এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ভ্রমণ  দেখেছি পথে যেতে

  • সান্দাকফু - পথ চলার গল্প - ৬ (শেষ পর্ব)

    সুদীপ্ত লেখকের গ্রাহক হোন
    ভ্রমণ | দেখেছি পথে যেতে | ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ৫৮১ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • সকাল নটা নাগাদ ট্রেকিং হাট থেকে বেরিয়ে যখন সান্দাকফু-কে বিদায় জানালাম, তখন-ও পরিষ্কার আকাশ আর কাঞ্চনজঙ্ঘা, এভারেস্ট, এমনকি ভুটানের শিখরশ্রেণী-ও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, মেঘের চিহ্নমাত্র নেই। সরু পথ ধরে ধীরে ধীরে নামা শুরু হল, দুদিকে পাহাড়ের গায়ে গায়ে ঘন জঙ্গল, কিছুক্ষণ পরেই বরফের চূড়ারা সবাই অদৃশ্য হল। প্রথম দিকে মাটির পথ, নেমে যাচ্ছি ভালো-ই, কিছুক্ষণ পর একটা নামজাদা ট্রেকিং কোম্পানির দল আমাদের পার হয়ে গেল। রাস্তা খুব-ই সরু, জায়গা করে দেওয়া বেশ সমস্যার; আর একটা জিনিস দেখলাম, অধিকাংশ প্রফেশনাল ট্রেকার্স-দের দলগুলো বলে থাকে পাহাড়ে ট্রেকিং করা উচিৎ নিজের সুবিধাজনক দ্রুততায়, কাউকে দেখে উৎসাহিত হয়ে বা প্রতিযোগিতা করে নয়; কিন্তু এরা দেখলাম প্রায় দৌড়োচ্ছে, তা-ও পিঠে দশ কিলো বোঝা নিয়ে। বেশ কয়েকজন যারা একটু পিছিয়ে পড়েছে (এই আমাদের পার হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা প্রায় এক কিলোমিটার ধরে চলেছিল), তারা দেখি রীতিমত হাঁপাচ্ছে, কেউ কিছুটা খোঁড়াচ্ছেও, কিন্তু পাছে সামনের দল হারিয়ে যায়, মনে হল প্রায় সেই ভয়ে কোনোরকমে দৌড়োচ্ছে। এই পথের নতি কোথাও কোথাও ষাট ডিগ্রির বেশী, দুদ্দাড় করে নামতে গিয়ে একজন তো আর একটু হলেই পড়ে যাচ্ছিল প্রায়। চারপাশের সৌন্দর্য কাউকে তেমন তাকিয়ে দেখতে বা উপভোগ করতে দেখলাম না; হবে হয়ত, ভিন্নরুচি লোকাঃ! আমরা প্রায় তিন কিলোমিটার মত নেমে আসার পর, বাঁশঝাড়ের জঙ্গল শুরু হল দু-পাশে। এত দুর্ভেদ্য যে কিছুই প্রায় দেখা যায় না, সরু, মোটা, কাঁচা, পাকা অজস্র বাঁশের ঝাড় দুপাশে, মাটিতেও পড়ে আছে শুকনো বাঁশ, ভাঙা কঞ্চি আর বেত আর ঝরা পাতা। 
     
    গুরদুমের পথে 

     
    রাস্তা এবার কিছুটা সহজ হল, তবে উৎরাই অব্যাহত। প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পরে হঠাৎ দেখি জঙ্গলের পথ খুলে গেল এক প্রশস্ত ঘাসজমিতে। যেন সুন্দর করে সাজানো লন, পা রাখলে জুতো ডুবে যাচ্ছে নরম ঘাসে। দূরে দেখা গেল একটা ট্রেকার্স হাট। ওখানেই দেখলাম সেই এগিয়ে যাওয়া ট্রেকারের দল ভিড় জমিয়েছে।
     
    সেই ট্রেকার্স হাট

     
     একটু এগোতে দেখলাম দুটো ঘর। একটা একটু লম্বাটে মত, এটাই বিশ্রামকক্ষ যা মনে হল। তবে রাতে থাকা যায় কিনা বুঝলাম না, জানলাগুলো দেখলাম ভাঙা, দরজাও তাই। পাশের চালাঘরটা এদের কিচেন। দু-তিনজন রয়েছে আর মোটামুটি ম্যাগি, থুকপা, ওমলেট, বিস্কিট, ফ্রুটি এইসবের বন্দ্যোবস্ত। আমরা একটু পাশের দিকে একটা গাছের ডাল দিয়ে বানানো বেঞ্চে গিয়ে বসলাম। সঙ্গে আনা শুকনো ফল আর চকোলেট খেলাম কিছু। প্রায় একটা নাগাদ আমরা আবার বেরিয়ে পড়লাম। একটু এগিয়ে আবার জঙ্গলের রাস্তা শুরু হল। তারপর শুধুই হু হু করে নেমে চলা। 

