এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  অপর বাংলা

  • গ্রামের মহিলাদের কোনো বন্ধু নাই - শেষ পর্ব

    কাবেরী গায়েন লেখকের গ্রাহক হোন
    অপর বাংলা | ১৪ মার্চ ২০১১ | ৮১৯ বার পঠিত
  • আগের সপ্তাহে প্রথম পর্বের পর :

    জোবরা: 'আঁরা বারের মাইয়াফোয়ার লগে খঁতা না খই।'

    ....................................

    চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে বিখ্যাত গ্রাম জোবরা। গ্রামীণ ব্যাংক-খ্যাত জোবরা। বন্ধু আতিকুর রহমান যখন তথ্য সংগ্রহকারী দলের সাথে অর্থাৎ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে জানালেন যে জোবরা গ্রামকে বাছা হয়েছে কাজ করার জন্য, মনটা একটু দমেই গিয়েছিলো। ধরে নিয়েছিলাম এটা হবে একটা সাজানো গ্রাম, মহিলারা হবেন অনেক চৌকস, বন্ধু থাকবে তাদের অনেক যা হয়তো ঠিক বাংলাদেশের গ্রামকে প্রতিনিধিত্ব করবে না। কিন্তু টীমের সদস্য মের্শেদুল ইসলাম (এখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক) আশ্বস্ত করেছিলেন, ""মিডিয়ায় যা দেখেন আর বাস্তবের মধ্যে অনেক ফারাক, হতাশ হবেন না ম্যাডাম, আর পাঁচটা গ্রামের সাথে এই গ্রামের খুব বেশী পার্থক্য নেই।'' এই গ্রামের দুই অংশ। বড় এক মাঠ মাঝে থেকে ভাগ করে দিয়েছে এই দুই অংশকে। একপাশে বৌদ্ধ পাড়া, আরেকদিকে মুসলিম বসতি। আমরা কাজ করেছি মুসলিম অংশে। অন্যান্য গ্রামের সাথে এই গ্রামের প্রথম যে পার্থক্য চোখে পড়ে তা হলো বাড়িগুলো বেশ দূরে দুরে। কোন মহিলার কোন ছবি তোলা যায়নি এবং স্বামীর অনুমতি ছাড়া কথা বলতে কোন মহিলাই রাজী হননি। কাজেই আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে যেনো তাঁরা স্বামীদের অনুমতি নিয়ে রাখতে পারেন। পাঁচ বাড়ির মহিলাদের সাক্ষাৎকার শেষ পর্যন্ত নেয়া সম্ভব হয়নি কারণ তাঁদের স্বামীরা বিদেশে থাকেন এবং সপ্তাহে মাত্র একদিন তারা ফোন করেন কাজেই কোন কারণে মনে না থাকলে অনুমতি নেয়া আর হয়ে ওঠেনি। আরো একটি বিষয়, বলা বেশ ঝুঁকিপূর্ণই, মোট ৯৮টি বাড়ির মহিলাদের সাথে আমরা কথা বলেছি কিন্তু তাঁদের একজনও দাবি করেননি যে তাঁরা গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্য। তিনজন মহিলা ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্পের সাথে জড়িত কিন্তু সেগুলো স্থানীয় ইসলামিক এনজিও।

    শুরুতে বন্ধু আছে কী না, প্রশ্নটাকে একধরনের অপমান হিসেবেই দেখেছেন মহিলারা। পরে টীমের সদস্য একই গ্রামের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী রুনু বুঝিয়ে বলেছেন সই মানে যে বাইরে থেকে থাকতে হবে এমন কোন কথা নেই, বাড়ির ভেতর যাদের সাথে তারা বেশী "মাতে', "তারার' নাম বললেই হবে। বাড়ির পর বাড়ি গিয়ে মনে হয়েছে বুঝি কেউ আগে থেকে শিখিয়ে দিয়েছেন সবাইকে একটা উত্তর আর পরীক্ষায় সেটি কমন পড়ে গেছে :

    আঁরা বারের মাইয়াফোয়ার লগে খঁতা না খই

    অনেক বাড়ির স্বামীরাই যেহেতু বিদেশে চাকরী করেন কাজেই অর্থনৈতিক দিক থেকে এই মহিলারা বেশ সচ্ছল, ফলে অন্যান্য গ্রামের মত ভাসুর-দেবরদের পরিবারগুলোর সাথে সবসময় একসাথে থাকতে হয় না একই পাড়ায়। জা-দের সাথেও সম্পর্ক তাই নিত্যদিনকার নয়। তারপরও মুশকিল হলো যে-মহিলার স্বামী বিদেশ থাকেন তাকে আবার তক্কে তক্কে রাখেন অন্যান্য জা-রা। মহিলাকেও সমঝে চলতে হয়, নাহলে টেলিফোনে কোন বেফাঁস তথ্য দিয়ে দিলে তো আর রক্ষা নেই। এ-কারণেও মহিলারা একে অপরের কাছে মুখ খুলতে ভয় পান। শ্বাসরুদ্ধকর এই জীবনে খুব কম মহিলাই দুইজনের বেশী "পেটের-কথা-বলা' মানুষের নাম করেছেন। তবুও যে ক'জনের নাম করা হয়েছে তারা সবাই-ই হয় জা, নয়তো শ্বশুরবাড়ির আত্মীয় সম্পর্কের কেউ। অবিবাহিত মেয়েদের সমস্যা আরো প্রকট। আসমা, জমিলা, নূরজাহান তিন জনের মা-ই জানিয়েছেন তাঁদের মেয়েদের স্বভাব-চরিত্র ভালো, কারো সাথে সই-য়ের সম্পর্ক নেই। বাড়ির বাইরে যেমন তারা যায় না তেমনি অন্য বাড়ির মেয়ের সাথে কথা বলে তার মেয়ে এমন অপবাদ নাকি যে দেবে তাদের জিহ্বা খসে যাবে। মেয়েদের বিয়ে দিতে পারলেই তারা মুক্তি পান। বলা দরকার আমরা এই অবিবাহিত মেয়েদের সাথে কথা বলার অনুমতি পাইনি।

    ব্রাহ্মণ শাসন: "প্যাটর কী কতা কইতাম কার সাতে?'

