এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  রাজনীতি

  • হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্ব্বী!

    রঞ্জন রায়
    আলোচনা | রাজনীতি | ২৪ জুন ২০২২ | ১৮০৯ বার পঠিত | রেটিং ৪.৭ (৬ জন)
  • মূল ছবি - Sunilkumar Krishnamoorthy



    বুদ্ধজয়ন্তী
    এ’বছর বুদ্ধপূর্ণিমা ছিল মে মাসের ১৬ তারিখে। তিথিটি, অর্থাৎ বৈশাখী পূর্ণিমা, একই সঙ্গে তথাগত বুদ্ধের জন্ম, বোধিপ্রাপ্তি ও দেহত্যাগের জন্যে স্মরণীয়। এ’বছর ওই সময়ে সারা ভারত, বিশেষ করে উত্তর ভারত, ঝলসে যাচ্ছিল তাপপ্রবাহে। আড়াই হাজার বছরেরও বেশি আগে নেপাল ভারত সীমান্তের তরাই অঞ্চলে বোধহয় বৈশাখী পূর্ণিমায় এমনই গরম হাওয়া বইত, নইলে রাত্তিরে চাঁদ উঠলে সিদ্ধার্থের মা সন্তানের জন্ম দিতে প্রাসাদ ছেড়ে লুম্বিনী উদ্যানে গাছের ছায়ায় গিয়ে শরীর এলিয়ে দিয়েছিলেন কেন?

    আবার রবীন্দ্রনাথের ১৬১তম জন্মদিবস ছিল ৭ই মে (২৫শে বৈশাখ), মাত্র ৯ দিন আগে। তাই রবীন্দ্রজয়ন্তী এলেই আমি প্রস্তুত হই বুদ্ধজয়ন্তীর জন্যে, গুনগুন করি—‘ঐ মহামানব আসে’। আমি দু’জনকে আলাদা করে ভাবতেই পারিনে, বিশেষ করে বৈশাখ মাস এলে।
    কিন্তু এ’বছর? দাবদাহের সঙ্গে দেশ জুড়ে বইছে ঘৃণার উত্তপ্ত বাতাস। নতুন কথা নয়, কিন্তু এ’ মাসে যেন একটু বেশি। বুদ্ধজয়ন্তীর দু’দিনের মধ্যের একটি ঘটনা দেখুন:

    ভঁওরলাল জৈনের মৃত্যু:
    ১৮ মে-র রাত থেকে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে এক ভিডিও ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাতে দেখা যাচ্ছে – মধ্যপ্রদেশের নীমাচ জেলার মানসা গ্রামে পানের দোকানের কাছে একজন অচেনা লোককে ঘুরে বেড়াতে দেখে স্থানীয় বিজেপি নেতা দীনেশ কুশবাহা (স্থানীয় কাউন্সিলরের স্বামী)  তাঁকে মুসলমান সন্দেহে বারবার চড় থাপ্পড় মারতে মারতে নাম জিজ্ঞেস করছে—তোর নাম কি মহম্মদ? আধার কার্ড দেখা!

    প্রৌঢ় লোকটি এই আচমকা আক্রমণে ভ্যাবলা লেগে উত্তর দিতে পারছে না। দীনেশ মারছে, তার সঙ্গী মোবাইলে যবন ঠ্যাঙানোর ভিডিও তুলছে, ১৯ তারিখ রাত্তিরে সেটা দেখে ভঁওরলালের ভাই দীনেশ অবাক। কারণ তার সেইদিনই সকালে নীমাচ পুলিশ তার দলছুট এবং একটু অপ্রকৃতিস্থ দাদার মৃতদেহ ওদের সঁপে দিয়েছে এবং সৎকারও করা হয়েছে। পুলিশ বলেনি যে তাকে পেটানো হয়েছিল। ভিডিও দেখার পর পরিবারের চাপে থানা এফআইআর নেয় এবং পোস্ট মর্টেম রিপোর্টে দেখা যায় যে মৃত্যুর কারণ তাকে ক্রমাগত পেটানো। আর মৃতদেহটি পড়েছিল ঠ্যাঙানোর জায়গাটি থেকে অল্প দূরে। এবার পুলিশ বাধ্য হয় খুনের ধারা লাগিয়ে দীনেশকে গ্রেফতার করতে। আশ্চর্য, সেই ভিডিও দীনেশ নিজে পোস্ট করেছিল।

    সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিবাদের ঝড়। মূল সুরটি—হতভাগা! হিন্দু হয়ে একজন হিন্দুকে এভাবে মারলি?

    প্রশ্ন তুলেছেন হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের  পার্সিং স্কোয়ার অধ্যাপক বিক্রম প্যাটেল: যদি প্রৌঢ় ব্যক্তিটি সত্যিই মুসলমান হত? অথবা পেটানোওয়ালা যদি দীনেশ না হয়ে কোনো মহম্মদ হত? তাহলে কি নিহত মানুষটি এতটা সহানুভূতি পেত? বা খুনের দায়ে এফ আই আর?[1]

    নিহতের ভাই রাজেশ জৈন বলছেন—এভাবে কাউকেই পেটানো উচিত নয়, মুসলমান হলেও না। আমাদের দেশে মুসলমানের সংখ্যা প্রায় ২৫ কোটি; সবাইকে মারবে নাকি?[2]

