এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • ল র ব য হ

    অভিষেক ভট্টাচার্য্য লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২০ এপ্রিল ২০১৬ | ৯২৭ বার পঠিত
  • বেজায় গরম। ফ্যানের তলায় দিব্যি চুপচাপ শুয়ে আছি, তবু ঘেমে অস্থির। টেবিলের উপর মোবাইলটা ছিল, ফেসবুক দেখবার জন্য যেই সেটা তুলতে গিয়েছি অমনি মোবাইলটা বলল, 'ডিজিটাল'! কি আপদ! মোবাইলটা ডিজিটাল বলে কেন?
    চেয়ে দেখি মোবাইল তো আর মোবাইল নেই, দিব্যি গোটা একটা ডিজিটাল দেশ প্যাটপ্যাট করে আমার দিকে চেয়ে আছে!
    আমি বললাম, 'কি মুশকিল! ছিল মোবাইল, হয়ে গেল একটা দেশ।'
    অমনি দেশটা বলে উঠল, 'মুশকিল আবার কি? ছিল সাদ্দাত হাসান মান্টো, হয়ে গেল রাজকাহিনী। এ তো হামেশাই হচ্ছে।'
    আমি খানিক ভেবে বললাম, 'তা হলে তোমায় এখন কি বলে ডাকব? তুমি তো সত্যিকারের দেশ নও, আসলে তুমি হচ্ছ মোবাইল।'
    দেশটা বলল, 'মোবাইলও বলতে পার, দেশও বলতে পার, দেশদ্রোহীও বলতে পার।'
    আমি বললাম, 'দেশদ্রোহী কেন?'
    শুনে দেশটা 'তাও জানো না?' বলে কাকে কাকে যেন খুনের হুমকি দিয়ে ফ্যাচফ্যাচ করে বিশ্রীরকম হাসতে লাগল। আমি ভারি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। মনে হল, ওই দেশদ্রোহীর কথাটা নিশ্চয় আমার বোঝা উচিত ছিল। তাই থতমত খেয়ে তাড়াতাড়ি বলে ফেললাম, 'ও হ্যাঁ হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি।'
    দেশটা খুশি হয়ে বলল, 'হ্যাঁ, এ তো বোঝাই যাচ্ছে - ভূমিকম্পের ভূ, ফ্যানের ফ্যা, আইপিএলের গরমমশলা - হল বাঙালি। কেমন হল তো?'
    আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না, কিন্তু পাছে দেশটা আবার সেইরকম বিশ্রী করে হেসে ওঠে, তাই সঙ্গে সঙ্গে হুঁ-হুঁ করে গেলাম। তার পর দেশটা খানিকক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বলে উঠল, 'সহ্য না হয় তো ওই দেশে গেলেই পার।'
    আমি বললাম, “বলা ভারি সহজ, কিন্তু বললেই তো আর যাওয়া যায় না!”
    দেশ বলল, “কেন, সে আর মুশকিল কি?”
    আমি বললাম, “কি করে যেতে হয় তুমি জানো?”
    দেশ একগাল হেসে বলল, “তা আর জানি নে? সেলিব্রিটি, মাইক, মন্তব্য, হইচই, হুমকি, ব্যাস্! সিধে রাস্তা, এক হপ্তার পথ, গেলেই হল।”
    আমি বললাম, “তা হলে রাস্তাটা আমায় বাতলে দিতে পার?”
    শুনে দেশটা হঠাৎ কেমন গম্ভীর হয়ে গেল। তার পর মাথা নেড়ে বলল, “উঁহু, সে আমার কর্ম নয়। আমার দাড়িদাদা যদি থাকত, তা হলে সে ঠিক-ঠিক বলতে পারত।”
    আমি বললাম, “দাড়িদাদা কে? তিনি থাকেন কোথায়?”
    দেশটা বলল, “দাড়িদাদা আবার কোথায় থাকবে? প্লেনে থাকে।”
    আমি বললাম, “কোথায় গেলে তাঁর সাথে দেখা হয়?”
    দেশ খুব জোরে মাথা নেড়ে বলল, সেটি হচ্ছে না, সে হবার জো নেই।”
    আমি বললাম, “কিরকম?”
    দেশ বলল, “সে কিরকম জানো? মনে কর, তুমি যখন যাবে জাপানে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে, তখন তিনি থাকবেন অস্ট্রেলিয়া। যদি অস্ট্রেলিয়া যাও, তা হলে শুনবে তিনি আছেন উলান বাতোর। আবার সেখানে গেলে দেখবে তিনি গেছেন চেকোশ্লোভাকিয়া। কিছুতেই দেখা হবার জো নেই।”
    আমি বললাম, “তা হলে তোমরা কি করে দেখা কর?”
    দেশ বলল, “সে অনেক হাঙ্গাম। আগে হিসেব করে দেখতে হবে, দাদা কোথায় কোথায় নেই; তার পর হিসেব করে দেখতে হবে, দাদা কোথায় কোথায় থাকতে পারে; তার পর দেখতে হবে, দাদা এখন কোথায় আছে। তার পর দেখতে হবে, সেই হিসেব মতো যখন সেখানে গিয়ে পৌঁছবে, তখন দাদা কোথায় থাকবে। তার পর দেখতে হবে—”
    আমি তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বললাম, “সে কিরকম হিসেব?”
    দেশ বলল, “সে ভারি শক্ত। দেখবে কিরকম?” এই বলে সে একটা তলোয়ার দিয়ে কুচুৎ করে একখানা গলা কেটে বলল, “এই মনে কর দাড়িদাদা।” বলেই খানিকক্ষণ গম্ভীর হয়ে চুপ করে বসে রইল।
    তার পর আবার ঠিক তেমনি একটা গলা কেটে বলল, “এই মনে কর তুমি,” বলে আবার ঘাড় বাঁকিয়ে চুপ করে রইল।
    তার পর হঠাৎ আবার একটা গলা কেটে বলল, “এই মনে কর ব্রিজ ভেঙে পড়ছে।” এমনি করে খানিকক্ষণ কি ভাবে আর একটা করে গলা কাটে, আর বলে, “এই মনে কর অ্যাক্ট্ অফ্ গড্—” “এই মনে কর ষড়যন্ত্র—” “এই মনে কর ব্রিজের গায়ে একটা ফুটো—”
    এইরকম শুনতে-শুনতে শেষটায় আমার কেমন রাগ ধরে গেল। আমি বললাম, “দূর ছাই! কি সব আবোল তাবোল বকছে, একটুও ভালো লাগে না।”
    দেশ বলল, “আচ্ছা, তা হলে আর একটু সহজ করে বলছি। চোখ বোজ, আমি যা বলব, মনে মনে তার হিসেব কর।” আমি চোখ বুজলাম।
    চোখ বুজেই আছি, বুজেই আছি, দেশের আর কোনো সাড়া-শব্দ নেই। হঠাৎ কেমন সন্দেহ হল, চোখ চেয়ে দেখি দেশটা ল্যাজ খাড়া করে ব্রিটেনে ছেলেমেয়েদের কাছে পালাচ্ছে আর ক্রমাগত ফ্যাচ্‌ফ্যাচ্ করে হাসছে।
    কি আর করি, ফ্যানের তলায় একটা সোফার উপর বসে পড়লাম। বসতেই কে যেন ভাঙা-ভাঙা মোটা গলায় বলে উঠল, “সাতশাহী আংটির পরে কি হয়?”
    আমি ভাবলাম, এ আবার কে রে? এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি, এমন সময় আবার সেই আওয়াজ হল, “কই জবাব দিচ্ছ না যে? সাতশাহী আংটির পরে কি হয়?” তখন উপর দিকে তাকিয়ে দেখি, রায়বাড়ির কুলাঙ্গারটা একতাড়া কাগজ হাতে নিয়ে স্ক্রিপ্ট লিখছে, আর এক-একবার ঘাড় বাঁকিয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছে।
    আমি বললাম, “সাতশাহী আংটির পরে রাজশাহী ক্যালানি। ”
    লোকটা অমনি দুলে-দুলে মাথা নেড়ে বলল, “হয় নি, হয় নি, ফেল্।”
    আমার ভয়ানক রাগ হল। বললাম, “নিশ্চয় হয়েছে। কেলিয়ে আঁচিল ফাটিয়ে দেব!"
