এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  বিবিধ

  • নিরন্ন অন্নদাতা ও অশোক ধাওলে

    Prativa Sarker লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ০৪ জানুয়ারি ২০১৯ | ১৮৮২ বার পঠিত
  • আমি আজ দেখলাম অশোক ধাওলেকে।
    অনেকক্ষণ তাঁর কথা শুনলাম, কি ক'রে নাসিক থেকে মুম্বাই অব্দি পদযাত্রায় রক্তমাখা ক্ষতবিক্ষত পা দুটোকে চলন্ত টেম্পোতে উঠে বিশ্রাম দেবার কথায় গর্জে উঠেছিলেন আদিবাসী কৃষক-নারী, বলেছিলেন,

    - নাসিক থেকে এতোদূর হেঁটে এলাম, সে কি গন্তব্যে পৌঁছবার আগেই বিশ্রাম নেব বলে !

    - কেন এতো কষ্ট করছেন - এই দীর্ঘ পথ হাঁটা ?

    সহযাত্রীদের এই প্রশ্নের জবাবে তার উত্তর,

    --আমার সন্তানসন্ততিকে যাতে এতো দীর্ঘ হাঁটতে না হয় আর কোনদিন , সে কারণেই আমার এই কষ্ট করা।

    শুনলাম কিসাণ লঙ মার্চের আরো বীরত্বপূর্ণ কাহিনী। সাতদিন হাঁটার পর শেষদিন গন্তব্য যখন ২৫ কিমি দূরে পরীক্ষার্থীদের অসুবিধে না করবার জন্য রাতে হাঁটা ঠিক হল। সারা দিন লাগাতার চল্লিশ কিমি হেঁটে আসবার পর খাওয়া আর অল্প বিশ্রাম।
    তারপরই মাঝরাত থেকে ফের হাঁটবে পদযাত্রীরা। চাপিয়ে দেবার ব্যাপার নেই, অনেক অশক্ত মানুষ কেবল মনের জোরে চলছেন। তাই যখন জিজ্ঞাসা করা হল, কে কে হাঁটতে পারবে সারা রাত, আকাশকে মুঠোয় ধরতে চেয়ে মাথার ওপর উঠে গেল পঞ্চাশ হাজার হাত। সবাই হাঁটবে রাত জেগে।

    যুগ যুগ ধরে মার খেতে থাকা 'চাষাভুষো'দের সঙ্ঘবদ্ধ করে তাদের প্রতিবাদ আর বিমুখতাকে এমন জায়গায় নিয়ে গেলেন ধাওয়ালেরা যে তিনটে রাজ্যে গণেশ উলটে গেল আর কৃষি ঋণ মকুব করবার ধুম পড়ে গেল। সত্যিই যেন গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার কাহিনী সত্য হয়ে ওঠা।
    না, ব্যক্তিপূজায় কোন আসক্তি নেই।
    কিন্তু ইতিহাসে তো ব্যক্তির ভূমিকা থেকে যায়, ব্যষ্টির ছাঁচে কখনো তারা ভীষণ গুরুত্ববহ হয়ে ওঠেন। মাও সে তুং বলেছিলেন, নেতা হচ্ছে সমুদ্রের ঢেউয়ের ওপর ফেনার মতো, নীচের জলকল্লোলের নাড়ী নক্ষত্র তার চেনা, অন্তরালে থাকা বিপুল শক্তির দ্যোতক তিনি।
    অশোক ধাওলে এইরকম একজন নেতা, কিসান লঙ মার্চের মূল সংগঠকদের অন্যতম, যার আঙুল রয়েছে সহযোদ্ধাদের নাড়িতে।

