এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ইস্পেশাল  স্বাধীনতা

  • নুনু যখন শনাক্তকরণের চিহ্ন (পর্ব ১)

    সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায়
    ইস্পেশাল | স্বাধীনতা | ১৭ আগস্ট ২০২৩ | ৪৮৩৪ বার পঠিত | রেটিং ৪.৯ (৭ জন)
  • পর্ব ১ | পর্ব ২


    ১।

    এসব অপকর্ম যারা করে, তাদের একটু নির্জনতা লাগে। কিন্তু বাড়িতে করলে বৌ বাটাম দেবে, তাই মনিকে বাজার থেকেই এসব করতে হয়। ফোন করার সময় মনি একটু কোণ ঘেঁষে দাঁড়ায়। এক চান্সেই ফোন লাগে, ওপাশে রিং হচ্ছে, মনির বুক ধুকপুক করে। ফোন তোলে, যথারীতি, মহিলাকণ্ঠ। জোরালো, তেজি গলা।
    - আনন্দমায়া হাসপাতাল।
    মনি একটু আমতা-আমতা করে বলে, হ্যালো।
    - বলুন।
    - ডক্টর মৈত্র আছেন?
    - না, আমি ওঁর অ্যাসিস্টেন্ট কথা বলছি। অ্যাপয়েন্টমেন্ট চাইলে...
    মনি একটু গলাখাঁকারি দেয়। গলা শুকিয়ে কাঠ, মাথায় অ্যাড্রিনালিন চড়ে গেছে। - না। অ্যাপয়েন্টমেন্ট না। একটা ইনফরমেশন চাই।
    - বলুন।
    - আপনারা তো প্লাস্টিক সার্জারি করেন।
    - করি। আপনার না অন্য কারো?
    - আমার।
    - নাক সোজা করতে গেলে ২৫ লাখ। গাল তোবড়াতে গেলে ৩০। অবিকল পড়া মুখস্থের মতো বলে মেয়েটা, মেয়ে না কলের পুতুল কে জানে। - ঠোঁটও ঠিক করি। কিন্তু মেলদের ওটা লাগেনা। - আপনার বাজেট কত?
    মনির গলা কেঁপে যায়। - মানে, মুখে না, একটু নিচে।
    - ঘাড়, গলা, এগুলোয় হবেনা। ওগুলো ভগবান দিয়েছেন। যা দিয়েছেন তাই নিয়েই খুশি থাকুন। ওখানে আমরা হাত দিইনা। বুকে ব্রেস্ট ইমপ্ল্যান্ট করি। সেটাও আপনার লাগবেনা। ভুঁড়ির ফ্যাট বার করে দেওয়া যায়। রেট কত চেক করে বলতে হবে। তবে সিক্স প্যাক হবেনা। ওটা আপনাকে নিজেকেই বানাতে হবে।
    - মানে, ভুঁড়িও না। তলপেটের সাইডটা।
    - বুঝিয়ে বলুন।
    চোখ-কান বুজে মনি বলে ফেলে - ওই জেনিটালস সাইডটা। আঃ। বলে ফেলে কী আরাম।
    একটুও না টসকে অবিকল একই ভঙ্গীতে মহিলা বলে চলেন - ওহ। দেখুন, ওগুলো আমরা করিনা। তাছাড়া কেটে একটা ফুটো করে দিলেই হল না। ওর জন্য হরমোন থেরাপি লাগে। বুকের শেপ তৈরি করতে হয়। ওসব আমরা করিনা। আপনি ইন্টারনেট দেখেন?
    ইন্টারনেট? সেটা কোথা থেকে এল? - হ্যাঁ। বলে মনি। কিন্তু কেন?
    - ডক্টর রুদ্রপ্রসাদ গুপ্তর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। উনি সেক্স চেঞ্জের এক্সপার্ট। নেটে যোগাযোগ পেয়ে যাবেন। আমরা এগুলো করিনা। নমস্কার।

    লাইন কেটে যায়। কিন্তু এইটুকুতে তেষ্টা মেটেনা। মনি পকেট থেকে বার করে একটা ছোট্টো খাতা। উল্টেপাল্টে দেখে। গলাখাঁকারি দিয়ে একটু আত্মবিশ্বাস আনে। খাতা দেখে পরের নম্বরটা ডায়াল করে।

    - নমস্কার। নীলাকাশ মেডিকাল সেন্টার।
    - দেখুন, আমার একটা প্রশ্ন আছে।
    - বলুন।
    - আপনারা প্লাস্টিক সার্জারি করেন?
    - করি। কোথায় করাতে চান?
    মনি এবার উত্তেজনায় হাঁটতে শুরু করে। অনেক ভ্যান্তারা হয়েছে, এবার সিধে পয়েন্টে যেতে হবে। - পেনিস বোঝেন তো? লিঙ্গ যাকে বলে। সব পুরুষমানুষেরই থাকে। মানে, আমি জেন্ডার পুরুষের কথা বলছিনা, ওরিয়েন্টেশনের কথাও না, আমি কিন্তু ট্রান্সজেন্ডার না। আমি সেক্সুয়ালি পুরুষদের কথা বলছি। তাদের লিঙ্গের উপরে একটা ঢাকনা থাকে...
    ওপাশের মহিলাকণ্ঠ তীব্র গলায় বলে, জানোয়ার।
    ফোন কেটে যায়। মনি দেখে হাঁটতে হাঁটতে একটা সব্জির দোকানের সামনে চলে এসেছে। এখানে খিস্তি করা যাবেনা। ফোন নামিয়ে রাখতে রাখতে বলে, ঢ্যাঁড়োশ।
    সব্জির দোকানদার জিজ্ঞাসা করে, কত দেব? পাঁচশো?
    - দেখে মনে হচ্ছে আমি ঢ্যাঁড়োশ কিনতে এসেছি?
    - তো, বাজারে কী করতে এসেছেন? ফোন করতে? বাড়িতে জায়গা নেই?
    আরেকটা ফোন করবে? মনি ঘড়ি দেখে। ওরেব্বাস, দেরি হয়ে গেছে। এখন না ফিরলে বাড়িতে কুরুক্ষেত্র। হনহনিয়ে হাঁটতে শুরু করে। দোকানদারের গলা পিছন থেকে শোনা যায় - বোকাচোদারা কোথা কোথা থেকে সব চলে আসে।

    পুরো রাস্তাটা ৫ মিনিটে শেষ করে মনি। চারতলা ফ্ল্যাটবাড়ির সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে ওঠে। তারপর চুপি চুপি দরজা খুলে ফ্ল্যাটে ঢোকে। সামনে শমিতা। কানে দুল পরছে। আর জায়গা পায়না, ঘরে পরলেই পারত, দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দুল পরার কী আছে কে জানে। আয়নাও তো নেই। - কোথায় গিয়েছিলে?
    মনি আমরা আমতা করে বলে, তুমি এখনও বেরোওনি?
    শমিতা কড়া গলায় আবারও একই প্রশ্ন করে। - কোথায় গিয়েছিলে?
    - বাজারে।
    - এতক্ষণ?
    - অনেকটা তো। হেঁটে গেলাম।
    - দুধ এনেছ?
    - না।
    - ফুলকপি? শ্যাম্পু? গলায় দেবার দড়ি? কী এনেছ?
    মনি চুপ করে থাকে। হাতে কোনো ব্যাগ নেই। কিছুই নেই। শুধু একটা নোটখাতা। সেটা পকেটে ভরে ফেলে।
    শমিতা কেটে কেটে বলতে থাকে, ফোন করতে গিয়েছিলে। বাড়ি থেকেই করতে পার এবার থেকে। বাড়ি থেকে করলে ডিভোর্স হবে, আর বাইরে থেকে করলে আটকে যাবে, এমন না।
    আর ফোন। মনি ভাবে, কেউ কিছু শোনেই না। সামান্য সাধারণজ্ঞানটুকুও নেই। গোটা পৃথিবীটাই গান্ডু হয়ে গেছে।
    শমিতা জুতো পরতে পরতে বলে, হ্যাঁ, পৃথিবীটা গান্ডু, আর তুমি একাই বুদ্ধিমান। আমরা কেউ কিছু বুঝিনা। আর পৃথিবীতে তোমারই একার নুনু আছে। আর তার সুড়সুড়ি আছে। আর কারো নেই।
    মনি কিছু বলেনা। শমিতা জুতো পরা শেষ করে বলে, যাই হোক, আমি গেলাম। তুমি হোমমেকার হাজব্যান্ড হয়ে বসে থাকো। আমাকে চাকরিটা বাঁচাতে হবে। আর খাবার-দাবার কিছু নেই। বুদ্ধি গিলে থেকো।

    বলতে বলতেই বেরিয়ে যায় শমিতা। দড়াম করে দরজা বন্ধ করে। পরক্ষণেই আবার দরজা খুলে যায়। এবার আবার কী? - আর রাতে বন্ধুরা আসবে। দয়া করে মানুষের মতো বিহেভ কোরো।

    মনি এবারও কিছু বলেনা। শমিতা চলে যায়। মনি একটু দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর পকেট থেকে নোটবই বার করে। চেয়ারে বসে। তারপর নোটবই দেখে আবার ডায়াল করে।
    - হ্যালো। হ্যাঁ একটা প্রশ্ন ছিল।



    ২।

    বন্ধুরা আসে সন্ধ্যেবেলায়। সব্য-শর্মিলা আর রতন-কৃষ্ণকলি। উপরে-উপরে হ্যাহ্যা পার্টি, কিন্তু সবই আসলে দুঃসময়ে নৈতিক জোর সরবরাহের নিমিত্ত। সব্য মদ-টদ ঢেলে মনির পাশে জমিয়ে বসে। বৌরা রান্নাঘরের দরজায়, শমিতার সঙ্গে। সবাই সবার পাশে আছে। বেঁধে বেঁধে। সব্য গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে বলে, হ্যাঁরে মনি, তুই নাকি টোটাল গাধার গাঁড়ে?
    রতন শুনে হ্যাহ্যা করে হাসে। - এরকম আমাদের একটা ফোনের কেস ছিল জানিস তো? অবিক্কল।
    - কী কেস?
    - কলেজের হস্টেলে একটা মান্ধাতার আমলের পে-ফোন ছিল। পাশের দেয়ালে বৌদিদের নম্বর লেখা থাকত। গাদা-গাদা নম্বর। সেখান থেকে আমরা এরকম বৌদিদের ফোন করতাম। মধুরিতাবৌদি, আমি সায়ন বলছি। একটা কথা বলি?
    - যা খুশি একটা ঢপ ঝেড়ে দিলি। সব্য আরেকটা চুমুক দেয়। - নাম জানতিস কীকরে?
    - তখন দুনিয়া পরোপকারীতে ভর্তি ছিল রে। তোদের মতো অবিশ্বাসী, স্বার্থপর হয়ে যায়নি। ফোন নম্বর যে লিখেছে, সে নামও লিখে রাখত।
    - দেয়ালে?
    - ইয়েস স্যার। ডেসক্রিপশন সমেত। ওয়ান-ওয়ান-থ্রি-টু, সঙ্গীতা দি। ব্র‌্যাকেটে ঢলানি। থ্রি-থ্রি-ওয়ান-টু, মধুমিতাবৌদি। খুব রাগী।
    - হেবি তো। পুরো রত্নগুহার গুপ্তধন। সব্যর দাঁত বেরিয়ে যায়। - তা বৌদিরা কী বলত?
    - কী বলবে। রতন উদাস ভাবে বলে। - টোটাল ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে থাকত। এত ফোন পেয়ে ফুল ডিসেন্সিটাইজড। বলে ফেল কী বলবে, এইসব বলতো। সেই সোনাগাছিতে বলে না, যা করবার তাড়াতাড়ি করে ফেল।
    দুজনে মিলে খ্যাক-খ্যাক করে হাসে। সব্য বলে, ভদ্র ঘরের বৌদিদের একদম প্রস্টিটিউট বানিয়ে দিলি রে?
    - থাম তো বাল। প্রস্টিটিউশন নিয়ে অত ট্যাবু কীসের। তাছাড়া মধুমিতাবৌদির সঙ্গে আমার একটা মেন্টাল কানেকশনও তৈরি হয়েছিল। ওর হাজব্যান্ডের সঙ্গেও কথা হয়েছে।
    - অ্যাঁ? হাজব্যান্ড? সব্য চোখ কপালে তুলে বলে। - কী বলল? ক্যালাবে?
    - ধুর। বলল, প্লিজ আর ফোন কোরোনা। ফোন নম্বরটা বদলেই ফেলতাম, কিন্তু বিজনেসের ব্যাপার আছে তো। পারছিনা। বড় দাদার এই অনুরোধটা রেখ। শুনে আমার কী খারাপই লাগল। ভাবলাম নম্বরটা মুছে দিই।
    - আহারে।
    - দিলামও মুছে। কিন্তু পরের দিন আবার দেখি কে একটা লিখে রেখেছে। পাবলিক ডায়রেক্টরি। ওপেন সোর্স। উইকিপিডিয়ার মতো ব্যাপার। মোছা অত সোজা না। কিন্তু আর ফোন করিনি। মধুমিতাবৌদির সঙ্গে ওই আমার শেষ কথা।
    - ওরে বাবা রে। হাসতে হাসতে সব্য বলে। - অসমাপ্ত ফোন কাহিনী। এর চেয়ে পুলিশে খবর দিলনা কেন?
    - দিয়েছিল মনে হয়। তারপর পুলিশ এসে ট্র‌্যাক ফ্যাক করে ফোনটা তুলে দিল। বলে তোমাদের তো সবার মোবাইল আছে, ফোনের কী দরকার। এই শুয়োরের বাচ্চা টেকনোলজি। মানবসভ্যতার আলোছায়া গোধূলিলগ্নটাকে পুরো নষ্ট করে দিল।