    অধ্যাপক বিক্রম প্যাটেলের আশঙ্কা যে অমূলক নয়, তার ভিত্তি হিসেবে আরও গোটা দুয়েক ঘটনার কথা উল্লেখ করি। এই বছরই বুদ্ধজয়ন্তীর দিন ওই নীমাচ জেলা সদরে একটি দরগায় হনুমানের মূর্তি রেখে দেওয়ার ঘটনায় উত্তেজনা ছড়ায়। পুলিশ পরিবেশ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। কিন্তু রাত্তিরে দরগার কাছের মসজিদে আগুন লাগে, কিছু দোকান পোড়ে এবং পাথর ছোঁড়া হয়।

    ২০শে অগাস্ট, ২০২০। দু’বছর আগে হরিয়ানার পানিপতে কাজ খুঁজতে আসা ইখলাক সলমানি বলে একটি ২৮ বছরের ছেলের হাতে ৭৮৬ লেখা উল্কি থাকায় বোঝা গেছিল সে মুসলমান। তাকে নির্মমভাবে পেটানো হয়। রাস্তায় পড়ে ছিল। রাত এগারোটা নাগাদ উঠে কাছের একটি বাড়িতে দরজায় ধাক্কা দিলে বেরিয়ে এল তারাই যারা ওকে মেরেছিল। এবার ওরা ওর উল্কিওলা হাতটাই একটা কাঠকাটার চেইন করাত দিয়ে কেটে দিল এবং ওকে সামনের রেল লাইনে ফেলে দিল।

    ওর বাড়ির লোকজন থানায় এফ আই আর করলে পুলিশ সেই এফ আই আর নেয়, ৭ সেপ্টেম্বর তারিখে। সেদিনই অভিযুক্তরা একটি পাল্টা এফ আই আর করে। অভিযোগ ইখলাক নাকি ওদের ভাইপোর--একটি বাচ্চাছেলে--সঙ্গে পায়ুমেহন করেছে। পুলিশ পস্কো আইনের বিভিন্ন ধারায় কাটা-হাত ইখলাককে গৃহনগর ইউপি’র সাহারানপুর থেকে গ্রেফতার করে। প্রতিবাদ করায় ওদের দুই ভাইকে সাহারানপুরে জেলে পুরে রাখা হয়। কিন্তু হাতকাটার অভিযোগে কেউ গ্রেফতার হয় না।[3]

    গত ২০শে মে, ২০২২ তারিখে  পানিপতের ট্রায়াল কোর্ট ইখলাককে সোডোমি চার্জ থেকে খালাস করে দিয়েছে। কোনো প্রমাণ, মেডিক্যাল রিপোর্ট কিছুই ছিল না। কিন্তু হাত কেটে দেওয়ার অভিযুক্ত রণধীর সৈনিদের বাড়ির কেউ আজও গ্রেফতার হয়নি বা কোনো আদালতে কেস পেশ হয়নি।[4]

    গত ৫ই মে, ২০২২ তারিখে রায়পরের জেলা আদালত মীনা খালকো বলাৎকার ও হত্যার অভিযোগ থেকে ছত্তিশগড়ের বলরামপুরের দুই পুলিশ কর্মীকে অব্যাহতি দিয়েছে। বিগত ৬ জুলাই ২০১১তে গাঁয়ের ১৬ বছরের আদিবাসী মেয়ে মীনা খালকোকে পুলিশ এনকাউন্টারে গুলি করে হত্যা করে। অভিযোগ ও মাওবাদী ছিল। কিন্তু গাঁয়ের লোকেরা বলে – মিথ্যেকথা; ওকে রাত্তিরে ঘর থেকে তোলা হয়েছে, সবাইকে দরজা বন্ধ করে ঘরে থাকতে বলা হয়েছে এবং শেষ রাত্তিরে মাত্র দুটো গুলির শব্দ শোনা গেছে। পোস্ট মর্টেম রিপোর্টে ধর্ষণের চিহ্ন এবং অন্যান্য সাক্ষ্যতে প্রমাণিত যে এনকাউন্টার নয়, হয়েছে সামূহিক বলাৎকারের পর হত্যা। এ নিয়ে হৈচৈ দেশের বাইরেও হয়। জাস্টিস অনীতা ঝা’র প্রাথমিক তদন্তে এর যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেলে তিনজন পুলিশ কর্মী ধর্মদত্ত ধানিয়া, জীবনলাল রত্নাকর এবং থানা প্রভারী নিকোদিমের (বর্তমানে প্রয়াত) বিরুদ্ধে হত্যার মামলা রুজু হয়। কিন্তু পুলিশ দুর্বল সাক্ষ্য পেশ করায় আদালত ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।[5]

    তাহলে মীনা খালকোকে কে বা কারা মারল?
    প্রশ্ন হল গৌতম বুদ্ধের উপদেশনা ও ধর্মপ্রচারের যে ব্যাপক ক্ষেত্র—বর্তমান উত্তর ও মধ্যভারত – তাতে এমন অর্থহীন উন্মাদ হিংসার কারণ কী? কোনো সুস্থ মানুষ একটা লোকের  হাত কাঠকলের বৈদ্যুতিক করাত দিয়ে এ ভাবে কেটে ফেলতে পারে? অন্য সম্প্রদায়ের সদস্য হওয়ার সন্দেহে—সত্যি বা মিথ্যে—কোনো আধবুড়ো লোককে মেরে ফেলতে পারে এবং তাকে মারার পৈশাচিক আনন্দে তার ভিডিও আপলোড করতে পারে?

