় না', ছেলেবেলার সই-এর সাথে দেখা হওয়া তো অনেক দূরের কথা। "সইয়ের মুখ মনে নাই' জানান আতোয়ারা বেগম। এই গ্রামের ৮৪ জন মহিলা যাদের কথা বলেছেন পেটের কথা বলার লোক হিসেবে তাদের ৭৮% জন হলেন জা, ১১% জন শাশুড়ি বা শাশুড়ি পদবাচ্য, বাকিরা ননদ বা বাড়ির উপর থাকা অন্য বউ-ঝি, কোন-না-কোন আত্মীয়। এঁদের সাথে দেখা হয় প্রতিদিন, বাড়িতেই দেখা হয়, মুখোমুখি দেখা হয়, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে কথা হয়, বিভিন্ন বিপদে-আপদে পরামর্শও চান কিন্তু এক শাশুড়ি ছাড়া এইসব জা-দের খুব প্রভাব আছে কোন বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে তেমন দাবি কেউই করেন না। সবার উপরে স্বামী।

    মহানন্দা নদীর এক পাড়ে এই শ্বশুর বাড়ি, বাপের বাড়িতে যেতে হলে নদী পার হতে হয় প্রায় সবাইকেই। তবুও তাঁরা সকাল-সন্ধ্যায় ছোট লঞ্চের পারাপার দেখেন, এই পারাপার দেখার জন্য তাঁদের এমনকি নদী পর্যন্ত যেতে হয় না, বাড়ি থেকেই দেখা যায়। তাঁদের স্বামীরা ঘরে ফেরেন মাগরেবের আজানের পর, মাছ নিয়ে, ফল নিয়ে, শাকসব্জি নিয়ে, চিপ্সের প্যাকেট আর কোকাকোলার বোতল নিয়ে, আরেকপারের খবর নিয়ে। আর তাঁরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন:

    ""আপা, আইজ আর কথা বুলব না, সাইনঝ্যা হয়্যা গিলচে, কারুর সাথে কথা ব্যুলা পছন্দ করে না ...''

    ""কে? কে আইস্যাছে ঘরে?'' স্বামীদের জোরালো আওয়াজ, আমাদের অগত্যা ফিরে আসতেই হয়।

    আর তাই শুক্রবার কোন ভালো দিন নয় এসব মহিলাদের সাথে কথা বলার জন্য, পুরুষরা সব বাড়িতে থাকেন জুম্মার নামাজের পর। তবুও এই গ্রামেরই পরিবার পরিকল্পনা মাঠকর্মী আকতারা খাতুন, শরীরে-মাথায় সৌদি চাদর জড়ানো আকতারা খাতুন, জানান তার বন্ধু আছে স্বামীর বাইরেও। তিনি তিনজন পুরুষ মানুষের কথা বলেন, এরা সবাই চাকুরি করেন তার সাথে। জানালেন তাঁর স্বামীর মন-মানসিকতা খুবই উঁচু দরের, সে কিছু মনে করে না। পাড়া-পড়শির খে?ঁটাকে আমলে আনেন না তিনি। জানালেন পাঁচ-দশ বছর আগেও গ্রামে পর্দার এত "কড়াক্কড়' ছিলো না, "বউ-বিটিরা বাহির হত্যে পারত্যুক', এই পরিবর্তন কেনো হচ্ছে তিনি নিজেও ঠিক জানেন না। এনজিও কার্যক্রম আছে গ্রামে কিন্তু ক্ষুদ্রঝণ বাড়ি বাড়ি এসে দিয়ে যাওয়া হয়, নিয়েও যাওয়া হয় বাড়ি থেকে কাজেই বউ-ঝিদের "ইজ্জত' নষ্ট হয় না অন্য পাড়ায় গিয়ে।

    রায়ের কাঠী: "মুই তো মুরুব্বি, মোরডে কেউ হাস-তামসাও করে না'
    .............................................

