এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • তবে বলো, জিতলো কে জন্মভূমি?

    বিপ্লব রহমান লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ০৫ মার্চ ২০১৮ | ৭৩০ বার পঠিত
  • রাঙামাটির দূর পাহাড়ে দুই মারমা আদিবাসী বোন ধর্ষণ ও যৌন হয়রানীর ঘটনাকে কেন্দ্র করে পাহাড়ে নিরাপত্তা বাহিনী একের পর এক ন্যাক্কারজনক যে ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে, তাতে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, পর্যটনের নিঃস্বর্গভূমি রাঙামাটি কী ডাকাতদের গ্রাম? সেখানে কী জঙ্গলের শাসন চলছে?
    সবশেষ ১৫ ফেব্রুয়ারি রাতে নিরাপত্তা বাহিনী বাতি নিভিয়ে চাকমা রাণী য়েন য়েন ও তার সহযোদ্ধা স্বেচ্ছাসেবীদের মারপিট করে হাসপাতাল থেকে দুই মারমা বোনকে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা হতবাক করে দিয়েছে শুভবুদ্ধির মানুষদের। ক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়েছে পাহাড় থেকে সমতলে।
    দুই মারমা বোনের নির্যাতন ও চাকমা রাণীর ওপর হামলার প্রতিবাদে প্রায় প্রতিদিনই পার্বত্য চট্টগ্রামে তো বটেই, ঢাকা ও ঢাকার বাইরে মিছিল, সমাবেশ, মানবন্ধন, মশাল মিছিল হচ্ছে। আদিবাসীদের বিভিন্ন সংগঠনের পাশাপাশি অ-আদিবাসী বাঙালিরাও যোগ দিচ্ছেন এসব কর্মসূচিতে। শ্লোগান উঠেছে- পাহাড় ও সমতলে/লড়াই হবে সমানতালে!

    অপারেশন ব্ল্যাক আউট
    কী ঘটেছিল, ১৫ ফেব্রয়ারি রাঙামাটি হাসপাতালে? ঘটনার পরদিন ১৬ ফেব্রুয়ারি রাণী য়েন য়েনের উপর শারীরিক হামলার বিষয়ে চাকমা চীফ রাজা দেবাশিষ রায় এবং চাকমা সার্কেলের উপদেষ্টা রাণী য়েন য়েনে যৌথ বিবৃতি দিয়ে ঘটনাটি প্রকাশ করেছেন। তাদের যৌথ বিবৃতিটি এরকমঃ

