এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • দেশে - বিদেশে

    Ramkrishna Bhattacharya লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১৭ জুন ২০১৬ | ২২৯১ বার পঠিত
  • “দেশে বিদেশে”

    +++++++

    রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য সান্যাল

    ++++++++++

    বাংলা সাহিত্যে খোশগল্প, মজলিসী এবং আড্ডা রসের একটি ধারা ছিল, কিন্তু খোশগল্প, আলী সাহেবের রচনায় শিল্পসুষমামণ্ডিত হয়ে দিল্ তর্ করা যে খুশবাই এনে দিয়েছিলেন- বাংলা সাহিত্যের কুতুব মিনার “ দেশে বিদেশে” র মাধ্যমে, তা ভগীরথের শিবের জটার থেকে গঙ্গা আনার মতই তুলনীয়।

    মুজতবা আলী
    রসসাহিত্যের ধারা যখন ধীরে ধীরে শুকিয়ে আসছে- ঠিক তখনই “দেশ” পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে এই লেখাটির আবির্ভাব। সাহিত্যের শুকিয়ে ওঠা নদী, খাল, বিল, হাওর ভরে উঠলো রসসাহিত্যের মিষ্টি জলে।
    খাবি খাওয়া মাছের মত পাঠককুল আবার চোখ মেলে তাকিয়ে সাঁতার কাটতে শুরু করলেন – এই জলে।

    ১৯৪৬ সালের দ্বিতীয় ভাগ। দেশ বিভাগের শুরুতে ভ্রাতৃহনন পালা সবে শেষ হয়েছে। চারিদিকে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। সন্ত্রাসের বিভীষিকা তখনো ভ্রুকুটি হেনে যাচ্ছে। যক্ষ্মারোগাক্রান্ত তরুণ বুদ্ধিজীবী বন্ধু আবু সইয়দ আইয়ুবকে নিয়ে সেই দুর্যোগের সময় আলী সাহেব গেলেন দাক্ষিণাত্যের মদনাপল্লী স্বাস্থ্য নিবাসে।

    কয়েক মাসের মধ্যে আবু সইয়দ আইয়ুব সেরে উঠে কোলকাতায় ফিরে গেলেও, আলী সাহেব থেকে গেলেন দক্ষিণ ভারতে। রমণ মহর্ষির অরুণাচল আশ্রমে সাধুসান্নিধ্যে কিছুদিন থেকে এখনকার বেঙ্গালুরু ( ভূতপূর্ব – ব্যাঙ্গালোর) গেলেন কয়েক মাসের জন্য – আর এখানেই রচিত হল, সেই দিগ্‌গজ বই। এখনকার লুরু বাসী বাঙালি ভাই বোনেরা এই জন্য গর্ব করতেই পারেন।

    তবে, তাঁর এই প্রথম বই বা সাহিত্য রচনার পেছনে একটা করুণ রস লুকিয়ে আছে, যেটা হয়তো অনেকেরই অজানা।

    মুজতবা আলী বলেছেন :-
    ….. “আমি তখন অর্থাৎ ১৯৪৮ (হবে ১৯৪৭) খ্রিষ্টাব্দে আমার এক অন্ধ্রদেশীয় বন্ধু বীরভদ্র রাওয়ের সাথে মাদ্রাজের বেলাভূমিতে নির্মিত তস্য গৃহে কাল যাপন করছি।
    সেখানে সমুদ্রের ওপারে চমৎকার সূর্যোদয় হয়। সূর্যাস্ত অবশ্য সমুদ্রগর্ভে হয় না। অর্থাৎ পূর্বাকাশে যে রঙে রঙে রঙিন চিত্রলেখা অঙ্কিত হয়, সেটি কারও দৃষ্টি এড়াতে পারে না।

    আমি মাঝে মাঝে তারই বর্ণনা আপন ডায়েরিতে লিখি। বীরভদ্র রাওকে মাঝে মাঝে পড়ে শোনাই।
    হঠাৎ, বলা নেই কওয়া নেই- সে একখান অত্যুত্তম green leaf খাতা তথা ভারী সুন্দর একটা কলম এনে দিয়ে বলল :-সূর্যোদয় সূর্যাস্তের স্কেচ অর্থাৎ বর্ণনা তো এঁকেছ বিস্তর, এবার একটা পূর্ণাঙ্গ কেতাব লেখো।

