এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • গোরা নকশাল

    Kallol Lahiri লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১৩ মার্চ ২০১৬ | ২১৮১ বার পঠিত | রেটিং ৪.৫ (৪ জন)
  • এক
    'কিছুটা থাক আলগোছেতে...কিছুটা থাক কাছে...কিছু কথা ছড়িয়ে পড়ুক...চেনা আলোর মাঝে...।''

    খুব সকালে ঘুম ভাঙতে চাইতো না আমার। লেপের পরে লেপ, চাদরের পরে চাদর এর গা থেকে ওর কাছ থেকে, ছেড়ে যাওয়া বিছানা থেকে টেনে টেনে গায়ে চলে আসতো আমার। লম্বা চাটাইয়ে স্যাঁতসেঁতে পলেস্তারা খসা ঘরে শুয়ে থাকতো ওপার বাংলা থেকে অনিচ্ছায় আসা উদ্বাস্তু মানুষ গুলো। আমিও তাদের মধ্যে কুন্ডুলী পাকিয়ে লেপ, চাদর আর কাঁথার পাহাড়ের মধ্যে সেঁধিয়ে থাকতাম। সকালের রোদ আমাদের বালীর বাসায় ঢুকতো না একটুও। কিন্তু মায়ের উনুনের ধোঁওয়া সারা ঘর ছেয়ে ছোটো ছোটো ঘুলঘুলি দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতো পাশের বাড়ির ডুমুর গাছের পাশ দিয়ে, শেফালীদের পাতকোয়া পেরিয়ে অনেক দূরে আমার না দেখা কোনও এক মাঠের দিকে। পাশে বসা দাদার কম্বল জড়িয়ে সকাল সকাল জোরে জোরে পড়া মুখস্থতে আমার ঘুম ভেঙে যেত। আমারা পিসিকে মণি ডাকতাম। সেই যে কবে ছোট্টবেলায় বিধবা হয়ে আমাদের বাড়ি চলে এসছিলো আজো কেউ মনে করতে পারে না। এমনকি ঠাম্মাও না। মণি ডিসেম্বরের সেই শীতের সকালে গঙ্গায় স্নান করতে যাওয়ার উদ্যোগ নিতো। বাবার পরের সবচেয়ে রুগ্ন ভাইকে আমরা ডাকতাম ‘হাঁদা’ বলে। হ্যাঁ তখন সেই আশির দশকের গোড়ায় হাঁদা-ভোঁদা খুব পপুলার আমাদের মফস্বলের শহরে। কমলা রঙের চটি বই গুলো হাঁদাই কিনে দিতো আমাকে আর দাদাকে। মাসের প্রথমের ‘শুকতারা’ নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়তো। হাঁদা ঘুম থেকে উঠতো সবার আগে। সকালের আহ্নিক সেরে বাবার কিছুদিন আগে করে দেওয়া ছোট্ট চায়ের দোকানটা খুলতে ব্যাস্ত হয়ে পড়তো হাঁদা। আমার কানে এসে পৌঁছোতো বাবারই গত রাতে পড়া সহজ পাঠের কবিতার একটা লাইন। “আমলকি বন কাঁপে যেন তার বুক করে দুরু দুরু/ পেয়েছে খবর পাতা খসানোর সময় হয়েছে শুরু।” বই গুলো স্কুলে জমা দেওয়ার আগে বাবার মনে হতো যেগুলো ভালো, যেগুলো সুন্দর, সেগুলো আরও একবার যদি পড়া যায়। আমি ঢুলতাম, বাবা গড়্গড়িয়ে পড়ে চলতো। কখোনো সখনো দাদা ধুয়ো ধরতো এসে। হ্যারিকেনের তেল যতক্ষণ না শেষ হয়, সারাদিনের ক্লান্ত মাখা মানুষ গুলো বাবার পাঠ চুপটি করে শুনতো।ঠাকুমা তার মাঝেই একবার জেনে নিতে চেষ্টা করতো কবে রিলিফ ক্যাম্প খুলবে? কবে তার ছানি অপারেশান হবে। দাদা লাইব্রেরী থেকে যে বই গুলো নিয়ে এসেছে সেগুলো যে একটাও পড়া হচ্ছে না তার। সেই রাতের ঢুলুনির মধ্যেই আমি তক্কে তক্কে থাকি আজ একাদশী, আজ ঠাকুমা নলেন গুড় মেখে খই খাবে। দুধ পাওয়া যায়নি। দুধকাকু বলে দিয়েছে হরিণঘাটার দুধের দাম বেড়েছে। আসতে আরো পাঁচ-ছয় দিন লাগবে। ঠাম্মা হ্যারিকেনের সেই নরম আলোয়, ওপার বাংলা থেকে আনা পদ্মকাটা কাঁসার বাটিতে একটু একটু করে জল ঢালে আর মিইয়ে যেতে থাকে খই গুলো। গলার কাছে কোঁচা দেওয়া চাদরে ঢাকা আপাদমস্তক আমি অপেক্ষা করি, অপেক্ষা করি কখন ঠাম্মা আমার হাতে তুলে দেবে একদলা জল মাখা খই। আমি সেই খই মাখা খেতে খেতে গল্প শুনবো আওটা দুধের। পাখা দিয়ে বাতাস করা লোহার কড়াইয়ের ঘন সরের। বাগানের ডয়রা কলার। ঠাম্মা আস্তে আস্তে খেতে খেতে আমার তো অনেকটা খাওয়া হয়ে যায়। দুধহীন একাদশীতে বাটির শেষ জল মাখা খইটুকু যাতে বাড়ির সবচেয়ে বয়জ্যেষ্ঠ মানুষটার পেটে যায় তা নিশ্চিত করতে মা আমাকে প্রায় জোর করে সেখান থেকে নিয়ে যায়। আমি রাগ করে শুয়ে পড়ি। খাই না। রোজ রোজ ফুলকপি খেতে আমার ভালো লাগে না। বাবা কি একটু পেঁয়াজ কলিও আনতে পারে না? আমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কোনো লোক থাকে না। কোথাও যেন মায়ের ওপর গভীর অভিমান, রাগ আমার দুচোখ জড়িয়ে ঘুম নামায়। আমি স্বপ্নে দেখি ঠাম্মার কোলাপোতার গোয়াল ঘরটাকে। দুধে ভর্তি লোহার সেই বড় কড়াইটাকে। তার ওপরে আসতে আসতে জমতে থাকা সরের প্রলেপটাকে। ঠাম্মা বলেছে, বাবাকে একদিন বলবে সর জমিয়ে রাবড়ি করতে। ঘুমের মধ্যে এইসব পাক খেতে খেতে সকাল নামে। লেপ টেনে নিতে থাকি… দাদার পড়ার শব্দ শুনতে পাই…আমার চারপাশে জমতে থাকে উনুনের ধোঁওয়া।

    লেপটাকে একটু ফাঁক করে বেলা বোঝার চেষ্টা আমার বৃথা যায়।কারণ ঠান্ডা লেগে চোখ পিচুটিতে ভর্তি। বন্ধ হয়ে গেছে চোখ দুটো নিজে থেকে। আমার ভয় লাগে। আর যদি না খোলে চোখ দুটো? আমার ভয় লাগে অন্ধকারে। আমি হাতড়াই। তাড়াতাড়ি সরিয়ে ফেলি আমার গায়ের চাদর, লেপ, কাঁথা…স্তুপাকৃতি জড়তা। আমি প্রানপণে দাদাকে খোঁজার চেষ্টা করি। দাদা বসে নেই কাছে। পড়ার আওয়াজ শুনতে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি মাকে ডাকি। মা শুনতে পায় না। বাইরে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের ধারে কারা যেন পিকনিক করতে যাবে বলে টেম্পোতে জোরে জোরে গান চালাচ্ছে।আমি ভয় পাই। ভীষণ ভয়। মণির কাছ থেকে শোন, মণির দেশের আমার না দেখা সেই আশশ্যাওড়া গাছের কথা মনে পড়ে। সেই দুষ্টু মামদোটার কথা মনে পড়ে। যে লেপের তলায় হিসি করা ছেলেদের ঘাড়ে চাপতো আর কুট কুট করে চিমটি কাটতো। অনেক দিন হলো আমি আর হিসি করিনা বিছানায়। সত্যি মামদো। একটুও ভিজে নেই শতরঞ্চি, তোষক কিছুই। ডাক্তার কাকিমা আমাকে অনেক গুলো কৃমির ট্যাবলেট দিয়েছে। সব খেয়েছি। আমি আর রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হজমি ওয়ালার কাছ থেকে ‘পচা কুলের’ আচার খাই না। বিশ্বাস করো। মনে মনে যত বিড়বিড় করি ততই শরীরের গভীর গহণ কোনে ভয়টা আমার সেঁধিয়ে যেতে থাকে। মাকে ডাকি, মণিকে ডাকি, হাঁদাকে ডাকি, দাদাকে ডাকি, কেউ সাড়া দেয় না। চোখ বন্ধ করা চারপাশের অন্ধকার নিয়ে আমি এগোতে থাকি। আর বিপত্তিটা সেখানেই হয়। লেপ, চাদর, বালিশ কাঁথা জড়িয়ে আমি সটান আছাড় খাই মেঝেতে। সেই প্রথম আমার মাথা ফাটে।