    পিরোজপুর জেলা সদর থেকে ৮ কিলোমিটারের মতো দূরে রায়ের কাঠি গ্রাম। গ্রামের আয় মূলত কৃষি। তবে কিছু পারিবারিক ব্যবসার চলও রয়েছে, যেমন কুমারের কাজ, তাঁতের কাজ আর মাছ-ধরা কিংবা জাল-বোনা। গ্রামটা সমৃদ্ধশালীই বলা চলে, বিশাল জমিদার বাড়ি, ফসলের মাঠ, স্কুল, আবার গ্রামের অবস্থানও শহরের কান ঘেঁষে। তবে এই গ্রামের দুটো পরিষ্কার অংশ, একদিকে পুরানো গ্রাম লাল ইটের প্রাক্তন জমিদার বাড়ি, মাঠ, মন্দির আর এই স্থাপনা ঘিরে গরীব হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বসবাস, অন্যদিকে নতুন বসতি, মসজিদ, মাদ্রাসা, হলুদ-নীলের নক্সাকাটা নতুন দালান-বাড়ি, সম্পদশালী মুসলমান জনগোষ্ঠীর বসবাস। তবে মাঝামাঝি জায়গায় কিছু নতুন ছোটখাটো আয়ের মানুষের ছোটছোট নতুন ঘরও দেখা যায়।

    হিন্দু অংশে কুমার পাড়ার মহিলারা বড় ব্যস্ত। তাঁতি পাড়ায় তেমন একটা কাজ নেই, অভাব। জেলে পাড়ায় মাছ ধরার কাজ ততটা নেই, স্বামীরা দাওয়ায় ঝিমুচ্ছেন কিন্তু মহিলাদের হাত থামে না, জাল বুনে চলেছেন, ওটাই আয়ের পথ।

    মারে, তের বচ্ছইরগ্যা বিয়া হইছে মোর, হেই থেইক্যা জালই বুনি। বাড়ির বাহির বা হমু কহন আর সই-বা পাতামু কহন। সব জালেরা মিলাই তো কাম করি। মোরা মাগো পাড়ার বাহির হই না। মোগো জালেরা (জা) আছে, হাউড়ি আছে, মোগো সই পাতাইনার সোমায়ও নাই।

    আরতি রানীর জাল-বোনা চলতেই থাকে। তবে বড় পূজায় (দুর্গা পূজায়) একবার বাপের বাড়ি প্রায় সবাই-ই যান, নিদেন পক্ষে জমিদার বাড়ি। জমিদার গিন্নি ভালো মানুষ, বিপদে-আপদে সাহায্য করেন, পরামর্শ দেন কিন্তু না, জিহ্বায় কামড় দেন কুমার পাড়ার সবিতা রানী, "উনি গুরুজন, উনার লগে পেডের কথা বলি না।'

    মুসলমান অংশে ঢুকতে সাহায্য করলেন এক মেয়ে, মর্জিনা বেগম, বড়-বাড়ির বোন, বেচারির মনে শান্তি নেই, স্বামী তার নতুন বিয়ে করেছেন অথচ কোলে তার ফুটফুটে ছেলে। ভাইদের বাড়িতে থাকেন, ছেলে কোলে নিয়ে তার মাঠে-ঘাটে চলতে বাধা নেই। তবুও তার কোন সই নেই। এই বাড়ির বউরা বেশ পর্দানশীন। কেউ বাড়ির বাইরে যান না। বাড়ির বড়-বউ বি.এ. পাশ কিন্তু তার কোথাও যাওয়ার "হুকুম নাই'। বেশ কাতর গলায় জানালেন:

    হ, আবার সই ! পুষ্করিণীতেই যাইতে পারি না, গোসলখানায় পানি দিয়া যায়, হেই পানিতে গোসল সারি। ফ্যামিলি প্ল্যানিং-এর মাইয়ারাও এই বাড়িতে ডোকতে পারে না। ... লণ্ডন কি খুব সুন্দার ? ... আর বউরা তো ছোড, মুই তো মুরুব্বি, মোরডে কেউ হাস-তামসাও করে না। ... মোর ছবি তো তোলতে পারবেন না, মোর মাইয়্যার এউক্ক্যা ফডো তোলেন। দোয়া করবেন আপা যেন মোর মাইয়াউগ্য একদিন আমনের মতো অইতে পারে, দ্যাশ-বিদ্যাশ যাইতে পারে।