    পুত্রকে কোলে নিয়ে জাহানার
    তখন মনে পড়লো – আমাদের পরিবারের প্রথম সন্তান, আমার বড় দাদার বড় মেয়ে জাহানারা একাধিক বার ব্যঙ্গ করে আমায় বলেছে:- হেঁ:! ছোট চাচার শুধু মুখে মুখে হাই জাম্প আর লঙ জাম্প। আপনি একটা বই লিখে দেখান না, আপনি কিছু একটা করতে পারেন?:
    আমার তখন বড্ডই গোশ্ শা হতো। তদুপরি অর্থকৃচ্ছ্রতা। তখন গত্যন্তর না পেয়ে লিখলুম – “দেশে বিদেশে”।…….. সেইটি নিয়ে চললুম সুদূর মাদ্রাজ থেকে সিলেটে। বইখানা জাহানারাকে নিজেই পড়ে শোনাবো বলে।
    ওই মেয়েটিকে আমি বড়ই ভালো বাসতাম। গিয়ে দেখি, জাহানারা সিলেটে নেই। তার স্বামী কক্সবাজারে বদলী হয়েছে বলে, দুই পুত্র আর এক পাতানো ভাই সহ চাটগাঁ থেকে জাহাজ ধরেছে।
    দুদিন পরে খবর এলো জাহাজডুবিতে সবাই গেছে।
    এই শোক আমার কলিজায় দগদগে ঘা হয়ে আছে। বইখানা তাই জন্নতবাসিনী জাহানারার স্মরণে উৎসর্গিত হয়েছে।”
    ( কি করে সাহিত্যিক হলাম- শ্রী অবিনাশ চক্রবর্তীর সৌজন্যে প্রাপ্ত এবং আকাশ বাণী কোলকাতা কেন্দ্র থেকে ৮ ই এপ্রিল ১৯৬৯ য়ে সম্প্রচারিত কথিকার টেপ থেকে অনুলিখিত)

    জাহানারা স্বামীপুত্রকন্যাসহ কক্সবাজারে ষ্টীমারডুবিতে মারা যান ১৯৪৭-এর ২৪ শে অক্টোবর। সুতরাং মুজতবা সদ্যসমাপ্ত প্রথম বইয়ের পাণ্ডুলিপি নিয়ে ১৯৪৭-এর অক্টোবরেই সিলেটে যাচ্ছিলেন।

    মুজতবা সায়েবের কোলকাতার বাসা ৫ নং পার্ল রোডে তখন তাঁর আড্ডা বসতো। সেখানেই লেখক তাঁর প্রথম বইটি বন্ধু বান্ধবদের পড়ে শোনাতেন। ব্যতিক্রমধর্মী রচনাটির অসাধারণত্বে বিমুগ্ধ কানাইলাল সরকার পাণ্ডুলিপিটি এনে সাগরময় ঘোষের হাতে দেন, সাথে এটাও অনুরোধ করেন যাতে এটি অনতিবিলম্বে “দেশ” পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়।

    এ সম্বন্ধে সাগরময় ঘোষ একটা চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন।