    কানের পাশ দিয়ে চটচটে কি একটা জিনিস গড়িয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারি না। মায়ের কান্নার শব্দ শুনতে পাই। ডাক্তার কাকিমা ঝুঁকে পড়ে ছুঁচ ফোটায় আমার কপালে। আমি চিতকার জুড়ি। কিন্তু হাত পা ছুঁড়তে পারি না বড় একটা। কেউ যেন আমাকে চেপে ধরে আছে। কোনোরকমে চোখটা খোলার চেষ্টা করি। দেখি একজন আমাকে কোলের মধ্যে আঁকড়ে ধরে বসে আছে। তার শাদা রঙের পাঞ্জাবি লাল হয়েছে আমার রক্তে। সকালের এক চিলতে রোদ্দুর এসে পড়েছে লোকটার মুখে। একগাল ভর্তি দাড়ি… কোঁকড়ানো কালচে দাড়ি নিয়ে লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে কি? ওমা তাইতো হাসছেই তো। আমার আরও কান্না পায়। আমার কষ্টে লোকটা কষ্ট পায় না, হাসে! তাহলে কি এই সেই মণির জ্যান্ত মামদো? কোল থেকে নামতে চাই। ছটফট করতে থাকি। লোকটা আরো জোরে জাপটে ধরে আমাকে। কিছুক্ষণ পর খাটের ওপর শুইয়ে দেয়। বাবাকে বলতে শুনি “গোরা চা খেয়ে যাস।” লোকটা বসে না। খোঁড়াতে খোঁড়াতে এগিয়ে যায় দরজার দিকে। এমন ভাবে খোড়াচ্ছে যেন মনে হয় হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে লোকটার। আমার সেটা দেখে এক অদ্ভুত নৃশংস আনন্দ হয়। চিতকার করে বলি “ঠিক হয়েছে...আমাকে চেপে ধরেছো তো...তাই ভগবান তোমার পাটা মুচকে দিয়েছে।” ঠিক তখনি অপ্রত্যাশিত ভাবে বাবা চিতকার করে ওঠে “টুকনু”। দাদা অঙ্ক করতে করতে মুখ তুলে চায়। মা রান্না ঘর থেকে ছুটে আসে। লোকটা দাঁড়ায় না। একবার পেছন ফিরে তাকিয়ে হাসে। আস্তে আস্তে বেরিয়ে যায়। মা এসে আমার ওই ব্যান্ডেজ বাঁধা গালেই একটা থাপ্পড় কষিয়ে দেয়। মাকে কেউ বাধা দেয় না। মণি আহা উহু করে এগিয়ে আসে না। ঠাম্মা অনেক বারের মতো এবার চিতকার করে বলে না... “ নিজেদের রাগ গুলা ওদের ওপর চাগাও ক্যান”। ফিসফিসিয়ে বাবাকে বলতে শুনি, আর কোনোদিন বোলো না টুকনু। ওর পা দুটো পুলিশ মেরে মেরে ভেঙে দিয়েছে। চিতকার করে বলি “বেশ করেছে...। পুলিশ তো দুষ্টু লোকদের মারে।” মা আবার তেড়ে এসেছিলো। কিন্তু মারতে পারেনি তার কারণ সেই একগাল দাড়ি ওয়ালা লোকটা হাতে শালপাতার ঠোঙা নিয়ে আমার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো এসে আবার। আমাদের বাড়ির সেই আসূ্য্যস্পর্শা দেওয়ালের ফাঁক দিয়ে এক চিলতে রোদ এসে পড়েছিলো সেই লোকটার মুখে। তার শাদা পাঞ্জাবিতে লেগেছিলো আমারই রক্তের দাগ। লোকটা অমিলন হাসিতে ভরিয়ে দিচ্ছিলো আমার সারা সকালটা। খোঁড়াতে খোঁড়াতে এগিয়ে আসতে গিয়ে বলেছিলো, “টুকনু শুনলাম জিলিপি খেতে ভালোবাসে।” এক ঠোঙা জিলিপি ধরে সেই শক্ত দুটো হাত। আরো অনেক পরে জানতে পারবো, যে হাত গুলো থেকে খুবলে নেওয়া হয়েছিলো মাংস। ঠাম্মা অস্ফুট স্বরে শুধু বলে... “সেই ওরা তোকে ছাড়লো...কিন্তু মাটাকে যদি একবার শেষ দেখা দেখতিস...। গোরা গোরা করে...”। বাবা এবার ধমকায় ঠাম্মাকে। বাবার বকুনিতে চুপ করে ঠাম্মা। মা নিয়ে আসে গরম রুটি, নলেন গুড়, আর লিকার চা। দুধ আসা বন্ধ। কারণ এই মাসে বাবার স্কুলের মাইনে হয়নি। শিক্ষকরা কিসব যেন আন্দোলন করছে। আন্দোলনের কথা শুনলে লোকটার চোখ চিক-চিক করে ওঠে। আমি সেই শীতের কুয়াশা ঘেরা সকালেও খুব যেন দেখতে পাই গভীর গহন চোখ দুটো। “কিছু বলবি না গোরা তুই?” বাবার কথার জবাবে লোকটা শুধু বলে, “অনেক কাজ পড়ে আছে রবিদা। জেলের জামা কাপড় গুলো কাচতে হবে। নদীর ধারে চিলে কোঠার ঘরটা একটু ঝাড়তে হবে। বই গুলোও অনেকদিন...”। রোদ সরতে থাকে। লোকটাও খোঁড়াতে খোঁড়াতে এগিয়ে যায় সদর দরজার দিকে। ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সবাই লোকটার পিছু পিছু।

    দাদার দিকে তাকাই। “কেরে দাদা?” দাদা অঙ্কর খাতা থেকে মাথা তুলে বলে, “চিনিস না?” আমি ঘাড় নাড়াই, “না”। দাদা বলে “গোরা নকশাল”। কথাটা আমার কানে বাজতে থাকে। হাঁদার একটা পোষা পায়রা আছে তার নাম নকশাল। হাঁদা বাঁশ দিয়ে হই হই করে সেই পায়রাটাকে ওড়ায়। হাঁদার খুব দুঃখ আমাদের বাড়ির ছাদ নেই। মানে ছাদে যাওয়ার অনুমতি দেয় নি বাড়িওয়ালা। কিন্তু নকশাল ছাদে যায়। নকশাল রেলিং এ বসে। নকশাল মনের সুখে রোদ পোহায়। সেই রকম নকশাল? দাদা ঘাড় নাড়ে। “না”। দাদা গম্ভীর। ওর ঠোঁটের ওপর একটা কালচে রঙের রেখা উঠছে। সেটা যত গাঢ় হচ্ছে দাদা তত গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে। ইদানিং আবার মাঝে মাঝে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে আর রেখাটাকে দেখছে। একবার নয় অনেকবার, বারবার। মা বলেছে দাদা বড় হয়ে যাচ্ছে। সেই বড় হতে থাকা দাদা আমার দিকে তাকিয়ে বলে, “নকশাল হলো তারা...যারা মনে করতো একদিন সব কিছু পালটে দেবে।” আমি জিভ উল্টোই, “এই ঘেঁচু...। কিচ্ছু জানিস না তুই। আসলে ওটা পায়রার টাইটেল। যারা ভালো উড়তে পারে তাদের নকশাল বলে। দেখিস না হাঁদার নকশালকে?” দাদা বেশি কথা বাড়ায় না। ক্লাসে ফাস্ট হয়। কেউ ওর কথা এমন তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে না। আরো গম্ভীর হয়ে যায় সে। পাপ্পু খেলতে আসে। আমার খেলা হয় না। কারণ বেঁহুশ জ্বর আমাকে ঘিরে ধরেছে। মাথা ফাটার সাময়িক ধাক্কাটা আমি আস্তে আস্তে টের পেতে থাকি। চারপাশে আঁধার নামতে থাকে। আমার আর কোনো জ্ঞান থাকে না। সেই অন্ধকারের মধ্যে দেখতে পাই শাদা পাঞ্জাবি পরা গোরা নকশাল আমাকে চেপে ধরে আছে। গোরা নকশালের শাদা পাঞ্জাবী আমার রক্তের রাঙা। আর দাদা বলে চলেছে “নকশাল হলো তারা...যারা মনে করতো একদিন সব কিছু পালটে দেবে”। জ্বরের ঘোরে আমার চোখের সামনে কোথা থেকে যেন মামদো উধাও হয়। গোরা নকশাল উজার হয়ে থাকে।ঠাম্মা বাবাকে ফিসফিস করে কিসব যেন বলতে থাকে। অনেক রাত…, পুলিশের জিপ…। আমি ঘুমিয়ে পড়তে থাকি। আমার মাথায় তখন মায়ের হাত। আমার মাথায় তখন জল পট্টি। সোনার কাঠি আর রূপোর কাঠি ছুঁইয়ে কেউ যেন আমাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখছে অনেক দিনের জন্যে।হাঁদার সেই ধপধপে সাদা পায়রা নকশাল আমার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছে। আমি দাদাকে বলছি নকশাল আসলে পায়রাদের টাইটেল। তারপর কিছু মনে নেই। ছোটদের সব কিছু মনে রাখা উচিত নয়। আসলে ওগুলো সব স্বপ্ন…কিম্বা…গল্প…আসলে যা শুনছো…দেখছো সবটাই ম্যাজিক…। ম্যাজিক দেখাতে দেখাতে একটা ফেরিওয়ালা আমাকে আর দাদাকে বলেছিলো। আজ সকালে আমার সামনে এমন একটা ম্যাজিক হয়েছে। আমি সারা জীবনের জন্যে গোরা নকশালকে পেয়ে গেছি! (ক্রমশ...)


    দুই

    “যাদের সামনের পথটা অজানা...আর পেছনের পথটা বিস্মৃত...তারাই গোলকধাঁধার পথে অন্তরীণ...”

    হাতে ধরা আমার মুঠো ফোন বিপ বিপ করে বেজে ওঠে। শীতের রাত চিরে ছুটছে সেদিনের শেষ ডানকুনি লোকাল...আমি ছুটছি বাড়ি...সারাদিন আমাকে ক্লান্ত করে রেখেছে কয়েকটা মিটিং...সারাদিন ক্লান্ত আমি না করা কাজের চাপে। মুঠোফোন বেজে যায়। ওপার থেকে ভেসে আসে খুব কাছের এক বন্ধুর গলা...
    “হাতে কিছু কাজ আছে?”
    মানে?
    “না...কোনো কিছু করছিস কি এখন?”
    বাড়ি যাচ্ছি...।
    “উফ...তুই বড্ড এঁড়া টাইপের ছেলে মাইরি...জানতে চাইছি এখন ব্যাস্ততা কেমন?”
    কেনো বলতো?
    “শোন...ওই যে তোর একটা ছোট লেখা বেরিয়েছিলো না...।”
    ফিল্মের রিভিউ?
    “উফ না...না...।
    মেগা সিরিয়াল?
    “সেটাও আজকাল ছাপাচ্ছিস নাকি? পাবলিক মাইরি তুই...”
    কোনটা বলতো...ঠিক বুঝতে পারছি না...আমার ব্লগে?
    “সেটা আমার মনে থাকলে তো হয়েই যেত...। ওই যে যাত্রা নিয়ে লেখার সময়...কে একজন মারা গেলেন না...”।
    শান্তি গোপাল?
    “রাইট...হ্যাঁ হ্যাঁ...। ওই লেখাটা।”
    তোর চাই?
    “না। শোন আগে কথাটা...ওই লেখাটাতে... খুব ছোট করে লিখেছিলিস...ওই যে তোর কাকা না কে...নকশাল নকশাল...!”
    গোরা নকশাল?
    “হ্যাঁ...হ্যাঁ...একদম ঠিক...শোন ওই লোকটাকে নিয়ে ছবি করতে চাই...”
    ফিল্ম?
    “একদম...।”
    হঠাৎ? আর কোনো সাবজেক্ট পাচ্ছিস না বুঝি?
    “তোকে এতো কিছুর জবাব দিতে পারবো না ফোনে...আর তেমন কিছু তোকে করতেও হবে না। শুধু নিজের মতো করে লিখে যেতে হবে।”
    লিখে যেতে হবে মানে?
    “আরে একটা পার্সোনাল জার্নি...সহজে কিছু বোঝানো যায় না তোকে”।
    গোরা নকশালকে নিয়ে?
    “রাইট...বেঁচে আছে না লোকটা এখোনো?”
    হ্যাঁ...মানে...না...মানে...
    “কী মানে মানে করছিস?”
    আসলে সবটা সত্যি নয়...।
    মানে?
    মানে ওটা একটা গল্প...কিছু মানুষের...। যাদের কাছে স্বাধীনতা মানে ছিলো দেশ ভাগ... যারা ভেবেছিলো আবার একদিন তারা ফিরে যেতে পারবে নিজের দেশে...নিজের গ্রামে...। কিন্তু হয়নি...। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের নায্য দাবীতে যারা একসময় পথে নেমে ছিল...যাদের কাছে বেঁচে থাকাটা পুরোটাই স্বপ্ন আর স্মৃতি...
    “থাক...থাক...পলিটিকাল এজেন্ডা দাঁড় করিয়ে দিচ্ছিস তো..এর মধ্যে গোরা নকশাল কোথায়...?”
    আছে...।
    “স্বপ্নে না স্মৃতিতে?”
    সিনেমায়...।
    “লিখবি? সত্যি তুই লিখবি আমার জন্য?”
    হ্যাঁ...।