    .................................

    সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিক পিছনেই ব্রাহ্মণশাসন গ্রাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক কর্মচারী এই গ্রামে থাকেন। অর্থনৈতিক অবস্থার বিচারে গ্রামটির দুটো পরিষ্কার ভাগ রয়েছে। গ্রামের প্রকৃত বাসিন্দাদের অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ ভালো। তাদের কারো রয়েছে আবাদী জমি, কেউ বা চাকরি করেন। কিন্তু কিছু গরীব মানুষ প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে এসে উঠেছেন সেই এরশাদের গুচ্ছগ্রামে। এই অংশের পুরুষরা রিকশা চালান কিংবা দিন-মজুরের কাজ করেন আর মহিলারা বাসাবড়িতে কাজ করেন নয়তো রাস্তা নির্মাণ কাজে বা ইটের ভাটায় দিনমজুর হিসেবে কাজ করছেন। সচ্ছল অংশের মহিলাদের সম্পর্ক অন্যান্য গ্রামের মহিলাদের মতই তাদের জা-শাশুড়ি-ননদদের সাথে কিন্তু গুচ্ছগ্রামের মহিলাদের সেই সুযোগও নেই। লাগোয়া ঘরের এইসব মহিলারা সবাই সবাইকে সন্দেহ করেন। পেটের কোন কথা তাদের নেই কারো কাছে বলার মত। স্বামী মারলে সবাই দেখে। স্বামী আরেক জায়গায় বিয়ে করলে হয় গুচ্ছগ্রাম ছেড়ে চলে যায় নয়তো সেই বউ নিয়ে ঘরে উঠলে মহিলাকে রাস্তায় নামতে হয়। জীবনের কোন বিষয়েই কোন গোপনীয়তা নেই কারো। গুচ্ছগ্রামের জুলেখা ইয়াসমিন সুন্দর ব্যাখ্যা দিলেন যে পেটের কথা সবাই দেখে, বলার কিছু নেই কারো সাথে।

    সম্পর্ক-কাঠামোর একই গল্প পুনরাবৃত্ত হতে থাকে গ্রাম থেকে গ্রামে- টাঙ্গাইল জেলার গয়াহাটা ইউনিয়নের বলাই নগর কিংবা দিনাজপুরের বীরগঞ্জের মহুগাঁও কিংবা ছোট শহরের মহল্লা আক্কেলপুর-এ। বলাই নগর গ্রামের অনেক মহিলাই এনজিও হাঙ্গার প্রজেক্ট-এর সাথে জড়িত আর একাকী চলতে পারার দাবীদার সবচেয়ে বেশী মহুগাঁও-এ। আর আক্কেলপুরের মহিলারা তো বলতে গেলে শহরেরই মহিলা। তাঁদের নাম ভিন্ন, ধর্ম ভিন্ন, ভাষা ভিন্ন কিন্তু সম্পর্ক কাঠামো একই। বিয়ের পরে মেয়েদের জীবনে সই-এর উপযোগিতা থাকতে পারে, এই ধারণাও যেনো অনুপস্থিত। আর বিয়ের আগে মেয়েরা একটু বড় হতেই বাইরে যাওয়া নিষেধ, কথা বলা নিষেধ বাড়ির বাইরের কারো সাথে, কাজের বাইরে।

    লক্ষণের গণ্ডি আসলে কতবড়?

    ..................

    দণ্ডকারণ্যে সীতাকে গণ্ডি এঁকে দিয়েছিলেন লক্ষণ। রামায়ণ অনুযায়ী সীতা সেই গণ্ডির বাইরে যাওয়ায় কী অনর্থই না ঘটেছিলো ! রবীন্দ্রনাথ মেয়েদের জন্য বাইরেটা কী ভয়ানক বোঝাতে মস্ত এক উপন্যাসই লিখে ফেলেছেন, ঘরে-বাইরে। মেয়েদেরকে বলেছেন তিনি সীমা স্বর্গের ইন্দ্রাণী। প্রশ্ন হলো, এই সীমা স্বর্গের সীমা কতদূর ? লক্ষণের গণ্ডিই বা কত বড় ?

    আন্ত:ব্যক্তিক সম্পর্ক কাঠামো উপস্থাপনের সফটওয়্যার ucinet- ৬-এর netdraw প্রোগ্রাম ব্যবহার করে পয়গ্রামের যে clique প্যাটার্ণ (যাদের সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ) পাওয়া গেছে সেটি লক্ষ করলেই বোঝা যাবে মহিলাদের সম্পর্ক কাঠামো কেমন। প্রত্যেকটি বৃত্ত যেমন একেকজন মহিলাকে নির্দেশ করছে তেমনি নির্দেশ করছে কত নম্বর বাড়ির মহিলা তিনি। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে কেবল পাশাপাশি/কাছাকাছি বাড়ির মহিলারাই্‌ সম্পর্কে আবদ্ধ। এই পাশাপাশি বাড়িগুলো হচ্ছে তাঁদের ভাসুর-দেবরদের বাড়ি, যেখানে থাকেন তাঁদের জা-শাশুড়ি-ননদ।

    যদি অঙ্কের হিসেবে বলি তবে সবগুলো গ্রামে মহিলাদের গড় সম্পর্ক ৩.১১ জনের সাথে। এবং এই সম্পর্কসূত্রের ৭৮.২৭% তাদের জা।