    “আমি যখন তন্ময় হয়ে সদ্য হাতে আসা পাণ্ডুলিপিটা পড়ছি, তখন প্রাত্যহিক বন্ধুরা একে একে এসে জুটলেন।
    রাবীন্দ্রিক ধাঁচের হস্তাক্ষরে লেখা পাণ্ডুলিপির ওপর সাগরবাবুর মুগ্ধদৃষ্টি লক্ষ্য করে, বৈঠকের গাল্পিক সাহিত্যিকরা বিরক্ত হয়ে বললেন:- রাবীন্দ্রিক ধাঁচের হাতের লেখার যে বিরাট পাণ্ডুলিপির ওপরে আপনি এতক্ষণ হুমড়ি খেয়ে পড়ছিলেন, সে বস্তুটি কি আমরা জানতে পারি কি?
    ভ্রমণ কাহিনী
    আমার কথা শুনে সব্যসাচী- সাহিত্যিক, গাল্পিক সাহিত্যিককে একটু ভরসা দেবার সুরে বললেন:-
    যাক্, বেঁচে গেলেন। উপন্যাস তো নয়। উপন্যাস হলেই ভয়- আবার একজন প্রতিদ্বন্দ্বী দেখা দিল।
    আমি বললাম- নাই বা হল উপন্যাস। এ লেখার জাতি – পাঁতি স্বতন্ত্র। উপন্যাস এর ধারে কাছে লাগে না।
    দশ জোড়া বড় বড় চোখে এক রাশ বিস্ময় ভরা প্রশ্ন জেগে উঠলো- লেখকটি কে ?
    আপনারা চিনবেন না। সৈয়দদা। ডক্টর সৈয়দ মুজতবা আলী। শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন ছাত্র। সেই সুবাদে আমার সৈয়দদা।
    সব্যসাচী লেখক বললেন – তাহলে তো আর কিছু বলা যাবে না। একে রাবীন্দ্রিক হস্তাক্ষর তদুপরি শান্তিনিকেতন, এ লেখা তো অবশ্য প্রকাশিতব্য।
    আমি বললাম :- আগামী সপ্তাহ থেকেই লেখাটি প্রকাশিত হবে। আপনারাই তখন বিচার করবেন, লেখাটি প্রকাশিতব্য কিনা। তবে, এটুকু বলে রাখছি- এই এক বই লিখেই ইনি বাংলা সাহিত্যের পাঠক চিত্ত জয় করে নেবেন।”
    সাপ্তাহিক “দেশ” এ, ১৩ ই মার্চ ১৯৪৮ থেকে ১৮ ই সেপ্টেম্বর ১৯৪৮ পর্যন্ত মোট আঠাশ কিস্তিতে- “দেশে বিদেশে” প্রকাশিত হয়ে. ইতিহাস তৈরি করল।

    ধারাবাহিকটি কতখানি পাঠক চিত্ত জয় করেছিল তার প্রমাণ পাই, ৫ ই আশ্বিন,১৩৫৫ তে লেখা “জনৈক পাঠকের” লেখা একটা চিঠিতে।
    তিনি লিখেছিলেন :-
    “আপনার “দেশে- বিদেশে” “দেশে” শেষ হয়ে গেল দেখে অকস্মাৎ একটা শূন্যতা অনুভব করলাম। এর পর কয়েক সংখ্যা “দেশ” পড়ার আগ্রহ থাকবে কিনা সন্দেহ।
    আপনার রচনাটি আমি খুব মন দিয়ে পড়েছি। এত ভালো লেগেছে, কী বলবো ......
    আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ, আপনি রচনাটিকে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করুন। তাতে বাংলা সাহিত্যের গৌরব বাড়বে বই কমবে না।”
    শ্রীযুক্ত কানাইলাল সরকারের সনির্বন্ধ অনুরোধে আলী সায়েব “নিউ এজ পাবলিশার্স লিমিটেড”কে বইটি প্রকাশের অনুমতি দেন।

    বৈশাখ ১৩৫৬ বা এপ্রিল ১৯৪৯ সালে প্রকাশ হল “দেশে- বিদেশে”। শুরু হল আলী সায়েবের জয়যাত্রা।
    কানাই বাবুর ঋণ স্বীকার করা ছাড়াও আলী সায়েব আরও দুজনের কাছে ঋণ স্বীকার করেছিলেন, প্রকাশিত বইয়ে। একজন কলাভবনের তৎকালীন সহকারী অধ্যক্ষ- শিল্পী বিনায়ক রাও মসোজী। ইনি বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন। অপরজন হলেন রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ পুলিন বিহারী সেন – যিনি “অশেষ যত্নের সাথে প্রুফ দেখেছিলেন”।

    'দেশে বিদেশে'-র পাণ্ডুলিপি থেকে
    বইটার প্রথম সংস্করণে আলী সায়েবের নামের আগে “ডঃ” ডিগ্রি দেওয়া হয়েছিল।এই বইটি প্রকাশের সাথে সাথেই তাঁর সাহিত্যিক জীবনের সূচনা। তিনি যে মুহূর্তে নিজেকে আবিষ্কার করলেন – সাহিত্যিক হিসেবে, তখনই অ্যাপেন্ডিক্সের মত “ডঃ” ডিগ্রিটা ছাঁটাই করে ফেলেছিলেন, প্রচার বিমুখ এই সত্যিকারের ভদ্রলোক।
    লেখক জীবনে আনাতোল ফ্রাঁসের একটি বক্তব্য, তিনি বীজমন্ত্র হিসেবে নিয়েছিলেন।
    “...If you wish to travel more, travel light.”
    আরও বলেছিলেন :-