    ফোন কেটে যায়। বালী বিজ্রের ওপর দিয়ে ছুটে চলেছে ট্রেন। গঙ্গার ঠান্ডা হাওয়া এসে লাগছে আমার চোখে মুখে। আমি ফিরে যাচ্ছি আমাদের লোড শেডিং এর দিন গুলোয়...ফিরে যাচ্ছি সেই বয়েসটায় যেখানে বড় হওয়ার বড্ড তাড়া ছিলো। মা থার্মোমিটারটা আমার মুখ থেকে নিয়ে নিচ্ছে...। একটু হাসছে...। জ্বর আর নেই...। তিনদিনের পরে আমার তপ্ত গা ঠান্ডা হয়। সারা রাত জাগা মায়ের মুখটা অনেকদিন পরে খুব দেখতে ইচ্ছে করে। ট্রেন থেকে নেমে আমি বাড়ি যাই। আর ওদিকে পুলিশের গাড়ি থেকে ঠেলে নামিয়ে দেওয়া হয় গোরা নকশালকে। এক মাঘের শীতের রাতে, জমকালো আঁধারে। খোঁড়াতে খোঁড়াতে গোরা নকশাল এসে বসে খেয়া ঘাটে। যেখানে মাঝিরা শুকনো পাতা জড়ো করে আগুন জ্বা্লিয়েছে। গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে আছে সবাই। বুড়ো শিব প্রামানিক সেই আগুন আলোর ধোঁওয়ার মধ্যে গোরা নকশালকে ঠিক চিনে নেয়। গোরা না? হ্যাঁ তাই তো...। কবে এলো এই মানুষটা? কবে ছাড়া পেলো? সেই যে একবার পুলিশের তাড়া খেয়ে লোকটাকে নদী পার করে দিয়েছিলো শিব...। তারপর আর দেখেনি কোনোদিন। শুনেছিলো জেলে আছে। পচছে। এর মধ্যে কত কি তো ঘটে গেলো। কত কচি কচি ছেলের লাশ গঙ্গা দিয়ে ভাসতে দেখলো শিব। কংগ্রেস গেলো...যুক্ত ফ্রন্ট এলো...আবার কংগ্রেস...। এখন আবার লাল পার্টি এসেছে। শিব একবার লরি করে ময়দানে গিয়েছিল। বিশাল জমায়েত দূর থেকে অনেক উঁচু মাঁচার ওপর এক লোককে দেখেছিল শিব। বেঁটে খাটো চশমা পরা লোকটা নাকি এবারের মুখ্যমন্ত্রী। গরীবের বন্ধু...। “হাঁ গা...লোকটার নাম কী?” রুটি ভেলিগুড় দেওয়া অল্প বয়স্ক ছেলেটা তাকিয়ে ছিল এক মুহূর্ত তার অনেক পাওয়ারের চশমার ফাঁক দিয়ে। “উনি কমরেড জ্যোতি বসু।” শিব অনেক দূর থেকে গরীবের বন্ধুকে দেখেছিল। সব কথা বুঝতে পারেনি সেদিন...। শিব সব কথা বুঝতে পারে না। আবার আগের মতো গঙ্গায় মাছ এলেই হয়...। ইলিশের মরশুমে তেমন তো মাছ উঠলো না...। বউটা অসুস্থ, ছেলেটার জুটমিলে কিসব গন্ডগোল শুরু হয়েছে। খুব টাকার দরকার শিবের।

    গোরা নকশাল নদীর রাস্তার দিকে তাকায়। একদল মানুষ গোল হয়ে বসে আগুন পোহায়। সেই কবে থেকে যেন মানুষ এমন করেই আগুনের ধারে বসে আছে। সেই কবে মানুষ জোটবদ্ধ হলো। তাদের নিজেদের কথা নিজেরাই গুছিয়ে বললো। ভাবতে গেলে মাথা টনটন করে গোরা নকশালের। কতদিন পরে সে জেলের বাইরে পা রাখলো। গল্প শুনতে ভালো লাগে তার। মানুষ গুলোর মাঝে এসে বসে। আগুনের সামনে। খোলা আকাশের দিকে তাকায়। অনেক দিন পর সে রাত দেখছে...অনেক দিন পর সে ঠান্ডা বাতাসে। অনেকদিন পর সে মানুষের ঘামের গন্ধ শুঁকছে। অনেকদিন পর সে বুঝতে পেরেছে...আসলে সব কিছু পাল্টে দেওয়া যায় না। সব কিছু পালটে দিতে দেয় না মানুষ।

    হাঁটু মুড়ে বসতে পারে না গোরা। শিব এগিয়ে এসে ভাঙা একটা টুল এগিয়ে দেয়। শিব বলে “চিনতে পারছেন কত্তা?” গোরার চোখ চিক চিক করে ওঠে। শিব নৌকা বাইছে...আর পেছনে পুলিশের লঞ্চ...। গোরা কি ঝাঁপ দিয়েছিলো জলে? নাকি শিব পার করে দিয়েছিলো তাকে? গোরা মনে করার চেষ্টা করে। পারে না। অনেক কিছু মনে নেই তার। অনেক কিছু ভুলে গেছে। মাথায় ওরা লোহার বাঁট দিয়ে মারতো...। মাথাটা নীচের দিকে করে পাটা ঝুলিয়ে দিতো...। চোখের সামনে জ্বেলে দিতো একটা বাল্ব...। চোখের সামনে সেই উজ্জ্বল ধাঁধার নির্যাতিত আলোতে গোরা নকশাল দেখতে পেতো খুলনার প্রাথমিক স্কুলটাকে....। গোরা নকশাল দেখতে পেতো একুশে ফেব্রুয়ারীর অলৌকিক ভোর...। গোরা নকশাল দেখতো স্বাধীন বাংলাদেশ। গোরা নকশাল শুনতে পেতো “তোর পিঠে কাঁটা তারের দাগ”। এক উদ্বাস্তু নকশাল হয়েছে বলে পুলিশ গুলো হাসাহাসি করতো। গোরা নকশাল অজ্ঞান হয়ে যেত। পাশের পুলিশ অফিসারের কাঁচা কাঁচা খিস্তি তার আর কানে এসে পৌঁছোতো না...। গোরা নকশাল অন্ধকারের মধ্যে শুধু টপকাতে থাকতো একের পর এক মাঠ...। পালটে দিতে হবে সব কিছু। ওই সব হারানো মানুষগুলোর সব কিছু ফেরত দিতে হবে দেশ...কাল...স্বাধীনতা...অধিকার...। বাঁচার অধিকার। ঝোলার মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসতো পিস্তল...। আর গোরা নকশাল হোঁচট খেয়ে পড়ে যেত...বারবার...। কিছুতেই পেরোতে পারতো না অন্ধকার সেই মাঠটা। যে মাঠটার উলটো দিকেই আস্তে আস্তে ভোরের আকাশটা পরিষ্কার হচ্ছে। ওখান থেকেই দিনের প্রথম আগুন রঙা সূর্য উঠবে।

    শিব প্রামানিক এসে দেখে গোরা নকশাল ঘুমিয়ে পড়েছে টুলে বসেই। একটা মানুষ কেমন ছিলো আর কি হয়েছে। তাগড়া মানুষটার সমস্ত শরীর যেন চিবিয়ে খেয়ে নিয়েছে কেউ এই এতগুলো বছরে। শিব নৌকো থেকে নিয়ে আসে একটা ছেঁড়া কাঁথা। গোরা নকশালের গায়ে চাপিয়ে দেয়। ঘুমোক। জেলে কি ঘুম হয়? তাও তো ওর লাশটা অনেকের মতো গঙ্গা দিয়ে ভেসে যায়নি। অনেকের মতো বৈঠা দিয়ে ঠেলে ফেলে দিতে হয়নি জলে, কুকুরে খাওয়া সেই সমত্ত ছেলেটার লাশটার মতো। “ঘুমোও কত্তা...ঘুমোও। কাল সকালে তোমায় দিয়ে আসবোনি তোমার বাবার বাড়ি।” সকালে উঠে শিব দেখেছিলো গোরা নকশাল আর সেখানে নেই। প্রথম সূর্যের আলোয় পড়েছিল ভাঙা টুলটা। গতরাতের ছেঁড়া কাঁথা আর অল্প অল্প ধোঁওয়া ওঠা আগুনের শেষ আঁচটুকু। গোরা নকশাল সেই অলৌকিক ভোরে আসতে আসতে এগিয়ে গিয়ে সদর দরজা খুলেছিল রবি মাষ্টারের বাড়ির। নিজের বাড়ি বলে ভুল করে ঢুকে পড়েছিলো সে।

    ভুল করে ঢুকে পড়েছিলো? নাকি গোরা নকশাল খুঁজতে গিয়েছিলো তার ছোটোবেলাকে...তার মাকে...ওপার বাংলার মানুষগুলোর গায়ের গন্ধকে। যা অনেককাল আগেই জেলের ছোট্ট খুপরিতে সে হারিয়ে ফেলেছিলো। গোরা নকশাল দেখেছিলো একটা ছোট্ট ছেলেকে। গোরা নকশাল দেখেছিলো রক্তে ধুয়ে যাচ্ছে ধরণী। কেউ যেন কবে একটা বলেছিলো “তোমরা আমাকে রক্ত দাও আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেবো”। কোথাও যেন শুনেছিলো “সশস্ত্র বিপ্লবই আমাদের একমাত্র পথ”। গোরা নকশাল ছুট্টে গিয়েছিলো ছোট্ট ছেলেটার কাছে। আঁকড়ে ধরেছিলো ছটফট করতে থাকা ছেলেটাকে। ডাক্তার কিস্কু তার মাথায় সেলাই করেছিল। গোরা নকশালের শাদা পাঞ্জাবী ভিজে গিয়েছিলো তাজা রক্তে। অনেক দিন পর রক্তের ঝাঁঝটা গোরা নকশালের নাকে এসে লেগেছিলো। একটা ছোট্ট তাজা প্রানকে আঁকড়ে ধরে রেখেছিলো গোরা নকশাল। আর সেই প্রানের যাবতীয় স্পন্দন যেন নিজের ভাঙা শরীরটার মধ্যে সঞ্চারিত করে নিচ্ছিলো সে। আর ঠিক তখনি...হ্যাঁ তখনি... জঙ্গলের মধ্যে একটা লাল পতাকা উড়তে দেখেছিলো গোরা নকশাল। সকাল হয়ে আসছিলো। কারা যেন গেয়ে উঠছিলো “একদিন সূর্যের ভোর...”। কারা যেন শিস দিচ্ছিলো। আর খেপা কুকুরের মতো ঝাঁক ঝাঁক গুলি এসে লাগছিলো সতীর্থদের গায়ে। গোরা নকশাল চোখ বন্ধ করে। কোলের মধ্যে ছটফট করছে বাচ্চাটা। ওখানে প্রান আছে, ওখানে ক্ষিদে আছে, ওখানে আছে অধিকার বুঝে নেওয়ার বীজ মন্ত্র।

    গোরা নকশাল কি তাহলে আরো একবার বাঁচতে চাইছে? সেটা বোঝা যাচ্ছে না। শুধু সেই মুহূর্তে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে উঁচু পাঁচিলের গা ঘেঁষে এক ফালি রোদ এসে পড়েছে গোরা নকশালের মুখে। কালো কোঁকড়ানো দাড়ি ভর্তি ফরসা মুখটা অমলিন হাসিতে টুকনুর দিকে তাকিয়ে আছে। টুকনু রেগে যাচ্ছে...। টুকনু ভয় পাচ্ছে।..টুকনু চিনতে পারছে না গোরা নকশালকে...। চিনবে কী করে? তার বাবার জ্যেঠতুতো ভাইকে তো এই প্রথম দেখলো সে। তখনও টুকনু জানে না একদিন সে গোরা নকশালকে নিয়ে ইয়াবড় একটা গল্প ফাঁদার চেষ্টা করবে!

