এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • সিনেমাওয়ালা প্রসঙ্গে

    Parichay Patra লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১৫ মে ২০১৬ | ১২০৩ বার পঠিত
  • এলিসিও সুবিয়েলার ‘ডোণ্ট ডাই উইদাউট টেলিং মী হোয়ার ইউ আর গোয়িং’ এ বন্ধ হতে বসা এক মুভি থিয়েটারের প্রোজেকশনিস্টের সঙ্গে দেখা হয় এক আপাত অশরীরী নারীর, যে এসেছে তার অতীত কোন এক জন্ম থেকে, যে জন্মে তারা দুজনে ছিল টমাস আলভা এডিসনের সহযোগী, সিনেমার জন্মরহস্যের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল। সুবিয়েলার ছবিটিও সিনেমার তথাকথিত ১০০ বছর চলাকালীন সময়েই করা। অথবা সাই মিং-লিয়াং এর ‘গুডবাই, ড্রাগন ইন’। তাইপেইয়ের বন্ধ হতে বসা সে মুভি থিয়েটারে শেষ শোতে চলে ষাটের দশকের জনপ্রিয় মার্শাল আর্টস ছবি ‘ড্রাগন ইন’, আর সেই হণ্টেড থিয়েটারে ষাটের দশকের ছবির অভিনেতাদের বিচরণ তখন, যারা সকলে হয়ত মরমানুষ নন।

    এন্ড অফ সেলুলয়েড অনেকদিনের বহুচর্চিত এক বিষয়, যদিও সুজান সনটাগ প্রমুখের প্রাথমিক নস্টালজিক প্রতিক্রিয়ার পরে ধীরে ধীরে তাতে কিঞ্চিৎ পলি জমেছে, জে হোবারম্যানের মত কেউ কেউ এ নিয়ে এবং নবোদিত ডিজিটাল সিনেমার কিছু নির্দিষ্ট উদাহরণ বেছে নিয়ে বই নামানো সত্ত্বেও। তবে সিনেফিলিয়ার সঙ্গে ইনস্যানিটির একধরনের প্রকট যোগ যে রয়েছে সে সম্পর্কে দ্বিমত নেই, প্যাট্রিক ফুয়েরির কৌতূহলোদ্দীপক বইটি যেমন বলে। কেরালায় কে আর মনোজ অন্তত দুটি ছবি করেছেন সেলুলয়েড, তৎসম্পর্কিত প্রোজেকশন/একজিবিশন সিস্টেম এবং সিনেফিলিয়ার পরিবর্তন বিষয়ে, একটি ‘১৬ মিমিঃ মেমরিজ, মুভমেন্টস অ্যাণ্ড আ মেশিন’ নামক নন-ফিকশন, অন্যটি তাঁর ডেবিউ ফিকশন ‘কন্যকা টকিজ’। শেষেরটির কেন্দ্রচরিত্র অবশ্যই একটি বন্ধ প্রেক্ষাগৃহ। এবং তার আনুষঙ্গিক নানা কৌতূক তাতে থেকে গিয়েছিল যতদূর মনে পড়ে, যেমন থিও এঞ্জেলোপুলসের ‘দ্য বী-কীপার’ সফট পর্ন হিসেবে কেরালায় মুক্তি পাওয়া।

    বাংলায় কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সিনেমাওয়ালা’ সম্ভবত এই নস্টালজিয়া কেন্দ্রিক প্রথম ছবি। সে কারণে এবং পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবিশ্বাস্য পারফর্মেন্স হেতু ছবিটিকে সাধুবাদ জানিয়ে এবার একটু ছবির দিকে দেখি। কৌশিকের এই ছবিতে অনেকসময়েই ইমেজ সেট ইন করার অবকাশ পায় না, দ্রুত এডিটিং তার আমেজটি নষ্ট করে দেয়। অথচ এন্ড অব সেলুলয়েড দাবী করতেই পারত অনেক বেশি মন্থরতা। প্রায় প্রতি দৃশ্যেই উচ্চকিত আবহের ব্যবহার তাঁর আর এক ব্যাধি। এই অপস্রিয়মাণ সিনেমা-ইতিহাসের সঙ্গে সুবিয়েলা বা সাই মিং-লিয়াং এর অশরীরীদের এক ধরনের যোগাযোগ আছে, এই স্পেকট্রাল প্রেজেন্স এখানে প্রায় নিয়তি-নির্দিষ্ট। ওদিকে গঙ্গোপাধ্যায় এই ইতিহাসকে ধরতে চান একটা বাস্তববাদী ন্যারেটিভ কাঠামোয়, যে কাঠামো বাংলা ছবির পারিবারিক বৈশিষ্ট্যকে এড়াতে পারে না, এবং ছবিটা এর ফাঁকেই দ্রুত ভেঙে পড়তে থাকে। সিনেমাওয়ালা পরাণবাবুর স্মৃতিচারণের সঙ্গে সাউণ্ডট্র্যাকে ‘নায়ক’ এর অরিন্দমের সংলাপ জুড়ে দেওয়াই কেবল পরিচালকের ইতিহাস-চারণ, এবং ‘নায়ক’ এর নন-ডাইজেটিক দৃশ্যের স্মৃতির সঙ্গে মূল ছবির ডাইজেটিক অংশের সংগতি রক্ষার প্রয়াস অতীব স্থূল।