    “তোমার লেখাকে যদি সর্বত্র গামী করতে চাও, হালকা হয়ে লেখ, পণ্ডিতি ফলিও না।”
    সুতরাং পাণ্ডিত্যের নির্মোক থেকে আশুমুক্তিই ছিল আলী সায়েবের কাম্য।

    ১৯৫০ সালে “দেশে- বিদেশে” বাঙলা ভাষায় প্রকাশিত সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হওয়ায়- দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় আলী সায়েবকে নরসিংহদাস পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করেন।

    আলী সায়েব কৌতুকের আড়ালে একটা কথা বলেছিলেন :-
    “লেখকের কর্তব্য যদি পাঠককে মহত্তর করাই হয়, তবে নিঃসন্দেহে আমি কুমতলব নিয়েই সাহিত্যে প্রবেশ করেছিলুম। আমার উদ্দেশ্য ছিল – অর্থলাভ।”
    এই “কুমতলবের” নমুনা যেখানে সেখানে ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর রচনায়।

    তৎকালীন সিনেমা সংক্রান্ত পত্রিকা “ জলসা”র সম্পাদককে লিখেছিলেন :-
    “শ্রীযুত জলসা সম্পাদক মহাশয় সমীপেষু,

    মহাশয়,

    সচরাচর আমি পাঠকদের জন্যই আপনার কাগজে লিখে থাকি (এবং আপনার কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ আছি, যে প্রতি সংখ্যায়ই কিছু লেখা দেব)। আপনার পড়ার জন্য নয়। কারণ আমি নিন্দুকের মুখে শুনেছি, সম্পাদকেরা এত ঝামেলার ভিতর পত্রিকা প্রকাশ করেন যে তারপর প্রবন্ধগুলো পড়ার মত মুখে আর তাঁদের লালা থাকে না। কথাটা হয়তো একেবারে মিথ্যা নয়। কারণ যেদিন আমি
    তিন্তিড়ী পলাণ্ডু লঙ্কা লয়ে সযতনে
    উচ্ছে আর ইক্ষুগুড় করি বিড়ম্বিত
    প্রপঞ্চ ফোঁড়ন লয়ে
    রন্ধন কর্ম সমাধান করি, সেদিন আমারও ক্ষিদে সম্পূর্ণ লোপ পায়।...অন্তত আমার লেখা যে আপনি একেবারেই পড়েন না, সে-বিষয়ে আমি সুনিশ্চয় – কারণ পড়া থাকলে দ্বিতীয়বারের জন্য লেখা চাইতেন না। ন্যাড়া একাধিক বার যেতে পারে বেলতলা – নিমতলা কিন্তু যায় একবারই।...

    “...যে দোষ আপনি করেছেন, তার গালমন্দ আপনিই খাবেন, এ তো হক্‌ কথা, এ তো আপনার ন্যায্য প্রাপ্য। তাই তাতে আপনার ক্ষোভ থাকাটা অশোভন, কিন্তু সংসারটা তো ন্যায়ের উপর চলে না, সে কথা তো আপনার বিলক্ষণ জানেন – তাই মাঝে মাঝে অন্যায় অপবাদ সইতে হয়।...

    “...গেল মাসে মিস গেছে তার জন্য আমি সম্পূর্ণ দায়ী নই। বড় লেখক হলে আমি অনায়াসে বলতে পারতুম, ‘মশাই, ইন্‌স্‌পিরেশন্‌ আসেনি – আমি কি দর্জি না ছুতোর অর্ডার-মাফিক মাল দেব?’ তা নয়। আমি সাধারণ লেখক। আমি আজ পর্যন্ত কখনো ইন্‌স্‌পায়ার্ড হয়ে লিখিনি। আমি লিখি পেটের ধান্দায়। পূর্বেই বলেছি, চতুর্দিকে আমার পাওনাদার। কে বলে আমি টাকার মূল্য বুঝিনে। একটু বেশি ব্যক্তিগত হয়ে যাচ্ছে, তবু না বলে উপায় নেই, আপনি হয়তো লক্ষ্য করেননি, আমি চাকরিতে থাকাকালীন কোনো প্রকারের ‘সাহিত্যসৃষ্টি’ করিনে – চাকরিতে থাকাকালীন আমার কোন বই বেরয়নি। তখন তো পকেট গরম, লিখতে যাবে কোন মূর্খ। অতএব ইন্‌স্‌পিরেশনের দোহাই কাড়লে অধর্ম হবে।...