    “গত বৃহস্পতিবার ১৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে আনুমানিক ৭-৮ টার দিকে চাকমা সার্কেল চীফ রাজা দেবাশীষ রায়ের সহধর্মিণী রাণী য়েন য়েন শারীরিকভাবে হামলার শিকার হন যখন তিনি বিগত ২২ জানুয়ারি তারিখে যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়া মারমা সম্প্রদায়ের দুইটি মেয়ের সাথে রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালে অবস্থান করছিলেন। নীচে রাণী য়েন য়েন ও তাঁর সাথে হামলায় আক্রান্ত একজন ভলান্টিয়ারের বর্ণনা অনুসারে লেখা হলো।
    ----
    “১৫ তারিখে দুপুর ১২টার দিকে ব্যাপক সংখ্যক পুলিশ ও প্রায় ১০ জন সাদা পোশাক পরিহিত ব্যক্তি ভিক্টিম মেয়েদের পিতা-মাতাকে হাসপাতালের ওয়ার্ডে নিয়ে আসে যেখানে ভিক্টিমদের গত ২৪ জানুয়ারি থেকে গৃহবন্দী অবস্থায় রাখা হয়েছিল। পুলিশ হাইকোর্ট থেকে একটি অর্ডার নিয়ে আসে এবং ভিক্টিমদের পিতা-মাতাকে তাদের মেয়েদের নিয়ে যেতে বলে। ভিক্টিম দুইজনই তাদের মা-বাবার সাথে যেতে অস্বীকৃতি জানায়। পুলিশ বারবার মা-বাবাকে তাদের মেয়েদের জোরপূর্বক ধরে নিয়ে যাওয়ার কথা বলছিল।
    “এক পর্যায়ে পুলিশ কর্তৃক প্রণোদিত হয়ে বাবা ভিক্টিমের একজনকে এবং মা অন্যজনকে চড় মারে। রাণী ও অন্য ভলান্টিয়াররা এতে হস্তক্ষেপ করে। সহকারি পুলিশ সুপার সিদ্দিকী ভিক্টিমদের ওয়ার্ডের বাইরে সরিয়ে নিতে নারী পুলিশদের আদেশ দেয়। রাণী ও ভলান্টিয়াররা এই বলে হস্তক্ষেপ করে যে, বাবা-মার হেফাজতে রাখার আদেশ কোর্ট দিলেও মেয়েদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের জোর করে সরিয়ে নেয়ার আদেশ দেয়নি এবং সর্বোপরি ভিক্টিমদের হাসপাতাল থেকে জোরপূর্বক সরিয়ে নিতে গ্রেপ্তার করা হতে পারে।
    “ভিক্টিমরা যখন তাদের আইনজীবীদের সাথে দেখা করতে চায়, যারা পুলিশ ও সাদা পোশাক পরিহিত ব্যক্তি দ্বারা হাসপাতালের ওয়ার্ডে প্রবেশে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল; শুরুতে ভিক্টিমদের এই দাবি প্রত্যাখ্যাত হয়। রাণী ও ভলান্টিয়ারদের হস্তক্ষেপে ভিক্টিমদের আইনজীবীদের অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ওয়ার্ডে প্রবেশ করতে দেয়া হয় কিন্তু তা ছিল শুধুমাত্র ১০ মিনিটের জন্য।
    “পুলিশ বারবার রাণী ও ভলান্টিয়ারদের সেখান থেকে চলে যেতে বলে, তারা এতে অস্বীকৃতি জানায়। প্রায় ৪টার সময় সকল ভলান্টিয়ারদের ওয়ার্ড ত্যাগ করতে বলা হয়। তবে একজন ভলান্টিয়ার (২১ বছর বয়সী) রাণীর সঙ্গ ত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানায় এবং সে ঘটনার সর্বশেষ পর্যন্ত রাণীর সাথে ছিল। ৬টার দিকে, পুলিশ ওয়ার্ডের দরজা বন্ধ করে দেয়। রাণী ও অন্য মেয়ে ভলান্টিয়ারটি দোতলার জানালা দিয়ে দেখতে পান যে আর্মির সৈনিকরা ও সাদা পোশাক পরিহিত ব্যক্তিরা হাসপাতালের দুইদিকের প্রবেশদ্বারের সামনের রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনকে তাড়িয়ে দিচ্ছে।
    “৭টার দিকে নিচতলা ও দোতলার করিডোরের ও সাধারণ মানুষের বসার জায়গার বাতিগুলো নিভিয়ে দেয়া হয়। “৭.৩০টার দিকে সাদা পোশাকে মাস্ক ও কাপড় প্যাঁচানো ৮-১০ জন নারী এবং মুখে মাস্ক পরিহিত ৬ জন পুরুষ যারা নারীদের দলটিকে আদেশ দিচ্ছিল, রুমে প্রবেশ করে এবং ভিক্টিম, তাদের বাবা-মা ও ১০ বছর বয়সী ছোট ভাইয়ের সামনে রাণী ও মেয়ে ভলান্টিয়ারকে আক্রমণ করে। ধস্তাধস্তির সময় কয়েকজনের মুখের মাস্ক খুলে পড়ে, কিন্তু তাদের সে বিষয়ে ভ্রুক্ষেপ ছিল না।