    লোকটা কিছু জবাব দিল না, খালি ক্যামেরা চোখে দিয়ে খানিকক্ষণ কি যেন ভাবল। তার পর বলল, “রবির পরে বিভুর হয় ন্যাকামি, হাতে রইল ক্যালানি।'
    আমি বললাম, “তবে যে বলছিলে ক্যালানি হয় না? এখন কেন?”
    লোকটা বলল, “তুমি যখন বলেছিলে, তখনো পুরো ক্যালানি হয় নি। তখন ছিল বোম্বেটেমার্কা পরম আনি বেণু পাই। আমি যদি ঠিক সময় বুঝে ধাঁ করে চার বানিয়ে না ফেলতাম, তা হলে এতক্ষণে হয়ে যেত মনঘোরামার্কা গরম আনি ধেনু পাই।”
    আমি বললাম, “এমন আনাড়ি কথা তো কখনো শুনি নি। পরিচালক যদি ভালো হয়, তা সে সব সময়েই ভালো। পথের পাঁচালী বানানোর সময়েও যা, আগন্তুক বানানোর সময়েও তাই।”
    লোকটা ভারি অবাক হয়ে বলল, “তোমাদের দেশে বাবার থেকে ঝাপা হয় না বুঝি?”
    আমি বললাম, “বাবার থেকে ঝাপা কিরকম?”
    লোকটা বলল, “এখানে কদিন থাকতে, তা হলে বুঝতে। আমাদের বাজারে বাবার এখনও ভয়ানক কাটতি, হুবহু বই থেকে টুকে গেলেই ছবি মার-মার কাট-কাট হিট। এই তো ক'দিন খেটেখুটে চুরিচামারি করে খানিকটে স্ক্রিপ্ট জমিয়েছিলাম, তাও তোমার সঙ্গে তর্ক করতে অর্ধেক খরচ হয়ে গেল।” বলে সে আবার ক্যামেরা ধরে টানাটানি করতে লাগল। আমি অপ্রস্তুত হয়ে বসে রইলাম।
    এমন সময়ে হঠাৎ ল্যাপটপের স্ক্রিন থেকে কি যেন একটা সুড়ুৎ করে পিছলিয়ে কি-বোর্ডের উপর নামল। চেয়ে দেখি, দেড় হাত লম্বা এক বুড়ো, তার নিচের ঠোঁটটা উপরের ঠোঁটের উপর উঠে গেছে, হাতে একটা গিটার - তাতে গান-টান কিচ্ছু নেই, আর মাথা ভরা টাক। টাকের উপর খড়ি দিয়ে কে যেন খিস্তি লিখেছে।
    বুড়ো এসেই খুব ব্যস্ত হয়ে গিটারে দু-একটা পিড়িং-পিড়িং করেই জিজ্ঞাসা করল, “কই, ফেসবুকের পোস্টটা লেখা হল?”
    কুলাঙ্গার লোকটা খানিক এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল, "এই হল বলে।”
    বুড়ো বলল, “কি আশ্চর্য! ভোটের বাজার গরম হয়ে গেল, এখনো পোস্টটা হয়ে উঠল না?”
    লোকটা দু-চার মিনিট খুব গম্ভীর হয়ে ক্যামেরার হাতল চুষল, তার পর জিজ্ঞাসা করল, “কীসের বাজার বললে?”
    বুড়ো বলল, “ভোট।”
    লোকটা অমনি গলা উঁচিয়ে হেঁকে বলল, “লাগ্ লাগ্ লাগ্ জোট।”
    বুড়ো বলল, “মোট।” লোকটা বলল, “নোট।” বুড়ো বলল, “ফোট।” লোকটা বলল, “তুই ফোট।” ঠিক যেন নিলেম ডাকছে।
    ডাকতে-ডাকতে লোকটা হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি ডাকছ না যে?”
    আমি বললাম, “খামকা ডাকতে যাব কেন?”
    বুড়ো এতক্ষণ আমায় দেখে নি, হঠাৎ আমার আওয়াজ শুনেই সে গিটারে প্যাড়াং-প্যাড়াং করে ভয়ানক শব্দ করে আমার দিকে ফিরে দাঁড়াল।
    তার পরে গিটারটাকে দূরবীনের মতো করে চোখের সামনে ধরে অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তার পর পকেট থেকে কয়েকখানা কাঁচা খিস্তি বের করে তাই দিয়ে ফেসবুকে টকাটক করে একটা পোস্ট করে ফেলল। তার পর কোত্থেকে একটা পুরনো গীতবিতান টেনে এনে সে আমার মাপ নিতে শুরু করল, আর হাঁকতে লাগল, “খাড়াই বন্ধুগণ, হাতা বন্ধুগণ, আস্তিন বন্ধুগণ, ছাতি বন্ধুগণ, গলা বন্ধুগণ।”
    আমি ভয়ানক আপত্তি করে বললাম, “এ হতেই পারে না। বুকের মাপও বন্ধুগণ, গলাও বন্ধুগণ? আমি কি জাতিস্মর?”
    বুড়ো বলল, “বিশ্বাস না হয়, দেখ।”
    দেখলাম গীতবিতানের লেখা-টেখা সব কালি দিয়ে মুছে তার ওপরে বড় বড় করে বন্ধুগণ লেখা, তাই বুড়ো যা কিছু মাপে সবই বন্ধুগণ হয়ে যায়।
    তার পর বুড়ো জিজ্ঞাসা করল, “ওজন কত?”
    আমি বললাম, “জানি না!”
    বুড়ো তার গিটার দিয়ে আমায় একটুখানি টিপে-টিপে বলল, "এক লাখ।”
    আমি বললাম, “সেকি, পটলা যে পাচ্ছে পাঁচ লাখ, সে তো এখনো মরেইনি।”
    কুলাঙ্গার লোকটা অমনি তাড়াতাড়ি বলে উঠল, “সে তোমাদের হিসেব অন্যরকম।”
    বুড়ো বলল, “তা হলে লিখে নাও— ওজন এক লাখ, বয়েস বিশ্বাসঘাতক ঊনচল্লিশ।”
    আমি বললাম, “দুৎ! আমার বয়েস হল পাঁচ বছর দু'মাস, বলে কিনা ঊনচল্লিশ।”
    বুড়ো খানিকক্ষণ কি যেন ভেবে জিজ্ঞাসা করল, “বাম না দক্ষিণ?”
    আমি বললাম, “সে আবার কি?”
    বুড়ো বলল, “বলি বয়েসটা এখন বাঁদিকে বেঁকছে না ডানদিকে?”
    আমি বললাম, “বয়েস আবার বেঁকবে কি?”
    বুড়ো বলল, “তা নয় তো কেবলই সোজা চলবে নাকি? তা হলেই তো গেছি! কোনদিন দেখব সোজা পথে চলতে চলতে একেবারে সক্কলের ভালো করে ফেলেছে। শেষটায় নিজের পকেট খালি হয়ে মরি আর কি!”
