এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  উপন্যাস  শনিবারবেলা

  • নকশিকাঁথা (৮)

    বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ১০০১ বার পঠিত
  • নকশিকাঁথা – উপন্যাসের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং বাঙালি অভিবাসী জীবনের না জানা সময়

    ১৮৯০ এর দশক। তখন আমেরিকা এক সন্ধিক্ষণে। কালো মানুষেরা সদ্যই স্বাধীন। কিন্তু আমেরিকার দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে বিভিন্নভাবে তাদেরকে আবার অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। অন্যদিকে শিল্প বিপ্লবের শেষ পর্যায়ে এসে মধ্যবিত্ত সাদা মানুষের আমেরিকা নিজেদের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য পেরিয়ে ধর্ম এবং সংস্কৃতির খোঁজ শুরু করেছে। বিবেকানন্দের আমেরিকা বিজয়, হিন্দু ধর্মের জন্য আমেরিকার কৌতূহল এবং পৃষ্ঠপোষকতার খবর আমাদের জানা আছে। কিন্তু এই আগ্রহ শুধু ধর্মের ক্ষেত্রে নয়। পণ্য এবং বিনোদনের জগতেও ছিল। তারই হাত ধরে এমনকি বিবেকানন্দ আসার আগেও আমেরিকায় এসে গেছিল চুঁচুড়া, তারকেশ্বর, চন্দনপুর, বাবনানের কিছু লোক তাদের চিকনের কাজের পসরা নিয়ে। হাজির হয়েছিল উত্তর আমেরিকার সমুদ্রতটে। ছড়িয়ে পড়েছিল আমেরিকার বিভিন্ন শহরে, সংসার পেতেছিল কালোদের সমাজের অংশ হয়ে। শুধু চিকনদারেরা নয়। শতাব্দীর শেষের দিকে বৃটিশ জাহাজ থেকে পালিয়ে নিউ ইয়র্কে নেবে যাচ্ছিল সিলেট, চট্টগ্রাম থেকে আসা মাঝি-মাল্লারাও। মধ্য আমেরিকার শিল্পাঞ্চলে কাজের অভাব ছিল না কোন।

    বড় অদ্ভুত এই সময়। একদিকে দ্রুত শিল্পের বিকাশ ঘটছে, দেশ বিদেশ থেকে মানুষ এসে জড়ো হচ্ছে আমেরিকায়। আবার পাশাপাশি কালোদের উপর নিপীড়ন বাড়ছে, এশিয়া থেকে আসা অভিবাসীদের জন্য কঠিন হয়ে উঠছে সব নিয়মকানুন। বাবনানের চিকনদার আলেফ আলি আর পাঁচকড়ি মণ্ডল, সিলেটের গোবিন্দ সারেং কি আক্রাম, বেদান্ত সোসাইটি গড়ে তুলতে আসা অভেদানন্দ - এমনি আরও অনেকের জীবন জড়িয়ে যাবে অনেক রঙের মানুষের দেশ আমেরিকার এক উথালপাথাল সময়ে, বুনবে নানা রঙের নকশিকাঁথা।



    ঘুমের মধ্যে গোবিন্দ নিজের ভিটেয় পৌঁছে গিয়েছিল। তার বইরালি গাঁ, বাচ্চা সাহের দরগা, সুরমা নদীর গহিন পানি হাতছানি দিয়েছিল। শালতি বাইছিল সুরমা নদীর বুকে। সুরমার পানি ভাঙার মিঠা শব্দে মিশে যাচ্ছিল বাতাসে ভেসে আসা আজানের ডাক। তাল গাছের সারির পিছনে আকাশ পানে উঁকি দেওয়া দরগার খিলান, যেন হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারবে জড়িয়ে থাকা আশমানি চাদরখানা। শ্বাস নিতে পারবে গাঁয়ের বাতাসে, মুঠোয় নেওয়া যাবে নিজের ভিটের মটি। সুখ ছড়িয়ে পড়েছিল গোবিন্দর শরীরে।

    এমন স্বপ্ন জাহাজের খোলে, পানির তিরিশ ফুট নিচে, ফার্নেসে আগুন-ঠেলা গোবিন সারেং দেখতে পেত না। সারাদিন কয়লা বয়ে বয়ে আর নিজেকে আগুনে সেঁকে বদনের সব নির্যাস ওখানেই ঢেলে দিয়ে আসত, তারপর একটা শুকনো দড়ির মত গুটিয়ে পড়ে থাকত জাহাজের খোলে। সেখানে স্বপ্নেরা আসে না।