    আর তথাকথিত ধর্মসংসদ থেকে ডাক দেওয়া হচ্ছে হাতিয়ার ধরতে এবং মুসলমানদের মেরে ফেলতে? ধর্মযুদ্ধ? আমরা ইসলামি জিহাদের নিন্দে করতে করতে নিজের অজান্তে তাদের মত হয়ে যাচ্ছি না তো? এই অবক্ষয়ের হাত থেকে আমাদের কে বাঁচাবে?
    বুদ্ধের অহিংসা এবং মৈত্রী-মুদিতা-করুণার বাণী আর আমাদের কোনোভাবে উদ্দীপিত করে না?

    মানছি, আজকের ভারতে বৌদ্ধধর্মের অনুযায়ীরা কোটিকে গুটিক। তাঁরা আছেন পশ্চিম ও উত্তর ভারতে দলিত সমাজে আম্বেদকারের অনুগামীদের মধ্যে। বঙ্গে ও ত্রিপুরায় বড়ুয়াদের থেরবাদী সম্রদায়ের মধ্যে। তাঁদের কন্ঠস্বর এত ক্ষীণ, যে প্রশাসন-আদালত বিশেষ পাত্তা দেয় না। তাই বাবরি মসজিদ মামলায় যে ধ্বংসাবশেষ ও পরবর্তী খননে কিছু বৌদ্ধ স্তুপের নিদর্শনও উঠে এসেছে – এই কথা সর্বোচ্চ আদালতে বলা সত্ত্বেও সেটা এভিডেন্সের সম্মান বা গুরুত্ব পায়নি। যদিও কানিংহ্যামের সময়ে ভারতের আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার জার্নালের প্রথম সংখ্যাতেই (১৮৬২-৬৩) সাকেত বা অযোধ্যার বিশাল এলাকায় বৌদ্ধস্তুপের নিদর্শনের উল্লেখ ছিল। এবং ২০১৮ সালের জুলাই ২৩ তারিখে একজন বৌদ্ধ – বিনীত কুমার মৌর্য্যের আবেদন বিবেচনার জন্যে সুপ্রীম কোর্ট গ্রহণও করেছিল।[6]

    কিন্তু ভারতে তো এমন হওয়ার কথা ছিল না। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ইদানীং নেপাল ও জাপানে গিয়ে  বিশ্বশান্তি ও মৈত্রীর প্রয়াসে ভারতের বৌদ্ধধর্মের বাণী এবং উপনিষদের ‘সর্বে সুখিনা ভবন্তু, সর্বে সন্তু নিরাময়া’[7] ইত্যাদি বলে এসেছেন।

    তাহলে? একটা কারণ কি ধর্মযুদ্ধের ডাক? ক্রিশ্চিয়ানদের রয়েছে ক্রুসেডের ঐতিহ্য, ইসলামে আছে জিহাদের ঘোষণা এবং গীতায় আমাদের প্রবোধ দেওয়া হয়েছে:

    ‘তস্মাত্ত্বমুত্তিষ্ঠ যশো লভস্ব, জিত্বা শত্রুনভুংক্ষ্ব রাজ্যম সমৃদ্ধম্‌
    ময়ৈবৈতে নিহতা পূর্বমেব, নিমিত্তমাত্রং ভব সব্যসাচীং’।[8]

    – ধর্মযুদ্ধে হত্যার দায়িত্ব তোমার নয়, তুমি নিমিত্তমাত্র। ভগবান আগেই সবাইকে মেরে রেখেছেন! তুমি বরং উদ্দীপ্ত হয়ে শত্রু মেরে রাজ্য যশ ও সম্পদ লাভ কর।

    কিন্তু বৌদ্ধধর্মে তো এমন শত্রুবধ, ক্ষাত্রধর্ম, মার-মার কাট-কাট নেই। বরং গোড়া থেকেই রয়েছে অহিংসার কথা। রয়েছে সদ্ধর্ম বা আটটি সদাচরণের বা বিরত থাকার উপদেশ:


    • অহিংসা
    • চুরি না করা
    • যৌনতা
    • মিথ্যাবাক্য
    • মাদক
    • নৈশ আহার
    • হুল্লোড় এবং দৈহিক সৌন্দর্য্যের উন্মাদনা
    • বিলাসদ্রব্য


    ঠিক আছে, যে দেশগুলোতে বৌদ্ধধর্ম প্রায় রাষ্ট্রধর্মের পর্যায়বাচী – তেমনই বৌদ্ধবহুল দুই প্রতিবেশী দেশের দিকে উঁকি মেরে দেখা যাক।

    শ্রীলঙ্কা এবং ময়ানমার—এই দুটো দেশেই থেরাবাদী বৌদ্ধমত অর্থাৎ প্রাচীন হীনযানের প্রধান শাখাটি জীবিত এবং সক্রিয় রয়েছে। সত্যনারায়ণ গোয়েঙ্কার বিপাসনা ধ্যানও ময়ানমারের বৌদ্ধসাধন পদ্ধতি থেকে নেওয়া। অবশ্য থাইল্যান্ড, কাম্বোডিয়া, লাওস এবং ভিয়েতনামেও থেরাবাদী বৌদ্ধ মতের প্রভাব। বিশ্বের বাকি বৌদ্ধপ্রধান অঞ্চলে, যেমন চীন-জাপান-তিব্বত-ভুটান-মঙ্গোলিয়া-মালয়-সিংগাপুরে মহাযান শাখার প্রভাব।
    আমরা গত শতাব্দীর ৬০ ও ৭০ এর দশকে দেখেছি মার্কিন অত্যাচারের প্রতিবাদে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের পথে নামতে, এমনকি আত্মাহুতি দিতে। এমনকি এই শতাব্দীর গোড়ায় ময়ানমারে দেখেছি সামরিক জুন্টার চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার এবং বন্দি জননেত্রী সূ-চি’র মুক্তির দাবিতে জনতার আন্দোলনে ভিক্ষুদের শরিক হতে।