    এই সীমাবদ্ধ জীবন আর সীমিত সম্পর্কের কারণগুলো একই সাথে জটিল, বহুমাত্রিক এবং আন্ত:সম্পর্কিত। সম্পর্ক কাঠামো গড়ে ওঠার আখ্যানভাগ নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করা না গেলে আমরা কতগুলো উপরিভাসা কারণের বন্দিশেই ঘোরাফেরা করবো। তাই মাঠের কাজের ফলাফলে উঠে আসা দৃশ্যমান সহজ কারণগুলো বিশ্লেষণ করা যেমন জরুরী, তেমনি বা আরো বেশী জরুরী এসব কারণের অর্ন্তনিহিত মতাদর্শিক এবং মনো-সামাজিক-আর্থনীতিক ভিত্তির দিকে ফিরে তাকানো। সামাজিক সংগঠন হিসেবে পরিবার এবং এই পরিবারের লৈঙ্গিক-সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ জরুরী, জরুরী বিশ্লেষণ করা "ঘর' আর "বাইরে'র বর্তমান রূপকাঠামো, এর ঐতিহাসিক নির্মাণের সাপেক্ষে।

    নারীর 'অপরায়ন'-এর ইতিবৃত্ত:

    -------------------

    "জমিন', পরিবার আর ব্যক্তিগত সম্পত্তির সরল-জটিল কোলাহল

    খালি চোখে যে কারণগুলো আমরা দেখি এই গবেষণায় সে-সবের মধ্যে অনিবার্য যে কারণ ছাপিয়ে উঠেছে আর সব কারণকে, সেটি হলো তাদের যোগাযোগ আবহ সীমিত, জমিন (Space) নির্দিষ্ট। নির্দিষ্ট তাদের বিচরণ ক্ষেত্র, কাজ কিংবা অবসরের। এই নির্দিষ্ট সীমিত জমিনের কারণগুলো আবার প্রায় মুখস্থ বলে দেয়া সম্ভব, অল্প বয়সে বিয়ে এবং বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়ির গৃহস্থালির কাজে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ, যে "কাজ' আবার "কাজ' হিসেবে স্বীকৃত নয় অর্থনৈতিক মানদণ্ডে অথচ সকাল থেকে রাত অবধি গৃহস্থালির কাজেই তাদের নিয়োজিত থাকতে হয়। গার্হস্থ্য পুনরাবৃত্ত শ্রমের নিগড়ে আবদ্ধ খুব কম মহিলারই সুযোগ থাকে সই জাতীয় "অপ্রয়োজনীয়' মানবিক সম্পর্ক নিয়ে মাথা ঘামানোর কিংবা সময় দেয়ার যেমনটা বলেছেন রায়ের কাঠির অবিরত জাল বুনতে থাকা সবিতা রানী, ""বাড়ির বাহির বা হমু কহন আর সই বা পাতামু কহন''। বাড়ির বাইরের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যোগ না থাকার কারণে মহিলাদের বাড়ির বাইরে যাওয়ার "প্রয়োজন হয় না' কিংবা নিন্দুকেরা হয়তো বলবেন "হুকুম' হয় না। বাড়ির বাইরের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যোগ না থাকার কারণকে আবার প্রায়শই তাদের "অ-শিক্ষার' সাথে সম্পর্কিত করে দেখা হয়। কিন্তু আমরা দেখেছি এসব মহিলাদের স্বামীদের শিক্ষাগত যোগ্যতাও তেমন আহামরি ভিন্ন কিছু নয়। যেহেতু স্বামীদের কর্মজগত "ইতিহাস নির্দিষ্টভাবে' বাইরের পৃথিবী তাই তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা কোন প্রতিবন্ধক নয় বাইরের পৃথিবীর আলো-হাওয়ায় সঞ্চরণের জন্য। মেয়েদের শিক্ষাগত যোগ্যতার ঘাটতি আবার অনেক ক্ষেত্রেই দারিদ্র্যের পাশাপাশি "বিয়ের বয়স' এবং "সম্ভাব্য উপযুক্ত বিয়ে'-এর সাথে সম্পর্কিত। একই আর্থ-সামাজিক অবস্থানের মেয়েদের প্রাথমিক স্কুলে নিবন্ধীকরণ ছেলেদের সমান বা ক্ষেত্র বিশেষে বেশী হলেও মাধ্যমিকে যাওয়ার আগেই তারা ঝরে যায়। স্কুল দূরে হলে বেশ মোক্ষম একটা যুক্তি আপসেই দাঁড়িয়ে যায় যেমন আমরা দেখেছি চৈতন্যপুরে। গড় বিয়ের বয়স সাড়ে পনেরো হওয়ার আগেই তাই বিচ্ছেদ ঘটে স্কুলের সাথে, বাইরের পৃথিবীর সাথে, সই-দের সাথে। এই সময়টা হচ্ছে তাদের বিয়ের জন্য প্রস্তুতির সময়। এই প্রস্তুতিকালীন সময় আবার নিবিড়ভাবে যুক্ত "সতীত্ব নিশ্চিতকরণ' প্রক্রিয়া এবং "নিরাপত্তা'র ধারণার সাথে, দু'টোই সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক নির্মাণ। আত্মীয় সম্পর্কের বাইরে এসব মেয়েদের অন্য কোন সম্পর্ক গড়ে ওঠার প্রক্রিয়াটি বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে শুরুতেই, এমনকি কাউকে জানান না দিয়েই। বিবাহিত মহিলাদের ক্ষেত্রে বাইরের পৃথিবীর সাথে যোগাযোগের সূত্র হয়ে উঠতে পারতো গ্রামে গ্রামে পত্তন নেয়া বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার কার্যক্রম। কিন্তু মাঠ অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে এমনকি ক্ষুদ্রঋণ বা অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো বাড়িতে এসে ঋণ বা সাহায্য দিয়ে যায় অনেকক্ষেত্রেই। নারী থাকবে লোক চোখের আড়ালে-"দেশজ সংস্কৃতির' এই প্রত্যাশার মতাদর্শ পরিষ্কারভাবে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানেও পরিব্যপ্ত এবং স্বীকৃত হয়েছে, যেমনটা দেখেছেন ওয়ালেস ও অন্যান্য ১৯৮৭ (সূত্র : হোয়াইট ১৯৯২)। তাঁদের মতে ""গ্রামীণ নারীকে বন্ধন-মুক্ত করার পক্ষে যুক্তি দেয়া আমাদের উদ্দেশ্য নয়-সেটা "দার্শনিক আর সমাজ-সংস্কারকদের কাজ'।''