    অথচ এক সময়ে সেই জাহাজের ভোঁ তাকে নিশির ডাকের মত ঘরছাড়া করেছিল। পেটের টানও ছিল। ইয়াসমিন চাচা যখন দুবছর বাদে বাদে গাঁয়ে ফিরত, তার মুখে শুনত নানান বন্দরের কিস্যা। জাহাজে ঘুরে ঘুরে তার ফুরফুরে দাড়িতে পাক ধরেছিল। স্টিমশিপের শুরুর দিন থেকে জাহাজের কাজে ভিড়েছিল চাচা। শুরুতে জুটেছিল কোল-পাসার হয়ে, একদিন হয়ে উঠল ফার্নেসের ফায়ার ম্যান। সেখানে কয়লা ঢেলে আগুনের আঁচ ধরে রাখার কথা বলতে বলতে গর্বে চাচার মুখে লাল আভা ছড়াত। চোখ চকচক করত দরিয়ার ঝড়ের সঙ্গে জাহাজের লড়াইয়ের কিস্যায়। আর বলত নানান দেশের মানুষের কথা। হরেক কিসিমের মানুষ সব এক একটা জাহাজে। কেউ নামাজ পড়ে, তামিল আর সিংহল দেশের মানুষের কপাল জুড়ে টিকা, আর কত আছে কেরেস্তান। ইঞ্জিনের কাজের সব লস্কর চাঁটগা, নোয়াখালি আর তাদের মত সিলেটি। দেশ ছেড়েও যেন নিজের গাঁ-গঞ্জের গন্ধমাখা। রান্নাঘরে যত গোয়ার লোক, ওদের কথা সব পর্তুগিজ ভাষায়। সেখানে আরও ছিল কাশ্মীর আর পাঞ্জাবের মানুষজন। বড় বড় কড়াইতে গোশত বানাত লম্বা চওড়া চেহারার পাঠান লস্করেরা। আরও উপরের ডেকে কিংবা স্যালনে কাজ করত ইয়েমেনি আর মালয় দেশের জনমানুষ। সকলের উপরে ছিল সাদা সাহেবেরা। ক্যাপ্টেন, ফার্স্ট মেট, সেকেন্ড মেট। পিরামিডের মধ্যে হাজার বছর বেঁচে থাকা রাজার কথা, ইংল্যান্ডের রানির প্রাসাদের রূপকথা শুনতে শুনতে গোবিন্দর দিল-দিমাগ শরীর ছেড়ে ছুটত। অ্যাডেন বন্দরের জলপাই-বরণ মেয়েদের কথা, কায়রোর স্ফটিক-রঙা নাচঘরের খোয়াবনামা - সেসবও শুনেছে চাচার জবানিতে।

    এরপর বইরালি গ্রাম, সুরমা নদীর মিঠা-পানি, বাপ-পিতাম’র ভিটের টান - কিছুই আটকে রাখতে পারেনি বিশ বছরের জোয়ান গোবিন্দ সারেংকে। কিভাবে যে আরও বিশটা বছর কেটে গেছে আর দরিয়ার নোনা বাতাসে জড়ানো শরীরটা বন্দরের ডাক শুনতে আনচান করে উঠেছে, নিজেও জানতে পারেনি গোবিন্দ।