    তিনি যখন বলেন কেন্দ্রীয় শাসক কি ভাবে ব্রিটিশ আমলের জমি অধিগ্রহণ আইনকে (১৯৮৪) নিজের স্বার্থে ব্যবহার করবার জন্য বার বার অর্ডিন্যান্স এনেছে, শুধু পারেনি বিরোধী মোকাবিলায় তখন তা ছবি হয়ে ভাসে চোখের সামনে। এই তো সেদিন ২০১৩ সালে ইউ পি এ আমলে এই দানবীয় আইনে কিছু জনকল্যাণ মুখী পরিবর্তন এসেছিল। ২০১৪ এ তখতে আসীন হয়েই সেসব উড়িয়ে দিতে চাইলেই হবে? যখন যেমন ইচ্ছে কেড়েকুড়ে নিয়ে নাও চাষের জমি, বসত জমি, যেন হরির লুট !
    চাষার পো রা সেইদিনই চিনে নিয়েছিল মূল শত্রুকে। বুঝে গিয়েছিল ঋণ মকুবের কোন চেষ্টা, স্বামীনাথন কমিশনের কোন সুপারিশ মানবে না এ বান্দা। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় অনেকে আত্মহত্যায় বাধ্য হয়েছেন। বাদবাকিরা লাল ঝান্ডার নীচে। বিরাট যে কৃষক আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছে বিশাল এই দেশে তার প্রেক্ষাপট মোটামুটি এই। সঙ্গে আছে অরণ্যের ওপর আদিবাসীর অধিকার নাকচ ক'রে জল জঙ্গল জমিনের অধিকার কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়া। উড়িষ্যা, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিসগড় সর্বত্র এই হরির লুট। বলপ্রয়োগে ছিনিয়ে নেওয়া সর্বস্ব, তারপর আত্মহত্যা করলে তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া নানা মিথ্যে ব্যক্তিগত কলঙ্ক।

    ভারতীয় কৃষকের দুরবস্থা তো নতুন কথা নয়। তা মোচনের জন্যই স্বামীনাথন কমিশন , যার সুপারিশকে অবলীলায় ব্যাখ্যা করেন অশোক যে ফরমুলায় তা হল C2+50 %। এর অর্থ পুরো উৎপাদন ব্যয়ের দেড়গুণ কৃষক যাতে পায় তা রাষ্ট্রকে দেখতে হবে। উপরন্তু রাখতে হবে এমন এক ব্যবস্থা (মেশিনারি) যাতে কৃষক নির্ধারিত মূল্যে তার উৎপাদিত শস্য বিক্রি করতে সক্ষম হন।
    ক্ষমতায় আসবার আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার নির্বাচনী বক্তৃতায় বার বার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ক্ষমতায় এলেই এইসকল ব্যবস্থা তুরন্ত করবেন তিনি। তখতে বসবার পর যখন সত্যি সত্যি সময় এলো তখন বিজেপি দলটি সুপ্রিম কোর্টে এফিডেভিট করে জানাল, তারা এগুলোর কোনটাই করতে পারবে না, কারণ তাতে বাজার বিকৃত (distort) হবে। ২০১৪/১৫ সালে ১২০০০কৃষকের আত্মহত্যা এরই ফলশ্রুতি।অবস্থা এমন দাঁড়াল যে কৃষক আত্মহত্যার পরিসংখ্যান নেওয়া তারপর থেকে বন্ধ ক'রে দিল দেশের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো। এখন এ সংক্রান্ত কোন পরিসংখ্যান চাইলেও পাওয়া যায় না।