    আবার অরণ্যে

     
    হু হু করে বলছি বটে, তবে এই উৎরাই-ও প্রাণান্তকর। মাঝে মধ্যে বেশ তিন-চার ফিট উপর থেকে নীচে লাফিয়ে নামতে হচ্ছে, তার উপর আমার ভাঙা পোলে বেশি চাপ দেওয়া যাচ্ছে না, হাঁটুতে ভালোই চাপ পড়ছে। দু-এক জায়গায় এমনকি সবাই সবাইকে ধরে নামতে হল, পথ এতই সরু আর খাড়া, একটু এদিক-ওদিক হলেই ‘পপাত চ, মমার চ’! প্রায় তিন কিলোমিটার এভাবে নামার পর অনেক নীচে কিছু লাল-সবুজ ঘরের চালা দেখা গেল। নিত্যম বলল ওইখানেই গুরদুম। কিন্তু এও বলল,এ এমন পথ আর এত ঘুরে ঘুরে নামবে যে মনে হবে পথের শেষ নেই! সত্যি তাই, চোখের সামনে নীচে দেখছি ঘর-বাড়ি, এদিকে পথ শুধুই নামছে আর বাঁকের পর বাঁক ঘুরে চলেছে, শেষ আর হয় না।    
    এইসব দৃশ্য চোখের সামনে থাকলে ক্লান্তি আসে না শরীরে,মনে


    গুরদুমের উচ্চতা প্রায় আট হাজার ফুট। সুতরাং এই দশ কিলোমিটারে আমরা প্রায় চার হাজার ফুট নীচে নেমে এসেছি। এথেকেই বোঝা যায় উৎরাই-টা কি প্রকৃতির! আর একটা জিনিস প্রথম থেকেই খেয়াল করছি, এই ট্রেকিং-এর রাস্তা এবড়ো খেবড়ো পাথরে বাঁধিয়ে দেওয়ার নামে যে প্রবল ‘উন্নয়ন’-টি চলে (হয়ত এর মধ্যে একশো দিনের কাজের বৃত্তান্ত-ও আছে), তাতে ট্রেকারদের সর্বৈব অসুবিধে ছাড়া কিছুই হয় না। কারণ মাটির রাস্তা, পাথুরে রাস্তার তুলনায় হাঁটার জন্যে অনেক বেশী আরামদায়ক, পা আর হাঁটুর উপর চাপ-ও অনেক কম পড়ে। নীচে নামার ক্ষেত্রে তো কথাই নেই। যাই হোক, শেষ দিকে এসে হঠাৎ এক জায়গায় দেখি পথ গিয়ে ছোটো একটা সমতল জমিতে মিশেছে। আমরা ভাবলাম তার পাশের বাড়িটাই আমাদের মিংমা হোমস্টে। ওমা, দেখি সেই বাড়ির বারান্দা ঘেঁষে আবার রাস্তা নীচে নেমে গেছে, আবার সেই নামা শুরু। অবশেষে আর-ও দশ মিনিট পরে রাস্তা এসে একেবারে আমাদের মিংমা হোমস্টে-তেই ঢুকে গেল।
     