    ক্যাটোরবাসী বিছানায় একটা হাল্কা সুবাস ছিল। কোন মন কাড়া আতরের গন্ধ, নারী শরীরের সুগন্ধি আবেশ। গোবিনের মনে পড়ছিল দামুর মায়ের কথা, রমনাবি। গত বিশ বছরে বিবির সঙ্গে মোলাকাত হয় দুই বছরে একবার। গোবিন বাড়ি ফিরলে তার তাম্বুল খাওয়া ঠোঁটের হাসি ছড়িয়ে পড়ে, পায়ে আলতার পোঁচ পড়ে, হাটে চুপড়ি ভরা নোলা আর খলিসা মাছ বেচে জালালের বিলে ধুন্দুলের খোসা দিয়ে ঘসে ঘসে সিনান করে চালা ঘরের বিছানায় গোবিনের কাছে ঘন হয়ে আসত। রমনাবির পাক দেওয়া পাটালি গুড়ের মত চামড়ায় নাক ডুবিয়ে আঁশটে গন্ধে সিনা জুড়াত গোবিনের। মৎস্যগন্ধা নারী তার লেজের ঝপটায় ভাতারকে পাকে পাকে জড়িয়ে নিত একদম। স্বপ্নে দামুর মায়ের জন্য ছটফট করে উঠল দশ ঘাটের পানি-ছ্যাঁচা, ব্রিটিশ জাহাজের পোড় খাওয়া লস্কর গোবিন্দ সারেং। দামুর মা, জীর্ণ বেড়ায় ঘেরা তার একচালা ঘর, ভিটের এক ছটাক জমিতে মাথা দোলানো নিমের শীতল বাতাস, স্বপ্নে তাকে ঘিরে ধরেছিল। ক্যাটোর বিছানায় যখন ঘুম ভাঙল গোবিন্দের, তখনও মনে জেগে রইল পায়ের তলায় শক্ত জমির কথা, পায়ের পাতায় ধুলা মাখার সুখানুভূতি। গোবিন্দ সাব্যস্ত করল যা হয়েছে সে বাচ্চা পীরের দোয়া। এই যে আক্রাম হঠাৎ করে চোখের সামনে কোন ভোজবাজিতে হাফিস হয়ে গেল সেটা আখেরে ভালই হল। তাকে জাহাজে ফিরতে দিল না। যে ইঞ্জিন রুমের জন্য বছরের পর বছর বাঙ্কার থেকে চাঁই চাঁই কয়লা বয়ে নিয়ে এসেছে, হাতুড়ি মেরে মেরে সেই কয়লা ভেঙেছে, কিংবা ফার্নেসের হ্যাচ খুলে আগুনে কয়লা ঠেলেছে, সে জাহাজি জীবন আর তাকে টানছিল না। সেই কোন জোয়ান বয়সে মাছ ধরার জাল গুটিয়ে রেখে জাহাজের খোলে প্রবেশ করেছিল গোবিন্দ। তার দেশ বিদেশ দেখার হাউশ মিটেছে। অনেক দেশের লোক দেখেছে সে-ও সত্যি, কিন্তু জীবনের এতগুলো বছর কেটে গেছে তিরিশ-হাত পানির নিচে, সে যেন এক অন্য পৃথিবী। যেখানে জীবনের সব চাওয়া পাওয়া জড়ো হয় হাতের ফুলে ওঠা পেশিতে। সেই সর্পিল পেশির মত জাহাজি জীবনের কাজের ধারা তাকে আগাপাশতলা পেঁচিয়ে রেখেছিল। সেখানে আর ফিরে যেতে চায় না গোবিন। পায়ের নিচে মাটি চায়। তার সুরমা নদী, তার বইরালি গাঁয়ের আধপেটা খাওয়ার জীবন নয়, হাডসনের তীরে বসবে নতুন গেরস্তি। রমনাবিকে নিয়ে আসবে এই দেশে। দামু, সুদি, ময়না সবাইকে নিয়ে আসবে এই সোনার দেশে। ভাবতেই দিল-দিমাগ ফুরফুর করে উঠল গোবিন্দের।

    জাহাজে সে আর ফিরবে না।

    তাহলে খাবেটা কী। কামাই হবে কোথা থেকে? সবচেয়ে বড় কথা হল, সে থাকতে চাইলেও এই দেশে তাকে থাকতে দেবে কেন? কানুন নেই? পুলিশে ধরবে না? কাগজ দেখতে চাইবে না কামকারবারের জন্য? ওই ডক্টর লোকটা ঘাঁতঘোত জানে, ওর দোকানে ফিরে যেতে হবে। কিন্তু এখুনি না। আগে এস. এস. সেন্ট লুই বন্দর ছাড়ুক। আগামী দশটা দিন তার এখানেই ঘাপটি মেরে থাকা। ভেবেই এবার খিদে পেল গোবিনের। বাইরে যাওয়ার কোন উপায় নেই। খাবে কী? ওই যে আফ্রিকা মেয়েটা, ওকে ডাকবেই বা কী করে? কাঠের ঘরের আনাচ কানাচ দিয়ে দিনের আলো ঢুকে যাচ্ছিল। তাই সকাল হয়ে যাওয়ার আন্দাজ ছিল গোবিন্দের। মরিয়া হয়ে সে ঘরের বাঁদিকের দেওয়ালে হাতের থাবা দিয়ে আওয়াজ তুলল বার কয়েক। রাতে যেটুকু বুঝেছে ওই পাশেই আফ্রিকার ঘর। সে যদি ঘরে থাকে নিশ্চয়ই শুনবে।