    গ্লাস শেষ বলে সব্য আবার ঢালে। তারপর দ্বিতীয় পেগের তূরীয়ানন্দে, বলে, ঠিক ঠিক। ফাক টেকনোলজি। রতন গ্লাসে গ্লাস ঠেকায়।

    তিন নম্বর পেগ থেকেই অবশ্য ব্যাপারটা সিরিয়াস হয়ে যায়। সংবেদনশীলতা চাগাড় দেয়। মনিকে সব্য বলে, কীরে শুয়োর। তোকে কিন্তু পুলিশে ধরবেই। পারভার্ট হয়ে যাচ্ছিস দিনে দিনে।
    - কী হচ্ছে। থাম না। রতন বলে। - বেচারা ছেলেটা প্রবলেমে আছে। মনি দেখে, রান্নাঘরের ওদিক থেকে রতনের বৌ কৃষ্ণকলি গুটি গুটি করে এদিকে আসছে, সেটাই এত দরদের কারণ কিনা কে জানে।
    - থামব কেন রে বাল। সব্য দাঁত খিঁচিয়ে বলে। ভাব, দিনে দুপুরে কলকাতা শহরে, একটা দামড়া খাসি ডাক্তারের রিসেপশনিস্টকে ফোন করে করে বলছে, জানেন, আমার লিঙ্গটি ছোটো ও বাঁকা। অপারেট করে একটু ঠিক করে দেবেন?
    মনি বিরক্ত হয়ে বলে, দেখ, তুই জানিস, এটা ছোটোর ব্যাপার না।
    - ছোটো না তো কি কিং সাইজ?
    মনি কিছু বলেনা। কৃষ্ণকলি চলে এসেছে। সব্য বলে, তোর আবার কী চাই?
    - কিং সাইজ আছে? কৃষ্ণকলি বলে। কী শুনেছে কে জানে। - আমাকে একটা দাও তো। ছোটো খেয়ে খেয়ে জিভে চড়া পড়ে গেল।
    - আমার আছে। কিং সাইজ। কিন্তু তোকে দেব না। সব্য বলে। তারপর রতনের সঙ্গে খ্যাকখ্যাক করে হেসে গড়িয়ে পড়ে।
    - অসহ্য। কৃষ্ণকলি কাঁধ ঝাঁকায়।
    সব্য একটা সিগারেট বার করে দেয়। তারপর বলে, এবার যা। এখানে লিঙ্গ নিয়ে কথা হচ্ছে। মানে, জেন্ডার না, জিনিসটা। হাতে করে দেখিয়েও দেয় জিনিসটা কী। সাবধানের মার নেই, যদি না বুঝতে পারে, তাই।
    কৃষ্ণকলি চোখ গোলগোল করে বলে, এত বড়? কার গো?
    রতন এবার খ্যাক করে হাসে। কেমন দিল? সব্য হাত জোড় করে বলে, আমার অন্যায় হয়েছে। প্লিজ যা ডার্লিং। আমি আসছি।
    - লাইটার দাও। কৃষ্ণকলি সিগারেট ধরায়। গম্ভীর মুখে। তারপর কোমর দুলিয়ে চলে যায়, সেই দিকে, যেখানে শর্মিলা শমিতার পাশে আছে। যৌনজীবনের খোঁজ নিচ্ছে। সঙ্গোপনে। এত হাসির হররা শুনে, জিজ্ঞাসা করে, কী হয়েছে রে?
    - তোমার বর। কৃষ্ণকলি দূরে সব্যর দিকে হাসিহাসি মুখে তাকায়। সব্য তখন মনিকে চতুর্থ পেগের জীবনদর্শন বোঝাচ্ছে। -দেখ সিরিয়াসলি বলছি। এটা কলকাতা শহর। কেউ কোথাও তোর প্যান্ট নামিয়ে দেখবেনা। বলতে বলতেই কৃষ্ণকলির দিকে হাত নাড়ায়, একটা চোখও মারে।
    শর্মিলা বলে, কী করেছে?
    - আমাকে খিস্তি করল।
    শমিতা বলে, বেশ করেছে।
    - এখন আবার চোখও মারছে। তোমাকে সাবধান করে দিলাম কিন্তু।
    - আমি আবার কী করব?
    - সাবধান হবে, আবার কী? বিকজ, ইউ নো, হোয়াট?
    - কী?
    সিগারেটে টান মেরে কৃষ্ণকলি বলে, বিকজ হি ইজ টোওওটালি ফাকেবল।
    সব্যর জ্ঞানদান ততক্ষণে শেষ। দূর থেকে হাত নাড়িয়ে বলে, চলে এসো কেষ্টা। চলে এসো। মনিবাবু এবার একটা গান গাইবে। লেটস ড্যান্স। কৃষ্ণকলি হাসতে হাসতে এগিয়ে যায়। শমিতা বলে, শর্মিলা, এইটা কিন্তু বাড়াবাড়ি করছে।
    - বাদ দে। মাল-টাল খেয়ে আছে।
    - সেই জন্যই তো।
    - আরে ধুর। ওদের মুরোদ আমার জানা আছে। ওসব বাদ দে। শর্মিলা বলে। - তোদের একবার কনসাল্ট করে নেওয়া উচিত কিন্তু।
    - সাইকিয়াট্রিস্টের অ্যাপয়েন্টমেন্ট? নিয়েছি তো। কাল, বললাম না?
    - মনি রাজি হল?
    - না তো ঘাড় ধরে নিয়ে যাব নাকি? সমস্যাটা তো ও বোঝে। কিন্তু বলে, যে, অ্যাডিকশনের মতো। থামিয়ে রাখা যায়না।
    - ইশ। কী যে হল তোদের।
    একসঙ্গে এত সংবেদনশীলতা নেওয়া কঠিন। শমিতা মনির দিকে তাকায়। জ্বলন্ত চোখে।