    তিন

    “বিজয়ের পথে এগিয়ে চলো! স্বদেশ অথবা মৃত্যু !... সবটুকু বিপ্লবী উষ্ণতা দিয়ে আলিঙ্গন করছি তোমাকে!”

    জ্বর, পেট ব্যাথা, শর্দি, সারা গায়ে গুটি গুটি এলার্জি এই সব হলে সাধারণত আমার আনন্দ হয়। আর একবার হলে দিন কয়েকের জন্যে আমার পড়াশুনো সব শিকেয় ওঠে। মা সরস্বতীর রাজ হাঁস সব বই পত্তর নিয়ে চৌপাট দেয় আমার এ্যালুমিনিয়ামের স্কুল বাক্সে। ধুলো জমে। মাকড়সা এসে বাসা বাঁধে। হাঁদার সাদা পায়রা নকশাল এসে মাঝে মাঝে তার ওপর একটু পাখনা মেলে ঘুরে বেড়িয়ে আমার দিকে ঘাড় কাত করে তাকায়। ভাবটা যেন... “টুকনু তুই হাড়ে বজ্জাত।” একটু সবুজ রঙের হাগুও করে দিয়ে যায়। তখনি বাড়ির সবার টনক নড়ে। তখনি খোঁজ পড়ে আমি অনেক দিন পড়ি না। দাদা কত পড়ে। সদ্য ওঠা গোঁফ নিয়ে, জ্যাবড়া করে মাথায় নারকোল তেল আর গায়ে পিঠে সরষের তেল মেখে রোদ না আসা উঠোনের এক কোনায় শীতের দুপুরে অঙ্ক করে। আমাকে বাবা বকে না। বলে “ওকে ছেড়ে দাও...বাপী তো আছে...ওই সামলে নেবে ভাইকে। ...দেখ টুকনু নকশালও তোর এই না পড়া সহ্য করতে পারছে না। দিয়েছে অপ কম্মটি করে। ” আমিও তক্কে তক্কে থাকি। আসুক পাশের বাড়ির হুলোটা একদিন। এমন মাংস ভোজ হবে না...তোর সব রেলা বেড়িয়ে যাবে। ঘাড় কেতলে পড়ে থাকবি...কিম্বা গোরা নকশালের মতো পা মুচকে যাবে। দাদা আবার অঙ্ক খাতা থেকে মাথা তোলে। গম্ভীর হয়ে তাকায়। আজ আমার জ্বরের তিন দিন। মাথার ঘাটা শুকিয়েছে। দাদা কেনো কারোরই দেখি পছন্দ নয় গোরা নকশালকে নিয়ে আল টপকা এমন সব কথা বলা...। তিন দিন গোরা নকশাল আমাদের বাড়ির দিকে আসেনি। তিনদিন আমিও যে বিছানা থেকে খুব একটা উঠতে পেরেছি তেমনটাও নয়। দাদা আবার অঙ্কে মন দিলে আমি আমার গলার কাছে গিঁট বাঁধা চাদরটা ঠিক করে নিই...। “গোরো কিনা কালো কি...” গুনগুন করে আসে গানটা গলার কাছেই। কালই পিকনিক পার্টি চালাচ্ছিলো মাইকে।

    জিটি রোডের পাশে হনুমান জুটমিলের কোয়ার্টারের দেওয়ালে পোষ্টার এঁটে দিয়েছে হরেন কাকা নতুন সিনেমার। হরেন কাকা পোষ্টার সাঁটে। দুপুরে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে, হরেন কাকা ছোট্ট মই, একটা বালতি ভর্তি আঠা আর পোষ্টার নিয়ে বের হয়। আমি পিছু নিলেই ঘাবড়ে যায় ছোটো খাটো মানুষটা। কাইমাই করে ওঠে। ওর ধারণা মাষ্টার বাবু ওকে বকবে। আমাকে বাধ্য হয়ে চলে আসতে হয়। তবে আসার আগে শর্ত হিসেবে হরেন কাকা বলে দেয় পোষ্টারে নাকি লেখা আছে ডিস্কো ডান্সার। মিঠুনের বই। হেবি হিট। শ্রীকৃষ্ণতে এসেছে। হরেন কাকার কান ঢাকা চুল। হরেন কাকার সাদা রঙের চটি। হরেন কাকা বিড়ি খায়। আর হাঁদার দোকানে চা। দাদা ডাকে। পেছন ফিরে তাকাই। “বাবা হিন্দি গান করতে বারণ করেছে না?” আমি মুখ ভ্যাঙাই। ওকে দেখিয়ে দেখিয়ে হরেন কাকার মতো কানের ওপর চুল গুলোকে আনতে চাই। দাদা চিতকার করে ওঠে... “ওই দেখো মা ভাই হিন্দি গান গাইছে...কানের ওপর চুল টানছে”। রান্না ঘর থেকে ভেসে আসে মায়ের গলা... “ওকে এবার ঠিক নেড়া করে দেবো দেখ...।” আমি পালাই। বাড়িতে একমাত্র মাকে ভয় পাই। আর কাউকে না। আমার পালানোর চোটে নকশালের দানার থালা উলটে যায়। নকশাল গলা ফুলিয়ে পাঁচিলের ওপরে ঘাড় কাত করে আমাকে দেখে। আমি ঠিক জানি যারা উড়তে পারে তাদের নাম হয় নকশাল। দাদা ভুল, কোনো মানুষ কি কিছু পালটে দিতে পারে? থমকে দাঁড়াই। স্কুলে একটা লোক ম্যাজিক দেখাতে এসেছিলো। সে সবুজ রঙের সব ফুল গুলোকে লাল করে দিলো। তাহলে কি গোরা নকশাল ম্যাজিশিয়ান? কিছুতেই ওই লোকটার কথা ভুলতে পারছি না কেনো? এতো মণির মামদোর চেয়েও খুব খারাপ।

    গোরা নকশালকে ভুলে এগোতে গেলে বাবার সাথে দেখা হয়ে যায়। বাবার ব্যাগ থেকে পেঁয়াজ কলি উঁকি মারতে দেখে আমার খুব আনন্দ হয়। বুঝতে পারি আজ খুব সুন্দর করে ভাত খাবো। বাবা রান্না ঘরের সামনে ব্যাগ নামালে মা চিতকার করে ওঠে। “আচ্ছা আবার এই এতো পেঁয়াজ কলি আনলে?” বাবা কথা ঘোরাতে চায়। “ওই জোর করে দিয়ে দিলো...বললো শেষবেলার বাজারে এসেছেন মাষ্টার মশাই...এই কটা নিয়ে যান।” মা আরো রেগে যায়। “তার সঙ্গে তেলটাও দিয়ে দিলে পারতো।” আমার সুন্দর মাটা দিন দিন কেমন যেন খিট খিটে হয়ে যাচ্ছে। বাবা ইশারায় আমাকে ওখান থেকে চলে যেতে বলে। আমি রান্না ঘরের সামনে থেকে পালাই। জল খাবার কি হচ্ছে সেটা জানার আর সাহস থাকে না আমার।

    এখন তো শরীর খারাপ তাই নানা টাল বাহানা, ফন্দি ফিকির এঁটে আমাকে পড়তে বসতে হয় না। পরীক্ষা শেষ, বড় দিনের ছুটি তাই বাবার সাথে সক্কাল বেলা উঠে স্কুলে যেতে হয় না। শুধু চিন্তা থাকে একবার স্কুলটা খুললে রেজাল্টটা যখন বেরোবে তখনকার কথা চিন্তা করে। শীতের সকালটা কেমন যেন ভয় নিয়ে আসে আমার ওই হাফপ্যান্টের জীবনে। চুপটি করে ঠাম্মার পুজোর পাশে গিয়ে বসি। হে ঠাকুর...আমাকে পাশ করিয়ে দিও বাবা...। চোখ বন্ধ করি। আর ঠিক তখনি মণির কাছে জল পোড়া নিতে আসে পাশের পাড়ার দত্ত বাড়ির বৌ। লাল পাড় শাদা শাড়ি। গলায় মোটা একটা সোনার চেন। পাড়ার মধ্যে ওদের বাড়িতেই একমাত্র ফোন আছে। আমি কোনোদিন ফোন ধরিনি। দাদা বলেছে ফোনের মধ্যে থেকে নাকি পি পি আওয়াজ বেরোয়। দাদা কে দত্ত গিন্নি মাঝে মাঝে নেমনতন্ন করে খাওয়ায়। ওর পৈতে হয়ে গেছে কিনা...। আমায় করে না। আজ ষষ্ঠী...কাল একাদশী...পরশু অমুক লেগেই থাকে। দাদা এসে জোরে জোরে গড় গড় করে বলে কি কি খাইয়েছে। হাঁদা, মণি, ঠাম্মা রেগে যায়। আমার তখন লুচি খেতে ইচ্ছে করে। শিমাইয়ের পায়েশ খেতে ইচ্ছে করে। লাড্ডু খেতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে দু পা ছড়িয়ে খুব করে কাঁদতে। হাঁদা আমাকে দোকানে নিয়ে যায়। বেঞ্চিতে বসিয়ে লম্বু দেয়। আমি চায়ে ডুবিয়ে ডুবিয়ে খাই। আর জুটমিলের হরকিষাণ দারোয়ান তখন বসে একটু জিরোয়। দেশের ছট পুজোর গল্প করে। তার গ্রামের পাশ দিয়েও নাকি গঙ্গার মতো এতো বড় না হলেও একটা ছোট্ট নদী বয়ে গেছে। কমলা। সে দেশে যেতে পারেনি এই বছর, তার মন ভালো নেই।