    ঠিকই। একটু বাদেই খট করে আওয়াজ তুলে দরজা খুলল। আফ্রিকা ঢুকেই আবার বন্ধ করে দিলে কপাট। Man, you slipin’ like a log.
    ঘরের আধো অন্ধকারে আফ্রিকার সাদা দাঁতের সারি ঝকমক করে উঠল।
    এখন অনেক সকাল?
    গড়িয়ে দুপুর।
    পেটে কেন এত টান পড়েছে মালুম হল এবার।
    আফ্রিকা গোবিনের মুখ দেখেই বুঝেছে। তোমার দেশের খাবার কিন্তু পাবে না।

    জাহাজের খালাসিগিরি করল এত বছর, কে তার জন্য মোটা চালের ভাত আর বাইল্যা মাছের ঝোল বানিয়ে দিত? জাহাজে যা পেয়েছে সোনামুখ করে খেয়ে নিয়েছে। অনেক সময় সারা দিন আগুনের তাতে সেঁকে স্বাদ গন্ধ মাথায় উঠেছে। যা পেয়েছে মুখে পুড়েছে আর নেতান দড়ির মত ঘুমে ঢলে পড়েছে।
    যা আছে দাও, পেটের মধ্যে ক্যানক্যান নাচ শুরু হয়েছে।
    এটা শুনে আফ্রিকা হেসে গড়াগড়ি। জানো, আমি এর আগে কোন হিন্দু দেকিনি। হিন্দু ফকিররা শুনেছি সব খাবার খায়নে।
    গোবিন অবশ্য জাহাজে অনেক নিগ্রো দেখেছে। তবে, নিগ্রো মেয়ের সঙ্গে এমন সাক্ষাৎ হয়নি। মেয়েটির গায়ের রং পায়রার বুকের মত ঘন ছাই, তাতে নীল আভা ঝলকাচ্ছে। পরিপূর্ণ ঠোঁট, হাসে বলে দাঁতগুলো ঝিকমিকিয়ে উঁকি মারতে দেখা যায় সবসময়ে।

    গোবিন্দ জানে একে বোঝানোর চেষ্টা বৃথা - যে হিন্দুস্তান থেকে এসেছে বলেই সে হিন্দু নয়। তার বদলে বলল, আমি তো জাহাজি, আমাদের খাবারে কোন বাছবিচের নেই।
    মেয়েটার দু’পাটি সাদা দাঁত আবার ঝকঝক করে উঠল। আমি আগে কোন জাহাজিও দেখিনি। দাঁড়াও তোমার জন্য খাবার আনচি।
    আফ্রিকা খাবার আনতে গেল। কাল রাতে ঘরে ঢুকে কিছু দেখার সুযোগ হয়নি। এখন চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখল। ছোট ঘর, একটা খাট আর টেবিলের সঙ্গে দুটো কাঠের চেয়ার। হলদে দেওয়ালে যিশুকে কোলে নিয়ে মা মেরির একটা ছবি কাত হয়ে ঝুলছে। ক্যাটো তেমন ভক্তিমনা প্রাণ ছিল না বোঝা গেল। ছবি ঝুলে গিয়ে যে জায়গাটা ছেড়ে দিয়েছে সেখানে দেওয়ালের রং অনেক বেশি ফটফটে, বোঝা গেল এই ঘরে রঙের পোঁচ পড়েনি অনেকদিন। তাতে গোবিনের কি যায়-আসে। তার নিজের একচালা বাড়িতে গোবরে নিকনো মেঝে। সে ঘরে শুধু একটা নড়বড়ে তক্তাপোশ। রমনাবির সঙ্গে ঝটাপটি করলে এই ভাঙে তো সেই ভাঙে। টেবিল চেয়ার তো শুধু ইঞ্জিনরুমের অফিসেই দেখেছে। আহা এই ঘরটায় যদি পাকাপোক্ত থেকে যেতে পারত! সে হবার নয়। টোনিয়া নেহাত দয়া করে দিন দশেকের জন্য থাকতে দিয়েছে।

    এই সময় মেঝেতে সেই নিগ্রো পালোয়ানের ফেলে যাওয়া পোশাক চোখে পড়ল গোবিনের। খাট থেকে নেবে তুলে দেখল পোশাকটা মন্দ নয়, শৌখিন পোশাকে বাবু পীরিতি করতে বেরিয়েছিলেন। যদিও আর একজনের পরা পোশাক, তবু তার পরনের জামা আর পাৎলুনের থেকে ঢের ভাল। তাছাড়া কাল মাথার চোট থেকে রক্ত ঝরে কেমন ঘিনঘিনে হয়ে গেছে জামাটা। ভাবল আফ্রিকা ফেরত আসার আগে একবার পোশাকটা বদলে নেওয়া যাক।