    এরই মধ্যে শাশুড়ি ঢোকেন, ছবি তোলার আয়োজন দেখে নিজেও বসে যান ফটো সেশনে যদিও দিব্যি দিয়ে দেন ছবি যেন কেউ না দেখে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করেন বিত্তান্ত, কোথায় কোথায় যাওয়া হয়েছে আরো। জমিদার বাড়ির কথা শুনে মুখটা কালো হয়ে যায়। বড় বউ চোখ টিপে দেন যেনো আমার পরিচয় ফাঁস হয়ে না যায়, উঠে পড়ি, শাশুড়ি একটা ঠোঙায় কিছু আমলকি দিয়ে দেন।

    সুলেখা বেগম [প্রকৃত নাম নয়] ট্রেনিংপ্রাপ্ত গ্রাম্য দাই। বয়স ৩৭। বিয়ে করেছেন ৬০ বছরের অবস্থাপন্ন এক লোককে। ঘরে সতীন আছে। সতীনের ছেলের বউরা তার বয়সী। তবে জমিজমা যেহেতু এখনো ভাগ হয়নি আর স্বামী যেহেতু তার "অঞ্চলে বান্ধা' তিনি কারো তোয়াক্কা করেন না এবং হিন্দু-মুসলিম দুই পাড়াতেই তার যাতায়াত কিন্তু ঠিক নিশ্চিত নন তাঁর কোন সই আছে কি না যার সাথে তিনি মনের কথা বলেন।

    প্রাক্তন জমিদার (যাঁরা ২৭ প্রজন্ম এই গ্রামে জমিদারি করেছেন এবং যাঁদের নামে এই গ্রামের নাম রায়ের কাঠি) গৌরাঙ্গ রায়ের স্ত্রী জানালেন তাঁর "বান্ধবী' আছে, একই স্কুলে চাকরী করেন কিন্তু মনের কথা বলার কেউ নেই, এক স্বামী ছাড়া। ভাসুরপুত্রের বউ আছে বাড়িতে কিন্তু সে অনেক ছোট, কর্তব্যকর্মের বাইরে কোন আলাপ নেই।

    এই গ্রামের ৯৮ জন মহিলার সম্পর্ক সূত্রের মধ্যে ৭৬% জা, ১২% শাশুড়ি-শাশুড়ি সম্পর্কিত, ৭.৬% বিধবা ননদ বা সতীন, ৩.২ % গ্রাম্য মুরুব্বি আর এক-আধজন বন্ধু-বান্ধব। ছেলে সন্তানের জন্য স্বামী যেনো অন্য বাড়িতে বিয়ে করে পর না হয়ে যায় শুধু সে-কারণেই এই গ্রামের দুই বোন এখন সতীন। আমেনা বেগম আপন ছোট বোন আরিফা বেগমকে বিয়ে দিয়েছেন স্বামীর সাথে। সুখ-দু:খের কথা তারা বলেন বই কি !

    পয়গ্রাম: "মহিলাগে সই থাকে নিকি, মেয়েগে থাকতি পারে'
    ....................................