    মনে হয়েছিল এটাই স্বাভাবিক। গৌতম বুদ্ধ যে মগধ এবং কোশলের উঠতি সাম্রাজ্যের বিপরীতে লিচ্ছবি ও বজ্জী গণতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। বৌদ্ধ সঙ্ঘে পরিচালনার নিয়মে সদস্যদের মতামত এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন।
    কিন্তু আজ? ময়ানমারে গত এক দশক ধরে গুলি করে জন আন্দোলনকে দমনের প্রচেষ্টা এবং পৈশাচিক ভাবে রোহিঙ্গিয়া নিধন ও বিতাড়ন বিবমিষা জাগায়। একইভাবে চলেছে শ্রীলঙ্কায় তামিলদের স্বাতন্ত্র্য ও আত্মসম্মানের প্রশ্নে জনপদকে বুটের তলায় নারীপুরুষ নির্বিশেষে গুঁড়িয়ে দেওয়া এবং গত মাস থেকে এক পরিবারের অপশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ রুখতে দাঙ্গায় উস্কানি ও লাঠিগুলি দিয়ে মোকাবিলা।

    তাহলে তথাগতের শিক্ষা ও নীতি কি কেবল প্যাগোডা, বিহার ও স্তুপের দেওয়ালে মধ্যেই আটকে থাকবে? চার আর্যসত্য, আটটি সদাচরণের উপদেশ কি কেবল কথার কথা?

    দেশ দেশ পরিল তিলক রক্ত-কলুষ-গ্লানি
    শ্রীলঙ্কা; সমুদ্রে ঘেরা ছোট দেশ, জনসংখ্যা আজ ২.১৬ কোটি।[9] তাতে ধার্মিক অনুযায়ীদের অনুপাতটি দেখুন:
    বৌদ্ধ (৭০.২%), হিন্দু (১২.৬%), মুসলিম (৯.৭%), খ্রিস্টান (৬.১%), অন্যান্য (১.৪)। কিন্তু ওই ৭০% বহুসংখ্যক বৌদ্ধ নাকি ১২ বা ১৩% হিন্দুদের (মূলতঃ তামিল) ভয়ে আতংকিত। কিসের ভয়? না, ওই ১৩% তামিল হিন্দু ধীরে ধীরে শ্রীলঙ্কার ক্ষমতা হাতিয়ে নেবে। ওখানকার বৌদ্ধ সংস্কৃতি নষ্ট হবে। মূল জনগোষ্ঠীর পরিচয় বিকৃত হয়ে যাবে।

    অবাক হবার কিছু নেই। আমরা আমাদের দেশেও ৮০ বনাম ২০ জনসংখ্যার দ্বন্দ্ব চলছে না? এবং জনসংখ্যার প্রতিশত একটু বাড়লেই মুসলমানরা শরিয়তের শাসনাধীন আলাদা জেলা  এবং আলাদা প্রদেশ চাইবে—এমন প্রচার বিভিন্ন ফোরামে সোশ্যাল মিডিয়ায় শুনছি না?
    এর ফলে শুরু হল সংসদে স্থানীয় প্রশাসনে তামিল হিন্দুদের সরকারী ও সামাজিকভাবে কোণঠাসা করার চেষ্টা, যাতে সায় ছিল বৌদ্ধ ভিক্ষুদের। দেশের উত্তর ও উত্তর পূর্বে জাফনা জেলায় তামিল হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। কোণঠাসা হতে হতে ওরা চাইল সীমিত স্বায়ত্তশাসন, বিগত শতাব্দীর সত্তরের দশকে গড়ে উঠল বিভিন্ন সংগঠন। কিন্তু নাগরিকদের বৃহত্তম অংশ, বৌদ্ধদের দিক থেকে বর্ষিত ঘৃণা ও তাতে সরকারের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সমর্থনের চাপে আন্দোলনের নেতৃত্ব চলে গেল লিবারেশন টাইগার ফর তামিল ইলমের (লিট্টে) হাতে। 

    ১৯৮৩ থেকে স্বতন্ত্র তামিল রাজ্যের (ইলম) দাবিতে লিট্টের জাফনা এলাকায় গেরিলা যুদ্ধ এবং বাকি প্রদেশে গৃহযুদ্ধে জনজীবন বিপর্যস্ত। ভারত সরকার একবার শ্রীলঙ্কার সরকারের সমর্থনে শান্তিরক্ষক সৈন্য (আইপিকেএফ) পাঠাল। এর ফলশ্রুতিতে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী লিট্টের সুইসাইড স্কোয়াডের হামলায় (২১শে মে, ১৯৯১) শ্রীপেরাম্বাদুরে নিহত হলেন। একইভাবে মে, ১৯৯৩তে নিহত হলেন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট রনসিংগে প্রেমদাস। ১৯৯৬ সালে কলম্বোয় ওদেশের সেন্ট্রাল ব্যাংকে আর একটি সুইসাইড বম্বার হামলায় ১০০ জন নিহত হল; বেশিরভাগই অসামরিক লোকজন। আবার জুলাই ২০০১ সালে কলম্বোর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আরেকটি অনুরূপ হামলায় দেশের অর্ধেকেরও বেশি বাণিজ্যিক বিমান নষ্ট হল।

