দুটো ঘটনাকে পাশাপাশি রাখব আমরা। গত বছরের কথা। সুশান্ত সিংহ রাজপুত ‘আত্মঘাতী’ হলেন। আমরা যারা সুশান্তের নামটুকুই জানতাম কেবল, এ বার বিস্ময়াবনত হয়ে চেয়ে দেখলাম, পাড়ায় পাড়ায় গজিয়ে গেল সুশান্ত ন্যায়মঞ্চ, সুশান্ত স্মৃতিসংঘ। ‘খুনে'র বিচার চেয়ে পদযাত্রা হল, এমন কী কলকাতারও বেশ কিছু মহল্লায়, পল্লিতে। কালীঘাট মন্দিরে চড়ল পুজো। প্রতি রাতে অর্ণব গোস্বামী তারসপ্তকে চ্যাঁচামেচি করতে থাকলেন, গোটা একটা জাতি দু’-তিন মাস ধরে তারিয়ে তারিয়ে খেল সে সব। খুব কম শব্দ খরচ করলে, স্রেফ অপ্রমাণিত সন্দেহের ভিত্তিতে সুশান্তকে নিয়ে যে অদৃষ্টপূর্ব তোলপাড় উঠেছিল ভারতীয় জনসমাজে, তা যে কোনও মহাতারকার কাছেই ঈর্ষণীয় বেঞ্চমার্ক। ... ...
অনিন্দ্য সেন, শিলচরের অসম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরিজির মাস্টারমশাই, এখন জেলে বন্দি। তাঁর অপরাধটা, অনেকে হয়তো বলবেন, নিতান্তই নির্বিষ। ৫ অগস্ট, অযোধ্যায় রামমন্দির-স্থাপনার পুণ্যমুহূর্তে, একটি বেচাল টিপ্পনি কেটেছিলেন এই ধৃত অধ্যাপক: 'এত হুলস্থূল কাকে নিয়ে, যিনি তাঁর বউকে ছেড়ে এসছিলেন– লোকলজ্জার ভয়ে?' গুয়াহাটির অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের এক মাতব্বর পোস্টটির বিরুদ্ধে থানায় এফআইআর করে, এবং অনিন্দ্যকে গ্রেফতার করা হয়। হুড়কো দেওয়া হয় তিনটি লাগসই ধারা: ২৯৪ (জনপরিসরে অশ্লীল কাজকারবার), ২৯৫এ (সোজা কথা: ধর্ম নিয়ে ব্লাসফেমি), ৫০১ (অবতারের মানহানি)। আজ হপ্তাদেড় কেটে গেল, অনিন্দ্য সেন জেলবন্দি। ... ...
মোক্ষম বোমাটা ফাটিয়েছেন শংকরাচার্য স্বামী স্বরূপানন্দ সরস্বতী। কারণ কী জানা নেই, তবে কিঞ্চিৎ কাণ্ডজ্ঞান খাটিয়েই দ্বারকাপীঠের ভূতপূর্ব শংকরাচার্যের ঘোষণা: রূপান্তরিত বাবরি মসজিদ, থুড়ি রামমন্দিরের শিলান্যাস-নির্ঘণ্টটি ‘অশুভ’। নানা মহলেও তোলপাড়, যে সময় মহামারীতে উজাড় হয়ে যাচ্ছে দেশ, কিঞ্চিৎ শ্রদ্ধাবশতই কি সে’ সময় স্থগিত রাখা যেত না আলো-ঝলমলে এই সব অনুষ্ঠানের বাহার? যোগী আদিত্যনাথ অবশ্য গাঁট। ... ...
সে ছিল এক রংদার কফি হাউসের দুনিয়া– এক টেবলে ভাগাভাগি করে পাশাপাশি বসে সত্যজিৎ রায়, চিদানন্দ দাশগুপ্ত, কমলকুমার মজুমদার, মৃণাল সেন, সমর সেন, ও পাশের টেবলে গর্জন করছে সদ্য-ছাপা কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর প্রথাচ্যুত জোয়ান কবিদের দঙ্গল! এই ধরতাইটুকু, এই দীপ্ত আধুনিকতা এবং পঞ্চাশের দশকের কলকাতার প্রেক্ষাপট বুঝে না-থাকলে আজকের কবরখানা কলকাতায় দাঁড়িয়ে সত্যজিতের শতবর্ষ-সেলিব্রেশন অর্থহীন হয়ে যায়। ... ...