    "নারীর কাজ গৃহকেন্দ্রিক' এই আধিপত্যশীল মতাদর্শকে ঘিরেই আবর্তিত বেশীরভাগ প্রকল্প কিংবা আবর্তিত "গৃহের আয় বৃদ্ধি'র সাথে নারীর সংযুক্তি জাতীয় উদ্যোগে যেমন হাঁস-মুরগি পালন, হস্তশিল্প। ফলে যারা ক্ষুদ্রঋণ বা অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে জড়িত, ব্যক্তিগত পর্যায়ে তাদের কিছু "সাহায্য' হলেও সামষ্টিকভাবে তাদের 'সীমাবদ্ধ জল আর সীমিত সবুজময় আঙ্গিনার বিস্তৃতি ঘটে না নতুন মানুষের সাথে মেশার কিংবা ভাব বিনিময়ের। বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠার যে অবকাশ আর জমিন প্রয়োজন দুই-ই অনুপস্থিত, তাই বন্ধুত্ব তৈরী হয় না। তবে গ্রামীণ নারীর এই জমিন space -এর নির্মাণ কোন আপাত নিরীহ সিদ্ধান্তের বিষয় নয় বরং বিয়ে, পরিবার এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো জটিল বিষয়গুলোর ঐতিহাসিক বিকাশ এবং বর্তমান প্রেক্ষিতের সাথে গভীরভাবে সংযুক্ত। নারী সত্ত্বার নির্মাণকে ঘিরে যে "অপরতা'র বলয়, তার বিচিত্র বিচ্ছুরণকে লক্ষ করতে হবে দর্শন ও ইতিহাসের প্রতিবেদনে।

    গার্হস্থ্য শ্রমের সাথে নারীর যুক্ততা কীভাবে অনিবার্য হয়ে উঠেছে কিংবা নারীর অবস্থা, পরিস্থিতিগুলো কেন "অপর' হয়ে উঠেছে এবং কীভাবেই বা এই "অপরায়ন' এই প্রশ্নগুলো নারীবাদী পাঠের কেন্দ্রীয়-ঐতিহাসিকভাবে স্থায়ীত্ব পেয়েছে বিষয়। নানা মত, নানা পাঠের ভেতর থেকে দু'টি প্রবল ধারা মোটা দাগে বের করে আনা সম্ভব (বলা বাহুল্য, নারী তার দৈহিক কারণেই গার্হস্থ্যধর্ম পালন করে, এই সনাতন সরল জৈবিক ব্যাখ্যাকে এখানে মোটেই আমলে নেয়া হচ্ছে না)। একটি ধারার মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে, ""সব সময়ে, সর্বত্র বা সব পর্যায়েই নারী সামাজিকভাবে পুরুষের অধ:স্তন নয়।'' এই ধারার প্রধান প্রবক্তা এঙ্গেলস (১৮৮৪/১৯৪২) তাঁর The Origine of the Family, Private Property, and the State বইতে যুক্তি দেন যে, গোষ্ঠীভিত্তিক সমাজ যখন সভ্যতার দিকে অগ্রসর হতে থাকে তখন পিতৃতন্ত্রের উদ্ভব ঘটে যা নারীর অধস্তনতার মূল কারণ এবং সমাজতন্ত্রের আগমনের সাথে সাথে পিতৃতন্ত্র পরাভূত হয়। পিতৃতান্ত্রিক সমাজের সাধারণ সামাজিক নিয়ম হচ্ছে নারী পুরুষের সম্পত্তির মত কাজ করে, সন্তান উৎপাদন ও তার সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পিতৃতান্ত্রিক নিয়মকানুন বজায় রাখে। এই প্রক্রিয়ার মূল দুটি প্রপঞ্চ "ব্যক্তি মালিকানার উদ্ভব' ও "শ্রেণীভিত্তিক অসমতার সাথে নারীর ঐতিহাসিক অধস্তনতার সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এভাবে, যেখানে পারিবারিক কাজের সাথে বাইরের বা সামাজিক কাজের কোন পার্থক্য নেই সেখানে নারী-পুরুষের মধ্যে একধরনের সমতার সম্পর্ক বিদ্যমান, এমনকি নারী পুরুষের চেয়ে অধিক ক্ষমতাবান ক্ষেত্র বিশেষে। এঙ্গেলস দেখান, এ ধরনের পরিস্থিতিতে উৎপাদনের উপায় ও উৎপাদনের উপর সমাজের সকলের মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ বিদ্যমান, গার্হস্থ্য জীবন ও সামাজিক জীবনের কেন্দ্রে রয়েছে যৌথ গৃহস্থালি। তাই যে সমাজে বিনিময়ের জন্য উৎপাদনের প্রবণতা কম এবং যেখানে ব্যক্তিমালিকানা ও শ্রেণী অসমতার সৃষ্টি হয়নি সেখানে লিঙ্গীয় ভূমিকার পার্থক্য থাকলেও লিঙ্গীয় অসমতা কম এবং ক্ষমতা, কর্তৃত্ব ও তুলনামূলক যৌন অধিকার নারী-পুরুষ উভয়ের মাঝে বিন্যস্ত। কিন্তু উদ্বৃত্ত বৃদ্ধির সাথে সাথে ব্যক্তিমালিকানার উদ্ভব হয় এবং নারী সম্পদ, উৎপাদিত দ্রব্য ও তার নিজের উপর কর্তৃত্ব হারায়। যৌথ গৃহস্থালিগুলো ব্যক্তিগত এককে পরিণত হয়, প্রতিটি পরিবারে একেকজন পুরুষ প্রতিনিধি কর্তৃত্ব করেন। পরিবার হয়ে ওঠে নারীর শ্রমের ক্ষেত্র যা পর্যায়ক্রমে একটি বৃহৎ সামাজিক বা বাইরের জগতের আর এই-নিয়ন্ত্রণাধীন হয়। এই বহির্বিশ্বের জগত আবার রাষ্ট্র দ্বারা পরিচালিত সমাজ, রাষ্ট্র সব কিছুই হচ্ছে পুরুষের। সোজা কথায়, ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিকাশে পিতৃতন্ত্রের সৃষ্টি হলো, উন্নত যন্ত্রের উদ্ভাবনের জন্য সামাজিক উৎপাদনে নারীর শ্রমের প্রয়োজনীয়তা কমে গেলো। সামাজিক জীবনে উৎপাদনের অংশ হিসেবে বিচ্যুত হয়ে সে নিযুক্ত হলো গৃহস্থালির একঘেয়ে বাঁদীগিরিত্বে।