    ৩।

    মনোবিদ একজন হাস্যমুখী গোলগাল মহিলা। ছিমছাম তাঁতের শাড়ি পরা। দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। ঘরে বিদেশী সব ছবির প্রিন্ট, দেয়ালে গাঁথা। সেরকমই একটা গোলকধাঁধাকে পিছনে রেখে তিনি মধুর গলায় জিজ্ঞাসা করেন, একদম প্রথম থেকে বলুন। এটা কবে থেকে শুরু হল?
    টেবিলের উল্টোদিকে বসে, মনির অস্বস্তি হয়। জানলার পর্দাগুলো সরানো, বাইরে আস্ত শহর কলকাতা। রাস্তা দিয়ে একজন ফেরিওয়ালা চলে যায়। মহিলা আবার জিজ্ঞাসা করেন, কবে থেকে?
    - অ্যাঁ? বলে মনি। - কবে থেকে? এ তো দেশভাগের পর থেকেই চলছে।
    - না না। সহাস্য বদনে ডাক্তার বলেন। হিস্ট্রি না। আপনার এই চিন্তাগুলো আসা কবে থেকে শুরু হল?
    - ও, আমার জীবনে। মনি মনে করার চেষ্টা করে। - কয়েক বছর ধরেই আসছে। গুণে বলতে পারবনা কবছর।
    - বেশ। কোনো নির্দিষ্ট ট্রিগার? মানে, ধরুন, কিছু একটা ঘটেছে আপনার জীবনে। বা কিছু ঘটতে দেখেছেন। সেটা থেকে এটা শুরু হয়েছে। এরকম কিছু মনে করতে পারেন?
    - পার্সোনালি? আমার? না আমার কিচ্ছু হয়নি।
    ডাক্তার একটু বিরতি দেন। চোখে চোখ রেখে তাকান। - একটু ভেবে দেখুন। এটা জরুরি।
    এসব জিনিস অনেকদিন ধরেই ভাবা আছে মনির। - ম্যাডাম, ভাবার কিছু নেই তো। মনি বলে। - আমি জানি তো কী থেকে হয়েছে।
    এবার ডাক্তার একটু অবাক হন। - ওকে। কী থেকে?
    - সুনীল গাঙ্গুলীর পূর্বপশ্চিম থেকে।
    - অ্যাঁ?
    - আপনি পড়েছেন? বাংলা বই পড়েন টড়েন?
    মনোবিদদের রোগীর সামনে টসকানোর কথা না। এরকম স্যাম্পল অনেক দেখতে হয়। - হ্যাঁ। বলেন তিনি। হাসিখানা অমলিন রেখে।
    - ওখানে একটা ঘটনা ছিল। মনি গড়গড়িয়ে বলে চলে। - তিন বন্ধু গিয়েছিল গ্রামে বেড়াতে। আমার ঠিক মনে নেই, জ্যোৎস্না দেখতে মনে হয়। তখন ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ চলছে। পুলিশ তাদের ধরে। মানে পাকিস্তানের চর ভেবেছিল। তো, ওরা কী করেছিল বলুন তো? প্যান্ট নামিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল, ওরা পাকিস্তানি না। প্যান্ট নামিয়ে পাকিস্তানি কীকরে বোঝা যায় বলুন তো? কারটা কাটা কারটা নয়, এই দিয়ে। আমার নাম মনিরুল ইসলাম। আমারটা কাটা।
    - আচ্ছা। সেটা থেকে আপনার মনে হল, আপনারও এরকম ঘটতে পারে?
    মনির হাত ঘামতে থাকে। এইসব বলতে হলে যেমন হয়। - ওরকম না। আপনি রবীন্দ্রনাথ পড়েছেন তো? সেই সদর স্ট্রিটের বাড়ি থেকে সূর্যোদয় দেখে ওঁর চোখের সামনে একটা পর্দা খুলে গিয়েছিল। সেই রকম আমারও চৈতন্যোদয় হল, প্যান্ট নামালেই তো আমি পাকিস্তানি।
    ডাক্তার শুনতে থাকেন। মনি বলে, আপনি দেবেশ রায় পড়েছেন?
    মহিলা এবার হেসে ফেলেন, আপনি কি আমার পরীক্ষা নিচ্ছেন?
    - না না। পরীক্ষা কেন হবে? মনি তড়বড়িয়ে বলতে থাকে। - এটা ইম্পর্ট্যান্ট। ওঁর একটা উপন্যাস ছিল না? সেই একটা মেয়ে, সাংবাদিক, গণধর্ষণের একটা ঘটনা কভার করে ফিরতে ফিরতে হঠাৎ অনুভব করে, মেয়ে মাত্রেই ধর্ষণযোগ্য। আগে কেন ফিল করেনি কে জানে। কিন্তু সে বাদ দিন। ওই লেখাটা পড়ে আমারও একটা ফিলিং হয়। মানে পূর্বপশ্চিম পড়ে। লিঙ্গ মাত্রেই শনাক্তকরণের চিহ্ন।
    - হম। ডাক্তার একটু জল খান এবার। টেবিলেই ঢাকা দেওয়া ছিল। অভ্যাস, না গলা শুকিয়ে গেছে, বোঝা যায়না।
    - হ্যাঁ। মনি জোর দিয়ে বলে, ওই দিনই শুরু।
    রাস্তা দিয়ে একটা বাস চলে যায় হর্ন বাজাতে-বাজাতে। কলকাতা শহর, হর্ন থাকলেই বাজাবে। প্রয়োজন থাক, না থাক। মনি আর ডাক্তার দুজনেই চুপ করে থাকেন। সিম্ফনি শেষ হলে, মহিলা বলেন, আচ্ছাআআ। একটু টেনে টেনে। - আর কিছু মনে করতে পারেন, পাস্টে? কখনও এই কারণে অস্বস্তিতে পড়েছেন?
    শুনে, মনিরই অস্বস্তি হয়। সে ব্যাপার তো ছোটো থেকেই। - সেইগুলো আপনাকে বলব? - কেন বলবেন না? সে জন্যই তো এখানে আসা।
    - মহিলাদের এইসব বললেই তো ফোন নামিয়ে রাখে। সবাই খ্যাখ্যা করে হাসে। পুলিশে দেয়নি এই যথেষ্ট।
    - কে হাসে আবার?
    - আরে, এনলাইটেন্ড লোকজন। আপনার-আমার মতোই। পিরিয়ড-ফিরিয়ড নিয়ে কথা বলে। কিন্তু লিঙ্গ শুনলেই বিচি টাকে... সরি।
    - সরির কিছু নেই। এখানে কোনো ট্যাবু নেই। আপনি যা মনে আসে বলুন। আমার অভ্যাস আছে।
    - ট্যাবু নেই মানে? মনির হাত ঘামে। গলা চড়ে যায়। ভয়টা বেমালুম চলে গেছে, এখন স্রেফ উত্তেজনা। - জানেন, সকালে উঠলে বেশিরভাগ সময়ই ছেলেদের ডান্ডা, সরি, মানে ওইটা শক্ত হয়ে থাকে? আমার কত বছর যেন বিয়ে করা বৌ জানেনা। সাতসকালে উঠছনা কেন, উঠছনা কেন বলে টিকটিক করে। খোঁজ নেবার চেষ্টাও করেনি কেসটা কী। একটা লোক বিছানায় বসে চা খেতে চায় কেন। ঠ্যাঙে তো ব্যথা নেই, যে, উঠে টেবিল অবধি যেতে পারবেনা।
    ডাক্তার হেসে বলেন, আপনি বললেই পারতেন।
    - হ্যাঁ, তারপর বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সারাদিন হ্যাহ্যা হিহি হোক আর কি।
    - আচ্ছা। ডাক্তার আবার হাসেন, কিন্তু কথা বলার ভঙ্গীটা এবার নির্দেশ দেবার। - এইটা এখন থাক। আপনার ম্যারিটাল প্রবলেমটা আলাদা টপিক। আমরা পরে সেটা নিয়ে কাজ করব। কিন্তু এখন যেটা বলছিলেন বলুন। পাস্টে কী আছে।
    - ভয়াবহ কিছু নেই। একটু ক্ষুণ্ণ হয়ে বলে। আগেরটাই ভালো টপিক ছিল। - আমাদের স্কুলে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে হিসি করতাম তো। বাকিরা বলত কাটা। ও, আর আরেকটা ঘটনা ছিল। আমরা বিনি পয়সায় সিনেমা দেখতে যেতাম একটা হলে। লাইটম্যান না কে ছিল একটা, হল ফাঁকা থাকলে সামনের সিটে বসতে দিত। আর মাঝে-মাঝে এসে হাত বোলাতো। ওই আর কি, বুঝতেই পারছেন। পিডোফিলও হতে পারে, এমনি হোমোসেক্সুয়ালও হতে পারে। আমি ব্লেম করছি এমন না। ওদের তো কামনাপ্রকাশের অন্য জায়গা থাকেনা সবসময়। তো, সে একদিন হাত দিয়ে বলেছিল, আরে তোর তো কাটা।
    - কাউকে বলেছিলেন?
    - কাউকে? আরে গোটা দুনিয়া জানে। ওই থেকেই তো আমার নাম কাটা মনি। এখনও বন্ধুরা কাটা মনির বাচ্চা বলে।
    ডাক্তার কিচ্ছু বলেননা। উত্তেজনা দেখেই হবে।
    - ওতে কোনো ট্রমা ফমা নেই কিন্তু। মনি বলে চলে। - বেঁটেকে বেঁটে, লম্বাকে লম্বা, কাটাকে কাটা বলবে। এতে ট্রমার কী আছে। ভালোবেসেই তো বলে। সমস্যাটা হল, ওই তো আগেই বললাম, লিঙ্গ যখন শনাক্তকরণের চিহ্ন হয়ে যায়।
    এইখানে মনি, হাঁফ ধরে গেছে বলে একটু বিরতি নেয়। ডাক্তার অবশেষে, চান্স পেয়ে বলেন, তাতেও, দেখুন, আপনি এত পড়াশুনো করেছেন, সাবকনসাস নিশ্চয়ই বোঝেন। আপনার সাবকনসাসে ওটা ঢুকে বসে আছে হতে পারে তো। সেটা আমরা অ্যানালাইজ করে দেখব।
    - আরে। মনি আবার দম ফিরে পায়। - সাবকনসাসে তো কোটি-কোটি ছেলের ঢুকে বসে আছে। তাহলে তো আপনাকে কালেকটিভ সাবকনসাসের চিকিৎসা করতে হবে।
    ডাক্তার, কে জানে কেন, দুষ্টু হাসি দেন। - কিন্তু কোটি-কোটি ছেলে তো আমার কাছে আসেনি। লেটস কনসেন্ট্রেট অন ইয়োর কেস।
    কিন্তু মনির তখন বেগ এসে গেছে। এসব দিয়ে থামানো মুশকিল। - দেখুন, আপনি ভাবছেন আমার ভয়টা দূর করবেন। কিন্তু ভয়টা তো যাবার নয়, ওটা তো রিয়েল।