    আমি বললাম, “তাই তো উচিত। লোকের ভালো করার জন্যেই তো -”
    বুড়ো বলল, “তোমার যেমন বুদ্ধি! ভালো করতে এখানে আসব কেন? গদিতে উঠলেই আমরা নিজেদের ভোল পাল্টে ফেলি। তখন আর 'জবাব চাই, জবাব দাও' হয় না— 'আমাদের সব ভালো, খারাপগুলো সব বিরোধীদের চক্রান্ত' করে দু'হাতে লুঠ চলতে থাকে। এমনি করে যখন পাঁচ বছর কেটে যায় তখন আবার বাকিদের সুযোগ দেওয়া হয়। আমি তো কত গদিতে উঠলাম, নামলাম আবার উঠলাম, এখন আমার গিটারটাও একটা আলাদা গদি চাইছে।” শুনে আমার ভয়ানক হাসি পেয়ে গেল।
    কুলাঙ্গারটা বলল, “তোমরা একটু আস্তে আস্তে কথা কও, আমার সিনেমাটা চট্‌পট্ বানিয়ে নি।”
    বুড়ো অমনি চট্ করে আমার পাশে এসে টাক নিয়ে বসে ফিস্‌ফিস্ করে বলতে লাগল, “একটা চমৎকার গান গাইব। দাঁড়াও একটু ভেবে নি।” এই বলে তার গিটার দিয়ে টেকো মাথা চুলকাতে-চুলকাতে চোখ বুজে ভাবতে লাগল। তার পর হঠাৎ বলে উঠল, “হ্যাঁ, মনে হয়েছে, শোনো—
    “তার পর এদিকে হানি আলকাদি তো কাকাবাবুর ক্রাচদু'টো খেয়ে ফেলেছে। কেউ কিচ্ছু জানে না। ওদিকে হাংরি কবিটা করেছে কি, ঘুমুতে-ঘুমুতে গভীরে যাও, আরো গভীরে যাও বলে হুড়্ মুড়্ করে খাট থেকে পড়ে গিয়েছে। অমনি ঢাক ঢোল সানাই কাঁশি লোক লস্কর সেপাই পল্টন হৈ-হৈ রৈ-রৈ মার্-মার্ কাট্-কাট্— এর মধ্যে রাণীমা বলে উঠলেন, ‘গীতাঞ্জলী যদি হবে, তা হলে জলাঞ্জলি নয় কেন?’ শুনে পাত্র মিত্র ডাক্তার মোক্তার আক্কেল মক্কেল সবাই বললে, ‘ভালো কথা! জলাঞ্জলি নয় কেন?’ কেউ তার জবাব দিতে পারে না, সুড়্‌সুড়্ করে পালাতে লাগল।”
    এমন সময় কুলাঙ্গারটা আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “বিজ্ঞাপন পেয়েছ? হ্যাণ্ডবিল?”
    আমি বললাম, “কই না, কিসের বিজ্ঞাপন?” বলতেই লোকটা বাবার বইয়ের বান্ডিল থেকে একখানা ছাপানো কাগজ বের করে আমার হাতে দিল, আমি পড়ে দেখলাম তাতে লেখা রয়েছে—
    শ্রীশ্রীধর্মেরষাঁড়ায় নমঃ
    শ্রীআমার-আপনারেশ্বর মুচমুচে
    ১০৮ নং চাপাতিবাজার, ধর্মপটি
    আমরা হিসাবী ও বেহিসাবী, খুচরা ও পাইকারী সকলপ্রকার হত্যার কার্য ধার্মিক প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন করিয়া থাকি। মূল্য শিরদাঁড়া। ATHEIST KILLING HALF PRICE, অর্থাৎ, নাস্তিকহত্যার অর্ধমূল্য। আপনার ব্লগের লেখা, ফেসবুকের পোস্ট ইত্যাদি আবশ্যকীয় জিনিস দেখিলেই হুমকি সহযোগে মুন্ডু উড়াইয়া থাকি।
    সাবধান! সাবধান!! সাবধান!!!
    আমরা সনাতন বরাহবংশীয় চাপাতিকুলীন, অর্থাত্‍‌, শুয়োরের বাচ্চা। আজকাল নানাশ্রেণীর গোরুর বাচ্চা, কুমীরের বাচ্চা প্রভৃতি নীচশ্রেণীর বাচ্চারাও ক্ষমতালোভে নানারূপ হত্যা চালাইতেছে। সাবধান! তাহাদের চাপাতির ধার দেখিয়া প্রতারিত হইবেন না।
    কুলাঙ্গার বলল, “কেমন হয়েছে?”
    আমি বললাম, “সবটা তো ভালো করে বোঝা গেল না।”
    কুলাঙ্গার গম্ভীর হয়ে বলল, “হ্যাঁ, ভারি শক্ত, সকলে বুঝতে পারে না। একবার ফেলু সাজতে একটা লোক এয়েছিল তার ছিল টেকো মাথা—”
    এই কথা বলতেই বুড়ো বন্ধুগণ-বন্ধুগণ করে তেড়ে উঠে বলল, “দেখ্! ফের যদি টেকো মাথা বলবি তো গিটার দিয়ে এক বাড়ি মেরে তোর আবির ফাটিয়ে দেব।”
    লোকটা একটু থতমত খেয়ে কি যেন ভাবল, তার পর বলল, “টেকো নয়, চীর্ষেন্দু-মাথা, যে মাথা ইদানিং হাবিজাবি লিখে লিখে টোল খেয়ে গিয়েছে।”
    বুড়ো তাতেও ঠাণ্ডা হল না, বসে-বসে গিটারের তারগুলো ছিঁড়ে মাথায় চুল বানিয়ে বসাতে লাগল। তাই দেখে লোকটা বলল, “পোস্টটা দেখবে নাকি?”
    বুড়ো একটু নরম হয়ে বলল, “হয়ে গেছে? কই দেখি।”
    লোকটা অমনি “এই দেখ” বলে তার ক্যামেরাখানা ঠকাস্ করে বুড়োর টাকের উপর ফেলে দিল। বুড়ো তৎক্ষণাৎ মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল আর ছোটো ছেলেদের মতো ঠোঁট ফুলিয়ে “ও দিদি, ও অঞ্জন" বলে হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদতে লাগল।
    লোকটা খানিকক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে, বলল, “লাগল নাকি! বেণু! আবির!"
    বুড়ো অমনি কান্না থামিয়ে বলল, “পরম! শাশ্বত! সাহেব!”
    লোকটা বলল, “সিদিকপুর! প্লেন!"
    আমি দেখলাম আবার বুঝি ডাকাডাকি শুরু হয়, তাই তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, “কই পোস্টটা তো দেখলে না?”
    বুড়ো বলল, “হ্যাঁ-হ্যাঁ তাই তো! কি পোস্ট হল পড় দেখি।”
    আমি ফেসবুকখানা খুলে দেখলাম ক্ষুদে-ক্ষুদে অক্ষরে লেখা রয়েছে—
    “ফেলুদা, ফেলুদা, ফেলুদা। শয়নে ফেলুদা, জাগরণে ফেলুদা, ফেলুদাই আমি, আমিই ফেলুদা। ফেলুদা আর আমি। ফেলুদার সাথে আমি। বাবা, ফেলুদা আর আমি। ফেলুদার সাথে আমি আর বাবা। বাবার দু'পাশে আমি আর ফেলুদা-”
    আমার পড়া শেষ না হতেই বুড়ো বলে উঠল, “এ-সব কি লিখেছ আবোল তাবোল?”
    লোকটা বলল, “ও-সব লিখতে হয়। তা না হলে সিনেমা হলে ছবি চলবে কেন? ঠিক চৌকস-মতো ছবি করতে হলে গোড়ায় এ-সব বলে নিতে হয়।”
    বুড়ো বলল, “তা বেশ করেছ, কিন্তু আসল পোস্টটা কি হল তা তো বললে না?”
    লোকটা বলল, “হ্যাঁ, তাও তো বলা হয়েছে। ওহে, শেষ দিকটা পড় তো!"
    আমি দেখলাম শেষের দিকে মোটা-মোটা অক্ষরে লেখা রয়েছে—
    রবির পরে বিভুর হল ন্যাকামি, হাতে রইল ক্যালানি, বয়স বন্ধুগণ, জমা শিরদাঁড়া, খরচ ৩৯ বৎসর।
    লোকটা বলল, “দেখেই বোঝা যাচ্ছে সিনেমাটা A-মার্কাও নয়, U-মার্কাও নয়। সুতরাং হয় এটা AB+ গ্রুপ, না হয় O-। পরীক্ষা করে দেখলাম ক্যালানিটা হচ্ছে O-। তা হলে বাকি তিনটে হল AB+। এখন আমার জানা দরকার, তোমরা AB+ চাও না O- চাও?”