    স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ মানতে হ'লে প্রত্যেক কুইন্টাল ধানের সহায়ক মূল্য হওয়া উচিত ২৩৪০ টাকা। সেখানে নির্ধারিত মোদীমূল্য পার কুইন্টাল ১৭৫০ টাকা। মমতা দয়াপরবশ হয়ে দিচ্ছেন ১৭৭০ টাকা। ঐ বাড়তি ২০টাকা নাকি ট্রান্সপোর্ট খরচ। সল্ট লেক থেকে যাদবপুর বাসে নেয় ১১টাকা। আর শস্যের কুইন্টাল যাবে ২০ টাকায় !
    বন্যাবিধ্বস্ত কেরালায় কিন্তু সরকার ন্যুনতম সহায়ক মূল্য হিসেবে প্রতি কুইন্টালে দিচ্ছে ২০টাকার জায়গায় ৬০০ টাকা। মোট পরিমাণ ২৩৫০ টাকা। অর্থাৎ স্বামীনাথন কমিশনের ফরমুলা মেনে C2+50% এর চেয়েও ১০টাকা বেশি।
    শাসনের পদ্ধতিতে আর বঞ্চনার প্যাঁচে এতো মিল, আর পশ্চিমবঙ্গে বঞ্চিত কৃষকের আত্মহনন নেই এ তো হতে পারে না। ফলে ১৯১ জন মৃত কৃষককে স্মরণ করে অশোক মনে করালেন পশ্চিমবঙ্গ থেকেও এ সংক্রান্ত কোন রিপোর্ট পাঠানো বন্ধ হয়ে গেছে বহুদিন আগে। মরে গেলে এখানে এখন দুলাখ, আর বেঁচে থাকলে পাঁচহাজার ! জীবন আর মৃত্যুকে নিয়ে কি ভয়ংকর ঠাট্টা !

    কৃষকদের লঙ মার্চ আয়োজিত হয়েছে, হচ্ছে এইসব বঞ্চনা বিদ্রূপের মুহতোড় জবাব হিসেবে। কৃষকদের দাবী দুটো , অশোক ধাওলে, সারা ভারত কিষাণ সভার কর্ণধার জানালেন, ঋণ থেকে মুক্তি আর শস্যের লাভজনক দাম। এই প্রসঙ্গে বললেন ২৫০০০ টাকার লোন শোধ করতে না পারলে ব্যাংক কুকুরের মতো তাড়া করে লোন নেওয়া কৃষককে। অথচ মহারাষ্ট্রে কৃষিঋণ যা মকুব হয়েছে তার ৫১% হয়েছে মুম্বাইওয়ালা চাষাদের জন্য। মুম্বাই শহরে চাষ করে কে ? ভরা প্রেক্ষাগৃহের দিকে প্রশ্ন ছোড়েন অশোক। প্রেক্ষাগৃহ ফিসফিসোয়, অমিতাভ বচ্চন। তার সঙ্গে যে নামগুলো বলেন তিনি, সেগুলো হল আম্বানি, আদানি, মাল্লা, মেহুল, নীরব, ললিত মোদী।

    ৪ লক্ষ কোটি ব্যাংকঋণ মকুব হয়েছে কর্পোরেট হাউজগুলির। কর্পোরেট বান্ধব ব্যাংকগুলি আরো ১২লক্ষ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে, যা নিয়ে এরা দেশ ছেড়ে পালিয়েছে অথবা সে ঋণকে অনাদায়ী ঘোষণা করিয়ে ছেড়েছে। ১৬ লক্ষ কোটি টাকায় ঋণগ্রস্ত কৃষকদের কিছু সুরাহা হতো কি ?
    প্রশ্নটা তো সহজ, আর উত্তর তো জানা !