    এঙ্গেলসের অর্থনৈতিক নিমিত্তবাদী ব্যাখ্যার বিপরীতে সক্রিয় সমালোচনাত্মক ধারাটির অন্যতম প্রতিনিধিত্বকারী হলেন ব্যুভোয়া (১৯৪৯/১৯৬৮)। তাঁর মতে, নারীজীবনের স্বর্ণযুগ কল্পনামাত্র, তা কখনোই ছিলোনা। সমগ্র ইতিহাসকে যাযাবর যুগ, কৃষির প্রথম যুগ, পিতৃতান্ত্রিক যুগ ও প্রাচীনকাল, খৃষ্টধর্ম ও মধ্যযুগ এবং ফরাসী বিপ্লবের পর থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত পাঁচটি বর্গে ভাগ করে তিনি দেখান চিরকালই পুরুষ প্রভু, মাঝে কিছুদিন কৃষির প্রথম যুগ যা প্রায়শই মাতৃতান্ত্রিক যুগ হিসেবে চিহ্নিত শুদ্ধ জন্ম রহস্যের প্রভাবে সে নারীকে খানিকটা সুবিধা দিয়েছে, বসিয়েছে মাতা বা দেবীর আসনে, এই যুগেও নারীর অবস্থান মূলত গৃহকেন্দ্রিক বলেই মনে করেন ব্যুভোয়া। নারী ও শ্রমিককে এক পর্যায়ে ফেলা এবং সামাজিক উৎপাদনে অর্থনৈতিক মর্যাদা পেলে উভয়েরই অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে, এঙ্গেলসের এই মূল থিসিসের বিপরীতে তিনি বলেন শ্রমিক এক বিশেষ সমাজ ব্যবস্থার ফল কিন্তু সমাজের প্রথম যুগ থেকেই নারী ও পুরুষের সম্পর্ক নির্যাতিত ও নির্যাতনকারীর। বিষয়টি আরো ভালোভাবে বোঝা যায় যখন তিনি বলেন শ্রমিকের মধ্যে শ্রেণী-বৈষম্য নিশ্চয়ই নেই কিন্তু নারীর মধ্যে শ্রেণীবিভাগ রয়েছে। আবার সামন্ততান্ত্রিক ইউরোপের ভূমিদাসদের মত প্রতিটি পরিবারের নারীর একদিকে যেমন সম্পত্তি রয়েছে (বিয়ের পরে স্বামীসূত্রে পাওয়া), অন্যদিকে সে নিজেও পুরুষের সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত। এইসব প্রশ্ন পরবর্তী নারীবাদী তত্ত্বেরও কেন্দ্রীয় ফোকাসে পরিণত হয় (দেখুন, কেলি ১৯৮৬)। তবে ব্যুভোয়া এঙ্গেলসের মতই মনে করেন যে ব্যক্তিগত সম্পত্তি নারীর অপরায়নকে দৃঢ়তর করেছে। উভয়ের থিসিসেই (বলা ভালো উভয় ধারায়) একটি মূলগত ঐক্যের দিক হলো দুজনেই মনে করেন ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিয়ের বন্ধনকে দৃঢ় করেছে কারণ পুরুষ তখন চেয়েছে নিজের ঘর, সম্পত্তি ও তার "বৈধ' উত্তরাধিকার। আগের যুগে বিয়ে বহির্ভূত যৌন অপরাধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা ছিলো না কিন্তু এই যুগে নিয়ম হলো সতীত্ব নিয়মলঙ্ঘনকারীকে তার স্বামী হত্যা করতে পারবে এবং তার জন্য কোন শাস্তি হবে না। পিতৃতন্ত্রের উদ্ভব থেকে আজ পর্যন্ত সকল সমাজে, কিছু ব্যতিক্রমসহ, এই ব্যবস্থাই কমবেশী বিদ্যমান। এক্ষেত্রে কেলি (১৯৮৬)-র বক্তব্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ : ""যেখানে ঘর আর বাইরের মধ্যে সুস্পষ্ট বিভাজন বিদ্যমান সেখানে লিঙ্গীয় অসমতার প্রাবল্য লক্ষ্য করা যায়, একই সাথে নারীর সতীত্ব এবং পতিতালয় চাওয়া হয়।'' ভারতীয় যৌন বাস্তবতার অধ্যয়ন এ-ধরণের আলোচনায় পুরোপুরি নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে। যেমন বাৎসায়নের কামসূত্র পড়লে স্পষ্ট বোঝা যায়, দাম্পত্য জীবনে নারী কখনো সমান মর্যাদা ভোগ করত না। বিবাহিত নারীরা অশিক্ষিত হওয়াতে স্বামীকে কখনো বুদ্ধিতে, সংবেদনায় সঙ্গী হিসেবে পেতো না। রাষ্ট্র চৌষট্টিকলায় নিপুণ বারাঙ্গনা বা জনপদবধূদের উৎসাহ যোগাত যাতে পুরুষেরা তাদের সাহচর্‌যে বৌদ্ধিক তৃষ্ণা মেটাতে পারে। এই সমাজে, প্রাক-আধুনিক যুগে, অন্তত দুই সহস্রাব্দ ধরে, যৌনতা-দাম্পত্য, স্ত্রী-পুরুষের সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়ে একই মনোভঙ্গি বজায় ছিলো। বিয়ে বহির্ভূত যৌনতা বিশেষভাবে স্ত্রীর সামাজিক মর্যাদার পক্ষে হানিকর বলে বিবেচিত হলো না শুধু, যৌন নৈতিকতার ধারণাও এই ভাবনাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হলো, তৈরী হলো বিভিন্ন নীতিশাস্ত্র। মহাভারতের শুরুতে আমরা দেখি কুন্তীর ক্ষেত্রজ পুত্রদের অথচ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্থাৎ মহাভারতের শেষ পর্যায়ে গীতায় পরিষ্কার বলা হয়েছে, "স্ত্রীষু দুষ্টাষু বার্ষ্ণেয় জায়তে বর্ণসঙ্কর:'। অর্থ, স্ত্রীদের অনৈতিক যৌন স্বেচ্ছাচারের ফলে বর্ণাশ্রম প্রথার দ্বারা অননুমোদিত সন্তানেরা জন্ম নেয়। অর্থাৎ সতীত্ব সংস্কারের শেকল পরানো শুরু হচ্ছে মাত্র আর তার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হচ্ছে। অধিপতি ব্রাহ্মণ্য সমাজে "বিশুদ্ধ' আর্য উত্তরপুরুষের পরম্পরা রক্ষা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে বলে সাহিত্য-সংস্কৃতি-স্মৃতি-পুরাণ জুড়ে নারীর অশুচিতা, অবিশ্বাস্যতা, অপূর্ণতা কীর্তিত হয়েছে। কঠোর হয়েছে সতীত্ব নিশ্চিতকরণের উপায়সমূহ। নারীর জমিন ক্রম সঙ্কুচিত হয়েছে।