    “তারা রাণী য়েন য়েন ও মেয়ে ভলান্টিয়ারকে কিল-ঘুষি ও লাথি মারে, তাদের মাটিতে ফেলে আরো উপর্যুপরি আঘাত করা হয়। মেয়ে ভলান্টিয়ারকে শুধুমাত্র পেটানোই হয়নি, তাকে পুরুষরা যৌন হয়রানি করে যখন নারীরা তাকে ধরে রেখেছিল এবং নিচতলায় টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। রাণী ও মেয়ে ভলান্টিয়ারকে করিডোর ও পরে নিচতলায় টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। নিচতলায় সাদা পোশাক পরিহিত ৬ জনের একটি দল তাদের সাথে যোগ দেয়।
    “রাণী ও মেয়ে ভলান্টিয়ারকে নিচতলায় টেনে নিয়ে যাওয়ার পর আক্রমণকারী দলটি দুই ভাগ হয়ে যায়। একটি দল রাণীকে পিছনের দরজার দিকে ও অন্যটি মেয়ে ভলান্টিয়ারটিকে সামনের গেইটের করিডোর দিকে নিয়ে যায়।
    “যখন রাণীকে মারা হচ্ছিল এবং পিছনের দরজার করিডোরের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন রাণী আক্রমণকারীদের কথা শুনতে পান, ‘শেষ করতে হলে এখানে করা যাবে না, করলে হাসপাতালের বাইরে করতে হবে।’
    “মাথার বাম পাশে একটি ঘুষি মেরে রাণীকে হাসপাতালের বাইরে ছুড়ে ফেলা হয়, সম্ভবত এটি ছিল তাঁকে অচৈতন্য করার একটি প্রচেষ্টা।
    “তিনি বাইরে আরো সাদা পোশাকধারী দেখতে পান। যা হোক এটি ছিল আলোকিত একটি প্রাঙ্গন এবং হাসপাতাল আঙিনার মধ্যে বিভিন্ন বিল্ডিং এর সামনে লোকজন জড়ো হয়েছিল, তারা রাণী ও সাদা পোশাক পরিহিতদের দেখতে পাচ্ছিল যারা রাণীর উপর নজর রাখছিল। রাণী এই সুযোগটা কাজে লাগালেন এবং কাছের সীমানা প্রাচীরের দিকে দৌড়ে গিয়ে এটি টপকে যান। অন্ধকারের মধ্যে প্রায় ১০-১৫ মিনিট দৌড়ানোর পর তিনি নিজেকে কাপ্তাই লেকের পাড়ে আবিষ্কার করেন। সে পানিতে তিনি মগ্ন অবস্থায় লুকিয়ে থাকেন এবং প্রায় আধা ঘন্টার মতো সেখানে ছিলেন।
    “পরবর্তীতে, তিনি কাছাকাছি একটি বাড়িতে যেতে সমর্থ হন এবং আশ্রয় ও সাহায্য খুঁজেন। ওই পরিবারটি রাণীর স্বজনদের সাথে যোগাযোগ করে, তাঁর স্বজনরা সেখানে চলে আসে ও রাণীকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়।
    “একই সময়ে মেয়ে ভলান্টিয়ারটিকে হাসপাতালের সামনের গেইটে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে একটি সিলভার কালারের ভ্যান জীপগুলোর (SUVs) সাথে দাঁড় করানো ছিল। আক্রমণকারীরা তাকে নিচতলার মেঝেতে ফেলে রাখে, মাঝেমাঝে মারধর করছিল যখন অন্যরা উপরতলা থেকে ভিক্টিম ও তাদের মা-বাবাকে নিয়ে এসে ভ্যানে তুলে দিচ্ছিল। ভিক্টিমদের ভ্যানে তোলার সময় বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার সুযোগে মেয়ে ভলান্টিয়ারটি উপরতলায় দৌড়ে যায় এবং ওয়ার্ডের স্টোর রুমে লুকিয়ে পড়ে।
    “সেখান হতে সে চাকমা চীফ রাজা দেবাশীষ রায় সহ অন্যদের ফোন করে কি ঘটনা ঘটেছিল তা জানায় এবং এও জানায় যে, রাণী কোথায় আছেন সে জানে না, যখন রাণীকে টেনে হিঁচড়ে হাসপাতালের পেছনের দরজার দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন সর্বশেষ দেখতে পায়। সেসময় চাকমা চীফ যিনি হাই কোর্ট ডিভিশনের একজন আইনজীবী এবং তিনি এই বিষয়টি নিয়ে মহামান্য হাই কোর্ট “ডিভিশন এবং মহামান্য আপিল বিভাগের চেম্বার জজকে জানানোর পর তিনি ঢাকা থেকে বিমানযোগে চট্টগ্রামে ফিরছিলেন।”