    নেমেই চলেছি- লাস্ট ল্যাপ, গুরদুমের পথে 


    আমাদের এখানে বুক করা ছিল ডরমিটরি ছয় বেডের। সঙ্গে একটা বাথরুম-ও। পথ-টা এসে হোমস্টের সাথে মিলেছে একটা বড় চাতালে। চাতালের দুদিকে ইংরাজী ‘L’ এর মত ঘরের সারি। আমাদের ঘরের পাশেই লম্বাটে খাওয়ার ঘর। আর একদিকে ভিতরে ঢুকে গেলে কিচেন, সেখানেও এক সারি খাওয়ার জায়গা, টেবিল-চেয়ার পাতা। চাতালে এসে দাঁড়িয়ে সামনে তাকালে, সবুজ পাহাড়ের সারি, অপূর্ব দৃশ্য! আমরা পৌঁছেছিলাম চারটের দিকে। তখনো হালকা রোদ। এখানে বাথরুম বেশ পরিষ্কার দেখে ওই ঠান্ডা জলেই স্নান সারলাম। সেই মানেভঞ্জং-এর পর আবার এখানে, কি যে আরাম হল! বাইরে এসে সূর্যাস্ত দেখা শেষ হতে না হতেই দেখি হই হই কান্ড। সেই ট্রেকিং কোম্পানি-র দল-টা এসে পড়েছে, তাদের-ও থাকার ব্যবস্থা এইখানেই। এদের আবার দুজন ইন্সট্রাক্টর কিছু ভিডিও তুলে নিল এই পৌঁছে যাওয়ার দৃশ্যের। তারপর দেখি, এদের আবার কিছু কিছু ব্যায়াম করার নির্দেশ দিল খানিক বিশ্রামের পর, এতে নাকি হাঁটু বা পায়ের উপর সারাদিন যে ধকল গেছে, তাতে উপকার হবে। বেশীর ভাগ-ই ওই স্ট্রেচিং টাইপ, নানা ধরণের। চলার পথে এদের খাবার-দাবার-ও একেবারে নিয়মমাফিক আর ওই ইন্সট্রাকটর-রাই সবার থেকে জেনে লিস্ট বানিয়ে হোম-স্টের মালিক কে ধরিয়ে দেয়। আমরা সন্ধ্যেবেলা কিছু পকোড়া নিলাম আর কফি/চা। রোহিতের স্ন্যাক্স তো আছেই, তবে প্রায় শেষের পথে। সাতটা নাগাদ নিত্যম আর বাইচুং এসে হাজির গল্প-স্বল্প করতে। আমাদের ট্রেক কাল শ্রীখোলা পৌঁছে শেষ হয়ে যাবে। তাই ওদের-ও বেশীর ভাগ পেমেন্ট করে দিলাম। পাঁচ মিনিট পরেই দেখি আবার দুজনেই হাজির, এবার নিত্যমের কাঁধে গিটার! গল্প করতে করতে জানতে পারলাম, নিত্যম বেশীর ভাগ গোচালা-র ট্রেক করায়, মাঝে মধ্যে সান্দাকফু বা ফালুট। ইতিমধ্যে গিটারে টুং টাং করতে করতে কখন যেন মিহি সুরে একটা নেপালী গান ধরে ফেলেছে। তারপর যত সময় গড়ায়, দেখি ঝুলি থেকে বেরিয়ে আসে পিঙ্ক ফ্লয়েড, ঈগলস ইত্যাদি। এমনকি আমার গুনগুন শুনে জামাইক্যান ফেয়ারওয়েল-ও গিটারে সুর তোলে, অগত্যা একটু গেয়ে ফেলি, বাকিরাও ইতিউতি সুর ধরে।  নিত্যম শেষ করল যে গানটা দিয়ে, আমি একেবারে হতবাক, সাইমন অ্যান্ড গারফাঙ্কেল এর  'Sound of Silence', খুব-ই পছন্দের একটা গান! 

    নিত্যমের গান আর গিটার 

     
    জানিনা আমাদের ‘অনুপ্রেরণায়’ কিনা, হঠাৎ দেখি বাইরের চাতালে সেই ট্রেকিং পার্টির ছেলে-মেয়েরা নাচ-গান শুরু করেছে, আজ-ই ওদের শেষ দিন, কাল ওখরে-র দিকে গিয়ে যে যার গন্তব্যে ফেরৎ যাবে। প্রায় সাড়ে আটটা যে বেজে গেছে, সে খেয়াল হল খাওয়ার ডাক পড়তে। মিংমা হোম-স্টের খাওয়া দাওয়া বেশ ভালো। রাতের মেনুতে চিকেন, সব্জী দিয়ে ডাল আর রুটি/ভাত। বাবার বয়স হয়েছে, তাঁর দুই ছেলে-মেয়ে আর স্ত্রী এই হোমস্টে চালান। ছেলে প্রশাসনিক দিকটা দেখে আর মা-মেয়ে কিচেন সামলায়। মেয়ে পড়ে কলেজে, এখন ছুটিতে এসেছে। এদের আয় প্রায় সম্পূর্ণভাবে এই ট্রেকারদের উপর নির্ভরশীল যা বুঝলাম। অন্যান্য পর্যটনের ক্ষেত্রে কোভিডের থাবা পড়লেও, ৩-৪ মাস বাদ দিলে, ট্রেকিং এর উৎসাহ মানুষের মধ্যে এই করোনাকালে ভালোই বেড়েছে, সুতরাং এঁদের ব্যবসার জন্যে সুখবর। আর গুরদুমে খুব বেশী থাকার জায়গা নেই, মিংমা হোম-স্টে সবচেয়ে বড়। খাওয়া দাওয়া শেষ করে দেখি গান-বাজনাও শেষ, বাইরের চাতালে নিঃঝুম পরিবেশ, চারিদিকের পাহাড় আর জঙ্গলের কালো অবয়ব ঘিরে ধরেছে, ঠান্ডাও ঝুপ করে বেড়ে গেছে যেন! উপর থেকে একটা কুয়াশার স্তর নেমে এসে চাতালে ঢুকে পড়তে আমরাও গুটি গুটি ঘরে ঢুকে পড়লাম।