    উনিশ শতকের শেষভাগ এবং বিশ শতকের প্রথম ভাগ বাঙ্গালী মুসলমান মধ্যবিত্তের উন্মেষকাল এবং এই শ্রেণী গঠনের সাথে শুরু হয় পরিবার, বিয়ে ব্যবস্থা, এবং নারী-পুরুষ সম্পর্কের আমূল পরিবর্তনের প্রক্রিয়া। এর আগে বাঙ্গালী মুসলমানদের মধ্যে পুরুষের একাধিক বিয়ে সব শ্রেণীতেই স্বাভাবিক ধরে নেয়া হতো। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণী গঠনের পর খুব দ্‌রুতই এক পতি-পত্নী বিয়ে নৈতিকতা, সমতা আর প্রগতিশীলতার স্মারক হিসেবে মূর্ত হয়ে ওঠে এবং অচিরেই, আধা শতাব্দীরও কম সময়ে, সেটি হয়ে ওঠে সামাজিক রীতি। আপাত প্রগতিশীল এই বিয়ে কাঠামোতেও "নারী ঘরণী, তার ভূমিকা নৈতিক এবং আদর্শিক, নারী চৈতন্যের বিশাল জায়গা জুড়ে রয়েছে যৌন শুচিতা', যেমনটা দেখেছেন চৌধুরী এবং আহমেদ (২০০০ : ১৫৫)। তাঁরা যথার্থই দেখেছেন, ""পুরুষের পরিচিতি এই পরিকাঠামোতে আর্থিক, তার কাজের জায়গা বহির্জাগতিক (রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক) ; তার শুচিতার ব্যাপার নারীর মত সংকটের নয়। ঘর-বাহির পুনর্গঠনের মধ্যে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কাছে সম্মানবোধ আর চরিত্র ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। সেই চরিত্র চর্চার কেন্দ্রীয় জায়গা হলো নারী। নারীর শুচিতার নতুন নতুন উপাদান তৈরী হয় এই সময়। পুরুষের আর্থিক ভূমিকা এক স্বামী-স্ত্রী বিয়ের ক্ষেত্রে এত প্রকট, যা বিশ শতকের মজুরি অর্থনীতিতে বাঙ্গালী মুসলমানের অংশগ্রহণের আগে ছিলো না, যে চাকরি পাওয়ার সাথে "বউ পালতে' পারার সামর্থ্য জড়িত হয়ে পড়ল। পৌরুষের ধারণার ভিত্তিই হচ্ছে স্বাধীন রোজগার, নির্ভরশীল বউ-বাচ্চার লালন-পালন।' বাঙ্গালী মুসলমান মধ্যবিত্তের এই এক পতি-পত্নী বিয়ে এবং "নারী' ও "পুরুষ' নির্মাণ ক্রমশ সঞ্চারিত হয়েছে সমাজের অন্য স্তরেও। সঞ্চারিত হয়েছে এর আনুষঙ্গিক 'ঘর/বাহির', "বিয়ে-করা/ বিয়ে-বসা', "সংসার চালানো/সংসার-করা'র ধারণাগুলোও। অর্থাৎ নারীকে গার্হস্থ্য জমিনের সাথে একাকার করে দেখার বিষয়টি পরিবর্তিত তো হয়ই নি বরং সাহিত্যে, গণমাধ্যমে, নাটকে, চলচ্চিত্রে, চর্চায়, আইনে সর্বত্র মোহময় রোমাণ্টিকতার প্রলেপসহ উপস্থাপন করা হয়েছে বা হচ্ছে এবং নারীর শিক্ষা, চাকরি, উপার্জন, সম্পর্ক সবই নির্ধারিত হয়েছে এই জমিনের প্রয়োজনে এবং এর সাথে সমন্বয় করে।

    কাজেই ব্যক্তিগত মালিকানার উদ্ভবের সাথে নারীর গার্হস্থ্য শ্রম, বিয়ে এবং বৈধ উত্তরাধিকারের প্রয়োজনে নারীর সতীত্ব শৃঙ্খলার উপরে জোরারোপ সংস্কৃতিভেদে কিছু তারতম্যসহ নারীর বর্তমান সীমিত গার্হস্থ্য জমিনের প্রেক্ষাপট রচনা করেছে এবং স্থায়িত্ব দিয়েছে, যা আমরা দেখেছি বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে।

    পুতুল তোমার জনম কিরূপ কে জানে

    আলোক লতায় বাইন্ধা সুতা সে টানে

    ........................