    মণি ফুঁ দিয়ে জলের ওপর কিসব মন্ত্র পড়ে। হাত দিয়ে আঁকি বুঁকি কাটে জলের ওপর। অনেক দূর দূর থেকে লোকজন আসে মণির কাছে। ভিড়টা একটু বেশি হয় শনি আর মঙ্গলবারে। কারো ঘাড় মচকে গেছে, কারোর পিঠে ব্যাথা, কারো অনেক দিনের বাচ্চা হচ্ছে না। মণি সবার কথা শোনে, তারপর কাগজের পুড়িয়াতে মুড়িয়ে মুড়িয়ে কিসব দেয়। দাদা বলে মণি অনেক তন্ত্র মন্ত্র জানে। রাতের বেলায় ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কথা বলে। বিড়বিড় করে। আমিও শুনেছি। কিন্তু ভয় পাইনি কোনোদিন। কেনো ভয় পাবো? মণি, ঠাম্মা, বড়মা সেই যে কবে আঁধার রাত পেরিয়ে, কাঁটা তার পেরিয়ে একা একা ইচ্ছামতী পার করে চলে এসেছিলো...। ঠাম্মা লক্ষ্মীর ঝাঁপিতে তুলে নিয়েছিলো এক খাবলা দেশের মাটি। ঠাকুরের বাক্সতে এখোনো তাকে যত্ন করে পুজো করে ঠাম্মা। রোজ সকালে প্রনাম করে। বাতাসা দেয়। তুলসী গাছ নেই...তুলসী তলা নেই...পুজো করতে করতে আমার দিকে তাকিয়ে ছানি পাকা চোখ গোল গোল করে বলে “একটা বড় তুলসী মঞ্চ ছিলো বুঝলি টুকনু...। বড় বড় পাতা। তোর দাদু সেখানে অষ্টম প্রহরের শামিয়ানা টাঙাতো।” অষ্টম প্রহর কী আমি জানি না। আমার তিক্ষ্ণ নজর বাতাসার থালার দিকে। ডেঁও পিঁপড়েদের আগে সেগুলো আমার পেটে। মণি ডাকে। কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখে। মাথায় ফুঁ দিতে গেলে আমি সরিয়ে নিই। পাছে জ্বর সত্যি সত্যি সেরে যায়! মণি দাদাকে পাঁচ টাকা দেয়। দত্ত গিন্নি প্রনামী দিয়েছে। আজ দুধ আসবে বাড়িতে। পায়েস হবে। হাঁদার জন্মদিন। আমি গিয়ে জানলার ধারে বসি। মাথার ঘাটা শুকিয়ে এসেছে। কত লোক কত কাজে যায় আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে। কত বড় বড় ট্রাক, বাস ছুটে যায় জিটি রোডের ওপর দিয়ে। বাড়ির কোনের দিকের ছোট্ট ঘরটার জানলা দিয়ে সবটা দেখা যায়। আমি অনেকটা সময় কাটাই এই ঘরে। মণি, ঠাম্মা, হাঁদা থাকে এই ঘরটায়। লম্বা একটা চাটাই পাতা হয়। শীতের সময় কড়িকাঠ থেকে ঝোলা বাঁশের ওপরে রাখা লেপ, কম্বল পাড়া হয়। বড় পাঁচিলের ওপর থেকে যেটুকু রোদ আসে সেটুকুতেই ওদের সেঁকা হয়। তারপর ঘরে ঘরে নাম করে সবার যা যা জিনিস চলে যায়। ঘর বলতে তো ওই মোটে সাড়ে তিনটে। সামনে একটা উঠোন। আর উঠোনের পাশে রান্না ঘর। উঠোনের আর একদিকে পায়খানা। সকালে ওদিকটা আবার মেথর এলে যাওয়া যায় না। খাটা পায়খানা থেকে গন্ধ আসে খুব। হরি মেথর বড় বড় দুটো টিনের ডাব্বা একটা ছোট্ট গাড়িতে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে আসে। সঙ্গে থাকে বড় একটা হাতা। বড় বড় হাতা দিয়ে রাস্তার ওপরে দাঁড়িয়ে হরি মেথর গু ঢালে বড় টিনের ডাব্বাতে। হাঁদা ঠিক উলটো দিকের দোকানে উনুনে আঁচ ধরায়। সাতটার সাইরেন পড়ে। জুটমিল ছুটি হয়। বিহার থেকে আসা সব মানুষ গুলো জড়ো হয় হাঁদার দোকানের সামনে। শীতের সকালে ওদের মুখে চোখে লেগে থাকে সারা রাত জেগে কাজ করার একটা স্নিগ্ধ অনুভূতি। ওদের মাঝখানে ওই শীতের সকালে চায়ের ভাঁড়ে যাকে চুমুক দিতে দেখি, তাকে তিন দিন দেখিনি। একটু একটু করে চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দেয় গোরা নকশাল। আর বুড়ো বিহারীটা যে আমাদের বাড়ির পাশে ডাক্তার কিসিকুর ডিস্পেন্সারিটা রোজ খুলে দেয়, ঝাঁট দেয়, সে হাতপা নেড়ে কিসব বলতে থাকে। ওর পাশে জড়ো হয় আরো গুচ্ছের লোক। সকাল বেলায় হাঁদার দোকানটা বেশ জম জমাট ভিড় হয়ে যায়। দাদা আমাকে ঠেলে জানলার পাশে এসে দাঁড়ায়। আমি বলি “দেখ কত বিক্রি হবে চা, মুড়ি, বিস্কুট। কাল সারা রাত জেগে যে ঠোঙা গুলো আমরা করলাম সব শেষ হয়ে যাবে আজকের সকালের মধ্যেই।” দাদা চুপ করে থাকে। সে জানে এইভাবে চললে আর বেশিদিন ব্যবসা করতে পারবে না হাঁদা। জুটমিলের মালিক বদল হচ্ছে। জুটমিলের অনেক লোককে বসিয়ে দেবে।হপ্তার টাকাও ঠিক মতো দিচ্ছে না। ওরা সবাই গোরা নকশালকে ঘিরে ধরে। গোরা নকশালকে বলে চলে। গোরা নকশাল সব শোনে, চুপ করে। কোনো কথা বলে না। আড় চোখে আমার জানলার দিকে তাকাতেই গোরা নকশাল আমাকে দেখতে পায়। তার সেই কোঁচকানো দাড়িতে তরঙ্গ ওঠে। গোরা নকশাল হেসে ওঠে। আমি দাদার মতো গম্ভীর হতে চেষ্টা করি। পারি না।

    সেই প্রথমবার হাঁদার জন্মদিনে পায়েস হয়। গোরা নকশাল নেমনতন্ন খেতে আসে। বারান্দায় চাটাই পেতে সবাই আমরা বরাবরের মতো খেতে বসি। ঠাকুমা তালপাতার পাখা নিয়ে মাছি তাড়ায়। আমি দেখি গোরা নকশাল খাচ্ছে আস্তে আস্তে। পাঞ্জাবির হাতার ফাঁক দিয়ে যে অংশটা বেরিয়ে পড়ছে সেখানকার মাংসটা খোবলানো। আমার দিকে তাকাতেই হাতা ঠিক করে নেয় সে। “ওরা নাকি ধর্মঘট করছে গোরা? জুটমিল নাকি বন্ধ রাখবে। কোনো শ্রমিক কাজ করবে না?” বাবা জানতে চায়। গোরা নকশাল কিছু বলে না। আঙুল গুলো চাটে। একটা ঢেকুর তুলে বলে কতদিন পর পায়েস খেলাম রাঙা মা। গোরা নকশাল ঠাম্মার এতো সুন্দর একটা নাম দিয়েছে জানতাম না তো। মা আরো একটু পায়েস ঢেলে দেয় বাটিতে। গোরা নকশাল চেটে চেটে খায়। বাইরে তখন শেষবারের মতন হনুমান জুটমিলের সাইরেন বেজে ওঠে। কাল থেকে হরতাল। কাল থেকে কাজ বন্ধ। কাল থেকে “দুনিয়ার মজদুর এক হও”। গোরা নকশাল ওঠার আগে বাবার দিকে তাকিয়ে বলে “জানো রবিদা…আমার ঘরে দুটো চড়াই বাসা বেঁধেছে। কাল আসিস টুকনু…। চড়াইয়ের ডিম দেখাবো।”

    সকালে ঘুম ভাঙে দাদার ঝাঁকুনিতে। এই ভাই ওঠ ওঠ…পুলিশ এসেছে। আমি ধড়মড় করে উঠে বসি। বাবার সাথে কিসব কথা বলছে পুলিশ। আর তখন হাঁদার দোকানের সামনে পড়ে আছে বুড়ো বিহারীর রক্ত জমাট দেহ। ভোর বেলায় গঙ্গার স্নান করতে যাওয়ার সময় কেউ তার মাথাটা থেঁতলে দিয়েছে পাথর দিয়ে। সেই ভিঁড়ের মধ্যে কোথাও গোরা নকশালকে দেখতে পেলাম না। শুধু দেখলাম বুড়ো বিহারীর বউ আছাড়ি পিছাড়ি দিয়ে কাঁদছে। আর হনুমান জুটমিলের সামনে বসে গেছে সার বেঁধে লোকজন। ওরা তাদের লিডারের লাশ তুলতেও দেবে না। কাজও হবে না। ওরা চিতকার করতে থাকে “মালিকের কালো হাত ভেঙে দাও গুড়িয়ে দাও…। হরতাল চলছে চলবে…। ইনক্লাব জিন্দাবাদ…।” আমাদের শান্ত জনপদটা আর শান্ত রইলো না। কেমন যেন সব পালটে যেতে থাকলো। বিকেলের দিকে পুলিশ এলো। তারা লাশ তুলে নিয়ে গেলো। কিন্তু শ্রমিকরা কেউ নড়লো না কারখানার দরজা থেকে। কেউ একটা গুনগুন করে গাইতে থাকলো “হাম ভুখ সে মরনে বালো…ইয়া মত সে ডরনে বালো…আজাদিকা ঝান্ডা উঠাও…”