    যদিও ২০০২ সালে লিট্টে এবং সরকারের মধ্যে একটি সিজফায়ার চুক্তি স্বাক্ষরিত হল, কিন্তু কেউই সেটা আন্তরিকভাবে মেনে চলছিল না। শেষে ২০০৬ সালে প্রধানমন্ত্রী মহেন্দ্র রাজাপক্ষের ভাই গোটাবায়া রাজাপক্ষ ডিফেন্স মিনিস্টার হয়ে নির্মমভাবে তামিলদের দমন করলেন। জাফনায় ও অন্যান্য দ্বীপে সেনাবাহিনী অসামরিক জনতাকেও নৃশংসভাবে হত্যা করল। আন্দোলনের কার্যত সমাপ্তি ঘটল ১৮ই মে, ২০০৯ সালে, লিট্টের সর্বেসর্বা প্রভাকরণ ও অন্যদের মৃত্যুতে। বিশ্বজুড়ে অসামরিক নাগরিকদের হত্যার ছবি ও দলিল দেখে মানবাধিকার লংঘনের তদন্তের দাবি উঠল। রাষ্ট্রসংঘের অনুমান অনুযায়ী কয়েক দশকের ওই সংঘর্ষের ফলে অন্তত ৭০,০০০ থেকে ৮০,০০০ প্রাণ বিনষ্ট হয়েছে। উদ্বাস্তু হয়েছেন কয়েক লক্ষ নাগরিক।

    তারপর সিংহলী বৌদ্ধ নাগরিকের প্রবল সমর্থনের ভিত্তিতে আজ রাজাপক্ষ পরিবারের পাঁচভাই রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিত্তমন্ত্রী, প্রতিরক্ষা আদি দেশের সবকটি গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত। কিন্তু আর্থিক দুরবস্থা এমন পর্যায়ে গেছে – যা প্রায় দুর্ভিক্ষগ্রস্ত কিছু আফ্রিকান দেশের কথা মনে করায়।
    আবার জনতা পথে নেমেছে খাদ্য, জ্বালানি, বিজলি এবং বিভিন্ন পরিষেবার সুষম পরিচালনার  দাবিতে। কিন্তু বৌদ্ধধর্মে আস্থাবান সরকার লেলিয়ে দিল সশস্ত্র সমর্থক এবং সুরক্ষা বাহিনীকে। প্রাণ হারালেন কিছু মানুষ, উন্মত্ত জনতা আগুন ধরিয়ে দিল প্রধানমন্ত্রীর পারিবারিক আবাসনে। এর শেষ কোথায়?

    অথচ গত শতাব্দীর গোড়ায় ভারত থেকে রাহুল সাংকৃত্যায়ন সিংহলের মহাবিহারে গেছিলেন থেরাবাদী বৌদ্ধদর্শনের পাঠ নিতে।

    আমার কথা বলি। পাঁচবছর আগে থেরবাদী দর্শনের পাঠ নেব বলে খুঁজতে খুঁজতে পূর্ব কোলকাতার বেলেঘাটার রেললাইনের ফ্লাইওভার পেরিয়ে হাজির হলাম একটি বৌদ্ধবিহারে। শ্রমণের সঙ্গে পরিচয় হয়ে ভাল লাগল। উনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পালি ভাষায় ডক্টরেট করেছেন; আমাকে অনেক বই দিলেন – যার মূল গ্রন্থ সিংহল থেকে আনিয়ে বাংলায় অনুদিত। চমৎকার লাগল। উনি রোজ আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে ধম্মপদের থেকে দু’টি শ্লোক ও তার ইংরেজি অনুবাদ পাঠাতে লাগলেন। আমি আপ্লুত। তখন সবে রোহিঙ্গিয়াদের হত্যাকাণ্ডের খবর বাইরে আসতে শুরু করেছে।

    হঠাৎ ওঁর ভাষা ও বক্তব্য পাল্টে গেল।

    ধম্মপদের সঙ্গে আসতে লাগল রিফিউজি রোহিঙ্গিয়াদের উদ্দেশে বিষবমন। উনি যা বলছিলেন তার সার হচ্ছে – মূলত ত্রিপুরার নিবাসী হওয়ার ফলে উনি প্রতিবেশি আরাকান বা রাখাইন  অঞ্চলের মুসলমান রোহিঙ্গিয়াদের ভাল করেই চেনেন। ওরা আগে বাংলাদেশ প্রান্তে বৌদ্ধদের উপর অবর্ণনীয় অত্যাচার করেছে। কাজেই আজ যা হচ্ছে তা হল ওদের পাপের ফল। ওদের আশ্রয় দেওয়া বা কোনো সহায়তা করা ভুল হবে। প্রেস বাড়িয়ে বলছে।

    আমি লিখলাম—এসব কী বলছেন? তথাগতের শিক্ষায় প্রতিহিংসার স্থান কোথায়? উনি তো নরঘাতক দস্যু অঙ্গুলিমালকেও আশ্রয় দিয়েছিলেন।

    আমাদের সম্পর্ক শেষ হয়ে গেল।

    ব্রহ্মদেশ বা হালের ময়ানমার:
    দেশটির জনসংখ্যা ৫.৫২ কোটি।[10] ধার্মিক অনুগামীদের হিসেবে জনসংখ্যার প্রতিশত হল:
    বৌদ্ধ (৮৭.৮%), খ্রিস্টান (৬.৩%), মুসলমান (৪.৩%), হিন্দু ও অন্য (১.৬%)।
    এখানেও কি ৯০% বৌদ্ধরা ভয় পাচ্ছেন ৪.৩% মুসলমানদের? ওরা দখল করে নেবে জমিজিরেত, খেদিয়ে দেবে আদি অধিবাসী বার্মিজ বৌদ্ধদের?