    আসলে প্রশ্ন করার আর তেমন কিছু নেই মনে হয়। হাজার বছরের চাপিয়ে দেয়া সতীত্ব সংস্কারের শেকল এতো গভীরে প্রোথিত যে, সব মহিলাই নিজেকে সেই সংস্কারের মানদণ্ডে মহীয়সী দেখতে আর দেখাতে চান। সীতার অগ্নি পরীক্ষায় উত্তরণের গল্প ধর্ম নির্বিশেষে আজও সতীত্ব গৌরবের পরম নিদর্শন। সেই নারী বিয়ের জন্য ভালো যে অসূর্যস্পর্শা। জানা কথাই যে বিয়ের আগ পর্যন্ত পিতামাতা আগলে রাখেন, আটকে রাখেন মেয়েকে এই সার্টিফিকেটের আশায় যে তার মেয়ের শরীরে কোন "দোষ' লাগেনি। পুরুষসঙ্গ তো দূরের কথা, বাড়ির আত্মীয়-স্বজনের বাইরে কোন মেয়ের সাথেও তাদের মেয়ের কোন সম্পর্ক নেই। বেগম রোকেয়ার "অবরোধবাসিনী' আর কতইবা পুরনো হয়েছে ! মেয়ে তো বিয়ে দেয়ার জন্যই কেবল পালাপোষা করা। সময় খারাপ। নিরাপত্তা নিয়েও চিন্তা আছে। আর সেই মেয়ের যখন বিয়েই হয়ে গেলো সে তো তখন স্বামী আর শ্বশুরবাড়ির যত বাধ্য, ততই ভালো "মহিলা'। বাড়ির আত্মীয় সম্পর্কের বাইরে কারো সাথে মেলামেশা মানে তো সেই একনিষ্ঠ আনুগত্যে অন্য বাতাস লাগা। কে না জানে 'এরা যত বেশী জানে, তত কম মানে'। স্বামী চান না, শাশুড়ি চান না, সমাজ চায় না এই মেলামেশার মধ্য দিয়ে ওই নির্দিষ্ট বাড়ির নির্দিষ্ট মান্যতাসংস্কৃতির শান্ত পুকুরে এমনকি পলকা ঢেউও উঠুক। হাজার বছরের পাখিপড়া শিক্ষায় মেয়েরা এত পোক্তভাবে আয়ত্ত করেছেন এই শিক্ষা যে শিক্ষককে আর পাহারাও দিতে হয় না, তারা নিজেরাই বলেন সই থাকার মত খারাপ কাজের ধার তারা ধারেন না, "পাখির শিক্ষা এখন পুরা হইয়াছে'।

    যারা ঘরের বাইরের কোন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত না (৯২.৭%) তাদের পক্ষে তো বাড়ি আর পাড়ার বাইরে যাওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না। এমনকি গ্রামের যে মহিলারা চাকরি করছেন তাদেরও বান্ধবী নেই, বা থাকলেও ওই মহিলারাই সেই স্বীকৃতি দেন না জনসমক্ষে। কারণ গ্রামের মেয়েদের চাকরীতে যাওয়ার লড়াইটা এখনো সমাজ-সংসারকে এই বুঝ দেবার পর্যায়ে আছে যে সে নেহাত বাধ্য হয়ে, পরিবারের প্রয়োজনে "বাড়তি' টাকা উপার্জনে বের হচ্ছে, কাজের বাইরে আর কোন সম্পর্ক তার নেই পৃথিবীর সাথে, তাই বান্ধবী যদি থেকেও থাকে সেই থাকাকে প্রকাশ করার সামর্থ্য সে অর্জন করেনি এখনো। এখনো সে নিজেকে এবং পারিপার্শ্বিক সবাইকে আশ্বস্তই করতে চায় যে সমাজ নির্দিষ্ট বিবাহিত সম্পর্কসমূহের বাইরে তার অন্য কোন জগত নেই। স্বামী-সংসারেরও এই আশ্বস্তিটুকু প্রয়োজন। মহিলাদের যে নিরঙ্কুশ আনুগত্যের উপরে পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানটি টিকে আছে, সেই আনুগত্যের লেশমাত্রও যে অন্য কোথাও ব্যয়িত হচ্ছে না সে-বিষয়ে আশ্বস্তির প্রয়োজন আছে বৈকি। তবু ধন্ধ আমার কিছুতেই দূর হচ্ছিলো না কেন এভাবে। শুরুতেই দেয়া Symposium-এ প্লেটোর উদ্ধৃতি যেন এক হঠাৎ আলোর ঝলকানি হিসেবে কাজ করেছে। এখানে বলা হয়েছে মালিকের স্বার্থে দাসদের মধ্যে যেন কোন বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠতে না পারে সে বিষয়টি নিশ্চিত করা দরকার। কারণ যে-কোন বন্ধুত্বের সম্পর্কে অন্যান্য উদ্দেশ্যের সাথে ভালোবাসারও উৎসারণ ঘটাতে পারে যা মালিক পক্ষের শক্তিকে ক্ষয় করে। সংসার সম্পর্ক কাঠামোর মালিক যখন স্বামী, আর স্ত্রী যখন দাস, এবং এটাই যখন নিয়ম, এবং এই নিয়মটাকে বহাল রাখাই যখন উদ্দেশ্য, তখন কেন যে মেয়েদের বন্ধুত্বকে সাহিত্যে বা জীবনে স্বীকার করা হয় না বা স্বীকৃতি দেয়া হয়না সেটা খানিকটা খোলসা হয় বৈকি !