    বুড়ো বলল, "আচ্ছা দাঁড়াও, তা হলে একবার জিজ্ঞাসা করে নি।” এই বলে সে নিচু হয়ে ঘরের চৌকাঠে মুখ ঠেকিয়ে ডাকতে লাগল, “ওরে বিজাত! বিজাত রে!”
    খানিক পরে মনে হল কে যেন চৌকাঠের ভিতর থেকে রেগে বলে উঠল, “কেন ডাকছিস?”
    বুড়ো বলল, "হাবু কি বলছে শোন্।”
    আবার সেইরকম আওয়াজ হল, “কি বলছে?”
    বুড়ো বলল, “বলছে, AB+ না O-?”
    তেড়ে উত্তর হল, “কাকে বলছে AB+? তোকে না আমাকে?”
    বুড়ো বলল, “তা নয়। বলছে, তোর রক্তটা AB+ না O-? ব্রিজ চাপা পড়া আহতদের জন্যে রক্ত লাগবে।"
    একটুক্ষণ পর জবাব শোনা গেল, “আচ্ছা, ইনবক্সে মেসেজ করতে বল।”
    বুড়ো গম্ভীরভাবে খানিকক্ষণ দাড়ি হাতড়াল, তার পর মাথা নেড়ে বলল, “বিজাতটার যেমন বুদ্ধি! মেসেজ করতে বলব কেন? টিভিতে বলাটা খারাপ হল কিসে? না হে হাবু, তুমি টিভিতেই দাও।”
    লোকটা বলল, “তা হলে ক্যালানির ক্যাল বাদ গেলে রইল আনি, আর কাটা যোগ হলে হল ক্যালকাটা। তোমার পোস্ট হল ক্যালকাটা। ক্যালকাটায় লোকের জীবনের দাম — বড়সড় কোনো হনু হলে দু'টাকা চোদ্দোআনা, আর মান মেশানো থাকলে ছয় পয়সা।”
    বুড়ো বলল, “আমি যখন গাইছিলাম, তখন তিন ফোঁটা বন্ধুগণ পোস্টের মধ্যে পড়েছিল। এই নাও তোমার ক্যামেরা, আর এই নাও পয়সা ছটা।”
    পয়সা পেয়ে লোকটার মহাফুর্তি! সে ‘টাক্-ডুমাডুম্ টাক্-ডুমাডুম্’ বলে বেণুর হাত ধরে নাচতে লাগল।
    বুড়ো অমনি আবার তেড়ে উঠল, “ফের টাক-টাক বলছিস্? দাঁড়া। ওরে বিজাত, বিজাত রে! শিগ্‌গির আয়। আবার টাক বলছে।” বলতে-না-বলতেই অন্ধকার বারান্দাগুচ্ছ থেকে মস্ত একটা সেলিব্রিটি মতন কি যেন হুড়্‌মুড়্ করে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল। চেয়ে দেখলাম, একটা টেকো লোক একটা প্রকাণ্ড কফির মগের নীচে চাপা পড়ে ব্যস্ত হয়ে হাত-পা ছুঁড়ছে! টেকোটা দেখতে অবিকল এই গিটারওয়ালা বুড়োর মতো, কেবল হাল্কা দাড়ি আছে আর বয়েস কম। গিটারওয়ালা কোথায় তাকে টেনে তুলবে, না সে নিজেই কফির মগের উপর চড়ে বসে, “ওঠ্ বলছি, শিগ্‌গির ওঠ্” বলে ধাঁই-ধাঁই করে তাকে গিটার দিয়ে মারতে লাগল।
    কুলাঙ্গারটা আমার দিকে চোখ মট্‌কিয়ে বলল, “ব্যাপারটা বুঝতে পারছ না? গাইয়ের বোঝা কবির ঘাড়ে। এর বোঝা ওর ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে, এখন ও আর বোঝা ছাড়তে চাইবে কেন? এই নিয়ে রোজ মারামারি হয়।”
    এই কথা বলতে-বলতেই চেয়ে দেখি, বিজাত তার মগসুদ্ধ উঠে দাঁড়িয়েছে। দাঁড়িয়েই সে মগ উঁচিয়ে দাঁত কড়্‌মড়্ করে বলল, “তবে রে ইস্‌টুপিড্ ভুলো!” বুড়োও আস্তিন গুটিয়ে গিটার বাগিয়ে হুংকার দিয়ে উঠল, “তবে রে লক্ষ্মীছাড়া হুলো!”
    লোকটা বলল, “লেগে যা, লেগে যা— সারদা-সারদা!”
    অমনি ঝটাপট্, খটাখট্, দমাদম্, ধপাধপ্! মুহূর্তের মধ্যে চেয়ে দেখি বুড়ো চিৎপাত হয়ে শুয়ে হাঁপাচ্ছে, আর বিজাত ছট্‌ফট্ করে টাকে হাত বুলোচ্ছে।
    বুড়ো কান্না শুরু করল, “ওরে ভাই বিজাত রে, তোর রক্ত কোন গ্রুপের রে?”
    বিজাত কাঁদতে লাগল, “ওরে হায় হায়! আমাদের বুড়োর টাকে কে খিস্তি লিখল রে!”
    তার পর দুজনে উঠে খুব খানিক গলা জড়িয়ে কেঁদে, আর খুব খানিক কোলাকুলি করে, দিব্যি খোশমেজাজে গিটারের ফাঁক গলে তার ভেতরে ঢুকে পড়ল। তাই দেখে লোকটাও তার শুটিং প্যাক্ আপ্ করে কোথায় যেন চলে গেল।
    আমি ভাবছি এইবেলা ফ্যান বন্ধ করে কেটে পড়া যাক, এমন সময় শুনি পাশেই একটা টেবিলের ওপরে কিরকম শব্দ হচ্ছে, যেন কেউ হাসতে হাসতে আর কিছুতেই হাসি সামলাতে পারছে না। উঁকি মেরে দেখি, একটা জন্তু— মানুষ না বাঁদর, প্যাঁচা না ভূত, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না— খালি হাত-পা ছুঁড়ে হাসছে, আর বলছে, “এই গেল গেল— নাড়ি-ভুঁড়ি সব ফেটে গেল!”
    হঠাৎ আমায় দেখে সে একটু দম পেয়ে উঠে বলল, “ভাগ্যিস তুমি এসে পড়লে, তা না হলে আর একটু হলেই হাসতে হাসতে পেট ফেটে যাচ্ছিল।”
    আমি বললাম, “তুমি এমন সাংঘাতিক রকম হাসছ কেন?”
    জন্তুটা বলল, “কেন হাসছি শুনবে? মনে কর, যদি ব্যাঙ্কের সিন্দুকগুলো সব আকাশে উড়ে যেত আর সব টাকাপয়সা বৃষ্টির মত মাটিতে এসে পড়ত, আর বড়লোকগুলো সব চিন্তায় শুকিয়ে আমশি হয়ে যেত আর জোরে হাওয়া দিলেই সব ধপাধপ্ পড়ে যেত, তা হলে— হোঃ হোঃ হোঃ হোঃ—” এই বলে সে আবার হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ল।
    আমি বললাম, “কি আশ্চর্য! এর জন্য তুমি এত ভয়ানক করে হাসছ?”
    সে আবার হাসি থামিয়ে বলল, “না, না, শুধু এর জন্য নয়। মনে কর, একজন নেতা আসছে, তার এক হাতে মাইক আর-এক হাতে আমসত্ত্ব, আর নেতাটা আমসত্ত্ব খেতে গিয়ে ভুলে মাইকের হ্যান্ডেল খেয়ে ফেলেছে— হোঃ হোঃ, হোঃ হোঃ, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ—” আবার হাসির পালা।
    আমি বললাম, “কেন তুমি এই-সব অসম্ভব কথা ভেবে খামকা হেসে-হেসে কষ্ট পাচ্ছ?”