    মনে হয় না, তাহলে?
    এখানে মনে হয় গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অভাবটাই বড় কথা, প্রতিষ্ঠানগুলো নড়বড়ে। ব্রহ্মদেশের অবস্থা একটু অন্যরকম। এখানে ১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে দেশ ইংরেজদের থেকে স্বাধীন হল বার্মিজ ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মির নেতৃত্বে। মার্ক্সিস্ট ভাবাপন্ন প্রধানমন্ত্রী আউং সান ছ’মাসের মধ্যেই আততায়ীর হাতে নিহত হলেন। প্রধানমন্ত্রী উ নু (নিষ্ঠাবান বৌদ্ধ, বোধগয়া দর্শনে আসতেন) নামেমাত্র সরকার চালিয়েছেন চারটে বছর। যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই ছিল; উত্তরে কাচিন ও কারেন জনজাতি এবং ভারত সীমান্তে শান প্রদেশে অল্পকিছু বার্মিজ নাগাগোষ্ঠী নতুন সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিল। এছাড়া ছিল কম্যুনিস্টদের হোয়াইট ফ্ল্যাগ আর্মি, যার নেতৃত্বে ছিলেন থাকিন বা থান-টুং এবং দুই বাঙালী – ডঃ অমর নাগ এবং থাকিন ঘোষাল।
    ১৯৬২ থেকে জেনারেল নে উইনের ক্যু দেতার পর পুরোপুরি সামরিক শাসন চলল ১৯৮৮ অব্দি, তারপর নির্বাচনের কথা ঘোষণা করেও হল গিয়ে সেই ২০১০ সালে। জেনারেল নে উইনের দলের নাম ছিল বার্মা সোশ্যালিস্ট প্রোগ্রাম পার্টি। তবে ১৯৬১ সালের সংবিধানে বৌদ্ধধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম করা হল।

    এটা বলা দরকার যে নে উইনের সামরিক জুন্টা খ্রিস্টান ও মুসলমানদের ধর্মপ্রচারে খোলাখুলি বাধা দিত এবং শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে প্রান্তিক করে রাখত। মসজিদ ও চার্চ ভেঙে বৌদ্ধ স্তুপ বা প্যাগোডা নির্মাণ কোনো ব্যতিক্রম নয়। সেখানে আবার খ্রিস্টান ও মুসলিমদেরই বেগারি শ্রম দিতে হত।

    ২০১১ থেকে  রাষ্ট্রপিতা আউং সানের মেয়ে অহিংস গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাসী সূ-চী’র গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় এল। সূ-চী নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯৯১ সালে। তবে ওদের সংবিধানে নিয়ম রয়েছে যে মোট ৪৪০ সিটের মধ্যে ৩৩০টি সিটে নির্বাচন হবে। বাকি ২৫%, অর্থাৎ ১১০ সিটে মিলিটারির মনোনীত লোক বসবে। অল্পদিনের মধ্যেই সামরিক জুন্টা দাঁত-নখ বের করল। শুরু হল রোহিঙ্গিয়া বিতাড়ন ও হত্যা দিয়ে।
    রোহিঙ্গিয়া মুসলিমদের উপর সামরিক জুন্টার এবং এথনিক বৌদ্ধদের অত্যাচার ১৯৭০ থেকেই লিপিবদ্ধ রয়েছে। তখন থেকেই ওদের দেশ ছেড়ে বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া ইত্যাদি দেশে উদ্বাস্তু হয়ে পালিয়ে যাওয়া শুরু।

    রোহিঙ্গিয়া কারা?
    রোহিঙ্গিয়ারা হল বর্মার উত্তর পূর্বে বাংলাদেশের চট্টগ্রামের কাছে প্রাচীন আরাকান, বর্তমান রাখাইন রাজ্যের কয়েক পুরুষ থেকে বাস করা মুসলিম। এদের ভাষা খানিকটা আমাদের চাটগাঁ’র বাঙাল ভাষার সঙ্গে মেলে। সামরিক সরকার ১৯৮২ সালে একটি আইন পাশ করে রোহিঙ্গিয়া গোষ্ঠীকে জাতীয়তা এবং নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করে দেয়। ওদের এক প্রদেশ থেকে অন্য প্রদেশে যাতায়াত করতে লিখিত অনুমতি নিতে হয়, কলেজে ভর্তি হওয়া মুশকিল। এইভাবে ওরা ক্রমাগত রাষ্ট্রীয় এবং বৌদ্ধ গরিষ্ঠ সমাজের ঘৃণা ও হিংসার শিকার হতে থাকে।

    সন ২০১৭তে আগস্ট মাসে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় ময়ানমারের বর্ডার পোস্টে আরাকান রোহিঙ্গিয়া স্যালভেশন আর্মি আক্রমণ করে। তার বদলা নিতে শুরু হয় রোহিঙ্গিয়া জনগোষ্ঠীর উপর সামরিক বাহিনীর এথনিক ক্লিন্সিং অভিযান। আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী রেপ, হত্যা, লুঠ, আগুনে ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া কিছুই বাদ যায়নি। রিপোর্ট অনুযায়ী প্রায় সাত লক্ষ রোহিঙ্গিয়া পালিয়ে বাংলাদেশের দিকে আশ্রয় নেয়।

