এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • হোক কলরব

    Vikram Pakrashi লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫ | ১৮৬৬ বার পঠিত
  • হোক কলরব

    হেমকণিকার মতো বিন্দু বিন্দু আলো মালা গেঁথে অন্ধকার কলকাতায় পিচঢালা রাস্তার ওপর দিয়ে সুদীর্ঘ পেশল সর্পিল পিচ্ছিলতায় ছড়িয়ে যায়। বিন্দু বিন্দু আলো হাতে বিন্দু বিন্দু উদ্ভাসিত মুখ অজস্র স্তব্ধদ্বার দোকান আর রুদ্ধবাক মানুষের সামনে দিয়ে পেরিয়ে যায়, তাদের মুঠো করা হাত অন্ধকার আকাশে ঘুষি পাকিয়ে গর্জন করে, যে গর্জনের ঢেউয়ের শেষে 'চাই' শব্দটি দূর দূর পর্যন্ত ধেয়ে যায়। শহরের পাণ্ডুর ত্রিফলা আলোর নিচে এলে সেই ভিড়ে খুদে খুদে বাচ্চাদের হাতে ধরা কার্ডবোর্ডের প্ল্যাকার্ডে রক্তলাল রঙে লেখা দৃশ্যমান হয় - 'উই ওয়ান্ট জাস্টিস'।

    বিচারের এই আকুল চিৎকার বাতাসে অশরীরির মতো বয়। মণিহীন বাচ্চাদের ফুসফুস থেকে সেই 'চাই' শব্দের উল্লাস মুখের ভাষা হয়ে প্ল্যাকার্ডে দৃশ্যমান, যে প্ল্যাকার্ডে অপরাধীর ফাঁসির তদ্বির করা হয়েছে - এই সেই জাস্টিস, যার মলমল বাঁধা চোখের সামনে তুলাদণ্ডের নিক্তির বিচারে পশুমানুষদের প্রকাশ্য ল্যাম্পপোস্ট থেকে দোদুল্যমান করতে চাই,তাদের দাঁড় করিয়ে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিতে চাই, কারাগারের মধ্যে কুপিয়ে তাদের চোখদাঁতনখ সব উপড়ে নিতে চাই - আর সেই গ্যালগ্যাল করে বেরোনো রক্তের সামনে এই অজস্র অহিংস অযৌন বাচ্চাদের দিয়ে হোক বিচারের কুচকাওয়াজ।

    মিছিল এগিয়ে চলে। স্লোগান দিতে দিতে বিন্দু বিন্দু আলোর মধ্যে ভিড়ের মধ্যে আরো পশুমানুষ রক্তবীজের মতো মিশে যায়। চোখের তারায় জাস্টিসের উল্লাস আর চোখের কেতুরে প্রচণ্ড লালসা নিয়ে তারা এই মূলতঃ অন্ধকার মিছিলে অতর্কিতে মেয়েদের শরীর হাতড়াতে থাকে, আর সে সব শরীরের অধিকারিনীরা বিদ্যুৎপৃষ্টের ন্যায় ছিটকে এগিয়ে যেতে থাকে, যতক্ষণ না সুবিচারের উত্তেজনায় মিছিলে মিশে যাওয়া এসব তরুণ, যুবা, প্রৌঢ়ের শ্বাস ঘন হয়ে আসে, কপাল থেকে টপটপ করে ঘাম পড়ে, হৎপিণ্ডের ধকধক শব্দে তাদের বুকটা একবার ওঠানামা করে ওঠে। তাদের স্পন্দিত শিশ্নের অগ্রভাগগুলি উদগ্রীব হয়ে তর্জনীর ন্যায় কাউকে অ্যাকিউজ করতে চায়। এরা, একা এবং কয়েকজন।

    কোনও কোনও মেয়ে পালাতে শুরু করে ডান-বাঁ দিকের গলি দিয়ে - এইসব ডেন্টেড-পেন্টেড মহিলারা পালাতে শুরু করে, তিরবেগে পালায় - খোলা সিঁড়ি পেয়ে ছাদে উঠে যায় - কেউ নিচু উঁচু বাড়ির ছাদের ওপর দিয়ে লাফিয়ে পাঁচিলে গেঁথে রাখা কাচের টুকরোর ওপরে রক্তাক্ত পায়ে কার্নিশে ভর করে ল্যাম্পপোস্টের কোনায় লুকিয়ে থাকে। ভীড় এদের ধাওয়া করে - অন্ধকার থেকে একটি একটি করে সেইসমস্ত মেয়েদের বেছে নিতে শুরু করে যাদের পোশাক উত্তেজক, যাদের কটাক্ষ বিলোল, যাদের চরিত্র স্খলিত, যাদের রূপটান অশ্লীল, যাদের হৃদয় স্বাধীন, যাদের চরণ রাতুল, সেই শঙ্খিনী, হস্তিনী, পদ্মিনী, চিত্রিনী ইত্যাদি ও অন্যান্য সকল লক্ষণযুক্তা নারীকেই ওরা বেছে বেছে নেয়। হেমকণিকার মতো বিন্দু বিন্দু আলো মালা গেঁথে অন্ধকার কলকাতায় পিচঢালা রাস্তার ওপর দিয়ে সুদীর্ঘ পেশল সর্পিল পিচ্ছিলতায় ছড়িয়ে যায়।

    আমরা মিছিলে অন্ধকার থেকে আলোকের দিকে এগিয়ে যাই। হাতে রংমশালের আলো নিয়ে, মোমবাতি নিয়ে, হ্যারিকেনের চারিদিকে অন্ধকার দোলাতে দোলাতে এগিয়ে যাই। নর্দমায় মুখ গুঁজে অচৈতন্য পড়ে থাকা মেয়েদের ডেকে ডেকে জিজ্ঞাসা করি তারা উঠতে পারবে কি না। আহত মুখের ওপরে আলো ফেলি, সেই কোজাগরী আলোয় তাদের মুখের রেখা যদি বা বিকৃত হয়, তাদের চোখের তারার ওপরে আলো ফেলি, যদি বা সেই আলোকরশ্মি ঝিলমিল তোলে, আমাদের হাত তাদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে পরীক্ষা করি তারা করমর্দন করতে পারে কি না। মিছিলের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দেহকাণ্ডগুলিকে জীবনের সাড়া মেলার জন্যে পরীক্ষা করি, বলি - তোমরা উঠতে পারছো না? উঠতে পারছো না?