আচ্ছা, ইন্ডাস্ট্রিয়াল সভ্যতার এ' রকম বিপর্যয় কি ইতিহাসে আগে হয়েছে? না বলেই মনে হল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চোটে জীবনযাত্রা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল ঠিক কথা। বুদ্ধদেব বসুর মেমোয়ারে পড়েছি, ট্রাম বাদে কোনও পাবলিক ট্রান্সপোর্ট যেত না তখন, সন্ধে নামলে এক কাঠি ওপরে বিদ্যুৎ অফ– মাঝেমধ্যে জনশূন্য রাসবিহারীর মোড়ে ট্রামের ইতস্তত ধাতব মর্মর, আর পূর্ণিমার চাঁদ গলে গলে ট্রামলাইনে পড়ছে। ... ...
পণ্ডিত রবিশংকর কে, এমন প্রশ্ন যদি তাঁর শতবর্ষে নিক্ষিপ্ত হয়, আমার উত্তর হবে: এক সেতার-বাজিয়ে প্রেমিক পুরুষ৷ নারীবাদীরা হয়তো অভিধার দ্বিতীয় শব্দটিতে কিঞ্চিৎ গোলমাল খুঁজে পাবেন, কিন্তু পৌরুষ ছাড়া রবিশংকরের বাজনাকে ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। সেই পৌরুষ, আশ্চর্যজনক ভাবে, উদগ্র ম্যাসকিউলিনতার কোনও ইস্তেহার নয়, বরঞ্চ প্রতি পলে ভারতীয় পৌরুষের ধারণাকে সে ভেঙেছে, গুঁড়ো করেছে, সাজিয়ে নিয়েছে নতুনতর কোনও ক্যালাইডোস্কোপে। ... ...
লকডাউনের আবহে বিশ্বায়নী দুনিয়াদারির স্মিত অন্তর্ঘাতে হঠাৎই চেগে উঠল ছাদ। একদা ছাদের ওপর পায়চারি করেছিল হারবার্ট আর বুকি, অস্পষ্ট অবুঝ চিলছাদ তার প্রণয়ের দিনগুলির সাক্ষ্য রেখে গেছে। ছাদ, বস্তুত, সংসার-সীমান্তে অথচ পাবলিক পরিসরেও নয়, এ রকম নিরালম্ব মধ্যবর্তিতায় ঝুলে-থাকা অস্তিত্ববিশেষ। ছাদ কখনও রাস্তা নয়। ... ...
লেখাটার আগে কিছু সাবধানবাণী থাকা প্রয়োজন। এ লেখার উদ্দেশ্য এই কঠিন সময়ে ভাইরাসের গুরুত্বকে খাটো করে দেখা নয়, অতএব, খুবই বিরসবদনে এই সার্কুলার লেখার আগে ঝুলিয়ে রাখছি, যে, লেখাটিকে তেমন ভাবে পড়বেন না। দিচ্ছি এই জন্যই যে, ১১ মার্চ, ভাইরাসের প্রভাবে সামাজিক তিড়িতঙ্ক শুরু হওয়ার অনেকটা আগে, লিখেছিলাম। ... ...
ছবিতে আর কতটুকু বোঝা যায়। সাউন্ডস্কেপ হাজির করা গেলে হয়তো ভাল হত। জনতা কারফিউয়ের সকালকার কলকাতার যে রূপ দেখলাম, কোনও দিনই তা দেখি নি। আমার বাবারা কোল্ড ওয়ার, নকশালবাড়ি প্রজন্ম– মানুষী সভ্যতার একেবারে তুঙ্গ ক্লাইম্যাক্স। মৃদু হেসে বলা যায়, ওঁরাও ওঁদের যৌবনে দেখেন নি। ... ...