দুনিয়া জুড়ে এ তাবৎ ফলিত গণতন্ত্র নানা গলদে ভরা—বিসদৃশকেও নিজের এবং নিজেকেও বিসদৃশের সমান ভাবার অক্ষমতা, ভোটের অঙ্কের পাটিগণিতের দাপটে সংখ্যালঘুর স্বর না শোনা, সেই পাটিগণিতকে কর্মক্ষম করার জন্য প্রয়োজনীয় পূর্ব স্থাপিত গণতান্ত্রিক সমাজের অভাব ইত্যাদি। এ থেকে মুক্তির পথ কী? শিক্ষা। গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের একটি বই। পড়লেন সাংবাদিক রজত রায় ... ...
নেজওয়ান দরবিশ। জন্ম ১৯৭৮। জেরুসালেনবাসী। এ সময়ের আরবি কবিতার নক্ষত্র। এ পর্যন্ত কাব্যসংকলন আটটি। পনেরোটি ভাষায় অনূদিত। মেহমুদ দরবেশ ও পূর্বজ মহান আরবি কবিদের থেকে তাঁর স্বর একেবারে ভিন্ন। আমরা বাধ্য হই সেই স্বর ‘হৃদয়ে পেরেক দিয়ে গেঁথে’ নিতে। লিখছেন পাকিস্তানের কবি অফজ়াল আহমেদ সৈয়দ। ... ...
এ জগতে কবিরা সৃষ্টিশীল অন্তত সাত শতক ধরে। বঙ্গের ঠিক পাশের অঞ্চলে। এও কম আশ্চর্যের বিষয় নয়, বিদ্যাপতি ব্যতীত এ ভাষার দ্বিতীয় কোনো কবির নাম অধিকাংশ কবিতাপ্রেমী বাঙালির কাছে আজও অজানা। তরজমা বিরল। বাংলা অনুবাদে মৈথিলি কবিতার তেমনই একটি সংকলন। পড়লেন তৃষ্ণা বসাক ... ...
১৯৭১-এ ভয়ের বাতাবরণ কেটেছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে। বরুণ সেনগুপ্ত লিখলেন সাতক্ষীরে অভিযানের কথা। আমরা সাতক্ষীরের লোক। বাড়ির সকলে হুমড়ি খেয়ে বরুণ সেনগুপ্তর প্রতিবেদন পড়লাম। বাঙালি লড়াই করছে স্বাধীনতার জন্য। ছেড়ে আসা মাটি, দেশ, গ্রাম, ভিটে কেমন ছিল তা আমার অজানা ছিল। ১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের পর দুই দেশে বৈরিতা আরও বেড়েছিল। পূর্ববঙ্গের খবর আসা ক্রমশ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। খবরের কাগজ এবং রেডিও খবর দিতে লাগল। পাকিস্তান ভেঙে যাচ্ছে। উদ্বাস্তু স্রোত আসছে সীমান্ত পার হয়ে। আমি তখন কী করব কী করব ভেবেই দিন কাটাচ্ছি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শামিল হতে চাই। একটা দেশ স্বাধীন হবে। সেই দেশটি আমার পিতৃকুল, মাতৃকুলের দেশ। ... ...
ভারতে যখন সুলতানী যুগ, তখনও পৃথিবীর বৃহত্তম গম্বুজ ছিল ১২৮ অব্দে নির্মিত রোমের প্যান্থেওন। দ্বিতীয় বৃহত্তম গম্বুজ ছিল ইস্তানবুলের আয়াসোফিয়া (তখন গীর্জা)। আয়াসোফিয়ার গম্বুজ ইঁটের। প্যান্থেওন ইঁটের গম্বুজ ছিল না, কংক্রীটের, তবে একই পদার্থবিদ্যার নিয়মে তৈরী। প্যান্থেওনের সমতুল্য মাপের গম্বুজ ভারতে তৈরী হয় অনেক পরে- সপ্তদশ শতকে- সেটিও একটি সমাধি, যার কথা আমরা পরে বলব। প্যান্থেওনের আরএকটা বিস্ময়কর ব্যাপার হল, এটিই এই বিশ্বে একমাত্র বাড়ী যা টানা ১৯০০ বছর ধরে সক্রিয়ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে- আগে রোমান মন্দির ছিল, পরবর্তীকালে গীর্জা। ... ...