    - তাহলে আমার কাছে এসেছেন কী ভেবে?
    মনির বলতে ইচ্ছে করে, বেশ করেছি।পয়সা তো দিচ্ছি। যা বলছি শুনুননা। কিন্তু সব কথা তো আর বলা যায়না। এমনকি মনোবিদের কাছেও। তাই বলে, অ্যাডিকশনের জন্য। ভয় তো অনেকেই পায়। কিন্তু যখন চেপে বসে, তখন বাড়াবাড়ি হয়। মৃত্যুভয়ের মতো। তখন ফোন না করে উপায় থাকেনা।
    - যদি ফোন না থাকে?
    - উপুড় হয়ে শুয়ে থাকি। আগে তো তাই থাকতাম। এখন ফোন করে একটা রিলিজ হয়।
    - সেইজন্যই তো ভয়টা ট্রিট করা দরকার। আর তার জন্য ইতিহাসটা জানা দরকার। আপনাকে আর কে কে, ওই ভাবে ডাকত বলুন। যতটা মনে করতে পারেন।
    - কী ভাবে ডাকত?
    - ওই সম্বোধনে। কাটা।
    মনি এইবার একটা প্রতিশোধ নেবার সুযোগ পায়। - ওই দেখুন, আপনি কাটা কথাটা বলতেই পারছেন না। আবার বলছেন ট্যাবু নেই।
    ডাক্তার হেসে বলেন, আচ্ছা। এই তো বলছি। কাটা। আপনাকে আর কে বলেছে বলুন।
    মধুর প্রতিশোধ নিতে পেরে, এইবার মনিও একটু হাসে। তৃপ্তিতে।


    ৪।

    শমিতার পাশের ডেস্কে ফিরোজ আর অনিমেষ সারাক্ষণ গেঁজিয়ে চলে। মেয়েরা এরকম ফিসফাস করেই থাকে, কিন্তু দুটো ছেলে কীকরে রোজরোজ এই জিনিস চালিয়ে যায় কে জানে। অদ্ভুত। খুব লুকিয়ে করে, তাও না, সবই উপচে আসে শমিতার কানে। ওদের আজকের বিষয় কোনো এক জুয়াড়ি। তাই নিয়ে খুব মনোজ্ঞ আলোচনা চলছে। অনিমেষ গল্পদাদুর মতো বলে, তারপর মালটা তো গেল বুকির কাছে। কে গেল, কেনই বা গেল, সেটা অবশ্য শমিতা জানেনা।
    ফিরোজ খুব আগ্রহ নিয়ে বলে, জেনুইন বুকি? যেন ভিনগ্রহের জীব।
    - আরে একদম রিয়েল বুকি। ল্যাপটপ-ফপ নিয়ে বসে আছে। ঘুপচি দোকানে। চারদিকে সব মাসলম্যান টাইপের লোক। তার মধ্যে ল্যাপটপ খুলে বসে। দেখলেই শ্রদ্ধা হয়। গিয়ে কী বলে বল তো। বলে দুশো টাকা বেট করব। ভাব, ক্রিকেটের একটা জেনুইন বুকি, তার কাছে গিয়ে বলে দুশো টাকা। যেন বাজারে ঢ্যাঁড়োশ কিনতে এসেছে।
    দুজনে মিলে হেসে গড়িয়ে পড়ে। একে অপরের গায়ে ঢলে পড়েনা, এই রক্ষে।
    অনিমেষ হাসতে হাসতেই বলে, বুকিটা আবার হেবি ভদ্র। বলে, পেটি না খোকা না, বাস দোসো? মাপ কিজিয়েগা সাব।
    ফিরোজ ফিচ ফিচ শব্দ করে হাসে। যেন নাক ঝাড়ছে।
    - আরে এখানেই শেষ না। কী বলল আবার সেটা বুঝতেও পারেনি। বলে, কার পেটে খোকা?
    ফিরোজ গড়িয়ে পড়তে পড়তে বলে, এইটা গুল দিচ্ছিস।
    অনিমেষও হাসে। - মাইরি, সব সত্যি। আমাকে আবার বেরিয়ে এসে বলে, এটা কী অদ্ভুত না, এই বুকিদের লিঙ্গো?
    হঠাৎ লিঙ্গ শুনে শমিতার কীরকম ধক করে লাগে। চমকে উঠে বলে, কী বললি?
    ফিরোজ মাছি ওড়ানোর ভঙ্গীতে বলে, আরে বুকিদের লিঙ্গো নিয়ে কথা হচ্ছে। হেবি ইন্টারেস্টিং গপ্পো।
    শমিতা বলে, ওঃ। তারপর একটু থেমে, লিঙ্গো।
    ফিরোজ একটু অবাক হয়। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে। তারপর বলে, এই তোর কী হয়েছে রে?
    - কী হবে?
    - কালকের মেলটার উত্তর দিসনি।
    এ আবার মেল নিয়ে পড়ল কেন? আচ্ছা ঝামেলা তো। শমিতা বলে, হুঁ।
    - পরশুর একটা রিপোর্টও মিস করেছিস।
    - হুঁ।
    - পরশুরটা ইম্পর্ট্যান্ট। বড়োকত্তারা সবাই কপিতে আছে কিন্তু।
    - হুঁ।
    - কী হুঁ? ফিরোজ খচে গিয়ে বলে, তুই শুনছিস?
    - আরে হ্যাঁ রে বাবা।
    - আমার আর কী। তোরই হাম্পু হবে।
    উপকারী বন্ধু সব। নিজেরা তো একেকটি অষ্টরম্ভা। কিন্তু অত কথায় যায়না শমিতা। শুধু বলে, তোরা তো বসে বসে গ্যাঁজাচ্ছিস।
    - তুমি তোমার টা কর বাবা। ফিরোজের সব দাঁত বেরিয়ে যায়। - আমরা বসের শিবলিঙ্গে ফুল চড়িয়ে এসেছি।
    আবার লিঙ্গ। উফ। শমিতাকে চমকে দিয়ে এবার ফোনটাও বেজে ওঠে। শর্মিলা। আবার কী হল?
    - বল।
    - শর্মিলা বলছি। ওপাশ থেকে শর্মিলা হাঁপাতে হাঁপাতে বলে।
    এটা বলার কী হল কে জানে, নম্বর তো সেভ করাই আছে। - জানি। বল।
    - তোরা সাইকোলজিস্টের কাছে যাসনি?
    - তোরা মানে? মনির যাওয়ার কথা। গেছে। আমি কী করব?
    - ওকে ওকে। ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে নিতে বলে শর্মিলা। - চিন্তা হচ্ছিল। ফিরে এলে জানাস।
    জানানোর কী আছে কে জানে। এত হাঁপাচ্ছেই বা কেন? - ঠিক আছে। কিন্তু কী আর জানাব। এসব প্রসিডিওরে সময় লাগে।
    - ওকেঃ। ফুঃ। ওঃ।
    - হাঁপাচ্ছিস কেন?
    - আরে জিমে। স্বাস্থ্যচর্চা করছি।
    - ঠিক আছে, রেখে দে তাহলে।
    - সরি। বলে শর্মিলা। এতে দুঃখপ্রকাশের কী আছে কে জানে। - শোন না।
    - কী বল।
    - একটা কথা বলার ছিল।
    সে তো বোঝাই যাচ্ছে। কথাটা বল না। শমিতা চুপ করে থাকে। - আসলে এটা উপযুক্ত সময় কিনা বুঝতে পারছিনা। তোদের এই সময়ে এসব বলে বিরক্ত করব?
    এ তো আচ্ছা ঝামেলা। মহা বিরক্তিকর তো। - আমাদের এই সময় মানে? আমরা কি বানের জলে ভেসে গেছি নাকি? কালকেই তো মদ খেয়ে গজল্লা করে এলি।
    - তাহলে বলি। এবার শর্মিলা একদম না হাঁপিয়ে বলে। - তুই কাল বললি না কৃষ্ণকলির কথা?
    - কী কথা?
    - ওই যে। বাড়াবাড়ি করছে।
    - হ্যাঁ, তুই তো উড়িয়ে দিলি।
    - কেসটা ঠিক লাগছেনা। বুঝলি।
    - কেন? কী হয়েছে?
    - আরে সব্যকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম।
    শুনে শমিতার মাথাটা গরম হয়ে যায়। - তোর কি মাথা খারাপ? কোনো হিস্ট্রি নেই, প্রুফ নেই, এইভাবে কেউ জিজ্ঞাসা করে?
    - তুইই তো মাথায় ঢোকালি।
    - এবার আমার দোষ?
    - তো কার?
    - হ্যাঁ তুই সতী সাবিত্রী, আমি জাম্বুবান।
    - শোন না। রাগারাগিতে একটুও না টসকিয়ে শর্মিলা বলে। - কীরকম একটা এড়িয়ে গেল বুঝলি। সেটাই তো সন্দেহজনক। রাগ-টাগ করবে, পাড়া মাথায় করে চিল্লাবে, আমি দুদিন কথা বন্ধ করে দেব, তারপর বিছানায় মিটমাট হবে, এটাই নর্মাল না? ওঃ সরি।
    এবার আবার কী? - সরির কী হল?
    - ওই বিছানা বললাম। মনির তো হচ্ছেনা মনে হয়। ভেরি সরি। তোদের এই অবস্থায়...
    - দূর বাল। শমিতা এবার প্রচণ্ড রেগে যায়। - আরেকবার বললে আমি ফোন কেটে দেব। সব্য তোর সঙ্গে শোয়নি, সেটা আমার ঘাড়ে চাপাচ্ছিস কেন?
    - সরি সরি। রাগিসনা প্লিজ। শোন না।
    - এবার কী?
    - ব্যাপারটা কীকরে বার করা যায় বল তো।
    - আরে একটা ঢলানি মেয়ে একটা হোঁতকা ব্যাটাছেলের সঙ্গে একটু ফ্লার্ট করেছে। তোর সামনেই করেছে। এর থেকে কী বার করতে চাস? কেঁচো খুঁড়তে কেউটে? ওসব গোয়েন্দা নভেলে হয় সোনা। রিয়েল লাইফে হয়না।
    শর্মিলা একটু চুপ করে থাকে। নির্ঘাত কিছু একটা ফন্দি আছে। ভেবেই তো ফোন করেছে। - শোন না, তুই একবার কথা বলবি?
    - কার সঙ্গে?
    - সব্যর সঙ্গে।
    - এই নিয়ে? শমিতা জোরে জোরে বলে। - নো ওয়ে।
    - মনিকেই বলতে বলতাম। কিন্তু তোদের যা অবস্থা, এই যাঃ আবার বলে ফেললাম, সরি সরি।
    শমিতা দাঁত কিড়মিড় করে। মুখ তুলে দেখে ওদিকে ফিরোজ হেলিকপ্টারের পাখার মতো হাত নাড়াচ্ছে। তার আবার কী হল? - ভলিউম, ভলিউম। নব ঘোরানোর ভঙ্গী করে দেখায় ফিরোজ। গোল্লায় যাক ভলিউম। - এই শোন, ফোনে জোরে-জোরেই বলে শমিতা। - আমি কিন্তু অফিসে, হ্যাঁ?