    কে এই অশোক ধাওলে ? তাঁর কথায় এতো নিবিড়ভাবে কেন ফুটে ওঠে অন্নদাতাদের নিরন্ন করুণ অবস্থা ? স্বাধীনতা সংগ্রামী, লেখক, আইনজ্ঞ, এক্টিভিস্ট গোদাবরী পারুলেকারের সাক্ষাত শিষ্য অশোক ধাওলে ডাক্তারি ছেড়ে পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হয়েছিলেন। ব্যক্তিগত বিলাসব্যসনকে তুচ্ছ জ্ঞান করে সমষ্টির স্বার্থে বিলিয়ে দিয়েছেন নিজেকে। নানা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গেছেন তিনি , অর্জন করেছেন কৃষকদের আস্থা। নাসিক টু মুম্বাই লঙ মার্চে সবার সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে সমস্ত পথটাই হেঁটেছেন তিনি। সারা ভারত কিসাণ সভার এই কর্ণধার শিলিগুড়ির পর কলকাতায় এসেছিলেন। পিডিজি ভবনের সভায় বলে গেলেন ২০১৯ এর নির্বাচনী লড়াইয়ের অন্যতম নির্ধারক হবে ব্যাপক কৃষক অসন্তোষ। বলে গেলেন আটই ও নয়ই জানুয়ারি ভারতজোড়া ধর্মঘটে সামিল হবে কৃষক সংগঠনগুলি। রাস্তায় নেমে জনবিরোধী সমস্ত নীতির বিরুদ্ধে গলা তুলবে কিষাণ কিষাণীরা। আর কোন কংসরূপী শাসকে বিশ্বাস নেই তাদের। তারা ভালই জানেন শাসকের স্বরূপ : মামা নেহি কসাই হ্যায় / কংস কা ছোটা ভাই হ্যায়।

    পথে এবার নামো সাথী ...

    আমি আজ দেখলাম অশোক ধাওলেকে।
    অনেকক্ষণ তাঁর কথা শুনলাম, কি ক'রে নাসিক থেকে মুম্বাই অব্দি পদযাত্রায় রক্তমাখা ক্ষতবিক্ষত পা দুটোকে চলন্ত টেম্পোতে উঠে বিশ্রাম দেবার কথায় গর্জে উঠেছিলেন আদিবাসী কৃষক-নারী, বলেছিলেন,
    - নাসিক থেকে এতোদূর হেঁটে এলাম, সে কি গন্তব্যে পৌঁছবার আগেই বিশ্রাম নেব বলে !

    - কেন এতো কষ্ট করছেন - এই দীর্ঘ পথ হাঁটা ?

    সহযাত্রীদের এই প্রশ্নের জবাবে তার উত্তর,

    --আমার সন্তানসন্ততিকে যাতে এতো দীর্ঘ হাঁটতে না হয় আর কোনদিন , সে কারণেই আমার এই কষ্ট করা।

    শুনলাম কিসাণ লঙ মার্চের আরো বীরত্বপূর্ণ কাহিনী। সাতদিন হাঁটার পর শেষদিন গন্তব্য যখন ২৫ কিমি দূরে পরীক্ষার্থীদের অসুবিধে না করবার জন্য রাতে হাঁটা ঠিক হল। সারা দিন লাগাতার চল্লিশ কিমি হেঁটে আসবার পর খাওয়া আর অল্প বিশ্রাম।
    তারপরই মাঝরাত থেকে ফের হাঁটবে পদযাত্রীরা। চাপিয়ে দেবার ব্যাপার নেই, অনেক অশক্ত মানুষ কেবল মনের জোরে চলছেন। তাই যখন জিজ্ঞাসা করা হল, কে কে হাঁটতে পারবে সারা রাত, আকাশকে মুঠোয় ধরতে চেয়ে মাথার ওপর উঠে গেল পঞ্চাশ হাজার হাত। সবাই হাঁটবে রাত জেগে।

    যুগ যুগ ধরে মার খেতে থাকা 'চাষাভুষো'দের সঙ্ঘবদ্ধ করে তাদের প্রতিবাদ আর বিমুখতাকে এমন জায়গায় নিয়ে গেলেন ধাওয়ালেরা যে তিনটে রাজ্যে গণেশ উলটে গেল আর কৃষি ঋণ মকুব করবার ধুম পড়ে গেল। সত্যিই যেন গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার কাহিনী সত্য হয়ে ওঠা।
    না, ব্যক্তিপূজায় কোন আসক্তি নেই।
    কিন্তু ইতিহাসে তো ব্যক্তির ভূমিকা থেকে যায়, ব্যষ্টির ছাঁচে কখনো তারা ভীষণ গুরুত্ববহ হয়ে ওঠেন। মাও সে তুং বলেছিলেন, নেতা হচ্ছে সমুদ্রের ঢেউয়ের ওপর ফেনার মতো, নীচের জলকল্লোলের নাড়ী নক্ষত্র তার চেনা, অন্তরালে থাকা বিপুল শক্তির দ্যোতক তিনি।
    অশোক ধাওলে এইরকম একজন নেতা, কিসান লঙ মার্চের মূল সংগঠকদের অন্যতম, যার আঙুল রয়েছে সহযোদ্ধাদের নাড়িতে।