    আজ আমাদের ট্রেকিং-এর শেষ দিন। সকাল সকাল গরম গরম আলুর পরোটা খেয়ে পথে নেমে পড়লাম। আজকের আমরা হাঁটা শেষ করব শ্রীখোলা-য়, ওখানেই কালকের জন্যে গাড়ি বন্দ্যোবস্ত করা আছে। শুরুতে সেই এক-ই পাথরে বাঁধানো সরু পথ, পাহাড় বেয়ে এঁকেবেঁকে সোজা নেমে চলেছে। গুরদুম থেকে শ্রীখোলার দূরত্ব ৬ কিলোমিটার। তবে আমরা পাহাড়ি রাস্তায় কিলোমিটারের হিসেব করা ছেড়ে দিয়েছিলাম, চরৈবেতি, যখন সময় হবে পৌঁছে যাবো! ঘন্টাখানেক পরে বাঁধানো রাস্তা শেষ হয়ে পাহাড়ের গায়ে জঙ্গলের রাস্তা ধরে নামা শুরু হল, এই রাস্তাটা একেবারেই যাকে বলে ‘Road less travelled’, নিত্যমের মতে এটা শর্টকাট। উঁচুনীচু, ছোটো নালা, জল-কাদা সব মিলিয়ে বেশ চাপের রাস্তা, তবে আমাদের আজ উৎসাহের অভাব নেই, মেরে এনেছি প্রায়! 

    গুরদুম থেকে শ্রীখোলার 'শর্টকাট'

     
    এতক্ষণ শুধু শব্দ পাচ্ছিলাম, এবার শ্রীখোলা নদী-ও আমাদের পাশে এসে হাজির, কলকলিয়ে ছুটে চলেছে পাথরের উপর লাফ দিয়ে দিয়ে, এখানে বুনো লতার সঙ্গে কিছু লাউ, চালকুমড়োর গাছ-ও একেবারে পথের উপর এসে পড়েছে, টাটকা ফলন সমেত। কিছু আধখাওয়া, পাখি বা পান্ডায় খেয়েছে হয়ত। 

    শ্রীখোলা বা সিরিখোলা 

     
    এরপর বেশ কিছুটা রাস্তা ‘W’ এর মত, ওঠা আবার নামা। এই করে করে হঠাৎ এক জায়গায় এসে দেখি রাস্তা নেই। মানে যাকে বলে ‘literally’ নেই। দু-ইঞ্চি মত মাটি লেগে আছে পাশের দিকে, আর বাকি রাস্তাটা নীচে খাদে নেমে গেছে সোজা। এই নাকি নিত্যমের ‘শর্টকাট’! আমরা ভাবছি আবার কতটা ফেরৎ গেলে অন্য পথ পাবো, ওদিকে নিত্যম আর বাইচুং দেখি ওখান দিয়েই আমাদের পার করার মতলব করছে! মোটামুটি পাঁচ থেকে ছ’ফুট মত আমাদের পার হতে হবে, এ তো পুরো স্কুলের স্পোর্টস-এর লং জাম্প! একদিকে খাদ, আর একদিকে নব্বই ডিগ্রী খাড়া পাহাড়। যাই হোক, নিত্যম-এর উপদেশ-মত দু’জন করে হাত ধরাধরি করে এগোলাম, পেছনে রইল বিক্রম, সামনে নিত্যম, তারপর ওই আধ ইঞ্চি মাটিতে কি করে পা রেখে এগোলাম, ওপারে গেলাম, কিভাবে শরীরের ব্যালান্স রাখলাম - সে আর মনে করতে চাই না! এরপরের রাস্তা আর খুব বেশী ছিল না, পরপর কিছু ধাপ পার হতেই অবশেষে শর্টকাট শেষ হয়ে পথ মিলে গেল গাড়ির রাস্তায়। আর নীচে পাকদন্ডী শেষে দেখা গেল শ্রীখোলা ব্রিজ আর দু-তিনটে বাড়ির মাথা।
     