    সে বলল, “না, না, সব কি আর অসম্ভব? মনে কর, একজন লোক গুন্ডা পোষে, রোজ তাদের নাইয়ে খাইয়ে শুকোতে দেয়, একদিন একটা কমিউনিস্ট এসে সব গুন্ডা খেয়ে ফেলেছে— হোঃ হোঃ হোঃ হোঃ—”
    জন্তুটার রকম-সকম দেখে আমার ভারি অদ্ভুত লাগল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “তুমি কে? তোমার নাম কি?”
    সে খানিকক্ষণ ভেবে বলল, “আমার নাম প্রতিশ্রুতি। আমার নাম প্রতিশ্রুতি, আমার ভায়ের নাম প্রতিশ্রুতি, আমার বাবার নাম প্রতিশ্রুতি, আমার পিসের নাম প্রতিশ্রুতি-"
    আমি বললাম, “তার চেয়ে সোজা বললেই হয় তোমার গুষ্টিসুদ্ধ সবাই প্রতিশ্রুতি।"
    সে আবার খানিক ভেবে বলল, “তা তো নয়, আমার নাম কাঁচকলা দেখানো! আমার মামার নাম কাঁচকলা দেখানো, আমার খুড়োর নাম কাঁচকলা দেখানো, আমার মেসোর নাম কাঁচকলা দেখানো, আমার শ্বশুরের নাম কাঁচকলা দেখানো—”
    আমি ধমক দিয়ে বললাম, “সত্যি বলছ? না বানিয়ে?”
    জন্তুটা কেমন থতমত খেয়ে বলল, “না না, আমার শ্বশুরের নাম মেতন ডগত।”
    আমার ভয়ানক রাগ হল, তেড়ে বললাম, “একটা কথাও বিশ্বাস করি না।”
    অমনি কথা নেই বার্তা নেই, ঝোপের আড়াল থেকে মার্কামারা একটা আমেরিকান লোক হঠাৎ উঁকি মেরে জিজ্ঞাসা করল, “সেফ মার্ক করা হচ্ছে বুঝি?”
    আমি বলতে যাচ্ছিলাম ‘না’, কিন্তু কিছু না বলতেই তড়্‌তড়্ করে সে বলে যেতে লাগল, “তা তোমরা যতই মার্ক কর, এমন অনেক জিনিস আছে যা মার্কের মার্কেটিং ক্যাম্পেনের মধ্যে পড়ে না। তাই আমি একটা বক্তৃতা দিতে চাই, তার বিষয় হচ্ছে— মার্ক ম্যায় হুঁ, মার্ক ইধার হ্যায়।” এই বলে সে হঠাৎ এগিয়ে এসে বক্তৃতা আরম্ভ করল—
    “হে বালকবৃন্দ এবং স্নেহের প্রতিশ্রুতি, আমার গায়ে চড়ানো টি-শার্ট দেখেই তোমরা বুঝতে পারছ যে আমার নাম শ্রী মার্কামারা চুরিরভাগ, মারকাটারি। আমি খুব চমৎকার মার্ক করাতে পারি, তাই আমার নাম মার্কামারা, আর চুরির ভাগ নিই সে তো দেখতেই পাচ্ছ। কোন-কোন ব্যাপারে মার্ক করা যায় আর কোনটা-কোনটায় করা যায় না, তা আমি সব নিজে পরীক্ষা করে দেখেছি, তাই আমার উপাধি হচ্ছে মারকাটারি। আমি অনেকরকম নো-মার্কসওলা জিনিস চেটে দেখেছি, ওতে মার্ক করার মতো কিচ্ছু নেই। অবিশ্যি আমরা মাঝে-মাঝে এমন অনেক জিনিস চাপাই, যা তোমরা নিতে চাও না, যেমন— অ্যাড্ কিম্বা রাঙানো ডিপি -" বলেই মার্কামারা লোকটা আকাশের দিকে চোখ তুলে বিকট চীৎকার করে লাইক কুড়োতে লাগল।
    প্রতিশ্রুতিটা এতক্ষণ পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিল, হঠাৎ লোকটার বিকট কান্না শুনে সে হাঁউ-মাঁউ করে ধড়্‌মড়িয়ে উঠে বিষম-টিষম খেয়ে একেবারে অস্থির! আমি ভাবলাম বোকাটা বুঝি মরে এবার! কিন্তু একটু পরেই দেখি, সে আবার তেমনি হাত-পা ছুঁড়ে ফ্যাক্‌ফ্যাক্ করে হাসতে লেগেছে।
    আমি বললাম, “এর মধ্যে আবার হাসবার কি হল?”
    সে বলল, “সেই একজন লোক ছিল, সে মাঝে-মাঝে এমন ভয়ংকর অহল্যা বানাত যে সবাই তার উপর চটা ছিল! একদিন কে একজন ব্যোমযাত্রীর ডায়েরি থেকে বেমালুম টুকে ছবি বানিয়েছে, আর অমনি সবাই দৌড়ে তাকে দমাদম মারতে লেগেছে— হোঃ হোঃ হোঃ হোঃ—” আমি বললাম, “যত-সব বাজে কথা।” এই বলে যেই ফিরতে গেছি, অমনি চেয়ে দেখি একটা নেড়ামাথা কে-যেন সঙের মতো চাপকান আর পায়জামা পরে হাসি-হাসি মুখ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। দেখে আমার গা জ্বলে গেল। আমায় ফিরতে দেখেই সে আবদার করে আহ্লাদীর মতো ঘাড় বাঁকিয়ে দু'হাত নেড়ে বলতে লাগল, “না ভাই, না ভাই, এখন আমায় পোস্টাতে বোলো না। সত্যি বলছি, আজকে আমার পোস্ট তেমন খুলবে না।”
    আমি বললাম, “কি আপদ! কে তোমায় পোস্টাতে বলছে?”
    লোকটা এমন বেহায়া, সে তবুও আমার কানের কাছে ঘ্যান্‌ঘ্যান্ করতে লাগল, “রাগ করলে? হ্যাঁ ভাই, রাগ করলে? আচ্ছা না হয় কয়েকটা পোস্ট করে দিচ্ছি, রাগ করবার দরকার কি ভাই?”
    আমি কিছু বলবার আগেই মার্কামারাটা আর প্রতিশ্রুতিটা একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, “হ্যাঁ-হ্যাঁ-হ্যাঁ, পোস্ট হোক, পোস্ট হোক।” অমনি নেড়াটা তার পকেট থেকে মস্ত একখানা ট্যাব বার করে, সেটা চোখের কাছে নিয়ে গুনগুন করতে করতে হঠাৎ সরু গলায় চীৎকার করে বলে উঠল— “ফিলিং হ্যাপি উইথ্ সেভেনটি আদার্স!”
    ঐ একটিমাত্র পোস্ট সে একবার করল, দু'বার করল, পাঁচবার, দশবার করল।
    আমি বললাম, “এ তো ভারি উৎপাত দেখছি, তোমার কি আর কোনো পোস্ট নেই?”
    নেড়া বলল, “হ্যাঁ আছে, কিন্তু সেটা অন্য একটা পোস্ট। সেটা হচ্ছে— ইটিং বাবার শ্রাদ্ধ অ্যাট বাড়ির ছাদ, ফিলিং দুঃখ-দুঃখ। সে পোস্ট আজকাল আমি করি না। আরেকটা পোস্ট আছে—সেটা অন্যের থেকে ঝেড়ে ঝেড়ে করতে হয়। সেটা আজকাল খুব করি।” এই বলে সে পোস্ট করল—
    হুল্লা হুল্লা গুল্লা গুল্লা, তোদের বাড়ি ছেলে পাঠাব।
    পান্তাভাতে পান্তুয়া দে, আমড়া মেখে কপাকপ খাব।।
    আমি বললাম, “এ আবার পোস্ট হল নাকি? এর তো মাথামুণ্ডু কোনো মানেই হয় না।”
    প্রতিশ্রুতি বলল, “হ্যাঁ, প্রতিশ্রুতি রাখাটা ভারি শক্ত।”
    মার্কামারা বলল, “শক্ত আবার কোথায়? ঐ দু-একটা লোককে আটকানোটা একটু শক্ত ঠেকল, তা ছাড়া টুপি পরানোটাতে তো শক্ত কিছু পেলাম না।”
    নেড়াটা খুব অভিমান করে বলল, “তা, তোমরা সহজ পোস্ট দেখতে চাও তো সে কথা বললেই হয়। অত কথা শোনাবার দরকার কি? আমি কি আর সহজ পোস্ট করতে পারি না?” এই বলে সে পোস্ট করল—
    tomake ki sundor dekhte, tumi amar bndhu hobe???