    তিনি যখন বলেন কেন্দ্রীয় শাসক কি ভাবে ব্রিটিশ আমলের জমি অধিগ্রহণ আইনকে (১৯৮৪) নিজের স্বার্থে ব্যবহার করবার জন্য বার বার অর্ডিন্যান্স এনেছে, শুধু পারেনি বিরোধী মোকাবিলায় তখন তা ছবি হয়ে ভাসে চোখের সামনে। এই তো সেদিন ২০১৩ সালে ইউ পি এ আমলে এই দানবীয় আইনে কিছু জনকল্যাণ মুখী পরিবর্তন এসেছিল। ২০১৪ এ তখতে আসীন হয়েই সেসব উড়িয়ে দিতে চাইলেই হবে? যখন যেমন ইচ্ছে কেড়েকুড়ে নিয়ে নাও চাষের জমি, বসত জমি, যেন হরির লুট !
    চাষার পো রা সেইদিনই চিনে নিয়েছিল মূল শত্রুকে। বুঝে গিয়েছিল ঋণ মকুবের কোন চেষ্টা, স্বামীনাথন কমিশনের কোন সুপারিশ মানবে না এ বান্দা। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় অনেকে আত্মহত্যায় বাধ্য হয়েছেন। বাদবাকিরা লাল ঝান্ডার নীচে। বিরাট যে কৃষক আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছে বিশাল এই দেশে তার প্রেক্ষাপট মোটামুটি এই। সঙ্গে আছে অরণ্যের ওপর আদিবাসীর অধিকার নাকচ ক'রে জল জঙ্গল জমিনের অধিকার কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়া। উড়িষ্যা, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিসগড় সর্বত্র এই হরির লুট। বলপ্রয়োগে ছিনিয়ে নেওয়া সর্বস্ব, তারপর আত্মহত্যা করলে তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া নানা মিথ্যে ব্যক্তিগত কলঙ্ক।

    ভারতীয় কৃষকের দুরবস্থা তো নতুন কথা নয়। তা মোচনের জন্যই স্বামীনাথন কমিশন , যার সুপারিশকে অবলীলায় ব্যাখ্যা করেন অশোক যে ফরমুলায় তা হল C2+50 %। এর অর্থ পুরো উৎপাদন ব্যয়ের দেড়গুণ কৃষক যাতে পায় তা রাষ্ট্রকে দেখতে হবে। উপরন্তু রাখতে হবে এমন এক ব্যবস্থা (মেশিনারি) যাতে কৃষক নির্ধারিত মূল্যে তার উৎপাদিত শস্য বিক্রি করতে সক্ষম হন।
    ক্ষমতায় আসবার আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার নির্বাচনী বক্তৃতায় বার বার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ক্ষমতায় এলেই এইসকল ব্যবস্থা তুরন্ত করবেন তিনি। তখতে বসবার পর যখন সত্যি সত্যি সময় এলো তখন বিজেপি দলটি সুপ্রিম কোর্টে এফিডেভিট করে জানাল, তারা এগুলোর কোনটাই করতে পারবে না, কারণ তাতে বাজার বিকৃত (distort) হবে। ২০১৪/১৫ সালে ১২০০০কৃষকের আত্মহত্যা এরই ফলশ্রুতি।অবস্থা এমন দাঁড়াল যে কৃষক আত্মহত্যার পরিসংখ্যান নেওয়া তারপর থেকে বন্ধ ক'রে দিল দেশের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো। এখন এ সংক্রান্ত কোন পরিসংখ্যান চাইলেও পাওয়া যায় না।