    বিশাল জমায়েতটার পাশ কাটিয়ে আমি দাদার সাথে সেই প্রথম গেলাম গোরা নকশালের ঘরে। ওপরের ছাদের ধারে একটা ছোট্ট ঘর। ঘরটার চারিদিকে জানলা। জানলার ওপাশেই গঙ্গা। ঘরটার দেওয়ালে আমাদের বাড়ির মতোই পলেস্তারা খসা। আর আমাদের ঘরের মতো যেটা নয় সেটা হল ঘরের সব দেওয়াল জোড়া বইয়ের তাক। সেখানে সারি সারি বই। বইয়ের ফাঁকে চড়াইপাখির বাসা। গোরা নকশাল আমাকে চড়াই পাখির বাসা দেখায়। তার ডিম ফুটে বের হওয়া ছানা দেখায়। আমি গঙ্গার ধারের জানলা ধরে দোল খাই। এমন যদি আমাদের বাড়িটা হতো দাদা? দাদা ইশারায় চুপ করতে বলে। গোরা নকশাল শুনতে পায়। গোরা নকশাল হাসে। “এটা তোকেই আমি দিয়ে যাবো টুকনু…এই ঘরটা তোর”। একগাল হেসে বলি “সত্যি? কবে দেবে?” গোরা নকশালের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। আমার এলোমেলো চুল গুলোকে আরো এলোমেলো করে দিতে দিতে বলে কয়েকটা লাইন… “বিজয়ের পথে এগিয়ে চলো! স্বদেশ অথবা মৃত্যু!... সবটুকু বিপ্লবী উষ্ণতা দিয়ে আলিঙ্গন করছি তোমাকে!” আমি কিছু বুঝতে পারিনা ছাই মাথা মুন্ডু। দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে জানতে চাই... “ ওই যে দেওয়ালের গায়ে এঁকেছো কোঁকড়ানো চুল...তোমার মতোই হাসছে...দাড়ি রেখেছে লোকটা কে?” গোরা নকশাল হা হা হা করে হেসে ওঠে। লোকটা হাসলে সারাটা ঘর যেন কাঁপতে থাকে। হাসির দমক যেন থামতে চায় না। লোকটা কী পাগল? লোকটা কী মণির বলা সেই মামদো ভূতটার মতো? আমি আসতে আসতে সরে আসি দাদার কাছে। দাদার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি সেও খানিকটা বিস্মিত গোরা নকশালের অট্টহাসিতে। ঘর ফাটানো হাসির দমক আস্তে আস্তে থেমে গেলো। লোকটার শরীরের কাঁপুনিটাও। দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে গোরা নকশাল বিড় বিড় করে বললো। “এই লোকটাকে চিনে রাখ টুকনু...এই লোকটা একদিন সব পালটে দেবে বলেছিল...সবাইকে পালটে দেবার স্বপ্ন দেখিয়েছিল...।” গোরা নকশাল হঠাৎ করে চুপ হয়ে যায়। ঘরটায় চড়াই পাখির কিচির মিচির ছাড়া কিছু শোনা যায় না। আমি দাদার দিকে তাকাতেই দাদা ইশারা করে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য। ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে জিজ্ঞেস করি, “ লোকটা কে রে দাদা?...ওই যে ছবির...”। দাদা ফিসফিস করে বলে “ইতিহাস বইতে ছবি আছে লোকটার... এর্নেস্তো চে গুয়েভারা...সবাই ডাকে চে বলে।”

    মাঘের শীতের বিকেল সবে শেষ হচ্ছে। ধূসর দেওয়ালে এক ধূসর মানুষের মুখের ছবি দেখে যখন রাস্তায় নেমেছি আমার চোখের সামনেই ঘটনাটা ঘটে গেলো। বিহারীর মৃত্যুর প্রতিবাদে বসে থাকা জুটমিলের শ্রমিকদের লক্ষ্য করে কারা যেন বোমা ছুঁড়তে থাকলো। ধোঁওয়ায় ধোঁওয়া হয়ে গেল চারিদিক। অনেক রাতে সবার সাথে খেতে বসে বাবাকে সেই প্রথম বলতে শুনলাম, “টুকনু...কাল থেকে একা একা মাঠে খেলতে যেও না। দাদা কিম্বা মণি তোমাকে দিয়ে আসবে কেমন?” হাঁদা ফিসফিস করে বললো “গরীবের সরকার...গরীবের ওপর লাঠি চালায় কী করে?” ঠাম্মা দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়লো। কারণ ঠাকুমা বুঝতে পেরেছে এই বারের শীতেও হয়তো রিলিফ ক্যাম্প খুলবে না। এই বারের শীতেও তার চোখের ছানি অপারেশান হবে না। ঠাকুমা হয়তো একদিন অন্ধই হয়ে যাবে। লম্ফটা নিভে যায়। তলানির তেলটুকুও শেষ। সেই ঘন কৃষ্ণকায় অন্ধকারে বসে থাকে দেশ ছাড়া ঘর ছাড়া কয়েকটা মানুষ। এক ফালি চাঁদের আলো এসে পড়ে তাদের এঁটো কাটা থালা বাটির ওপর। (ক্রমশ)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১৩ মার্চ ২০১৬ | ২১৮১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Kallol Lahiri | 11.39.62.215 (*) | ১৩ মার্চ ২০১৬ ০৭:২১56039
  • অনবদ্য স্মৃতিচারণ। পরের কিস্তির জন্য অপেক্ষা করা এক দূরহ পরীক্ষা।
  • Kallol Lahiri | 11.39.62.215 (*) | ১৩ মার্চ ২০১৬ ০৭:২১56038
  • অনবদ্য স্মৃতিচারণ। পরের কিস্তির জন্য অপেক্ষা করা এক দূরহ পরীক্ষা।
  • Kallol Lahiri | 11.39.62.215 (*) | ১৪ মার্চ ২০১৬ ০৩:২৬56040
  • অনবদ্য স্মৃতিচারণ। পরের কিস্তির জন্য অপেক্ষা করা এক দূরহ পরীক্ষা। : কল্লোল ভট্টাচার্য
  • pi | 24.139.209.3 (*) | ১৪ মার্চ ২০১৬ ০৩:২৬56041
  • আবার সেই বাগ। কল্লোল লাহিড়ি জানিয়েছেন, মন্তব্যটা ওঁর পোস্ট নয় !
  • গৌতম মিস্ত্রী | 11.39.38.232 (*) | ১৪ মার্চ ২০১৬ ০৩:৩৭56042
  • নিজের অ্যালবামের ধুসর ছবির মত।
  • d | 144.159.168.72 (*) | ১৪ মার্চ ২০১৬ ০৪:৪০56043
  • আহা .....
  • রোবু | 213.132.214.81 (*) | ১৪ মার্চ ২০১৬ ০৫:০৩56044
  • খুব সুন্দর লাগল।
  • sosen | 177.96.124.76 (*) | ১৪ মার্চ ২০১৬ ০৯:৪৬56047
  • খুব সুন্দর
    ও রঞ্জনদা, এম্নি জিগিয়ে জিগিয়ে ঘোর কাটিয়ে দেবেন না। এসব মানুষগুলো একটু অচেনাই থাক না।
  • Sakyajit Bhattacharya | 23.17.125.9 (*) | ১৪ মার্চ ২০১৬ ০৯:৫৩56045
  • পুরো কবিতার মত লাগল
  • ranjan roy | 24.96.167.1 (*) | ১৪ মার্চ ২০১৬ ১০:৫৬56046
  • প্রশ্ন লেখককে,
    উনি কি আড়িয়াদহের গোরা ভট্টাচার্য্য? নয় ভাইয়ের মধ্যে সবচে ছোট? যিনি জেল থেকে বৃদ্ধবাবাকে লিখেছিলেন-- চিন্তা কর না, A cat has nine lives.?
  • সে | 198.155.168.109 (*) | ১৫ মার্চ ২০১৬ ০৬:৪০56049
  • পরের কিস্তির অপেক্ষায় আছি।
  • ranjan roy | 125.117.235.26 (*) | ১৫ মার্চ ২০১৬ ০৯:৪৪56048
  • সোসেন,
    ঠিক বলেছেন। সরি।
  • Kallol Lahiri | 127.194.81.15 (*) | ১৬ মার্চ ২০১৬ ০৭:২৮56050
  • দুই

    “যাদের সামনের পথটা অজানা...আর পেছনের পথটা বিস্মৃত...তারাই গোলকধাঁধার পথে অন্তরীণ...”

    হাতে ধরা আমার মুঠো ফোন বিপ বিপ করে বেজে ওঠে। শীতের রাত চিরে ছুটছে সেদিনের শেষ ডানকুনি লোকাল...আমি ছুটছি বাড়ি...সারাদিন আমাকে ক্লান্ত করে রেখেছে কয়েকটা মিটিং...সারাদিন ক্লান্ত আমি না করা কাজের চাপে। মুঠোফোন বেজে যায়। ওপার থেকে ভেসে আসে খুব কাছের এক বন্ধুর গলা...
    “হাতে কিছু কাজ আছে?”
    মানে?
    “না...কোনো কিছু করছিস কি এখন?”
    বাড়ি যাচ্ছি...।
    “উফ...তুই বড্ড এঁড়া টাইপের ছেলে মাইরি...জানতে চাইছি এখন ব্যাস্ততা কেমন?”
    কেনো বলতো?
    “শোন...ওই যে তোর একটা ছোট লেখা বেরিয়েছিলো না...।”
    ফিল্মের রিভিউ?
    “উফ না...না...।
    মেগা সিরিয়াল?
    “সেটাও আজকাল ছাপাচ্ছিস নাকি? পাবলিক মাইরি তুই...”
    কোনটা বলতো...ঠিক বুঝতে পারছি না...আমার ব্লগে?
    “সেটা আমার মনে থাকলে তো হয়েই যেত...। ওই যে যাত্রা নিয়ে লেখার সময়...কে একজন মারা গেলেন না...”।
    শান্তি গোপাল?
    “রাইট...হ্যাঁ হ্যাঁ...। ওই লেখাটা।”
    তোর চাই?
    “না। শোন আগে কথাটা...ওই লেখাটাতে... খুব ছোট করে লিখেছিলিস...ওই যে তোর কাকা না কে...নকশাল নকশাল...!”
    গোরা নকশাল?
    “হ্যাঁ...হ্যাঁ...একদম ঠিক...শোন ওই লোকটাকে নিয়ে ছবি করতে চাই...”
    ফিল্ম?
    “একদম...।”
    হঠাৎ? আর কোনো সাবজেক্ট পাচ্ছিস না বুঝি?
    “তোকে এতো কিছুর জবাব দিতে পারবো না ফোনে...আর তেমন কিছু তোকে করতেও হবে না। শুধু নিজের মতো করে লিখে যেতে হবে।”
    লিখে যেতে হবে মানে?
    “আরে একটা পার্সোনাল জার্নি...সহজে কিছু বোঝানো যায় না তোকে”।
    গোরা নকশালকে নিয়ে?
    “রাইট...বেঁচে আছে না লোকটা এখোনো?”
    হ্যাঁ...মানে...না...মানে...
    “কী মানে মানে করছিস?”
    আসলে সবটা সত্যি নয়...।
    মানে?
    মানে ওটা একটা গল্প...কিছু মানুষের...। যাদের কাছে স্বাধীনতা মানে ছিলো দেশ ভাগ... যারা ভেবেছিলো আবার একদিন তারা ফিরে যেতে পারবে নিজের দেশে...নিজের গ্রামে...। কিন্তু হয়নি...। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের নায্য দাবীতে যারা একসময় পথে নেমে ছিল...যাদের কাছে বেঁচে থাকাটা পুরোটাই স্বপ্ন আর স্মৃতি...
    “থাক...থাক...পলিটিকাল এজেন্ডা দাঁড় করিয়ে দিচ্ছিস তো..এর মধ্যে গোরা নকশাল কোথায়...?”
    আছে...।
    “স্বপ্নে না স্মৃতিতে?”
    সিনেমায়...।
    “লিখবি? সত্যি তুই লিখবি আমার জন্য?”
    হ্যাঁ...।

