এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • গুহাচিত্র

    অভিষেক ভট্টাচার্য্য লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২০ এপ্রিল ২০১৯ | ১৩২৩ বার পঠিত
  • গত এক বছর হল আমরা গুহাচিত্রের মাধ্যমে পরস্পরের সঙ্গে কথা বলছি। আমরা মানে আমাদের পাড়ার লোকেরা। আমরা ফ্ল্যাটের দেয়ালে গুহাচিত্র আঁকছি। আমরা ছাদের জলের ট্যাঙ্কে গুহাচিত্র আঁকছি। আমরা সর্বত্র গুহাচিত্র আঁকছি।

    এই গুহাচিত্র আঁকার সূচনাকালকে আমরা প্যালিওলিথিক যুগ নাম দিয়েছি। গত বছরের এপ্রিল থেকে জুলাই ছিল প্যালিওলিথিক। তারপর মেসোলিথিক। এখন নিওলিথিক যুগ চলছে। এ যুগে আমরা আগের দুই যুগের চেয়ে বেশি উন্নত হয়েছি। আমরা আমাদের পাথরের হাতিয়ারকে আরও ধারাল করেছি। আমরা গুহাচিত্রের ভাষাকে আগের চেয়ে উন্নত করেছি। আমরা সভ্যতার পথে অগ্রসর হয়েছি। অঙ্কিতা বলেছিল, খুব সূক্ষ্মভাবে, খুব ভাল করে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় এইসব যুগেরও আবার নানা অধিযুগ আছে। প্যালিওলিথিক যুগটাকে আপার, মিডল ও লোয়ার এই তিনভাগে ভাগ করেছে অঙ্কিতা। ওসব জটিল অ্যাকাডেমিক ব্যাপার আমি বুঝিনি। আমার ব্রেন এখনও অত উন্নত হয়নি। অঙ্কিতা বলছিল এই বিষয় নিয়ে ডক্টরেট করবে। অঙ্কিতা খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম. ফিল. করেছে অঙ্কিতা। সেদিন অফিস থেকে ফিরতে অঙ্কিতা একটু চিলি চিকেন করবে বলে চিকেন আনতে বলায় আমি পাথরের হাতিয়ার নিয়ে বেরিয়ে একটা মুরগি মেরে নিয়ে এসেছি।

    সেদিন আমাদের সোসাইটিতে একটা উৎসব ছিল। বিজয়া-সম্মিলনী টাইপের। আমরা বাজারের চত্বরটায় আগুন জ্বেলে গোল হয়ে হাত-ধরাধরি করে নাচলাম। আমরা বাঁশি বাজাতে শিখেছি। সামনের ফ্ল্যাটের সুধাময়বাবু বাঁশি বাজালেন। সে এক মনকে আচ্ছন্ন করা অপার্থিব সুর। প্যালিওলিথিক থেকে মেসোলিথিক, মেসোলিথিক থেকে নিওলিথিক - যুগাযুগান্ত ধরে যেন বয়ে গেল সেই বাঁশি। এই উৎসব, পার্বণের ছবি আমরা বাজারের দেয়ালে এঁকে রেখেছি। আজ থেকে বিশ হাজার, তিরিশ হাজার বছর পরে কোনও আর্কিওলজিস্ট হয়তো আবিষ্কার করবে সেইসব ছবি। তাই নিয়ে গবেষণা করবে। সামনে ২০২০ সাল আসছে। আমরা নববর্ষ পালন করব। নাচব, গাইব, খাব। আমাদের সভ্যতার ধারা বয়ে চলবে অনাদিকাল।

    আমি অনেকদিন সেক্স করিনি। সেদিন আচমকা অঙ্কিতা ও আমি সেক্স করলাম। এই সেক্সের কথাও আমরা গুহাচিত্র এঁকে পরস্পরকে বুঝিয়েছি। আমি আমাদের বেডরুমের দেয়ালে একটা নগ্ন ছেলে আর একটা নগ্ন মেয়ের ছবি এঁকে অঙ্কিতাকে জিজ্ঞেস করলাম ও রাজি কি না। ও উত্তরে জানাল, হ্যাঁ। তারপর আমরা সেক্স করলাম। এখানে বলে রাখি, একই ফ্ল্যাটে থাকলেও অঙ্কিতা আর আমি কিন্তু হাজব্যান্ড-ওয়াইফ নই। আমরা প্রস্তরযুগের মানুষ। আমাদের সমাজে এখনও বিয়ের প্রচলন হয়নি।

    সেদিন আমাদের পাড়ায় একটা রেপ হয়েছিল। রেপ অ্যান্ড মার্ডার। ব্যাপারটা পলিটিক্যাল কি না তা আমরা বলতে পারব না, অনেকে বলছিল একটা প্রেমের অ্যাঙ্গেলও আছে। কিছুক্ষণ পরে পুলিশ এল। এসে সব জিজ্ঞেস-টিজ্ঞেস করছিল। আমরা পুলিশকে বোঝালাম আমাদের এখানে সভ্য জগতের আইনের প্রচলন নেই। সিভিলাইজড সোসাইটিকে আমরা হেট করি। পুলিশকে বুঝিয়ে-টুঝিয়ে আমরা গাড়িতে করে ফেরত পাঠিয়ে দিলাম। তারপর আমরা বিচারসভা বসালাম। বিচারে যে ছেলেটিকে দোষী সাব্যস্ত করা হল তাকে আমরা ল্যাম্পপোস্টে বেঁধে পুড়িয়ে মেরেছি। এছাড়াও আমাদের মধ্যে চুরি করলে হাতদু'টো কব্জি থেকে কেটে নেওয়া ও মিথ্যে কথা বললে জিভ কেটে নেওয়া প্রভৃতি শাস্তির প্রচলন আছে।