    স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ মানতে হ'লে প্রত্যেক কুইন্টাল ধানের সহায়ক মূল্য হওয়া উচিত ২৩৪০ টাকা। সেখানে নির্ধারিত মোদীমূল্য পার কুইন্টাল ১৭৫০ টাকা। মমতা দয়াপরবশ হয়ে দিচ্ছেন ১৭৭০ টাকা। ঐ বাড়তি ২০টাকা নাকি ট্রান্সপোর্ট খরচ। সল্ট লেক থেকে যাদবপুর বাসে নেয় ১১টাকা। আর শস্যের কুইন্টাল যাবে ২০ টাকায় !
    বন্যাবিধ্বস্ত কেরালায় কিন্তু সরকার ন্যুনতম সহায়ক মূল্য হিসেবে প্রতি কুইন্টালে দিচ্ছে ২০টাকার জায়গায় ৬০০ টাকা। মোট পরিমাণ ২৩৫০ টাকা। অর্থাৎ স্বামীনাথন কমিশনের ফরমুলা মেনে C2+50% এর চেয়েও ১০টাকা বেশি।
    শাসনের পদ্ধতিতে আর বঞ্চনার প্যাঁচে এতো মিল, আর পশ্চিমবঙ্গে বঞ্চিত কৃষকের আত্মহনন নেই এ তো হতে পারে না। ফলে ১৯১ জন মৃত কৃষককে স্মরণ করে অশোক মনে করালেন পশ্চিমবঙ্গ থেকেও এ সংক্রান্ত কোন রিপোর্ট পাঠানো বন্ধ হয়ে গেছে বহুদিন আগে। মরে গেলে এখানে এখন দুলাখ, আর বেঁচে থাকলে পাঁচহাজার ! জীবন আর মৃত্যুকে নিয়ে কি ভয়ংকর ঠাট্টা !

    কৃষকদের লঙ মার্চ আয়োজিত হয়েছে, হচ্ছে এইসব বঞ্চনা বিদ্রূপের মুহতোড় জবাব হিসেবে। কৃষকদের দাবী দুটো , অশোক ধাওলে, সারা ভারত কিষাণ সভার কর্ণধার জানালেন, ঋণ থেকে মুক্তি আর শস্যের লাভজনক দাম। এই প্রসঙ্গে বললেন ২৫০০০ টাকার লোন শোধ করতে না পারলে ব্যাংক কুকুরের মতো তাড়া করে লোন নেওয়া কৃষককে। অথচ মহারাষ্ট্রে কৃষিঋণ যা মকুব হয়েছে তার ৫১% হয়েছে মুম্বাইওয়ালা চাষাদের জন্য। মুম্বাই শহরে চাষ করে কে ? ভরা প্রেক্ষাগৃহের দিকে প্রশ্ন ছোড়েন অশোক। প্রেক্ষাগৃহ ফিসফিসোয়, অমিতাভ বচ্চন। তার সঙ্গে যে নামগুলো বলেন তিনি, সেগুলো হল আম্বানি, আদানি, মাল্লা, মেহুল, নীরব, ললিত মোদী।

    ৪ লক্ষ কোটি ব্যাংকঋণ মকুব হয়েছে কর্পোরেট হাউজগুলির। কর্পোরেট বান্ধব ব্যাংকগুলি আরো ১২লক্ষ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে, যা নিয়ে এরা দেশ ছেড়ে পালিয়েছে অথবা সে ঋণকে অনাদায়ী ঘোষণা করিয়ে ছেড়েছে। ১৬ লক্ষ কোটি টাকায় ঋণগ্রস্ত কৃষকদের কিছু সুরাহা হতো কি ?
    প্রশ্নটা তো সহজ, আর উত্তর তো জানা !