    শ্রীখোলা ব্রিজে আমাদের ট্রেকিং শেষ হল, ছবি তোলা ইত্যাদি হল, আমাদের গাইড-দেরও টাকা-পয়সা মিটিয়ে বিদায় জানানোর পালা, ওদেরও গাড়ি আসবে, ধোত্রে থেকে নিয়ে যাবে। হোটেল রেড পান্ডায় ঢুকতেই রিঙ্কুদা অভ্যর্থনা জানালেন, বৌদির সাথেও আলাপ হল। এনারা দুজনেই বাঙালী, এখানে প্রায় বারো বছরের ওপর আছেন হোটেলের ব্যবসা নিয়ে, শুধু ট্রেকার-রাই আসে এপথে, কারণ গাড়ির রাস্তা থাকলেও যারা গাড়ি নিয়ে যান তারা সাধারণতঃ শ্রীখোলায় থাকেন না। দেখলাম, আজ শুধু আমাদেরই বুকিং রয়েছে এখানে। চটপট ঘর দখল করে, অবশেষে আরামের স্নান!
     
    বিশ্বাস হচ্ছে না - শেষ করলাম তবে!! 


    এবার চারিদিকের জায়গাটা নিয়ে একটু বলা যাক। শ্রীখোলা প্রায় সাড়ে ছয় থেকে সাত হাজার ফুট উচ্চতায়। চারপাশে পাহাড়ের সারি, মাঝখানে গিরিখাতে বয়ে চলা শ্রী বা সিরি নদী। নদীখাতে ছোট-বড় পাথর আর বোল্ডারে ভর্তি, তার উপর দিয়ে ঝমঝমিয়ে ছুটে চলেছে জল, আশপাশে দু-চারটে বাড়ি আর দু-একটা হোটেল য়ার একটা ট্রেকার্স হাট ছাড়া কিছু নেই। খুবই নির্জন আর শান্ত পরিবেশ, আর যেখানেই থাকি এই নদীর বয়ে চলার আওয়াজ পুরো এলাকা জুড়ে, সারাদিন। গোটা এলাকাটা দুটো কুকুরের জিম্মায়, যার একজনের নাম টাইগার, যদিও দুজনের মধ্যে বিশেষ ভাব-সাব নেই, বিশেষতঃ বিস্কুটের ভাগাভাগি নিয়ে। আমাদের রেড পান্ডার ছাদে বেশ কিছুটা খোলা জায়গা, সেখান থেকে পুরো এলাকাটা দেখা যায়, নদী তো সামনেই, আর একটু পাশেই ট্রেকার্স হাট, যদিও আজ সেখানেও কেউ নেই।
     


    দুপুরে খাওয়া সারলাম একেবারেই বাঙালী খাবার দিয়ে, ভাত, ডাল, ফুলকপির তরকারি, পেঁয়াজী, ডিমের কারি আবার পনীর-ও, একেবারে এলাহী ব্যাপার। তবে স্কোয়াশের তরকারি নেই দেখে সবাই মোটামুটি খুশী হলাম, এই ট্রেকে এই প্রথম কোথাও লাঞ্চ বা ডিনারে স্কোয়াশ দেয়নি! বিকেলে অল্পস্বল্প পান-ভোজন হল, ট্রেকের সাফল্যের খুশীতে, রিঙ্কুদা-ই ব্যবস্থা করে দিলেন, উল্লাস! অতঃপর ছবি দেখা, আড্ডা, রুটি-চিকেন সহ ডিনার এবং ঘুম! তবে হ্যাঁ, এর মধ্যে একটু ভুতের প্রসঙ্গ ছিল। এই শ্রীখোলা ট্রেকার্স হাটের নাকি বেশ নাম আছে ভূতের ব্যাপারে। রিঙ্কুদা জানালেন, দুদিন আগে নাকি তিন-চারজন ট্রেকার ওখানে আশ্রয় নিয়েছিল এবং রাতে তাদের পাশের একটি বিছানায় ভূত বাবাজী (একজন বুড়ো মানুষ) আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন, ভোরে উঠে যাকে আর দেখাই যায় নি ঘরে, এদিকে ঘরের দরজাও ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। তো এইসব রোমাঞ্চকর মুহূর্ত, গল্প ইত্যাদি!