    রাজা দেবাশীষ রায়, চাকমা রাজা
    রাণী য়েন য়েন, চাকমা সার্কেল উপদেষ্টা
    রাঙ্গামাটি, পার্বত্য চট্টগ্রাম, তারিখঃ ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ "



    পাহাড়ে পাকিপনা চলবে না!
    ফ্লাশব্যাক-১
    ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের সময় বর্বর পাকিস্তানী সেনা বাহিনী এদেশের মানুষের ওপর যে হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ, জ্বালাও-পোড়াও নির্যাতন চালিয়েছিল, সে একই রকম পাকিপনা যেন চলছে পাহাড়ে অন্তত চারদশক ধরে। আর এসব ঘটনা ধামাচাপা দিতে গিয়ে নিরাপত্তা বাহিনী একের পর এক আরো ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে।
    পাহাড়ের সূত্রগুলো জানাচ্ছে, রাঙামাটির বিলাইছড়ির দুর্গম ফারুয়ার তক্তানালায় মারমা আদিবাসী গ্রামে গত ২২ জানুয়ারি রাতে সেনা বাহিনী সন্ত্রাসীদের সন্ধানে অভিযান পরিচালনা করে। অভিযোগে প্রকাশ, এসময় সেনা সদস্যরা দুই মারমা বোনদের একজনকে ধর্ষণ ও আরেকজনকে যৌন হয়রানি করে। বলা ভাল, জুম চাষী (পাহাড়ের ঢালে বিশেষ চাষাবাদ) হতদরিদ্র এই পরিবারটি মোটেই বাংলাভাষা বোঝেন না। মূলধারার গণমাধ্যমে ঘটনাটি সেভাবে প্রকাশ না পেলেও স্যোশাল মিডিয়াতে এই ঘটনা তোলপাড় ফেলে।
    ঘটনা ধামাচাপা দিতে কিছুদিন আগে স্থানীয় একজন মারমাভাষী আওয়ামী লীগ নেতা দুই বোনের বাবা-মাকে জেলা শহরে এনে রাঙামাটি প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। সেখানে তিনি বাংলায় দেওয়া বক্তব্যে দাবি করেন, ওইদিন মারমা গ্রামে সেনা সদস্যরা প্রবেশ করেনি, এমনকি কোনো ধর্ষণের ঘটনাও ঘটেনি! তবে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত মেয়ে দুটির ছোটভাইয়ের বক্তব্যে বেড়িয়ে আসে থলের বেড়াল। মারমা সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে নিজ ভাষায় কিশোর ছেলেটি জানায়, সেনা সদস্যরা মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে সেদিন রাতে তাদের ঘরে প্রবেশ করে। বাইরে বন্দুক নিয়ে টর্চ হাতে পাহারায় ছিল আরো কয়েক সেনা সদস্য। এ সময় ঘরের ভেতর থেকে দিদিদের চিৎকার ভেসে আসে। গ্রামবাসী ভয়ে কেউ এগিয়ে আসেনি!...