    ৫।

    বাজারের মোড়ের পাশেই দেয়াল। শমিতা বাস থেকে নেমে দু পা এগোতেই দেখে, একটা লোক হিসি করছে। দেয়ালে বড়বড় করে লেখা আছে, এখানে প্রস্বাব করিবেননা। সেই জন্যই করে। ওটাই তো চিহ্ন, যে, এটাই তীর্থস্থান, নইলে কী আর লিখত?
    এসব থেকে চোখ সরিয়ে নেওয়াই দস্তুর। কিন্তু আজ অজান্তেই নজর চলে যায়। এর লিঙ্গটা কেমন? কাটা না জোড়া? উফ, কী হচ্ছে এসব। শমিতা চোখ ঘোরাতেই দেখে সামনে আরেকটা লোক। নজর পড়তেই বিগলিত হয়ে হাসে। এ আবার কে?
    - অফিস থেকে ফিরছেন? লোকটা বলে।
    শমিতা একটু আলগোছে বলে, হ্যাঁ? হ্যাঁ।
    - চিনতে পারেননি না? সেদিন আপনাদের বাড়িতে কল সারাতে গেলাম তো।
    - হ্যাঁ হ্যাঁ।
    - পুরো জ্যাম হয়ে গিয়েছিল। এবার চিনতে পেরেছেন?
    - হ্যাঁ হ্যাঁ।
    - দরকার লাগলে আবার ডাকবেন। দাদার কাছে নম্বর আছে।
    তা আর বলতে? - নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। বলে শমিতা।
    শমিতা হাঁটা লাগায়। লোকটাও। দেয়ালের দিকে। শমিতা আড়চোখে দেখে, দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছে। পিছন হাত নাড়ানো দেখে বোঝা যায় চেন খুলছে। এবার...
    শমিতা জোরে মাথা ঝাঁকায়। তারপর আরও জোরে হাঁটে। কী হচ্ছে এ সব? কী হচ্ছে জীবনে? এর চেয়ে তো মনি একটা পরকীয়া করতে পারত। শর্মিলার মতো ফোন করে একটু দুঃখ-টুঃখ করা যেত। বাড়িতে রাগারাগি-চুলোচুলি। কিন্তু তা না, একটা সুস্থ-সমর্থ লোক, হঠাৎই একদিন সকালবেলা থেকে নিজের লিঙ্গ ছাড়া আর কিছু নিয়ে ভাবছেনা। লিঙ্গের উপর চামড়াটা নতুন করে কী করে গজানো যায়, এই হল ধ্যানজ্ঞান। বাড়ি, বন্ধুবান্ধব সব্বাই সেই একই জিনিস নিয়ে ভেবে চলেছে। লিঙ্গ, লিঙ্গ, লিঙ্গ। এ জিনিস হ্যান্ডল করে কীকরে লোকে? পরকীয়া, বৌ-পেটানো সবই সিলেবাসে আছে, সবাই জানে কী করতে হয়। মুখ বুজে সহ্য করতে হবে, পাল্টা ঝগড়া-মারামারি করতে হবে, কিংবা পুলিশে যেতে হবে। কিন্তু এই জিনিস? এরকম একটা অলীক জিনিস সত্যিই হচ্ছে জীবনে? ভেবে হঠাৎ কান্না পায় শমিতার।
    ঘরে ঢুকে দেখে, মনি সোফায় উপুড় হয়ে মোবাইল দেখছে। যথারীতি।
    - কী হল আজ?
    মনি কোনো উত্তর দেয়না। শমিতা জুতো খোলে।
    - গিয়েছিলে তো?
    কোনো উত্তর নেই। শমিতা ব্যাগ রাখে।
    - কী করছ? আবার ফোন?
    কোনো উত্তর নেই।
    - আজ সারাদিনে কটা ফোন হল?
    কোনো উত্তর নেই।
    - তোমার অফিসের ছুটি কিন্তু শেষ হয়ে গেছে। এবার চাকরিটা যাবে।
    কোনো উত্তর নেই।
    এর পরে মাথা ঠিক রাখা অসম্ভব। তাও শমিতা সামান্য একটু গলা চড়ানোর বেশি কিছু করেনা। - কী হল? গিয়েছিলে তো?
    তাতেও কোনো উত্তর নেই।
    শমিতা বেডরুমের ভিতরে ঢোকে। জামাকাপড় ছেড়ে বেরিয়ে আসে। তখনও মনি মোবাইল ঘাঁটছে। শমিতা উঁকি মেরে দেখে, ভিডিওয় একটা বিজ্ঞাপন চলছে। কন্ডোমের। উফ। - তুমি চাকরি করবেনা। শমিতা গলা চড়িয়ে বলে এবার, - ঘরে বসে বসে এই অ্যাবসার্ড ফোন গুলো করে যাবে, এভাবে কতদিন যাবে?
    এতক্ষণে মনি একটু নড়েচড়ে বসে। মোবাইলটা সরায়। তারপর তেরিয়া ভাবে বলে, আমি আর যাবনা।
    - কোথায় যাবেনা?
    - সাইকোলজিস্টের কাছে। অশিক্ষিত পাঁঠি একটা।
    শমিতা নিজেকে বলে, শান্ত হও, শান্ত হও। বাজে কথা বোলোনা। এরকম রেজিস্ট্যান্স কাউন্সেলিং শুরুর দিকে থাকে।
    - বলে কিনা আপনি প্যারানয়েড হচ্ছেন। তেরো গন্ডা ওষুধ খেতে হবে। মুখ ফুটে খালি বলতে পারলনা, টিপিকাল ক্লিনিকাল কেস অফ প্যারানইয়া।
    - আচ্ছা ভুলটা কী বলেছে? মনি, এটা কী হচ্ছে? শমিতা মাথায় ঠান্ডা জল ঢালে। সত্যি না, কল্পনা করে। - এটা কলকাতা শহর। আমাদের, কী যেন বলে, প্রগতিশীলতার একটা ব্যাপার আছে। তুমি মুসলমান জেনেও আমার বাড়িতে কেউ একটি কথাও বলেনি। তোমারও কোনো সমস্যা হয়নি। এখানে তোমার পেনিসের উপর একটা চামড়া আছে কি নেই, কে চেক করতে যাচ্ছে। মানে, কমিউনালিজম উঠে গেছে তা নয়। কিন্তু তুমি স্রেফ একটা চামড়া নিয়ে অবসেসড। এটা প্যারানইয়া নয়?
    মনি এবার ভালো করে উঠে বসে। যেন ঘুম থেকে উঠল। - ও প্যারানইয়া। চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে থাকে, যেন শমিতাই জীবনের একমাত্র প্রতিপক্ষ। - অ্যাজ ইফ তুমি জানোনা, এই কলকাতা শহরে তোমাকে বিয়ে করার আগে এবং পরে, আমি বাড়িভাড়া নিতে দরজায় দরজায় ঘুরেছি। পরপর রিজেকশন। মুসলমানকে ভাড়া দিইনা। ডগস অ্যান্ড মুসলিমস আর নট অ্যালাউড। এটা প্যারানইয়া তাই না?
    - ওটা প্যারানইয়া কেন হবে? শমিতা জলের তাপমাত্রা কমিয়ে দেয়। ফ্রিজের জল যেন পড়ছে কল দিয়ে। - ওটা বাস্তব। কিন্তু তুমি যেটা করছ সেটা প্যারানইয়া। তোমার প্যান্ট খুলে কেউ কিচ্ছু চেক করেনি। আগামীতেও করবেনা। এই নিয়ে ভয় পাওয়াটা ভয়ের জন্য ভয় পাওয়া। অলীক।
    - আচ্ছা? মনি এবার গলা চড়ায়। যেন সব অসুখ সেরে গেছে। - তোমাদের সমস্যাটা কি জানো? প্রবলেমটাকে প্রবলেম হিসেবে রেকগনাইজ না করা। আজ যদি আমার ঠ্যাং ভেঙে যেত, বাড়িতে বসে বসে আমার মানসিক সমস্যা হত, তখন ডাক্তারের প্রায়োরিটি হত ঠ্যাং সারানো। পা জুড়ে গেলে মানসিক সমস্যা এমনিই সেরে যাবে। আর ভাঙা পা না জুড়ে কাউন্সেলিং করতে বসলে ডাক্তারকেই পাগলাগারদে পাঠানো হত। কিন্তু এখানে সব উল্টো। আমার নুনুর উপর চামড়া নেই। সেটা জুড়ে দিলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। তা নয়, মানসিক সমস্যা নিয়ে পড়েছে। কেন রে ভাই। এটা কি ব্রেন টিউমার? এটা কি মেডিকাল সায়েন্সের জন্য কঠিন কিছু কাজ? একটুও না। কিন্তু করবেনা। কারণ, সমস্যাটাই রেকগনাইজ করবেনা।
    জলে আর কাজ হয়না। শমিতা এবার মাথায় আইস ব্যাগ দেয়। - সোসাইটির একটা নর্ম আছে মনি।
    - হ্যাঁ, যেমন পেট্রিয়ার্কি। কাল থেকে ঘোমটা দিয়ে বেরিও।
    - উফ। কর্মে অষ্টরম্ভা। কিন্তু তর্কে স্বয়ং সরস্বতী। - এটা তো সেরকম না। তুমি তো নুইসেন্স করছ একটা। যেকোনো দিন ল অ্যান্ড অর্ডার প্রবলেম তৈরি করবে।
    - ও। গলার শির তুলে বলে মনি। - আমি সমাজের জন্য বিপজ্জনক।
    এর পর বিশ্বের কোনো আইসব্যাগের পক্ষেও ঠান্ডা করা অসম্ভব। শমিতারও গলা সপ্তমে ওঠে। - আবার কী? আজ বাড়িতে বসে আছ। কাল বাইরে গিয়ে ইট পাটকেল ছুঁড়বে। তোমাকে তো পুলিশে ধরবে।
    - ধরুক। ডাকো পুলিশ। ধরে নিয়ে যাক। সেফার। জেলে অন্তত দাঙ্গা হয়েছে বলে শুনিনি।
    শমিতা ফোন তোলে। পুলিশ ডাকতে কিনা বোঝা যায়না। কারণ তক্ষুনি ফোনটা বেজে ওঠে। কৃষ্ণকলি। শমিতা কেটে দেয়। কিন্তু অত সহজেই যদি ছেড়ে দেবে তো কৃষ্ণকলি কেন। ফোন আবার বাজে। শমিতা গলা সপ্তমে চড়িয়েই বলে - বল।
    - আরে কী হয়েছে? ফোন কেটে দিচ্ছ কেন? চেঁচাচ্ছই বা কেন?
    এখানে বসে থাকা অসম্ভব। শমিতা উঠে বেডরুমের দিকে চলে যায়। দুমদুম করে। - কী হয়েছে মানে? তোরা এটা কী শুরু করেছিস?
    - অ্যাঁ? আমি আবার কী করলাম?
    - কী করলাম মানে? ঢলানি করবি অন্য জায়গায় কর। তা বলে যেখানে-সেখানে?
    - লে বাবা। আমি আবার কী করলাম?
    - কী করলাম? শমিতার ছাদ ফাটিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। নেহাৎই গলা সপ্তমের উপরে আর ওঠেনা। - কাল কী করছিলি?
    কলি খিলখিল করে হাসে উল্টোদিকে। - ও। কালকে। দূর ও বাদ দাও তো। তোমাদের এই সময়ে ওইসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছ কেন?
    আবার সেই একই কথা। আমাদের এই সময় মানে? কী হয়েছে আমাদের? শমিতার ফোন ছুঁড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু উপায় নেই। এর মধ্যেই ঢং করে বাড়ি কাঁপিয়ে আওয়াজ। বেল বাজছে। এই সময় কোন মহাপ্রভু আবার দয়া করে দর্শন দিতে এলেন কে জানে।
    শমিতা বলে, ফোন রাখতে হবে। কে আবার এল।
    - ও মনিদা খুলুক। তুমি একটু রিল্যাক্স কর তো।
    শমিতা জোরে জোরে ডাকে। - মনি, মনি।
    আবার কোনো উত্তর নেই। আবার বেল বাজে।
    শমিতা ফোন কেটে দিয়ে দুমদাম করে বাইরে বেরোয়। - কী ব্যাপার? দরজা খুলছনা কেন? ফোনে কথা বলছি তো আমি, নাকি?
    - তুমি তো ঝগড়া করছ।
    এর পরে আর কী বলা যায় কে জানে। শমিতা যথাসম্ভব শব্দ করে দরজার সামনে যায়। শব্দ করে ছিটকিনি নামায়। দড়াম করে খোলে। তারপর বাকস্তব্ধ হয়ে যায়। বাইরে পুলিশ। সত্যি সত্যিই।
    শমিতা কয়েক সেকেন্ড ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। লোকে দরজা খুলে যদি দেখে, বাইরে বাড়ি ভাঙবে বলে বুলডোজার দাঁড়িয়ে আছে, তাহলে যেমন হয়। এক দিনে এত কিছু নেওয়া কঠিন। কোনো সম্বোধনও করেনা। শুধু হাঁ করে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকে, মূর্তির মতো।
    পুলিশ অবশ্য এতে টসকায়না। বিনীত ভাবে বলে - নমস্কার। অভ্যাস থাকারই কথা, লোকে যে পুলিশ দেখলে ঘাবড়ে যায়, এ তো নতুন কিছু না। - আমি রাধানগর থানা থেকে আসছি।
    শমিতা ঢোক গিলে বলে, বলুন।
    - এটা কি মনিরুল ইসলামের বাড়ি?
    - হ্যাঁ।
    - উনি কি আছেন?
    - হ্যাঁ, কিন্তু... শর্মিলা কী বলবে বুঝতে পারেনা।
    পুলিশ অত্যন্ত নরম করে বলে, - একটু বলে দেবেন, বড়বাবু ওনাকে ডেকে পাঠিয়েছেন।
    শমিতা এবার একটু তুৎলে যায়। এসব হচ্ছে টা কী?
    - থানায় পাঠিয়ে দেবেন। আজ রাতেই।
    - কী হয়েছে?
    পুলিশ বিগলিত হেসে বলে, কমপ্লেন আছে ম্যাডাম।
    - কমপ্লেন? কী কমপ্লেন?
    পুলিশ আরও বিনয়ী হয়ে বলে, - সেটা তো আমার জানা নেই ম্যাডাম। থানায় গিয়ে জেনে নেবেন। আসি।
    শমিতা দরজা বন্ধ করে। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকে। নাকি কয়েক মিনিট, কে জানে। তারপর মনির দিকে তাকায়। সে যথারীতি চুপ করে বসে। পুরোটাই শুনেছে। একবারও উঠে আসার প্রয়োজন মনে করেনি। এখন অসহায় কুকুরছানার মতো তাকিয়ে আছে।বাকতাল্লা সব খতম। - কী করেছ? চিৎকার করে বলে শমিতা। কী করেছ?
    মনি বোকার মতো তাকিয়ে বলে, সত্যি পুলিশ?
    অসহ্য। অসহ্য। শমিতা ফোনটা হাতে নেয়। এই মেনিমুখোকে দিয়ে কিছু হবেনা। সব্যকে একটু জানাতে হবে।