    আমাদের সমাজে ধর্মের চলন এখনও হয়নি। মানে অর্গানাইজড রিলিজিয়ন। তবে আমরা স্পিরিচুয়াল। আমরা পূর্বপুরুষের আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস করি। প্রতি চান্দ্রমাসের একটা বিশেষ দিনে আমরা বাজারের কাছে সকলে সমবেত হই। হয়ে আমরা একটানা একঘেয়ে একটা সুরে গান করি। পূর্বপুরুষের আত্মারা আকাশ থেকে তখন আমাদের ওপর লক্ষ্য রাখেন ও খুশি হন। এছাড়াও কারোর অসুখ-বিসুখ করলে আমাদের পাড়ার প্রদীপ বাগচী ও তাঁর সঙ্গিনী সীমা বাগচী আসেন। ওনারা দু'জনেই শামান। মানে ওঝা। এমনিতে দু'জনেই বড় অ্যাডভোকেট। ফ্ল্যাটের দরজায় পেতলের নেমপ্লেটে নাম লেখা। বড় ছেলে টেক্সাসে আইটি ইঞ্জিনিয়ার। ওনারা মন্ত্রতন্ত্র জানেন। দিনের কোন সময়ে কী রোগ করলে কী মন্ত্র পড়লে অপদেবতা পালায় সেসব দু'জনের নখদর্পণে। ওনারা সারিয়ে তোলেন। প্রদীপ বাগচী আমাকে একটা হাড়ের টুকরো দিয়েছেন। ম্যামথের হাড়। এই ম্যামথটাকে গত ডিসেম্বরে আমরা পাড়ার সকলে মিলে মেরেছিলুম। বিরাট ভোজ হয়েছিল। পনেরোদিন ধরে খাওয়াদাওয়া। প্রদীপ বাগচী আমাকে ঐ ম্যামথের হাড়টা গলায় পরে থাকতে বলেছেন।

    এখন খুব গরম চলছে। এই গরমে আর আমরা কেউই পাহাড়ের তলার ঝর্না থেকে জল আনতে যেতে পারছি না। সকলে ফ্রিজেতেই কাজ সারছি। অঙ্কিতা সেদিন চিলি চিকেনটা দারুণ রেঁধেছিল। রাতে টিভিতে কেকেআর ভার্সেস আরসিবি দেখতে দেখতে আমরা চিলি চিকেন দিয়ে রুমালি রুটি খেলুম। খেলার স্কোর বুঝতে আমাদের একটু অসুবিধে হয়। আমরা দশের বেশি গুনতে জানি না। দেয়ালে দাগ কেটে কেটে আমরা হিসেব রাখলুম। এইসব দাগও হয়তো বিশ হাজার বছর পরে কোনও আর্কিওলজিস্ট আবিষ্কার করবে। নেক্সট মাসে অফিসের একটা অ্যাসাইনমেন্টে দিনদশেকের জন্যে আমাকে দিল্লী যেতে হবে। ঐ সময়টা আমি অঙ্কিতাকে দেখতে পাব না৷ গুহাচিত্র আঁকতেও পাব না। আমাকে সিভিলাইজড সোসাইটির সঙ্গে মিশে যেতে হবে। তবে মোবাইলে রোজ কথা হবে। স্কাইপও করা যেতে পারে। ঐ সময়টা অঙ্কিতাও একা হয়ে যাবে। তবে একা না-ও হয়ে যেতে পারে। হয়তো অঙ্কিতা অন্য কারোর ফ্ল্যাটে যাবে। অন্য কারোর সাথে সেক্স করবে। আমরা প্রস্তরযুগের মানুষ। আমাদের সমাজে এখনও সভ্যতার তৈরি করা ন্যায়-অন্যায়ের প্রচলন হয়নি।

    এভাবেই আমাদের দিন চলছে। আমাদের পাড়া, আমাদের ফ্ল্যাট। আমাদের সোসাইটি। আমরা - প্রস্তরযুগের মানুষ। আমরা নিওলিথিক। পাথরের হাতিয়ার দিয়ে আমরা সব সমস্যার সমাধান করি। আমরা নাচি, গাই, ঘুমোই, হাসি। আমরা দেয়ালে দেয়ালে গুহাচিত্র আঁকি। আজ থেকে বিশ হাজার, চল্লিশ হাজার বছর পরে কী হবে আমরা জানি না। কিন্তু আমরা বেঁচে আছি। একটু একটু করে আমরা উন্নত হচ্ছি। আমাদের সভ্যতার ধারা বয়ে চলেছে ভাবীকালের দিকে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ২০ এপ্রিল ২০১৯ | ১৩২৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • r2h | 232312.167.013412.178 (*) | ২১ এপ্রিল ২০১৯ ১২:২৯47947
  • প্রস্তরযুগের মরালিটি, নিয়ম নীতি, অপরাধের ধারনা - এইসব নিয়ে কৌতুহল হলো লেখাটা পড়ে।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি মতামত দিন