    আমি বললাম, “bndhu বলে কোনো-একটা কথা হয় না।”
    নেড়া বলল, “কেন হবে না— আলবৎ হয়। gndu, andu সব হতে পারে, bndhu কেন হবে না?”
    মার্কামারা বলল, “ততক্ষণ পোস্টটা চলুক-না, হয় কি না হয় পরে দেখা যাবে।” অমনি আবার পোস্ট শুরু হল—
    ommmaaaa!!! ki sndor kochugcher chobi diecho tumi!! amar briteo kochugch ache. ami kochu khte khub valabasa.
    আমি আবার আপত্তি করতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু সামলে গেলাম। পোস্ট আবার চলতে লাগল,
    thiz iz my sweeetieee baby teddy!!!! he izzz soooooooooo adorable!!!!! OMG!!!! I luv my teddddyyyy chhhhoooooo mucccccch!!! muuuuaaaahhhhh!!!!!
    পোস্টটা আরো চলত কি না জানি না, কিন্তু এইপর্যন্ত হতেই একটা গোলমাল শোনা গেল। তাকিয়ে দেখি আমার আশেপাশে চারদিকে একটা ফেসবুক গ্রুপ খোলা হয়ে গিয়েছে। একটা পোস্টকর্তা এগিয়ে বসে ফোঁৎ ফোঁৎ করে কাঁদছে আর একটা অ্যাডমিন মস্ত একটা লাইক নিয়ে আস্তে-আস্তে তার পিঠ থাবড়াচ্ছে আর ফিস্‌ফিস্ করে বলছে, “কেঁদো না, কেঁদো না, সব ঠিক করে দিচ্ছি।” হঠাৎ একটা ফুলশার্ট পরা, কোট জড়ানো সাংবাদিক বুম মাইক উঁচিয়ে চীৎকার করে বলে উঠল— “উড়ালপুল ভাঙার মোকদ্দমা।”
    অমনি কোত্থেকে একটা কালো চশমা পরা বিটকেল লোক এসে সকলের সামনে একটা কংক্রিটের চাঁইয়ের উপর বসেই চোখ বুজে ঢুলতে লাগল, আর একটা মরা মজুর পাঁচ লাখ টাকার নোটের একটা তোড়া দিয়ে তাকে বাতাস করতে লাগল।
    বিটকেল লোকটা একবার ঘোলা-ঘোলা চোখ করে চারদিকে তাকিয়েই তক্ষুনি আবার চোখ বুজে বলল, “গুড়ুম!”
    বলতেই অ্যাডমিনটা অনেক কষ্টে কাঁদো-কাঁদো মুখ করে চোখের মধ্যে নখ দিয়ে খিমচিয়ে পাঁচ ছয় ফোঁটা জল বার করে ফেলল। তার পর সর্দিবসা মোটা গলায় বলতে লাগল, “ধর্মাবতার হুজুর! এটা উড়ালপুল ভাঙার মোকদ্দমা। সুতরাং প্রথমেই বুঝতে হবে পুল কাকে বলে। পুল মানে টানা। টানা অতি ভালো জিনিস। টানার সাথে অনেক শব্দের ধ্বনিগত মিল, যথা— মানা, ছানা, কচুরিপানা, তাইরে-না-না ইত্যাদি। উড়ালপুলের মূল হল ওড়া, সুতরাং আমাদের উড়তে উড়তে একেবারে দিল্লী পর্যন্ত যাওয়া দরকার।”
    এইটুকু বলতেই সেই সাংবাদিকটা তড়াক্ করে লাফিয়ে উঠে বলল, “হুজুর, মূল অতি অসার জিনিস। মূলের সাথে মিল হয় পুলের, যা যখন-তখন মাথায় ভেঙে পড়ে। মুলো খেলে গলা কুট্‌কুট্ করে, রাঙামুলো বললে মানুষ চটে যায়। পুল করে কারা? যারা চেয়ারের নিচ দিয়ে টাকার বান্ডিল টেনে নেয় আর উঁচু উঁচু পোস্টে বসে থাকে।” পোস্টকর্তাটা আবার ফ্যাঁৎফ্যাঁৎ করে কাঁদতে যাচ্ছিল, কিন্তু অ্যাডমিনটা সেই প্রকাণ্ড লাইক দিয়ে তার মাথায় এক থাবড়া মেরে জিজ্ঞাসা করল, “শেয়ার, কমেন্ট, রিঅ্যাকশন কিছু আছে?” পোস্টকর্তাটা নেড়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “ঐ তো ওর হাতের ট্যাবে সব রয়েছে।” বলতেই অ্যাডমিনটা নেড়ার কাছ থেকে ট্যাবটা কেড়ে নিয়ে হঠাৎ ফেসবুকটা খুলে পড়তে লাগল—
    দেয় কে তোদের? কে দেয় তোদের? তোদের কে দেয়, রে?
    LOL LOL LOL LOL LOL LOL-
    পোস্টকর্তা বলল, “আহা ওটা কেন? ওটা তো নয়।” অ্যাডমিন বলল, “তাই নাকি? আচ্ছা দাঁড়াও।” এই বলে সে আবার একখানা পোস্ট খুলে পড়তে লাগল—
    malati, ami tomay onek valabase. tomake khub sndr dakhte. thnk for accept frndshp.…
    পোস্টকর্তাটা বলল, “দূর ছাই! কি যে পড়ছে তার নেই ঠিক।”
    অ্যাডমিন বলল, “তাহলে কোনটা, এইটা?— Hiiiiiiiiiiiiii— এটাও নয়? আচ্ছা তা হলে দাঁড়াও দেখছি— gd mrng frnds — কি বললে?— ও-সব নয়? তোমার নিজের গ্রুপের পোস্ট?— তা সে কথা আগে বললেই হত। এই তো— aaj grp e amar prthm post. kmn acho sobai???— এটাও মিলছে না? তা হলে নিশ্চয় এটা—
    Rajnikanth poked উড়ালপুল।
    পোস্টকর্তাটা ভয়ানক কাঁদতে লাগল, “হায়, হায়! আমার কমেন্টগুলো সব জলে গেল! কোথাকার এক আহাম্মক অ্যাডমিন, পোস্ট খুঁজে পায় না!”
    নেড়াটা এতক্ষণ আড়ষ্ট হয়ে ছিল, সে হঠাৎ বলে উঠল, “কোনটা শুনতে চাও? সেই যে— ইটিং বাবার শ্রাদ্ধ — সেইটে?”
    পোস্টকর্তা ব্যস্ত হয়ে বলল, “হ্যাঁ-হ্যাঁ, সেইটে, সেইটে।”
    অমনি সাংবাদিকটা আবার তেড়ে উঠল, “কার বাবার শ্রাদ্ধ? হুজুর, তা হলে বাবাকে সাক্ষী মানতে আজ্ঞা হোক।”
    বিটকেল লোকটা গাল-গলা ফুলিয়ে হেঁকে বলল, “বাবা হাজির?”
    সবাই এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখল, কোথাও বাবা নেই। তখন সাংবাদিকটা বলল, “তা হলে হুজুর, ওদের সক্কলের ফাঁসির হুকুম হোক।”
    অ্যাডমিনটা বলল, “তা কেন? এখন আমরা আপিল করব!”