    একটি যুবক, তারা সারা শরীরে অসংখ্য ভগচিহ্ন, সে আমাদের সাহায্য করতে চায়, হাত বাড়িয়ে আজকের খবরের কাগজ দেয়, বলে - কলেজ গার্ল সে পুরে বদন মাসাজ করওয়ায়েঙ্গে সার? ফুল প্যাকেজ ঘন্টে কা আঠারো-শ রুপিয়া। এই বলে সে খবরের কাগজের ফ্রেণ্ডশিপ কলামটির ওপর আঙুল ঠুকে ঠুকে এই ঘন্টাপ্রতি রেট এর সহি প্রমাণ আমাদের হাতে তুলে দিতে চায়, আমরা যেন প্রতারিত না হই। তোমার সারা শরীরে এ অবস্থা কী করে হলো, এইসমস্ত প্রশ্ন আমরা করি। জানতে পারি এই যুবক এমন অসংখ্য অসংখ্য অন্ধকার জাস্টিসের মিছিলে রকমারি নারীকে যাচ্ঞা করে, তাদের ঘর পর্যন্ত ধাওয়া করে, লোক ঢুকিয়ে বরবাদ করে দেয় - সেইসব বরবাদ হয়ে যাওয়া, শিক্ষা পেয়ে যাওয়া নারীসঙ্গের চিহ্ন এসব। অতঃপর মিছিলের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ তার পীতচক্ষু রিরংসায় ভরে যায়, তার মাথার ওপর একটি ভগচিহ্ন থেকে ভলকে ভলকে কবোষ্ণ নিঃসরণ হতে থাকে, আমরা সেসব মুছিয়ে দিয়ে এগিয়ে যাই। লোকটি পেছন থেকে করুণ আহ্বান করে - আমাকে ফেলে যাবেন না, আমার স্ট্রোক হচ্ছে। মিছিল এগিয়ে যায়, যুবকের মাথার ভগচিহ্ন থেকে ক্রমাগত নিঃসরণ হতে থাকে।

    মিছিল চলে যায়। মিছিল ভেঙে যায়। রাত নামে। একটা লঝঝড়ে ধূসর বাস থেকে সাত আটটা লোক মিলে একটি মেয়েকে দরজা থেকে জাস্ট বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়, সে তথাপি বেঁচে থাকে। একটা কালো অটোরিক্সা থেকে ফেলে দেওয়া আরেকটি মহিলা মাটিতে ছেঁচড়ে যায়। তার খামচে ধরা হাতের ফাঁক দিয়ে বাতাস মর্দিত হয়। সে তথাপি বেঁচে থাকে। একটা মোটরবাইক এসে ছোট্ট এক পাত্র অ্যাসিড আর একটি মহিলার মুখে ছুঁড়ে মারে এবং সেও বেঁচে থাকে। একটা শাদা প্রাইভেট গাড়ি, তার মধ্যে থেকে বাঁচাও বাঁচাও শব্দ আসে, গাড়িতে গান বেজে ওঠে (জিংগল বেল্‌স) ও সেই আওয়াজ আর শ্রুত হয় না। এর পরে পথের দুপাশে জানা-অজানা মধুচক্রে অকস্মাৎ পুলিশি রেড হতে শুরু করে। সেসব মধুচক্র, মধুশালার জানালা দিয়ে বিভিন্ন তলা থেকে কতগুলি নেশাগ্রস্ত পতিতাকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলা হয়। তারা ধুপধাপ শব্দে কার্নিশে ধাক্কা খেতে খেতে পড়ে। একটা বিশাল লাউডস্পিকারে ঘোষণা হয় - দয়া করে আমাদের প্রোভোক করবেন না। দোহাই আপনাদের। হেমকণিকার মতো বিন্দু বিন্দু আলো, মালা গেঁথে, অন্ধকার কলকাতায় পিচঢালা রাস্তার ওপর দিয়ে সুদীর্ঘ, পেশল, সর্পিল পিচ্ছিলতায় ছড়িয়ে যায়।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫ | ১৮৬৬ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    ভগীরথ - Vikram Pakrashi
    আরও পড়ুন
    শপথ  - Prolay Adhikary
    আরও পড়ুন
    বকবকস  - Falguni Ghosh
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | 11.39.97.51 (*) | ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ১১:৪৪65802
  • উফফ

    ওয়েল্কাম্ব্যাক
  • 0 | 132.163.78.110 (*) | ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ১১:৫৪65803
  • জেনেরালি ভিকিদার লেখা যেমনি হয়, তার চেয়ে অন্যরকম। বিষন্ন, ব্যথিত লেখা।
  • R | 131.241.218.132 (*) | ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ১২:১৬65804
  • কমল কুমার আর অ্যালান পার্কারের (পিঙ্ক ফ্লয়েড) ওয়াল, এই দুটোর কথা মনে পড়ে গেল। স্টাইল আর কনটেন্ট - যথাক্রমে।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে মতামত দিন