    সূত্র : ১. প্রচলিত ধারণা যে মুসলমানপ্রধান গ্রামগুলোতে মহিলারা অনেক বেশী পর্দানশীন, বাইরের জগতে তাদের চলাচল সীমিত দৃশ্য-অদৃশ্যমান নানা পর্দার কারণে, অন্তত অমুসলমানপ্রধান গ্রামের মহিলাদের তুলনায়। ধর্মকেন্দ্রিক কোন সাংস্কৃতিক পার্থক্য মহিলাদের চলাচলে আসলেই আছে কিনা, এবং থাকলে তার প্রভাব সম্পর্ক কাঠামোতে পড়ে কিনা, দেখার জন্যই এই ব্যবস্থা।

    ২. Cilque হলো সাব-গ্রুপ, বলাই বাহুল্য যাদের পরস্পরের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ, পারস্পরিক আদান-প্রদান, সহমর্মিতা বেশি তাদের সাব-গ্রুপ। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় একই ক্লাসের পঁচিশ জন ছাত্রের সম্পর্ক একই মাত্রার নয়। ধরা যাক, ক, গ, প-এই তিনজনের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ কারণ তারা পরস্পরকে পছন্দ করে, একত্রে সময় কাটায়, খেলাধুলা করে, মাঝে মাঝে একে অপরের বাসায় যায়। একটি ক্লাসে এরকম ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের সাব-গ্রুপ বেশ কয়েকটিই থাকতে পারে। এসব সাবগ্রুপকে ক্লিক বলা হয়। ঠিক একইভাবে গ্রামের মহিলারা যে যখন দাবি করেছেন যে কারো সাথে তারা বেশী কথা বলেন, পেটের কথা বলেন, বিপদে-আপদে সাহায্‌যের জন্য যান এবং এভাবে তারা ঘনিষ্ঠ, এই ঘনিষ্ঠতার প্যাটার্ণটিই সারা গ্রামের আঁকা হয়েছে UNICEF সফটওয়্যারটি ব্যবহার করে। ফলে দেখা যাচ্ছে কে কার সাথে ঘনিষ্ঠ। দেখা যাচ্ছে কেবল পাশাপাশি বাড়ির মহিলাদের সাথেই তাদের সম্পর্ক। লাগোয়া ঘরের এসব মহিলারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের বৈবাহিক সম্পর্কসূত্রের আত্মীয়--জা, ননদ, শাশুড়ি। পছন্দ অপছন্দ যাই থাক, যোগাযোগ কেবল এদের সোশ্যাল নেটওয়ার্কের পরিভাষায় বলা হয় isolate .

    ৩. ক্ষেত্রজ পুত্র হলো স্বামী কোন কারণে সন্তান জন্মদানে অক্ষম হলে অন্য কোন মুনি-ঋষি বা রাজন্যবর্গ বা যে কোন পুরুষ কর্তৃক (স্ব-বর্ণের হলে ভালো) স্ত্রীর গর্ভে সন্তান জন্মদানের প্রক্রিয়া যা প্রাচীন বৈদিক যুগে সন্তান জন্মদানের একটি বৈধ প্রথা হিসেবে প্রচলিত ছিলো। এসব সন্তানরা সন্তান জন্মদানে অক্ষম ব্যক্তির সন্তান হিসেবেই প্রতিপালিত হতেন এবং তাদের সম্পত্তির বৈধ উত্তরাধিকারী হতেন। পঞ্চ পাণ্ডবদের সকলেই ক্ষেত্রজ পুত্র। ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু, বিদূর এরাও প্রত্যেকে ক্ষেত্রজ পুত্র। এ-বিষয়ে সহজ পাঠের জন্য বুদ্ধদেব বসুর 'তপস্বী ও তরঙ্গিনী' পড়ে নেয়া যেতে পারে। স্মৃতিকাররা বিশেষ করে মনু-পরাশর এই রীতি বিলোপের প্রস্তাব করেন, বলা হলো কলিযুগে এই বিধান থাকবে না।

    তথ্যসূত্র :

    ------

    Beauvoir, S. de. (1949/1968). The Second Sex, translated in English by Pardhlay, H. M. Bantam Books, NY.

    Engels, F. (1884/1942/1972). The Origin of Family, Private Property and State, translated in English by West, A. (1942), Pathfinder Press, NY.

    Kelly, J. (1986) "The Social Relation of the Sexes: Methodological Implications of Women's History", in Women, History and Theory. The Essays of Joan Kelly, The University of Chicago Press, Chicago & London.

    Plato. (360 B.C./1997) The Symposium, translated in English by Neham, A. and Woodruff, P. From Plato: Complete Works, Cooper, J. M. (ed.), 1997. pp. 457-506.

    White, S. C. (1992). "Research on Women in Bangladesh", Arguing with the Crocodile, Gender and Class in Bangladesh, University Press Limited, Dhaka.

    চৌধুরী, মানস এবং আহমেদ, রেহনুমা। ২০০০। ""লিঙ্গ, শ্রেণী এবং অনুবাদের ক্ষমতা : বাঙ্গালী মুসলমান মধ্যবিত্ত পরিবার ও বিয়ে'', কর্তার সংসার, গুলরুখ, সায়দিয়া এবং চৌধুরী, মানস (সম্পাদিত)। পৃষ্ঠা ১৩৯-১৬৪। রূপান্তর প্রকাশন, ঢাকা।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • অপর বাংলা | ১৪ মার্চ ২০১১ | ৮১৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। সুচিন্তিত মতামত দিন