    “...বেশীরভাগ সময়ই চলে যায় টুকিটাকি লিখে হাঁড়ির চাল জোগাড় করতে। তদুপরি আমার লেখার মন নেই, আছে পড়ার শখ। অবকাশ পেলেই মনে হয়, আরেকটু পড়ে নিই। এখন প্রচণ্ড এক মৌতাত। এর থেকে এ জীবনে আর নিষ্কৃতি পাব না।...

    “...আমার মা বলতো, আমাকে দেখলে যতটা বোকা বলে মনে হয়, আমি ততটা বোকা নই; আর বড়দা বলতো, আমাকে দেখলে যতটা বুদ্ধিমান বলে মনে হয়, আমি ততটা বুদ্ধিমান নই। কোন্‌টা ঠিক জানিনে, তবে আমার স্মৃতিশক্তিটি ভালো সে-কথাটা উভয়েই স্বীকার করতেন।...

    “...দম্ভভরে বলছি, আমি শঙ্কর কপিল পড়েছি, কান্ট হেগেল আমার কাছে অজানা নন। অলঙ্কার নব্যন্যায় খুঁচিয়ে দেখেছি, ভয় পাইনি। উপনিষদ, সূফীতত্ত্বও আমার কাছে বিভীষিকা নয়।

    “আমার পরীক্ষা নিয়ে সত্যেন বোসের এক সহকর্মী আমাকে বলেছিলেন, তিন বছরে তিনি আমায় রিলেটিভিটি কলকাতার দুগ্ধবত্তরলম্‌ করে দিতে পারবেন। পুনরূপি দম্ভভরে বলছি, জ্ঞানবিজ্ঞানের হেন বস্তু যেই যার সামনে দাঁড়িয়ে হকচকিয়ে বলেছি, এ জিনিস? না এ জিনিস আমাদ্বারা কখনও হবে না। আপ্রাণ চেষ্টা করলেও হবে না।...

    “...গুরুচণ্ডালী নিয়ে আলোচনা একাধিক স্থলে দেখেছি। চলতি ভাষা আরম্ভ হওয়ার পূর্বে এটাকে অমার্জনীয় অপরাধ ও অনুশাসন রূপে সম্মান করা হত। যদিও, যে দ্বিজেন্দ্র নাথকে রবীন্দ্রনাথ বাংলাভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ বিশেষজ্ঞ রূপে সশ্রদ্ধ সম্মান জানাতেন, তিনি স্বয়ং সে অনুশাসন তার কঠিনতম সংস্কৃত পদে পরিপূর্ণ বাংলা-দর্শন গ্রন্থে পদেপদে লক্ষ্য করতেন ও সবাইকে সে উপদেশ দিতেন। অধীন দ্বিজেন্দ্রনাথের আদেশ বাল্যকাল থেকে মেনে নিয়েছি।...ভাষার দিক দিয়ে আমি একটু সংস্কারের চেষ্টা করেছি। গুরু ও চণ্ডালকে এক পংক্তি ভোজনে বসিয়ে দিয়েছি – গুরুচণ্ডালী দোষ যে আসলে গুণ, গৌড়জনকে তা বোঝাবার চেষ্টা করেছি।...

    “...স্বীকার করলাম, বাংলাভাষায় হিন্দুর উত্তরাধিকারিত্ব আছে যথেষ্ট পরিমাণে, কিন্তু এটাই তো শেষ কথা নয়।