    বিটকেল লোকটা চোখ বুজে বলল, “আপিল চলুক! সাক্ষী আন।”
    অ্যাডমিনটা এদিক-ওদিক তাকিয়ে প্রতিশ্রুতিকে জিজ্ঞাসা করল, “সাক্ষী দিবি? চারশো একর জমি পাবি।” জমির নামে প্রতিশ্রুতি তড়াক্ করে সাক্ষী দিতে উঠেই ফ্যাক্‌ফ্যাক্ করে হেসে ফেলল।
    সাংবাদিকটা বলল, “হাসছ কেন?”
    প্রতিশ্রুতি বলল, “একজনকে শিখিয়ে দিয়েছিল, তুই সাক্ষী দিবি যে, লোকটা গোটা থিসিসটা নিজে নিজে লিখেছে, কারুর থেকে টোকেনি, উকিল যেই তাকে জিজ্ঞাসা করেছে, এই লোকটাই কি চুরি করেছে? অমনি সে বলে উঠেছে, আজ্ঞে হ্যাঁ, পুরো চুরিটাই নিজে নিজে করেছে, কারুর থেকে টোকেনি— হোঃ হোঃ হোঃ হোঃ—”
    শেয়াল জিজ্ঞাসা করল, “তুমি পোস্টকর্তাকে চেন?”
    প্রতিশ্রুতি বলল, “হ্যাঁ, পোস্ট চিনি, কর্তা চিনি, সব চিনি। পোস্ট ফেসবুকে থাকে, তার নিচে লাইক আর কমেন্ট, আর কর্তারা খালি নিজেদের সেফ মার্ক করে।” বলতেই মার্কামারা চুরিরভাগ ভ্যাঁ-ভ্যাঁ করে ভয়ানক কেঁদে উঠল।
    আমি বললাম, “আবার কি হল?”
    মার্কা বলল, “আমার ডিপিটায় কে রামধনু লাগিয়ে দিয়েছিল, তাই আসল মুখটাও ওরকম হয়ে গেল।”
    আমি বললাম, “গেল তো গেল, আপদ গেল। তুমি এখন চুপ কর।”
    সাংবাদিকটা জিজ্ঞাসা করল, “তুমি উড়ালপুলের বিষয়ে কিছু জানো?”
    প্রতিশ্রুতি বলল, “তা আর জানি নে? একজন ধরাকে সরা ভেবে উড়তে শুরু করে, তার একদল চ্যালাচামুন্ডা থাকে আর একজনকে ভেজাল দেওয়া কোম্পানি থেকে পুল করে নিয়ে আসে, তাকে কোম্পানির মালিক বলে । তারও একদল কর্মী থাকে। এক-একদিকে দশজন করে সাক্ষী থাকে! আর পার্লামেন্টের একজন মেম্বার থাকে, সে বসে-বসে ঘুমোয়।”
    বিটকেল লোকটা বলল, “মোটেই উনি ঘুমোন না, ওনার চোখের ব্যারাম আছে, তাই চোখ বুজে থাকেন।"
    প্রতিশ্রুতি বলল, “আরো অনেক মেম্বার দেখেছি, তাদের সক্কলেরই চোখে ব্যারাম।” বলেই সে ফ্যাক্‌ফ্যাক্ করে ভয়ানক হাসতে লাগল।
    সাংবাদিক বলল, “আবার কি হল?”
    প্রতিশ্রুতি বলল, “একজনের মাথার ব্যারাম ছিল, সে খালি সিনেমার হিরো সাজত। একবার সাজল শঙ্কর, একবার যোদ্ধা, একবার পাগলু— কিন্তু যেই চাঁদের পাহাড় ২ করবে বলে অামাজনের জঙ্গলে ঢুকেছে অমনি জঙ্গল থেকে ইয়াব্বড় একটা অ্যানাকোন্ডা বেরিয়ে হিরোটাকে খেয়ে ফেলেছে। হোঃ হোঃ হোঃ হোঃ—”
    সাংবাদিক বলল, “বটে? তোমার নাম কি শুনি?”
    সে বলল, “এখন আমার নাম প্রতিশ্রুতি।"
    সাংবাদিক বলল, “নামের আবার এখন আর তখন কি?”
    প্রতিশ্রুতি বলল, “তাও জানো না? ভোটের আগে আমার নাম থাকে প্রতিশ্রুতি আবার ভোট চলে গেলেই নাম হয়ে যাবে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ।”
    সাংবাদিকটা বলল, “বাড়ি কোথায়?”
    প্রতিশ্রুতি বলল, “কার কথা বলছ? দাড়িদাদা? দাড়িদাদা প্লেনে উঠে গিয়েছে।” অমনি ভিড়ের মধ্যে থেকে বুড়ো আর বিজাত একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, “তা হলে দাড়িদাদা নিশ্চয়ই সেল্ফি তুলেছে!”
    বুড়ো বলল, “প্লেনে উঠলেই লোকেরা সব পটাপট করে সেল্ফি তোলে।”
    বিজাত বলল, “হাবুলের কাকা যেই প্লেনে উঠল অমনি দেখি সে সেল্ফি আপলোডিয়েছে।”
    সাংবাদিকটা বলল, “আঃ, সবাই মিলে কথা বোলো না, ভারি গোলমাল হয়।”
    শুনে বুড়ো বিজাতকে বলল, “ফের সবাই মিলে কথা বলবি তো তোকে মারতে মারতে সাবাড় করে ফেলব।” বিজাত বলল, “আবার যদি গোলমাল করিস তা হলে তোকে ধরে কফি-মগের তলায় চাপা দিয়ে দেব।”
    সাংবাদিকটা বলল, “হুজুর, এরা সব পাগল আর আহাম্মক, এদের সাক্ষীর কোনো মূল্য নেই।”
    শুনে অ্যাডমিনটা রেগে গ্রুপটা ডিলিট করে দিয়ে বলল, “কে বলল মূল্য নেই? দস্তুরমতো জমিজায়গা খরচ করে সাক্ষী দেওয়ানো হচ্ছে।” বলেই সে তক্ষুনি চটপট করে চারশো একর জমি মেপে প্রতিশ্রুতির হাতে দিয়ে দিল।
    অমনি কে যেন ওপর থেকে বলে উঠল, “সায়লেন্স! অ্যাকশন! কাট!” চেয়ে দেখলাম রায়বাড়ির কুলাঙ্গারটা বসে-বসে ক্ল্যাপস্টিক কামড়াচ্ছে।
    সাংবাদিকটা আবার জিজ্ঞাসা করল, “তুমি এ বিষয়ে আর কিছু জানো কি-না?”
    প্রতিশ্রুতি খানিক ভেবে বলল, “একখানা সিনেমার একটা গান আছে, সেইটা জানি।”
    সাংবাদিক বলল, “কি গান শুনি?”
    প্রতিশ্রুতি সুর করে বলতে লাগল, "একবার বল চোর, তোরা সব চোর, তোরা সব চোর—”
    বলতেই বিটকেল লোকটা ভয়ানক ব্যস্ত হয়ে উঠল, “থাক্-থাক্, সে অন্য লোকজনদের কথা, তোমার সাক্ষী দেওয়া শেষ হয়ে গিয়েছে।”
    এদিকে হয়েছে কি, সাক্ষীরা জমি পাচ্ছে দেখে সাক্ষী দেবার জন্য ভয়ানক হুড়োহুড়ি লেগে গিয়েছে। সবাই মিলে ঠেলাঠেলি করছে, এমন সময় হঠাৎ দেখি কুলাঙ্গারটা ধুপ করে ছাদের সিলিং থেকে নিচে পড়ে সাক্ষীর জায়গায় বসে সাক্ষী দিতে আরম্ভ করেছে। কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করবার আগেই সে বলতে আরম্ভ করল, “ফেলুদা, ফেলুদা, ফেলুদা। শয়নে ফেলুদা, জাগরণে ফেলুদা, ফেলুদাই আমি, আমিই ফেলুদা। ফেলুদা আর আমি। ফেলুদার সাথে আমি। বাবা, ফেলুদা আর আমি। ফেলুদার সাথে আমি আর বাবা। বাবার দু'পাশে আমি আর ফেলুদা- ”
    সাংবাদিকটা বলল, “বাজে কথা বোলো না, যা জিজ্ঞাসা করছি তার জবাব দাও। কি নাম তোমার?”