    টোনিয়া ঠিকই বলেছিল। এই নিগ্রোটি ছোটখাটো চেহারার মানুষ ছিল না মোটেই। জামার হাতাটা না হয় গুটিয়ে নেবে, কিন্তু প্যান্ট? শুধু যে লম্বায় আধ হাত বড় তাই নয়, এমন ঢলঢলে যে কোমরে জাপটে ধরে না রাখলে এক পা চললেই খুলে পড়ে যাবে।
    নিজের পোশাকে ফিরে যাবে ভাবছে, সেই সময় আফ্রিকা খাবার নিয়ে ফিরে এলো। গোবিনের দিকে তাকিয়ে তার বত্রিশ পাটি আবার বিকশিত হল। এই জামার মধ্যে তো দুটো গোবিন ঢুকে যাবে মনে লাগচে।
    গোবিন্দ খুব লজ্জা পেল। আমি নিজের জামা কাপড়টা আবার পরে নি’।
    না, না থাকুক। আমি বরং তোমার ছেড়ে দেওয়া জামা কাপড় নিয়ে ধুয়ে দিই, শুকোলে তখন আবার পরো না হয়। তবে দ্যাখো বাপু, আমি কিন্তু ঘসে ঘসে এই রক্তের দাগ তুলতে পারব না। মেয়েটার চোখের সাদাটা এতো পরিষ্কার - যেন তার সুরমা নদীর পানি। চেনা নেই শোনা নেই, তার জামা কাপড় চেয়ে নিয়ে কাচতে চলেছে। গোবিন্দর নিমির কথা মনে পড়ে গেল। বাপের বাড়ি এলে নিমিও যে এমনি টেনে নিয়ে বড় ভাইয়ের জামা কেচে দিত। এই মেয়ে বয়সে নিমির থেকে অনেক ছোট, তবু কেন জানি নিজের মনে গোবিন একে নিমির জায়গা দিয়ে ফেলল।
    তারপর আমি এই জামাটা একটু ফোঁড় তুলে দেবো, প্যান্টটাও – টেনে ধরে রাখতে হবে না। বলতে বলতে আবার এক চোট হাসি হাসল সারা শরীর দুলিয়ে।

    গোবিনের প্রাপ্তিযোগ ভালই চলেছে এখন। খাবারের গন্ধে শরীরের ভিতর থেকে কেমন একটা রাক্ষুসে লাফালাফি শুরু হয়ে গেছে। ঘরের ছোট টেবিলটায় খাবার আর জল রেখেছিল আফ্রিকা। মাংসের স্টু, পাউরুটির লোফ আর অনেকখানি করে সেদ্ধ আলু আর বাঁধাকপি পাতা। স্টু-টা থেকে গরম ধোঁয়া বেরোচ্ছে, মেয়েটা নিশ্চয় গরম করে এনেছে। ঠাণ্ডা হলেও তার যে সেরকম ফারাক পড়তো এমন তো নয়। ছুরি আর কাঁটাও সাজিয়ে দিয়েছে। কিন্তু গোবিন ওসবের ধার না ধরে পাউরুটি দুহাতে ছিঁড়ে স্টুতে ডুবিয়ে খেতে শুরু করে দিল। তার জাহাজের খাবারের থেকে শতগুণে ভাল। এত খিদে পেয়েছিল, যে মেয়েটা তার ছেড়ে রাখা বিছানাটা টানটুন করতে করতেই খাওয়া শেষ। এমন কী একটুকরো বাঁধাকপি পাতা অবধি পড়ে নেই।
    পিছন ফিরে সেটা দেখে আফ্রিকার মুখটা শুকিয়ে ছোট হয়ে গেল। তোমার আরও লাগত? সে তো লাগবেই - কাল রাতে খাওনি কিচু, সকালেও না। এখন কী করি বল তো? আমার কাছে দু’টো কলা আর বাতাবি নেবু আচে, খাবে?