    “আমি বলব হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতেই সৃষ্টি হয়েছে বাংলাভাষার।...মাতৃভাষা যদি শিক্ষার মাধ্যমের মর্যাদা না পায়, তবে শিক্ষা বস্তুটা অনিবার্যভাবে উপর তলার লোকেদের একচেটিয়া অধিকারে চলে যাবে এবং শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বৈষম্যের ফলে শুরু হবে শ্রেণী সংঘাত। জন্ম নেবে নবতর অর্থনৈতিক সমস্যা। দারিদ্র-পীড়িত লোকের কাছে শিক্ষা হবে ব্যয় বহুলতার কলঙ্কে কলঙ্কিত। আকাশচুম্বী বস্তুকে ধরতে গিয়ে ব্যর্থ হবে দেশের বৃহত্তর ছাত্রসমাজ। শিক্ষার আঁতুড় ঘরে জীবনের সব আশা আকাঙ্ক্ষার সমাধি রচনা করে চিরদিনের জন্য তারা স্থবির হয়ে যাবে। মিথ্যে হয়ে যাবে লক্ষ-কোটি জীবনের হাজারো সম্ভাবনাময় সৃজনীশক্তি, তৈল-হীনতার অভিশাপে অভিশপ্ত হবে। একে কিছুতেই রোধ করা যাবে না।...”

    চিত্র পরিচালক দেবকী বসুর ইচ্ছে ছিল- ছেলে ডাঃ দিলীপ বসু বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা শাস্ত্রে উচ্চতর ডিগ্রি আর ট্রেনিং নিয়ে আসুক। এই নিয়ে বাবা ছেলের সঙ্গে মতান্তর – মনান্তর হয়, ফলে দিলীপ বাবু রাগ করে কটকে পিতৃসম সৈয়দ মুজতবা আলীর কাছে চলে যান। যাওয়ার আগে- দিলীপ বাবু আলী সায়েবকে সব কথা জানিয়ে একটা চিঠি লেখেন। চিঠির শেষে একটি হিন্দি দেহাতী ছড়ার তিনটি ছত্র তুলে ধরে চতুর্থ ছত্রটি পূরণ করার জন্য আলী সায়েবের কাছে আবদার করেন।

    দিলীপ বাবুর পাঠানো তিনটি ছত্র ছিল – এরকম :-

    “নিদ না মানে টুটি খাট
    পিয়াস না মানে ধোবী ঘাট
    ভুখা না মানে বাসী ভাত”
    আলী সায়েব প্রত্যুত্তরে লিখলেন :-

    “ভুখা ন্ মানে বাসী ভাত
    প্রেম না মানে আধী রাত ( অর্ধ রাত্রি)
    প্রেম ন্ মানে আঁধি রাত ( অন্ধকার রাত্রি)
    প্রেম ন্ মানে জাতিপাত ( জাতপাত)
    প্রেম ন্ মানে ঢেড়ী জাত (ঢেড় = ডোম)
    প্রেম ন্ মানে ভালী বাত্ ( সদুপদেশ)
    দিলীপ ন্ মানে বাপ কী বাত্।”
    আলী সাগর শেষ হবে না। পাড়ি দেওয়া ভীষণ দুষ্কর। তবু, চেষ্টা করলাম আলী সায়েবের সাহিত্যিক জীবনের শুরুয়াত নিয়ে।

    তাঁরই কথা ধার করে বলি :-
    “রক্ত রেখায় পদ্ম আসন ...”

    সূত্র -
    প্রসঙ্গ : মুজতবা আলী, শ্রীবিজনবিহারী পুরকায়স্থ সম্পাদিত, নবপত্র প্রকাশন।
    সৈয়দ মুজতবা আলী – জনাব নূরুর রহমান খান, আগামী প্রকাশনী- ঢাকা।
    চিত্র সৌজন্য :- জনাব সৈয়দ জগলুল আলী (আলী সায়েবের ছোট ছেলে)