সতীনাথ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, আমি কলেজে ফিলসফি পড়তুম। প্রথম যখন হেগেল-মার্কস পড়েছি, আমরাও মনে মনে মার্কসকে শ্রদ্ধা করেছি; তোর এখন যে বয়েস, এ বয়েসে হয়তো এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা বেঁচে গিয়েছিলুম, মার্কসিস্ট হওয়ার কথা ভাবিওনি। কেন জানিস? নৈতিক সংঘাত। আমাদের আজন্ম শিক্ষা নাস্তিক মার্কসের মেটিরিয়ালিজ্ম্ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলো আমাদের। তোদের তো আমি সেভাবে মানুষ করতে পারিনি। এই তো, এখনই সন্ধ্যা-আহ্ণিক বন্ধ করে দিয়েছিস, বাইরে কার হাতে কী খেয়ে বেড়াস আমি ভয়ে জিজ্ঞাসাই করি না। আমি এখনো বেঁচে আছি, তা সত্ত্বেও পৈতেটা পর্যন্ত ফেলে দিয়েছিস তুই, যদুগোপাল ন্যায়রত্নের পৌত্র ! ... ...
বিশ্বরূপা থিয়েটারের সেই বাড়ি জুড়ে ছিল শিশিরকুমারের স্মৃতি। আমি দেখেছি কী অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন অভিনেতারা, কলাকুশলীরা শিশিরকুমারকে। শিশিরকুমারের দুই খাস অনুচরকে আমি দেখেছি। একজন তাঁর খাস চাকর রামচরণ। আমরা বলতাম রামচরণদা আর একজন তাঁর খাস ড্রেসার গোবিন্দ অধিকারী। আমাদের গোবিন্দ কাকা। এমনই প্রভাব ছিল শিশিরকুমারের যে বিশ্বরূপার তদানীন্তন মালিকদের দুজন, দক্ষিণেশ্বর সরকার এবং রাসবিহারী সরকারকে সকলে বলতেন মেজবাবু আর ছোটবাবু। বড়বাবু? নৈব নৈব চ। সেটা একমাত্র শিশিরকুমারের প্রাপ্য। প্রত্যেকদিন, কেউ না কেউ একবার শিশিরকুমাররের নাম নিতেনই। একটা শ্রদ্ধার জায়গা, সেই সময়েই আমার মনে ঢুকে গেছিল সে সব শুনে। ... ...
ঠাকুমাকে পেছনে ফেলে আমি দৌড়ে নামি কাঠের দোতলা থেকে। সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে সঞ্জীব কাকু। বুকের কাছের আদর্শলিপি ধরে আমাকে ইশারায় ডাকে, কই স্লেট নিয়ে আয়। আমি দৌড়ে গিয়ে দাদুর রেডিও'র পাশ থেকে স্লেট হাতে নিয়েই কাকুর সামনে গিয়ে দাঁড়াই, আমি সব স্বরবর্ণ লিখতে পারলে সন্দেশ বিস্কুট দেবে তো? ঘাড় নেড়ে 'হ্যাঁ' বলে সঞ্জীব কাকু বড়ঘরের মেঝেয় পাটি পাড়ে। সন্দেশ বিস্কুট দেবো, তার আগে সবগুলো স্বরবর্ণ লিখে শুদ্ধ উচ্চারণে আমাকে শোনাতে হবে। আমি দেরী না করে পাটিতে বসেই কালো স্লেট সাদা দাগে ভরিয়ে তুলি। আর মুখে বলি, অ আ ই ঈ উ ঊ ঋ ৯(লী)। দেখেছো সঞ্জীব কাকু আজ কিন্তু ৯ (লী) লিখতে ভুল করিনি। ... ...
আমরা এক সচেতন প্রয়াস-এর পক্ষ থেকে পশ্চিমবঙ্গে বিগত চার বছরে রামনবমী উত্তর পর্বে সাম্প্রদায়িক হিংসার স্বরূপ বুঝতে বিভিন্ন জনপদে তথ্যায়ন করা হচ্ছে। ২০১৮-২০২০ এই তিন বছর আমরা উত্তর ২৪ পরগণা জেলার ভাটপাড়ায় ক্ষেত্র গবেষণা চালিয়েছি, ইতিমধ্যে তার প্রতিবেদন প্রকাশিত। সেই ধারাবাহিকতায় তেলেনিপাড়া হোল দ্বিতীয় প্রতিবেদন। ... ...