    ফোন কেটে যায়। বালী বিজ্রের ওপর দিয়ে ছুটে চলেছে ট্রেন। গঙ্গার ঠান্ডা হাওয়া এসে লাগছে আমার চোখে মুখে। আমি ফিরে যাচ্ছি আমাদের লোড শেডিং এর দিন গুলোয়...ফিরে যাচ্ছি সেই বয়েসটায় যেখানে বড় হওয়ার বড্ড তাড়া ছিলো। মা থার্মোমিটারটা আমার মুখ থেকে নিয়ে নিচ্ছে...। একটু হাসছে...। জ্বর আর নেই...। তিনদিনের পরে আমার তপ্ত গা ঠান্ডা হয়। সারা রাত জাগা মায়ের মুখটা অনেকদিন পরে খুব দেখতে ইচ্ছে করে। ট্রেন থেকে নেমে আমি বাড়ি যাই। আর ওদিকে পুলিশের গাড়ি থেকে ঠেলে নামিয়ে দেওয়া হয় গোরা নকশালকে। এক মাঘের শীতের রাতে, জমকালো আঁধারে। খোঁড়াতে খোঁড়াতে গোরা নকশাল এসে বসে খেয়া ঘাটে। যেখানে মাঝিরা শুকনো পাতা জড়ো করে আগুন জ্বা্লিয়েছে। গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে আছে সবাই। বুড়ো শিব প্রামানিক সেই আগুন আলোর ধোঁওয়ার মধ্যে গোরা নকশালকে ঠিক চিনে নেয়। গোরা না? হ্যাঁ তাই তো...। কবে এলো এই মানুষটা? কবে ছাড়া পেলো? সেই যে একবার পুলিশের তাড়া খেয়ে লোকটাকে নদী পার করে দিয়েছিলো শিব...। তারপর আর দেখেনি কোনোদিন। শুনেছিলো জেলে আছে। পচছে। এর মধ্যে কত কি তো ঘটে গেলো। কত কচি কচি ছেলের লাশ গঙ্গা দিয়ে ভাসতে দেখলো শিব। কংগ্রেস গেলো...যুক্ত ফ্রন্ট এলো...আবার কংগ্রেস...। এখন আবার লাল পার্টি এসেছে। শিব একবার লরি করে ময়দানে গিয়েছিল। বিশাল জমায়েত দূর থেকে অনেক উঁচু মাঁচার ওপর এক লোককে দেখেছিল শিব। বেঁটে খাটো চশমা পরা লোকটা নাকি এবারের মুখ্যমন্ত্রী। গরীবের বন্ধু...। “হাঁ গা...লোকটার নাম কী?” রুটি ভেলিগুড় দেওয়া অল্প বয়স্ক ছেলেটা তাকিয়ে ছিল এক মুহূর্ত তার অনেক পাওয়ারের চশমার ফাঁক দিয়ে। “উনি কমরেড জ্যোতি বসু।” শিব অনেক দূর থেকে গরীবের বন্ধুকে দেখেছিল। সব কথা বুঝতে পারেনি সেদিন...। শিব সব কথা বুঝতে পারে না। আবার আগের মতো গঙ্গায় মাছ এলেই হয়...। ইলিশের মরশুমে তেমন তো মাছ উঠলো না...। বউটা অসুস্থ, ছেলেটার জুটমিলে কিসব গন্ডগোল শুরু হয়েছে। খুব টাকার দরকার শিবের।

    গোরা নকশাল নদীর রাস্তার দিকে তাকায়। একদল মানুষ গোল হয়ে বসে আগুন পোহায়। সেই কবে থেকে যেন মানুষ এমন করেই আগুনের ধারে বসে আছে। সেই কবে মানুষ জোটবদ্ধ হলো। তাদের নিজেদের কথা নিজেরাই গুছিয়ে বললো। ভাবতে গেলে মাথা টনটন করে গোরা নকশালের। কতদিন পরে সে জেলের বাইরে পা রাখলো। গল্প শুনতে ভালো লাগে তার। মানুষ গুলোর মাঝে এসে বসে। আগুনের সামনে। খোলা আকাশের দিকে তাকায়। অনেক দিন পর সে রাত দেখছে...অনেক দিন পর সে ঠান্ডা বাতাসে। অনেকদিন পর সে মানুষের ঘামের গন্ধ শুঁকছে। অনেকদিন পর সে বুঝতে পেরেছে...আসলে সব কিছু পাল্টে দেওয়া যায় না। সব কিছু পালটে দিতে দেয় না মানুষ।

    হাঁটু মুড়ে বসতে পারে না গোরা। শিব এগিয়ে এসে ভাঙা একটা টুল এগিয়ে দেয়। শিব বলে “চিনতে পারছেন কত্তা?” গোরার চোখ চিক চিক করে ওঠে। শিব নৌকা বাইছে...আর পেছনে পুলিশের লঞ্চ...। গোরা কি ঝাঁপ দিয়েছিলো জলে? নাকি শিব পার করে দিয়েছিলো তাকে? গোরা মনে করার চেষ্টা করে। পারে না। অনেক কিছু মনে নেই তার। অনেক কিছু ভুলে গেছে। মাথায় ওরা লোহার বাঁট দিয়ে মারতো...। মাথাটা নীচের দিকে করে পাটা ঝুলিয়ে দিতো...। চোখের সামনে জ্বেলে দিতো একটা বাল্ব...। চোখের সামনে সেই উজ্জ্বল ধাঁধার নির্যাতিত আলোতে গোরা নকশাল দেখতে পেতো খুলনার প্রাথমিক স্কুলটাকে....। গোরা নকশাল দেখতে পেতো একুশে ফেব্রুয়ারীর অলৌকিক ভোর...। গোরা নকশাল দেখতো স্বাধীন বাংলাদেশ। গোরা নকশাল শুনতে পেতো “তোর পিঠে কাঁটা তারের দাগ”। এক উদ্বাস্তু নকশাল হয়েছে বলে পুলিশ গুলো হাসাহাসি করতো। গোরা নকশাল অজ্ঞান হয়ে যেত। পাশের পুলিশ অফিসারের কাঁচা কাঁচা খিস্তি তার আর কানে এসে পৌঁছোতো না...। গোরা নকশাল অন্ধকারের মধ্যে শুধু টপকাতে থাকতো একের পর এক মাঠ...। পালটে দিতে হবে সব কিছু। ওই সব হারানো মানুষগুলোর সব কিছু ফেরত দিতে হবে দেশ...কাল...স্বাধীনতা...অধিকার...। বাঁচার অধিকার। ঝোলার মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসতো পিস্তল...। আর গোরা নকশাল হোঁচট খেয়ে পড়ে যেত...বারবার...। কিছুতেই পেরোতে পারতো না অন্ধকার সেই মাঠটা। যে মাঠটার উলটো দিকেই আস্তে আস্তে ভোরের আকাশটা পরিষ্কার হচ্ছে। ওখান থেকেই দিনের প্রথম আগুন রঙা সূর্য উঠবে।

    শিব প্রামানিক এসে দেখে গোরা নকশাল ঘুমিয়ে পড়েছে টুলে বসেই। একটা মানুষ কেমন ছিলো আর কি হয়েছে। তাগড়া মানুষটার সমস্ত শরীর যেন চিবিয়ে খেয়ে নিয়েছে কেউ এই এতগুলো বছরে। শিব নৌকো থেকে নিয়ে আসে একটা ছেঁড়া কাঁথা। গোরা নকশালের গায়ে চাপিয়ে দেয়। ঘুমোক। জেলে কি ঘুম হয়? তাও তো ওর লাশটা অনেকের মতো গঙ্গা দিয়ে ভেসে যায়নি। অনেকের মতো বৈঠা দিয়ে ঠেলে ফেলে দিতে হয়নি জলে, কুকুরে খাওয়া সেই সমত্ত ছেলেটার লাশটার মতো। “ঘুমোও কত্তা...ঘুমোও। কাল সকালে তোমায় দিয়ে আসবোনি তোমার বাবার বাড়ি।” সকালে উঠে শিব দেখেছিলো গোরা নকশাল আর সেখানে নেই। প্রথম সূর্যের আলোয় পড়েছিল ভাঙা টুলটা। গতরাতের ছেঁড়া কাঁথা আর অল্প অল্প ধোঁওয়া ওঠা আগুনের শেষ আঁচটুকু। গোরা নকশাল সেই অলৌকিক ভোরে আসতে আসতে এগিয়ে গিয়ে সদর দরজা খুলেছিল রবি মাষ্টারের বাড়ির। নিজের বাড়ি বলে ভুল করে ঢুকে পড়েছিলো সে।

    ভুল করে ঢুকে পড়েছিলো? নাকি গোরা নকশাল খুঁজতে গিয়েছিলো তার ছোটোবেলাকে...তার মাকে...ওপার বাংলার মানুষগুলোর গায়ের গন্ধকে। যা অনেককাল আগেই জেলের ছোট্ট খুপরিতে সে হারিয়ে ফেলেছিলো। গোরা নকশাল দেখেছিলো একটা ছোট্ট ছেলেকে। গোরা নকশাল দেখেছিলো রক্তে ধুয়ে যাচ্ছে ধরণী। কেউ যেন কবে একটা বলেছিলো “তোমরা আমাকে রক্ত দাও আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেবো”। কোথাও যেন শুনেছিলো “সশস্ত্র বিপ্লবই আমাদের একমাত্র পথ”। গোরা নকশাল ছুট্টে গিয়েছিলো ছোট্ট ছেলেটার কাছে। আঁকড়ে ধরেছিলো ছটফট করতে থাকা ছেলেটাকে। ডাক্তার কিস্কু তার মাথায় সেলাই করেছিল। গোরা নকশালের শাদা পাঞ্জাবী ভিজে গিয়েছিলো তাজা রক্তে। অনেক দিন পর রক্তের ঝাঁঝটা গোরা নকশালের নাকে এসে লেগেছিলো। একটা ছোট্ট তাজা প্রানকে আঁকড়ে ধরে রেখেছিলো গোরা নকশাল। আর সেই প্রানের যাবতীয় স্পন্দন যেন নিজের ভাঙা শরীরটার মধ্যে সঞ্চারিত করে নিচ্ছিলো সে। আর ঠিক তখনি...হ্যাঁ তখনি... জঙ্গলের মধ্যে একটা লাল পতাকা উড়তে দেখেছিলো গোরা নকশাল। সকাল হয়ে আসছিলো। কারা যেন গেয়ে উঠছিলো “একদিন সূর্যের ভোর...”। কারা যেন শিস দিচ্ছিলো। আর খেপা কুকুরের মতো ঝাঁক ঝাঁক গুলি এসে লাগছিলো সতীর্থদের গায়ে। গোরা নকশাল চোখ বন্ধ করে। কোলের মধ্যে ছটফট করছে বাচ্চাটা। ওখানে প্রান আছে, ওখানে ক্ষিদে আছে, ওখানে আছে অধিকার বুঝে নেওয়ার বীজ মন্ত্র।