    ৬।

    কী কেস বেধেছে কে জানে। হাঁচড়-পাঁচড় করে থানায় পৌঁছতে সব্যর একটু দেরি হয়ে যায়, তার আগেই মনিরা চলে গেছে। বড়বাবু একজন সুদক্ষ ও কর্মপটু মানুষ। বয়স একটু বেশির দিকে, বলা যায় অভিজ্ঞ লোক, পুরোনো ইশকুলে যেমন ক্লাসে অভিজ্ঞ ছাত্রদের পাওয়া যেত, নেহাৎই প্রোমোশনের অভাবে থানার বড়বাবু হয়ে আছেন। সব্য ঘরে ঢুকে দেখে, তিনি শান্ত মেজাজে মনিকে ঝাড় দিচ্ছেন, - কী করে এসব করলেন বলুন তো? চাকরি চলে যাবে। ওয়াইফের কী হবে? পথে বসবে। (শমিতার দিকে তাকিয়ে) আপনিই ওয়াইফ তো? বোঝান একটু।
    সব্য এসবের কিছু মাথামুন্ডু বোঝেনা। কী হয়েছে, বোঝা শিবেরও অসাধ্য। শমিতাও সেটা জিজ্ঞাসা না করে বলে, আমি তো চাকরি করি। মাথাফাতা গুলিয়ে গেলে যা হয়।
    - তাহলে আর কী। ওনাকে শান্তিতে গারদে পুরে দিতে পারি। নেহাৎই ভদ্রলোক বলে কিছু করিনি এখনও।
    এর থেকেও কিছুই বোঝা যায়না। সব্য জিজ্ঞাসা করতে যাবে, এমন সময় মনিই কুঁই কুঁই করে বলে ওঠে - কিন্তু আমি কী করেছি টা কী?
    - চোপ। বড়বাবু হুঙ্কার দেন। তারপর একটু বিরতি।
    মনি ধমক খেয়ে কুঁকড়ে যায়। - কী করেছেন জানেননা? বড়বাবু আবার চিৎকার করেন। তারপর আবার বিরতি।
    সব্যর অধৈর্য্য লাগে। এ কি যাত্রাপালা নাকি? বলে দিলেই তো পারে।
    কিন্তু বড়বাবু তো অন্যের ইচ্ছায় চলবেননা। তিনি আবার চুপ করেন। নাটকে যাকে তুঙ্গমুহূর্ত তৈরি বলে। কী আর করা যাবে, কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। বেশ কিছু সেকেন্ডের বিরতি। তারপর গলার স্বর নামিয়ে নাটকের বিবেকের মতোই আসল রহস্যটা ফাঁস করেন, - আপনি কাউন্সিলারের শালিকে ফোন করে পেনিসের মাপ বলেছেন। এমনিতে ৬ ইঞ্চি, বড় হলে ১০। বলেননি?
    ঘরে যেন বোম ফাটে। যদিও সব্যর এবার ধড়ে একটু প্রাণ আসে। এতক্ষণে অন্তত ব্যাপারটা বোঝা গেছে। জ্লের মতো। একে তাকে ফোন করতে করতে মনি কখন রাজনৈতিক প্রভাবশালীদেরও করে ফেলেছে। কিন্তু তারা কেন রিসেপশানিস্ট হবে? অবশ্য নিজেদের কারবারও হতে পারে। ফ্যামিলি বিজনেস। হয়তো খরচা বাঁচাচ্ছে। কে জানে। যাই হোক, অন্তত খুন-জখম-রাহাজানি না। মনির যা অবস্থা, সবই সম্ভব ছিল।
    কিন্তু বড়বাবুর মুখ দেখে বোঝা যায়, এটাও সোজা ব্যাপার না। কাউন্সিলারের শালি বলে কথা। ঘরে একটা অস্বস্তিকর পরিবেশ। শমিতাও থ মেরে আছে, প্রথমবার জিনিসটা শুনল আর কী। বড়বাবু কেমন-ঝাড়-দিলাম ভঙ্গীতে শিকারী বেড়ালের মতো বসে। আবার বিরতি নিয়েছেন, এবার সবাইকে হজম করার সময় দিচ্ছেন আর কি। মনি বোকার মতো তাকিয়ে। এখানে আসল কথাটা কীকরে বলবে কে জানে, আপাতত নীরবতা ভাঙার জন্য, সব্য একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বলে, দেখুন, ওটা আসলে...
    বড়বাবু ভুরু কুঁচকে তাকান। স্পষ্টতই নিঃশর্ত ক্ষমাপ্রার্থনা ছাড়া তিনি আর কিছু প্রত্যাশা করছিলেন না। - আপনি এক্স্যাক্টলি কে বলুন তো?
    - মনির বন্ধু।
    - শুধু বন্ধু? নাকি মাসতুতো ভাই?
    ঈঙ্গিতটা গায়ে না মেখে একটু বুঝিয়ে বলবে, ভাবে সব্য, কিন্তু তার আগেই মনি আবার বিগড়ে দেয়। - মাপটা তো একটা টেকনিকাল ব্যাপার।
    - টেকনিকাল? বড়বাবু স্পর্ধা দেখে আবার গর্জে ওঠেন। - একজন মহিলাকে পেনিসের মাপ বলা, টেকনিকাল? আপনাকে তো এখনই ধরে আউটরেজিং দা মডেস্টি অফ উইমেনের দায়ে হাজতে ভরতে পারি। আর কাকে কাকে এসব বলেছেন? বৌ জানে এসব সুকীর্তি? সরি ম্যাডাম, আপনি জানতেন এসব?
    শমিতাকে বলার সময়, লক্ষ্যণীয়ভাবেই ওঁর গলা নরম হয়ে আসে। ভদ্রলোক খুবই অবলাবন্ধব, এমনকি স্বাবলম্বী চাকুরিজীবীত্বও ব্যাপারটাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। খুবই ইতিবাচক ব্যাপার। খালি মনি বিগড়ে না দিলেই হয়। সব্য বড়বাবুর নজর এড়িয়ে, হাত নাড়িয়ে ইঙ্গিত করে, মনিকে ঘর থেকে বার করতে। ছোকরা এখানে থাকলেই ভন্ডুল করে দেবে সব।
    শমিতা, দেখতে পায় কিনা কে জানে, বলে, আমি একটু কথা বলব?
    - বলুন না। বড়বাবু বলেন অমায়িক স্বরে।
    - না, মানে, একটু আলাদা করে। যাক বুঝেছে তাহলে। বাঁচা গেছে।
    - অ। মনির দিকে আঙুল দেখিয়ে বলেন বড়বাবু। ইনি থাকবেননা তো?
    - হ্যাঁ, একটু আলাদা করে।
    বড়বাবু আবার ব্যঘ্রগর্জনে বলেন, যান বাইরে বেঞ্চিতে গিয়ে বসুন। পালাবার চেষ্টা করবেন না। তাহলে কোমরে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে দেবে।
    মনি আস্তে আস্তে উঠে বাইরে যায়। বড়বাবুর গলা আবার নরম হয়ে আসে। এত চমৎকার স্বরের ওঠানামা, এ লোক শাস্ত্রীয় সঙ্গীত গায়না কেন? সব্য ভাবে। গাইলে নাম করতে পারত। - ম্যাডাম। বড়বাবু বলেন। - ভেঙে পড়েছেন বুঝেছি, কিন্তু কী করা যাবে বলুন তো, ঘরে-ঘরে পারভার্সান। এ তো তাও ভালো, সেদিন একটা কেস পেলাম, ভদ্রলোকের ছেলে, বুঝেছেন, করেছে কী, পাশের বাড়ির বাথরুমের দেয়ালে ফুটো করে, সেখানে পেরিস্কোপ না কী ঢুকিয়ে, চান করা দেখে। কোনো ভাবেই বাঁচানো গেলনা। একদম রেপ কেস।
    - রেপ কেস? এখানে কথা বলা একেবারেই উচিত নয়, কিন্তু আশ্চর্য হয়ে সব্যর গলা দিয়ে বেরিয়ে যায়, রেপ কীকরে হল?
    - আপনি, এক্স্যাক্টলি কে বলুন তো? বড়বাবুর গলায় আবার বিরক্তি ফিরে আসে।
    - বললাম তো। মনির বন্ধু।
    - অ। ওই জন্যই খোঁজ রাখেন না। এখন আইন বদলে গেছে। পেরিস্কোপ ঢোকাও আর যাই ঢোকাও, সব রেপ। সরি ম্যাডাম।
    তাই সই। সব্য আর কথা বাড়ায়না। বড়বাবু আবার নরম করে বলেন, ম্যাডাম আমি খুবই সরি, এসব মহিলাদের সামনে বলার কথা না। তবে যেটা বলছিলাম, আপনার হাজব্যান্ডের কেসটা ইউনিক কিছু না। খুবই মাইল্ড। একটু জুতোপেটা করলেই সিধে হয়ে যাবার কথা। আমাদের কেস দেবার দরকার পড়তই না। এইসব ফালতু ঝামেলায় কে জড়াতে চায় বলুন। কিন্তু আপনার হাজব্যান্ড ফোন করেছেন সোজা কাউন্সিলারের শালিকে। কিছু মনে করবেন না, ওনার কি মাথাটা একটু ডাল?
    - আসলে। শর্মিলাও কোমল স্বরে বলে। বুঝিয়ে বলার ভঙ্গীতে। - ব্যাপারটা না একটু অন্যরকম।
    - এই তো। নরম হয়ে গেলেন। বড়বাবু একটু হাসেন। দাঁতের পাটি ঝকঝক করে। - কাজের সময় শরৎচন্দ্রের নায়িকাদের মতো হয়ে যান কেন বলুন তো। শক্ত হতে হবে। নইলে আমাদের দেখতে হবে। কাউন্সিলারের শালি। ইয়ার্কি না।
    - আসলে বিষয়টা। শমিতা একটু ইতস্তত করে। - মানে, বলা একটু অস্বস্তিকর।
    শুনে বড়বাবু কীরকম আঁতকে ওঠেন। শশব্যস্ত হয়ে বলে ওঠেন - মহিলা পুলিশ ডাকব?
    - না না। শমিতা বলে। - তার দরকার নেই।
    - কেন? সব খুলে বলবেন? আপনার উপর কোনো অত্যাচার করে থাকলে, মন খুলে বলবেন। তারপর সোজা ৪৯৮। কাউন্সিলারের শালি আর আপনার একসঙ্গে জাস্টিস হয়ে যাবে।
    ব্যাপারটা কোন দিকে যাচ্ছে কে জানে। আসল কথাটা পাড়তে হবে। সব্য এই মধুরালাপে একটু বাগড়া দিতে বাধ্য হয়। - যদি কিছু মনে না করেন, আমি একটু বলি?
    - আবার আপনি?
    - না না বলুক না। বলে শমিতা।
    বড়বাবু অনুমতি দেবার ভঙ্গী করেন। অগত্যা। সব্য বলে, দেখুন, কেসটা একটু কমপ্লিকেটেড।
    - তাই?
    - দেখুন। কীভাবে বলবে বুঝতে না পেরে, সব্য সোজা কাজের কথায় চলে আসে। - মনি তো আসলে মুসলমান। ওদের তো ওই, মানে পেনিসের উপরের চামড়াটা কাটা থাকে...
    - ব্যস ব্যস। বড়বাবু টেবিলের উপর একটা চাপড় মারেন। - এইসব কমিউনাল কথাবার্তা এখানে বলছেন কেন?
    সব্য হাতজোড় করে বলে, প্লিজ, একটু শুনুন। পুরোটা। শমিতাও বলে, প্লিজ। বড়বাবু শান্ত হয়ে আবার হেলান দিয়ে বসেন। নারীদরদী ভাবমূর্তিতে উনি হাত পড়তে দেবেননা।
    - সেই নিয়ে ওর একটু মানসিক সমস্যা হয়েছে। ওর ধারণা হয়েছে, যদি ধরুন, দাঙ্গা টাঙ্গা হয়, তাহলে ওকে ওই দিয়েই আইডেন্টিফাই করে ফেলা যাবে। খুব অমূলক ব্যাপার তো না। ইলেকশনের রেজাল্ট অন্য রকম হলে...
    - আবার। বড়বাবু বলেন। - শেষবারের মতো বলছি, এর মধ্যে পলিটিক্স ঢোকাবেননা। কাউন্সিলার ইনভলভড আছেন। আপনাকে আগেই বলেছি।
    সব্য এবার পৃথিবীর সবচেয়ে বিনীত মানুষটি হয়ে যায়, - আপনি যা বলছেন, সবই বুঝছি। সবই যথার্থ কথা। কিন্তু ওর তো একটু সমস্যা আছে। ভয় আছে। তা, সেই ভয় থেকে ও করছে কি, নানা হাসপাতালে ফোন করছে। যদি কেউ চামড়াটা জুড়ে দেয়।
    - কী?
    - মানে প্লাস্টিক সার্জারি।
    ঘরের মধ্যে যেন বজ্রপাত হয়। বড়বাবু একটু হাঁ করে থাকেন। কয়েক সেকেন্ড। কিন্তু পুলিশই তো, কমবয়সে কম্যান্ডো ট্রেনিংও নিয়ে থাকবেন হয়তো। তাই দ্রুতই সম্বিত ফিরে পান। গর্জন করে বলেন - আপনি কি থানায় ইয়ার্কি মারতে এসেছেন?
    সব্য চুপ করে যায়। এরকমই হবার কথা। দোষও দেওয়া যায়না। ওকে নিজেকে কেউ এইসব বললেও তাইই হত। উফ, মনিটা যে কী বিপদ বাধাল।
    ঘরে অখণ্ড নীরবতা। শুধু ঘড়ির টিকটিক শব্দ শোনা যায়। বড়বাবুও এরপর কী বলবেন খুঁজে না পেয়ে, শুধু তীব্রভাবে তাকিয়ে আছেন। খুব সম্ভবত অপরাধীর বন্ধু হিসেবে, সব্যকেও গারদে ঢোকানো উচিত কিনা ভাবছেন। অস্বাভাবিক কিছু না। এবার কিছু যদি পারে তো শমিতা। সব্য টেবিলের নিচ দিয়ে এক লাথি মারে। শমিতা চমকে ওঠে। বড়বাবুও।
    - কী হল?
    - দেখুন। শমিতা যেন ঘুম ভেঙে উঠে বলে। - ব্যাপারটা অ্যাবসার্ড, আমরাও জানি। কিন্তু...
    বড়বাবু গর্জন করে আবার কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু শমিতার নরম গলায় থমকে যান। একটু মাথা চুলকোন। চিন্তায় পড়েছেন মনে হয়। পুরোটা বিশ্বাসও করতে পারছেননা, আবার নিপীড়িতা নারীর কথা ফেলেও দিতে পারছেননা। ট্রেনিং এ আটকে যাচ্ছে। সংবিধানেও যেতে পারে। একেই শাস্ত্রে বলে, দুই নৌকায় পা।
    সব্য ফাঁকতালে বলে, আমরা ডাক্তারও দেখাচ্ছি।
    - মাথার ডাক্তার? বড়বাবু এবার কথা খুঁজে পেয়ে জোরে জোরে বলেন। - সার্টিফিকেট আছে? না ব্যাকডেটে বানাবেন? স্বরটা গর্জনেরই, সুরটাও ধমকের, কিন্তু গলায় তেমন জোর নেই।
    সব্য খুব সাবধানে শমিতাকে বলে, শমি, নম্বর আছে?
    শমিতা মোবাইল দেখে। বড়বাবু সম্বোধন শুনে একটু সন্দেহের চোখে তাকান। এখনও একটু দ্বিধাগ্রস্ত। এ সুযোগ ফস্কাতে দেওয়া যায়না। সব্য বিনয়ের ঝাউগাছ হয়ে যায়। - দেখুন, এখানে আসার আগে তো জানতামনা কী কেস, বানাব কখন। আপনি নম্বরটায় ফোন করে দেখুন না।
    বড়বাবু একটু চুপ করে থাকেন। আরও একটু মাথা চুলকোন। তারপর সন্দিগ্ধভাবে বলেন, তাহলে। পাগলের কারবার বলছেন? সিরিয়াসলি?
    - মানে, ঠিক পাগল না। একটু মানসিক সমস্যা আছে আর কি।
    - তাতেই ফোন করে কাউন্সিলারের শালিকে...
    - ও তো কাউন্সিলারের শালি ভেবে করেনি। সব্য গলায় মধু ঢেলে বলে, দেখুননা প্লিজ।
    বড়বাবু একটু চুপ করে বসে থাকেন। টেবিল থেকে একটা পেন নিয়ে নাড়াচাড়া করেন। সব্য চুপ করে থাকে। বিজ্ঞানচিন্তার সময় আইনস্টাইনকে বিরক্ত করতে নেই। প্রাচীন অরণ্যপ্রবাদ।
    বড়বাবু অবশ্য বেশিক্ষণ নেননা। কিছু সেকেন্ডের মধ্যেই সাধনা শেষ করে বলেন - দেখুন। তাঁর গলায় এখন তুমুল ব্যক্তিত্ব, কিছু একটা মনস্থির করে ফেলেছেন মনে হয়। - কাউন্সিলার ইনভলভড। পাগল হোক আর ভবঘুরে, কেস বন্ধ করা যাবেনা।
    হয়ে গেল। - প্লিইইজ। বলে শমিতা।
    - তবে। হাত তুলে তাকে থামান বড়বাবু। - আপাতত একটু ওয়ার্নিং দিয়ে ছেড়ে দিতে পারি।
    শর্মিলা বিগলিত হয়ে একটা নমস্কার করে।
    - কিন্তু গ্যারান্টি চাই। কেস খোলা থাকবে, সপ্তাহে একবার থানায় হাজিরা দিতে হবে। আর কোথাও ফোন করবেনা, এই গ্যারান্টি আপনাদের দিতে হবে।
    শমিতা অবাক হয়ে বলে, কোনো ফোনই করবেনা?
    - না। নিজেরাই তো বললেন মানসিক সমস্যা আছে। কী করতে কী করে ফেলল, ঠেলা কে সামলাবে? ফোনটা নিয়ে নিন।
    - কিন্তু বাইরে বেরিয়ে যদি করে? এসব জটিল জিনিসপত্র এখন বলার কী দরকার ছিল কে জানে। আরেকটা লাথি মারবে কিনা ভাবে সব্য।
    - তালাবন্ধ করে রেখে দিন। না পারলে আমরাই রেখে দেব। কোনটা চান?
    - না না। বলে সব্য। এ আর গড়াতে দেওয়া ঠিক না। - ঠিক আছে। যা বলবেন, তাইই হবে।
    - তাহলে তাইই ঠিক রইল। নো ফোন অ্যান্ড আন্ডার লক অ্যান্ড কি। বড়বাবু চিৎকার করে বলেন, রতন। রতন। একটু ওয়ার্নিং দিয়ে দাও। আর একটা হাজিরার ব্যাপার আছে। যান, রতনের সঙ্গে যান। বুঝিয়ে দেবে।
    থানা থেকে বেরিয়ে সব্য হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। আজকের মতো মিটল অন্তত। মনি ক্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে। শমিতা পিছনে। একটু দূরে একজন হোমগার্ড। সব্য জোরে জোরে বলে, কী কেস করেছিস দেখেছিস তো। ফোনটা দে। ফোনটা দে। দে দে দে।
    বাধ্য ছেলের মতো ফোনটা বার করে মনি। অগোছালো ভাবে বার। সব্য ছিনিয়ে নেয়। পিছন থেকে হোমগার্ড বলে, এখানে না, এখানে না। এখানে ঝামেলা করবেন না। আগে যান আগে যান।
    - যাব্বাবা। বলে সব্য। ঝামেলা কী করলাম?
    - থানার সামনে সবসময় ১৪৪ ধারা। ভিড় করবেন না।
    - কিন্তু চারজন না হলে তো ১৪৪ ধারা ভাঙা হয়না। আমরা তো তিনজন।
    - আমিও তো আছি। কজন হল? কথা বাড়াবেন না। আগে যান আগে যান।
    আইনের শাসন সুকঠিন। তিনজনেই এগিয়ে যায়, কথা না বাড়িয়ে।