    অথচ অনেক স্বতন্ত্র পথে ধরা যেতে পারে সেলুলয়েডের ইতিবৃত্ত। যেমন ক্লদ লেলুশের পারিবারিক ইতিহাস, যার ইহুদি বাবার সঙ্গে অ-ইহুদি মায়ের দেখাই হত না তিরিশের দশকের প্রাক-অকুপেশন পারীতে মার্কিন মিউজিক্যাল বিষয়ে মত্ত না হলে। অথবা অলিভিয়ের অ্যাসায়াসের ‘আপ্রে মে’, পোস্ট-৬৮ তরুণ জিল লন্ডনের সিনেমাতেকের পর্দায় খুঁজে পায় হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকা লোরকে, ছবির মাঝপথেই যে এঞ্জেলিক মেয়েকে আমরা দাউ দাউ আগুন থেকে বাঁচতে ফরাসী প্রাসাদপ্রতিম বাড়িটির জানালা থেকে মৃত্যুর দিকে লাফিয়ে পড়তে দেখেছি। সিনেমা আদতে এমনই এক সোলারিস গ্রহ, বা এক মন্দির-শহর চিদম্বরম, যেখানে তারকোভস্কি এবং অরবিন্দনের মৃতেরা চিরকাল ফিরে এসেছে। যেমন আমাদের অতি প্রিয় হোসে লুই গেরিনের নতুন ছবি 'আকাদেমি অব দ্য মিউজেজ' এ গেরিন কবিতাকে ডায়ালগ উইথ দ্য ডেড' বলে শনাক্ত করেন। এইভাবেই আর্কাইভিং এর ক্ষমতাই সিনেমাকে সময়ের সঙ্গে আজীবনের দ্বন্দ্বযুদ্ধে নামিয়েছে।

    এই অমিত সম্ভাবনা হয়ত ‘সিনেমাওয়ালা’ র শেষদৃশ্য ব্যবহার করতে পারত, যা করেছেও খানিক, মৃত প্রোজেকশনিস্ট এবং পরাণবাবুর সিনেমা-প্রবেশে, কিন্তু তা চূড়ান্ত বিচারে প্রেডিক্টেবল, এবং, যেমন দুর্ভিক্ষে মোট মৃত্যুর সংখ্যা কত তা ‘অশনি সংকেত’ কে পর্দায় লিখে দিতে হয়েছিল, তেমনি বন্ধ হলের মোট হিসেবনিকেশও এক্ষেত্রে করে দিতে হয়। এবং সেলুলয়েডকে ‘মেমরি অব দ্য পাস্ট’ বলে উল্লেখও করতে হয়, যদিও সেলুলয়েড এই যাবতীয় নস্টালজিয়া ধারণ করেও এখনো অতীত নয়। মহামহিম ফিলিপ গ্যারেলের মত কেউ বা তাঁদের বিষণ্ণ, আত্মহত্যাকামী, তীব্র ফরাসী ছবিগুলি নিয়ে সেলুলয়েড আঁকড়ে থাকেন আজীবন। শুধু সেলুলয়েডের সংকট সেখানে ন্যারেটিভে ধরতে হয় না, বা দেওয়াল লিখনও প্রয়োজন হয় না। ছবির এস্থেটিক একধরনের কয়েক দশক ওপারের মেলানকলিয়া নির্মাণে দক্ষ, যাকে কেবল সেলুলয়েডই ধারণে সক্ষম, এবং গ্যারেলই যাকে ছুঁতে পারেন কেবল।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১৫ মে ২০১৬ | ১২০৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • apps | 11.39.36.244 (*) | ১৭ মে ২০১৬ ০৮:০৫54044
  • পড়লুম
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। কল্পনাতীত মতামত দিন