    গোবিন্দ একটু লজ্জা পেলো এবার। তার খাওয়ার ধরন দেখে ঘাবড়ে গেছে হয়তো মেয়েটা। কিন্তু তার খাওয়া শেষ। আর কিছু খাবে না এখন। কিন্তু সে কিছু বলার আগেই দরজায় খুটখুট করে আওয়াজ। আফ্রিকা চমকে গেল। কেউ তো জানে না, ঘরে কেউ আছে। সে পা টিপে টিপে গিয়ে দরজায় কান পাতল। ওই পাশ থেকে ঘনঘন শ্বাস নেওয়ার শব্দ পেয়ে আবার মুখে হাসি ফুটল। টোনিয়া। সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠলে তার শ্বাসের টান পড়ে, এমন আর কারো নয়। খুট করে দরজা খুলতেই টোনিয়া ঢুকল হন্তদন্ত হয়ে।
    চোখ কুঁচকে তাকাল আফ্রিকার দিকে। তুমি ভিতরে কী করছ? পল্লীটাই এমন আর তার তাঁবে এতগুলো মেয়ে, টোনিয়ার মাথায় প্রথমে সন্দেহটাই আসে।
    অতিথকে খাবার দেবো না বুজি? গোবিন কি হাওয়া খেয়ে থাকবে?
    খাবার দেবে, কিন্তু ঘরে থাকবে না। বাইরে তালা না লাগান থাকলে লোকে কী ভাববে? আর সবাই জানে এই ঘরে কেউ থাকে না।
    কথাটা সত্যি। এটা আফ্রিকার মাথায় আসেনি।
    টোনিয়ার নজর গেল এবার গোবিনের দিকে। কী হে জাহাজি, তোমার মাথার ঘা-টা কেমন আচে?

    সত্যি বলতে কী, এত সবের মধ্যে গোবিন্দ সেটা নিয়ে ভাবেনি মোটেই। ব্যথা আছে। আর মাথায় কালকের টোনিয়ার লাগানো রূমালের ফেট্টিটাই ঝুলছে এখনো।
    ওটার যদি যতন না নাও, তাহলে পেকে পুঁজ রক্ত হবে, তকন আবার ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। তোমার লুকিয়ে থাকার ওখেনেই শেষ। বলতে বলতে সে তার হাতের বাদামি কাগজের মোড়ক খুলে একটা টিঞ্চার আইডিনের শিশি বের করলো, সঙ্গে তুলো আর একখানা গজের কাপড়।
    দ্যাখো গোবিন, আমি কোন ডাক্তার নার্স নই কো। ব্যান্ডেজ বাঁধতে গিয়ে ব্যাতা দিলে আবার রাগ করো নি বাপু। বরং একটু ব্যথা লাগলেই আমাকে বলে দিও, আমি যতটা পারি সাবধানে কাপড়টা পাল্টানোর চেষ্টা করচি। এই মেয়ে, আমার সঙ্গে একটু হাতে হাতে করো তো দেখি।
    দাঁড়াও টোনিয়া। আমি একটু গরম জল নিয়ে আসি।
    তারপর শুরু হলে ওদের শুশ্রূষার কাজ। টোনিয়া আর আফ্রিকা দুজনে মিলে গোবিনের মাথায় ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ বাঁধতে লাগল।

    গোবিন্দ বিশ বছর জাহাজে ঘুরছে। চুল্লির আগুনে তার শরীরে রস শুকিয়েছে শুধু তাই নয়, মনটা বেশ শক্ত পোক্ত। সেই চল্লিশের বুড়ো গোবিন ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।
    ব্যান্ডেজ বাঁধা বন্ধ করে থমকে গেল টোনিয়া। মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, খুব ব্যথা দিলাম নাকি। কী হল গোবিন?

    গোবিন্দ যা বলতে চায় সে কথা তার টাকরাতেই খলসে মাছের মত লাফালাফি করে আটকে রইল। দুই নিগ্রো মেয়ে টোনিয়া আর আফ্রিকা কী করবে বুঝতে না পেরে থমকে দাঁড়িয়ে। ওদিকে গোবিন্দ হাপুস নয়নে কেঁদেই চলেছে।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ১০০১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • প্রতিভা | 182.66.13.191 | ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১১:৩৪497570
  • চমৎকার লাগছে উপন্যাসের গতি। গুরুচণ্ডালীর এক গুরুত্বপূর্ণ কাজ হতে চলেছে এটি। 
  • Mahua Sen Mukhopadhyay | 72.74.50.168 | ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১১:৫৩497668
  • পরের সংখ্যার  অপেক্ষায়।
    চমতকার বুনন এবং বর্ণনা। ইতিহাসের এমন একটা সময় আর সাধারণ মানুষদের নিয়ে যাদের  বিষয়ে আগে লেখা হয়েছে কিনা জানা নেই।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে মতামত দিন