    ফ্ল্যাশব্যাক-২
    গত বছর ১৯ এপ্রিল দুপুরে রাঙামাটির নান্যাচর কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী রমেল চাকমা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এর আগে ৫ এপ্রিল সকালে নান্যাচরে সেনাবাহিনী কর্তৃক আটক ও অমানুষিক নির্যাতনে গুরুতর আহত হয়েছিলেন রমেল। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি নাকী, শান্তিচুক্তি বিরোধী পাহাড়িদের গ্রুপ ইউপিডিএফের চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসী ছিলেন!
    মানবাধিকার কর্মীরা সে সময়েই প্রশ্ন তোলেন, রমেল চাকমা সন্ত্রাসী হলে তাকে পুলিশে হস্তান্তর করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হল না কেন? তাকে সেনা হেফাজতে পিটিয়ে মেরে ফেলতে হবে কেন?
    নিহত রমেল ছিলেন নান্যাচর উপজেলার পূর্ব হাতিমারা গ্রামের কান্তি চাকমার ছেলে। তিনি ডানচোখে দেখতে পেতেন না। মারা যাওয়ার আগে গুরুতর আহত অবস্খায় রমেল সেনা নজরদারি ও পুলিশের পাহারায় দু’সপ্তাহ ধরে ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। পড়ে তার লাশটিও পরিবারের কাছে হস্তান্তর না করে সেনা হেফাজতে পুড়িয়ে দেওয়া হয় অভিযোগে প্রকাশ।
    সে সময় রমেলের মরদেহ চেয়ে সরকারি কর্তাদের কাছে তার বাবার লেখা আবেদনপত্র ফেসবুকে ভাইরাল হয়। এ ঘটনা পাহাড় ও সমতলে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দেয়। মূল ধারার গণমাধ্যমে রমেল “হত্যাকাণ্ড” সংবাদ সেভাবে না এলেও স্যোশাল মিডিয়া ও মুক্তমনাসহ বিভিন্ন ব্লগে প্রতিবাদের ঝড় তোলে। লক্ষ্যনীয়, খুব সফলতার সঙ্গেই অভিযুক্ত সেনা সদস্যরা থেকে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে।

    ফ্লাশব্যাক-৩
    পাহাড়ে মানবাধিকার লংঘন, তথা পাকিপনার সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক ঘটনাটি ঘটেছিল আরো আগে, ১৯৯৬ সালে। সে বছর ১২ জুন রাঙামাটির বাঘাইছড়ির নিউ লাইল্যাঘোনা থেকে অপহৃত হন হিল উইমেন্স ফেডারেশন নেত্রী কল্পনা চাকমা। অভিযোগে প্রকাশ, লাইল্যাঘোনা সেনা শিবিরের লেফটেনেন্ট ফেরদৌস ও কয়েক ভিডিপি সদস্য অস্ত্রের মুখে কল্পনা চাকমাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যান।
    কল্পনা চাকমাকে উদ্ধারের আন্দোলন সে সময় পাহাড়ে তো বটেই সমতলেও তোলপাড় ফেলে। ক্ষোভ-বিক্ষোভে কল্পনা পরিনত হন আন্তর্জাতিক সংবাদে। এই ঘটনায় প্রথমবারের মতো জাতীয় জীবনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, এতো বছর ধরে সন্ত্রাসী নিধনের নামে কী চলছে পাহাড়ে? স্বাধীন বাংলার সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাহলে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর পার্থক্য কী?
    এরপর গত ২২ বছরে কাচালং, মাইনি, চেঙ্গী, শঙখ, মাতামুহির অনেক জল গড়িয়েছে। কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলার শুনানীর তারিখের পর তারিখ পড়েছে। কিন্তু অভিযুক্ত লেফটেনেন্ট ফেরদৌস ও তার তিন সহযোগিদের কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারেনি আইন-শৃংখলা বাহিনী। পাহাড় ও সমতলের তীব্র প্রতিবাদকেও আমলে নেয়নি সরকার।