    ৭।

    পরের দিন। অফিসে শমিতার অসহ্য লাগে। বাড়িতে মনি তালাবন্ধ। এখানে ফিরোজ আর অনিমেষ বসে যথারীতি গুজগুজ করছে। তার উপরে শর্মিলার ফোন। সমবেদনার ওভারডোজ। এরপর কী করণীয়, কতদূর হয়েছে, সেই নিয়ে খোঁজখবর। সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যা। কাল আবার কেন, পারলে আজই যা। সে তো সবাই জানে। বলার দরকারটা কী। ওদিকে মনোবিদ মুম্বই গিয়ে বসে আছেন। কী এক কনফারেন্সে। কিন্তু এত সব ব্যাখ্যা করতে ভালো লাগেনা। সংক্ষেপে বলে, নারে আজ হয়নি। অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া গেলনা।
    - ভালো করে বলেছিলি? ক্রাইসিসটা?
    না, তুই আমাকে উপদেশ দিবি বলে ফেলে রেখেছি। - হ্যাঁ, খুব ভালো করে। কিন্তু তিনি এখন মুম্বাই।
    - অন্য ডাক্তার পাওয়া গেলনা?
    হ্যাঁ, হাতের মোয়া তো। - দেখ শর্মি, এরকম মুড়িমুড়কির মতো রাতবিরেতে কলকাতা শহরে ভালো সাইকিয়াট্রিস্ট পাওয়া যায়না। যাকে খুশি একটা দেখিয়ে নিলেই তো হলনা। আজ দেখব। রাখি?
    শর্মিলা পাত্তাই দেয়না। এরকম হাল্কা বিরক্তি গায়ে মাখলে আর বন্ধু কীসের। - শোন না। সে আছে কোথায়? মনি?
    - বাড়িতে।
    - একা?
    সঙ্গ দেবার ইচ্ছে থাকলে আমাকে ফোন না করে তুই গিয়ে থাকনা বাবা। শমিতা দাঁতে দাঁত চেপে বলে, - টিভি ফিভি দেখছে। এমনিতে তো কোনো সমস্যা নেই।
    - তাও, দেখিয়ে নিলে পারতিস।
    এ তো আচ্ছা ঝামেলা। - আরে, পাওয়া গেলনা বললাম তো।
    - সব্যকে বললে পারতিস। এসব দুমদাম করে করে ফেলে।
    তোরই তো বর। উফ। - তুই বলে দে না।
    - বলব?
    - অবশ্যই। আর কিছু?
    - নাঃ তুই বিরক্ত হচ্ছিস।
    এতক্ষণে বুঝলি? শমিতা আরও বিরক্ত হয়ে বলে, ন্যাকামি করিসনা। বল।
    - জানি, এইসব সময়ে এসব বলা ঠিক নয়।
    আবার। একে কী বলা যায়, শমিতা জানেনা। তাই চুপ করে থাকে।
    - তুই কি সব্যকে জিজ্ঞাসা করেছিলি?
    - কী।
    শর্মিলা একটু ফোঁস করে শ্বাস ফেলে। তারপর বলে, ওই। কলির ব্যাপারটা?
    এ মেয়েটা কী উন্মাদ হয়ে হয়ে গেল? শমিতা প্রচন্ড রেগে গিয়ে বলে, এই এসবের মধ্যে? তুই কি পাগল? এই শোন। মাথা গরম করাসনা। আমি অফিসে। এখন রাখছি।

    শমিতা ফোন রেখে দেয়। পাশ থেকে ফিরোজ উঁকি মারে। এর আবার কী চাই। শুনতেই তো পাচ্ছে, রাগারাগি হচ্ছে। শমিতা কটমট করে তাকায়।
    - তোর রিপোর্ট কিন্তু এখনও পেন্ডিং।
    - উফ।
    ফিরোজ নির্বিকার মুখে বলে, - উফ আফ না করে কাজ টা করে ফেল।
    শমিতা হাত-পা ঝাঁকিয়ে জোরে জোরে বলে, -এরকম কসাইয়ের মতো করছিস কেন? একদিন, একদিনও কি মানুষের খারাপ সময় যেতে পারেনা?
    ফিরোজ তাতেও নির্বিকার ভাবে মাথা নাড়ে। - পারে।
    শমিতার একটুও হাসি পায়না। -তোর বৌয়ের প্রেগনেন্সির সময় আমি কত কিছু করেছি। তখন তো। শমিতা ভেঙচে ভেঙচে বলে। - ওর না একটু গা গুলোচ্ছে, ওর তো মুড সুইং হচ্ছে। রোজ হাওয়া হয়ে যেতিস।
    ফিরোজ তাতেও নির্বিকার। -কিন্তু তোকে মিষ্টি করে রিকোয়েস্ট করতাম তো। তুইও একবার প্লিজ বল, সব হয়ে যাবে।
    এই ছেলেটা এরকম কেন? গা জ্বালানো টাইপ? শমিতা এইবার অল্প করে হেসে ফেলে। - এই ফিরোজ।
    - বলে ফেল।
    বলবে? নাঃ থাক। - ধুর। মানে ব্যাপারটা খুবই অকোয়ার্ড।
    - বলে ফ্যাঅ্যাল।
    - মানে, তুই তো মুসলমান।
    - কী ভাগ্যিস বললি।
    ফিরোজ তাকিয়ে আছে। শমিতা একটু আমতা আমতা করে বলে, -মানে, সংখ্যালঘুদের তো একটা সমস্যা হয়। ধুর, কীরকম সোশাল সায়েন্স ক্লাসের মতো শোনাচ্ছে।
    ফিরোজ চেয়ারটা একটু টেনে কাছে আসে। এতক্ষণে কিছু একটা টের পায়। - কী হয়েছে রে? মনিকে নিয়ে কিছু?
    - বাদ দে।
    - না না, বল না।
    বলব? একটু থতমত খেতে খেতেই শমিতা বলে, -মানে, তুই তো মুসলমান। সেটা কি ফিল করিস? মানে, সংখ্যালঘু হিসেবে?
    ফিরোজের মুখভঙ্গী বদলায়না। ছেলেটার এই একটা ব্যাপার। সব কথাই একই ভাবে বলে যেতে পারে। - আমি মুসলমান ফিল করি কিনা? তার উত্তর হল, না, প্রত্যেক মুহূর্তে নয়। কিন্তু প্রায়ই ফিল করি।
    শমিতার কথা বলতে এবার আরাম লাগে। - মানে, তোর কি ভয় করে?
    - তুই তো মেয়ে। রাতবিরেতে নির্জন রাস্তায় বেরোলে তোর রেপ হয়ে যাবার চান্স আছে। তা বলে সারা দিনরাত কি তোর ভয় করে?
    - নাঃ।
    - করলে তোরই সমস্যা হবে। বাড়ি থেকে বেরোতে পারবিনা। কিন্তু এইসব ফিলসফি আলোচনা কেন?
    শমিতা কিছু একটা বলতে যায়, কিন্তু আবার ফোন বাজে। এবার কে? সব্য। কী হল আবার?
    শমিতা বলে, দাঁড়া, এক সেকেন্ড।
    ফিরোজ সরে বসে। -এইই কর সারাদিন।
    শমিতা ফোন ধরে উদ্বিগ্ন গলায় বলে, বল।
    সব্য উৎফুল্ল গলায় বলে, তোমার সঙ্গে একটা কথা ছিল। গলা শুনে অবশ্য কিছু বোঝা যাবার কথা না। কারণ, ও সবসময়েই উৎফুল্ল।
    - বল না।
    - ফোনে হবেনা। একবার আসতে পারবে? লাঞ্চ আওয়ারে?
    শমিতা এবার প্রচণ্ড উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। আবার কী হল? - কী হয়েছে?
    - আরেঃ ঘাবড়ে গেলে নাকি? কিচ্ছু হয়নি। মনিকে নিয়ে কথা ছিল।
    তাহলে বোধহয় শর্মিলা ডাক্তারের জন্য বলেছে। - শর্মিলা ফোন করেছিল?
    - অ্যাঁ? মানে করেছিল বটে, কিন্তু ধরা হয়নি। তুমি কি করে জানলে?
    অত ফেনিয়ে ব্যাখ্যা করতে ভালো লাগেনা। - ও বাদ দাও।
    - এই মাইরি, বলে ফেললাম। চুকলি কোরোনা কিন্তু।
    - লাঞ্চ আওয়ারটা কখন?
    সব্য সব্য তার চির উৎফুল্ল গলায় বলে - তুমি যখন বলবে। খাবার আবার সময় কী?
    এই জিনিস আর নেওয়া যায়না। শমিতা বলে, আমি এখনই আসছি। তারপর ফোনটা কান থেকে সরিয়ে বলে, এই ফিরোজ, একটু বেরোলাম। সামলে নিস।
    ফিরোজ নির্বিকার মুখে কাঁধ ঝাঁকায়। শমিতা একটু থেমে ম্লান হেসে বলে, -প্লিজ।