    লেখাটি অবসর ওয়েজিনের ৩০ শে মে২০১৬ সংখ্যায় প্রকাশিক
    সকলকে ধন্যোগ । আজ দ্বিতীয় কিস্তি দিলাম । অবসরে আরও দুটো কিস্তি বেরুবে । প্রকাশিত হলে এখানে দেবো।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১৭ জুন ২০১৬ | ২২৯১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Ramkrishna Bhattacharya | 55.64.238.162 (*) | ১৭ জুন ২০১৬ ০৫:৫০55187
  • দুটো ছবি দিতে পারি নি অনেক চেষ্টা করেও
  • Abhyu | 138.192.7.51 (*) | ১৭ জুন ২০১৬ ০৬:৫১55188
  • মুজতবা আলী আমার খুব প্রিয় লেখক। ধন্যবাদ।
  • শান্তনু কুমার দাশ | 11.39.38.106 (*) | ১৭ জুন ২০১৬ ০৮:৫২55189
  • সিতু মিঞা কে না পড়লে কত মনি মুক্তো হাত ফসকে বেরিয়ে যেতে পারে - কোনো ধারনা ছিল না । পঞ্চতন্ত্র পড়া শুরু করে এইটা বুঝলাম । এমন লেখাবে আসলে শুধু মুন্সিয়ানার ফসল নয় । মানুষটাই ছিলেন তেমনি । দিলদরিয়া বাউণ্ডুলে - আর পড়াশুনা করার নেশা । কায়রোর কাফের আড্ডা গুলো চাক্ষুষ দেখে এলাম ।
  • ন্যাড়া | 81.6.117.50 (*) | ১৭ জুন ২০১৬ ০৯:৫৪55190
  • শরদিন্দুর ডাইরিতে দেশে-বিদেশে ধারাবাহিক পড়ে লেখকের প্রতি মুগ্ধতাবোধ, বিশেষতঃ ভাষার ব্যবহার আর পান্ডিত্যপূর্ণ ছ্যাবলামি, নিয়ে ছোট কিন্তু ইন্টারেস্টিং একটা এন্ট্রি আছে।
  • কল্লোল | 111.63.205.152 (*) | ১৮ জুন ২০১৬ ০২:০০55191
  • বাংলা সাহিত্যে মুজতবা আলি সায়েব, সুকুমার রায়ের মতো-ই এক ও অদ্বিতীয়।
    রম্য রচনা বা ভ্রমণসাহিত্য বাংলা ভ্ষায় নতুন কিছু না। কিন্তু আলি সায়েবের (উপন্যাসগুলি বাদ দিয়ে) সাহিত্যকীর্তিকে নিছক রম্য বা ভ্রমণসাহিত্য আখ্যা দিলে বড় বেশী লঘুকথা হয়ে যাবে। উনি আদতে প্রাবন্ধিক, এমন এক ধারার প্রাবন্ধিক যা ওনার আগে ছিলো না, ওনার পরে নেই।
  • Anaklusmos | 117.167.108.185 (*) | ১৮ জুন ২০১৬ ০৩:৫৭55192
  • আহাহা, আরেকবার পড়া শুরু করেই ফেলি। কতবার যে হল গোণার হিসেব নেই।
  • Abhyu | 85.137.6.220 (*) | ১৮ জুন ২০১৬ ০৪:০১55193
  • ভাবছিলাম, তোরমুণ্ডু কখন আসে :)
  • Atoz | 161.141.85.8 (*) | ১৮ জুন ২০১৬ ০৪:১২55194
  • আহ, অপূর্ব সব লেখা !
  • avi | 113.24.86.24 (*) | ১৮ জুন ২০১৬ ০৫:৪২55195
  • সৈয়দ মুজতবা আলীর সব লেখাই ভালো লাগে, এমন বলব না। দেশে বিদেশে পুরো অলৌকিক লেখা, হাজার বছরে একবার আসে। এক সময় ভাবতাম, ক্রুসোর মতো কোনো দ্বীপে মেরুনড হলে অন্তত সাথে যেন দেশে বিদেশে থাকে। কিন্তু ওনার উপন্যাস খুব ভালো লাগে নি, 'অবিশ্বাস্য' অতি ঝুল মনে হয়েছিল। ফিকশন ওনার খেলার জায়গা নয় বলে মনে হত। অথচ তথাকথিত রম্যরচনা যেমন চাচাকাহিনী বা পঞ্চতন্ত্র জাস্ট ফেনোমেনাল। আবার রাজনৈতিক লেখাগুলো খুব একটা পোষায় নি, কিন্তু হিটলার অ্যাডেনাওয়ার নিয়ে লেখাগুলো দারুণ। তবে হ্যাঁ, গুরুচণ্ডালী যে দোষ নয়, গুণ, সেটা এত স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে দিয়েছিলেন, লাখো কুর্নিশ।
  • de | 69.185.236.54 (*) | ২০ জুন ২০১৬ ০৯:৩০55196
  • দেশে-বিদেশে আর চাচাকাহিনীর মতো লেখা জাস্ট হয় না -

    খুব ভালো লাগলো -
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খেলতে খেলতে মতামত দিন