    রাষ্ট্রসংঘে সু-চী জুন্টার পক্ষে বক্তব্য রাখায় নিন্দার ঝড় উঠল। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। ২০২১শে আবার নির্বাচনে বিপুলভাবে জয়ী হবার পরের দিন সামরিক বাহিনী এক অভ্যুত্থানে ক্ষমতা দখল করে এবং সূ-চীকে ফের গৃহবন্দী করে। তারপর থেকে বৌদ্ধ সামরিক সরকারের একতরফা হিংসার প্রতিবাদে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে যুব ও ছাত্ররা পথে নামছে, সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে, প্রাণ দিচ্ছে; কিন্তু যে ধর্মীয় ঘৃণার বীজ বপন করে এতদিন ধরে জল সিঞ্চন ও সার দেওয়া হয়েছে তার কোন সমাধান দেখা যাচ্ছে কি? সন্দেহ রয়েছে।

    আবার আমার কথা। কয়েক বছর আগে দিল্লিতে এক বন্ধুর বাড়িতে কথা হচ্ছিল আমেরিকান প্রেসের দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ডিজিটাল নেটওয়ার্কের ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক মহিলার সঙ্গে।
    বলছিলেন এক আঁখো দেখা হাল – একটি সীমান্তে নদীর পাড়ের গাঁয়ে রাত্তিরে সামরিক বাহিনীর হামলার পর হাঁটুজল ভেঙে বোঁচকাবুঁচকি এবং শিশুদের কাঁখে নিয়ে প্রাণ হাতে পালিয়ে আসা এক রোহিঙ্গিয়া দম্পতির কথা। হঠাৎ মেয়েটির মনে হল এখন তো সকাল। কাল ঈদ, যাই পনের মিনিটে নদী পেরিয়ে ঘরে রাখা সেমাইয়ের পায়েস আর ফিরনি নিয়ে আসি।
    মহিলাটি বারণ করলেন—খবর্দার যেও না। সেমাইয়ের ব্যবস্থা এখানেই হবে।

    – না, না। এখন সুজ্জি উঠেছে, ওরা চলে গেছে। আমি যাব আর আসব, কিছু হবে না।
    মেয়েটি স্বামীর কোলে বাচ্চাকে দিয়ে চলে গেল, আর ফিরল না। ওঁরা এ’পার থেকেই দেখতে পেলেন চালাঘরটি দাউ দাউ করে জ্বলছে।
    বর্ণনা দিতে গিয়ে উনি কান্নায় ভেঙে পড়লেন, বললেন এসব দেখানো যায় না, প্রেস আইনে সীমা বেঁধে দেওয়া আছে।

    শেষ কথা যাও বলে!
    কেউ বলে না আমরা আক্রমণ করছি, বেশ করছি। সবাই বলে আমরাই আক্রান্ত, বাধ্য হয়ে সবার ভালোর জন্যে করছি। বাকি যা হচ্ছে তা হল কোল্যাটারাল ড্যামেজ। সমস্ত আক্রমণকারীরই আছে এক আমরা-ওরা প্যারাডাইমের নির্মাণ। কোনো না কোনো শত্রু থাকতেই হবে।

    • যীশুর ক্ষমার ধর্মে আস্থাবান রাশিয়া উক্রেইন আক্রমণ করেনি; নাজি চক্রান্ত ও ন্যাটোর সম্ভাবিত আক্রমণ ঠেকাতে সৈন্য পাঠিয়ে একের পর এক নগর জনপদ গুঁড়িয়ে দিচ্ছে।
    • ময়ানমারের বুদ্ধিস্ট সামরিক সরকারও দেশের সুরক্ষার তাগিদে রাখাইনের বোম্বেটেদের একটু টাইট করছে।
    • শ্রীলংকার গোটাবায়া স্পষ্ট করেই বলেছিলেন—আন্তর্জাতিক স্তরে টেররিস্ট বলে ব্ল্যাক লিস্টেড লিট্টের মত সংগঠনকে শায়েস্তা করতে যা করা উচিত তাই করেছি। আমাদের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কোন বাইরের মানবাধিকার সংস্থার নাক গলানোর অধিকার নেই।
    •  আমরা বিশ্বাস করি না যে  ইসলাম ছাড়া কোন অন্য ধর্মের দেশে ধার্মিক কারণে অত্যাচার হয়।  তাই আমাদের সিটিজেন্স অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট, ২০১৪তে আমরা শ্রীলঙ্কা থেকে ধার্মিক বা এথনিক অত্যাচারে পালিয়ে আসা হিন্দু তামিল অথবা ময়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গিয়াদের জন্য কোন জায়গা ছাড়িনি। ওই আইনে শুধু মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতিবেশি দেশগুলো—পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ—থেকে পালিয়ে আসা হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন,ক্রিশ্চান ও পার্সীদের নাগরিকত্ব দেয়ার ব্যবস্থা করেছি।
    • এখন কণিকার গলায় শুনছি—বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি।