    ৮।

    শহরে এখন নিত্যনতুন ক্যাফে গজাচ্ছে। কবে কোনটা খুলছে, আর কোনটা উঠে যাচ্ছে, হিসেব রাখা মুশকিল। তার উপর উদ্ভট সব নাম। সেসব আবার বদলেও যায়। সেই রকমই একটা বিদঘুটে ক্যাফেতে বসে, শমিতা অবাক হয়ে বলে, - জ্যোতিষী? জ্যোতিষী মানে কী?
    - আরে বাবা। সব্য একটুও অপ্রস্তুত না হয়ে, হাত-পা নেড়ে বোঝায়। - এ জ্যোতিষী সে জ্যোতিষী নয়। দাঁড়াও বুঝিয়ে বলি। অ্যাই, খাবার-দাবার কদ্দুর।
    - কী হচ্ছে। শমিতা অপ্রস্তুত হয়ে বলে। - দেবে তো।
    এই আধা সস্তা ক্যাফেটায় এনেছে কেন কে জানে? এদের নাকি সুপটা দারুণ। কিন্তু এটা কি খাওয়া-দাওয়ার সময়?
    সব্য ঠ্যাং দোলাতে দোলাতে বলে, - যা হোক, তুমি শিবলিঙ্গ দেখেছ?
    -অ্যাঁ? এটা আবার কী প্রশ্ন। - দেখবনা কেন?
    - শিবরাত্রি করতে নাকি?
    এসব আবার কী? শমিতা বলে, - কী বলছ বল তো।
    - বল তো, শিবলিঙ্গ কাটা কিনা?
    পয়েন্ট টা কী? শমিতা বলে, ভ্যাট। ওসব কে দেখেছে।
    - ওই তো। দেখইনি। বলে নাকি শিবের মাথায় জল ঢালছে। এই, খাবারটা এখনও দিচ্ছেনা কেন বলতো?
    - তুমি ভ্যানতারা ছেড়ে কেসটা বলবে?
    - আরে কেসের কিছু নেই। যদি ভালো করে দেখতে তো বুঝতে, শিবলিঙ্গকে মাথা কেন বলে। পুরো মসৃণ। ডেফিনিটলি কাটা। আমাদের, মানে হিন্দুদের পুরাতন ঐতিহ্য হল কাটা লিঙ্গ।
    - তাতে কী হল?
    সব্য প্রচণ্ড উৎসাহের সঙ্গে বলে, - এইটা মনির মাথায় ঢোকাতে হবে। ওইসব সাইকিয়াট্রিস্ট থেরাপিস্ট ওসব দিয়ে হবেনা। ছোঁড়া পন্ডিত মানুষ। ইতিহাস, ধর্ম এইসব অ্যাঙ্গল দিয়ে অ্যাটাক করতে হবে, যে, কাটা লিঙ্গ স্রেফ মুসলমানদের সম্পত্তি না।
    ইয়ার্কি মারছে কিনা বুঝতে পারেনা শমিতা। - সেই জন্য জ্যোতিষী?
    - আরে জ্যোতিষীটা ফালতু। ওটা একটা এনভায়রনমেন্ট তৈরির জন্য। রুদ্রাক্ষ ফাক্ষ পরে বসে আছে, চেম্বার টেম্বার আছে। বেশ একটা হিন্দু ধর্মের হোলসেলারের মতো হাবভাব। ছোকরাকে আমি চিনি। একটা লোনের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। হেবি বলিয়ে কইয়ে। একবার মনিকে নিয়ে ফেললেই হবে। একদম কনভিন্স করে ছেড়ে দেবে। দাও দাও। পেটে আগুন জ্বলছে।
    শমিতা ঘুরে দেখে, পিছনে ওয়েটার। খাবার দাবার এসে গেছে। সেসব সাজাতে একটু সময় লাগে। ততক্ষণে শমিতা সিনটা একটু ভাবে। জ্যোতিষীর সামনে মনি। কী অ্যাবসার্ড। কী অকল্পনীয়। এর এসব মাথায় আসে কী করে? ফুস করে অল্প হেসে মাথা নাড়ে।
    - কী হল?
    - এই প্লিজ, জ্যোতিষী টোতিষী না।
    - ওকে। সুপটা নাও। হেবি বানায়।
    সব্য মন দিয়ে একবাটি সুপকে দুভাগ করতে থাকে। শমিতা অবাক হয়ে বলে, তুমি এইটুকুতেই মেনে নিলে?
    সব্য সুপ ঢালতে ঢালতে বাণী দেয়, - আরে এটা মানবেনা তো এক্সপেক্টেড। তবু ট্রাই করলাম। আমার প্ল্যান বি আছে। নাও নাও।
    শমিতা সুপ নেয়।
    - এবার চুমুক দাও।
    শমিতা খেতে পারবেনা ভেবেছিল। কিন্তু চুমুক দিয়ে বেশ ভাল লাগে। শমিতার কেমন একটু সন্দেহ হয়। - সব্য।
    - হুঁ।
    - তুমি কি আমাকে চিয়ার আপ করার জন্য এইসব করছ?
    - আরে না রে বাবা। (সুপে চুমুক দিয়ে) উফ কী গওম। উফ। আমি প্রচণ্ড সিরিয়াস। ডাক্তার-ফাক্তারের সঙ্গে কথা বলে ফেলেছি।
    - ডাক্তার? আবার কীসের ডাক্তার?
    - আরে বলছি বলছি। খাও না। এটা সিরিয়াস। ফুঃ, এত গরম দেয় কেন কে জানে। সব্য ফু দিতে দিতেই বলে, - একটা রোগ, রোগ ঠিক না, পার্শিয়াল ডিফর্মিটি আছে জান? ফাইমোসিস।
    - সেটা আবার কী?
    - ব্যাটাছেলেদের হয়। লিঙ্গের মাথাটা চামড়া দিয়ে আটকানো থাকে।
    ইয়ার্কি মারছে কিনা কে জানে। - সে আবার কী?
    - আরে সিরিয়াস কিছু সমস্যা না। সব্য সুপ ফেলে রেখে গম্ভীর ভাবে বলে।- ডাক্তার জাস্ট কুচুং করে কেটে দেয়।
    - কেটে দেয়?
    - আরে ক্যাস্ট্রেশন না, উফ। জাস্ট উপরের চামড়াটা। মুসলমানদের ছোটোবেলায় যেরকম হয়। কুচুং। দাঁড়াও। সব্য সুপে চুমুক দেয়। - কিন্তু সেটা কথা না।
    তাহলে কথাটা কী? - কথাটা হল, সব্য খোলসা করে, এরকম লোকের সংখ্যা প্রচুর। এবং তারা ন্যাচারালি মুসলমান নয়। ওদের তো জোড়া থাকার প্রশ্নই নেই।
    এটা তো মনে হচ্ছে না ক্যাওড়ামি। চারদিকে এইসব হয় নাকি? - সিরিয়াসলি?
    - তো, ইয়ার্কি মারছি নাকি। আমি একজন ডাক্তারকে চিনি যিনি এই অপারেশনটা করেন। দাদা টাইপের। একবার মনিকে নিয়ে ফেল। জলের মতো করে বুঝিয়ে দেবেন, যে, মুসলমান না হলেও গাদাগাদা কাটা লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে চারদিকে। আসল ব্যাপারটা তো হল কনভিন্স করানো।
    এই আইডিয়াটা অবশ্য ততটা অলীক লাগেনা শমিতার। বিজ্ঞান আছে, সভ্যতা আছে, আলোকপ্রাপ্তি আছে, এবং একজন সভ্যভদ্র ডাক্তার আছেন। হয়তো বুঝিয়েই ফেললেন। শুধু প্রশ্ন একটাই, এই অবস্থায় মনি বুঝবে কিনা।
    - দেখা যাক না ট্রাই করে। কালই আসতে পার। কথা বলে রাখা আছে।
    - উফ। বলে শমিতা। সব্যর কথার জন্য না। ভুল করে অনেকটা সুপ মুখে দিয়ে দিয়েছিল। কথাটা শুনে বরং, কে জানে কেন, শমিতার খুবই আশ্বস্ত লাগে হঠাৎ করে। এই জন্য না, যে, এতে সমস্যাটা মিটে যাবে। হয়তো যাবেনা। কিন্তু কেউ অন্তত ভাবছে। নইলে একলা এসব টানা সত্যিই মুশকিল।
    - কী হল?
    - অনেকটা খেয়ে ফেলেছি। থ্যাংকিউ থ্যাংকিউ।
    - আরে লিঙ্গের কথা শুনে এত উত্তেজিত হয়ে পড়ার কিছু নেই। তোমার যৌবন এখনও লাফাচ্ছে। ধীরে সুস্থে খাও।
    শমিতা ফস করে হেসে ফেলে। আবার এক চুমুক দেয়। - সেদিন মনির সঙ্গে রাগারাগি করছিলাম জানো?
    - কী নিয়ে।
    - সারাক্ষণ এই একটাই টপিক নিয়ে কথা হচ্ছে। কোনোদিন ভেবেছি? আমার এমন দশা, যে, রাস্তায় কেউ হিসি করছে দেখলেও মনে হয় তাকিয়ে দেখি...
    - কী, কাটা কিনা?
    শমিতা মাথা নাড়ায়। এবার একটু বেশি হেসে ফেলে। - তবে সিরিয়াসলি, এখন বেটার লাগছে। তুমি না...
    - প্রশংসা করতে হলে করেই ফেল। চেপে রাখতে নেই।
    - মানে, খুবই লাইভলি। সারাক্ষণ এত কিছুর মধ্যে, অফিস সামলে, শর্মিলাকে সামলে এত চিয়ারফুল থাক কীকরে?
    - শর্মিলাকে সামলে মানে? সব্য ভুরু কুঁচকে তাকায়। - এ তো শর্মিলারই কৃতিত্ব।
    শমিতা কৌতুহলী চোখে তাকায়। সব্য বলে, শর্মিলা না থাকলে তার সুন্দরী, স্মার্ট বান্ধবীদের পেতাম কোথা থেকে?
    শর্মিলা আবার হাসে।
    - আচ্ছা এবার কাজের কথা। ডাক্তারটা তাহলে ফাইনাল তো? আমিই নিয়ে যাব না হয়।
    শমিতা একটু ভাবে। ক্ষতিই বা কী। কিন্তু মনিকে এটা বলবে কীকরে? রাজি হবে?
    - মনিকে রাজি করিয়ে ফেলা যাবে। সব্য আত্মবিশ্বাসী স্বরে বলে।
    - তুমি একটু মনিকে বলবে? প্লিজ প্লিজ প্লিজ।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
    পর্ব ১ | পর্ব ২
  • ইস্পেশাল | ১৭ আগস্ট ২০২৩ | ৪৮৩৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • একক | ১৭ আগস্ট ২০২৩ ১৭:৪৬522569
  • একঝোঁকে পড়ে ফেল্লুম :) খাশা! 
  • Rupanwita Biswas | ১৭ আগস্ট ২০২৩ ২১:২৬522571
  • অদ্ভুত অস্বস্তি লাগছে পড়ে। 
  • মোহাম্মদ কাজী মামুন | ১৮ আগস্ট ২০২৩ ০০:৪৪522577
  • '' অ্যাঁ? বলে মনি। - কবে থেকে? এ তো দেশভাগের পর থেকেই চলছে।''
    অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে! 
  • :|: | 174.251.162.89 | ১৮ আগস্ট ২০২৩ ০৫:৩০522581
  • সামান্য তথ্যে একটা প্রশ্ন:  -- অত "লেখাপড়া করা" মনি সত্যিই জানতেন না যে শিবলিঙ্গের কল্পনাটা থ্রিডি? গৌরীপট্ট বা যোনীপট্টের মধ্যে প্রবিষ্ট লিঙ্গ "পুরো স্মুদ" হতে পারেনা কি? জ্যোতিষী বলে দিলো আর উনি মেনে নিলেন?! এইখানেই তো শুরুর দিকে আছে https://www.varanasi.org.in/shiva-linga/amp
     
    বাকী গল্প ঠিক আছে।
  • রানা সরকার | 2402:3a80:196c:37cb:778:5634:1232:5476 | ১৮ আগস্ট ২০২৩ ১১:৫১522588
  • খুব সুন্দর ভাবনা। তবে আগে একজন বলেছেন যে শিবলিঙ্গের ব্যাপারটা কি মনিবাবু জানেন না? হতেও পারে। অনেকে অনেক কিছু জানলেও,  আবার অনেক কিছুই জানেন না। তবে প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি মুসলিম ধর্মের মানুষ  ছাড়াও ইহুদিদের মধ্যেও এই রীতি আছে। আর মুসলমানদের আগেই আছে। ভালো লেগেছে 
  • Samir pal | 2409:4061:4e99:8950:ac64:3fef:ec92:d6f7 | ১৮ আগস্ট ২০২৩ ১৪:১৬522592
  •   Asadharon, fatafati  golpo, khub valo laglo, bisoybostu nirbachon proshongsonio. Lekhoker sadhubad prapyo.
  • সৈকত মিস্ত্রী | 112.79.61.233 | ১৮ আগস্ট ২০২৩ ১৯:২৫522599
  • পড়লাম। ৫,৬ এ একটু ঘাঁটা ঘাঁটা হলেও, ওভারল খাশা!বেশ ক্যাওরামি আছে।
  • Ranjan Roy | ১৯ আগস্ট ২০২৩ ০৩:০৫522605
  • ভালো লেগেছে।
  • বিপ্লব চক্রবর্তী। | 2402:3a80:413a:aadd:d57d:fb6c:2563:e990 | ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৪:১০523254
  •  ভালো লাগলো গল্পটা। পড়িয়ে নিল। নামকরণ টি সাহসী। আর একটু মেদবর্জিত করা যেত কি? গল্পকারকে শুভেচ্ছা।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে মতামত দিন