    খুলনা জেলার ফুলতলা ইউনিয়নের পয়গ্রাম। আর পাঁচটা গ্রামের মত হতে গিয়েও হতে পারেনি কয়েকজন মানুষের ওই গ্রামে অবস্থানের জন্য। গ্রামে ঢুকতেই প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের পৈতৃক বাড়ি, তাঁর ভাই সমাজকর্মী ইমদাদুল হক আনু থাকেন সে বাড়িতে। তারপরেই রয়েছে পি.সি. কলেজের সাবেক দুই অধ্যাপক মুক্তি মজুমদার আর মোহাম্মদ কায়কোবাদ দম্পতির বাড়ি আরণ্যক। শুরুতে এটি ছিলো দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয়ের ছোট একটা ঘরসহ গাছ-লতায় ঘেরা এক বাগান। অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক বলে পরিচয় দিয়ে আসলে খুব অল্পই বোঝানো যায়। এই বাড়িতে মুক্তি মজুমদার গড়ে তুলেছেন এক নীরব সাংস্কৃতিক আন্দোলন। গ্রামের ছেলেমেয়েরা প্রতিদিন গান শেখে এখানে মুক্তি মজুমদারের কাছে, মহড়া নেয় কঠিন কঠিন সব রবীন্দ্র নাটকের। রীতিমত খাইয়ে-দাইয়ে, কখনোবা সন্দেশের প্রলোভন দিয়ে এ-সব ছেলেমেয়েকে দিয়ে অনুষ্ঠান করাচ্ছেন মুক্তি মজুমদার। যেসব ছেলেমেয়েরা ফুলতলার আঞ্চলিক টান ছাড়া কথা বলতে পারে না, পড়াশুনা শিখে উঠতে পারেনি এখনো তারাই দিব্যি ফাল্গুনী, তাসের দেশ, হ-য-ব-র-ল করছে। এখানে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরা যেমন আছেন তেমনি আছেন পড়াশুনা তেমন-না-জানা মেয়েরাও। কিন্তু তারপরও এসব মেয়েরা কতটুকু বন্ধু আসলে পরস্পরের ? তানিয়া বি.এল. কলেজের ডিগ্রির ছাত্রী বা মুমু সমাজবিজ্ঞানে অনার্স পরীক্ষা দিচ্ছেন তখন। তারা গান-বাজনা করছেন ঠিকই কিন্তু ঠিক নিশ্চিত নন তাদের সেই অর্থে কেউ বন্ধু আছে কী না। কারণ কোন কাজ ছাড়া নাকি তারা ঘর থেকে বের হন না। গানের মহড়াটুকু দিয়েই বাড়ি ফিরে যান। কাজ ছাড়া সময় কাটানোর উপলক্ষ্য তাঁরা পান না।

    বাংলাদেশের অন্য পাঁচটা গ্রামের মতই পাড়ায় পাড়ায় বিভক্ত এই গ্রাম: পাল পাড়া, ঋষি পাড়া, কুমার পাড়া, নিকেরী পাড়া, বরজীবী পাড়া, শালবন পাড়া, গাজী পাড়া, কাজী পাড়া। কাজী পাড়ায় যে কাজীরা থাকেন তারা সবাই একই পরিবারভুক্ত, খানা যদিও আলাদা। এই পাড়ার সব বউরাই পরস্পরের আত্মীয়, অবশ্যই বৈবাহিক সূত্রে। প্রতিদিন সকালে চোখ খুললেই পরস্পরের দেখা হয়, কাজের কথাও হয়, কিন্তু এরা পরস্পরের জা-ননদ-শাশুড়ি, কেমন যেনো এক চাপা টেনশন, ঠিক বন্ধু নয়। একই গল্প পাড়ায় পাড়ায়। পাল পাড়ার শোভা রানী পাল, যিনি তথ্য সংগ্রহকারী দলেরও একজন, একদিন বলে উঠলেন,

    ওদ্দি, এই প্রশ্নডা বাদ দিলি ভালো হতো না ? মহিলাগে সই থাহে নিকি, মেয়েগে থাকতি পারে।

    বিয়ে হয়ে গেলেই মেয়েরা মহিলা হয়ে যান, সই থাকাটা আর তখন ভালো কোন কাজ না। বি.এ.বি.টি.-পাশ এক ভদ্রমহিলা আসমা খাতুন, স্কুলে পড়ান, আমাদের কাজে খুবই সাহায্য করেছেন, বললেন,

    বিয়ার পর নিজির বুনগির সাথেই ভালো যোগাযোগ নাই তো সই !

    এই গ্রামে মোট ১৯৭ জন মহিলার সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে। তাঁরা যাদের সাথে নিয়মিত কথা বলেন, দেখা হয় বলে জানিয়েছেন তারা হলেন মূলত জা (৮১%)। এছাড়াও শাশুড়ি-ননদ-বিধবা ননদ-সতীন। এক শাশুড়ির কথার প্রভাব খানিকটা আছে তাদের জীবনে বাকি সবার প্রভাব বলতে গেলে নেই। স্বামীই সব। তবুও ধান শুকাতে দিয়ে, কাঁথা নাড়তে গিয়ে, বাচ্চার পেট খারাপ হলে এদের সাথেই দেখা হয়, কথা হয়। পরের কিস্তিতে সমাপ্য।

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • অপর বাংলা | ০৮ মার্চ ২০১১ | ১১৩৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে মতামত দিন