    কুলাঙ্গার বলল, “কি আপদ! তাই তো বলছিলাম— হাবুরাম ক্যামেরা।”
    সাংবাদিকটা বলল, “নিবাস কোথায়?”
    কুলাঙ্গার বলল, “বললাম যে, বাবার বাড়ি।”
    সাংবাদিক বলল, “সে এখান থেকে কতদূর?”
    কুলাঙ্গার বলল, “তা বলা ভারি শক্ত। বিভু হাঁটলে চার ঘন্টা, বেণু হাঁটলে দশ টাকা, রিকশা নিলে দু'টাকা কম। যোগ করলে সাতশাহী আংটি, বিয়োগ করলে বোম্বেটে, ভাগ করলে কেলেঙ্কারি, গুণ করলে ফেলুদা-৩০।”
    সাংবাদিক বলল, “আর বিদ্যে জাহির করতে হবে না। জিজ্ঞাসা করি, তোমার বাড়ি যাবার পথটা চেন তো?”
    কুলাঙ্গার বলল, “তা আর চিনি নে? এই তো সামনেই সোজা পথ দেখা যাচ্ছে।”
    সাংবাদিক বলল, “এ-পথ কতদূর গিয়েছে?”
    কুলাঙ্গার বলল, “পথ আবার কোথায় যাবে? যেখানকার পথ সেখানেই আছে। পথ কি আবার এদিক-ওদিক চরে বেড়ায়? না, গ্যাংটকে গন্ডগোল করতে যায়?”
    সাংবাদিকটা বলল, “তুমি তো ভারি বেয়াদব হে! বলি, সাক্ষী দিতে যে এয়েছ, উড়ালপুলের কথা কি জানো?”
    কুলাঙ্গার বলল, “খুব যা হোক! এতক্ষণ বসে-বসে সিনেমাটা বানাল কে? যা কিছু জানতে চাও আমার কাছে পাবে। এই তো প্রথমেই, পুল কাকে বলে? পুল মানে পুলুদা। পুলুদা নিশিযাপন করেছে—” বলতেই বিচার সভায় একটা ভয়ানক গোলমাল বেধে গেল। অ্যাডমিনটা হঠাৎ খেপে গিয়ে ধাঁই করে বিটকেল লোকটাকে এক ঘুঁষি কষিয়ে দিল, তাই দেখে সাংবাদিকটা মাইক হাতে 'ক্যামেরায় হাবুরামের সঙ্গে আমি -' বলে ভয়ানক চেঁচাতে লাগল, পোস্টকর্তা সেই বিরাট লাইকটা কুড়িয়ে নিয়ে হুস্ হুস্ করে মার্কামারাকে তাড়াতে লাগল।
    বিটকেল লোকটা গম্ভীর হয়ে বলল, “সবাই চুপ কর, আমি মোকদ্দমার রায় দেব।” এই বলেই কানে-কলম-দেওয়া মেয়রকে হুকুম করল, “যা বলছি লিখে নাও: উড়ালপুল ভাঙার মোকদ্দমা, পাঁচ লাখ নম্বর। ফরিয়াদী— পোস্টকর্তা। আসামী—দাঁড়াও। আসামী কই?” তখন সবাই বলল, “ঐ যা! আসামী তো কেউ নেই।” তাড়াতাড়ি ভুলিয়ে-ভালিয়ে নেড়াকে আসামী দাঁড় করানো হল। নেড়াটা বোকা, সে ভাবল আসামীরাও বুঝি জমিটমি পাবে, তাই সে কোনো আপত্তি করল না।
    হুকুম হল— নেড়ার সারাজীবনের জেল আর জেলে থেকেই ভোটে দাঁড়ানো। আমি সবে ভাবছি এরকম অন্যায় বিচারের বিরুদ্ধে আপত্তি করা উচিত, এমন সময় মার্কামারাটা হঠাৎ “তুই আনসেফ্” বলে পিছন থেকে তেড়ে এসে আমার কান কামড়ে দিল। অমনি চারদিকে কিরকম সব ঘুলিয়ে যেতে লাগল, মার্কামারার মুখটা ক্রমে বদলিয়ে শেষটায় ঠিক অফিসের বসের মতো হয়ে গেল। তখন ঠাওর করে দেখলাম, বস আমার কান ধরে বলছে, “অফিসে কাজ করবার নাম করে বুঝি বসে-বসে ফেসবুক করা হচ্ছে?”
    আমি তো অবাক! প্রথমে ভাবলাম বুঝি এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলাম। কিন্তু, তোমরা বললে বিশ্বাস করবে না, আমার মোবাইলটা খুঁজতে গিয়ে দেখি কোথাও মোবাইল নেই, আর একটা কলিগ বসে বসে একটা গ্রুপে পোস্ট করছিল, হঠাৎ আমায় দেখতে পেয়েই ফেসবুক বন্ধ করে পালিয়ে গেল। আর ঠিক সেই সময়ে রাস্তায় কে যেন ক্যাড়াং করে গিটার বাজিয়ে গান গেয়ে উঠল।
    আমি বসের কাছে এ-সব কথা বলেছিলাম, কিন্তু বস বলল, “যা, যা, কতগুলো বাজে স্বপ্ন দেখে তাই নিয়ে গল্প করতে এসেছে।” মানুষ বস হলেই এমন হোঁতকা হয়ে যায়, কিছুতেই কোনো কথা বিশ্বাস করতে চায় না। তোমরা কিনা এখনো কেউ বস হওনি, তাই তোমাদের কাছে ভরসা করে এ-সব কথা বললাম।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ২০ এপ্রিল ২০১৬ | ৯২৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • cb | 208.147.160.75 (*) | ২০ এপ্রিল ২০১৬ ০১:০৯52904
  • কি বিশাল!!! হাঁপিয়ে উঠলাম

    ভাল হয়েছে। তবে রায় বাবু যে টেমপ্লেট রেখে গেছেন সেখানে কাস্টমাইজ করলেই চলে যায় :)
  • sosen | 177.96.94.175 (*) | ২০ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:১৩52905
  • এই নিয়ে অন্তত ষোলোটা এই টেম্প্লেটে লেখা পড়লাম। একটাও অরিজিনালের মতো না ঃ)
  • Robu | 11.39.37.42 (*) | ২০ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:৫০52906
  • অরিজিনালের মত কি করে হবে? ও হয়না।
    বিটকেল লোকটা কে? বুঝতে পারলাম না তো।
  • b | 24.139.196.6 (*) | ২০ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:৫৮52907
  • বড্ড ক-ল-ই-শ-এ
  • kihobejene | 22.208.161.99 (*) | ২২ এপ্রিল ২০১৬ ০৯:৪৬52908
  • hok cliche; original to claim kore ni writer; tobu pore besh anando paoa jai - tobe kulangar lekha ta ki thik holo? nijer dosh e to o barite jonmai ni - aar "oil field" feluda jokhon peyeche tokhon chaarbe keno :-)
  • জাস্ট | 132.177.13.75 (*) | ২৩ এপ্রিল ২০১৬ ০৮:৫৪52909
  • একেবারে জমল না। না টেমপ্লেট কপি করায়, না অর্থবোধ্যতায়, না টেনে রাখার ক্ষমতায়।
  • রৌহিন | 113.42.124.95 (*) | ২৩ এপ্রিল ২০১৬ ১২:১৩52910
  • দ্বিমত। প্রথম কথা টেমপ্লেট ক্লিশে হলেও আগেরগুলো সবই আংশিক ছিল। পুরোটা এই প্রথম পড়লাম। মজাও পেলাম।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে প্রতিক্রিয়া দিন