    কে এই অশোক ধাওলে ? তাঁর কথায় এতো নিবিড়ভাবে কেন ফুটে ওঠে অন্নদাতাদের নিরন্ন করুণ অবস্থা ? স্বাধীনতা সংগ্রামী, লেখক, আইনজ্ঞ, এক্টিভিস্ট গোদাবরী পারুলেকারের সাক্ষাত শিষ্য অশোক ধাওলে ডাক্তারি ছেড়ে পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হয়েছিলেন। ব্যক্তিগত বিলাসব্যসনকে তুচ্ছ জ্ঞান করে সমষ্টির স্বার্থে বিলিয়ে দিয়েছেন নিজেকে। নানা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গেছেন তিনি , অর্জন করেছেন কৃষকদের আস্থা। নাসিক টু মুম্বাই লঙ মার্চে সবার সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে সমস্ত পথটাই হেঁটেছেন তিনি। সারা ভারত কিসাণ সভার এই কর্ণধার শিলিগুড়ির পর কলকাতায় এসেছিলেন। পিডিজি ভবনের সভায় বলে গেলেন ২০১৯ এর নির্বাচনী লড়াইয়ের অন্যতম নির্ধারক হবে ব্যাপক কৃষক অসন্তোষ। বলে গেলেন আটই ও নয়ই জানুয়ারি ভারতজোড়া ধর্মঘটে সামিল হবে কৃষক সংগঠনগুলি। রাস্তায় নেমে জনবিরোধী সমস্ত নীতির বিরুদ্ধে গলা তুলবে কিষাণ কিষাণীরা। আর কোন কংসরূপী শাসকে বিশ্বাস নেই তাদের। তারা ভালই জানেন শাসকের স্বরূপ : মামা নেহি কসাই হ্যায় / কংস কা ছোটা ভাই হ্যায়।

    পথে এবার নামো সাথী ...
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ০৪ জানুয়ারি ২০১৯ | ১৮৮২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • aranya | 3478.160.342312.238 (*) | ০৪ জানুয়ারি ২০১৯ ১১:২০50080
  • ভাল লাগল
  • sm | 2345.110.124512.226 (*) | ০৫ জানুয়ারি ২০১৯ ০২:৫৫50082
  • খুব ভালো লেখা।স্বল্প পরিসরে অনেক কথা লেখা আছে।
    কিন্তু দুতিনটে বিষয়ে খটকা আছে।
    এন এস এস ও নাবার্ড এর স্টাডি অনুযায়ী,দেশের 50 পার্সেন্ট এর অধিক কৃষক ব্যাংক থেকে লোন নেয় না।
    আবার ব্যাংক থেকে মোটলোন এর দুই তৃতীয়াংশ বৃহৎ কৃষক বা ধনী কৃষক নেয়।
    তাহলে লোন মুকুব হলে,লাভের গুড় কারা পাচ্ছে,সহজেই অনুমেয়।
    স্টাডির,দ্বিতীয় অংশ টি আরো ইন্টারেস্টিং।ব্যাংক থেকে লোন নেয় যে কৃষক আর মহাজনের কাছ থেকে লোন নেয় যারা,দুই শ্রেণীর মধ্যে শেষোক্ত শ্রেণীর লাভের পরিমান ও উৎপাদন দুটোই কম। তাহলে লোন মুকুব হয়ে কতখানি লাভ হতে পারে?
    এম এস পি বাড়ানো একটা সল্যুশন। কিন্তু সেটা ক্ষতে মলম দেওয়ার মতন।
  • বিপ্লব রহমান | 340112.231.126712.75 (*) | ০৫ জানুয়ারি ২০১৯ ০২:৫৫50081
  • জনতার সংগ্রাম চলবে, আমাদের সংগ্রাম চলবেই, চলবে।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে মতামত দিন