আট নম্বর তার আসলে একটি মানসিকতা, একটি মানসিক গঠন বলতে পারেন। কিউয়িদের মানসিক গঠন বোধহয়। খুব সামান্য জিনিসপত্র দিয়ে যতটুকু কাজ সারার সেরে নেওয়ার ক্ষমতা। এই জায়গাটাতে আমি আমাদের ভারতীয় মানসিকতার মিল খুঁজে পাই, আজকাল আবার তাকে অনেকে “জুগাড়” (ইং: Jugaad) নামে অভিহিত করে থাকেন। তবে কিউয়ির ‘Number eight mentality’ আর জুগাড় ঠিক একও নয়। সেভাবে দেখলে আট নম্বর তার একটা আট-গেজ বা চার মিলিমিটার বেড়ের তার বই কিছু নয়, এমনকি ১৯৬৭ সালের আগে অবধি (যে বছর বার্ট মানরো বোনেভিল ফ্ল্যাট রেস জিতে রেকর্ড গড়লেন) সে তার এদেশে আমেরিকা থেকে আমদানি করা হত। এদেশ যেহেতু অনেকটা কৃষি আর পশুপালনের ওপর আর্থিক ভাবে নির্ভরশীল, জমির বেড় দেবার জন্যই সে তার ব্যবহার করত লোকে। সেখান থেকে আট নম্বর তারের বহুধা ব্যবহারের গল্প এতটাই যে সে লোকসংস্কৃতির জায়গা নিল কীভাবে? ... ...
আমার ফুলফুল ছিটওয়ালা জামায় নোংরা লেগেছে। হাত দিয়ে জামার ধুলো পরিষ্কার করছিলাম আমি। নিচু হয়ে জামার ওপর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে দেখলাম যেখানে আমার শরীর ভয়ঙ্করভাবে ক্রমশ পাহাড়চুড়া হয়ে উঠছে, সেখানে কালো রং লেগে রয়েছে। কখন ? কখন এখানে কালো রং লেগেছে, কিছুই টের পাইনি। কাল রাতে এই কালো রং দিয়েই তো ফরেস্ট বাংলোর দেয়ালে বীরু লিখেছে – ওয়েলকাম টু গোর্খাল্যান্ড। আমার হঠাৎ মনে হল এই শরীর, শরীরে ফুটেওঠা লালিগুরাস, ঝাউপাতার মত আমার মাথার চুল, পাহাড়ি ঝোরার মত কখনও শুকনো, কখনও ভরাট আমার হাসিকান্না, শরীরের উপত্যকাজুড়ে চা-বাগান, অর্কিড-ক্যাকটাসের নার্সারি, মকাই-এর খেত – আমিই গোর্খাল্যান্ড। ... ...
ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হবে আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রস্তুতি প্রায় শেষ। বেরোনোর আগে সুলতানের শুভেচ্ছা নেওয়ার পালা। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। তরজমায় স্বাতী রায় ... ...
বাংলা লিখিত সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদের যুগ থেকে কোম্পানি-রাজের পত্তন পর্যন্ত রচিত নানা বাংলা গাথা চর্ব্যচোষ্যলেহ্যপেয়র রঙিন বিবরণে ভরপুর। উঠে আসে বাঙালির রসনা-সংস্কৃতির বিবর্তনের ছবি। এই শেষ কিস্তিতে রইল বাঙালির ‘টিফিন’ আর শেষপাতে ‘অম্বল’ ও পিঠে-পায়েস-মেঠাইয়ের মেলা। লিখছেন ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় ... ...
চলছে খিচুড়ি মহারহস্য অ্যাডভেঞ্চার। আগের কিস্তিতে দেখেছিলাম খাঁটি ভারতীয় খিচুড়িতে কীভাবে এসে ভিড়েছিল ‘শোলে’, খিচুড়ির আফগানি চলন। এ কিস্তিতে আমরা এই শোলে-ধারার খোঁজে আফগানিস্তান পার করে পৌঁছে যাব ইরানে! নীলাঞ্জন হাজরা ... ...