    [1]  ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ৩১শে মে, ২০২২।
    [2]  দি  কুইন্ট, ২৭শে মে, ২০২২।
    [3]  নিউজ লন্ড্রি, ১২ই সেপ্টেম্বর, ২০২০।
    [4]  দ্য ওয়্যার , ২৭ মে, ২০২২।
    [5] হিন্দি পোর্টালঃ নিউজ ১৮, ১৮ই মে, ২০২২।
    [6] ইকনমিক টাইমস, ২৮শে জুলাই, ২০১৮।
    [7]  বৃহদারণ্যক উপনিষদ, ১.৪.১৪।
    [8]  শ্রীমদ্‌ভগবদগীতা, ১১.৩৩।
    [9] বিশ্ব ব্যাংকের অগাস্ট, ২০১৯শের অনুমোদিত ডেটা থেকে অনুমানিত।
    [10] বিশ্ব ব্যাংকের অগাস্ট, ২০১৯শের অনুমোদিত ডেটা থেকে অনুমানিত।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ২৪ জুন ২০২২ | ১৮০৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • হীরেন সিংহরায় | ২৪ জুন ২০২২ ১১:২২509327
  • বাক রুদ্ধ হয়ে যায় । ধন্যবাদের ভাষা নেই। 
     
    আধমরাদের ঘা মেরে বাঁচান ।
  • Santosh Banerjee | 2401:4900:314e:bc0:0:66:becd:d601 | ২৪ জুন ২০২২ ১২:২৭509329
  • অশেষ ধন্যবাদ। স্যার, ফ্যাসিজমের চেহারা টা বুঝতে গেলে এই ইতিহাস টাকেও যে বুঝতে হবে , সেটা আপনি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন! ইতিহাস টা বুঝলে আমাদের দেশের নব্য হিটলার দের চিনতে অসুবিধে হয় না। কিন্তু, পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় ? সেটাও তো ইতিহাস বলে দিয়েছে বার বার। সেটাই আশার কথা। ইতিহাস ঘুরে আসে।আর , ইতিহাস মিথ্যে বলে না, ক্ষমাও করে না।
  • Sobuj Chatterjee | ২৪ জুন ২০২২ ১৪:১৩509340
  • ঝদ্ধ হলাম; সমৃদ্ধ হলাম! 
  • Swapan Sengupta | ২৪ জুন ২০২২ ১৪:৩৭509341
  • ভাবতেই পারছি না !  আমরা ভাবছি, অন্তত এই বাংলায়
    তবু কিছুটা হলেও প্রতিবাদী স্বর আছে, আমরা ঠিক আছি ! কিন্তু হায়, এ যে পৃথিবী জোড়া ফাঁদ !
    আর রঞ্জনকে নতুন করে কিছু বলার নেই !
    একটা ইনস্টিটিউশন !!!!
  • Kishore Ghosal | ২৪ জুন ২০২২ ২০:০২509344
  • অবক্ষয় বিশ্বজুড়ে। 
     
    অবান্তর ঘৃণা আর বিদ্বেষের প্রচার করে সাধারণ মানুষকে উস্কে না রাখলে, ওরা যে কাজ চাইবে, দুর্নীতির কৈফিয়ৎ চাইবে, সস্তায় সু চিকিৎসা চাইবে, সস্তায় সুশিক্ষা চাইবে...   প্রকট হবে ইচ্ছে করে জমিয়ে রাখা যত সমস্যা,  ওদের মনে পড়ে যাবে ক্ষমতায় আসার আগে দেওয়া যত প্রতিশ্রুতির কথা  .. তখন?  বলি, অনেক কষ্টে চেয়ারটা হাতানো গেছে, সেটাকে সামলাতে হবে না? 
     
    অতএব মানুষের হতাশা আর ক্ষোভকে ভিড়িয়ে রাখো দাঙ্গায়। 
     
    ভীষণ তথ্য সমৃদ্ধ প্রাসঙ্গিক প্রবন্ধ। সমৃদ্ধ হলাম। 
  • kk | 2601:448:c400:9fe0:a93b:519a:4dcf:6d1a | ২৬ জুন ২০২২ ২১:২৫509434
  • রঞ্জনদার এই লেখাটা পড়ে আমার কী মনে হয়েছে তা জানাবো ভেবেছি কয়েকদিন ধরে। কিন্তু পারছিলামনা। আমার একটা কন্ডিশন আছে, আমি অনেক সময়েই কী অনুভব করছি সেটা প্রকাশ করার মত শব্দ খুঁজে পাইনা। খুবই অসুবিধা হয় তখন। আবার আশ্চর্য ভাবে কিছু সময় অনুভূতি প্রকাশ করতে পারি শুধু স্বাদ দিয়ে। বা খাবারেরই ছবি দিয়ে। এটা খুব প্রবলেম্যাটিক একটা ব্যপার কারণ আর কাউকে এটা বোঝাতে পারিনা। এই লেখাটা পড়ে যা মনে হয়েছে তা আমার প্রকাশ-সাধ্য মতো জানিয়ে গেলাম। অপারগতার জন্য জটিলতা সৃষ্টির ​​​​​​​জন্য ​​​​​​​দুঃখিত। ​​​​​​​
     
  • Ranjan Roy | ২৬ জুন ২০২২ ২২:৩৯509435
  • K K
    আপনার এই  কাটা tomato দিয়ে প্রকাশ আমার চোখে এক সুন্দর installation।  এটা  নিয়ে ভাবছি। 
  • অমিতাভ চক্রবর্ত্তী | ২৭ জুন ২০২২ ০৪:২৯509437
  • সমস্ত হিংসা-হিংস্রতার দায় অন্য কা্রও, আমার নয় - এই হচ্ছে চূড়ান্ত। 
    রঞ্জনদার এ লেখাও এক দলিল।
  • Irfanur Rahman Rafin | ২৯ জুন ২০২২ ০১:৪৮509485
  • জমিয়ে রাখলাম, এই লেখা বারবার পড়তে হবে।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে মতামত দিন