    গোরা নকশাল কি তাহলে আরো একবার বাঁচতে চাইছে? সেটা বোঝা যাচ্ছে না। শুধু সেই মুহূর্তে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে উঁচু পাঁচিলের গা ঘেঁষে এক ফালি রোদ এসে পড়েছে গোরা নকশালের মুখে। কালো কোঁকড়ানো দাড়ি ভর্তি ফরসা মুখটা অমলিন হাসিতে টুকনুর দিকে তাকিয়ে আছে। টুকনু রেগে যাচ্ছে...। টুকনু ভয় পাচ্ছে।..টুকনু চিনতে পারছে না গোরা নকশালকে...। চিনবে কী করে? তার বাবার জ্যেঠতুতো ভাইকে তো এই প্রথম দেখলো সে। তখনও টুকনু জানে না একদিন সে গোরা নকশালকে নিয়ে ইয়াবড় একটা গল্প ফাঁদার চেষ্টা করবে!
  • d | 144.159.168.72 (*) | ১৬ মার্চ ২০১৬ ০৭:৩২56051
  • যাঃ আপনি কমেন্টে পোস্ত করে ফেলেছেন। ঐ Add to Comment এর নীচে দেখুন আরেকটা অপশান আছে অ্যাড টু অরিজিনাল পোস্ত বা এমনি কিছু একটা লেখা। ঐটে সিলেক্ট করে এই লেখাটা আরেকবার পেস্ট করে দিন প্লীজ।
  • Kallol Lahiri | 127.194.81.15 (*) | ১৬ মার্চ ২০১৬ ০৭:৩৪56052
  • হ্যাঁ করে দিয়েছি। এ্যাডমিনকে অনুরোধ করছি এই কমেণ্টের জায়গা থেকে পোস্টটাকে ডিলিট করে দিন। সেটার অপশান পাচ্ছি না।
  • সে | 198.155.168.109 (*) | ১৬ মার্চ ২০১৬ ০৭:৩৭56053
  • অদ্ভুত সুন্দর লেখা। জাস্ট অসাধারন।
  • ranjan roy | 24.96.41.155 (*) | ২১ মার্চ ২০১৬ ০৪:১৯56054
  • অসাধারণ লেখার হাত; আরও চাই। ক্ষিদে বেড়ে গেল।
  • pi | 233.176.35.149 (*) | ২১ মার্চ ২০১৬ ০৪:৩০56055
  • খুব ভাল লাগছে।
  • d | 144.159.168.72 (*) | ২১ মার্চ ২০১৬ ০৪:৫৮56056
  • একেবারে জ্যান্ত লেখা। বড্ড বড্ড ভাল।
  • Sakyajit Bhattacharya | 116.51.26.191 (*) | ৩০ মার্চ ২০১৬ ০২:৪৭56057
  • পর্বে পর্বে লেখা পোস্ট করার একটা সমস্যা আছে। পুরনো লেখা তলায় চলে গেলে সেতায় নতুন পর্ব জুড়লে আর ওপরে উঠে আসে না। ফলে পাঠক নতুন পর্ব পড়তে পারেন না।

    বলছি এই কারণে যে এই সিরিজটা অসামান্য। পাঠকের মনোযোগ দাবী করে আরো
  • aranya | 83.197.98.233 (*) | ০৩ এপ্রিল ২০১৬ ০৯:০৩56058
  • অসাধারণ লেখা
  • aranya | 83.197.98.233 (*) | ০৩ এপ্রিল ২০১৬ ০৯:১০56059
  • কেমন একটা ঘোরে চলে যাই
  • de | 69.185.236.52 (*) | ০৬ এপ্রিল ২০১৬ ০৯:১৭56060
  • খুব ভালো লাগছে --

    এফর্টলেসলি ঝরঝরে লেখা -
  • Kallol Lahiri | 127.194.13.116 (*) | ০৭ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:৩১56061
  • ধন্যবাদ সবাইকে। আপনারা যে আমার লেখা ধৈর্য্য নিয়ে পড়ছেন আমি কিছুটা অবাক এবং আপ্লুত। ভালো থাকবেন সবাই।
  • বিপ্লব রহমান | 113.231.161.74 (*) | ০৪ জুন ২০১৮ ০৫:৩৬56062
  • আমার বাবা আজিজ মেহের সাতের দশকে পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (মতিন-আলাউদ্দিন) নকশাল নেতা ছিলেন। জেল খেটেছিলেন বহু বছর। জেল থেকেই আমার নাম রেখেছিলেন “বিপ্লব”। পাকিস্তান আমলে বহু কৃষক আন্দোলন করেছেন, মওলানা ভাষানীর কাগমারি সম্মেলন করেছেন, সন্তোষের সম্মেলন করেছেন, নকশাল বিদ্রোহের সময় পার্টির দায়িত্ব নিয়ে ইন্ডিয়ায় গিয়ে চারু মজুমদারের সাথে দেখাও করেছেন।

    কমিউনিস্ট আন্দোলনের স্মৃতি নিয়ে দু-তিনটি বই লিখেছেন। সে সব বই আর বাজারে নেই। ৮৬ বছর বয়সে গত বছর বাবা দেহ রাখলেন। এখনো সিরাজগঞ্জে প্রত্যন্ত গ্রামের বাড়িতে গেলে তার সাবেক কৃষক কর্মী-কমরেডরা ভীড় করে আসেন। অনেকেই নকশাল বিদ্রোহের কথা বলেন। তাদের সততা, কঠোর জীবন সংগ্রাম, আত্মত্যাগ আর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দেখলে এখনো চমকে উঠি।

    মনে পড়ে বাবার কথা। তিনি বরাবরই বলতেন, সাধারণ গ্রামের মানুষ কমিউনিস্ট আন্দোলনে দীক্ষা নিলে ব্যক্তিজীবনে কখনো আদর্শচ্যুত হননা, ডিগবাজী মারেন পাতি বুর্জোয়ারা, এটি তার ৪০ বছরের কৃষক রাজনীতির অভিজ্ঞতা।

    এই লেখা পড়তে পড়তে এসব এলোমেলো ভাবনাই এলো।

    বাবা চলে যাওয়ার পর “আমার বাবা আজিজ মেহের” নামে গুরুতে একটি নোট লিখেছিলাম, গুগোল করলে বোধহয় সেই লেখাটি পাওয়া যাবে।

    এই লেখাটি নিয়ে নতুন কথা আর কি বলবো? “গোড়া নকশাল”
    বইটি আনতে অর্ডার দিয়েছি। বাকীটা বই পড়ার পর।

    শুভেচ্ছা
  • কৌস্তুভ দাস | 103.87.142.22 | ১৭ এপ্রিল ২০২২ ০১:১৬506490
  • গোরা নকশাল 
    #পাঠ_প্রতিক্রিয়া 
    গুরুচণ্ডা৯ প্রকাশনা 
    ফেসবুকে বিভিন্ন গ্রুপের রিভিউ পড়ে একদিন পড়েই ফেললাম ইন্দুবালা ভাতের হোটেল। কল্লোল লাহিড়ী র লেখার সঙ্গে সেই সূত্রে পরিচয়। 
    ভালো লাগলো ,সেই কারণে এবার খোঁজ করতে লাগলাম সেই লেখক এর অন্যান্য বইয়ের। 
    এবার বই মেলা থেকে কিনে আনলাম গোরা নকশাল, আর বাবার ইয়াশিকা ক্যামেরা। 
    আজকে কথা বলব গোরা নকশাল নিয়ে। 
    একটা লেখাপড়া হয়ে যাওয়ার পর কল্লোল লাহিড়ীর গদ্যের চলন সম্পর্কে একটা পরিচিতি এসেছে, তাই প্রথম আলাপ এর মত আবিষ্ট না হলেও পরিচিত প্রিয়জনের সঙ্গে পুনরায় সাক্ষাতের যে আরাম তা পেয়েছি। 
    নকশাল আন্দোলনের পটভূমিকায় লেখা হয়েছে অনেক গল্প উপন্যাস। সমরেশ মজুমদার।, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, অসীম রায় , এবং আরো অনেকের লেখা রয়েছে। কিন্তু এই লেখাটির বিশেষত্ব হল এখানে লেখক কোন পক্ষ নেন নি, বিশেষ কোনো বার্তা দেন নি,  একটা প্রচ্ছন্ন সহানুভূতি প্রতিটি ছত্রে প্রকাশ পেয়েছে যদিও। 
    এই লেখা যতটা গোরা  নকশালের তার থেকে বেশি লেখক এর , যার নাম টুকনু, একটি ছোট্ট ছেলে যে বড় হয়েছে এবং যার চোখেই সেই গোরা নকশাল কে দেখা।
    তারা ঠিক ছিল কি ভুল ছিল, কি ছিল তাদের আন্দোলন, কেমন ছিল তাদের আন্দোলন সেই প্রশ্নের দিকেই যাননি লেখক। বরং দেখতে চেয়েছেন ফিরে আসার পর পরবর্তীকালে মানুষের সরকার, আমাদের সরকার ,লাল সরকার তার আমলে কিছু কি পরিবর্তন হয়েছিল? রোমান্টিসিজম এই লেখার ছত্রে ছত্রে ,আর হয়তো সংগত কারণেই প্রবল বিতর্কিত এই রাজনৈতিক বিষয়ে লেখক আড়াল খুঁজে নিয়েছেন খানিকটা তার অপূর্ব বর্ণনার মাধ্যমে। 
    কিন্তু যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে যদি এই বর্তমান ব্লগ ফেসবুকের যুগে টুকনু র শুধুমাত্র গল্প লেখার মাধ্যমে স্মৃতিচারণ ছাড়াও এই যে মানুষের নিরন্তর লড়াই, রাষ্ট্র ও ক্ষমতার অপরিবর্তিত রূপ , তার পরিপ্রেক্ষিতে আজকেও যে সব আশা শেষ হয়ে যায়নি এমন কোনো উল্লেখ যদি বীজের মতো, অংকুর এর মত ও থাকতো, হয়ত একটা দিক থেকে লেখাটা পূর্ণতা পেত। 
    এটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত মতামত ।
    যদিও সেই অর্থে লেখা টি কখনোই অপূর্ণ নয়। এক মায়াবী আবেশে মনটা ভরে থাকে পড়া শেষ হয়ে যাওয়ার পরে ও । হয়তো বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে চারিদিকের পরিস্থিতির মধ্যে নিজেদের অসহায়তায় ক্ষিপ্ত হতে হতে মনটা এতটাই বিক্ষিপ্ত যে সুন্দর একটি রোমান্টিক স্মৃতিচারণমূলক লেখার মধ্যেও রাজনীতি অনুপ্রবেশ নিজেই ঘটিয়ে ফেলেছি।

     
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে মতামত দিন