"ঘরে চল, এইখানেই দাঁড়ায়ে থাকবি নাকি ছেমড়ি?" হানিফার ডাকে হুঁশ ফেরে সাকিনার। ব্যাগটা তুলে হানিফার পিছন পিছন ভিতরে ঢোকে সে। ঘরের ভিতরটা কিছুটা বদলেছে বটে। উঠোনের ওপারে আগে কাঁটাগাছের বেড়া ছিল, মাঝে মাঝে ফাঁকা। ওখানটায় একটা ঘর উঠেছে। পাকঘরটা ছিল ডান দিকে, বাম দিকে খালপাড়ে খাটা পায়খানা। এখন ওখানে পাকা পায়খানা হয়েছে, রাস্তাটায় একটু সিমেন্ট দেওয়া। রান্না হচ্ছে এদিকের বারান্দার এক কোনে, সেখানে দুটি বউ কাজ করছে। সম্ভবতঃ জলিল আর খলিলের বিবি ওরা। ওদের আসতে দেখে একটু অবাক হয় দুজনেই। তাদের কাছে ডাকে হানিফা, "এই দেখ ছেমড়িরা, আমার একখান মাইয়া আছে কইছিলাম না? এই হইল সাকিনা বানু - আমার সই জারিনার মাইয়া। কিন্তু আসলে আমারই। ছালাম কর" ... ...
আমার প্রজন্ম নতুন করে দেশভাগ-মন্বন্তর-মহামারী দেখছে। নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে হচ্ছে আবার স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময়ের পর। আমার ঘরে এসে আমাকেই ভাড়াটে বানাতে যায় আগন্তুক! বাংলাদেশের বরিশালের বাসিন্দা ছিলেন আমার দাদামশাই। মুকুন্দ দাসের দলে গান করতেন। ব্রিটিশ বিরোধী গান করে জেলে গেছেন। এপারে এসে দক্ষিণ কলকাতার এই কলোনির বাসিন্দা হন তিনি। এই উদ্বাস্তু কলোনি তখন দিকে-দিকে ছড়িয়ে পড়ছে। ঋত্বিক ঘটকের ছবিতে আমরা দেখেছি আজাদগড় কলোনি। ঋত্বিক ছাড়াও বিজন-দেবব্রত-জ্যোতিরিন্দ্র-সলিলদের কাজে বারবার ধরা দিয়েছে এই যন্ত্রণা। ... ...
আপনি যদি বিশালকায় হোল্ড -অল আর স্যুটকেস নিয়ে নেমেছেন তো লালজামা লালগামছা কুলিদের শরণাপন্ন হতেই হবে। আজকের নীল বা সবুজ জামা কোথায়? হারিয়ে যাবার ভয় নেই , সবার হাতে তাবিজের মত করে বাঁধা পেল্লায় এক একটি পেতলের চাকতি, তাতে নম্বর লেখা। ওটা মনে রাখলেই হবে। ট্যাক্সির প্রি-পেড বুথ বা স্ট্যান্ড কিস্যু নেই। মিটারে যায়, শেয়ারে যায় । কখনও সামান্য দরাদরি। দুই থেকে পাঁচটাকায় হাওড়া থেকে পার্কসার্কাস। ... ...
ধরা যাক, সন্ধের কালবৈশাখীর পর ঝিরঝিরে বৃষ্টিটাও থেমে গিয়েছে। এখন শুধু ক্লান্ত পাতাগুলো থেকে টিপটিপ করে জলের ফোঁটা পড়ছে। বাগান ছন্নছাড়া। ভেঙে পড়া পাখির বাসায় ইঁদুরেরা হামলা চালিয়েছে। আর ঠিক এসবের মধ্যিখানে, একটি মা মরা ছেলে, ঘুম থেকে উঠে দেখছে, তার বাবা ও মা কোনো একটি গাছের মগডালে নবদম্পতির সাজে পা ঝুলিয়ে বসেছে। খুনসুটি করছে। সরষে রঙের আলো এসে পড়েছে তাদের শরীরে। তারা রস ও রতিতে বিভোর। এতই বিভোর যে তাদের ক্রিয়া মসলিনের মতো গাছের ডালপালায় বিঁধে গিয়ে বারবার ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছে। তবু সন্তানের দিকে তাদের খেয়াল নেই। ... ...