    ফ্ল্যাশব্যাক-ইনফিনিটি
    স্মরণ করিয়ে দেই, পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের (২ডিসেম্বর, ১৯৯৭) আগে পাহাড়ে লোগাং, লংগদু, নান্যাচর, দীঘিনালা, বরকলসহ অন্তত ১৩টি গণহত্যা হয়েছে। পাহাড়ে অভিবাসিত (সেটেলার) বাঙালি ও সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ হামলায় একের পর এক উজাড় হয়েছে পাহাড়ি জনপদ, হয়েছে গণধর্ষণ, লুন্ঠন, অগ্নিসংযোগ।
    আর শান্তিচুক্তির পরে গণহত্যা না হলেও একই কায়দায় অন্তত ১৬ বার পাহাড়ি জনপদে অগ্নিসংযোগ, লুন্ঠন ও ভিটেমাটি উচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে। এসবই ঘটেছে সেটেলার বাঙালিদের ফৌজদারি হামলায়, নেপথ্য শক্তি সেই সেনাবাহিনী।
    তাই পাহাড়ে আদিবাসী পাহাড়িদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়া সাম্প্রদায়িক সেটেলার শক্তি বরাবরই খুব সক্রিয়, আর তা উর্দির ইন্ধনেই।
    প্রসঙ্গত, এই লেখক নিজেই লোগাং গণহত্যা (১০ এপ্রিল, ১৯৯২) ও নান্যাচর গণহত্যা (১৭ নভেম্বর, ১৯৯৩) সরেজমিনে প্রত্যক্ষ করে এ নিয়ে তথ্য-সংবাদ ও ব্লগনোট লিখেছেন। আর শান্তিচুক্তির পর সেটেলার হিংসার আগুনে ভস্মিভূত রামগড়, বাঘাইহাটসহ একাধিক পাহাড়ি জনপদ উজাড় হওয়ার বিষয়েও সরেজমিন সংবাদ ও ব্লগ নোট লিখেছেন।

    বিচারপতি, তোমার বিচার করবে যারা
    এসব ঘটনা বার বার এটিই প্রমাণ করছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম যেন বাংলাদেশের নয়া উপনিবেশ! যেন ১৯৭১ বার বার ত্রাস হয়ে নেমে আসছে পাহাড়ি জনপদে। আসলে পাহাড়ে সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছে রাষ্ট্রের ভেতরে আরেক রাষ্ট্র। তারাই সেখানে হর্তাকর্তা, রথী-মহারথী ও গডফাদার। আর বন্দুকই সেখানে একমাত্র আইন। ইউএন মিশনে আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষায় ভূয়সী প্রশংসা কুড়ানো দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীই এখন নিজ দেশেই নেমেছে জাতিগত নিধনে, অনেকটা পাক সেনাদের ভূমিকায়। চাকমা রাণী য়েন য়েনের ওপর হামলার পর রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় এক সমাবেশে বক্তব্য রাখতে গিয়ে চাকমা ও বাংলা ভাষায় দেওয়া বক্তৃতায় বলেছেন, “তোমরা আমাকে মেরে ফেলতে পার, রাণীকেও মেরে ফেলতে পার, কিন্তু তোমরা জুম্ম (পাহাড়ি) জাতির সবাকেই মেরে ফেলতে পারবে না।”
    তিনি স্পষ্টই বলেন, “আমরা পাহাড়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসন চাই, সেনা শাসন চাই না।”
    রাজা দেবাশীষ আরো বলেন, “মানবাধিকার কর্মীর গায়ে হাত তোলা হয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কে? মানবাধিকার কর্মীরা, না তোমরা?”
    লক্ষ্যনীয়, চাকমা রাজার এই প্রশ্নটি গুরুতর।...

    সংযুক্তঃ ব্যরিস্টার দেবাশীষের বক্তব্য।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ০৫ মার্চ ২০১৮ | ৭৩০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • প্রতিভা | 125.96.158.189 (*) | ০৫ মার্চ ২০১৮ ০৬:৩৬84987
  • আমার চাকমা বন্ধুদের পোস্টে এসব পড়েছি। তারা ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীরর দ্রুত হস্তক্ষেপ জরুরী।
    লেখককে ধন্যবাদ এই লেখার জন্য। এই সাহসী মানুষগুলোর জন্য বাংলাদেশের উপর চিরকালের মায়া।
  • বিপ্লব রহমান | 129.30.45.85 (*) | ০৫ মার্চ ২০১৮ ১০:৩৬84988
  • মাফ করবেন। আমার মনে হয়, প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কোন স্থায়ী সমাধান নয়, আসলে দরকার বাংলাদেশের আদিবাসীর প্রতি শাসকগোষ্ঠীর দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। আরো চাই মৌলিক মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠা।

    আগ্রহের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
  • de | 24.139.119.171 (*) | ০৫ মার্চ ২০১৮ ১২:২৭84989
  • জানতে পেলাম - লেখককে ধন্যবাদ -
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে মতামত দিন