    পরের দিনের গল্প ছোটো, সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট করে গাড়িতে ব্যাগপত্র তুলে প্রথমে সোজা ঘুম মনাস্টেরি,‌ তারপর সোজা লেপচাজগৎ। এরপর মার্গারেট’স ডেক-এ (খাবারের খাদ্যগুণ ঠিক ঠাক, তবে দামের তুলনায় পরিমাপ খুব, খুবই কম, তবে এর পেছনের পাহাড়ের দৃশ্যাবলী স্বর্গীয়) লাঞ্চ সেরে নিউ জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং মেল এবং বাড়ি!
     
    লেপচাজগতের পরিচিত দৃশ্য 


    মার্গারেট'স ডেক থেকে যা দেখা গেল


    জীবনের প্রথম লম্বা ট্রেকিং, কি পেলাম? হাঁটতে তো ভালোই লাগে, নিয়মিত হাঁটি, যেখানে পারি সেখানেই হাঁটি। কিন্তু এই দিগন্তজোড়া পাহাড়-জঙ্গল-প্রকৃতির বুকে পথচলা! যেখানে নাগরিক কোলাহল নেই, গাছেরা, ফুলেরা, পাখিরা যেখানে ডাল, পাতা, পাপড়ি নেড়ে কথা বলতে চায় নিজেদের ভাষায়! অথবা গুরদুমের মিংমা পরিবার, প্রধানজী, নিত্যম-বিক্রম-বাইচুং যাদের ছাড়া এই ট্রেক সম্পূর্ণ হতোই না, জানতেই পারতাম না, যারা পাহাড়ে ওঠে, ওঠায়, তারা পিঙ্ক ফ্লয়েডেও মজে থাকে, গিটার নিয়ে অবসরে হয়ত কোনো পাবে আসর জমায়! বহুদিন আগে সুধীর চক্রবর্তীর ‘গভীর নির্জন পথে’ বা কালকূটের ‘কোথায় পাবো তারে’ পড়ার পর মনে হয়েছিল জীবনবোধ, মানুষকে দেখার দৃষ্টি বদলে গেল বুঝি! এই ট্রেকিং-টা মনে হল সেই অনুভূতির একটা প্র্যাকটিকাল ক্লাস, এখানে যদিও মানুষ আর প্রকৃতি দুই-ই আছে, বাকি কথা মনেই থাক; পথ চলার গল্প কি আর শেষ হয়, সে তো আজীবনের সঙ্গী! ফেরার সময় ট্রেনে জানলার বাইরে তাকিয়ে সেকথাই মনে হচ্ছিল -

    “শেষ নাহি যে
    শেষ কথা কে বলবে।…

    ফুরায় যা, তা
    ফুরায় শুধু চোখে--
    অন্ধকারের পেরিয়ে দুয়ার
    যায় চলে আলোকে।

    পুরাতনের হৃদয় টুটে
    আপনি নূতন উঠবে ফুটে,
    জীবনে ফুল ফোটা হলে
    মরণে ফল ফলবে।”
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ভ্রমণ | ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ৫৮১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৮:২১516520
  • বড্ড ভাল লিখেছিস। 
    শ্রীখোলায় নদীর পাশে নাকি নানারকম পাখি দেখা যায়। কিছু ছপবি তুলিস নি।
  • সুদীপ্ত | ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ২১:০৯516521
  • থ্যাংকু!  হ্যাঁ পাখি দেখেছি তো, গুরদুম থেকে শ্রীখোলা নামার রাস্তাতেই দেখেছি, শ্রীখোলায় যে পাশে আমাদের হোটেল ছিল, তার ঠিক বিপরীতে মানে নদীর ওপারে পাখিদের আড্ডা ছিল পুরো। মূলত: বুলবুলি, ময়না, বনটিয়া (এগুলো ঝাঁক বেঁধে ঘুরে বেড়ায়) আর কাঠঠোকরা; কালিপোখরির কাছে একটা ঈগল, আর কোথাও একটা মোনাল-ও দেখেছি রাস্তায়। কিন্তু হাঁটার সময় বড় ক্যামেরা বের করিনি আর, তাই তেমন ছবি নেই। তবে এটাও ঠিক, পাখির ডিটেইল নিয়ে আমার খুব উৎসাহ নেই, দেখা-শোনা-ভালো লাগা, ওই অবধি, অন্ততঃ এখনো
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে মতামত দিন